বিক্ষোভ
দেখা যাচ্ছে সর্বোচ্চ আদালত এবং উচ্চ আদালতের জজদের বিরুদ্ধে ইম্পিচ করার ঘটনার হার বেড়ে গেছে ২০১১ সালের পর থেকে। যদিও ইমপিচ করা মোটেই সহজ নয় --- Removal can take place only on the grounds of proved misbehavior or incapacity of the judge or by an order of the President passed after a majority of the total membership and a majority of not less than two-thirds of the members present and voting in each House of Parliament present an address to the President in the same session for such removal। স্বাধীন ভারতে প্রথম ইম্পিচ করার চেষ্টা হয় ১৯৯৩ সালে, যদিও সেটা সফল হয়নি। তার পর হল ২০১১, এবং তার পর থেকে গতি বেড়ে গেছে আচমকা। ২০১১, ২০১৫, ২০১৭, ২০১৮!!! বোঝাই যাচ্ছে জনতার আস্থায় ঘাটতি হচ্ছে, যার প্রতিফলন জনপ্রতিনিধিদের এই পরিবর্তিত আচরণে স্পষ্ট হচ্ছে। এমনকি my lordship শুনতে না চাওয়াই ভাল, এমন ভাবনা চিন্তাও শুরু হয়েছে আদালতের ভিতরে। দুষ্যন্ত দাভের কাছ থেকেই জানা যাক জনতার এই মোহমুক্তি কারণ। তিনি অভিযোগ করেছেন যে প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড়ের আমলে ঝুলে থাকা মামলা তো কমেইনি বরং বেড়েছে। সাড়ে চার কোটি মামলা যা গোটা দেশের আদালতে ঝুলে ছিল উনার বিচারপতি হিসেবে নিয়োগের আগে সেটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ কোটি ১০ লাখে। শুধু সর্বোচ্চ আদালতেই ঝুলে থাকা মামলার সংখ্যা ছিল উনসত্তর হাজার, সেটা তাঁর অবসরের সময় বেড়ে দাঁড়িয়েছে তিরাশি হাজার। ১ লাখ ৮০ হাজার মামলা ৩০ বছরের উপর ঝুলে আছে। বলাই বাহুল্য, বেশীরভাগ মামলা শ্রমিক, কৃষকের, ছোট ব্যবসাদার, নির্যাতিত মহিলা, দলিত আদিবাসীর। এতো গেল সর্বোচ্চ বিচারপতির প্রশাসনিক ব্যর্থতা। এবার তাকানো যাক তাঁর বিচারের গুনমানের দিকে। খুবই গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক মামলাগুলিতে চন্দ্রচূড় যা ভূমিকা নিয়েছিলেন সেগুলি নিয়েও শ্রী দাভে হতাশ। যেমন জয় শা-র বিসিসিআই মামলায় কারুর শাস্তি হল না। ইলেক্টরাল বন্ড মামলায় কেউ শাস্তি পেল না। ৩৭০ ধারা বাতিলকে বৈধ ঘোষণা তিনি করেছিলেন কিন্তু একইসাথে আশংকা ব্যক্ত করেছিলেন জম্মু কাশ্মীরকে রাজ্য হিসেবে অস্বীকার করা নিয়ে, তবু তিনি রাজ্য হিসেবে কাশ্মীরের স্বীকৃতি ফিরিয়ে দিলেন না। সিবিআই বিচারপতি ব্রিজভূষণ লোয়ার মামলায় তিনি (তখনো তিনি প্রধান বিচারপতি হননি) কোনো স্বাধীন তদন্তের অনুমতি দিলেন না। এমনকি হিন্দু মেয়ে আর মুসলিম ছেলের বিয়েতে চন্দ্রচূড় এন আই এ তদন্তের নির্দেশ দিয়েছিলেন। অযোধ্যার বাবরি মসজিদের রায়ের কথা সকলেই জানেন। আর আজ বলতেই হচ্ছে আদানি হিন্ডেনবার্গ মামলায় চন্দ্রচূড় সাহেব যে আলস্য দেখালেন সেটা ক্ষমার অযোগ্য। দাভে এমনও ভয়ংকর অভিযোগ করেছেন যে সিজেআই আসলে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সামনে কুঁকড়ে গেছিলেন। দাভের বক্তব্য হল বিচারপতিদের এমন কুঁকড়ে যাওয়ার উদাহরণ ইন্দিরা গান্ধীর সময়েও হয়েছিল। আমরা দেখছি বিরোধী দলের নেতা মন্ত্রী কর্মীদের ইডি সি বি আই বিনা বিচারে ধরে রেখে দিচ্ছে বছরের পর বছর, তথাকথিত আর্বান নকশালদেরকেও নানা মামলায় বিনা বিচারে আটক করা হচ্ছে বছরের পর বছর, স্ট্যান স্বামীকে ছাড়া হয়নি, সাঁইবাবাকেও না। উচ্চ আদালতই বার বার ইডি কে অনুমতি দিচ্ছে রাজ্যের সাথে কথা না বলেই রাজ্যের জনপ্রতিনিধিদের গ্রেপ্তার করতে।
অথচ বিচার ব্যবস্থার স্বাধীনতা নিয়ে বিচারপতিরা বাড়াবাড়ি রকম সরব। জমিদারি চলে গেলে জমিদার যেমন সরব হয়। কলেজিয়াম ব্যবস্থাকে রক্ষা করতে তারা ভয়ানক উদ্যোগী। অথচ বিপরীতে কিন্তু তাঁদের পক্ষ থেকে বিনা বিচারে আটকের সংখ্যা কমাতে কোনো সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। আবার সরকারকেও তেমন কোনো নির্দেশ বা এমনকি প্রস্তাবও দেওয়া হয়নি। পুলিশ বা কোনো এজেন্সি যদি দুই বছরের মধ্যে কেস ফাইল করতে না পারে তবে মামলা খারিজ হবে --- এই ন্যূনতম আইনও সরকার করেনি।
এত ঢাল তলোয়ার নিয়েও ভয়!!
কেন কুঁকড়ে যাবেন বিচারপতিরা? তাঁদের হাতে ঢাল এবং তরোয়াল কম দেয়নি সংবিধান। বিচারক হিসেবে সংবিধানকে ব্যাখ্যা করে তাঁরা যাকে খুশী শাস্তি দিতে পারেন, সেই ধারালো তরোয়াল তাঁদের আছে, কিন্তু আছে ঢালও। তাঁদের রয়েছে ১৯৮৫ সালের নিচ্ছিদ্র রক্ষাকবচ, তাঁদের জেল জরিমানা প্রায় অসম্ভব। আগেই বলেছি এমনকি ইমপিচ করাও অত্যন্ত কঠিন। এমনকি মহামান্য, মাই লর্ডশিপ না বললেও আদালত অবমাননা হবে!! তাহলে তাঁদের এত কুঁকড়ে যাওয়া কেন? তাঁদের জীবন যাতে স্থিতিশীল হয় তার জন্য এন্তার সুযোগ দিয়েছি আমরা।
সংবিধানসভার আলোচনায় বিচারপতিদের আর্থিক সুরক্ষা নিয়ে এমনকি জহরলাল নেহরুও সরব হয়েছিলেন। প্রতিনিধিরা কেউ বলেছিলেন তাঁদের পেনসনের পরিমান মাইনের থেকে কমানো যাবে না, তাঁদের অবসরের বয়স যাতে অনেক এগিয়ে আনা যায় তার জন্য সরব ছিলেন বহু প্রতিনিধি। মোদ্দা কথা হল যাতে তারা কখনো লোভে না পড়েন। যদিও কেউ বলতেই পারেন যে সংবিধান সভার বিতর্কে রাজ্য সভার সাংসদ হওয়ার লোভের কোনো টোটকা দেওয়া হয়নি। জজ থাকা অবস্থায় বা জজ হওয়ার আগে কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য হতে তারা পারেন না, কিন্তু এমন কোনো নিয়ম হয়নি যে অবসরের পর তারা সাংসদ হতে পারেন না। অথবা সংবিধান সভার বিতর্কে, আলোচনায় জাস্টিস লোয়ার পরিণাম হয়তো তারা কল্পনাতেও আনতে পারেননি। সেক্ষেত্রে তাঁদের বিবেচ্য শুধু লোভ হতো না, প্রাণনাশের বিপদ এড়ানোর সম্ভাবনাকেও তারা খতিয়ে বিবেচনা করতেন। ফলে সেই অর্থে বললে, লোভ এড়ানোর কোনও নিচ্ছিদ্র দাওয়াই দিতে পারেনি সংবিধান সভা!
শুধু একটা কথা সমস্ত নেতা সমস্ত বিচারক বলে গেছেন যে বিচারব্যবস্থাকে স্বাধীন হতে হবে। কার থেকে স্বাধীন? রাষ্ট্রের একটি অঙ্গ যদি বিচারব্যবস্থা হয় তবে তাকে অন্য দুই অঙ্গ, অর্থাৎ আইন প্রণয়নকারী সংস্থা এবং প্রশাসনের থেকে স্বাধীন থাকতে হবে, সামলাকে আমলা এবং জনপ্রতিনিধিদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে রাখতে হবে, এই হল মোদ্দা চাহিদা। কিন্তু এই নীতি কার্যকর করতে যে ফর্মূলাই ব্যবহার করা হচ্ছে, তার মধ্যেই অসংখ্য ফাঁক পাওয়া যাচ্ছে। কেন, এমন হাহাকার, স্বাধীনতার এতগুলি দশক পরেও? প্রশ্ন হল, রাজনীতি আওয়ার বাইরে যে স্বাধীনতার স্লোগান তোলা হল সেটা কতটা বাস্তব সম্মত? অথবা কতটা সংবিধান সম্মত?
সংবিধানের আত্মা
'সবার উপরে জনপ্রতিনিধিত্ব সত্য, তাহার উপর নাই'-- এই হল আমাদের সংবিধানের আত্মা। তাই সংবিধান সভায় প্রতিনিধিরা সেই আত্মাকে রক্ষা করার জন্য নানা রকম প্রস্তাব দিয়েছিলেন। বিচার ব্যবস্থা কে নিয়ন্ত্রণহীন স্বাধীন করার পক্ষে ছিলেন না বেশিরভাগ প্রতিনিধি, তাই সংবিধান সেই লাগামছাড়া স্বাধীনতা যা কার্যত স্বৈরাচারের অপর নাম, সেই ব্যবস্থা সংবিধান করেনি। কিন্তু বিচারব্যবস্থাকে যাতে সরকারি দল কব্জা না করতে পারে সেই ভারসাম্য নিয়ে আলোচনাও করেছিল সংবিধান সভার বৈঠকগুলো।
যেমন সিব্বন লাল সাকসেনা প্রস্তাব দিয়েছিলেন যে উভয় কক্ষের যৌথ অধিবেশনের দুই তৃতীংশের সম্মতিতে সর্বোচ্চ আদালতের বিচারপতিদের নামের তালিকা নির্দিষ্ট করা হোক, যার মধ্য থেকে একজনকে বেছে নেবেন বিদায়ী সর্বোচ্চ বিচারপতি। অথবা বিচারপতি একটি তালিকা দেবেন যার মধ্য থেকে একই প্রক্রিয়ায় জনপ্রতিনিধি বেছে নেবেন একজনকে। যদিও শেষ পর্যন্ত সংবিধানে লেখা হল যে রাষ্ট্রপতি (যা বকলমে প্রধানমন্ত্রী বা সরকারি দল ) সর্বোচ্চ বিচারপতির পরামর্শে এবং রাষ্ট্রপতি মনে করলে আরও কয়েকজন বিচারপতির পরামর্শ নিয়ে পরবর্তী প্রধান বিচারপতি স্থির করবেন। আর উচ্চ আদালতের প্রধান বিচারপতিদের ক্ষেত্রেও প্রক্রিয়া একই, যদিও মুখ্যমন্ত্রীরা চাইলে রাজ্যপালের মাধ্যমে প্রস্তাব পাঠাতে পারেন। মনে রাখতে হবে ভারতে রাষ্ট্রের অন্যান্য অঙ্গে (প্রশাসন, সশস্ত্র বাহিনী) রাজ্য এবং কেন্দ্রের ভাগাভাগি থাকলেও বিচারব্যবস্থায় সেটা নেই। এখানে বিচারব্যবস্থা কেন্দ্রীয় স্তরের একটি অখণ্ড কাঠামো। বিচার ব্যবস্থায় কোনো যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার প্রতিফলন নেই।
জজ নিয়োগ করা নিয়ে স্বাধীনতার ছয় মাস পর থেকেই শুরু হয়ে গেছিল বিতর্ক । হাইকোর্টগুলোতে অসাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় জজ নিযুক্ত হচ্ছে, এমন অভিযোগ উঠেছিল। আদালতগুলোর মোটা মোটা দেওয়ালের মধ্যে চলা সেই বিতর্ক প্রায় যুদ্ধের রূপ নিয়েছিল। যখন সর্বোচ্চ আদালতের প্রথম প্রধান বিচারপতি মারা গেলেন, কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় সরকার চাইছিল তাদের পছন্দ মত একজন জজ নিযুক্ত করতে। কিন্তু সর্বোচ্চ আদালতের প্রায় সমস্ত জজ পদত্যাগ করার হুমকি দিয়েছিল। এতদিনের প্রথা মেনে সব থেকে সিনিয়র জজকেই প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিযুক্ত করতে হবে, এই ছিল তাঁদের দাবি। যদিও বিতর্কটি জনতা জানতে পারল না। 1967 সালেও একটি রাজ্য কেন্দ্র সম্পর্কের গবেষণা কমিটি উচ্চ আদালতগুলির জজ নিয়োগ নিয়ে অসন্তোষ ব্যক্ত করে। 1973 পর্যন্ত সবচেয়ে যিনি সিনিয়র তাকেই প্রধান বিচারপতি করার রেওয়াজ চলেছিল। রাষ্ট্রপতি আর সর্বোচ্চ বিচারপতির প্রস্তাবে তাই কোনো তফাত হতো না। কিন্তু সেই বছর হঠাৎ করে তিনজন সিনিয়র কে টপকে একজনকে প্রধান বিচারপতি করা হল, প্রতিবাদে ঐ তিন সিনিয়র পদত্যাগ করলেন। শুরু হল সমাজ জুড়ে বিতর্ক।
এর পর ১৯৭৭ সালে কংগ্রেস সরকারের পতন হল, আইন কমিশন সুযোগ পেয়ে গভীর অসন্তোষ ব্যক্ত করলো। কিন্তু কংগ্রেস আবার ফিরলো। তারা এসেই সেই সমস্ত উচ্চ আদালতের জজদের গণ বদলি করলো যারা ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৭ সালে নেতাদের বিরুদ্ধে রায় দিয়েছিল। তাছাড়া কেন্দ্রীয় আইন মন্ত্রী সব রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে নির্দেশ পাঠিয়েছে যে জজ নিয়োগের প্রস্তাবের আগে কেন্দ্রের অনুমতি লাগবে। এর প্রতিবাদে একজন জজ মামলা করলেন। তার পরের 'জজ মামলা'-গুলির কথা আমরা জানি, এবং শেষ পর্যন্ত সংবিধানে লেখা (after consultation with such of the Judges of the Supreme Court and of the High Courts in the States as the President may deem necessary)
সর্বোচ্চ আদালতের সর্বোচ্চ বিচারপতির প্রস্তাব শুধু পরামর্শ নয় বরং অনুমতি হিসেবেই দেখতে হবে সর্বোচ্চ আদালতের এই রায় হল। সংবিধানের ১২৪(২) আর ২১৭ নম্বর ধারাতে পরিবর্তন এনে বলা হল যে সর্বোচ্চ আদালতের প্রধান বিচারপতির মতামত বা পরামর্শ বাধ্যতামুলক। জন্ম নিল কলেজিয়াম পদ্ধতি। জজ নিয়োগ কমিটি বা কলেজিয়ামের নেতৃত্বে থাকবেন প্রধান বিচারপতি। যদিও 2014 সালে বিজেপির ফ্যাসিস্ট পরিকল্পনার অন্তর্গত ৯৯ তম সংবিধান সংশোধন করে জজ নিয়োগ কমিশন বা NJAC আইন এলো, যা কলেজিয়াম ব্যবস্থাকে বাতিল করলো। কিন্তু ২০১৫ সালে
সর্বোচ্চ আদালত আবার মরিয়া হয়ে কলেজিয়াম ব্যবস্থাকেই ফিরিয়ে আনলো।
কলেজিয়াম নাকি জমিদারি?
প্রশ্ন হল জনপ্রতিনিধিদের প্রভাব, নিয়ন্ত্রণের বাইরে নিয়ে এসে এই কলেজিয়াম পদ্ধতি কি সংবিধানের আত্মা অনুযায়ী কাজ করলো? বাস্তবে এই কলেজিয়াম পদ্ধতির গোপনীয়তা, আদালতের মোটা দেওয়ালের মধ্যে কি চলছে তার হদিস জনসমক্ষে না আসা কি সত্যিই সুফল দিল? যদি দিতই তবে প্রধান বিচারপতিদের এমন প্রধানমন্ত্রীদের সামনে কুঁকড়ে যেতে হচ্ছে কেন? না পাওয়া গেল সুবিচার না বিচারপতিরা নির্ভয়ে রায় দিতে পারল, তারা কুঁকড়ে থেকেই গেল!!!
কলেজিয়াম পদ্ধতি শব্দটা সংবিধান সভার বিতর্কে ব্যবহৃত না হলেও কাছাকাছি ঐ ধরনের প্রস্তাবও এসেছিল। তার বিরোধিতা করে আম্বেদকর বলেছিলেন,
With regard to the question of the concurrence of the chief justice, ..... I personally feel no doubt that the chief justice is a very eminent person but after all the chief justice is a man with all the feelings all the sentiments and all the prejudices which we as common people have. I think to allow the chief justice is really to transfer the authority to the chief justice which we are not prepared to waste in the president or the Government of the day. therefore I think that's that is also dangerous proposition.
কলেজিয়াম পদ্ধতি মানে ওই কমিটিকে, প্রধান বিচারপতিকে বাকি জজরা তুষ্ট রাখবেন এই সম্ভাবনা প্রবল হয়। অন্তত যারা পরে প্রধান বিচারপতি হতে চাইছেন। অথচ আদালতের স্বাধীনতা মানে কিন্তু শুধু জনপ্রতিনিধিদের থেকে স্বাধীনতা নয়, জজদের পারস্পরিক স্বাধীনতাও বটে।
দ্রুত-সস্তা সুবিচারের বুলি
ঠিক সত্তর বছর আগে, ১৯ শে নভেম্বর, ১৯৫৪ নবগঠিত আইন কমিশনের ঘোষিত লক্ষ্য ছিল দ্রুত, সস্তা, সরল, সুবিচার পাওয়ার প্রকার-পদ্ধতি নির্দিষ্ট করা এবং বৃটিশ আমলের আইনকে উলটে দেখে পালটে দেওয়া। আবার জজদের নিয়োগ প্রক্রিয়া পর্যালোচনা করার দায়িত্ব পেল এই কমিশন। এদিকে সংবিধানের নির্দেশমুলক নীতিগুলিকে কার্যকর করতে বিচার ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাবে কমিশন, এমনও বলা হল। আবার পেনাল কোড আর সংবিধানের মধ্য যদি কোনো বিরোধ দেখা যায় তবে পেনাল কোড বদলানোর প্রস্তাবও তারা দেবে। যদিও কমিশন নিজেরাই স্বীকার করেছিল যে তাঁদের সদিচ্ছার সাথে সরকার, বা প্রশাসন তেমন সহযোগিতা করেনি। যেমন তারা নিজেদের গবেষণার সুবিধার জন্য একটা প্রশ্নপত্র তৈরী করেছিল, যেখানে ছিল ১৯৩ টি প্রশ্ন। ৬০০০ কপি সেই প্রশ্নপত্র বিলি করা হয় উকিল, জজ, আইনজ্ঞ, মন্ত্রী, আমলা, বিশিষ্ট জনদের কাছে, কিন্তু তেমন আশাপ্রদ উৎসাহ মেলেনি। আর কেমন দ্রুত সস্তা বিচার জনতা পেল তার খতিয়ান আগেই দিয়েছি। শুধু একটা উদাহরণ বাড়ানো যাক।জমিদারি চলবে না এদেশে সেই আইন অনেক আগেই হয়েছিল, কিন্তু কার্যকর হতো না কারণ ভূস্বামীরা উচ্চ আদালত, সর্বোচ্চ আদালতে চলে যেতেন আর কৃষকদের পক্ষে সেই পয়সা ও সময় খরচ করা সম্ভব হতো না। তাই বর্গাদারদের দেওয়া হল উচ্ছেদ বিরোধী আইনের রক্ষাকবচ আর গ্রামীণ পরিসরেই রফা পাকা করার ব্যবস্থা। কার্যত জমিদারদের কাছ থেকে যেদিন উচ্চ আদালতে যাওয়ার অধিকার কেড়ে নেওয়া হল সেদিন থেকেই বাস্তবে জমিদারি বিলোপ আইন কার্যকর হয়েছিল এরাজ্যে, এদেশে। আইনের চোখে সবাই সমান এই ভ্রান্ত নীতিকে অস্বীকার করেই সেদিন ১৯৭৭ সালের পর জমিদারি আইন কার্যত বাতিল হল।
১৮৩৩/৩৪ সালে যে বৃটিশ আইন কমিশন প্রথম গঠিত হয়, এদেশে শাসন শোষণ করার জন্য, তাদেরও ১৯২৩ সালের কমিশনের স্লোগান ছিল দ্রুত, সস্তা ও সরল বিচার। এদিকে স্বাধীন ভারতের আইন কমিশন, যা শ্রী সেতলাওয়ারের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছিল, তারা বলেছে যে স্বাধীনতার পরবর্তী বছরগুলিতে সরকার অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে নাকি এতই চাপে ছিল যে ইংরেজ আইনকে পর্যালোচনা করে পরিবর্তন করার সময় বা উৎসাহ পায়নি সরকার। পশ্চিমবঙ্গ এবং উত্তর প্রদেশ সরকার ১৯৫২/৫৩ সালে নিজেদের মত করে কমিশন বানায় বিচার ব্যবস্থার অভ্যন্তরীণ প্রশাসন, আইন এবং গ্রামীণ অঞ্চলে বিচারের রূপ পদ্ধতি নির্ধারণ, আইনি প্রকরণ, সরকারি সাহায্য ইত্যাদি পর্যালোচনা করতে। আসলে সরকার বোধহয় ব্রিটিশ আইনি ব্যবস্থা নিয়ে যথেষ্ট সন্তুষ্ট ছিল। সেটা আর বলে উঠতে পারেনি আইন কমিশন। বলবেই বা কি করে? তারা নিজেরাই যে ব্রিটিশ আইনি ব্যবস্থা নিয়ে ভয়ঙ্কর মোহগ্রস্ত ছিলেন।
প্রথম আইন কমিশনের রিপোর্টে ইংরেজ আইন কমিশন নিয়ে যে মাত্রাছাড়া গদ্গদ ভাব, সেটা এক কথায় বিস্মিত করে আমাদের। আবার ভারতের প্রাচীন হিন্দু আইনি ব্যবস্থা নিয়েও বিচিত্র আদিখ্যেতা। রাজার আইন আর প্রজার আইন আলাদা, বিদেশী শাসক আর নিগারের অধিকার আলাদা, প্রাচীন যুগে ব্রাহ্মণ আর শূদ্রের অধিকার আলাদা, পুরুষ আর নারীর আইন আলাদা ---- কমিশনের প্রধানরা যেন এই অ আ ক খ ভুলে গেছিলেন। সাধে কি আর আজ অমন শিক্ষিত জজ চন্দ্রচুড়ও এমন কুঁকড়ে যান!
ভোট নির্ভর যুক্তরাষ্ট্রীয় মার্কিন বিচারব্যবস্থা
আমেরিকা এখনও অধিকাংশ রাজ্যে নির্বাচিত জজ বহাল রেখেছে। এমনকি কোথাও কোথাও রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি বা সদস্য/সমর্থক পরিচয় নিয়েও জজ নির্বাচিত হয়। মোট চার রকম ব্যবস্থা সেখানে। কিছু রাজ্যে রাজনৈতিক দলের লোক হিসেবে জজ নির্বাচন করে জনতা, কিছু রাজ্যে রাজনৈতিক পরিচয় ছাড়াই জজ রা ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। কোথাও সংসদ নিয়োগ করে, কোথাও বিশিষ্ট কমিটি। কিন্তু যাই হোক, বিচারব্যবস্থা জনপ্রতিনিধিদের থেকে স্বাধীন এমন বলা যাবে না। *যার ফলে বিচার ব্যবস্থাতেও যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো বহাল থাকে*। অর্থাৎ কেন্দ্রে যে দল জিতবে তারই পছন্দমত লোক সর্বোচ্চ আদালতের প্রধান বিচারপতি হবেন। কিন্তু রাজ্যে রাজ্যে আবার সেখানে জিতে থাকা দলের লোক হবে। সর্বোচ্চ আদালতে গর্ভপাত নিয়ে যে আইনই হোক, রাজ্যে রাজ্যে আলাদা হতে বাধ্য।
আবার আদালতে বিচার চলাকালীন যে জুরি বোর্ড গঠন হয় সেটা একেবারে নাগরিক সমাজের বিভিন্ন অংশের প্রতিনিধি। আমেরিকাতে জনতার দরবার বসে এক অর্থে। আমাদের দেশে তেমন হয়তো এখনও সম্ভব নয়, কিন্তু সংবিধান সভার শ্রী সাক্সেনার প্রস্তাব নিয়ে ফের চিন্তা করার সময় হল, কলেজিয়াম এবং দুই তৃতীয়াংশ সাংসদদের অনুমতি না হলেও অন্তত পরামর্শটুকু নেওয়া হোক। কিন্তু সাংসদদের ভীতি কাটাতে হবে, গোপন ব্যালটে তারা ভোট করতে পারে সেক্ষেত্রে।
আসলে আমেরিকা হোক বা ভারত, বিচারব্যবস্থার সংস্কারের কথা সকলেই বলছেন, কিন্তু বাস্তবে যা হচ্ছে তা ওই থোর বড়ি খাড়া। হবেই, কারণ আইনের চোখে সকলে সমান, শক্তিশালীর রক্ষাকবচ এই স্লোগান এখনো বিচারের মূল দর্শন!
ফ্যসিস্টরাও কলেজিয়াম চায়না। জনতার ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে তারা তারা চায় সম্পূর্ণ করায়ত্ব বিচার ব্যবস্থা। আমরা জানি বিজেপির রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি রাম মন্দির কিন্তু তারা নিজেরা কার্যকর করার সাহস পায়নি। আদালতের কাঁধে ভর করে রাম মন্দির প্রতিষ্ঠা করতে হয়েছে তাদের। ওয়েস্টমিনিস্টার ব্যবস্থাকে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ না করে উচ্চ আদালত সরাসরি ইডি সিবিআই দের মন্ত্রী দের গ্রেপ্তার করার অনুমতি দিচ্ছে এমন নিদারুণ স্বাধীনতাও দেখতে হচ্ছে আমাদের!!