এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  রাজনীতি

  • গ্রাহাম স্টেইন্সের হত্যা ও হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি

    সোমনাথ গুহ
    আলোচনা | রাজনীতি | ৩০ এপ্রিল ২০২৫ | ১৫৬ বার পঠিত | রেটিং ৫ (৩ জন)
  • ছবি: রমিত


    এটা উপলব্ধি করা দরকার যে ১৯৯৯ সালের ২৩ জানুয়ারি, ওড়িশার কেওনঝড় জেলার মনোহরপুর নামক এক প্রত্যন্ত গ্রামে খ্রিস্টান মিশনারি গ্রাহাম স্টেইন্স এবং তাঁর দুই পুত্রকে যে পৈশাচিক ভাবে হত্যা করা হয়েছিল তা নিছক কোনও ব্যতিক্রমি, আকস্মিক উত্তেজনার বশে হয়ে যাওয়া ঘটনা নয়। গত ১৭ এপ্রিল ওই ঘটনার অন্যতম অপরাধি মহেন্দ্র হেমব্রমের কারাবাস থেকে মুক্তি হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির নির্লজ্জতা ও সংখ্যালঘুদের প্রতি ঘৃণা ও বিদ্বেষের ওপর পুনরায় আলোকপাত করেছে। ছাব্বিশ বছর আগে ঠিক কী ঘটেছিল সেটা একবার দেখে নেওয়া যেতে পারে। মনোহরপুর গ্রামের ৮০০ জনসংখ্যার মধ্যে ১৮টি পরিবারের প্রায় ১০০ জন খ্রিস্টান। প্রতি বছর ২০ থেকে ২৪ জানুয়ারি খ্রিস্টানরা গ্রামে জঙ্গলি মেলা পালন করে। স্টেইন্স পাশ্ববর্তী ময়ুরভঞ্জ জেলার বারিপাদায় কুষ্ঠরোগীদের মধ্যে কাজ করতেন। প্রতি বছর ছেলেদের নিয়ে তিনি ওই মেলায় আসতেন। অনুষ্ঠানের শেষে তিনি দুই ছেলেকে নিয়ে ভ্যানে ঘুমিয়ে পড়েন। মধ্যরাতের পরে গাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। সশস্ত্র জনতা গাড়িটাকে ঘিরে থাকে এবং শ্লোগান দেয়। গাড়ির চালক গ্রাম প্রধানের কাছে সাহায্য চাইতে গিয়েছিলেন কিন্তু তিনি নিজের অসহায়তা প্রকাশ করেন। জেলা প্রশাসক জানান হত্যাকান্ডের উদ্দেশ্য ও স্টেইন্সের জীবনের ওপর কোনও হুমকি সম্পর্কে তাঁর কোনকিছু জানা নেই। শোনা যায় যে ৩৭ জন আদিবাসীকে ধর্মান্তকরণ করা হয়েছে, কিন্তু এর কোনও প্রমাণ নেই; যাঁদের নাম উল্লেখ করা হয় তাঁরাও এটা অস্বীকার করেন। এও জানা যায় যে এলাকায় খ্রিস্টান ও অখ্রিস্টানদের মধ্যে সম্পর্ক মোটামুটি সৌহার্দপূর্ণ ছিল। কয়েকজন ব্যক্তি জানান যদিও এফআইআর হয়েছে, কিন্তু প্রধান অভিযুক্ত দারা সিং (রবীন্দ্র কুমার পাল) ও তাঁর সহযোগীদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। (প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ীর নির্দেশে ওড়িশা সফরের পর তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী জর্জ ফার্নান্ডেজের বিবৃতি—২৮ জানুয়ারি, ১৯৯৯)।
    উক্ত ঘটনায় মহেন্দ্র হেমব্রমকে গ্রেপ্তার করা হয় ডিসেম্বর ৯, ১৯৯৯। মূল অপরাধি দারা সিং কয়েক সপ্তাহ বাদে জানুয়ারি ৩১, ২০০০ গ্রেপ্তার হন। সম্প্রতি হেমব্রমের কারাবাসের মেয়াদ ২৫ বছর পূর্ণ হয়। তাঁর জীবনযাপন ও ব্যবহারে উন্নতি হওয়ার ফলে কারা কর্তৃপক্ষ তাঁকে মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। জানা যাচ্ছে দারা সিংও শীঘ্রই মুক্তি পাবেন, বর্তমানে তাঁর আবেদন ওড়িশা সরকারের বিচারাধীন। আইনত গুরুতর অপরাধের ক্ষেত্রে যাবজ্জীবন কারাদন্ডের মেয়াদ ২০-২৫ বছর। সুতরাং আইন অনুযায়ী হেমব্রমের মুক্তি ও দারা সিংয়ের আসন্ন মুক্তি নিয়ে বিতর্কের কোনও অবকাশ নেই। যেটা অস্বস্তিকর এবং চূড়ান্ত ভাবে আপত্তিকর সেটা হল মুক্তি পাবার পর বিশ্ব হিন্দু পরিষদের স্থানীয় কর্মকর্তারা তাঁকে সংবর্ধনা দেন এবং রাজ্য সরকারকে ধন্যবাদ জানান। এই পুরো ঘটনা হিন্দুত্ববাদী শাসনের দুটি মারাত্মক প্রবণতাকে সামনে নিয়ে এসেছে। প্রথমত সঙ্ঘ পরিবার খুনি, ধর্ষকদের মুক্তির পর তাঁদের সংবর্ধনা দিয়ে এবং সমাজে তাঁদের সসম্মানে পুনর্বাসিত করে পরিষ্কার কিছু ইঙ্গিত দিচ্ছে। এটা করে তারা অপরাধের যাঁরা শিকার হয়েছিলেন তাঁদের প্রতি চূড়ান্ত অসংবেদনশীলতা প্রকাশ করছে, তাঁদের পুনরায় অপমান করছে, নির্যাতন করছে; ওই সব খুন, ধর্ষণ, গণহত্যার মতো সাংঘাতিক অপরাধকে লঘু করে দিচ্ছে, এবং খোলাখুলি ঘোষণা করছে যে সংঘিদের ঘনিষ্ঠ হলে সে যত বড় অপরাধিই হোক না কেন তার সমাজের মূল স্রোতে ফিরে আসার সুযোগ থাকবে। দ্বিতীয়ত হিন্দু রাষ্ট্র গঠনের প্রক্রিয়ায় আজ শুধু মুসলিমরা নন, খ্রিস্টানদের জীবন, রুটিরুজি ও ধর্মপালনের অধিকার একই রকম ভাবে বিপন্ন। গত দুই দশক ধরে খ্রিস্টানদের ওপর আক্রমণ ক্রমবর্ধমান। এই লেখায় এই দুটি প্রবণতার ওপর আমরা আলোকপাত করার চেষ্টা করব।

    আমরা জানি, মহেন্দ্র হেমব্রমকে ভালো আচরণের জন্য ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ঘটনা হচ্ছে এত দিন শাস্তির পরেও, তিনি অনুনতপ্ত। যদিও গ্রাহামের স্ত্রী গ্ল্যাডিস বহু বছর আগে খুনিদের ক্ষমা করে দিয়েছেন, হেমব্রম ওই হত্যাকাণ্ডের জন্য কোনও দুঃখপ্রকাশ করেননি। উলটে তিনি অনুযোগ করেছেন যে বিনা দোষে তাঁকে এতগুলো বছর কারাবাস করতে হয়েছে। আইনের চোখে এটাকে কি ভালো আচরণ বলা যায়? একটু তলিয়ে দেখলে বোঝা যায় ছাব্বিশ বছর আগের ওই হত্যাকাণ্ডের পিছনে অন্যান্য কারণ পরোক্ষ ভাবে কাজ করেছিল। ঘটনার কয়েক সপ্তাহ আগে গুজরাটের ডাং নামক জায়গায় সঙ্ঘীরা বাঁশ ও শালপাতার তৈরি প্রায় তিরিশটি গির্জা পুড়িয়ে দেয়। প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ী ঘটনাটিকে লঘু করে দেন যখন তিনি বলেন এটা সমাজের প্রান্তিক এক শতাংশের মানুষের কাজ (fringe elements) এবং ধর্মান্তকরণের ওপর তিনি জাতীয় বিতর্ক আহ্বান করেন। ওই নৃশংস ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান যে আক্রমণকারীরা বজরং দল ও ভিএইচপির (বিশ্ব হিন্দু পরিষদ) নামে শ্লোগান দেয়, স্টেইন্সের পরিবার গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করলে তাঁদের বলপূর্বক বাধা দেয়। ওড়িশার বজরং দলের তৎকালীন প্রধান পরবর্তী সময়ে লোকসভায় বিজেপির সাংসদ হন। আরও গুরুত্বপূর্ণ খোদ মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট তাঁদের রায়ে বলেন যে, একটি ধর্ম আরেকটির থেকে ভালো এই ভুল ধারণাটা প্রমাণ করার জন্য শক্তি প্রয়োগ করা, প্ররোচনা দেওয়া, ধর্মান্তকরণ করা ঠিক নয়, এবং ধর্মপ্রচারককে ‘একটি শিক্ষা দেওয়ার’ জন্য এই হত্যা করা হয়েছিল। সমাজের বিশিষ্টজন ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের তীব্র প্রতিবাদের কারণে এই কথাগুলি শীর্ষ আদালত প্রত্যাহার করে নিলেও, সমাজের উচ্চ পর্যায়ে খ্রিস্টানদের সম্পর্কে বিরূপ মনোভাব পরিষ্কার হয়ে যায়।

    অপরাধীকে মহিমান্বিত করার এই প্রবণতা স্বাধীন ভারতের অন্যতম জঘন্য অপরাধ, গান্ধী-হত্যা দিয়েই শুরু হয়েছিল। এটা সর্বজনবিদিত যে তাঁর হত্যার পর সঙ্ঘীরা বাজি ফাটিয়ে উল্লাস করেছিল, মিষ্টি বিতরণ করেছিল। স্বাধীনতার পর কয়েক দশক চুপচাপ থাকার পর নব্বইয়ের দশকের পর থেকে তাঁকে বরেণ্য করে তোলার প্রক্রিয়া চলছে। এই বিষয়ে বিখ্যাত ঐতিহাসিক এবং গান্ধীর জীবনীকার রামচন্দ্র গুহর পর্যবেক্ষণ স্মরণীয়। নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে গান্ধীবাদী ডঃ সুশীলা নায়ার অযোধ্যায় একটি আন্তঃধর্মীয় প্রার্থনা সভায় যোগদান করতে যান। সভায় তাঁরা ‘রঘুপতি রাঘব রাজা রাম’ গাইছিলেন। যখন ‘ঈশ্বর আল্লা তেরে নাম’ লাইনটা গাওয়া শুরু করেন তখন একদল বিক্ষোভকারী তাঁদের গান থামিয়ে দেন। প্রবীণ ডঃ নায়ার বলেন আমরা তো গান্ধীজীর তরফ থেকেই এখানে এসেছি, বিক্ষোভকারীরা পাল্টা বলেন, আমরা গডসের তরফ থেকে এসেছি এবং তাঁরা গানটি গাওয়া বন্ধ করে দেন। গত কয়েক বছর ধরে প্রজ্ঞা ঠাকুর, সাক্ষী মহারাজের মতো বিজেপি সাংসদরা গডসেকে দেশভক্ত বলে অভিহিত করার পরেও দল তাঁদের বিরুদ্ধে কোনও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়নি। উল্টে তারপরেও তাঁরা পার্টির হয়ে নির্বাচনে দাঁড়িয়েছেন এবং বিপুল ভোটে জিতেছেন। কয়েক বছর আগে গুহ লিখেছিলেন, সুপরিচিত গুজরাটি লেখক বিষ্ণু পান্ড্য, যিনি পদ্মশ্রী প্রাপক এবং তৎকালীন রাজ্য সাহিত্য একাডেমির সভাপতি, তিনি টিভি বিতর্কে প্রজ্ঞা ঠাকুরকে ‘সন্ত’ বলে অভিহিত করেন এবং গডসে, গান্ধী উভয়কেই দেশপ্রেমিক বলেন। গুহ বলেন গডসে বন্দনা এখন আর প্রান্তিক নয়, বরং মূলধারার।

    সঙ্ঘ পরিবার সেই ঐতিহ্যকেই বহন করে চলেছে। মাত্র আড়াই বছর আগে আমরা দেখেছি কী ভাবে সারা দেশকে স্তম্ভিত করে বিলকিস বানো ধর্ষণকারীদের বীরের মতো অভর্থ্যনা জানান হয়েছে। তাদেরকে ব্রাহ্মণ এবং শুদ্ধ বিচারধারার মানুষ বলে অভিহিত করা হয়েছে। কয়েক মাস আগে আমরা দেখেছি কী ভাবে গৌরী লঙ্কেশের হত্যায় অভিযুক্তদের জামিনে মুক্তি দেওয়ার পর শিবাজির মুর্তির সামনে নিয়ে গিয়ে মালা পরিয়ে সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছে। বিচার বিলম্বিত হওয়ায় সতেরোজন অভিযুক্তকে জামিনে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। অথচ আমরা দেখছি উমর খালিদ, গুলফিশা, ভীমা কোরেগাঁও মামালায় মহেশ রাউত, সুরেন্দ্র গ্যাডলিং, জ্যোতি জগতাপ এবং অন্যান্যদের বিচার শুরু না হওয়া সত্ত্বেও বছরের বছর বন্দি করে রাখা হয়েছে। এর আগে পরশুরাম ওয়াঘমারে, যিনি গৌরীকে গুলি করার কথা স্বীকার করেছিলেন (যদিও পরে তিনি সেটা অস্বীকার করেন), গ্রেপ্তারের পর, তাঁর পরিবারকে সাহায্য করার জন্য চাঁদা তোলা হয়েছিল।

    বাবরি মসজিদ ধ্বংস করা যদি মুসলিম সাম্প্রদায়িকতার একটা মাইলফলক হয় তবে খ্রিস্টান-বিরোধি সাম্প্রদায়িকতার একটা গুরুত্বপূর্ণ সূচনা পর্ব হল গ্রাহাম স্টেইন্সের হত্যাকান্ড। লক্ষ্যণীয় যে এরপর থেকে খ্রিস্ট সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমণ ক্রমবর্ধমান। হিন্দুত্ববাদী দর্শন অনুযায়ী ভারতবর্ষ মুসলিমদের মতো খ্রিস্টানদেরও ‘পবিত্র ভূমি’ নয়, কারণ এই দুই ধর্মাবলম্বী মানুষদের কাছে এই দেশ তাঁদের ‘পুণ্যভূমি’ এবং ‘পিতৃভূমি’ কোনটাই নয়। দুটি ধর্মের সাথেই এই দর্শনের সম্পর্ক বৈরিমূলক। দ্বিতীয়ত সঙ্ঘ পরিবার শুরু থেকেই খ্রিস্টান মিশনারিদের কাজকর্মের প্রবল বিরোধী। তাঁরা মনে করেন এই ধর্মপ্রচারকরা সর্বত্র এবং, বিশেষ করে আদিবাসী অঞ্চলে, প্রধানত ধর্মান্তকরণের কাজ করেন। এটা বলা দরকার যে কয়েক শতক আগে পশ্চিমি উপনিবেশকারীরা যবে থেকে এই দেশে আসে তবে থেকে ধর্মান্তকরণের সূত্রপাত। পর্তুগিজ, ওলন্দাজ, ইংরেজ, ফরাসি সমস্ত বহিরাগতদের এক হাতে ছিল বন্দুক, অন্য হাতে বাইবেল। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের দরিদ্র, বুভুক্ষু, বহু শতকের বর্ণাশ্রম প্রথায় নিপীড়িত মানুষ, মুক্তি পাবার আকাঙ্ক্ষায় খ্রিস্ট ধর্মপ্রচারকদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন। তাই ধর্মান্তকরণের জন্য শুধু বিদেশি প্রচারকদের দায়ী করে লাভ নেই, এটা ঘটনা যে সমাজের দারিদ্র, অসাম্য, মনুবাদী , বর্ণাশ্রম প্রথা মানুষকে বাধ্য করেছে অন্য ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হতে।
    ১৯৭৭ এর জনতা সরকারের এক শরিক ছিল আজকের বিজেপি দলের পূর্বসুরি জনসঙ্ঘ। তাঁরা তিনটি আইন প্রণয়নের ওপর জোর দিয়েছিলেন, যার মধ্যে একটি ছিল ধর্মান্তকরণ বিরোধী আইন। ১৯৯৮ সালে অটল বিহারী বাজপেয়ী জোট সরকারের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরে সংখ্যালঘু-বিরোধিতা নতুন মাত্রা পায়। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী পশ্চিমি দেশের রাষ্ট্রদূতদের খ্রিস্টানদের জীবন ও জীবিকা সম্পর্কে বারবার আশ্বস্ত করা সত্ত্বেও ‘হিউম্যান রাইটস ওয়াচ’ ওই সময় গুজরাট এবং ওড়িশায় খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের ওপর হামলায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন। পরবর্তি সময়ে এই ধরনের হামলা উত্তর ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ে। ২০০৮ সালে ওড়িশার কন্ধমলে খ্রিস্টধর্মীদের ওপর নৃশংস আক্রমণ বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করে। ঘটনার সূত্রপাত হয় ২৩শে আগস্ট যখন লক্ষমানানন্দ সরস্বতী নামে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের এক প্রচারক এবং তাঁর চার সহযোগী আততায়ীদের হাতে খুন হন। অভিযোগ ওই সাধু উস্কানিমূলক বক্তব্যের জন্য কুখ্যাত ছিলেন। সঙ্ঘীরা এই আক্রমণের জন্য এলাকার খ্রিস্টধর্মীদের দায়ী করে, যদিও খ্রিস্টানরা সব সময় এটা অস্বীকার করেছেন। এরপর ভয়ঙ্কর প্রতিহিংসা শুরু হয়। কয়েকদিন ধরে হিংসাত্মক ঘটনায় ৬০০ গ্রাম লুটপাট হয়, ২৩২টি গির্জা ধ্বংস করা হয়, ৫৬০০ বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়, ৫৪০০০ মানুষ ঘরছাড়া হন। মৃতের সংখ্যা ৩৯, যদিও বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের মতে প্রকৃত সংখ্যা (একশোর অধিক) আরও অনেক বেশি। স্থানীয় বিজেপি বিধায়ক গ্রেপ্তার হলেও, কয়েক দিন বাদেই মুক্তি পেয়ে যান। ২০১৬ সালে সুপ্রিম কোর্ট ওই ঘটনার সাথে সম্পর্কিত ৩১৫টি কেস পুনরায় তদন্ত করার আদেশ দিলেও, আজ অবধি ওই ঘটনার জন্য কারো সাজা হয়নি। রাজ্যের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়েক ওই ঘটনার জন্য বিজেপিকে দায়ী করেন এবং দীর্ঘ দুই দশক ধরে ক্ষমতায় বহাল থাকেন, যদিও কন্ধমলের খ্রিস্টানদের মতে এলাকায় সঙ্ঘীদের প্রবল প্রতাপ, শক্তি প্রদর্শন খর্ব করার জন্য তিনি কোনও কার্যকারী পদক্ষেপই গ্রহণ করেননি।

    ২০১৮র একটি রিপোর্টে জানা যায় সারা বিশ্বে খ্রিস্টানদের জন্য বিপজ্জনক ৫০টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান এগারো। আমাদের দেশে খ্রিস্টধর্মী মানুষের সংখ্যা মাত্র ২.৩% অথচ তাঁদের ওপর হামলা বেড়েই চলেছে। ‘ইভানজেলিক্যাল ফেলোশিপ অফ ইন্ডিয়ার’ তথ্যর ওপর চোখ রাখা যেতে পারেঃ দেখা যাচ্ছে ২০১৪ সালে যেখানে হামলার সংখ্যা ছিল ১৫১ সেটাই ২০২১ বেড়ে হয়েছে ৫০৫, ২০২২এ ৫৯৯, ২০২৩এ ৬০১, ২০২৪এ ৮৪০। সর্বাধিক আক্রমণ হয়েছে উত্তর প্রদেশে, ১৮৮। এরপর আছে ছত্তিসগড়, ১৫০; রাজস্থান, ৪০; পাঞ্জাব, ৩৮, হরিয়ানা, ৩৪ ইত্যাদি। (এই তথ্যের মধ্যে মণিপুরে খ্রিস্ট সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমণ কিন্তু যোগ করা নেই। সুপ্রিম কোর্টে একটি পিটিশন অনুযায়ী সেখানে গণ্ডগোল শুরু হওয়ার প্রথম চার মাসে ৬৪২টি ধর্মস্থানের ওপর আক্রমণ হয়েছে। ইম্ফলের আর্কবিশপের বিবৃতি অনুযায়ী প্রথম ৩৬ ঘন্টাতে ২৪৯টি গির্জায় হামলা হয়েছে।) ২০২৩এ বিধানসভা সভা নির্বাচন, এবং ২০২৪এ এপ্রিল, মে মাসে লোকসভা নির্বাচনের সময় ছত্তিসগড়ে হামলার সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। এই মার্চে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বিষ্ণু দেও সাই ঘোষণা করেন যে ধর্মান্তকরণ বন্ধ করার জন্য আরও কঠোর আইন তৈরি করা হবে। অপর দিকে বিভিন্ন গির্জার সঙ্গে যুক্ত যাজকরা জানিয়েছেন যে খ্রিস্ট ধর্মে বলপূর্বক ধর্মান্তকরণের কোনও স্থান নেই।

    সম্প্রতি ১৯শে এপ্রিল ইস্টার শনিবারের দিনে দেশের বিভিন্ন গির্জায় সঙ্ঘীরা দলবদ্ধ ভাবে আক্রমণ করে লুটপাট করে এবং প্রার্থনা সভা এবং ধর্মপালনে বাধা দেয়। রায়পুর, আহমেদাবাদ, দেরাদুন সহ আরও বহু জায়গা থেকে এই ধরনের খবর পাওয়া গেছে। আইনশৃঙ্খলার বাহানা করে দিল্লি পুলিশ গত ১৩ই এপ্রিল দেশের রাজধানীতে ‘পাল্ম সানডে’ উপলক্ষে খ্রিস্টধর্মীদের পায়ে হেঁটে শহরে শোভাযাত্রার জন্য অনুমতি দিতে অস্বীকার করে। গত এক দশক ধরে এই শোভাযাত্রা দিল্লিতে শান্তিপূর্ণ ভাবে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। এঁরা পুরনো দিল্লির সেন্ট মেরিজ চার্চ থেকে নতুন দিল্লির গোল মার্কেটের একটি গির্জা অবধি পদযাত্রা করেন। অথচ এর এক সপ্তাহ আগেই রামনবমী উপলক্ষে মুখ্যমন্ত্রী রেখা গুপ্ত শহরে শোভাযাত্রা করেছেন।

    আমরা এমন একটা সময়ে বাস করছি যখন সংখ্যা সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ১৭-১৮% সংখ্যালঘুদের কারণে বিপন্ন বোধ করছে। দেশের যাবতীয় সমস্যার কারণ এই অল্পসংখ্যক মানুষ, তাঁদের জন্যই এত দারিদ্র, বেকারত্ব, অসাম্য, অর্থনৈতিক দুর্দশা ইত্যাদি। সারা বিশ্বে এই প্রবণতা বিপুল আকার ধারণ করেছে। আমেরিকায় শ্বেতাঙ্গরা বিপন্ন, ইউরোপে অভিবাসীদের কারণে নাকি উন্নয়ন স্তব্ধ হয়ে গেছে। হাতেগোনা কয়েকজন সংখ্যালঘু মৌলবাদী, উগ্র অভিবাসীদের কারণে সমগ্র সম্প্রদায়কে রাষ্ট্রবিরোধী, বিদেশের চর ইত্যাদি বলে দেগে দেওয়া হচ্ছে। কাশ্মীরের মর্মান্তিক ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় ঘৃণা, বিদ্বেষের যে উদগিরণ দেখা যাচ্ছে তা ভয়ঙ্কর। সারা দিন ধরে টিভি ও সমাজমাধ্যমে মুসলিম-খ্রিস্টান নামক ‘অপর’কে দানবীয় করে চিত্রিত করার যে প্রক্রিয়া চলছে, সেটার কাছে সুস্থ স্বাভাবিক মানুষও আত্মসমর্পণ করছেন। মিডিয়ার এই হট্টগোল থেকে নিজেকে একটু সরিয়ে নিয়ে ভিন্ন ভাবে ভাবা অনুশীলন করা যায় কি? তাতে হয়তো এই বিষাক্ত পরিবেশ থেকে মুক্তির কিছু সুস্থ, স্বস্তিদায়ক উত্তর পাওয়া যেতে পারে।


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • আলোচনা | ৩০ এপ্রিল ২০২৫ | ১৫৬ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • সোমা চ্যাটার্জী | 103.242.***.*** | ৩০ এপ্রিল ২০২৫ ২০:৪৪542751
  • লেখককে ধন্যবাদ  ও অভিনন্দন,  ক্রমবর্ধমান  বে্কারত্বের,  আর অর্থনৈতিক বৈষম্যের  দিক থেকে মানুষের  দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেবার জন্য জাতপাতের লড়াই ও ধর্মীয় বিভাজনের যে জঘন্য প্রচেষ্টা চলছে,  তার বিরুদ্ধে  এটি অত্যন্ত বলিষ্ঠ ও তথ্য ভিত্তিক প্রতিবেদন। আরো বেশী সংখ্যক পাঠকের  কাছে এই লেখাটি পৌছতে পারলে জনমানষে চেতনার  উন্মেষ ঘটবে,  সেই আশায় ও প্রতিক্ষায় রইলাম
  • MP | 2409:4060:2d9f:cd80:a3c5:cd7f:dca8:***:*** | ৩০ এপ্রিল ২০২৫ ২১:০৪542753
  • ভীষণ প্রাসঙ্গিক লেখা l লেখককে ধন্যবাদ l 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। বুদ্ধি করে প্রতিক্রিয়া দিন