২০১০ সালে অক্টোবরের শেষে বুকার পুরষ্কার জয়ী লেখিকা অরুন্ধতী রায়, যাঁর নন-ফিকশন লেখালেখি রাষ্ট্রের ঘুম কেড়ে নিয়েছে, কাশ্মীরে গিয়েছিলেন। শরৎকালের কাশ্মীর, বাগিচা থেকে আপেল কুড়ানো শুরু হয়েছে, হালকা বরফ পড়ছে, দিনরাত আরও কনকনে, চিনারের রঙ সবুজ থেকে গাঢ় লাল হয়ে হলুদ হতে শুরু করেছে। শ্রীনগর থেকে শোপিয়ানের রাস্তায় সর্বত্র সেনা, আধা-সেনা। শোপিয়ানে লেখিকা শাকিল আহমেদ আহঙ্গারের সাথে দেখা করতে যাচ্ছেন প্রায় এক বছর আগে যাঁর বাইশ বছরের স্ত্রী নিলোফার এবং সতেরো বছরের বোন আসিয়ার মৃত এবং বিকৃত দেহ একটি জলাধারের নিকটে পাওয়া গেছে। শাকিলের কাহিনী শুনে ফিরে আসার পথে এক সাংবাদিকের ফোন আসে এবং জানা যায় যে, দিল্লিতে একটি সভায় তাঁর বক্তব্যের কারণে সেই রাত্রেই লেখিকাকে গ্রেপ্তার করা হবে, ওয়ারেন্ট তৈরি হচ্ছে।
অন্ধকার হয়ে গেছে, হাইওয়েতে গাড়ির গতি আরও দ্রুত হয়, লেখিকা শ্রীনগর ফিরে যাচ্ছেন। পেছন থেকে হুড়মুড় করে একপাল লোক নিয়ে একটি গাড়ি তাদের রাস্তা রোধ করে দাঁড়িয়ে পড়ে। বিপদের আঁচ করে অরুন্ধতী নিজেকে শক্ত করেন। এক প্রৌঢ় জানলা দিয়ে মুখ বাড়ান, তিনি আব্দুল হাই, নিলোফারের পিতা। কিছু যুবক গাড়িতে কয়েক ক্রেট আপেল ভরে দেন। আব্দুল তাঁর বাদামি ফিরানের গভীর পকেট থেকে একটি ডিম বার করে অরুন্ধতীর হাতের তালুতে দিয়ে আঙ্গুলগুলো সেটার ওপর ভাঁজ করে দেন। অন্য হাতের তালুতেও তিনি আরেকটি ডিম ভরে দেন, ‘ঈশ্বর তোমায় রক্ষা করুন,’ তিনি বলেন। দুটো ডিমই গরম, উষ্ণতার ছোঁয়া। সেই রাতে গ্রেপ্তারির কোন খবর নেই। দিল্লি ফেরার পর লেখিকার বাড়ির সামনে বিজেপির মহিলা শাখা বিক্ষোভ দেখায়, বজরঙ দল তাঁকে উচিত শিক্ষা দেওয়ার হুমকি দেয়, সমস্ত টিভি চ্যানেল, যা পরবর্তি সময়ে চাটুকারবৃত্তির চরম নিদর্শন ‘গোদি’তে রূপান্তরিত হয়, ঘটনাবলি লাইভ সম্প্রচারণ করে।
২১শে অক্টোবর, ২০১০ দিল্লির এলটিজি অডিটোরিয়ামে ‘আজাদি দ্য ওনলি ওয়ে’ নামক আলোচনাসভায় অরুন্ধতী প্রধান বক্তা ছিলেন। সেখানে আরও যাঁরা উপস্থিত ছিলেন তাঁরা হলেন হুরিয়াত নেতা সৈয়দ আলি শাহ গিলানি, এসএআর গিলানি, প্রখ্যাত কবি ও সমাজকর্মী ভারভারা রাও এবং সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি অফ কাশ্মীরের প্রাক্তন অধ্যাপক, শেখ সওকাত হুসেন। প্রথম দুজন ইতিমধ্যে প্রয়াত, ভারভারা রাও অসুস্থ, ভীমা কোরেগাঁও মামলায় জামিনে মুক্ত। সুশিল পন্ডিত নামে এক তথাকথিত সমাজসেবী ওই সভায় ‘প্ররোচনামূলক’ বক্তব্য রাখা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন এবং একটি এফআইআর দায়ের করেন। দীর্ঘ তেরো বছর বাদে দিল্লি পুলিশ ধারা ১৫৩এ, ১৫৩বি, ৫০৪, ৫০৫ এবং ইউএপিএ ধারা ১৩ অনুযায়ী লেখিকা এবং অধ্যাপক হুসেন কে অভিযুক্ত করেন। তখন দিল্লির লেফট্যানেন্ট গভর্নর ভি কে সাক্সেনা শুধুমাত্র আইপিসির অধীনে ধারাগুলি মোতাবেক বিচার শুরু করার অনুমতি দেন। ২০২৪এ বিজেপি/এনডিএ সরকারের তৃতীয় অবতার ভূমিষ্ঠ হবার পর নতুন উদ্যমে গভর্নর, অভিযোগ যিনি বিভিন্ন সময়ে শাসকের ‘হ্যাচেট ম্যান’ হয়ে কাজ করেছেন, ইউএপিএ ধারায় তাঁদেরকে বিচার করার অনুমতি প্রদান করেন। অনেকের মতে এটা একটা আইনি বাধ্যবাধকতা। ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৬৮ ধারা অনুযায়ী যেহেতু তিন বছরের অধিক কোন অপরাধের বিচারের ওপর নিষেধ রয়েছে তাই ইউএপিএ ধারায় লেখিকাকে ফের কাঠগড়ায় টানার প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে।
অরুন্ধতী এবং অধ্যাপক হুসেনের বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ তাঁরা ‘প্ররোচনামূলক’ বক্তব্য রেখেছেন। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে তথাকথিত এই প্ররোচনার কারণে কাশ্মীরে নতুন গণ্ডগোল সৃষ্টি হয়েছে, বা সন্ত্রাসবাদ আরও ব্যাপক হয়েছে, বা জঙ্গি আন্দোলন তীব্রতর হয়েছে এরকম কোন প্রমাণ নেই। তাহলে আজকে চোদ্দ বছর বাদে নতুন করে এঁদের ওপর সরকার কেন খড়্গহস্ত? এবারের সরকারে বিজেপির সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই, মনে করা হচ্ছে শরিকদের ওপর নির্ভর হবার কারণে মোদী ৩.০ দুর্বল, দ্বিধাগ্রস্ত। সরকার শুরুতেই এই ধারণাকে উচ্ছেদ করতে বদ্ধপরিকর। সেই জন্যই তারা শরিকদের একটিও গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রক দেয়নি, যারা মন্ত্রিত্ব বন্টনে অখুশি হয়েছে, যেমন এনসিপির অজিত পাওয়ার গোষ্ঠী, তাদের কোন গুরুত্বই দেয়নি। একই রকম ভাবে তারা দমনপীড়ন চালিয়ে যেতে, যে কোন বিরোধী স্বরের কণ্ঠরোধ করতে বদ্ধপরিকর। ছত্তিসগড়ে ইতিমধ্যেই দুজন মুসলিম ব্যবসায়ীকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। জুন মাসের সাত ও পনেরো তারিখ অন্তত পনেরো জন আদিবাসীকে মাওবাদী অভিহিত করে ‘সংঘর্ষে’ হত্যা করা হয়েছে। এরপর চোদ্দ বছরের পুরানো ঘটনা খুঁচিয়ে তোলা হল; অর্থাৎ সরকার একই রকম ভাবে কঠোর, লক্ষ্যে অবিচল।
বিরোধীদের দমন করার একটা বিশেষ কৌশল এই সরকার রপ্ত করেছে। তারা তাঁদের ভাষণের এক নির্দিষ্ট অংশ, পরিপ্রেক্ষিত ব্যতিরকে, তুলে ধরে তাঁকে রাষ্ট্রবিরোধী, দেশদ্রোহী ইত্যাদি তকমায় ভূষিত করে। তরুণ ছাত্রনেতা, গবেষক উমর খালিদকে ঠিক এভাবেই ফাঁসান হয়েছে। বিজেপি আইটি সেল রটিয়ে দেয় ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন ভারতে এসেছিলেন তখন উমর না কি মানুষকে দলে দলে রাস্তায় নেমে আসতে বলেছিলেন, ট্রাম্পকে জানাতে বলেছিলেন ভারত সরকার দেশকে বিভাজিত করতে চাইছে, মহাত্মা গান্ধীর মূল্যবোধ ধ্বংস করতে চাইছে। টিভি চ্যানেলগুলিতেও এটাই প্রচার হয়। উমরের বক্তব্যের যে অংশটি সুচতুর ভাবে ছেঁটে দেওয়া হয় তা হলঃ আমরা হিংসার বিরোধিতা হিংসা দিয়ে করবো না, ঘৃণার বিরোধিতা ঘৃণা দিয়েও নয়। …… তারা লাঠি চালালে আমরা তেরঙ্গা তুলে ধরব, গুলি চালালে সংবিধান আঁকড়ে ধরব। আমাদের জেলে পাঠালে ‘সারে জাঁহা সে আচ্ছা’ গাইতে গাইতে চলে যাব।
অরুন্ধতীর ক্ষেত্রেও একই পদ্ধতি অনুসরণ করা হচ্ছে। ২১শে অক্টোবরের ওই বক্তব্যে লেখিকা বলছেন ২০০৭ সালে শ্রীনগরের রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় আমি শুনলাম, ‘নাঙ্গা ভুখা হিন্দুস্তান, জান সে পেয়ারা পাকিস্তান’; আমার মন ভেঙে গেল, কারণ আপনারই তো নাঙ্গা ভুখা হিন্দুস্তান, যদি আমরা একটা ন্যায্য সমাজের জন্য সংগ্রাম করি, তাহলে এই ক্ষমতাহীনরাই তো আমাদের সাথী। শুধু নিজের জন্য ন্যায় চাইলেই হবে না, পাশের মানুষটার জন্যও একই দাবী তুলতে হবে। এই যুক্তিতেই তিনি কাশ্মীরী পন্ডিতদের ওপর অত্যাচারের বিরোধিতা করেন, আওয়াজ তোলেন যে তাঁদের কাশ্মীরে ফিরে আসার সম্পূর্ণ অধিকার আছে।
ইউএপিএ যে অতি মারাত্মক আইন, এটা নিয়ে বহু লেখালিখি হয়েছে, তথ্যের ভান্ডার গড়ে উঠেছে। এই আইনের অতি ক্ষতিকারক যে বিষয়টি অনেকের দৃষ্টি এড়িয়ে যায় তা হল এই আইনে জামিন পেলেও নিস্তার নেই। কারাগার থেকে মুক্তি পেলেও ইউএপিএর খাড়া মাথায় নিয়ে অতি সক্রিয় সমাজকর্মীরাও সামাজিক, রাজনৈতিক ভাবে নিষ্ক্রিয় হয়ে যেতে বাধ্য হন। তাঁদের জামিনের শর্ত এতো কঠোর যে পুনরায় মানুষের জন্য কাজ করা অসম্ভব হয়ে যায়। ধরুন তাঁদের একটি বিশেষ এলাকার বাইরে যাওয়ার অনুমতি নেই, তাঁদের নিয়মিত স্থানীয় থানায় হাজিরা দিতে হয়, তাঁদের মোবাইল সেই থানার অফিসারের ফোনের সাথে লিঙ্ক করা থাকে, তাঁদের নিজেদের পেশায় সক্রিয় হওয়াও তাঁদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে। এই কারণে যাঁরাই সম্প্রতি ইউএপিএ মামলায় জামিন পেয়ে কারাগারের বাইরে এসেছেন, তাঁরা মূলত নীরব জীবনযাপন করছেন। সরকার অরুন্ধতীকেও এই আতঙ্কের নাগপাশে বেঁধে ফেলতে চায়। সমস্ত রাজনৈতিক দলের ইউএপিএতে জামিনের পরবর্তি শর্তাবলী শিথিল করার দাবী তোলা আবশ্যক।
কিন্তু অরুন্ধতী নাছোড়বান্দা, কোন আইন তাঁকে দমিয়ে রাখতে পারবে কি না সন্দেহ। ২০১০এর ওই এফআইআরের পর তিনি কাশ্মীর নিয়ে আরও অনেক লিখেছেন। তিনি আজাদির প্রশ্নে একই রকম ভাবে সরব; ভারতের থেকে আজাদি নয়, ভারতের মধ্যে আজাদি; ক্ষুধা থেকে আজাদি, বৈষম্য থেকে আজাদি, ধর্মীয় এবং জাতপাতের নিপীড়ন থেকে আজাদি। আজাদি তাঁর কাছে, যেমন আরও বহু বহু মানুষের কাছে, শুধুমাত্র একটা দাবী নয়, আজাদি একটা সংগীত, একটা স্তব, একটা প্রার্থনা।