এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  পড়াবই  বই পছন্দসই

  • এক সাংবাদিকের হত্যা ও তারপর……

    সোমনাথ গুহ
    পড়াবই | বই পছন্দসই | ০৭ এপ্রিল ২০২৫ | ১০৪ বার পঠিত | রেটিং ৪ (১ জন)


  • গত ১০ জানুয়ারি গৌরী লঙ্কেশ হত্যা মামলায় হেফাজতে থাকা শেষ অভিযুক্ত শরদ ভাউসাহেব কালস্কর জামিনে মুক্তি পান। আদালতের বিচারপতি বলেন দীর্ঘ সময় ধরে আটকে রাখা সংবিধানের ২১ অনুচ্ছেদের অধীনে দ্রুত বিচারের যে সাংবিধানিক অধিকার তা লঙ্ঘন করে। (অবাক লাগে এই ২১ অনুচ্ছেদ কেন প্রায় পাঁচ বছর ধরে বিনা বিচারে আটকে থাকা উমর খালিদ, গুলফিশা ফতিমা বা মহেশ রাউতের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয় না!) মামলায় ১৮ জন সহ-অভিযুক্তের মধ্যে ১৬ জন আগেই জামিন পেয়ে গেছেন, আরেক অভিযুক্ত বিকাশ পাতিল পলাতক।

    ‘আই এম অন দ্য হিট লিস্টঃ আ জার্নালিস্টস মার্ডার এন্ড দ্য রাইজ অফ অটোক্রেসি ইন ইন্ডিয়া’ বইয়ে লেখক রোলো রোমিগ প্রতিবাদী সাংবাদিক গৌরী লঙ্কেশের এক ভিন্নধর্মী জীবনী রচনা করেছেন। লেখক এই জীবনী রচনা করতে গিয়ে লিখছেন তিনি তিনটি দক্ষিণ ভারতীয় রাজ্যের কাহিনি লিখবেন। দক্ষিণের রাজ্য কেন? কারণ তিনি গত এক দশক ধরে এই রাজ্যগুলি নিয়ে লেখালেখি করছেন এবং তাঁর স্ত্রী দক্ষিণ ভারতীয় মুসলিম। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই অঞ্চল একটা উপদ্বীপের মতো, যে কারণে এখানে বাণিজ্য আছে এবং বাণিজ্য থাকার কারণে শিক্ষা আছে। এর প্রভাব দেখা যায় কেরালায় যেখানে মুসলিম বাচ্চারা ক্যাথলিক স্কুলে যাচ্ছে, হিন্দুরা বিখ্যাত মসজিদে প্রার্থনা করছে, ক্যাথলিক সাধ্বীরা হিন্দু উৎসবে নৃত্য করছে। মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা আগে গৌরীর একটা ফেসবুক পোস্টে এর প্রতিফলন দেখা যায়। স্থানীয় একটা ফসল কাটার উৎসবে, ক্যাথলিক সন্ন্যাসিনীরা হিন্দু নাচ, তিরুবতীরকলির তালে তালে নাচছে। গৌরী লিখছেন, আমার মাল্লু (মালয়ালাম) বন্ধুদের দেখো, কী ভাবে তারা ধর্মনিরপেক্ষতা উদযাপন করছে……। আর তিনটি গল্প কেন? লেখকের মতে একটা কাহিনির মধ্যে অনেকগুলি কাহিনি ঘাপটি মেরে থাকে। তিনটির মধ্যে প্রধান কাহিনি অবশ্যই গৌরী এবং তাঁর প্রিয় শহর ব্যাঙ্গালোর, বাকি দুটি কেরালা এবং তামিলনাড়ু। এই লেখাটায় আমরা মূলত গৌরীর কাহিনির ওপর আলোকপাত করব।

    এই হত্যার প্রতিবাদে দেশজুড়ে বিপুল প্রতিবাদ হয়, মানুষ শোকে স্তব্ধ হয়ে যায়। ‘আমি গৌরী’ ব্যাজ বুকে লাগিয়ে মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। লিঙ্গায়েত সমাধিস্থলে একটা পেন এবং তাঁর পত্রিকার সাম্প্রতিক সংখ্যা সহ গৌরীকে কবরস্থ করা হয়। সমাধিস্তম্ভে লেখাঃ এখানে যে বীজ বপন করা হয়েছে তা সারা বিশ্বে অঙ্কুরিত হয়েছে। ১২ সেপ্টেম্বর ব্যাঙ্গালুরুতে বিশাল মিছিল হয়েছে। সেখানে লেখক, শিল্পীরা যেমন ছিলেন তেমনি দলিত, আদিবাসী, ট্র্যান্সজেন্ডার ইত্যাদি নিপীড়িত মানুষও ছিলেন। ব্যাঙ্গালোর থেকে ২০০ মাইল দূরে টালাগুপ্পা নামে একটি গ্রামে ‘আমিও গৌরী’ প্ল্যাকার্ড নিয়ে পূর্ণিমা নামে এক মহিলা গ্রামের বাজারে একা দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করেছেন। তারপর তিনি সেখান থেকে দশ মাইল দূরে একটি শহরে হেঁটে গেছেন এবং সেখানেও প্ল্যাকার্ড নিয়ে এক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকেছেন।

    কেন গৌরীকেই হত্যা করা হল

    লেখক বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে গৌরীর ব্যতিক্রমী জীবন ও তাঁর হত্যাকে বুঝবার চেষ্টা করেছেন। প্রথমেই তিনি প্রশ্ন করছেন গৌরীকেই কেন হত্যা করা হল। তিনি ছিলেন ইংরাজি পত্রিকার এক গড়পড়তা সাংবাদিক, চমকপ্রদ কিছু নয়। তাঁর পিতা পি.লঙ্কেশ কন্নড় ভাষায় এক দিকপাল লেখক ছিলেন, অনেকের মতে ইউ.আর.অনন্তমুর্তির সমগোত্রীয়। সমস্ত রাজনৈতিক দল তাঁর ‘লঙ্কেশ পত্রিকে’-কে ভয় পেত, সমীহ করত। সাংবাদিকতায় তিনি নৈতিকতার অনন্য নজির সৃষ্টি করেছিলেন, কোনও মহল থেকে তিনি কোনও সুযোগ সুবিধা নিতেন না, কারো চাপের কাছে নত স্বীকার করতেন না।

    এহেন পিতার কন্যা গৌরী। লঙ্কেশের মৃত্যুর পর তাঁর সহকর্মীরা ভেবেছিলেন পত্রিকা বন্ধই হয়ে যাবে, কিংবা বরিষ্ঠ কেউ দায়িত্ব নেবেন। এক সহকর্মী নটরাজ হুলিয়ার বলেন, গৌরীর নাম কারো মাথাতেই ছিল না, তবুও মিটিং শুরু হওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যে তিনিই হয়ে গেলেন সম্পাদক। অনেকের মতো আমিও ভেবেছিলাম এটা ঠিক হল না, তিনি বলেন। কিন্তু স্রেফ জেদ এবং আত্মবিশ্বাসের জোরে গৌরী সবাইকে ভুল প্রমাণ করলেন। কন্নড় ভাষার ওপর সেরকম দখল না থাকা সত্ত্বেও পরিস্থিতির চাপে গৌরী বাধ্য হন ‘লঙ্কেশ পত্রিকে’র দায়িত্ব নিতে। গুণগত মান কিংবা সাহিত্যিক মানের দিক থেকে তিনি তাঁর পিতার সমপর্যায়ে কখনোই পৌঁছাতে পারেননি। পিতার পথ অনুসরণ করে তিনি কোনও বিজ্ঞাপন নিতেন না, পত্রিকার দামও ছিল মাত্র ১৫ টাকা, মৃত্যুর সময় তাঁর নিজের পারিশ্রমিক সামান্য ২৫০০০ টাকা। পত্রিকার সেরা সময়েও তা কয়েক হাজার মাত্র বিক্রি হতো এবং বিজ্ঞাপন ও অনুদান না নেওয়ার কারণে শুরু থেকেই এর অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল সঙ্গিন। কোভিডের সময়ে প্রিন্ট মিডিয়া প্রবল প্রতিকূল পরিস্থিতির সম্মুখিন হয়; বহু কাগজ পাততাড়ি গুটিয়ে ফেলে, গৌরীর পত্রিকার অবস্থাও গুরুতর হয়ে পড়ে। অনেকের মতে এই সময় পত্রিকা বন্ধ হওয়া ছিল সময়ের অপেক্ষা মাত্র। অফিসে শেষ সন্ধ্যায় পত্রিকাকে বাঁচিয়ে রাখতে তিনি বিজ্ঞাপন নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, নিজের এলআইসি পলিসি ভাঙ্গিয়ে কর্মচারীদের মাইনে দিয়েছিলেন।

    তবুও দক্ষিণপন্থীরা এই ছোট সীমিত প্রচারের পত্রিকা, অর্থনৈতিক ভাবে যেটা ছিল রিক্ত, সেটাকে ভয় পেত, কারণ তার সম্পাদকের ছিল ক্ষমতার চোখে চোখ রেখে কথা বলার অসমসাহসিকতা। সঙ্ঘ পরিবারের নির্লজ্জ শক্তি প্রদর্শন, হুমকিকে তিনি ভয় পেতেন না। পিতা পি.লঙ্কেশও ছিলেন যে কোনও ধরনের ধর্মান্ধতার বিরোধী, কিন্তু তাঁর কন্যার সময়ে দেশের পরিবেশের আমূল পরিবর্তন ঘটে গেছে। সংবাদ পরিবেশনের ঝুঁকি বহু গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে, বিশেষ করে যাঁরা স্থানীয় ভাষায় সাংবাদিকতা করেন, আরও গুরুত্বপূর্ণ সারা দেশ জুড়ে দক্ষিণপন্থীদের রমরমা শুরু হয়ে গেছে। কিছু হিন্দুত্ববাদী সংগঠন, যারা এক সময় প্রান্তিক ছিল তারা প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে এবং রাজনীতিতে তাদের দাপট প্রদর্শন করা শুরু করেছে। তারা নিদান দেয় যারা হিন্দু ধর্মের নিন্দা করে তাঁদের নিকেশ করতে হবে। শুরু হয় পরপর যুক্তিবাদী, অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তিদের হত্যা; আগস্ট ২০, ২০১৩ কুসংস্কার-বিরোধি আন্দোলনের পুরোধা নরেন্দ্র দাভোলকার পুণেতে দুই আততায়ীর গুলিতে হত্যা হন; ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ শ্রমিক আন্দোলনের প্রবীণ নেতা গোবিন্দ পানসারে মহারাষ্ট্রের কোলাপুরে একই ভাবে নিহত হন; কয়েক মাস বাদে ৩০ আগস্ট লিঙ্গায়েত সম্প্রদায়ের প্রথিতযশা পন্ডিত এম.এম.কলবুর্গি নিজের বাড়িতে গুলিবিদ্ধ হন। এই হত্যার পরেই ম্যাঙ্গালোরের এক হিন্দুত্ববাদী নেতা টুইট করেন, হিন্দু ধর্ম নিয়ে মজা করলে, কুত্তার মতো মরতে হবে।

    গৌরীর নিজের একটি সম্ভাব্য হিট লিস্ট ছিল। এক মাস বাদে গৌরী একটি সাক্ষাৎকারে নামগুলি ব্যক্ত করেন। নিজে তালিকায় চতূর্থ নম্বরে থাকলেও, তিনি সেটাকে একেবারেই গুরুত্ব দিতেন না। তিনি মনে করতেন একজন মহিলা সাংবাদিক হওয়ার অনেক সুবিধা আছে, সেটাই তাঁর নিরাপত্তা। শারীরিক ভাবে আক্রান্ত হওয়ার কোনও আশঙ্কাই তাঁর ছিল না। তাঁর ঘনিষ্ঠরাও একই রকম নিরুদ্বিগ্ন ছিলেন। “ও মাঝেমধ্যে এটা নিয়ে মজা করতো, কিন্তু ওর সেরকম কোনও বিপদ আছে বলে আমাদের কখনো মনে হয়নি,” গৌরীর বোন কবিতা বলেন। সহকর্মী শিবসুন্দর বলেন উনি বরঞ্চ অন্যদের নিরাপত্তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিলেন। যেমন ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায় আসার পর ওনার প্রথম প্রতিক্রিয়া ছিল, তিস্তার কী হবে। অনেকের মতে গৌরীর সাংবাদিকতা ছিল উগ্র, তিনি শুধু সমালোচনা করতেন না, হিন্দুত্ববাদীদের নিয়ে মজামস্করা করতেন। পত্রিকার কভার পাতা হতো রীতিমত প্ররোচনামূলক যা সাংবাদিকতার তথাকথিত নিয়ম নীতি লঙ্ঘন করত। ঐতিহাসিক রামচন্দ্র গুহ এই ব্যাপারে দ্বিমত প্রকাশ করেন। তাঁকে যখন জিজ্ঞাসা করা হয় গৌরী কি খুব রূঢ় ছিলেন, তাঁর ভাষায় কি অতিশয়োক্তি ছিল, তিনি বলেন যাই হোক একটা লেখার প্রতিক্রিয়ায় আরেকটা লেখাই শুধু হতে পারে, কখনই তাঁকে হত্যা করা হতে পারে না।

    গৌরীর বন্ধু চন্দন গৌড়ার মতে হত্যার সম্ভাব্য কারণ লিঙ্গায়েত সম্প্রদায় নিয়ে বিতর্ক। তিনি বলেন, গৌরী লিঙ্গায়েত সম্প্রদায়কে হিন্দু ধর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য লাগাতার চেষ্টা করেছিলেন। এটা প্রমাণ করা সম্ভব নয়, কিন্তু হয়তো এই কারণেই তাঁকে খুন হতে হয়। উত্তর কর্ণাটকে লিঙ্গায়েতরা বিজেপির মূল শক্তি হওয়ার কারণে হিন্দুত্ববাদীদের ভয় ছিল যদি তাদেরকে হিন্দু ধর্ম থেকে বিযুক্ত করে দেওয়া হয় তাহলে ধর্মীয় মেরুকরণ করার চেষ্টা ধাক্কা খাবে এবং তাদের ক্ষমতায় আসা কঠিন হয়ে যাবে। প্রসঙ্গত লিঙ্গায়েতরা কর্ণাটকের জনসংখ্যার প্রায় ১৫%। প্রতিটি নির্বাচনের আগে এদের ভোট নিয়ে রাজ্যের দুটি প্রধান দল কংগ্রেস ও বিজেপির মধ্যে টানাপোড়েন শুরু হয়।

    হত্যার পরে গঠিত স্পেশ্যাল ইনভেস্টিগেশন টিম (এসআইটি) এর মতে ২০১২ সালে হিন্দু ধর্ম নিয়ে গৌরীর একটি বক্তব্য তাঁকে চিরতরে সরিয়ে দেওয়ার প্রধান প্ররোচনা হিসাবে কাজ করেছে। ওই বক্তব্যে গৌরী হিন্দু ধর্ম ব্রিটিশ-সৃষ্ট বলে বর্ণনা করেন এবং সেটার অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। পুলিশ এর জন্য গৌরীকে দাঙ্গায় প্ররোচনা দেওয়ায় (ধারা ১৫৩) অভিযুক্ত করে। গৌরী কখনো এই বক্তব্যের জন্য অনুতাপ প্রকাশ করেননি, উলটে ২০১৬ সালে নিজে একটি ভিডিও পোস্ট করে বলেন, আমি যা বলেছি ঠিক বলেছি। হিন্দুত্ববাদীরা সুযোগ পেয়ে যায়, তারা বুঝতে পারে এই বক্তব্যকে ব্যবহার করে অনেককে গৌরীর বিরুদ্ধে খেপিয়ে তোলা যাবে। তারা বাজারে একটা ভিডিও ক্লিপ ছেড়ে দেয় যার শিরোনাম ‘কেন আমি ধর্মনিরপেক্ষতাকে ঘৃণা করি’। এই ক্লিপ ইউটিউবে ভাইরাল হয়। এরপর তারা এই ভিডিও দেখিয়ে অভিযুক্তদের উত্তেজিত করে, তাদের মন্ত্র দেয় এই মহিলা একজন ‘দুর্জন’ যে হিন্দু ধর্মের ক্ষতি করছে এবং একে বলতে দেওয়া হলে আরও অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে।

    কারা এই হত্যার পিছনে

    কেন গৌরীকেই হত্যা করা হল সেটা না হয় বোঝা গেল, কিন্তু হত্যাকারী কারা? সাধারণ বুদ্ধিতে লেখক বোঝার চেষ্টা করেছেন এই হত্যার কারণে কারা সবচেয়ে উল্লসিত। তাঁর বই থেকে এটা পরিষ্কার যে এই অকুতোভয় মহিলার হত্যায় যারা অভিযুক্ত তারা যে সবাই জামিন পেয়ে গেছেন এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই কারণ মৃত্যুর অব্যবহিত পরেই হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক মহল এই ঘটনাকে সরবে, সগর্বে উদযাপন করেছে। কিছু প্রতিক্রিয়া এখানে উল্লেখ করা যেতে পারেঃ একটি টুইটার একাউন্ট লিখছে, কুত্তার মতো এই মহিলার মৃত্যু হয়েছে, আর ছানাগুলো এখন কুঁই কুঁই করে কাঁদছে। আর একজন লিখছে, যেমন কর্ম, তেমনি ফল। আরেকজন তো খোলাখুলি হুমকি দিচ্ছেঃ গৌরী লঙ্কেশের হত্যা সাংবাদিক ও রাজনৈতিক কর্মীর ভেকধরা রাষ্ট্রদ্রোহীদের জন্য একটা হুঁশিয়ারি। এরকম আরও রাষ্ট্রদ্রোহীদের তিনি একটা তালিকা দিচ্ছেন এবং আশা করছেন তাদেরও এক এক করে নিকেশ করা হবে। ছোটখাটো, ক্ষীণকায়, নিঃসঙ্গ বসবাসকারী, ছোট পত্রিকার এক সাংবাদিকের মৃত্যুতে এত ঘৃণা, কুকথা বর্ষিত হয় যে প্রখ্যাত সাংবাদিক রাভিশ কুমার বলতে বাধ্য হন, “আমরা এমন এক সমাজ সৃষ্টি করেছি যা মৃতদেহকে ঘিরে উল্লাস করে।”

    ফেব্রুয়ারি, ২০১৮, গৌরীর মৃত্যুর প্রায় চার মাস বাদে প্রথম একজন গ্রেপ্তার হন। তিন মাস বাদে আরও চারজন এবং এসআইটি একটি চার্জশিট পেশ করে যা থেকে জানা যায় যে কলবুর্গি এবং গৌরীকে একই পিস্তল দিয়ে খুন করা হয়েছে। অনুমান করা হয় যে দুটি হত্যার মধ্যে যোগসূত্র আছে, এবং দুটির সাথে সনাতন সংস্থা নামে একটি প্রান্তিক হিন্দুত্ববাদী সংগঠন কোনও ভাবে জড়িত। ১১ই জুন, ছাব্বিশ বছর বয়সি পরশুরাম ওয়াঘমারের গ্রেপ্তার আলোড়ন সৃষ্টি করে। পুলিশের মতে এই যুবকই গৌরীকে গুলি করে হত্যা করে। তিনি শ্রী রাম সেনা নামক একটি সংগঠনের সাথে যুক্ত, যারা পরশুরামের পরিবারের জন্য ফেসবুকে তহবিল সংগ্রহ শুরু করে দেয়। সনাতন সংস্থা প্রান্তিক হলেও এর ছায়া সংগঠন রয়েছে, যেমন শ্রী রাম সেনা ও হিন্দু জনজাগৃতি সমিতি। বিজেপি-আরএসএস এদের সাথে সম্পর্ক অস্বীকার করে আবার এদের নানা ভাবে কাজে লাগায়।

    ৯ জানুয়ারি, ২০২০, সতেরোতম অভিযুক্ত গ্রেপ্তার হন। প্রত্যেক অভিযুক্তের কাছে ‘ক্ষত্রধর্ম সাধনা’, সনাতন সংস্থার বাইবেল পাওয়া যায়।

    বিচার না প্রহসন

    এসআইটি চার্জশিট দেওয়ার প্রায় তিন বছর বাদে, শেষ গ্রেপ্তারের দেড় বছরের অধিক সময় বাদে এবং হত্যাকান্ডের চার বছর বাদে, অবশেষে ২০২১ এর অক্টোবর মাসে আদালত অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে চার্জ পেশ করে। অভিযুক্তদের পক্ষে হাই কোর্ট একটি রায় দেয়, রাজ্যের বিজেপি সরকারকে সেটার বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করার প্রয়োজন হয়। সরকারের ক্রমাগত গড়িমসি করে যে কারণে কবিতা লঙ্কেশ নিজে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হন এবং উচ্চ আদালত হাই কোর্টের রায় খারিজ করে। এরপরেও নানা অছিলায় বিচার বিলম্বিত করা হয়। ৬ ডিসেম্বর, ২০২১ বিচার শুরু হওয়ার দিন ধার্য হয়, সেটা প্রায় সাত মাস পিছিয়ে ৪ জুলাই, ২০২২ করে দেওয়া হয়। যদিও বিচারক প্রতি মাসে এক সপ্তাহ বিচারের দিন ধার্য করেন, পরের মাসে মাত্র দেড় দিন শুনানি হয়, সেপ্টেম্বরে বিচারক পরিবর্তন হওয়ার কারণে শুনানি স্থগিত থাকে। চার মাস বাদে সেই বিচারকও অন্যত্র চলে যান। ডিসেম্বর, ২০২৩ মোহন নায়ক নামে অভিযুক্ত প্রথম জামিন পান, গৌরী হত্যার সপ্তম বার্ষিকীতে একসাথে আট জন জামিন পান। এদের মধ্যে দুজনকে শিবাজি মুর্তির সামনে নিয়ে গিয়ে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। তাদের শাল ও মালা পরিয়ে বরণ করা হয়, ‘ভারতমাতা কি জয়’ শ্লোগান ওঠে। শেষ অভিযুক্তের জামিন পাওয়া আমরা শুরুতেই উল্লেখ করেছি।

    গৌরী হত্যা ও স্বৈরতন্ত্রের উত্থান

    গৌরী হত্যার চতূর্থ বছরে সনাতন সংস্থা ইউটিউবে একটি দু ঘণ্টার অনুষ্ঠান করেঃ ‘গৌরী লঙ্কেশের হত্যা – বাস্তব এবং প্রচার’। সঞ্চালক ঘোষণা করেন, হত্যা নিয়ে রাজনীতি করা, হত্যা করার থেকে আরও ঘৃণ্য। এক আমন্ত্রিত বক্তা বলেন, গৌরী লঙ্কেশকে সাংবাদিক বা লেখক বলা অন্য সাংবাদিক ও লেখকদের অপমান করা। বস্তুত গৌরী হত্যার পরের বছরগুলিতে রাজ্য রাজনীতিতে সনাতন সংস্থার গুরুত্ব বহুগুণ বেড়ে যায়। তাদের মূলধারার সংগঠন হিসাবে গণ্য করা শুরু হয়। তাদের নিয়মিত টিভি আলোচনায় দেখা যায়; তাদের হুমকির কারণে প্রগতিশীল আলোচনা, মুসলিম স্ট্যান্ড-আপ কমেডিয়ানদের অনুষ্ঠান, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর ওপরে বইয়ের উদ্বোধন সব বাতিল করে দেওয়া হয়। ফেসবুকের নিরাপত্তা সংক্রান্ত টিম সনাতন সংস্থাকে প্ল্যাটফর্ম থেকে নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব দেয়। কিন্তু এর পরিণামে ভয়ঙ্কর প্রতিক্রিয়া হতে পারে ভেবে তারা পিছিয়ে আসে। ২০২৩ সালে বোম্বে হাই কোর্ট রায় দেয় যে সনাতন সংস্থা কোনও সন্ত্রাসবাদী সংগঠন নয়।

    লেখক লিখছেন বিদেশে ভারতের মুখ উজ্জ্বল হয়েছে, কিন্তু দেশ স্বৈরতন্ত্রের গহ্বরে নিমজ্জিত হয়েছে। গৌরীর হত্যা ভারতের বর্তমান সংকট বোঝার এক চাবিকাঠি। দেশের বিচারব্যবস্থা, অপরাধ-দমন থেকে আদালতের বিচার, কুক্ষিগত ও অকেজো হয়ে গেছে; শাসক দলের চাপে প্রেস নতি স্বীকার করেছে; সমস্ত ভিন্ন মতামতকে অপরাধ হিসাবে গণ্য করা হচ্ছে; এক স্বৈরতন্ত্রীর প্রবল প্রতাপের কারণে সমস্ত আঞ্চলিক, ধর্মীয় বিভিন্নতাকে মুছে দিয়ে হিন্দু রাষ্ট্র গড়ার চেষ্টা হচ্ছে; উগ্র জাতীয়তাবাদের নিষ্পেষণে কয়েক কোটি সংখ্যালঘুদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক করে দেওয়ার চক্রান্ত চলছে।

    লেখক আক্ষেপ করছেন দক্ষিণের রাজ্যগুলির সেই সৌহার্দমূলক পরিবেশ হারিয়ে যাচ্ছে। সেখানকার মুসলিম মহিলার সাথে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হওয়ার কারণে, তিনি তাঁর স্ত্রীর পরিবারের নিরাপত্তা সম্পর্কে ভীত। যে দুর্বার গতিতে ভারত এই অন্ধকার ভবিষ্যতের দিকে এগোচ্ছে তাতে তিনি আতঙ্কিত।

    বই: আই এম অন দ্য হিট লিস্টঃ আ জার্নালিস্টস মার্ডার এন্ড দ্য রাইজ অফ অটোক্রেসি ইন ইন্ডি
    লেখক : রোলো রোমিগ
    প্রকাশক : পেঙ্গুইন
    দাম - ৪৮০ টাকা
     


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • পড়াবই | ০৭ এপ্রিল ২০২৫ | ১০৪ বার পঠিত
  • আরও পড়ুন
    কবিতা - Suvankar Gain
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • aranya | 2601:84:4600:5410:807f:e40d:c4c3:***:*** | ০৭ এপ্রিল ২০২৫ ০৯:২০542158
  • ভাল  ও জরুরী লেখা 
  • সোমা চ্যাটার্জি | 223.185.***.*** | ০৭ এপ্রিল ২০২৫ ১১:৪৫542162
  • বর্তমান রাষ্ট্রের  ভয়াবহতার প্রেক্ষিতে খুব ভাল , এবং জরুরী লেখা , মত প্রকাশের স্বাধীনতা যেখানে প্রশ্নের মুখে, সেখানে এরকম  লেখা খুব প্রয়োজনীয়,  
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। বুদ্ধি করে প্রতিক্রিয়া দিন