এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  আলোচনা  রাজনীতি

  • শতবর্ষে সাম্প্রদায়িকতা-কম্যুনিস্টদের ভ্রান্তি আজ অপরাধে পর্যবসিত

    Barnali Mukherjee লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | রাজনীতি | ২১ আগস্ট ২০২৫ | ৫৩ বার পঠিত
  • কয়েক কোটি কম্যুনিস্ট কর্মী ফ্যাসিস্টদের হাতে প্রাণ দিয়েছেন। মানবেন্দ্রনাথ রায়, গঙ্গাধর অধিকারী, জ্যোতি বসু, অজয় মুখার্জী, হরকিষেন সিং সুরজিৎ, পুরণ যোশী, ডাঙ্গে, বা চারু মজুমদারদের দিকে আঙুল তুলে কেউ বলতে পারবেন না যে তাঁরা মুসলিম বিদ্বেষী ছিলেন। অথবা মুজফফর আহমেদ হিন্দু বিদ্বেষী ছিলেন। বরং তারা ব্যক্তি জীবনে ধর্মীয় পরিচয় নিয়ে মাথা ঘামাননি, ধর্মের তোয়াক্কা না করে একসাথে চলেছেন, খেয়েছেন, জেলে গেছেন, পরস্পরকে বিবাহ করেছেন। কমিউনিস্টরা লালা লাজপত রায়-ইকবাল মত হিন্দু মুসলিম জনগোষ্ঠীর পরস্পরের সাথে থাকা প্রায় অসম্ভব, এমন ভাবেওনি। শ্রী আম্বেদকার দৃঢ়ভাবে মনে করতেন যে দেশভাগ রোখা যদি সম্ভব হয়ও সেটা কৃত্রিম হবে। যদি দেশ ভাগ হয় কিছু সমস্যা হবে কিন্তু না হলে সমস্য হবে আরও বেশি (Thoughts on Pakistan , 1941)। যদিও কেউ বলতেই পারেন যে ১৯৪১ থেকে ১৯৪৫ সাল, এই পর্যায়ে কম্যুনিস্ট পার্টি পাকিস্তান প্রস্তাবের প্রতি সহমর্মিতা দেখিয়েছিল। কিন্তু সেটার কারণ মোটেই দ্বিজাতি তত্ত্ব নয়। তখন বিচ্ছিন্নতার অধিকার সহ যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর কথা বলছিলেন কমিউনিস্টরা। কিন্তু একসাথে থাকার প্রচেষ্টা না করেই বিচ্ছিন্নতার বিরুদ্ধে ছিলেন কম্যুনিস্টরা। দেশ স্বাধীন হোক, লীগ সেই অটুট দেশের মধ্যেই প্রবেশ করুক, যাচাই হোক, তার পর যদি মুসলিম জনতা মনে করেন (সংবিধান সভাকে দেওয়া প্রস্তাবে সোমনাথ লাহিড়ি সার্বজনীন ভোটের ভিত্তিতে মুসলিম জনতার গণভোট ভাবনাও সামনে এনেছিলেন ) যে সত্যিই থাকা যাচ্ছে না, তখন তাদের জন্য রাস্তা খোলা রইলো। অর্থাৎ বিচ্ছিন্নতার অধিকার চাই কিন্তু বিচ্ছিন্ন চাই না। অনেকটা ডিভোর্সের অধিকার সহ বিবাহের মতই। এতটা ঔদার্য আর কোনো দলই সেদিন দেখাতে রাজী ছিল না। তাহলে কেন আজ আর.এস.এস-এর শতবর্ষের প্রাক্কালে কম্যুনিস্ট দলগুলো বিজেপির দোসরে পরিণত হল? বাংলায় আর কেরালায় বহু বছর ক্ষমতায় থেকেছে তাই সিপিআইএম দলটা নষ্ট হয়ে গেছে বা মমতা ব্যানার্জী তাদের ভোটে হারিয়েছিল তাই পশ্চিমবঙ্গে সিপিআইএম খোলাখুলি বিজেপির পক্ষে নেমেছে ---- এই উত্তরগুলি অতি সরল। কারণ কেরালায় প্রতি অন্য ভোটে হেরে যাওয়া কম্যুনিস্টদের অভ্যেস আছে। তবে সেখানে কেন আজ কংগ্রেসকেই প্রধান শত্রু করেছে সিপিআইএম? কেরালা আর পশ্চিমবঙ্গের নেতাদের স্বস্তি দিয়ে কেনই বা বিজেপিকে ফ্যাসিস্ট হয়ে যাওয়া দল বলতে রাজী হল না মাদুরাই পার্টি কংগ্রেস? ২০০৮ সালে পরমাণু চুক্তি ইস্যুতে নিজের পার্টির ভবিষ্যত জলাঞ্জলি দিয়ে বিজেপির সাথে জোট বেঁধে ইউপিএ সরকার ফেলতে চেষ্টা করেছিলেন কারাট সাহেব। নিন্দুকেরা বলেন, চীনের নাকি এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা ছিল। চীনের প্রশ্নে সিপিআইএম আজও ভয়ানক দুর্বল। এই ডামাডোলের বাজারে চীন মোটেও মোদীকে হাতছাড়া করতে রাজী নয়। মোদীকে মার্কিন লবির থেকে কেড়ে নিজেদের লবির দিকেই রাখতে চায় চীন। তবে কি, কারাট এবারেও চীনের কথা শুনে মোদীর সব কসুর মাফ করলেন? কিন্তু মাদুরাই সিদ্ধান্ত নিয়ে দলের মধ্যে কোনো বিদ্রোহ হল না, ভাবতে অবাক লাগে না? শুধু সিপিআইএম-বামফ্রন্ট-ই বা কেন? দিল্লির ভোটে আপ-র পক্ষে কোনো জেএনইউ-র নকশালকে নামতে দেখা গেল না। প্রত্যেক রাজ্যে যে দল (সেটা যদি অবিজেপি দলও হয়) ক্ষমতায় আছে তার বিরুদ্ধে খড়গহস্ত হয়েই আছেন সব ধরনের বাম দল। বিজেপির লাভ, ক্ষতি এসব হিসেবের থোড়াই তোয়াক্কা করেন তারা।

    ১) ভ্রান্ত দিমিট্রভ লাইন

    দিমিট্রভের লাইনই কারাট লাইনের জনক। এই প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করবো না কারণ ইতিপূর্বেই এই ব্লগেই এই প্রসঙ্গে সবিস্তারে আলোচনা করেছি। শুধু এটুকুই বলবো, দিমিত্রভ লাইন শিকড়হীন। যে তত্ত্ব ফ্যাসিবিরোধী জোটের কথা বলেছে!! ফ্যাসিস্টদের উত্থান পর্বে গণ আন্দোলন করতে বলেছে, কৃষকদের পাশে পেতে বলেছে, সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট সরকারকে কম্যুনিস্ট বিরোধিতার আক্রমণ কমানোর জন্য চাপ সৃষ্টি করতে বলেছে। কিন্তু ইয়োরোপ জুড়ে কমিন্টার্নের সোশ্যাল ফ্যাসিস্ট তত্বের ভ্রান্তির কথা বলেননি। সরকারি দলকে পরাজিত করার জন্য কমিউনিষ্টদের ফ্যাসিস্টদের পাশে নিয়ে আপ্রাণ প্রচেষ্টার অপরাধের আত্মসমালোচনা করেননি ।

    ফলে সিপিআইএম, নকশালদের দাবি যে দিমিট্রভ যা বলেছেন তারা সেটাই করছেন।  স্পষ্ট ভাষায় ১৯৩৩ সালের আগের দশ বছর যখন ফ্যাসিস্ট চরিত্র সম্পন্ন হিটলারের দল এককভাবে ক্ষমতা আসার প্রস্তুতি নিচ্ছিল, এবং যখন ইয়োরোপের কম্যনিস্টরা কোনো জোটে তো যায়নি, বরং সার্বিকভাবে হিটলারকে উত্থানকে সমর্থন করে গেছে, কখনো প্রত্যক্ষভাবে রেড ব্রাউন (আজকের ভাষায় রাম বাম) রেফারেন্ডাম করে কখনো আবার পরোক্ষে ভোটে সরকারি দলের সাথে জোট না করে। ফলে সেই প্রস্তুতির পর্যায়কে কমিন্টার্ন সহ দেশে দেশে (চীন মানেনি কমিন্টার্নের নির্দেশ) কম্যুনিস্টদের বিরাট মাপের ভ্রান্তিকে স্বীকার না করে দিমিত্রভ লাইন অকাজের লাইনই হয়ে থেকে গেছে। কারণ ফ্যাসিস্ট রাজ এসে যাওয়ার পর কি করতে হবে সেটা বোঝার জন্য দিমিত্রভ তত্ত্ব পড়তে হয় না, বা কম্যুনিস্টও হতে হয় না। প্রাণ বাঁচাতে তখন বাছ বিচার না করেই সকলে পরস্পরের হাত ধরে। আজ প্রকাশ কারাট সহ নকশাল-এসইউসি(সি) সহ সমস্ত বামদেরই বিজেপির প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ মদতকারী হওয়ার লাইসেন্স দিয়েছে দিমিত্রভ তত্ত্ব। ট্রটস্কাইটদের কথা আর বললাম না কারণ তারা তত্ত্বগতভাবেই বুর্জোয়াদের সাথে কোনো জোটে বিশ্বাস করেন না তারা। মার্ক্সবাদী রাজনীতিতে এই গভীর দুর্বলতা না থাকলে বামপন্থীরা এমন নিশ্চিন্তে দিল্লিতে আপ আর পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস কে হারাতে ‘জি জান সে’ নেমে পড়তো না।

    ২) চরমপন্থা প্রেম
    লেনিনদের পার্টির জন্ম হয়েছিল নৈরাজ্যবাদ এবং সন্ত্রাসবাদকে নস্যাৎ  করে। আর ভারতে ঠিক বিপরীত। ভারতের বামপন্থীদের মধ্যে জন্মকাল থেকেই জঙ্গীত্ব প্রীতি। কংগ্রেসের চরমপন্থী লবি আজন্ম হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার সাথে আষ্ঠে পৃষ্ঠে জড়িয়ে ছিল। আর সেই চরমপন্থী লবিকেই কম্যুনিস্ট পার্টি সমর্থন করে গেছে। একদিকে অটোমান সাম্রাজ্যকে রক্ষা করতে ভারতের মুসলিম যুবদের হিজরাত জাত কম্যুনিস্ট সদস্য, যাদের প্রতিনিধি কম্যুনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য শওকত ওস্মানি। আবার বাংলার হিন্দু প্রধান জঙ্গী অনুসীলন সমিতি জাত সদস্য, যাদের অন্যতম প্রতিনিধি মানবেন্দ্রনাথ রায়। মহারাষ্ট্রের তিলক ঘরানাকে প্রভাবিত করেছিল উগ্র ইতালীয় জাতীয়তাবাদ। অনুসীলন সমিতি, যুগান্তরদের ক্ষেত্রেও কখনো জাপান, কখনও জার্মানি, কখনও আবার ইতালি। রাসবিহারী বোস আজীবন জাপানের লোক হয়েই থেকে গেলেন। অরবিন্দ ঘোষ জেল থেকে মুক্তি পেয়ে আশ্রয় নিলেন বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের প্রতিযোগী সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ফরাসী উপনিবেশে, সাথে পেলেন ফরাসি রাজনীতিবিদ রিচার্ডের স্ত্রী মীরা আলফাসাকে। আইরিশ সন্ত্রাসবাদীদের সাথে দার্শনিক ও বাস্তব যোগাযোগ রেখেও চলেছিল জঙ্গি স্বাধীনতা সংগ্রামী দলগুলো। এই ধারা থেকে ধারাবাহিকভাবে সদস্য পেয়েও কম্যুনিস্ট আন্দোলন হিন্দু শাক্ত দর্শনে দীক্ষিত এই নৈরাজ্যবাদের বিরুদ্ধে কঠোর সংগ্রাম গড়ে তোলেনি। অনুসীলন সমিতির শেষের দিকে, চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের পর বহু সদস্য কম্যুনিস্ট হয়েছিলেন। কিন্তু তাদের পূর্বের সন্ত্রাসবাদী মন মানসিকতাকে ধ্বংস করতে চাওয়া  করা হয়েছে এমন কোনো দলিল চোখে পড়েনি। কংগ্রেস মডারেটরা যেদিকে তারা বিপরীত দিকে কম্যুনিস্টরা, ব্যাপারটা ছিল অনেকটা এরকম। শিশুসুলভ এই বৈশিষ্টের একটি উদাহরণ দেওয়া যাক --- ১৯২৮ সালের ২রা জানুয়ারি জহরলাল নেহরু চিঠি দিয়ে কম্যুনিস্টদের মোতিলাল নেহরু রিপোর্ট নিয়ে আলোচনার জন্য আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন। জবাবে কম্যুনিস্টরা বলছেন যে এই সংবিধান নিয়ে ইংরেজদের সাথে গোল টেবিল বৈঠকে কংগ্রেসের যাওয়া উচিত নয়। অর্থাৎ যে সংবিধান রচনা করবে পরাধীন দেশের দলগুলো তার গুরুত্ব শুধু প্রচারমুলক! দরকষাকষিও চলবে না!! গান্ধী হলেন শান্তির পক্ষে, আপোষের পক্ষে, গোল টেবিল বৈঠকের পক্ষে আর কম্যুনিস্টরা হলেন গণ আন্দোলন আর জঙ্গীত্বের পক্ষে--- এই ছিল সাধারণ ধারণা, শুধু সেদিন নয়, আজও। চিত্তরঞ্জন দাসকে লেখা মানবেন্দ্রনাথ রায়ের খোলা চিঠি থেকে নৈরাজ্যবাদী ঘরানা অনেকটা স্পষ্ট হয়। শুধু শ্রেণী বিশ্লেষণ, মৌলিক ও ন্যয্য দাবি আর জঙ্গীত্বের গুণকীর্তন। মহারাষ্ট্রের চরমপন্থী লবি যে প্রতিক্রিয়াশীল অথবা চিত্তরঞ্জন দাস এদের মধ্যে তুলনায় প্রগতিশীল সেটা যদিও এই দলিল স্বীকার করেছিল। কংগ্রেসের পরিবর্তনপন্থী বনাম বদল বিরোধীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব আসলে সম্ভ্রান্ত শ্রেণী বনাম মধ্যবিত্ত নৈরাজ্যবাদীদের দ্বন্দ্ব, এই সঠিক বিশ্লেষণ করা হল, বিশ্লেষণ হল এবার বদল আসবে জঙ্গীত্ব করে-- এই ছিল তাদের শিশুসুলভ ধ্যান ধারণা। কংগ্রেসের মধ্যে তারা যে তৃতীয় বিভাজনের প্রস্তাব দিয়েছে তাতে নৈরাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামের কোনো লাভ হলো কি? পরেও কংগ্রেসের নেতৃত্বে থাকা প্রতিটা গণ আন্দোলনের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ যখনই করেছে কম্যুনিস্ট দলিল, তখনই এই প্রশ্ন ঘুরে ফিরে এসেছে— কেন গান্ধীজী গোল টেবিল বৈঠকে যাচ্ছেন? ১৯৯৭ সালে হরকিষেণ সিং সুরজিৎ বলেছিলেন যে তাদের ভুল ছিল যে তারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর অভ্যুত্থানের জন্য অপেক্ষা না করেই, তার মধ্য দিয়ে কম্যুনিস্টদের উঠে আসার সম্ভাবনার কথা মাথায় না রেখেই, বার বার শুধু কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের যৌথ জাতীয় সরকারের জন্যই সচেষ্ট হয়েছিলেন। অর্থাৎ অভ্যুত্তান না হলে কংগ্রেস-লীগ-কম্যুনিস্ট যৌথ সরকারের কথা বলা যাবে না!! বহু দশক সংসদীয় গণতন্ত্রে রাজনীতি করার পরেও যখন সুরজিৎ এটা বলতে পারলেন তখন বুঝে নিতে হয় যে জঙ্গিত্বই তাদের স্বাক্ষর। আর স্বাধীনতা সংগ্রাম কালে এই চরমপন্থীদের সাথে চরম আত্মিক যোগাযোগ তাদের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপন করেছিল। কারণ সাম্প্রদায়িকতা রোগের বাহক হওয়া যায়, নিজেরা রুগী না হলেও। ভারতে সাপ্রদায়িকতার মূল বৈশিষ্টই হল, সংখ্যালঘুদের রাজনৈতিক ক্ষমতার ভাগ না দেওয়া। কমিউনিস্টরা সেই পথেই হাঁটলো।

    ৩) সাম্প্রদায়িক চরমপন্থা

    কংগ্রেস নরমপন্থীরা মর্লে মিন্টো সংস্কার প্রস্তাবিত মুসলিমদের জন্য পৃথক নির্বাচকমন্ডলীর বিরুদ্ধে যে কোনো মূল্যে রুখে দাঁড়াচ্ছেন না, আপোষ করছেন, সেটাই ছিল চরমপন্থীদের মূল আপত্তি। এহেন সাম্প্রদায়িকতার পক্ষে দাঁড়ালেন কমিউনিস্টরা। 

    চরমপন্থীরা মূলত সাম্প্রদায়িক ছিলেন এবং কমিউনিষ্টদের মত যারা তাদের সমর্থক ছিলেন তারাও সেই পাঁকে ডুবে যেতে থেকেছেন। যারা ফাঁসির মঞ্চে চড়লেন, যাঁরা আন্দামানে অমানুষিক অত্যাচার সহ্য করে পাগল হয়ে গেলেন, তাদের নামে এতবড় অভিযোগ আনতে স্পর্ধা লাগে বৈকি। আস্পর্ধা বললেও রাগ করবো না। কিন্তু সত্য এটাই যে চরমপন্থী অনুসীলন সমিতি হিন্দু ধর্মের স্তোত্র পাঠ করে সদস্য করতো, বার্তা হল মুসলিম সদস্য নেওয়া হবে না। যাদের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির মূল বহিঃপ্রকাশ ছিল যে তারা  রাজনৈতিক ক্ষমতার ভাগ মুসলিম এলিটদের কিছুতেই দেবেন না। রাজনৈতিক ভাগ পাবেন শুধু হিন্দু এলিটরা, এটা কেমন আদর্শ তাদের? তারা যদি স্রেফ এই কারণে নরমপন্থীদের বিরোধী হতেন যে নরমরা বিদেশী পণ্য বয়কট করছেন না বা গণ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে স্বরাজ চাইছেন না, তবে বলার কিছুই থাকতো না। কিন্তু চরমপন্থিদের বিরোধিতার মূল অক্ষ হয়ে গেল বঙ্গভঙ্গ, মুসলিম লীগ গঠন এবং মর্লে মিন্টো সংস্কার। বঙ্গভঙ্গ হলে মুসলিম এলিটদের কিছু সুবিধা হবে, তারা ক্ষমতার ভাগ পাবেন, এটাই তবে আপত্তি!? তবে তিলক যতই হিন্দু জাতীয়তাবাদের পুনরুত্থান চেয়ে থাকুন তিনি নিজে হিন্দু মহাসভার নেতা লালা লাজপত রাই বা বিপিন পালদের সমগোত্রীয় ছিলেন না। ১৯১৬ সালের হিন্দু মুসলিম চুক্তির অন্যতম স্বাক্ষরকারী ছিলেন তিলক এবং তিনি হিন্দু মহাসভা করেননি। তবে রাজনীতিতে তাঁর আশীর্বাদ ধন্য হয়েছিলেন হিন্দু মহাসভার পরবর্তিকালের নেতা মুনজে। 

    ১৯০৬ সালের কংগ্রেস অধিবেশনে বঙ্গভঙ্গকে প্রত্যাহার করাতে স্বদেশী ও বিদেশী পণ্য বয়কটকে ভাল চোখে দেখেনি নতুনভাবে সংগঠিত বাংলার মুসলিম সম্ভ্রান্তরা, যারা ক্ষমতার অলিন্দে ঢুকতে চাইছিলেন। ১৮৭১ সালের তথ্য অনুযায়ী ৯২ জন মুসলিম আর ৬৮১ জন হিন্দু সরকারি আধিকারিক ছিল। অন্যদিকে উকিল চিত্তরঞ্জন দাসকে প্রয়োজন ছিল চরমপন্থীদের। অরবিন্দ ঘোষকে তিনিই রক্ষা করেছিলেন। ফলে দেশবন্ধুর অনুরোধ মেনে কংগ্রেসের বাইরে থাকা চরমপন্থীরা দুই তিন বছর বাংলায় কোনো সন্ত্রাসবাদী কার্যক্রমে লিপ্ত হননি। কিন্তু তাবলে বেঙ্গল প্যাক্টকে সমর্থন করেছেন তেমন কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। প্রসঙ্গত বলে নেওয়া ভাল, চিত্তরঞ্জন দাস বেঙ্গল প্যাক্ট করে মুসলিম আসন চাইবেন এটা স্বাভাবিক, এটা ছাড়া বাংলায় তাদের পক্ষে জেতা সম্ভব ছিল না। কিন্তু নীতিগতভাবে যদি স্বরাজ পার্টি এই ধর্মনিরপেক্ষ নীতি গ্রহণ করতো তবে দেশের অন্য প্রান্তে, যেখানে স্বরাজ পার্টি আসন জিতেছিল সেখানেও আসন সংরক্ষণ মানা হতো।

    কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে কম্যুনিস্টরা থেকে গেলেন চরমপন্থীদেরই লেজুড়। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসকে দেওয়া কমিউনিষ্টদের খোলা চিঠিতে বেঙ্গল প্যাক্ট নিয়ে প্রায় কিছুই নেই, যতটুকু আছে সেটা সমালোচনামুলক। আর বিপরীতে সেই খোলা চিঠি সহ কম্যুনিস্টদের দলিলেগুলির ছত্রে ছত্রে রয়েছে ধর্মের ভিত্তিতে সব ধরনের রাজনৈতিক সংরক্ষণের বিরোধিতা, যা সেদিন তো বটেই আজও হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার অন্যতম ভাষ্য। একজন শিশুও জানে যে কংগ্রেসের গয়া বিভাজন হয়েছিল কাউন্সিল ভোটে দাঁড়ানোর জন্য, বাকি পার্থক্য অপ্রধান, কিন্তু কম্যুনিস্টদের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে কাউন্সিল ভোটের প্রসঙ্গ এসেছে নামমাত্র গুরুত্ব দিয়ে! এর অবশ্য কারণ আছে। কম্যুনিস্ট শক্তি এই বিভাজনে পরিবর্তনপন্থীদের পক্ষে ছিলেন, অথচ তারা নিজেরা ছিলেন সংসদীয় ভোট ব্যবস্থায় প্রবেশের বিরুদ্ধে। ফলে সত্য প্রকাশ করলে তাদের আর পরিবর্তনপন্থীদের পক্ষে থাকা হয় না। সাম্প্রদায়িক অবস্থানের বহিঃপ্রকাশ আমরা দেখলাম মোতিলাল নেহরু রিপোর্ট প্রসঙ্গে কম্যুনিস্ট অবস্থানেও। নেহরু রিপোর্ট এর পরিপ্রেক্ষিত টা একবার চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক।

    বঙ্গভঙ্গ রোখার প্রচেষ্টার নেপথ্যে ছিল মদন মোহন মালব্যের সভাপতিত্বে থাকা কংগ্রেসের হিন্দু সাম্প্রদায়িক অবস্থান। বাংলার মুসলিম উঠতি এলিটদের সাথে এই নিয়ে আলোচনার মধ্য দিয়ে কোনো রফায় পৌঁছানোর কোনো চেষ্টা করেনি কংগ্রেস। মুসলিম প্রতিনিধি দল পৃথকভাবে সাম্রাজ্যবাদের সাথে দরকষাকষি করার জন্য মুসলিম লীগ গঠিত হল, ফলস্বরূপ বৃটিশ মর্লে মিন্টো সংস্কার এলো। কংগ্রেসের সব নেতা, এদেশের হিন্দু রাজন্য বর্গ, জমিদার, উঠতি ব্যবসায়ীরা সেই সংরক্ষণ মেনে নিলে ভাগ করে শাসন করার সাম্রাজ্যবাদী উদ্দেশ্য সফল হতো না। তবে কংগ্রেসের মডারেট নেতৃত্ব সংরক্ষণের বিরুদ্ধে যুদ্ধংদেহী মেজাজ নিতে মোটেই রাজী ছিল না, আর পাঁচটা বৃটিশ নীতির মোকাবিলায় তারা এতকাল যা করে এসেছে তাতেই সন্তুষ্ট ছিলেন তারা। ফলে কংগ্রেসের হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তির ক্ষোভ বাড়ছিল। ধীরে ধীরে রাজ্যে রাজ্যে হিন্দু সভা তৈরী হল আর তার পরে হিন্দু মহাসভা। গান্ধীজী এসে মুসলিম মন জয় করার বার্তা দিলেন, ১৯১৬ সালে লখনৌ চুক্তি হল লীগের সাথে, যেখানে সংরক্ষিত আসন এবং মুসলিমদের পৃথক নির্বাচকমণ্ডলীকে লিখিতভাবে গ্রহণ করলো কংগ্রেস। তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলছে। দুটি বিপরীত মেরু শক্তিশালি হল ভারতে। এক, সশস্ত্র ধারা যারা বৃটিশ বিরোধী সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির সাহায্য নিচ্ছে, যারা দেশে মুসলিমদের ‘তোয়াজ’ করা মানতে চাইছে না, যাদের মধ্যে রয়েছে দ্বি-জাতি তত্ত্বের ঘোরতর সমর্থক ঘরানা। দুই, গান্ধীর ধারা যারা আসন সংরক্ষণকে মৌখিকভাবে বা লিখিত হলেও মেনে নিল এবং যাদের মূলমন্ত্র অহিংসা। অসহযোগ আন্দোলনে দেশের প্রথম ভোট বয়কট অন্তর্ভুক্ত ছিল, ভোটাধিকার যদিও সার্বজনীন ছিল না। এই ঘরানাগুলির শ্রেণী ভিত্তি আর ভোটাধিকার কেন সার্বজনীন নয় এটা নিয়ে কম্যুনিস্টরা সঠিকভাবেই অন্য দলের থেকে অনেক বেশী মাথা ঘামিয়েছেন। কিন্তু রাজনীতির নেতা হওয়া ইচ্ছা থাকলে তারা গান্ধীজীর সাথে মুসলিম মন জয় করার প্রতিযোগিতায় নামতেন। এই ভোট বয়কট ছিল নরমপন্থি কংগ্রেসের হিন্দু সাম্প্রদায়িক কর্মসূচী। মানবতার শত্রু খলিফা বাঁচানোর রাজনীতির বাধ্যবাধকতায় লীগকে ভোট বয়কট মানতেই হতো। কিন্তু মানবেন্দ্রনাথ রায়, মুজফফর আহমেদরা ধর্মনিরপেক্ষতার স্বার্থে বলতেই পারতেন যে বয়কট না করে মন্টেগু চেমসফোর্ডের মধ্য দিয়ে মুসলিমরা যে আসন সংরক্ষণ পেল, সেটা কাজে লাগাক তারা। গান্ধীজির সাথে মুসলিম মন জয় কোরার প্রতিযোগিতায় নামতে পারতেন কম্যুনিস্টরা। অথচ ১৯২০-র কংগ্রেসের নির্বাচন বয়কটে খুশী হয়ে ছিলেন কম্যুনিস্টরা বললেন, শুধু ইংরেজ তল্পিবাহক ছাড়া সকলেই নাকি প্রথম নির্বাচনটিকে বয়কট করেছেন। যেখানে নিন্দা করার কথা সেখানে তারা সমর্থক, আর শান্তির প্রশ্নে সমর্থক হওয়ার কথা সেখানে কম্যুনিস্টরা গান্ধী বিরোধী হয়ে থেকে গেলেন! স্বরাজ পার্টি হল কিন্তু তারা কংগ্রেস ত্যাগ করলেন না। কাউন্সিল নির্বাচনে স্বরাজ পার্টি ৪২ টা আসন পেল যা হরে দরে শেষ পর্যন্ত কংগ্রেস দলেরই আসন পাওয়ার সামিল হল। আর লীগের হাতে থাকলো পেন্সিল--- এই ঘটনাক্রমকে মুসলিম নেতারা এবং তাদের পেছনে থাকা মুসলিম সমাজ এক ধরণের চক্রান্ত হিসেবেই দেখবেন, এটুকু বোধও কম্যুনিস্টদের ছিল না? তারা হয়তো ভাবতেন মুসলিম শ্রমিক কৃষকের উপর লীগের এলিট নেতাদের কুপ্রভাবকে প্রশ্রয় না দিয়ে মোহমুক্ত করার এটাই বুঝিবা শ্রেষ্ঠ পন্থা। পরবর্তী ইংরেজ সাংবিধানিক কমিশনে ভারতীয় প্রতিনিধি ছিল না, তাই লীগ এবং কংগ্রেস সেই সাইমন কমিশনের সাথে আলোচনা বয়কট করলো। যদিও আম্বেদকার বয়কট না করে অস্পৃশ্যদের জন্য মুসলিমদের মতই পৃথক নির্বাচকমণ্ডলী দাবী করলেন। পেলেনও কিন্তু গান্ধীর অনশনের চাপে পুনে চুক্তির মধ্য দিয়ে সেই অধিকার খোয়ালেন, তবে আসন সংরক্ষিত হল। তবে লীগের সাথে একটি ঐক্যবদ্ধ বিকল্প সংবিধান বানানোর এলেম যে কংগ্রেসের নেই সেটা সাম্রাজ্যবাদ জানতো। মোতিলাল নেহরুর নেতৃত্বে কংগ্রেস একটি সংবিধান রচনা কমিটি গঠন করলো, যারা সর্বদলীয় বৈঠকে সেটা পেশ করবে। এহেন নেহরু রিপোর্টকে কেন্দ্র করে নবগঠিত কম্যুনিস্ট পার্টি যদি সঠিক পদক্ষেপ নিতে পারতো তবে তাদের হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার লেজুড়বৃত্তি করার অভ্যেস বদলে যেত। 

    ১৯২৯ সালে সারা ভারত ট্রেড ইউনিয়ন প্রায় ৫০ জনের একটা দল স্থির করলো যারা উপরোক্ত সর্বদলীয় কনভেনশনে যোগ দেবে। সাথে এই সিদ্ধান্তও নিলেন যে তাদের প্রস্তাবিত সংবিধান ঐ সর্বদলীয় বৈঠক মেনে না নিলে তারা বৈঠক পরিত্যাগ করবেন! অর্থাৎ কোনো রফায় আসবেন না তারা। তাদের দাবীগুলি খুবই ভাল ছিল। নেহরু রিপোর্টের দাবী থেকে অনেক ভাল। যেমন, পূর্ণ স্বরাজ, রাজন্য বর্গের অপসারণ, শিল্প ও জমির জাতীয়করণ, অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষা, সার্বজনীন ভোটাধিকার, কাজের অধিকার, বেকার ভাতা, মাতৃত্বকালীন সুবিধা, প্রতিক্রিয়াশীল শ্রম আইনে বদল। নেহরু রিপোর্টে এসব কেন নেই সেই সমালোচনা করেছেন কম্যুনিস্টরা — কিন্তু সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জন্য বা শ্রেণী ঐক্যের জন্য যে কথাগুলো বলার দরকার ছিল সেগুলোই উহ্য থেকে গেল। নেহরু রিপোর্টকে কেন্দ্র করে লীগ আর কংগ্রেসের মধ্যে যে মূল বিরোধ সেই প্রসঙ্গে কোনো কথা নেই!! অর্থাৎ ধর্মের ভিত্তিতে পৃথক নির্বাচকমণ্ডলী, সংখ্যালঘুদের আসন সংরক্ষণ, অঞ্চলের স্বশাসন--- এসব বিষয় কম্যুনিস্টদের কাছে গুরুত্বহীন। বরং ১৯২৮ সালের কম্যুনিস্ট দলিলে বলা হল যে সাম্প্রদায়িক সব সংরক্ষণ নাকি শ্রেণী ঐক্যের পক্ষে ক্ষতিকারক! ১৯৪২ সালে যে প্রশ্ন কম্যুনিস্টরা তুলেছিলেন, সেটা ১৯২৮ সালে বললে সেটা বরং সময়োচিত হতো। গান্ধীজী ভারতে এসে বললেন যে হিন্দু মুসলিম ঐক্য ছাড়া স্বাধীনতা আসবে না, অথচ সেই ঐক্য তৈরীর বদলে ক্রমেই লীগকে দূরে ঠেলে দেওয়া হল। এই বিচ্যুতির বিরুদ্ধে বামপন্থীরা শুধু নীরব নয়, বরং এই নরম হিন্দুত্ববাদী কৌশলের সমর্থক। এমনকি ম্যাকডোনাল্ড পুরস্কারের পরিপ্রেক্ষিতে গান্ধী যখন বলছেন যে "the separate electorate will create division among Hindus so much that it will lead to bloodshed. Untouchable hooligans will make common cause with Muslim hooligans and kill caste Hindus." সেদিনও কম্যুনিস্টরা নীরব!! প্রশ্ন করেননি যে কেন নেহরু রিপোর্ট পৃথক নির্বাচকমণ্ডলী বাতিল করলো? আর যদি করলোই তবে সমস্ত রাজ্যেই কেন আসন সংরক্ষিত হল না? কেন তিনটি বিষয় বাদে আর সব রাজ্যের হাতে তুলে দেওয়ার প্রস্তাব এলো না?  নেহরু রিপোর্ট লেখার পর্যায়ে মোতিলাল আর জিন্নাহর মধ্যে অনানুষ্ঠানিক আলাপচারিতা চলেছিল। জিন্নাহরা সিন্ধুপ্রদেশের পৃথকীকরণ চেয়েছিলেন, মোতিলাল মানেননি। তার বদলে সার্বজনীন ভোটাধিকার চালু হওয়া পর্যন্ত পাঞ্জাব ও বাংলায় সংরক্ষিত আসনে নাকি তিনি সম্মতি দিয়েছিলেন। রিপোর্টের প্রত্যুত্তরে জিন্নাহ যে ১৪ দফা দাবী পেশ করেন সেখানেই নির্দিষ্টভাবে সেই দাবিগুলি ছিল। জিন্নাহ মুসলিম লীগ দলকে বহু আভ্যন্তরীণ বিরোধিতা সত্ত্বেও বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন যে তাদের পৃথক নির্বাচকমন্ডলী থেকে সরে এসে রাজ্যগুলির স্বশাসনে জোর দেওয়া উচিত। কোনোটাই মানা হল না, লীগের মধ্যে জিন্নাহ-র মুখ পুড়লো। ঐ বছরকে জিন্না বিচ্ছেদের বছর (parting of ways) হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। নেহরু রিপোর্ট নিয়ে সর্বদলীয় বৈঠক ব্যর্থ হয়েছিল বলাই বাহুল্য। আর কম্যুনিস্টরা কংগ্রেসের এহেন সাম্প্রদায়িক অবস্থানের নিন্দা না করে বললেন, ইছে থাকলেও কমিটির (পড়ুন কংগ্রেসের) নেতারা সাম্প্রদায়িক নেতাদের (পড়ুন জিন্নাহ) আবদারগুলি বাতিল করতে পারেননি।

    সাম্প্রদায়িকতা রোগের এই বাহকের ভূমিকা চলতেই থাকলো। ১৯৩৬ সালে পার্টি প্রকাশিত একটি পুস্তিকায় ১৩৪টি সংরক্ষিত আসনকে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বহিঃপ্রকাশ হিসেবেই দেখানো হল। সিপিজিবির সদস্য ক্লিমেন্স দত্ত ‘লেবার মান্থলি’তে বললেন যে পৃথক নির্বাচনী ক্ষেত্রের মধ্য দিয়ে সাধারণ মুসলমানদের সঙ্গে হিন্দু গরীবের ঐক্য ব্যহত হচ্ছে। গান্ধীজির কথার প্রতিধ্বনি করে পরে তারা বলল, “----Communal electorates for the Moslems were accordingly established and the principle of divide and rule accepted as an integral part of representative government. Accordingly at the first Round Table Conference we find the principles of electorates for religious communities further extended by representation for the Sikhs, Indian Christians and the Depressed Classes. -- At length in July Mr. MacDonald found time, in an interval between conferences, to make his communal award. The Backward Areas apart, Whatever its immediate results may be for the depressed classes, it is therefore a retrograde step, which it were better had never been made.

    ৪) যুক্তরাষ্ট্র বিরোধিতা

    সিপিআইএম তৃণমূলের কাছে হেরে ভয়ানক ক্ষুব্ধ, তার একটা বড় কারণ হল তৃণমূল একটা আঞ্চলিক দল। জাতীয় দল কংগ্রেস বা জাতীয় দল বিজেপির কাছে হারলে ওদের হয়তো এত লজ্জা হতো না। এই আঞ্চলিক দলের প্রতি ঘৃণা আসলে হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার বহিঃপ্রকাশ। 

    সংবিধান সভার মাথা হিসেবে আম্বেদকার বলেছিলেন, “ভারতীয়দের মধ্যে সংবিধান নিয়ে একটাই বিরোধের জায়গা, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোটি কেমন হবে। যুগ্ম তালিকার বিষয়গুলো কি হবে, কেন্দ্রের হাতে যাবে নাকি রাজ্যের হাতে”। পরাধীন ভারতেও চিত্র ঠিক তাই ছিল। ৫-টা প্রভিন্সে ছিল মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠা। আর দুটোতে সংখ্যার বিচারে না হলেও ধনে মানে এলিট মুসলিমরা শক্তিশালী। ফলে হিন্দু মুসলিম ঐক্য (যা কার্যত হিন্দু এলিট এবং মুসলিম এলিটদের মধ্যে সাময়িক বোঝাপড়া, যেটুকু দাঙ্গা থামিয়ে দিতে বা দেশ ভাগও রুখে দিতে সক্ষম) গড়ে তুলতে হলে প্রভিন্সগুলোর ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং স্বশাসন দাবীতে ঐক্যমত জরুরী ছিল। তবে কেবল সেদিন পরাধীন দেশেই নয়, স্বাধীন ভারতে আজও রাজ্যগুলির ক্ষমতা বৃদ্ধি হলে এদেশে হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা কঠিন। স্বশাসন থাকলে একই সাথে প্রত্যেক রাজ্য আর কেন্দ্রেও একই দলের ক্ষমতায় থাকা জরুরী হয়ে যায় দেশ জুড়ে হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে হলে। ফলে ভারতে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলার সাথে রাজ্যের হাতে স্বশাসন বা যুক্তরাষ্ট্রের প্রসঙ্গ তোলা বাধ্যতামুলক হয়ে যায়। কমিউনিষ্টদের এটা লজ্জার যে তারাই প্রথম এদেশে যুক্তরাষ্ট্রের দাবি তুলতে পারেননি। জিন্নাহ তুললেন। সেই দাবিকে অন্তত সমর্থন করে অপরাধ লাঘব করা যেত। কম্যুনিস্ট দলের কোনো নীতিগত অসুবিধাও ছিল না, সোভিয়েত ব্যবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো, বিচ্ছিন্নতা সহ রাজ্যগুলির, জাতিসত্ত্বাগত অধিকার তত্ত্বগতভাবে স্বীকৃত। আর বাস্তবেও ততদিনে সোভিয়েত রাশিয়া এক দশকের জীবন কাটিয়ে দিয়েছে, এই অধিকার নিয়ে বহু ঘাত প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে। কিন্তু দেখা গেল কম্যুনিস্টরা কোনো স্পষ্ট অবস্থান নিতে পারলেন না, বলা ভাল একটা ১৯৪০/৪১ থেকে ৪৫- এই বছরগুলি ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর বিরুদ্ধে দাঁড়ালেন, কংগ্রেস নেতাদের মতই। তখন বাস্তব পরিস্থিতি ছিল এমনই যে আম্বেকারের কাছে বা জিন্নার কাছে ইংরেজরা কংগ্রেসের তুলনায় প্রিয়। দুই ক্ষেত্রেই পৃথক নির্বাচকমণ্ডলী বা আসন সংরক্ষণ দিয়ে কংগ্রেসের থেকে তাদের দূরে সরিয়ে দিয়েছে ইংরেজ শাসক। কংগ্রেসও পারেনি তাদের কাছে টেনে নিতে, কম্যুনিস্টরাও কেন পারলেন না, বদলে কংগ্রেসেরই লেজুড় হয়ে থেকে গেলেন তারা, দুর্ভাগ্য সেটাই! যদিও পি সি যোশী শেষ বেলায় সঠিকভাবেই ভাগ কর শাসন কর-র প্রকৃত স্বরূপ উদ্ঘাটন করেছিলেন। বলেছিলেন, “তোমরা ক্রীপসকে ব্রাত্য করলে আর ওয়াভেলকে নিয়ে আদিখ্যেতা করলে। ওয়াভেল তোমাদের বোকা বানালো। সে সফলভাবে ভারতীয় দলগুলির কাদা ছোঁড়াছুড়ি উন্মোচন করলো, সাধু সন্তের মতন সব দোষ নিজেদের কাঁধে তুলে নেওয়ার ভন্ডামি করে তোমাদের টা টা করতে করতে চলে গেল”। যাই হোক ভাগ কর শাসন কর-র আসল কথা এটি, বৃটিশরা স্রেফ ভারতের দলগুলির কাদা ছোঁড়াছুঁড়িকে উন্মোচন করে আর নিজের আসাধু সাজে। যাই হোক, যুক্তরাষ্ট্র থাকলে বহু দল থাকে, আঞ্চলিক দলগুলি গড়ে ওঠার সুযোগ পায়। আর বহু দল থাকলেই জোট সরকারের প্রয়োজন চলে আসে।  ১৯৪৫ সালে পি সি যোশীর মন্তব্য করেছিলেন যে সিমলা সম্মেলনে অন্যান্য দলকে, বঞ্চিত করে কংগ্রেস একাই ইংরেজদের থেকে ক্ষমতা নিতে ব্যগ্র যা দুঃখজনক। আম্বেদকারের সেই অভিযোগ তো বরাবরই ছিলই। আবার মুসলিম লীগের জন্মও এই অভিযোগ থেকে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের দাবী যত শক্তিশালী হতো ততই জোট সরকারের ভবিষ্যত অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠতো। দেখাও গেল যে পর্যায়ে  কম্যুনিস্টরা  যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে দাঁড়ালেন একমাত্র তখনই তারা কংগ্রেস-লীগ-কম্যুনিস্ট বিকল্প সরকারের প্রস্তাব সামনে এনেছিলেন। 

    কম্যুনিস্টরা কেন এভাবে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে দাঁড়ালেন? এর একটা বড় কারণ রাজন্য বর্গ। প্রভিন্সগুলির হাতে স্বশাসন হলে করদ রাজ্যগুলির স্বশাসনকে নৈতিকভাবে মেনে নিতে হবে। সাম্নততন্ত্র বিরোধী সংগ্রাম দুর্বল হবে এই আশংকায় তারা মুসলিম সম্ভ্রান্ত আবেগ বা মুসলিম জনতার আবেগের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গেলেন!! অথচ শ্রেনী ঐক্য, হিন্দু মুসলিম অঈকয় তৈরী না হলে রাজন্য বর্গ বিরোধী সংগ্রামও হবে না। আর বাস্তবে রাজন্য বর্গদের নেতৃত্বে থাকা সিপাহী বিদ্রোহকে প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ বলেছিলেন মার্ক্স। বা পরবর্তীকালে ভারতের কম্যুনিস্ট দলিল সেই বিদ্রোহকে সম্মান জানিয়েছে। ফলে রাজন্য বর্গদের বর্বর শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতেই হতো, সেই সব রাজত্বে প্রজাদের আন্দোলনের প্রচেষ্টা নিতেই হতো, কিন্তু বৃটিশ বিরোধী সংগ্রামে বিভিন্ন রাজন্য বর্গদের সাহায্যও নিতে হয়েছে বইকি, যেমন অত্যাচারী ভারতীয় মিল মালিক এবং অত্যাচারী জমিদারদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হয়েছে, আবার তাদের সাহায্যও নিতে হয়েছে।  হিন্দু মুসলিম ঐক্যের উপরই নির্ভর না প্যাটেলের উপর নির্ভর করা হয়েছিল বলে আজও বেশীরভাগ রাজা রাজপুত্র রাজরানীরা বিজেপি করেন। আর তাদের বায়না সামলাতে সরকারের নাভিঃশ্বাস উঠে গেছিল।  

    মৌলানা আবুল কালাম আজাদের ভূমিকা এক্ষেত্রে অত্যাশ্চর্য। একজন মৌলানা হয়েও যেভাবে তিনি পাকিস্তানের বিরোধিতা করে গেছেন আবার তার দলের ভেতরে যুক্তত্রাষ্ট্রের পক্ষে প্রায় নিঃসঙ্গ সংগ্রাম করে গেছে সেটা অতুলনীয়। যুক্তরাষ্ট্রকে সমাজতন্ত্রের বিপরীতে দাঁড় করিয়েছিলেন কংগ্রেসের মধ্যে এবং বাইরে থাকা বামেরা। সেটা নেতাজি-নেহরু হোক বা কম্যুনিস্ট পার্টির নেতারা হোক। রাজামহারাজাদের প্রীত করতেই যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর প্রস্তাব দেওয়া হচ্ছে এই আওয়াজ নেহরু বা সুভাষও তুললেন। সুতরাং, সমাজতন্ত্রের দিব্যি, এই কাঠামো মানা যায় না! মুসলিমদের নেতৃত্বে থাকা মুসলিম লীগ, দলিতদের নেতৃত্বে থাকা আম্বেদকার যখন কংগ্রেস ও গান্ধী সহ কংগ্রেস নেতৃত্বকে বর্ণ হিন্দুদের দল হিসেবে গণ্য করতে শুরু করে দিয়েছেন, তখন কম্যুনিস্টরাই কংগ্রেসের একমাত্র ভরসাস্থল। তাই সমাজতন্ত্রের স্লোগানে প্রীত কম্যুনিস্ট নেতৃত্ব কংগ্রেসের হরিপুরা অধিবেশনে সমর্থনের বার্তা পাঠালেন। রজনী পাম দত্তের প্রেরিত চিঠিটি ছিল এরকম--- The Haripura Session of the Congress will consider the question of the efforts of the Government to impose the Federal side of the Constitution….The question of the attitude of the vast mass of the Indian people towards the Federal Government will be decided, not by a formula satisfactory to certain elements in India and to the British Government, but by the Indian National Congress representing the vast masses of Indian people. The question of how this new stage of the fight will be conducted will depend largely on the strength of the Congress and the development of the mass movement…. The question is raised in this connection of the need to support the struggle of the people in the Indian States for democratic rights and civil liberties.

    আবার একই প্রসঙ্গে ত্রিপুরী কংগ্রেস নিয়ে বেন ব্র্যাডলির বক্তব্য, The question of Federation became the centre-point of these gathering issues within the movement. The Congress stood committed to a policy of resisting and preventing the introduction of the Federal Constitution, which would represent, not in any sense even a limited constitutional advance, but a strengthening of reaction and of the grip of imperialism in India. The acceptance of office in the Provinces was …not an acceptance of constitutionalism, but a stage of preparation for future mass struggle to win complete independence on the basis of a Constitution framed by a freely elected Constituent Assembly.

    গান্ধী আরিউন চুক্তি কালে সাখলাতওয়ালা স্বীকার করেছিলেন যে গোল টেবিল বৈঠকে মূলত diarchy নিয়েই বিরোধিতা আছে। অথচ এই বিতর্কে তাঁরা কোনো পক্ষ নিলেন না!! গান্ধীজী নিজে না গিয়ে সাপ্রুর মত কেন্দ্রিকতা পন্থী, আর মুঞ্জের মত মুসোলিনি পন্থীদের পাঠালেন লীগকে মোকাবিলা করতে। তারা অবিরাম দুর্বল রাজ্যের পক্ষে কথা বলে গেলেন আর লীগ শক্তিশালী রাজ্যের পক্ষে! তিনটি বৈঠকেই এবং সাইমন কমিশনের প্রস্তাবের একমাত্র যে বিষয়টি বার বার অমীমাংসিত থেকে যাচ্ছিল তা ছিল ঐ যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো, দুর্বল কে হবে— কেন্দ্র না রাজ্য, অথচ কম্যুনিস্টদের আপত্তি সেসব নিয়ে নয়, গোল টেবিল বৈঠকটা আদৌ হল কেন সেটা নিয়ে!! ১৯৩৬ সালে পার্টি প্রকাশিত একটি পুস্তিকায় বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের অধীনে থাকা যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর বিরোধিতা করা হল। অথচ ১৯৩৩ সালে কম্যুনিস্ট পার্টির কর্মসূচীতে ৩টি দাবীর মধ্যে প্রথমটি ছিল পূর্ণ স্বাধীনতা, দ্বিতীয়টি ছিল সোভিয়েত ধরণের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো। অর্থাৎ অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা না এলে এই ধরনের সংস্কারের কথা বলা যাবে না? 

    সংবিধানসভাতে জহরলাল নেহরু বলেছিলেন, ‘রাজ্য জনগণের স্বায়ত্ত্বশাসিত একক হিসেবে মর্যাদা পাবে, যুগ্ম তালিকা তারই থাকবে, কেন্দ্রের হাতে যে কটা ক্ষমতা থাকবে তার বাইরে সবই তার থাকবে। বা কোনো রাজ্যের জনগণ যদি নিজেদের জন্য স্বৈরতন্ত্র বা রাজতন্ত্র বেছে নেয় তাহলেও অপছন্দ সত্ত্বেও তা আমাদের মেনে নিতে হবে’। কিন্তু সংবিধান সভার আলোচনাতে নেহরু বা আম্বেদকার যাই বলুন না কেন, স্বাধীনতা সংগ্রাম জুড়ে তারা দুজনেই ছিলেন কট্টরভাবে যুক্তরাষ্টেরর বিরোধী, চূড়ান্তভাবে কেন্দ্রিকতার পক্ষে। ১৯২৮ সালে মুসলিম লীগ যখন হাজির করলো যে তিনটি বিষয় থাকবে কেন্দ্রের হাতে, বাকি সব অধিকার প্রভিন্সের হাতে, সেটুকু তো মানলোই না বরং নেহরু রিপোর্ট residual ক্ষমতা কেন্দ্রের হাতেই দিতে বললো! আর আগেই বলেছি, কম্যুনিস্ট দলিল অনুযায়ী নেহরু রিপোর্টের দোষ হল কেন আসন সংরক্ষণটাই বা আদৌ মানা হলো! 

    কম্যুনিস্টোরা ১৯৪১/২ সালে খুব স্পষ্ট করেই ভাষা-সংস্কৃতি-জাতির ভিত্তিতে তৈরী রাজ্যগুলির স্বশাসনে সম্মতি দিয়েছিল। লীগ আর কংগ্রেসের যুদ্ধ আসলে হিন্দু মুসলিম সম্প্রদায়ের বুর্জোয়াদের দ্বন্দ্ব, এই বিশ্লেষনের সঙ্গে কম্যুনিস্টরা যুক্ত করেছিল, “প্রভিন্সিয়াল অটোনমির ফলে বিভিন্ন ভাষা বা জাতির ভিত্তিতে যে রাজ্যগুলি তৈরী হয়েছিল সেখানে জনতার মধ্য একে ধরনের স্বাভিমান গড়ে উঠেছে, যেটা খারাপ নয়। আবার লীগও আগের মত মৌলবাদী নেই। কারণ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী মুসলিম জনতা কংগ্রেসের বদলে সেখানেই ভীড় করছে, আর লীগও জনতার চাপে পূর্ণ স্বাধীনতার দাবী তুলেছে… তারা এখন স্বাধীনতার দাবী আর সার্বজনীণ ভোটাধিকারের দাবীও তুলছে” । ১৯৪২ সালে যুদ্ধকালীন একটি যুদ্ধ তদারকির সরকার, যুদ্ধে শেষেই স্বাধীনতা আর রাজ্যের স্বশাসন, এই প্রস্তাব নিয়ে আসা ক্রীপস মিশনকে যখন গান্ধীজীরা জাপানের জয়ের আশায় প্রত্যাখ্যান করলেন, তখন কম্যুনিস্টরা ক্রীপস মিশনের বিরুদ্ধ্বে খুব প্রচার করেনি। ক্রীপস মিশনকে প্রত্যাখ্যান করা নিয়ে পি সি যোশীর বিদ্রুপাত্মক বিবৃতি আগেই দেখলাম আমরা।

    ১৯৩৭ সালে নির্বাচিত কংগ্রেস সরকারগুলির চূড়ান্ত দাদাগিরি, লিগের সাথে অসহযোগিতা, মুসলিম জনতাকে লীগের দিকে ঠেলে দিয়েছিল। একদিকে কংগ্রেস সরকারগুলো মুসলিমদের সাথে অন্যায় করছে আর অন্যদিকে কম্যুনিস্ট অসরফ কে কংগ্রেস নিয়োগ করছে জনসংযোগ কর্মসুচিতে। মুসলিম লীগের থেকে কংগ্রেসের দিকে টেনে আনার দায়িত্ব নিচ্ছে কম্যুনিস্ট পার্টি। সুতরাং কম্যুনিস্ট লীগ সম্পর্ক তলানিতে গিয়ে ঠেকছিল। এই পর্যায়ে কমিউনিস্টরা বললেন যে তারা পরাধীন ভারতে যুক্তরাষ্ট্রের ফর্মুলার বিরুদ্ধে। আরও বললেন, বৃটিশদের থেকে  চাকরি ভিক্ষে আর ক্ষমতায় ভাগ পাওয়ার জন্য যে প্রতিযোগিতা হচ্ছে তারই মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার উৎসমুখ। আবার অন্যদিকে 1938 সালে, মন্ত্রবরপল্লম অঞ্চলে সাম্প্রদায়িকতার ব্যাখ্যা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়  এবং কংগ্রেস লীগ ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা উঠে আসে। অর্থাৎ লীগ বিরোধী তীব্র বক্তব্য আর আন্দোলনের মধ্যেই লীগের গুরুত্ব তাদের চোখে বাড়তে শুরু করেছিল।

    ১৯৪০ সালের লাহোর কনফারেন্সের সিদ্ধান্ত মুসলিম সমাজে জনপ্রিয় হয়ে গেছিল। একমাত্র কম্যুনিস্ট পার্টিই কিন্তু অত্যন্ত দক্ষতার সাথে সেই সিদ্ধান্তকে দেশ অটুট রেখে বিচ্ছিন্নতার অধিকার সহ স্বশাসিত রাজ্যের দাবী হিসেবে ব্যাখ্যা করেছিল। আসলে ১৯৪০ সালের আগে কংগ্রেস ছিল তাদের কাজ করার একমাত্র মঞ্চ। কিন্তু জনতার ভীড় (1927 সালে লীগের সদস্য সংখ্যা ছিল 1330, আর ২০ লাখ হল 1944 সালে পৌঁছে) দেখে তারা লীগকে সার্টিফিকেট দিলেন। গঙ্গাধর অধিকারি, পি সি যোশী মনে করলেন কংগ্রেসেরই মত বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক মুসলিম লীগেও কাজ করা দরকার। গুরুত্ব দেওয়ার ফল হল অধিকারী থিসিস, যেটা নিয়ে রজনীপাম দত্তদের বিরোধ ছিল। সিমলা সম্মেলনে (১৯৪৫ সালের জুন মাসে, অর্থাৎ তখনো যুদ্ধ শেষ হয়নি), কম্যুনিস্ট পার্টী লীগ কংগ্রেসের জোট চেয়েছিল, যাতে আগামীদিনে জোট সরকার হতে পারে, কিন্তু যখন লীগ ছয়টা প্রভিন্স নিয়ে জেদাজেদি শুরু করলো কম্যুনিস্টরা বেঁকে বসলো। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এই অধ্যায়ে পেরিয়ে যে মুহূর্তে আবার ভোটের মুখোমূখি হল ভারতের দলগুলি, যেখানে কম্যুনিস্ট পার্টিও অনেক প্রার্থী দিয়েছিল (৮ টা আসনও জিতেছিল), তখন তাদের আবার লীগ বিরোধিতায় নামতে হল। রজনী পাম দত্ত বললেন লীগ হিন্দু মহাসভা গোত্রের দল, এর সাথে কংগ্রেসের মিল খুঁজতে যাওয় বৃথা। পাকিস্তান ধর্মের ভিত্তিতে চাওয়া রাষ্ট্র, এর সাথে জাতি বা জাতীয়তার সম্পর্ক নেই। এবং একই সাথে আবার তারা নামলেন যুক্তরাষ্ট্র বিরোধিতায়। যা আমরা ক্যাবিনেট মিশনের কাছে দেওয়া তাদের স্মারক লিপি থেকেই বুঝতে পারি।

    ১৯৪৬ সালে এলো শেষ ভবিষ্যত সংবিধান টিম---ক্যাবিনেট মিশন। বহু মুসলিম ও অমুসলিম গণতান্ত্রিক অংশের বহুদিনের ভাবনার মিল পাওয়া গেলো ঐ প্রস্তাবে। মৌলানা আজাদের নেতৃত্বে কংগ্রেসকেও এই প্রস্তাবকে লিখিতভাবে সমর্থন করলো। কিন্তু আচমকা নেহরু-প্যাটেল, আজাদ ইঙ্গিত করছেন যে গান্ধীজীর সমর্থন ছাড়া যা সম্ভব ছিল না, সাংবাদিক সম্মেলন করে জানিয়ে দিল আগে স্বাধীনতা পরে সংবিধান। এবার মুসলিম লীগকে দূরে সরাতেই শুধু নয়, এমনকি মৌলানা আবুল কালাম আজাদকেও আগামী প্রধানমন্ত্রীত্ব থেকে দূরে রাখতে যে নাটক হয়েছিল তা সকলেই জানেন। কম্যুনিস্টদের স্মারকলিপি কি বলেছিল?

    ১৫ই এপ্রল, ১৯৪৬ সালে ক্যাবিনেট মিশনের কাছে দেওয়া কম্যুনিস্টদের স্মারকলিপি অনুযায়ী সার্বজনীণ ভোটাধিকারের ভিত্তিতে সংবিধান সভার দাবি করা হয়েছিল। ধর্মের ভিত্তিতে রাজ্য ভাগ হবেন না, ভাষা আর জাতির ভিত্তিতে নতুন করে রাজ্যগুলিকে তৈরী করা হোক। বাউন্ডারি নতুন করে তৈরী হোক। সোমনাথ লাহিড়ি যিনি কম্যুনিস্টদের পক্ষ থেকে একজন সংবিধান সভার সদস্য ছিলেন যে প্রস্তাব পেশ করেছিলেন তাতে ভারতের প্রভিন্সগুলির সীমানা নতুন করে তৈরী করার জন্য বাউন্ডারি কমিশনের প্রস্তাব দেন। স্মারকলিপিতেও ভাষার ভিত্তিতে কেরালা, তামিলনাড, অন্ধ্রপ্রদেশ, কর্ণাটক, মহারাষ্ট্র, গুজরাট, রাজস্থান, হিন্দুস্থান, সিন্ধ, বালুচিস্তান, পাঠানল্যান্ড, উড়িষ্যা, বিহার, বাংলা, আসাম, পশ্চিম পাঞ্জাব, পাঞ্জাব আর কাশ্মীর—রাজ্যের প্রস্তাব দেওয়া হল। রাজন্য বর্গদের জন্য কোনো বিশেষ সুবিধার প্রস্তাবকে খারিজ করলেন কম্যুনিস্টরা। যদিও আমরা দেখেছি রাজন্য বর্গদের জন্য তেমনই ‘সু’ব্যবস্থা হয়েছিল, মুসলিম এলিট মারফত মুসলিম জনতাকে সেই সুবিধা দিতে রাজী হয়নি কংগ্রেসের নেহরু, গান্ধী, প্যাটেল। রাজ্যগুলির বিচ্ছিন্নতার অধিকারের কথা বললেও স্বশাসনের ক্ষেত্রে রেসিডুয়াল অধিকার কার হাতে থাকবে, যুগ্ম তালিকা কার হাতে থাকবে এই প্রসঙ্গে কোনো কথা সুনির্দিষ্ট নেই স্মারকলিপিতে।  সব থেকে বড় কথা মুসলিম লীগ ক্যাবিনেট প্রস্তাবে সমর্থন দিয়ে স্বাধীন দেশের দাবী থেকে সরে এসেছে। এই অবস্থায় নেহরুদের এই অনৈতিক প্রত্যাখ্যানকে নিন্দে করেছে কম্যুনিস্ট দল তেমন কোনো প্রমাণ নেই। বরং পরোক্ষে সমর্থনসূচক বিবৃতি পাওয়া গেছে।  যা শদুহু ভ্রান্তি নয় চরম সাম্প্রদায়িক অপরাধ হিসেবেই গণ্য হবে ইতিহাসে।

    ৫) রুটি রুজির সংগ্রাম

    আজও বামপন্থীরা ধর্মনিরপেক্ষতার সংগ্রামের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সংগ্রামকে যুক্ত করতে দ্বিধাগ্রস্ত। সাম্প্রদায়িকতাকে রুটি রুজির সংগ্রাম দিয়ে মোকাবিলা করতে চাই আমরা। রুটি রুজির সব ঐক্যেই ভেঙে যায় পরিচিতি সত্ত্বার রাজনীতির মধ্য দিয়ে, এই অ আ ক খ-ও কি করে ভুলে যাই আমরা? এমনকি বিপ্লবের পরই ঐক্য ভেঙে যেতে দেখেছি আমরা। মেহনতী জনতা বিভক্ত হয়ে পড়ে বিভিন্ন পরিচয়ে। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামও যার জ্বলজ্যান্ত প্রমাণ। ২০-র দশকে কৃষক শ্রমিকের সংগ্রাম, আর তার পরেই দাঙ্গা। ৩০-র দশকের উচ্চতর ঐক্যের সংগ্রাম আবার দাঙ্গা। উত্তাল দল্লিশ, এমনকি নৌবিদ্রোহে একই সাথে উড়লো লীগ কংগ্রেস আর কম্যুনিস্ট ঝান্ডা, আর তার পরই দাঙ্গা। অথচ সুনীতি ঘোষ বলছেন , The solution of the communal problem lay in the lasting revolutionary unity of the people against imperialism and its native allies— কিন্তু এই lasting ঐক্য কি আদৌ সম্ভব? অথচ এই কথার আগেই তিনি বলেছেন, জনতাকে তার স্ব স্ব পরিচিতি সত্ত্বার মাতব্বরা পরিচালিত করে, নিজেদের আর্থিক ও রাজনৈতিক লিপ্সার সংগ্রামে জনতাকে জড়িয়ে নেয়, এবং পরস্পরের বিরুদ্ধে লেলিয়েও দেয়। ফলে যতদিন এই মাতব্বর সমাজ থাকবে, অর্থাৎ শ্রেণী বিভাজন থাকবে শ্রেণী ঐক্য যেমন হবে আবার সেটা ভাঙবেও। আর যখন শ্রেণীই থাকবে না তখন শ্রেণী ঐক্যই অবান্তর হয়ে যায়। এই ভ্রান্তি আজও বয়ে নিয়ে চলেছে বামপন্থীরা। বোঝাই যাচ্ছে পরাধীন আমলেও কম্যুনিস্ট পার্টি এটাই করার চেষ্টা করছিল, অবাস্তব দীর্ঘস্থায়ী শ্রেণী ঐক্য।   সেই শ্রেনী সংগ্রাম গড়ে তুলতে গিয়ে কখন যে হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার খপ্পরে পড়ে গেছিলেন তারা বুঝেই উঠতে পারেননি। 

    আজও আমাদের মত বামপন্থী উদারবাদীদের মুখস্থ বুলিতে রুটি রুজির সংগ্রামী ঐক্য ছাড়াও আসে আর একটি কথা, সাংস্কৃতিক সামাজিক মেলামেশা। আমাদের নাকি নিজেদের ইতিহাস থেকে শিখতে হবে যে রাজস্থানের মন্দিরের স্থাপত্যে জৈন প্রভাব আছে। অথবা মুসলিম রাজত্বের দান যে সারেঙ্গি, যা হিন্দু মার্গ সঙ্গীতের অপরিহার্য অংশ, সেই শিক্ষা দানে মনোনিবেশ করতে হবে। যেন বা রাজনৈতিক ক্ষমতার ভাগ না থাকলেও স্রেফ সম্প্রীতির শিক্ষা থাকলেই লোকে আর বিজেপির প্রার্থী হবেন না!!  
    স্বাধীনতার পর ১৯৪৭ সালে কম্যুনিস্ট পার্টির পাঞ্জাব ইউনিটের অক্টোবর মাসের রেসোলিউশোন অনুযায়ী "the Punjab the land of Lala Lajpat Rai, the Punjab that gave India Iqbal"… কি আশ্চর্য যে দুজনের নাম নেওয়া হয়েছিল তারা দুজনেই ছিলেন দুই জাতি তত্ত্বের প্রবক্তা। লালা সম্ভবত ভারতে প্রথম হিন্দু মুসলিম সমাজকে দুই জাতি হিসেবে চিহ্নিত করেন আর ইকবাল জিন্নাহকে ধর্মনিরপেক্ষ অবস্থান থেকে মৌলবাদী অবস্থানে নিয়ে আসার অন্যতম ভূমিকা নিয়েছিলেন। ইকবালই তাকে উৎসাহ দিয় পৃথক দেশ ও রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানের সম্ভাবনা ঊর্দ্ধে তুলে ধরেন। ইকবাল বলেন, আর্থিক নীতি মুসলিমদের কাছে একমাত্র দুশ্চিন্তার বিষয় নয়। অন্ন বস্ত্র বাসস্থান থেকেও কখনও কখনও তাদের কাছে হয়ত বেশী জরুরী। জহরলাল যখন বার বার সমাজতন্ত্রের প্রসঙ্গ তুলেছেন ইকবাল বিদ্রুপ করে বলেছেন,  হিন্দুদের সাথে সমাজতন্ত্রের সম্পর্ক হিন্দুদের সাথে বৌদ্ধদের সম্পর্কের মতই।  শ্রীমানবেন্দ্রনাথ রায় ১৯৩৪ সালে সংবিধানসভার কথা তুলেছিলেন বটে, কংগ্রেস সমাজতন্ত্রীদের সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করার সিদ্ধান্তে তা দরকারও ছিল। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই আবার শ্রেণী সংগ্রামের সুযোগ তৈরী হতেই তারা অভ্যুত্থানের ডাক দিয়ে ফেলেন বা সেরকম ইঙ্গিত করেন, যে অপরাধে সিএসপি থেকে বহিষ্কৃতও হয়ে যান।

    ভাবতেও খারাপ লাগে স্বাধীনতার পরের দুটি ভোটে কমিউনিষ্টদের চমকপ্রদ ফল থাকা সত্ত্বেও ১০০ বছর পর কম্যুনিস্টরা আজ বিলীয়মান আর আর.এস.এস সেই শতবর্ষে দেশকে হিন্দু রাষ্ট্র বানানোর তোড়জোড় করছে।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • আলোচনা | ২১ আগস্ট ২০২৫ | ৫৩ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Manali Moulik | ২১ আগস্ট ২০২৫ ২১:১৬733546
  • অসাধারণ একটি বিশ্লেষণ পড়ে অনেককিছু জানতে পারলাম। অমূল‍্য তথ‍্যে সমৃদ্ধ সুগভীর প্রবন্ধটি পড়তে সুযোগ করে দেওয়ার জন‍্য  প্রথমেই আন্তরিক শ্রদ্ধা জানাই। 
    কয়েকটি বিষয় একটু খটকা লাগার জন‍্য কিছু বিনম্র প্রশ্ন রাখছি।
    ১.'বঙ্গভঙ্গ রোখার প্রচেষ্টার নেপথ‍্যে ছিলো মদনমোহন মালব‍্যের সভাপতিত্বে থাকা কংগ্রেসের হিন্দু সাম্প্রদায়িক অবস্থান।'   -- এই বঙ্গভঙ্গ মূলত ছিলো ব্রিটিশের একটি কৌশল  যাতে স্বাধীনতা সংগ্রামের আঁতুড়ঘর বঙ্গপ্রদেশকে দ্বিধাবিভক্ত করা যায়। তাই তৎকালীন জ্ঞানীগুণী মনীষী এবং সকল সচেতন মানুষ এর বিরোধিতা করেন। বঙ্গভঙ্গ রোখার প্রচেষ্টা যদি কংগ্রেসের 'হিন্দু সাম্প্রদায়িক অবস্থান' হয়, তবে কি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর,রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী,শ্রী হীরেন্দ্রনাথ দত্ত প্রমুখও সেই ধারাতেই পড়ছেন? রাখীবন্ধন উৎসবও কি কোনো 'সাম্প্রদায়িকতার নিদর্শন'? 
     
    ২.'গান্ধীজীর সঙ্গে মুসলিম মন জয় করার প্রতিযোগিতায় নামতে পারতেন কমিউনিষ্টরা'   -- তবে কি গান্ধীজীর "ঈশ্বর-আল্লাহ তেরে নাম/সবকো সম্মতি দে ভগবান!"  কোনো মন জয়ের মন্ত্র? যদি তাই হয় তবে একদিকে চরমপন্থী হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার প্রতিষেধক হিসাবে মুসলিম জনতার মন জয় করা উচিত ছিলো। এটিকে 'competitive communalism' ছাড়া আর কিছু কি বলা যেত?
     
    ৩. 'চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনের পর বহু সদস‍্য কমিউনিষ্ট হয়েছিলেন,কিন্তু তাঁদের পূর্বের সন্ত্রাসবাদী মন-মানসিকতা ধ্বংস করার চেষ্টা করা হয়নি।' --- সুতরাং এই যুক্তিতে স্বয়ং মাষ্টারদা সূর্য সেন ছিলেন সন্ত্রাসবাদী? হ‍্যাঁ, ব্রিটিশের চোখে সেটা তো অবশ‍্যই ছিলো। কিন্তু তৎকালীন পরাধীন দেশমাতৃকার মুক্তির জন‍্য দুঃসাহসী ও সুসংগঠিত পথে আত্মত‍্যাগী বিপ্লবী আজও ব্লগপোষ্টে 'শিশুসুলভ' আখ‍্যা পেলেন দেখে কেমন একটা লাগলো!  
    প্রসঙ্গত:, বঙ্গভঙ্গের আগে থেকে পূর্ববঙ্গের ছোটোলাট বামফিল্ড ফুলার মুসলিমদের বোঝাতে থাকেন যে হিন্দুরা চাকরির ক্ষেত্রে সুবিধা পাচ্ছে,তাই বঙ্গভঙ্গ হলে তাদেরই উন্নতি হবে। সুতরাং সাম্প্রদায়িক বিভাজন প্রশ্নে মুসলিমরা ফুলারের কাছে 'সুয়োরানির আদর' পেতে শুরু করে।কিন্তু বঙ্গভঙ্গের মূল উদ্দেশ‍্য কি সত‍্যি সংখ‍্যালঘুদের সুবিধাদান ছিলো? 
     
    পরিশেষে বলি, ক‍্যাবিনেট মিশন যখন ১৯৪৬ সালে পুনরায় তিনজন সদস‍্য নিয়ে আসে, তাঁদের মধ‍্যে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্লিমেন্ট অ‍্যাটলির সচিব প‍্যাথিক লরেন্স, অ‍্যাডমিরাল এ.ভি.আলেকজান্ডার সহ স‍্যার স্ট‍্যাফোর্ড ক্রিপসও ছিলেন। এবারের সুপারিশগুলি দেখে মৌলানা আবুল কালাম আজাদ মন্তব‍্য করেন , "ক‍্যাবিনেট মিশন যা প্রস্তাব করছে,বিভাজন-সমস‍্যার এর চেয়ে ন‍্যায‍্য সমাধান আর হয় না।" তবে কি এক্ষেত্রেও সংখ‍্যালঘুদের পিছনে ঠেলার প্রশ্নটি তোলা যায়? যদি কেউ বলে,  'আমি চাই না বাড়িতে কফি হোক!" বললেই বোঝা যায় যে সে চায়ের ভীষণরকম ভক্ত ?  নাকি দুটি ধারণা সম্পর্কবিযুক্ত? হতে পারে বাড়িতে ক‍্যাফিনযুক্ত কোনো পানীয়ই  সে পছন্দ করে না। 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ঠিক অথবা ভুল মতামত দিন