এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  আলোচনা  রাজনীতি

  • বাম আদর্শ শুধু বঙ্গে?

    Barnali Mukherji লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | রাজনীতি | ০৫ নভেম্বর ২০২৪ | ৪৩৩ বার পঠিত
  • পশ্চিমবঙ্গে ছয়টি উপনির্বাচনে INDIA নামক জোটটির কোনো অস্তিত্ব নেই। কংগ্রেস আলাদা, তৃণমূল কংগ্রেস আলাদা আর INDIA –র বাম শরীকরা একসাথে। চলতি ভাষায় লোকে বলছে যে বৃহৎ বাম জোট হয়েছে। প্রথমেই স্বীকার করা ভাল বাম আদর্শ বস্তুটা ঠিক কি বামেরাও আজ  আর জানে না। ভোটের মধ্য দিয়ে বাম কর্মসূচী নিয়ে সরকারের যাওয়ার প্রয়াসকে তারা বাম বলেই স্বীকার করেন না। অথচ দলীয় কোষাগারের অধিকাংশই খরচ হয় ভোটে। বাম আদর্শের সাথে সম্পর্ক হীন স্লোগান, রাস্তাই রাস্তা, তাদের মুখে। রাস্তা থেকে সরকারের গতিকে তারা বাম বলেই স্বীকার করেন না। এই দ্বিচারিতার ফলে যারা সরকারে গেছেন এবং টিকে গেছেন দুনিয়া জুড়ে তারা সকলেই বুর্জোয়া দলে পরিণত হয়েছেন। আর যারা যায়নি, জঙ্গলে রাস্তায় লড়াই করেছেন তারা আক্ষরিকভাবেই ধ্বংস হয়েছেন। 

    তবে কি সর্বত্রই বামজোট?

    নাহ্‌, সেই ‘ভুল’ সিপিআইএম বা cpiml লিবারেশন করেনি। ঝাড়খন্ডে বৃহৎ বাম জোট হয়নি। সিপিআই(এমএল) লিবারেশন বাম জোট করেনি সেই রাজ্যে। তারা থাকলো পশু খাদ্য কেলেংকারি খ্যাত এবং জেহানাবাদ গণহত্যা খ্যাত আরজেডি-র সাথে। সিপিআইএম পৃথকভাবে প্রার্থী দিল আর সিপিআই(এমএল) লিবারেশন জোট করলো টু-জি স্পেক্ট্রাম কেলেংকারি খ্যাত আর বহু নকশালের রক্তে রাঙানো ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের সাথে। জোটের পক্ষে সিপিআইএমএল পাচ্ছে ৩টে আসন। যদিও জোট সার্বিক হয়নি। অতি গুরুত্বপূর্ণ আসন ধানওয়াড়ে-তে সিপিআই(এমএল) ঝাড়খন্ড মুক্তি মোর্চার বিরুদ্ধ্বে প্রার্থী দিয়েছে। জানা যাচ্ছে যে সিপিআইএম ইতিমধ্যেই ৯ টা আসনে প্রার্থী ঘোষণা করেছে। অর্থাৎ যেখানে সিপিআইএমএল লিবারেশনের শক্তি বেশী সেখানে তারা বাম জোটের ধার ধারেনি। যত বাম আদর্শ সবই কি তবে পশ্চিমবঙ্গে? এবার মহারাষ্ট্রের দিকে তাকাই। মহারাষ্ট্রে লিবারেশনকে বাদ রেখে সেখানে জোট করেছে সিপিআই, সিপিআইএম। সুতরাং মহারাষ্ট্রেও বাম জোট হয়নি। মহারাষ্ট্রে সিপিআইএম বাম ঐক্যের পথে না গিয়ে চোর খুনীদের সাথে জোট করেছে। ফলে প্রশ্ন চলেই আসে, ' চোর-চোর, খুনী-খুনী' নিনাদ তবে কি শুধু পশ্চিমবঙ্গে?

    বঙ্গেও কি বাম জোট হল?

    মোটেই না। আর জি কর ধর্ষণ ও হত্যা যদি এই তথাকথিত বাম জোটের ভিত্তি হয়, তবে আরও বহু বাম দল এই তথাকথিত লড়াই-তে ছিল। সকল কম্যুনিস্ট দলের সাথে জোটবদ্ধ হয়ে এই নির্বাচনী লড়াই হতে দেখা গেল না। সকলকেই যে আসন দিতে হবে এই উপভোটে তেমন মোটেই নয়। কিন্তু এখন বৃহৎ বাম জোট করলে ২০২৬ সালে এই পাঁচ দল বাদ দিয়ে সকলেই একটা করে অন্তত আসন নিতে পারতো। সেই আশংকাতেই কি তবে বৃহৎ বাম জোট হল না এই বঙ্গেও।অস্ট্রিয়ান সমাজতন্ত্রী অটো বাউয়ার ১৯২৭ সালে বলেছিলেন, ---- where the working class is divided, one workers' party embodies sober, day-to-day Realpolitik, while the other embodies the revolutionary will to attain the ultimate goal. Only where a split is avoided are sober Realpolitik, and revolutionary enthusiasm united in one spirit. এমন কথা শুনলে যদিও এই বাম দলগুলোর নেতৃত্বই হেসে গড়াগড়ি দেবেন। কারণ এত কিছু ভেবে তারা জোট করেন না।

    প্রায়শ্চিত্ত? 

    গত লোকসভা ভোটে পশ্চিমবঙ্গের সিপিআইএম নিজের ভোট ফেরত আনার জন্য সচেষ্ট হয়নি। কারণ তাদের ভাষণ ছিল মূলত তৃণমূল কংগ্রেস বিরোধী। যদিও সিপিআইএমএল লিবারেশন মূলত বিজেপির বিরুদ্ধে কথা বলেছিল। ফলে এক অর্থে তারা তৃণমূলকে সাহায্য করেছে। কিন্তু সেই তৃণমূলের দিকে ঝুঁকে থাকা অবস্থান নিয়ে তাদের দলের একাংশের মধ্যে প্রবল আপত্তি ছিল। তবে কি আজ সেই অংশকে খুশী করতেই এই বৃহৎ বাম জোটের অজুহাত এলো? নীতি বিসর্জন দিয়ে দলের সদস্যদের ধরে রাখা, কিছু সদস্য সংখ্যা বাড়ানো, এই বুঝি বাম আদর্শের ভিত্তি? অথচ প্রায় বিনা দোষেই কবিতা কৃষ্ণানকে দল থেকে তাড়ানো হয়েছিল। অর্থাৎ দলের নেতাদের প্রতিদ্বন্দ্বি হলে অল্প বা বিনা দোষেই বহিষ্কার, আবার সেই নেতৃত্বকেই অটুট রাখতে প্রয়োজনে নীতি বিসর্জন দিয়ে বৃহৎ বাম জোটের অজুহাত? 

    INDIA–র আঠা কি বামেরা হতে পারতেন না?

     দেশ জুড়ে INDIA নামক জোটটিকে অকেজো করার দায় আজ বামপন্থীদের কাঁধে এসে পড়লো। INDIA নামক জোটটির দফা রফা করে বাম দলগুলো যেভাবে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের পদাংক অনুসরণ করল সেটা খুবই দুর্ভাগ্যের। কোথায় বামেরা হবেন আঠা (ইংরেজিতে আজকাল গ্ল্যু শব্দটা ব্যবহৃত হচ্ছে), যে ভূমিকা শারদ পাওয়ারের মত আপাদমস্তক দক্ষিণপন্থী দল নিচ্ছে, এক সময় জ্যোতি বসুকেও যে ভূমিকায় দেখা গেছে, যে ভূমিকার জন্যই তাঁকে দেশের সমস্ত নেতারা চিরকাল মনে রাখবে, সেটুকু ভূমিকা নিতে ব্যর্থ হল জ্যোতি বসু এবং বিনোদ মিশ্রের উত্তরসূরীরা।    

    ২০২৯-সালের আগেই কি তবে হাল ছেড়ে দিল বামেরা? 
    INDIA নামক জোটটিকে সফল করার দায়িত্ব তারা নিজেদের কাঁধ তুলে নিল না। বামেরা হয়তো যুক্তি দেবেন যে প্রধান জোট সঙ্গীরা নিজেদের মধ্যে মারপিট করে, এর দায় বামেদের কেন নিতে হবে? কথাটা অর্ধসত্য। কারণ যাদের ক্ষেত্রে আদর্শ প্রধান নয়, তাদের ঘাড়ে দায় চাপিয়ে বামেরা যদি এক এক রাজ্যে এক এক রকম আচরণ করেন তবে আর বাম নামের অধিকার তাদের থাকে কী? দেশে যদি বিজেপিই ক্ষমতা থেকে যায় তবে বামেদের দুই তিনটে আসন বাড়িয়ে লাভ কী? বাম দলগুলি চাইলে যে কোনো মূল্যেই এই INDIA-কে রক্ষা করবেন কি না, প্রশ্ন সেটাই। বামেরা কি মনে করছেন এই জোটের আর তেমন দরকার নেই? 
    মহারাষ্ট্রে উদ্ভব শিবসেনা গোষ্ঠী, কংগ্রেস আর শারদ পাওয়ার - দের সাথে আসন রফা নিয়ে বৈঠকে নাকি সিপিআইএম তাদের মনে করিয়েছে যে দেশে বাম শক্তির থাকার দরকার আছে। কিন্তু প্রশ্ন, বামেদের দরকার কেন তারা কি নিজেরাই জানেন? বিজেপি যখন ঘৃণা ভাষণ দেবে তখন সংসদে (বা রাস্তায়) বিরোধিতার জন্য বামেদের লাগবেই তেমন কোনো কথা নেই। সংসদের বিজেপি বিরোধী বেঞ্চ ভালই লড়াই করে। বীমা বেসরকারিকরণ বা অভিন্ন দেওয়ানি বিধির বিরোধিতার ক্ষেত্রেও একই কথা সত্য। তবে? বামেরা যদি ভারতের সংবিধানের মধ্যে যে ইংরেজ দাসত্ব লুকিয়ে আছে তার বিরোধিতা করতেন সংসদে বা বিধানসভায়, তারা যদি জনপ্রতিনিধিদের হাতে সর্বোচ্চ ক্ষমতার জন্য লড়াই করতেন সংসদে বা বিধানসভায়, তারা যদি সম্পদ কর বসানোর জন্য লড়াই করতেন সংসদে বা বিধানসভায়, তারা যদি সাংসদ, বিধায়ক এবং কাবিনেট স্তরের আমলাদের পরিবারের সরকারি ইস্কুল এবং হাসপাতালে যাওয়া বাধ্যতামুলক করতে লড়াই করতে পারতেন সংসদে বা বিধানসভায় তবে তাদের প্রয়োজন সম্পর্কে একটা সার্বজনীন বোধ জন্ম নিতো। অথবা সংসদ এবং বিধানসভার বাইরে তারা যদি হিন্দুত্বের সংজ্ঞা নিয়ে জাতীয় বিতর্কে নামতে পারতেন তবে তাদের বিশেষ প্রয়োজনীয়তা মানুষ টের পেতেন। সংসদীয় গণতন্ত্রে সকল বিরোধিরাই হাবে ভাবে সমাজতন্ত্রী। তাদের সাথে টক্কর দিতে হলে শুধু গম্ভীর মুখে ঘুরলেই চলবে না। সর্বপ্রথমে দরকার নিজেদের বাম অবস্থানকে সংজ্ঞায়িত করা। কিসে তারা বাম? এখনো বামেরা জানে না সংসদে বা সরকারে ঠিক কোন ভূমিকা বাম, আর কোনটা অ-বাম। কারণ জ্ঞান তৈরি হয় কাগজে কলমে শুধু না, বাস্তব অভ্যাসে। আর সরকারে গিয়ে বাম হয়েই থাকার অভ্যেস বামেদের নেই। হবেই বা কি করে? আগেই বলেছি, তাত্ত্বিকভাবেই তারা স্বীকার করেননা যে সরকারে যাওয়াটাই তাদের প্রধান কাজ। 
    যাই হোক্‌ এখন যে স্তরে ভারতের সাম্যবাদী আন্দোলন রয়েছে, সংবিধানের নীতিগুলিকে রক্ষা এবং প্রসারিত করার জন্য বিজেপিকে পরাজিত করাই বামেদের প্রধান লক্ষ্য হওয়ার কথা ছিল। তারা চাইলে বিজেপির বিরুদ্ধে এক গভীর রাজনৈতিক, মতাদর্শগত সংগ্রাম করতে পারতেন। এবং INDIA জোটটির গুরুত্ব রাজনৈতিক এবং মতাদর্শগতভাবে প্রতিষ্ঠা করতে পারতেন। সেই দায়িত্ব তাদেরই তুলে নেওয়ার কথা ছিল। এবং এই কাজের জন্য তারা এক বৃহত বাম জোট গঠন করতে পারতেন। তার বদলে, তারা ঝাড়খন্ডে বাম জোট ছেড়ে আসন নিচ্ছে, মহারাষ্ট্রেও তাই। অথচ পশ্চিমবঙ্গে তাদের হঠৎ বাম জোটের দরকার হয়ে গেল!  

    অস্থিরমতি বামেরা?

    একদিকে শুধু মিঠুন চক্রবর্তী নয়, খোদ মোদী তীব্র ঘ্ররীনা ভাষণ ছড়াচ্ছেন মহারষ্টড় আর ঝাড়খন্ড ভোটে। আর বিপরীতে ২০২৪ -এর লোকসভা ভোটে একটু ভাল ফল (মোদীকে এন ডি এ নির্ভর বানিয়ে) করেই সন্তুষ্ট বামেদের INDIA জোটে আর মন নেই। এত অস্থির তাদের চিত্ত, বিজেপি কিন্তু ঠিক বিপরীত মেরুতে রয়েছে। তারা হাল ছাড়ার পাত্র নয়। অমিত শাহ মরীয় হয়ে বলছেন যে আদিবাসীদের অভিন্ন দেওয়ানি বিধি থেকে বাদ দেওয়া হচ্ছে। এই কঠিন সময়ে বামেরা ইণ্ডিয়া জোটের থেকেও বেশী বাম জোটের অজুহাত তুলছেন বিজেপি বিরোধিতায় অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে।  বামেদের এজেন্ডা সমাজতন্ত্র, অথচ তাদের ঘোষিত লক্ষ্য হয়ে গেছে সংকীর্ণ দল রক্ষা আর কয়েকজন সদস্য সাময়িকভাবে বাড়ানো। যা পয়সা নেওয়ার মত দুর্নীতি না হলেও এক রকম অসততা তো বটেই। এই সদস্যদের স্থায়িত্ব সাময়িক কারণ সমাজতন্ত্রের আদর্শ লক্ষ্য যত দূরে চলে যাচ্ছে, সদস্যদের স্থায়িত্বও কমতে থাকে। যদিও আজকের এই জোট ভাঙ্গনপন্থীদের সাথে বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী কমিউনিস্ট আন্দোলনকে এক সারিতে দেখা যায়না, কিন্তু এই অস্থিরতার আভাস পাওয়া যায় বাম ইতিহাসেও।  

    অস্থিরতার ইতিহাস

    দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হতেই, ইয়োরোপের দেশগুলিতে ১৯৪৫ সালের ভোটে কম্যুনিস্টদের ভোট শতাংশ এরকম ছিল, অস্ট্রিয়া - ৫.৪%, বেলজিয়াম- ১২.৭%, ডেনমার্ক-১২.৫%, ফিনল্যান্ড-২৩.৫%,  ফ্রান্স-২৬%, ইতালি-১৯%, নরওয়ে-১২%, সুইডেন-১০.৩%। পঃজার্মানি-৬%। ফ্রান্সে পর পর দুটি ভোটেই কম্যুনিস্টরা খুব ভাল ফল করলো। ১৯৪৫ সালে ২৬% আর ১৯৪৬ সালে আরও বেশী, প্রায় ২৯%। সমাজতন্ত্রী আর কম্যুনিস্টদের যৌথ ভোট ধরলে তারাই সংখ্যাগরিষ্ঠ ইতালিতে। ১৯৪৬ সালের ভোটে ইতালীয় কম্যুনিস্ট পার্টি পেল ১৯% ভোট আর সমাজতন্ত্রীরা পেল প্রায় ২১% ভোট। অন্যদিকে দক্ষিণপন্থী দল পেয়েছিল ৩৫% ভোট। ফিনল্যান্ডে কমিউনিস্টরা মধ্যপন্থী অ-বাম দলের সাথে জোট সরকারে থাকল। এছাড়া হাঙ্গেরী আর চেকোস্লোভাকিয়াতে কম্যুনিস্ট পার্টি ভোটে ভাল ফল করলো। এই পাঁচটি দেশেই তারা দক্ষিণপন্থী দলের সাথে জোট করে সরকারে আসীন হল। কিন্তু কি এমন হল যে চার পাঁচ বছর যেতে না যেতেই, ১৯৫০ সালের মধ্যেই কম্যুনিস্টদের অবস্থা খারাপ হতে শুরু করলো। ১৯৪৮ সালে পশ্চিম জার্মানি, ডেনমার্ক, নরওয়ে, বেলজিয়াম, ইংল্যন্ড, হল্যান্ড আর অস্ট্রিয়াতে স্বাধীন শক্তি হিসেবে তাদের গুরুত্ব কমে গেল। ইংল্যন্ডে মাত্র দুজন জনপ্রতিনিধিতে নেমে এলো কম্যুনিস্টরা। একমাত্র স্পেন আর পর্তুগাল, অর্থাৎ যেখানে তখনো ক্ষমতায় স্বৈরতান্ত্রিক দক্ষিণপন্থা, সেখানে কম্যুনিস্টরাই মুখ্য বিরোধী পক্ষ থাকলো। অর্থাৎ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর উন্নত দুনিয়ায় কম্যুনিস্টদের এগোনোর বিরাট সুযোগ সামনে এলো অথচ আমরা পারলাম না। দায় ও দায়িত্ব কিন্তু অস্থিরমতি কম্যুনিস্টদের নিতেই হবে। সমাজতান্ত্রিক এবং দক্ষিণপন্থী দলগুর সাথে কম্যুনিস্টদের জোট হল, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে। কিন্তু সেটা কতটা নৈতিক ছিল আর কতটা তথাকথিত কৌশল সেটা নিয়ে সংশয় থাকেই। তাই যুদ্ধে জিতেই তাদের ‘জোট ছেড়ে দি-জোট ছেড়ে দি’ ভাব চলে এল। আজকের পশ্চিমবঙ্গের মতই। সেদিন গ্রীস ছিল এর আদর্শ উদাহরণ। গ্রীসে বেশ শক্তিশালী কমিউনিস্ট পার্টি অভ্যুত্থানের ডাক দিয়ে বসলো। সেই অভ্যুত্থানের মুখ থুবড়ে পড়ার ফলে, বিভিন্ন দেশে সরকারে থাকা দলগুলির মধ্যে অভ্যুত্থানপন্থীদের আওয়াজ জোরালো হলো। একদিকে জোটকে শান্তিপন্থী বলে গাল দেওয়া শুরু হল ‌আর অন্যদিকে গ্রীসের কম্যুনিস্টদের কচুকাটা করা শুরু হল, ফলে সরকার থেকে বেরিয়েই যেন বা নিশ্চিন্ত হলেন দেশে দেশে কম্যনিস্টরা। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ইয়োরোপের পুঁজিবাদী দেশগুলিকে হুমকি দিয়ে রেখেছিল, মার্শাল ঋণ দেওয়ার একমাত্র শর্ত হল বাম মুক্ত পশ্চিম ইয়োরোপ। ফ্রান্সের মার্কিন দূত জেফারসন কাফেরির ভাষায়, I told Ramadier no communists in government or elsewhere.. ১৯৪৭-১৯৪৮ সালের মধ্যে ফ্রান্স, ইতালি, বেলজিয়াম, লুক্সেমবুর্গ, অস্ট্রিয়া, ফিনল্যান্ড সব দেশে কম্যুনিস্টদের শাসক জোট থেকে বহিষ্কার করলো দক্ষিণপন্থী দলগুলি। এক্ষেত্রে তারা সব ধরনের নোংরামির আশ্রয় নিল। ইতালিতে মাফিয়াদের উত্থান ঘটাতে পিছুপা হল না। মাফিয়ারা বাম খুঁজে খুঁজে হত্যা করা শুরু করলো। শেষে তোগলিয়াত্তিকেও গুলি করা হল। যে কোনো ভাবেই হোক কম্যুনিস্টরা যাতে বিক্ষোভে নামে, এটাই ছিল উদ্দেশ্য। বিক্ষোভ হল, উত্তাল হল ইতালির শহর। কম্যুনিস্টরা অভ্যুত্থান করতে চাইছে, এই অজুহাত তুলে তাদের বের করে দেওয়া হল। একটি শ্রমিক আন্দোলন আসলে গোপনে অভ্যুত্থানের প্রস্তুতি নিচ্ছে, এই বলে বিতাড়িত হলেন ফ্রান্সের বামেরা। এর সাথে চেকোস্লোভাকিয়ার কম্যুনিস্ট দলের কৌশলকে নিয়ে অপপ্রচার চালালো দক্ষিণপন্থীরা। চেকোস্লাভিয়াতে দক্ষিণপন্থীদের সাথে জোট সরকারে থেকে তারা সেই সরকারকে হাতিয়ার করে ক্ষমতার শীর্ষে পৌঁছালেন এবং পুঁজিবাদী রাষ্ট্রকে চূর্ণ করার কাজে হাত দিয়েছিলেন। তাদের কৌশিক্সে দলিল যা কৌশিক্সে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কর্মসুচী, সেই সময় বিরাট বিতর্কের জন্ম দেয়। দক্ষিণপন্থীদের সাথে জোট সরকারে যাওয়া এবং সেই সরকারকেই অভ্যুত্থানের হাতিয়ার করার থিসিস অনুযায়ী তারা সফলও হলেন। যদিও সোভিয়েত ইউনিয়নের সহযোগিতা না থাকলে এই সাফল্য অত সহজে হতো না, তা বলাই বাহুল্য। প্রসঙ্গত বলে রাখা ভাল, পশ্চিম ইয়োরোপে এভাবে বিতাড়নের ঘটনা না হলে, পুর্ব ইয়োরোপে দক্ষিণপন্থীদের তাড়ানো হতো না- সোভিয়েত ইউনিয়নের তেমনই বয়ান ছিল। সাম্রাজ্যবাদের কাজ তারা করেছে, করবেই। কিন্তু প্রশ্ন হল পশ্চিম ইয়োরোপের কম্যুনিস্টরা এই আক্রমণকে মোকাবিলা করার জন্য কতটা প্রস্তুত ছিলেন? পশ্চিম ইয়োরোপের দেশগুলিতে কম্যুনিস্টরা হয়তো ভেবেছিলেন ফ্যাসিবাদ বিরোধী যে জোট হয়েছে তা যুদ্ধের পরও একই চরিত্র নিয়ে বহাল থাকবে! কম্যুনিস্ট দলগুলির একদম তাগিদ ছিল না, তেমন নয়। সরকার থেকে বিতাড়নের আগে, November 1946, থোরেজ বললেন যে তারা একটি ফরাসী শ্রমিক দল তৈরী করতে চান যা কম্যুনিস্ট ও সমাজতন্ত্রীদের যৌথ মঞ্চ হবে। উদ্দেশ্য গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। ১৯৪৪ সালেও তিনি একবার সমাজতন্ত্রীদের নিয়ে একটি পার্টি করার কথা বলেন। ওদিকে তোগলিয়াত্তি ভ্যাটিকান সিটির স্বশাসন নিয়ে যে চুক্তি আগে হয়েছিল তাকে অনুমোদন দিলেন। ফলে তাদের তাগিদ ছিল। হতো একটু বেশীই ছিল, দক্ষিণ দিকেই ঝুঁকে গেছিলেন। কিন্তু আন্তর্জাতিক কম্যুনিস্ট আন্দোলন যদি অস্থির মতি না হতো তবে দক্ষিণ দিকে ঝোঁকা সঠিকবাবেই মোকাবিলা করা যেত।  ফ্রান্স আর ইতালির সংবিধান রচনার ক্ষেত্রে এই দুই পার্টির  জোটবদ্ধ থাকার চেষ্টা ঐতিহাসিক বলেই মনে হয়েছে। যদিও এক্ষেত্রে থোরেজের থেকে তোগলিয়াত্তি আরও ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছিলেন। যার ফলে তাদের সরকার থেকে বের করে দেওয়া সত্ত্বেও ঐ সংবিধানের সুবিধা তারা নিতে পেরেছিলেন ফ্রান্সের তুলনায় অনেক বেশী। এক কক্ষের সংসদ হোক, চেয়েছিল দুটি পার্টিই। কিন্তু তোগলিয়াত্তি এটা নিয়ে বেশী জেদ করেননি। অথচ ফরাসী দল এটা নিয়ে বিরোধিতা শুরু করেছিল এমনই যে একটি গণভোটের ব্যবস্থা করতে হয়েছিল এবং সেখানে এমনকি বামেদের একটা বড় অংশও দ্বি-কক্ষের পক্ষে ভোট দেয়। এই পরাজয় তাদের জনপ্রিয়তায় ফাটল ধরায়। আসলে ফরাসী কম্যুনিস্ট দলের সমস্যা এটাই ছিল যে তাদের শক্তি, তাদের ভোট, তাদের আসন এবং ফ্রান্সের সমাজতন্ত্রীদের ভোট ইতালির তুলনায় শক্তিশালী ছিল। যার ফলে কম্যুনিস্টদের চিরকালের অভ্যেস মত, ফরাসী কম্যুনিস্ট পার্টি অস্থিরমতি হয়ে বৃহদ বাম জোটের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল, এবং ফ্রান্স মোটামুটি দুই জোটের রাজনৈতিক মঞ্চে পরিণত হোক এটাই চাইলেন। অর্থাৎ জোট ধর্ম পালন করার ক্ষেত্রে ফরাসী দল পিছিয়ে পড়েছিল, যার ফল তাদের বিতাড়নের পর তাদের অসুবিধা হয়েছে অনেক বেশী। কিন্তু এক কথায় বললে তোগলিয়াত্তি বা থোরেজ সরকারে যাওয়ার আগে যে সব কর্মসূচীর কথা বলেছিলেন তা পালন করার জন্য মরীয়া হয়নি। লেনিনও যেমন হননি নিজের দেশে। কিন্তু মরীয়া না হয়ে যে ইতালি ফ্রান্সের কম্যুনিস্ট পার্টি বামপন্থী থাকতে পারলো সেটা নয়, বরং তারা বুর্জোয়া দলে পরিণত হল। ইংল্যন্ডের দিকে তাকালে আমরা দেখবো, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই লেবার দলের সঙ্গে আবার আদায় কাঁচকলায় সম্পর্ক হয়ে গেল তাদের। লেবার দলের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করার জন্য যদিও তারা ১৯৫১ সালে ‘british road towards socialism’ নামে কর্মসুচী গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু ১৯৪৫ থেকে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত এই ছয় বছর বড্ড বেশী দামী হয়ে গেল না? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রতিটা দেশেই জোট সরকারের সুযোগ এসেছিল, এবং প্রায় সর্বত্রই আমরা অভ্যুত্থানের জন্য বেশী আগ্রহী ছিলাম। 
    দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হল দক্ষিণপন্থীদের এই বহিষ্কার নিয়ে কমিনফর্ম ইতালি-ফ্রান্সের কম্যুনিস্টদেরকেই দোষারোপ করা শুরু করলো। কেন তারা নিজেরাই আগে বেরোয়নি। বা কেন তারা এমন সংস্কারবাদী জোট ও সরকারে গেল! কমিনফর্ম বৈঠকে সোভিয়েত প্রতিনিধি আন্দ্রেই স্‌দানভ ইতালীয় প্রতিনিধি লোঙ্গো কে বলেন যে তাদের আক্রমণাত্মক হওয়া উচিত ছিল আগেই। যুগোস্লাভিয়ান প্রতিনিধি অভিযোগ করেন যে আসলে ইতালীয় কমরেড শান্তিপূর্ণ পথে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা ভাবছেন এবং তার সঙ্গে এও যোগ করেন, ‘The Italian leading comrades did not take sufficient and consistent use of our experiences”. যুগোস্লাভিয়ার আর এক কম্যুনিস্ট মাইলোভ্যান জিলাস (যিনি নিজে আবার কালক্রমে টিটোর সাথে সংঘাতে বিপদে পড়েন) ফরাসী ও ইতালীয় কম্যুনিস্টদের সুবিধাবাদের খপ্পড়ে পরার অভিযোগ করেন এবং বলেন, ‘draw lessons from their work and the mistakes they have made’, দেখা গেল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পশ্চিম ইয়োরোপের দেশের কম্যুনিস্ট পার্টিগুলি বহু সংস্কারের প্রশ্নে বিভ্রান্ত অবস্থান নিলেন। 
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • আলোচনা | ০৫ নভেম্বর ২০২৪ | ৪৩৩ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ঠিক অথবা ভুল মতামত দিন