এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  আলোচনা  রাজনীতি

  • রামমোহন থেকে বিবেকানন্দ -- সাম্রাজ্যবাদী সমীকরণে বদল ও প্রভাব

    Barnali Mukherji লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | রাজনীতি | ১০ জানুয়ারি ২০২৫ | ১৩১৩ বার পঠিত | রেটিং ৪ (৩ জন)
  • সাম্রাজ্যবাদের আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব কখনো রামমোহন রায়ের সাফল্য এবং বিদ্যাসাগর, অক্ষয় দত্ত সহ এক ঝাঁক উদার যুক্তিবাদী তারকার উঠে আসার পিছনে বড় ভূমিকা নিয়েছে, আবার সেই দ্বন্দ্বই স্বামী বিবেকানন্দর হিন্দু পুনরুত্থানে সাহায্য করেছে। ১৮২০ সাল থেকে ভারতে বিধবা বিবাহ আইন প্রচলন পর্যন্ত একটি অধ্যায় এবং সিপাহী বিদ্রোহ ও তার পর চিকাগো ধর্ম সম্মেলন পর্যন্ত আর এক অধ্যায়। রাধাকান্ত দেবের সময়ে হিন্দু পুনরুত্থান না হওয়া এবং স্বামী বিবেকানন্দের হাত ধরে সেই কাজটি সম্পন্ন হওয়ায় আন্তর্জাতিক প্রভাব আজ এই আলোচনার বিষয়।

    আঠারশ শতকের শেষ বেলায় উইলিয়াম কেরি সহ ইংরেজ মিশনারি ত্রয়ী শ্রীরামপুরে আশ্রয় নিয়েছিলেন কারণ তাদের খ্রীষ্ট ধর্ম প্রচার প্রসারের অনুমতি ড্যানিশ উপনিবেশ দিতে পারত, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী নীতিতে যার অনুমতি তখন ছিল না। রামমোহন রায়কেও ওই পর্যায়ে শ্রীরামপুরের ভরসায় থাকতে হয়েছে। অথচ ১৮১৫ সাল সমীকরণে বদল আনল, ইউরোপ থেকে ভারতে। এদেশে, বাংলায় রেনেসাঁ সেই বদলের চিহ্ন বহন করেছে। আবার একইভাবে ক্রিমিয়ার যুদ্ধ পরবর্তী বদল নিয়ে এল ইউরোপে এবং ভারতে। বিদ্যাসাগরের পরাজয়, রামকৃষ্ণ দেবের উত্থান যার সাক্ষী। আবার সাম্রাজ্যবাদী দুনিয়ায় মার্কিন উত্থান বদল এনে দিল ভারতে। স্বামী বিবেকানন্দ আবার যার প্রতিফলন। 

    ১৮১৫ থেকে ১৮৫৭, বিদ্যাসাগরদের উত্থান

    ১৮১৫, নেপোলিয়ন যুগ শেষ করে ইয়োরোপ মেটারনিক পর্বে প্রবেশ করলো। শ্রেণী সংগ্রামে ইয়োরোপ উত্তাল হল, তাদের দমনও করা হল। পুঁজিবাদ, যার মুখ ছিল ইংল্যন্ড, সে ইয়োরোপে থিতু হল। ১৮২৯ সালে বৃটিশ পার্লামেন্ট নিজেদের দেশের সংখ্যালঘু খ্রীস্টানদের, অর্থাৎ ক্যাথলিকদের সরকারি পদে আসীন হওয়ার এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে দাখিল হওয়ার উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করলো। ১৮৩৩ সালে নিজেদের উপনিবেশগুলিতে দাস প্রথাকে নিষিদ্ধ করেছিল বৃটেন। এই বছরেই কারখানায় কর্মরত মহিলা আর শিশুদের কাজের সময় বেঁধে দেওয়া হল। গরীবদের সামাজিক সুরক্ষার জন্য আইনে বদল এলো, ১৮৩৪ সালে। এই সবই ইয়োরোপ জুড়ে শ্রমজীবিদের উত্তাল আন্দোলন, গণতান্ত্রিক চেতনার জয় আবার সেই আন্দোলনগুলি দমনের প্রতিফলনও বটে। সব শেষে ১৮৫৫-সালে পৌঁছে শুরু হল শাসক হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত পুঁজিবাদের কয়েক দশকের অবিচ্ছেদ্য স্বর্ণ যুগ, বুর্জোয়াদের হাত দিয়েই সংস্কারের যুগ। ভোট (সীমিত), সংসদ, লিখিত সংবিধান, মুক্ত সংবাদপত্র, এই সব অধিকার একে একে চলে এলো। ইংল্যন্ড কিছুদিনের জন্য নিজের সব পুঁজিবাদী প্রতিদ্বন্দ্বি দেশকে অনেক পেছনে ফেলে এগিয়ে গেলো। ১৮৩১ সালের মধ্যে ইংল্যন্ড শিল্পোৎপাদনে মোট উৎপাদনের ৬০%-এ পৌঁছে গেছিল, যা ১৮৭১ সালের মধ্যে ৭৩%-এ বিকশিত হয়েছিল, যেখানে ফ্রান্স ১৮৭১-এও ছিল ৫৫%। ইংল্যন্ডে ১৮৭০-এ শিল্পের সঙ্গে যুক্ত শ্রমজীবীরা ছিলেন ৫৫% আর ফ্রান্সে তখনো তা ৩৭%। ইংল্যন্ডে শহুরে জনসংখ্যা ১৮৫১ সালে ৫২%, ফ্রান্সে ২৫%। মোদ্দা কথা ১৮১৫ থেকে ১৮৫৫ এই সময়ে বৃটিশ শাসকদের প্রতিদ্বন্দ্বি সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সাথে যুদ্ধের বদলে শ্রমজীবিদের সাথে ‘গৃহযুদ্ধেই’ মনোনিবেশ করেছে, বলা ভাল ঘর গুছিয়েছে। কিন্তু ১৮১৩-র আগে ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদকে অনেক সাবধানে চলতে হয়েছে। ভারতের মাটিতে সেই dynamics এরই প্রতিফলন দেখা গেছিল।  

    এদেশে ডাচ আর ফরাসী সাম্রাজ্যের অধীনে বহু অঞ্চল ছিল এবং তারাও বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানির মতোই রাজন্যবর্গের সাথে বোঝাপড়া করে চলছিল। সিরাজদৌল্লার বিদ্রোহ ও পলাসীর যুদ্ধ ছিল যার জ্বলন্ত উদাহরণ। ভারতের রাজন্যবর্গদের পাওয়ার জন্য ফরাসী ও ডাচ সাম্রাজ্যবাদও নানা টোপের ব্যবস্থা রেখেছিল। ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানি বা খ্রিস্টান বৃটিশরা হিন্দু মুসলিম ধর্মে নাক গলাচ্ছে, খ্রিস্টান মিশনারীদের সাহায্যে হিন্দুদের ধর্মান্তরিত করা হচ্ছে, এই প্রচার করতে ফরাসী বা ডাচ শাসকদের কোনো অসুবিধা ছিল না। ফলে এদেশের ভূমিপুত্র সামন্ত শাসকদের নিজেদের দিকে টানতে হেস্টিংস ১৭৭২ আর পরে আবার ১৭৮০ সালে আইন বানালেন যে উত্তরাধিকার, বিবাহ ইত্যাদি ক্ষেত্রে হিন্দুরা চলতে পারবেন হিন্দুশাস্ত্র মতে। আর মুসলমানেরা চলতে পারবে ইস্লামিক আইন মেনে। যদিও এর ফলে ইংল্যান্ডের গণতান্ত্রিক শক্তি, যাদের মধ্যে বেশ কিছু ধর্মীয় পাদ্রীও অন্তর্ভুক্ত, যারা ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদী লুটেরা সরকারের মৌখিক ঘোষণায় বিশ্বাস করেছিলেন। তারা সত্যিই চেয়েছে ভারতের মেয়েদের উন্নতি করতে, জাতপাতপ্রথাকে নিশ্চিহ্ন করতে। ফলে  তারা ব্রিটিশ দের এই নতুন আইনে আপত্তি তুলতে শুরু করলেন। আবার অন্যদিক পাদ্রীতন্ত্রও নিজেদের স্বার্থে বিক্ষোভে ফেটে পড়লো, চার্চ অব্‌ ইংল্যন্ডের সাথে বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানির ও সংসদের বিরোধ পেকে উঠলো। 

    কিন্তু নিজেদের ঘরোয়া বিরোধকে বাড়তি গুরুত্ব দিয়ে উপনিবেশ নিয়ে ছেলেখেলা করার ক্ষমতা সাম্রাজ্যবাদের নেই। ১৮১০ সালে ভেলোরে যে সিপাহী বিদ্রোহ (হিন্দু সৈন্যদের কপালে তিলক কাটা চলবে না আর মুসলিমদের দাড়ি রাখা চলবে না, ইংরেজদের এই নির্দেশের বিরুদ্ধে) হয়েছিল, ইংরেজ শাসকদের সন্দেহ ছিল যে তার পিছনে ফরাসী জেনেরাল ডুখানের (decaen) হাত আছে। ফরাসীরা যেমন টিপু সুলতানের সঙ্গে সহযোগিতা করতে চেয়েছেন তেমনই বৃটিশ অনুগ্রহপ্রাপ্ত অন্যান্য রাজাদের সাথেও ফরাসীরা যোগাযোগ রাখতো। ত্রানজোর রাজ্য থেকে ডুখানের চরদের গ্রেপ্তার করেছিল ইংরেজ শাসকরা। 

    ফরাসি, ডাচ শক্তির মুখ বন্ধ করতে তাই পাদ্রীদের আসা যাওয়াতে নিয়ন্ত্রণ শুরু করলো বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ। কিন্তু সেটাও কাজে লাগালো প্রতিদ্বন্দ্বি সাম্রাজ্যবাদী শক্তি। যে সব ইংরেজ পাদ্রীরা এদেশে আসতে চাইছিল অথচ তাদের বৃটিশ জাহাজ জায়গা দিতে রাজী ছিল না, ওলন্দাজ, ড্যানিশ বা ফরাসীদের জাহাজেই তারা এদেশে আসতো। যেমন উইলিয়াম কেরি। উইলিয়াম কেরিকে প্রাথমিকভাবে আশ্রয় দিয়েছিল ডাচ এবং ড্যানিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি, শ্রীরামপুরে। রামমোহন রায় ও কেরিদের সতীদাহ বিরোধী আন্দোলন তাই ওলন্দাজ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সাহায্য পেয়েছে, পাওয়ারই কথা। বৃটিশদের বিপদে ফেলাই তাদের লক্ষ্য। কিন্তু তাদের আশা চুরমার করে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ যেমন ইয়োরোপে ১৮১৫ সালে ফরাসী সাম্রাজ্যবাদকে পরাজিত করেছে, ভারতেও তাই করলো। ওলন্দাজ আর ফরাসীদের মাথা নোয়াতে হয়েছে ১৮১৬-র মধ্যেই। যতদিন বহির্শক্তির বিপদ ছিল, ধর্মীয় সংস্কারের ঝুঁকি বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ নেয়নি। কিন্তু ফরাসি ডাচদের মাজা ভেঙে দেওয়ার পর তাদের আর সেই বিপদ ছিল না, বরং ঘরের মধ্যে নানা মহল থেকে যে ক্ষোভ ধূমায়িত হচ্ছে তা সামলানো ছিল তাদের প্রধান চ্যালেঞ্জ। শুধুমাত্র পাদ্রী শিবির ও গণতান্ত্রিক স্বরই নয়, ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানির বাইরে যে কম্পানিগুলি ছিল, যারা দীর্ঘদিন যাবত ইয়োরোপে ওলন্দাজ ও ফরাসীদের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাদেরও চাপ বাড়লো। নতুন চার্টার হল, এবং ১৮১৩ সালের পর থেকে ইস্ট ইণ্ডিয়া কম্পানির যে বিধিনিষেধগুলি ছিল পাদ্রী নীতির ক্ষেত্রে তা শিথিল করা সম্ভব হল। ফলে যেদিন ফরাসী আর ডাচ সাম্রাজ্যকে কোণঠাসা করা গেল তখনই কেরিকে বা রামমোহন রায়কে, ইংল্যন্ডের সতী দাহ বিরোধী জনতাকে সন্তুষ্ট করার সাহস ইংরেজ শাসকরা পেলো। ইংল্যন্ডের সব শিল্পপতিকেই ভারতে প্রবেশাধিকার দেওয়া হল, এবং উইলিয়াম কেরীদের মত ব্যাপ্টিস্টরাও (baptist) ভারতে আসতে পারলো সরকারী জাহাজেই। ১৮৩৩ সালের পরবর্তী চার্টারে পাদ্রীদের আভ্যন্তরীণ প্রতিযোগিতার সুযোগ বেড়ে গেল। ফলে একাধিপত্যের মধ্য দিয়ে রাজনীতির উপরে ওঠার ক্ষমতা পাদ্রীতন্ত্রের থাকলো না আর, কারণ সব ধারার পাদ্রিদের অনুমতি মিললো ভারতে প্রবেশ করার। ১৮৩৩ সালে যদিও ইংল্যন্ডের ভেতরে শ্রমিক মেহনতী মানুষের প্রতিবাদের ঢল নেমেছে, কিন্তু আর্থিক-সামরিকভাবে ইংল্যন্ডের দোর্দন্ডপ্রতাপ অনস্বীকার্য। তাই ঠিক এই পর্যায়টাতেই বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ অনায়াসেই সতীদাহ প্রথা রদ করলো।

    এই পর্যায়টাই বাংলার স্বর্ণযুগের পর্যায়, বাংলার বস্তুবাদী বীক্ষার উত্থান। ডিরোজিও, ব্রাহ্ম সমাজের বিস্তার ও সবশেষে অক্ষয় দত্ত ও বিদ্যাসাগরের স্বর্ণ যুগ। বেকন-হিউম-লকদের দর্শনের বিস্তার।

     কিন্তু এই সুখ বেশীদিনের নয়। হবেই বা কি করে? ১৮৫৩ থেকে ১৮৫৬ ক্রিমিয়ার ভয়ানক যুদ্ধ লাগলো, ইয়োরোপে ব্রিটিশ প্রতিযোগী দেশগুলো আবার সামরিক ও রাজনৈতিকভাবে মাথা তুললো।

    যার প্রতিফলন ভারতেও পড়লো। বিদ্যাসাগরদের দুর্দিন ঘনিয়ে এলো। সিপাহী বিদ্রোহের অন্যতম কারণ হিসেবে যুক্তিবাদীদের প্রতি সরকারি প্রশ্রয় এবং তাদের পক্ষে ইংরেজ প্রশাসনের আইন প্রণয়নকেও দায়ী করলো ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদ। সিপাহী বিদ্রোহের পর থেকে নতুন শাসক হলেন রানী ভিক্টোরিয়া ও সরাসরি বৃটিশ সংসদ। আবার ১৮১৩ সালের আগের মত ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ হয়ে গেলো ইংরেজ শাসকরা। তারা ঘোষণা করলো যে ধর্ম ও লোকাচারে নাক গলালে নেটিভ হিন্দু বা নেটিভ মুসলিমরা ক্ষিপ্ত হচ্ছে। কিন্তু এমন ক্ষিপ্ত তো নীল চাষীরাও হয়েছিল, সেই রাগের ভয়ে তারা কি নীলকুঠি বানানো ছেড়ে দিয়েছিল? নিশ্চয়ই নয়। আসলে তাদের ভয় হল রাজন্য বর্গ, অর্থাৎ এদেশের ছোট শাসকরা, যারা আবার ফরাসীদের পাল্লায় পড়ে যেতে পারে, ক্রিমিয়ার যুদ্ধের পর। ফলে এদেশের হিন্দু বা মুসলিম সম্ভ্রান্তরা যদি ক্ষিপ্ত হয়ে অন্য সাম্রাজ্যবাদীদের সাহায্য নিয়ে বসে তা তারা অনুমোদন করতে পারে না। সিপাহী বিদ্রোহকে ইংরেজরা শুধু নানা সাহেব, তাঁতিয়া টোপেদের বিদ্রোহ হিসেবেই দেখেছিলেন, জনগণের নয়। অন্যদিকে ক্রিমিয়ার এই যুদ্ধ শুরু হওয়ার ঘোষিত কারণ ছিল ধর্মীয়, সনাতন চার্চের সাথে ক্যাথলিকদের বিরোধ। যদিও ভারতে বা বৃটেনের অভ্যন্তরে খ্রীস্টান মিশনরীদের প্রতি বিমাতৃসুলভ আচরণ নিয়ে দেশের মধ্যে প্রশ্ন ঘনীভুত হল। তা সত্ত্বেও ভারতের রানী হিসেবে ভিক্টোরিয়া খ্রীস্টান পাদ্রীদের অধিকার আবার কেড়ে নিলেন। বৃটেন ক্রিমিয়ার যুদ্ধ চলাকালীনই সন্দেহ করছিল যে রাশিয়ার সঙ্গে নেপোলিয়ন ৩ একটি গোপন বোঝাপড়া করছেন, এবং তারা এবার ভারতের দিকে হাত বাড়াবে। তাই ভয়ে তারা নিজেদের সামলে নিল উপনিবেশগুলিতে। সুতরাং ১৮৫৭ সালের পর বিদ্যাসাগরের পরবর্তী দুই প্রজেক্ট--- বাল্য বিবাহ ও বহুবিবাহ বিল পাশ হয়নি। যার জন্য আরো একশো বছর হিন্দু মেয়েদের অপেক্ষা করতে হয়েছিল। 

    ১৮৫৭ থেকে ১৮৯১, বিদ্যাসাগরদের পতন

    শ্রী রাধাকান্ত দেব হিন্দু জাগরণের প্রচেষ্টা কম  করেননি, এবং তাঁর যথেষ্ঠ যোগ্যতাও ছিল। কিন্তু তৎকালীন ব্রিটিশ স্বর্ণযুগ তাকে বিদ্যাসাগরের সামনে মাথা নোয়াতে বাধ্য করেছিল, ক্রিমিয়া যুদ্ধের আগে। কিন্তু রাধাকান্ত দেবদের উত্তরসূরীরা যথা শশধর তর্কচূড়ামণি, রামকৃষ্ণ পরমহংস এবং সবশেষে বিবেকানন্দ সেই সুবিধা পেলেন, এবং বিবেকানন্দই তাকে যথাযোগ্যভাবে ব্যবহার করতে পারলেন। রামকৃষ্ণ বললেন যে সব ধর্মই ভাল কিন্তু নিজ নিজ ধর্ম নিজের কাছে সত্য। এর মধ্য দিয়ে বিভ্রান্ত হিন্দু শিক্ষিতদের তিনি নিশ্চিন্ত করলেন এই বলে যে আর তাদের খ্রীস্টান হতে হবে না, হিন্দু ধর্মের খারাপ জিনিস নিয়ে লজ্জাও পেতে হবে না। তাঁর গ্রাম্য ভাষা, রোজগার বা শহুরে চাকুরীজীবীদের নিয়ে বিদ্রুপ, মেয়েদের প্রায় অস্তিত্বহীন ভাবার যে দর্শন তা আগের কয়েক দশকের মধ্য দিয়ে বিকশিত যুক্তিবাদী মননকে আঘাত করলো, কিন্তু চাকরি প্রায় নিঃশেষিত, কেরানী হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে যারা গ্রাম থেকে এসেছে, সামাজিকভাবে যে ভদ্রলোকশ্রেণী আজ দরিদ্র তাদের খুব আকর্ষণ করলো। আর করলো কিছু বুদ্ধিজীবীকেও। যেমন কেশব সেন। কিন্তু রামকৃষ্ণ দেব যতই হিন্দু পুনরুত্থান ঘটিয়ে থাকুন, হিন্দুত্বকে তিনি রাজনৈতিক ময়দানে নামাতে পারেননি। অনাশক্ত ভক্তি বা আধ্যাত্ম্যিকতা বা রোজগার কর্মজীবন বিমুখতাই ছিল চাকরি না পাওয়া গ্রাম্য মানুষগুলোর দীর্ঘঃশ্বাস। রামকৃষ্ণ দেব সশস্ত্র সংগ্রামী হিন্দুত্বের আওয়াজ তুলতে পারেননি, যা পেরেছিলেন বিবেকানন্দ। যোগ্য শিষ্যের মতই তিনি একদিকে যেমন রামকৃষ্ণকে গ্রহণ করেছিলেন আবার অন্যদিকে তাঁকে খারিজ করে জঙ্গী হিন্দুত্বকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যদিও সেটাকে rss মার্কা যে নয় সেটা বলাই বাহুল্য। তাহলে প্রশ্ন হল, এই সামাজিক ঘটনার পেছনে আন্তর্জাতিক কোন ঘটনাপ্রবাহের প্রভাব ছিলো? কিই বা সেই নতুন পরিস্থিতি যা রাধাকান্ত দেব তো বটেই এমনকি রামকৃষ্ণদেবও পেলেন না?

    মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের উত্থান

    ১৮৭১ থেকে স্পষ্ট হল যে বৃটেনের একাধিপত্য কমছে। ইউরোপে জার্মানি ও সাগর পাড়ে আমেরিকার উত্থান ঘটে গেছে। ১৮৪৮ সালের মধ্যেই আমেরিকা মেক্সিকো আক্রমণ করে তাদের সাম্রাজ্য বিস্তারের ইচ্ছা ও ক্ষমতা দুটোই জানান দিয়ে দিয়েছে সাম্রাজ্যবাদী শিবিরে, তবু ১৮৬১ সাল পর্যন্ত আমেরিকা নিজেদের ঝামেলা নিয়ে ব্যস্ত থেকেছে। গৃহযুদ্ধ চলাকালীন এটাও স্পষ্ট হয়েছে যে ফ্রান্স ও ইংল্যন্ড আমেরিকার অভ্যন্তরের অগ্রগতির প্রতিনিধিদের থেকেও প্রতিক্রিয়াশীল শিবিরের সঙ্গেই বেশী সম্পর্ক রাখতে উৎসাহী। চার্চ অব্‌ ইংল্যন্ডও তাই। যদিও ভুট্টার আমদানির জন্য শেষ পর্যন্ত তারা বাধ্য হয়েছিল নিষ্ক্রিয় থাকতে। কিন্তু গৃহযুদ্ধ শেষ হতেই বৃটেন ও ফ্রান্সকে টক্কর দিতে আমেরিকা প্রস্তুতি নিল, আর অন্যদিকে ছিল সাধারণ সংকট। শুধু প্রতিযোগীর উত্থান ঘটলেই তো আর মরণপণ প্রতিযোগিতা হয় না। তার জন্য দরকার সংকট, যে তীব্র সংকটের মুখোমুখি হল ইয়োরোপের পুঁজিবাদ ওই ১৮৭০-র দশকেই। ফলে সাম্রাজ্য কেউ বিস্তার করবে, আর কেউ রক্ষা করবে। দুই মিলে ১৮৯৩ সালে চিকাগোতে আমেরিকা এক বিরাট প্রদর্শনীর আয়োজন করল, প্রায় ৬ মাস ধরে যা চললো। কলম্বাসের বিজয়ের ৪০০ বছর পালন করা হলো এবং আমেরিকা জানান দিল যে তারাই আগামীদিনের রাজা হতে চায়। নিজেদের সার্বিক অগ্রগতির প্রচার, সামরিক শক্তিকে জাহির করা, এটাই ছিল এই মহামেলার উদ্দেশ্য। তারা যা যা বানিয়েছে, যা যা ভাবে, সবই সেখানে প্রদর্শিত হল, কয়েক লক্ষ মানুষ সেখানে এলো। অথচ ঠিক 7 বছর আগে এই শহর শ্রমিকের রক্তে ভেসে গেছে, জন্ম হয়েছে রক্ত লাল পতাকারও। যাই হোক্‌ সেই প্রদর্শনীতেই হল বিশ্ব ধর্ম সম্মেলন। আমেরিকাতে ১৭৯২ সালে যে great awakening হয়েছিল তার মধ্য দিয়ে মার্কিন শাসকরা শিখেছিল যে revivalist আন্দোলনের ফলে চার্চ অব্‌ ইংল্যন্ড বিপদে পড়ে। তাই ১০০ বছর পরে, ১৮৯৩ সালে যখন আমেরিকা জাতি গঠনের পর্যায় সমাপ্ত করে উপনিবেশ গঠনে মনোযোগ দিচ্ছে, সাম্রাজ্যে পরিণত হচ্ছে তখন তারা আবার একই বার্তা দিল ওই ধর্ম সম্মেলনের মধ্য দিয়ে। উপনিবেশগুলিতে যে বার্তা পৌছানো আমেরিকার বেশী দরকার। কারণ সেখানেই রয়েছে বিক্ষুব্ধ অংশ, যারা সপ্তদশ শতক ফেরত চায়। ভারতেও বার্তা এলো, হিন্দু পুনরুত্থানের আন্দোলনকে উস্কে দেওয়া আমেরিকার দরকার, বৃটিশদের প্রতি সহমর্মিতা নিয়ে এখানে সমাজ সংস্কারকরা ভূমিকা রাখছেন, আর হিন্দু সনাতনপন্থীরা বিক্ষুব্ধ হচ্ছেন, বিশেষত রাজন্য বর্গ। রাজনৈতিক ও আর্থিক অত্যাচারের ফলে ইংরেজ বিরোধিতাকে তারা ধর্মীয় দিকে টেনে নিয়ে যেতে সক্ষম হচ্ছেন আর পাশে এমনকি প্রজাদেরও পেয়ে যাচ্ছেন, যা তারা এর আগের শতকে পাননি। ১০০ বছর আগে এই প্রজাদের সাহায্য নিয়েই বৃটিশরা রাজন্য বর্গ কে হারাতে পেরেছিল। যেমন ভীমা কোরেগাঁও যুদ্ধ।  ভারতের এই রাজন্য বর্গরাই ছিল হিন্দু জাগরণের অর্থনৈতিক ভিত্তি। এদেরই পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে উঠেছে মন্দির, সন্যাসীদের বা ধর্মীয় প্রচারকদের স্পন্সর করছেন এরাই। সর্ব ধর্ম সমন্বয়ের বার্তা দিয়ে এই মহা প্রদর্শনীতেও বিবেকানন্দ ডাক পেলেন আলাসিঙ্গারদের একটি মঞ্চ এবং তাঁদের পৃষ্ঠপোষক কিছু দক্ষিণ ভারতীয় রাজাদেরই মাধ্যমে। 

    প্রসঙ্গত ইতিমধ্যেই আমেরিকাতে ১৮৭৫ সালে ব্ল্যাভাৎস্কি নামী এক রুশ মহিলার দৌলতে জন্ম নিয়েছে থিওসফিকাল সোসাইটি। এরা গোড়া থেকেই ভারতের আর্য সমাজের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলছিল। আর এই ব্ল্যাভাৎস্কিই হলেন অ্যানি বেসেন্টের গুরুস্থানীয়া। থিওসফিকাল সোসাইটির পক্ষে আমেরিকার ওই মহামেলার মহাসম্মেলনে ডাক পেলেন আনি বেসেন্টও। কাকতালীয় বটে! বিবেকানন্দ ‘বোন ভাই’ বলে সকলকে সম্বোধন করলেন ও ১০ মিনিটের হাততালি কুড়োলেন। তাঁর ভাষণে যদিও একটিবারও উল্লেখ করলেন না যে এই শহরে 7 বছর আগে বহু ‘ভাই’-র রক্ত ঝরেছে, ৭জন ‘ভাই’-র ফাঁসিও হয়ে গেছে!! মোদ্দা কথা বিবেকানন্দ কর্তৃপক্ষের নজরে এলেন, অ্যানি বেসেন্টেরও নজরে এলেন। ততদিনে ব্ল্যাভাৎস্কি ভারতে সক্রিয় হয়ে গেছেন। মার্কিন সরকারের সাহায্য নিয়েই, বাণিজ্য প্রতিনিধি হয়ে ব্ল্যাভাৎস্কির সঙ্গী হেনরী অলকট এলেন! এদেশে আর্য সমাজের সাথে মিলে হিন্দু পুনরুত্থানের কাঠামোটি তিনি তৈরী করছিলেন। তার সেই ব্যাটন ধরার জন্য আনি বেসেন্ট তৈরী। অ্যানি ভারতে পদার্পণ করলেন কিছুদিনের মধ্যেই এবং হিন্দু পুনরুত্থানে লেগে পড়লেন। দেখা যাচ্ছে অ্যানি বেসেন্টকে আশ্রয় দিচ্ছেন মাদুরাই, ব্যাঙ্গালোর, ভরতপুর, দ্বারভাঙা, কপুরতলার মহারাজরা। বিবেকানন্দ স্বীকার করলেন যে এবার আর তার কোনো টাকা পয়সার সমস্যা হবে না, যে সব রাজারা তার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন তাদেরকেও তিনি সব জানালেন, এবং ইয়োরোপ ঘুরে বেশ কয়েকজন বিদেশী শিষ্যকে নিয়ে জাহাজে করে নামলেন মাদ্রাজ। সে ছিল এক জাঁক জমকের অবতারণা। যদিও ব্রিটিশ সংবাদ মাধ্যম বিবেকানন্দ কে অত প্রচার দেয়নি। দিয়েছিল মার্কিন প্রেস।

    মুচি মেথর সিস্টার্স

     আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী নীতিতে দুটি বিষয় খুব স্পষ্ট ছিল। তারা মেক্সিকো জিতে বুঝেছিল যে মহিলাদের মুক্তিদাতা হিসেবে আমেরিকাকে প্রতিষ্ঠা করা জরুরী। এবং দাস প্রথা বিলোপ তাদের ট্রাম্প কার্ড। বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ যেমন বর্বর অসভ্য দেশকে সভ্য করতে এসেছিল, তেমনই আমেরিকা বিষয়টাকে আরও নির্দিষ্ট করলো, তারা মহিলাদের মুক্তিদাতা। অন্যদিকে আমেরিকা সবে গৃহযুদ্ধ শেষ করে দাসপ্রথাকে নিষিদ্ধ করেছে। জাতপাতপ্রথায় জরাজীর্ণ ভারতে এর আকর্ষণ অনস্বীকার্য।বিবেকানন্দের মুচি-মেথর নিয়ে বক্তব্যকে তাই খবরের কাগজগুলো সাংঘাতিক প্রচার করলো এবং মার্কিন মহিলাদের অগ্রগতি নিয়ে তাঁর উৎসাহও আমরা দেখলাম। ফলে ভারতে ব্ল্যাভাৎস্কি যখন এলেন তখন তা তাদের সেই নীতির সঙ্গে সাযূজ্যপূর্ণ হল, আবার ১৮৭৯ সালে যখন অ্যানি বেসেন্টের এলেন তাও একই নীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হল। আমেরিকা নিশ্চয়ই বুঝেছিল যে ব্ল্যাভাৎস্কি বা অ্যানিকে দিয়ে যা হবে না তা একজন স্বদেশীকে দিয়েই হবে। ভারতে অ্যানি বেসেন্টের হোম রুল লীগের আয়ু স্বল্প কাল, ঠিক প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়টুকু। যে সময়ে সাম্রাজ্যবাদী অন্তর্দ্বন্দ্ব এক বিষম চেহারা নেয়, ঠিক সেই সময় পূর্ণ স্বরাজের ডাক দেওয়ার আওয়াজ স্বাভাবিকভাবেই ইংল্যন্ডের প্রতিযোগী সাম্রাজ্যবাদীদের কাছে খুবই অভিপ্রেত। তিলকদের সহযোগিতায় এবং পতাকায় হিন্দুত্বের চিহ্ন রেখে অ্যানি বেসেন্ট মহাত্মা গান্ধীকে কংগ্রেসের প্রধান হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে গেলেন। অ্যানির আয়ারয়ান্ডের বিপ্লবী জীবনের সঙ্গী ব্র্যাডলোর সমাধিতে উপস্থিত ছিলেন গান্ধীজী। মদনমোহন মালব্যের মত হিন্দু মহাসভার (এবং কংগ্রেসেরও) নেতার সঙ্গে তিনি কাজ শুরু করেন। গান্ধীজী এদেশে ফিরলেনও  বিশ্বযুদ্ধের সময়টাতেই! যদিও তিনি বা কংগ্রেস প্রথম বিশ্বযুদ্ধে লোক এবং টাকা দিয়ে বৃটেনকেই সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, আমেরিকাও তাই করেছিল ১৯১৭ সাল থেকে। ১৯১৬ থেকে ১৯১৭ অ্যানি ‘বৃটেনের প্রয়োজন, ভারতের সুযোগ’ স্লোগান তুললেন যা আইরিশ স্বাধীনতার স্লোগানের অনুকরণও বটে। কিন্তু ১৯১৭ সালে, যখন আমেরিকা বিশ্বযুদ্ধে প্রবেশ করলো, তিনি গ্রেপ্তার হলেন। অবশ্য তাকে ছেড়ে দেওয়া হল। অ্যানিও নিজের কাজ শেষ করে ভারত ছাড়লেন।

    এবার আমাদের একটু আয়ারল্যান্ডের প্রসঙ্গ টেনে আনতেই হবে, ভারতের হিন্দু পুনরুত্থান ও বিদ্যাসাগরের কোণঠাসা হয়ে যাওয়া নিয়ে আলোচনা করতে হলে যা বিশেষ দরকার। এমনিতেই ইতিহাসবিদরা ভারত আর আয়ারল্যাণ্ডের মধ্যে বহু মিল পেয়ে থাকেন, বৃটিশ উপনিবেশ, ধর্মীয় সংখ্যাগুরু ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মধ্যে বিবাদ, জাতি হিসেবেই পরস্পরকে গণ্য করার অভ্যেস, এবং শেষ পর্যন্ত দেশভাগ, loose Confederation এর সমাধান --- এই সবেই দুই দেশের বহু মিল। অ্যানি বেসেন্ট ছিলেন আয়ারল্যান্দের ক্যাথলিক (যদিও তিনি প্রথম জীবনে মুক্ত চিন্তক ছিলেন)। যে ক্যাথলিকরা প্রটেস্টান্ট বৃটিশ প্রভূদের সরকারী বদান্যতা পেতেন না। আয়ারল্যাণ্ডের স্বাধীনতা সংগ্রাম নানা পর্যায়ে বিভক্ত ---  ফিয়েনপন্থী নৈরাজ্যবাদী ঘরানা থেকে শুরু করে শেষে হোম রুল–র পর্যায়, প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত আমেরিকার সাথে ওতপ্রোত যোগাযোগ। বৃটেনের বিরুদ্ধে আয়ারল্যান্ডের যে সংগ্রাম তা আমেরিকার স্বাধীনতার সংগ্রামের সঙ্গে মিলেমিশে ছিল। আইরিশ প্রবাসীরা যেমন আমেরিকার গৃহযুদ্ধে দুই পক্ষের সৈন্য বাহিনিতেই ছিল, তেমনই তারা একসাথে বৃটিশ শাসনের বিরুদ্ধে আমেরিকাতেই জোট বেঁধেছিল, এবং মার্কিন গৃহযুদ্ধের পর ১৮৬৫ থেকে আব্রাহাম লিঙ্কনের মিলিটারি প্রধানরা তাদের বিপদে আপদে পাশে দাঁড়িয়েছে, পরামর্শও দিয়েছে। আয়ারল্যান্ডে যখন বিপ্লবীরা কচুকাটা হচ্ছে তখনো আমেরিকা সেই ঘোলা জলে তাদের সাহায্যের নামে মাছ ধরতে চেষ্টা করেছে। আয়ারল্যান্ডের ক্যাথলিক বনাম প্রটেস্টন্ট, ক্যাথলিক মৌলবাদী বনাম স্বাধীনচেতা বিপ্লবী, প্রতিটি দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে এটুকু আমেরিকা সহ সকলের কাছেই স্পষ্ট হয়েছিল যে চার্চ অব্‌ ইংল্যন্ড একটু সুযোগ পেলেই উপনিবেশগুলির লোকাচারে বা ধর্মীয় বিশ্বাসে নাক গলাতে চায়। যার সুযোগ আবার বস্তুবাদী ঘরানা নিয়ে থাকে। বৃটেনের গণতান্ত্রিক স্বরও চায় উপনিবেশগুলির লোকাচারকে ধ্বংস করতে। অন্যদিকে আমেরিকার স্বাধীনতার পর বৃটেন কানাডাতে চার্চ অব্‌ ইংল্যন্ডের গুরুত্ব অনেক বাড়িয়ে দিয়েছিল।

    ভারতে হিন্দু পুনরুত্থানে একদিকে ব্ল্যাভাতস্কি-আর্য সমাজ, তার পর একদিকে অ্যানি-তিলক আর অন্যদিকে বিবেকানন্দের এই অগ্রগতিতে তৎকালীন বস্তুবাদের শেষ স্তম্ভ বিদ্যাসাগর পরাভূত। বঙ্কিম চলে গেছেন ওই শিবিরে। বিদ্যাসাগরের ভীতু বন্ধুরাও তাঁকে ছেড়ে চলে গেছেন, অথবা মারা গেছেন। বিদ্যাসাগর সম্পূর্ণ একা হয়ে গেলেন। তিনি কি বিশ্ব ও বাঙলার, আমেরিকা ও বাংলার এই রোমহর্ষক যোগাযোগের খবর রাখতেন?  বোধহয় না। সম্ভব ছিল না সেদিন। 

    বিচিত্র বিষয় হল, আয়ারল্যান্ডের ছায়া শেষ পর্যন্ত ছিল বিবেকানন্দের সঙ্গে। অ্যানি বেসেন্তের পর ভগিনী নিবেদিতা ছিলেন বিবেকানন্দের উত্থানের হাতিয়ার ও পরামর্শদাত্রী, যদিও তিনি নিজেকে শিষ্যা বলেছেন। নিবেদিতা ছিলেন রাজনীতিবিদ ও বিজ্ঞানী। আনির মুক্ত চিন্তক থেকে ধর্মপরায়না হওয়ার পিছনে যথেষ্ট কারণ ছিল। ব্র্যাডলো এগিয়ে গেলেন তিনি পারলেন না, নিজের সন্তানদের সাথে সম্পর্ক থাকলো না। আমেরিকা অ্যানিকে স্বপরিচয়ে বিশ্বধর্ম সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল, এবং বেসেন্ট নিজের পরিচয়ে ভারতে কাজ করলেন। অন্যদিকে ভগিনী নিবেদিতাও তাই। বিবেকানন্দ বেঁচে থাকতে এবং পরেও। তবে আইরিশ বিপ্লবী বা জাতীয়তাবাদী অ্যানি যতটা বৃটিশ বিরোধিতা দিয়েই শুরু করেছিলেন, ততটা নিবেদিতা নয়। ফলে মার্কিন যোগাযোগ আনির সঙ্গে যতটা ছিল, নিবেদিতার সাথে ছিল না। বরং রামকৃষ্ণ মিশনের সঙ্গে বিবাদটাই সামনে চলে এল এবং শেষ জীবনে নিবেদিতাও প্রায় বিদ্যাসাগরের দশাতেই পৌঁছলেন। এখানে আর একজন মহিলার নাম না বললেই নয়। হিন্দু পুনরুত্থানে যে বিদেশিনিও যথেষ্ট ভূমিকা রেখেছিলেন। বিপ্লবী অরবিন্দ ঘোষ, যিনি বৃটিশ কারাবাসের পর ফরাসী উপনিবেশ পন্ডিচেরিতে আশ্রয় নিলেন, এবং হিন্দু পুনরুত্থানের প্রবক্তা হিসেবে পুনর্জন্ম ঘটল তাঁর। তারও সাথে ছিলেন ব্রিটিশ বিরোধী আর এক সাম্রাজ্যবাদী দেশ ফ্রান্সের এক মহিলা। ফরাসী সাম্রাজ্যবাদের কাছে নিশ্চয়ই তা অভিপ্রেতও ছিল। তাঁর রাজনীতিবিদ স্বামীর রিচার্ড যখন দেশে ফিরলেন তখন তিনিও যাতে ফেরত যান প্যারিস সেই চেষ্টার ত্রুটি রাখেনি না ফরাসী প্রশাসন।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • আলোচনা | ১০ জানুয়ারি ২০২৫ | ১৩১৩ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • দীপ | 42.***.*** | ১০ জানুয়ারি ২০২৫ ১৫:৪৩540566
  • আপনি না বুঝেছেন বিদ্যাসাগর, না বুঝেছেন বিবেকানন্দ! কোনো কিছু না বুঝেই মাতব্বরি ফলাতে এসেছেন! 
    ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, নেহেরু, বিনয় সরকার, উৎপল দত্ত প্রমুখ ব্যক্তিত্ব বিবেকানন্দ নিয়ে আলোচনা করেছেন। একটু কষ্ট করে দেখে নেবেন! 
     
    অবশ্য আপনাকে তো আমরা চিনি! সারা বাংলা যখন সন্দেশখালির ঘটনা শুনে স্তম্ভিত হয়েছিলো,‌ আপনি তখন শাসকের হয়ে গপ্পিবাজি লিখছিলেন!
    চোরের মায়ের বড় গলা; প্রবাদটা এমনি এমনি আসেনি!
  • দীপ | 42.***.*** | ১০ জানুয়ারি ২০২৫ ১৫:৫০540567
  • 'আমরা আরম্ভ করি, শেষ করি না; আড়ম্বর করি, কাজ করি না; যাহা অনুষ্ঠান করি তাহা বিশ্বাস করি না; যাহা বিশ্বাস করি তাহা পালন করি না।ভূরিপরিমাণ বাক্যরচনা করিতে পারি, তিলপরিমাণ আত্মত্যাগ করিতে পারি না।আমরা অহংকার দেখাইয়া পরিতৃপ্ত থাকি, যোগ্যতালাভের চেষ্টা করি না।আমরা সকল কাজেই পরের প্রত্যাশা করি, অথচ পরের ত্রুটি লইয়া আকাশ বিদীর্ণ করিতে থাকি।পরের অনুকরণে আমাদের গর্ব, পরের অনুগ্রহে আমাদের সম্মান, পরের চক্ষে ধূলিনিক্ষেপ করিয়া আমাদের পলিটিক্স্, এবং নিজের বাকচাতুর্যে নিজের প্রতি ভক্তিবিহ্বল হইয়া উঠাই আমাদের জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য। 
    এই দুর্বল, ক্ষুদ্র, হৃদয়হীন, কর্মহীন, দাম্ভিক, তার্কিক জাতির প্রতি বিদ্যাসাগরের এক সুগভীর ধিক্কার ছিল। কারণ, তিনি সর্ববিষয়েই ইহাদের বিপরীত ছিলেন।"
    -রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
    (চারিত্রপূজা/ বিদ্যাসাগর চরিত)
     
    মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন!
  • দীপ | 42.***.*** | ১০ জানুয়ারি ২০২৫ ১৭:৪৭540569
  • "বহু সাধকের বহু সাধনার ধারা
    ধেয়ানে তোমার মিলিত হয়েছে তারা।
    তোমার জীবনে অসীমের লীলাপথে
    নূতন তীর্থ রূপ নিল এ জগতে;
    দেশ বিদেশের প্রণাম আনিল টানি
    সেথায় আমার প্রণতি দিলাম আনি।"
     
    মহাকবির দৃষ্টিতে রামকৃষ্ণ! 
     
     
    ছাগল‌‌ কোনোকালেই কম পড়ে নাই!

                
  • Saikat | 42.108.***.*** | ১০ জানুয়ারি ২০২৫ ১৮:১৪540570
  • অসাধারণ ।..খুব সুন্দর লেখা .
  • Barnali Mukherjee | ১০ জানুয়ারি ২০২৫ ১৮:১৭540571
  • ধন্যবাদ সৈকত বাবু। 
  • sp | 2405:8100:8000:5ca1::365:***:*** | ১০ জানুয়ারি ২০২৫ ২০:৫৪540574
  • এটা কী গুগল ট্রান্সলেট দিয়ে লেখা না বাংলায় চ্যাটজিপিটি? মাথামুণ্ডুহীন।
  • MP | 2401:4900:731a:c6f2:b057:761:87ab:***:*** | ১১ জানুয়ারি ২০২৫ ২২:৩৩540592
  • বর্ণালী আপনি অনেক পরিশ্রম ও গবেষণা করে লিখেছেন l আমি নিজে রামকৃষ্ণ মিশনের প্রাক্তনী কিন্তু বলতেই হবে আপনি গ্লোবাল জিয়োপলিটিক্সের আলোতে ১৮ আর ১৯ শতকের রাজনীতি বিশ্লেষণ করেছেন l এবিষয়ে আপনি পথিকৃৎ l অনেক কিছুই ভাববার অবকাশ দিলো আপনার লেখা l স্বামীজীর উত্থানের পিছনে যে রাজন্য বর্গ বিশেষতঃ খেতরির রাজা এটা আপনি মনে করিয়ে দিয়েছেন এবং তার পিছনের জিয়োপলিটিক্সের এঙ্গেল টাও যথেষ্ট মুন্সিয়ানার সঙ্গে দেখিয়েছেন l অনেক ধন্যবাদ l 
  • Barnali Mukherjee | ১১ জানুয়ারি ২০২৫ ২৩:০৩540594
  • ধন্যবাদ। তবে অনেক, অনেক গবেষণা বাকি আছে। যদি যোগ্য মানুষ এই গবেষণায় হাত দেয় তবে এই প্রাথমিক প্রচেষ্টা সফল হবে। 
  • অনিরুদ্ধ ঘোষ | 2401:4900:882a:f4b7:cb9:ce64:5210:***:*** | ১২ জানুয়ারি ২০২৫ ১১:৫৩540603
  • দীপ বাবু , আপনাকে একটা কথা বলি । লেখাটির বিষয়বস্তু নিয়ে আপনার ভিন্ন মত থাকতেই পারে । সেইন নিয়ে বিশদে লিখতে পারতেন । তা না করে আপনি ব্যক্তি আক্রমণ করলেন । এটা প্রমাণ করে যে যুক্তি দিয়ে লেখাটি বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা আপনার নেই । 
    আর সন্দেশখালী কোথা থেকে এলো জানিনা । তবে সন্দেশখালীর মিথ্যাগুলো সবার কাছেই পরিষ্কার এখন । সেটা উল্লেখ করে আপনি নিজেকে এক্সপোস করে দিলেন ।
  • অনিরুদ্ধ ঘোষ | 2401:4900:882a:f4b7:cb9:ce64:5210:***:*** | ১২ জানুয়ারি ২০২৫ ১২:০১540605
  • খুব ভালো লেখা
  • Barnali Mukherjee | ১২ জানুয়ারি ২০২৫ ১২:২২540606
  • ধন্যবাদ অনিরুদ্ধ বাবু
  • q | 2405:8100:8000:5ca1::190:***:*** | ১২ জানুয়ারি ২০২৫ ১২:৩১540607
  • "ভারতে হিন্দু পুনরুত্থানে একদিকে ব্ল্যাভাতস্কি-আর্য সমাজ, তার পর একদিকে অ্যানি-তিলক আর অন্যদিকে বিবেকানন্দের এই অগ্রগতিতে তৎকালীন বস্তুবাদের শেষ স্তম্ভ বিদ্যাসাগর পরাভূত। বঙ্কিম চলে গেছেন ওই শিবিরে। বিদ্যাসাগরের ভীতু বন্ধুরাও তাঁকে ছেড়ে চলে গেছেন, অথবা মারা গেছেন। বিদ্যাসাগর সম্পূর্ণ একা হয়ে গেলেন।"
    - এইটা কত সালের ঘটনা?
  • দীপক পিপলাই | 223.223.***.*** | ১২ জানুয়ারি ২০২৫ ১৩:৪৪540611
  • প্রশংসনীয়।
    অনেক চিন্তার খোরাক যোগাবে এই লেখা।
  • Barnali Mukherjee | ১২ জানুয়ারি ২০২৫ ১৫:০৫540614
  • বিদ্যাসাগরদের পরাজয় একটা সাল নয়, একটা পর্যায় ধরে হয়েছে। সরকারের প্রশ্রয় না থাকায় ক্রমেই যুক্তিবাদী বস্তুবাদী শক্তি দুর্বল হয়েছে। 
    ক্রিমিয়া যুদ্ধ ১৮৫৪- ৬
    সিপাহী বিদ্রোহ ১৮৫৭
    তত্ত্ববোধিনী সভা বিলুপ্ত হল ১৮৫৯
    ১৮৬৫ থেকে কেশব সেন শ্রীরামকৃষ্ণের দিকে সরে গেলেন ক্রমেই
    Blavatsky Aarya samaj venture 1875 
    বিবেকানন্দ রামকৃষ্ণের কাছাকাছি আসতে  শুরু করলেন ১৮৮১/৮২
    রামকৃষ্ণ বিদ্যাসাগর মুখোমুখি হলেন 1882 
    অক্ষয় দত্ত মারা গেলেন ১৮৮৬, বিদ্যাসাগর মারা গেলেন 1891
    বিবেকানন্দ  মারা গেলেন 1902
    বঙ্গ ভঙ্গ প্রস্তাব ও মুসলিম লীগ গঠন
    Morley minto reform ১৯০৯
    Home rule 1916 ও lucknow চুক্তি
  • Barnali Mukherjee | ১২ জানুয়ারি ২০২৫ ১৫:০৬540615
  • ধন্যবাদ দীপক পিপলাই বাবু
  • কৌতূহলী | 103.249.***.*** | ১২ জানুয়ারি ২০২৫ ১৮:০৮540617
  • বিদ্যাসাগর অক্ষয় দত্তের মত প্রগতিশীল লিবারেল মানবতাবাদী ধারা ও তাঁর বিপ্রতীপে ভূদেব বঙ্কিম বিবেকানন্দের ধারা ,এই নিয়ে যুক্তিবাদীরা চর্চা করেন , কিন্তু আন্তর্জাতিক আর্থসামাজিক বিশ্লেষণটা চমৎকার দেখিয়েছেন আপনি। এটা সিরিজ হিসাবে কন্টিনিউ করলে খুব ভাল হয়। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে
  • Barnali Mukherjee | ১২ জানুয়ারি ২০২৫ ১৮:৩১540618
  • ধন্যবাদ আপনাকে। বিরাট দায়িত্ব দিলেন। দেখি কতদূর এগোতে পারি। 
  • | ১২ জানুয়ারি ২০২৫ ২১:০৭540621
  • ইন্টারেস্টিং অ্যাঙ্গল। যদি আরেকটু বিস্তার করতে পারেন বিভিন্ন রেফারেন্স দিয়ে তাহলে ভাল লাগবে। 
  • Debasis Bhattacharya | ১২ জানুয়ারি ২০২৫ ২১:১১540622
  • বর্ণালী,
     
    শিরোনামটি দেখে খুব আগ্রহ নিয়ে লেখাটি পড়লাম। কিন্তু, আমি দুঃখিত, লেখাটির প্রতিপাদ্য বিষয় খুব ভাল বুঝলাম না। অনেক তথ্য সমাবেশ করেছ, অনেক টুকরো মন্তব্যের সমাহার ঘটিয়েছ, তার সবই চিত্তাকর্ষক। কিন্তু, সেগুলো সব মিলে কি কোনও মোদ্দা প্রতিপাদ্য উঠে আসে, দ্ব্যর্থহীনভাবে? নিশ্চিত হতে পারলাম না। লেখার গড়নটা একটু যেন ছড়ানো ছেটানো, অগোছালো লাগল! 
  • বর্ণালী মুখার্জী | 45.113.***.*** | ১২ জানুয়ারি ২০২৫ ২১:৩১540624
  • দ্ব্যর্থহীন অবস্থান! ইতিহাস সম্পর্কে? ঠিক কি চাইছেন যদি বলেন, দেবাশিস দা। মোদ্দা প্রতিপাদ্য বোধহয় একটাই, রেনেসাঁ বা পরবর্তী অধ্যায় কে আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে বিচার করা। 
  • Debasis Bhattacharya | ১৩ জানুয়ারি ২০২৫ ০২:০৯540627
  • শুধু তোমার বক্তব্যটা জানতে চাইছি, আর কিছু না, এইটুকুই। "রেনেসাঁ বা পরবর্তী অধ্যায় কে আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে বিচার করা" --- এটা হচ্ছে তোমার আলোচনার বিষয়। কিন্তু, আলোচনার শেষে ঠিক কোথায় পৌঁছতে চাইলে? ঠিক কী প্রমাণ করতে চাইলে?
     
    ইতিহাসে দ্ব্যর্থকতা থাকতে পারে, তবে ইতিহাস সম্পর্কে তোমার নিজস্ব বয়ানের মধ্যে তা না থাকাটাই বোধহয় ভাল। 
  • Barnali Mukherjee | ১৩ জানুয়ারি ২০২৫ ০৭:৩৬540630
  • বিদ্যাসাগরদের সেই সময় উচিত ছিল অমুক করা তমুক করা, এমনটা বলতে হতো ?
     অথবা 
    বিবেকানন্দের আগে পিছে প্রতিক্রিয়াশীল শব্দ টা ব্যবহার করতে হতো ?
    শুধু subaltern studies দিয়ে ইতিহাস হয় না, ইতিহাস  শাসকদের আভ্যন্তরীণ দ্বন্দও বটে। সেই চোখ টা বোধহয় আমাদের নষ্ট হয়েছে 
  • Debasis Bhattacharya | ১৩ জানুয়ারি ২০২৫ ১৬:৪৮540639
  • কাউকেই 'জাজ' করবার দাবি করিনি গো, প্রকাশ্যে বা ইঙ্গিতে। বস্তুত, ইতিহাসকে 'জাজ' করতে যাওয়াটাই একটা মস্ত বোকামি বলে আমার মনে হয়। আমার মতে, ইতিহাসের আভ্যন্তরীণ কাঠামো এবং কার্যকারণ বুঝে ওঠাটাই আসল কাজ। সেইটা কদ্দুর কী বার করতে পারলে, বা অন্তত, বার করেছ বলে দাবি করতে চাইলে, সেটাই বোঝার ছিল। তবে, আমার বক্তব্য বুঝিয়ে উঠতে পারছি না বোধহয়! 
  • Barnali Mukherjee | ১৩ জানুয়ারি ২০২৫ ১৭:৫০540642
  • ফোন করে জেনে নিচ্ছি দেবাশিস দা। smiley
  • Debasis Bhattacharya | ১৩ জানুয়ারি ২০২৫ ১৯:১২540643
  • আচ্ছা, কোরো, অনেক দিন তো কথা হয়নি তোমার সঙ্গে। 
  • হীরেন সিংহরায় | ১৪ জানুয়ারি ২০২৫ ২২:০২540657
  • অনেক ধন্যবাদ। অসাধারণ লেখা ,তথ্য ভিত্তিক আলোচনা । যদি অনুমতি করেন আমি একটু কিছু যোগ করতে চাই ।

    আপনি লিখেছেন “১৮৩৩ সালে নিজেদের উপনিবেশগুলিতে দাস প্রথাকে নিষিদ্ধ করেছিল বৃটেন। এই বছরেই কারখানায় কর্মরত মহিলা আর শিশুদের কাজের সময় বেঁধে দেওয়া হল। গরীবদের সামাজিক সুরক্ষার জন্য আইনে বদল এলো, ১৮৩৪ সালে। এই সবই ইয়োরোপ জুড়ে শ্রমজীবিদের উত্তাল আন্দোলন, গণতান্ত্রিক চেতনার জয় আবার সেই আন্দোলনগুলি দমনের প্রতিফলনও বটে”। ঠিক।  
     
    যদিও এই নবচেতনার বলে দাসপ্রথা রদ হলো সরকারিভাবে কিন্তু ঠিক পরের বছর (১৮৩৪) পিছনের দরোজা দিয়ে আরেক দাসত্ব ব্যবস্থা চালু হয়  যার নাম ছিল Indentured labour system । কারণ ত্রিনিদাদ জামাইকা ফিজি মরিশাস দক্ষিণ আফ্রিকায় আখের ক্ষেতে তুলোর ক্ষেতে কাজ করবে কে ? এই ইনডেনচারড শ্রমের শর্ত – কম করে ২১ বছর বয়েস, পাঁচ বছর কাজ করার দায়বদ্ধ অঙ্গীকার,  দেশে ফিরতে পারেন নিজের খরচায় ( যা অসম্ভব প্রায় ), দশ  বছর কাজ করলে সরকারি খরচায় দেশে ফেরা ;  সোম -শুক্র দিনে ৯ ঘণ্টা কাজ, শনিবার ৫ ঘণ্টা , বাসস্থান চিকিৎসা ফ্রি। এটা দু নম্বরি দাস প্রথা কলকাতার সুরিনাম ঘাট বিহার উত্তর প্রদেশের বহু মানুষের নির্বাসনের স্মৃতি বহন করে । ক্রিকেটে ওয়েস্ট ইন্ডিজের রোহান কানহাই , শিভনারায়ন চন্দ্রপাল,  সুনীল নারায়ণ, আলভিন কালিচরন দক্ষিণ আফ্রিকার হাশিম আমলা কেশুভ মহারাজ, বিখ্যাত ফিজি গলফার ভিজয় সিংহ , মরিশাসের প্রধানমন্ত্রী সার সিউসাগর রামগুলাম ইত্যাদি সেই শ্রমিকদের উত্তর পুরুষ । সবচেয়ে বরেণ্য নাম অবশ্যই সাহিত্যে নোবেল বিজেতা সার ভিদিয়াধর সুরজপ্রসাদ নাইপল।  সদাশয় ইংরেজ তৎকালীন ডেনিশ এবং ফরাসি কলোনিতেও শ্রমিক সাপ্লাই করেছেন Hunter Arbuthnot কোম্পানি বিশেষ দক্ষতা দেখান এই কাজে । ১৮৫৮ সালে রানি ভিক্টোরিয়া ভারতের শাসনভার নিলেন কিন্তু একটি কমার্শিয়াল প্রতিষ্ঠানের এই ফলপ্রসূ আইনটি সচল রাখলেন। 
     
  • Barnali Mukherjee | ১৪ জানুয়ারি ২০২৫ ২৩:৩৫540660
  • অনেক ধন্যবাদ হীরেনবাবু 
  • lcm | ১৫ জানুয়ারি ২০২৫ ০৮:০০540666
  • লেখাটি তথ্যনিষ্ঠ।

    কিন্তু একটা মূল জায়গা...
    "... আবার সাম্রাজ্যবাদী দুনিয়ায় মার্কিন উত্থান বদল এনে দিল ভারতে। স্বামী বিবেকানন্দ আবার যার প্রতিফলন। ... "
    বিবেকানন্দ ঠিক কীভাবে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের প্রতিফলন হলেন সেটা বুঝতে পারলাম না। মার্কিন দেশে নারীমুক্তির প্রয়াসের সঙ্গে বিবেকানন্দের যোগসূত্র ও ঠিক ধরতে পারলাম না। 
     
  • bujhlam | 2405:8100:8000:5ca1::5c8:***:*** | ১৫ জানুয়ারি ২০২৫ ১২:৫১540667
  • রামমোহন বিদ্যাসাগর ছিলেন বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের প্রতিভূ। রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দের হিন্দু জাগরণ হল বৃটিশ বিরোধী আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদী প্রকল্প যা এখন তুলসী গ্যাবার্ড কাশ প্যাটেল বিবেক রামস্বামী দিয়ে ফুটে বেরোচ্ছে।
  • lcm | ১৫ জানুয়ারি ২০২৫ ২৩:৫২540680
  • না, না - ব্যাপারটা হল, যে রামমোহন আর বিদ্যাসাগর নতুন আইন প্রণয়নে বৃটিশদের সহায়তা পেয়েছিলেন। বৃটিশরা সতীদাহ, বিধবা বিবাহ ইত্যাদি আইন তৈরি করে। অর্থাৎ, বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে।

    কিন্তু, বিবেকানন্দর কেসটা কী?
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভেবেচিন্তে মতামত দিন