শিশু যখন প্রথম কথা শেখে, সে শুরু করে এক অক্ষর কি দুই অক্ষর দিয়ে। আস্তে আস্তে সে অক্ষরের পর অক্ষর জুড়ে শব্দ তৈরি করতে শেখে, শেখে শব্দের পর শব্দ জুড়ে বাক্য। এই শিক্ষা সে পায় তার চারপাশের মানুষজন, পশু পাখি, জীবজন্তু, পোকামাকড়, গাছপালা, টেবিল চেয়ার আরো পঞ্চাশ রকমের প্রাণী ও অপ্রাণ বস্তু থেকে।
আধো আধো বুলি থেকে গড়গড়িয়ে গল্পের বই পড়ার পর্যায়ে যেতে শিশুকে শিখে নিতে হয় বানান, ব্যকরণ, বাক্যের গঠন। যুক্তাক্ষর সেই শেখার পথে এক গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। সে ধাপে আটকে কিছুটা সময় লাগতেই পারে অনেক শিশুরই। তাতে তার গল্পের ভুবন যেন ছোট না হয় তাই অভিভাবকরা নিজের মত করে সমাধান খুঁজে নেন।
অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই সমাধান হয় মুখে মুখে গল্প বানিয়ে বলা। সুস্মিতা কুণ্ডু শুধু নিজের শিশুটি নয়, আরো পাঁচটা শিশুর কথা ভেবে লিখে ফেলেছেন এমন কিছু গল্প যা সম্পূর্ণ যুক্তাক্ষর বর্জিত। সে গল্প উঠে এসেছে শিশুর চারপাশের পরিবেশ থেকে। বিড়াল, খরগোশ, মাকড়শা, শুঁয়োপোকা, ভেড়া, পাতাবাহার গাছ সেসব গল্পের মূল চরিত্র।
ছোটোমানুষের জগতে জাদুকর, রাজকন্যে আর পরী থাকবে না তাও কি হয়! তারাও আছে বৈকি। দুষ্টুলোক আছে, ভালমানুষের হাতে তাদের শাস্তি পাওয়াও আছে। শাস্তি আছে কিন্তু হিংস্রতা নেই। দুষ্টুলোক শাস্তি পায় বটে কিন্তু সেসব শাস্তি তাদের চূড়ান্ত শারীরিক ক্ষতি করে না।
মনে আছে এক বান্ধবীর কন্যা উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরির টুনটুনির বই পড়তে গিয়ে কেঁদে উঠে গিয়েছিল। টুনটুনি কেন রাণীদের নাক কাটালো? নাক কাটলে তো খুব ব্যথা লাগবে, রক্ত পড়বে। বাঘের রাঁধুনি বৌ কেন বাঘের ছানাদুটোকে অকারণে মারল? ওরা তো স্রেফ মারবে বলেছিল, বাঘ তাদের শাসনও করেছে, তাহলে?
সেই শিশু ওই অকারণ হিংস্রতা মেনে নিতে পারে নি। আর তাকে পড়ানো যায় নি ও বই। এরপরে অনেকবার ভেবেছি আমাদের রূপকথাগুলোতে অকারণ হিংস্রতার ছড়াছড়ি, শাস্তি মানে নাক কান কেটে দেওয়া বা মেরে ফেলা তাই হয়ত আমাদের স্বভাবেও একরকম চাপা হিংস্রতা থাকে। তাই নিষ্ঠুর আচরণ একরকম কৃতিত্ব বলে গণ্য হয় আমাদের সমাজে।
সুস্মিতার গল্পের ব্যতিক্রমী মজাদার কিন্তু কার্যকরী শাস্তির বিবরণগুলো এই কারণেই আমার খুব ভাল লেগেছে। এমনিতে প্রতিটা গল্পেই পশু পাখি পোকা মাকড়ের প্রতি তাঁর মমত্ব চোখে পড়ে। হাতি জিরাফ বিড়াল ভেড়া শুধু নয় শামুক শুঁয়োপোকা মাকড়সারাও আছে তাঁর মায়ার পশমে বোনা গল্পে। রোবোটছানা, বাড়ি, উলের গোলারাও মোটে চুপচাপ নয়, দিব্বি নড়েচড়ে, কথা বলে, গল্পের নদী তুরতুরিয়ে বয়ে যায়।
গল্পগুলো পড়তে পড়তে পৃথিবী শুধু মানুষের নয়, সক্কলের এই বোধ আপনি আসে। এসব গল্প পড়ে যারা বড় হবে তারা চারপাশের সব প্রাণী, অপ্রাণীকেই মমতার চোখে দেখতে শিখবে, ভালবাসতে শিখবে। আমাদের বেঁচে থাকার জন্য কাউকে মেরে ফেলার, ধ্বংস করার দরকার নেই এই বোধ গড়ে উঠবে। বইটার গুরুত্ব এখানেই।
বইয়ের প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণ যথাযথ, করেছেন সুকান্ত মণ্ডল। গোটা বইতে একটিও কুকুরের কথা নেই দেখে একটু বিস্মিত হয়েছি যদিও। তবে আমার ক্ষমতা থাকলে সদ্য পড়তে শেখা প্রতিটি বাংলাভাষী শিশুকে এই পনেরোখানা গল্প আর পাঁচখানা কবিতা নিয়ে গড়ে ওঠা বইটা উপহার দিতাম।