১)
‘আমি কক্ষনো অন্য কারুর জন্য কাঁদি নি জানো। যতবারই কেঁদেছি তা কেবল নিজের জন্য, নিজের না পাওয়া, ক্ষোভ, দুঃখ থেকে চোখে জল এসেছে। বাবা মা মারা যাওয়ার পরেও না, দাদা বৌদি সম্পর্ক কেটে চলে যাওয়ার পরেও না।‘ প্রায় একদমে বলে ফেলে একটু থমকে যায় ও, আঁচল ঘুরিয়ে এনে মুখটা মোছে। মাঝারি হাইটের গাঁট্টাগোট্টা মেয়েটির নাম দেওয়া যাক ‘আমি’। এখানে গরম একেবারেই নেই, বরং বাতাসে একটা হালকা শিরশিরে ভাব। ঘাম হওয়ার প্রশ্নই নেই। সকলের মুখের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে আবার আস্তে আস্তে বলে ‘কেউ মারা গেলে আমার ঠিক কান্না পায় না, কেমন যেন বুকের খাঁচাটা ছোট হয়ে যায়।‘ ‘আমি’র মনে হয় এবারে থামা দরকার, একদম অচেনা লোকদের কাছে অনেক কিছু বলে ফেলেছে। থেমে যায় ও। কয়েক সেকেন্ড কেউ কোন কথা বলে না।
‘তুমি যেমন অন্যের জন্যে কাঁদো নি কখনো আমার ঠিক তার উলটো। আমি নিজের লোকদের জন্য মাসের পর মাস কেঁদেছি, পাড়ার লোক যাদের রোজ দেখি তাদের কারুর কিছু হলেও কেঁদেছি। এমনকি কাগজে, টিভিতে কোথাও আগুন লেগে, জলে ডুবে, বিল্ডিং ভেঙে, ঝড়ে বন্যায় মানুষ মারা যাবার খবরেও হাউ হাউ করে কেঁদেছি। সেই থেকেই আমার নাম হয়ে গেছে খোলাকল। অন্যের জন্য এত কেঁদেছি যে নিজের জন্য আমার একটুও কান্না পড়ে নেই আর।‘ বলেই ডানহাতটা মুখেচোখে বুলিয়ে নেয় একবার, যেন দেখে নিচ্ছে সত্যিই জল নেই চোখে। হাত টান করে ছড়িয়ে আড়মোড়া ভাঙে, মাথার খামচি ক্লিপ খুলে চুলে আঙুল চালিয়ে আবার ক্লিপ আটকে দেয়। হাঁটুর ভাঁজ খুলে পা ছড়িয়ে বসে। লম্বা চওড়া খেলোয়াড়ি ধরণের চেহারার মেয়েটির নাম দেওয়া যাক ‘তুমি’।
সে মুখে একটা মিচকে হাসি ঝুলিয়ে চুপচাপ দেখছিল এদের। আমি বা তুমি কেউ কোন কথা বলছে না দেখে আস্তে করে গলা খাঁকারি দিল। তারপর মিচকে হাসিটা চোখের মণিতে ধরে রেখে বলল ‘না বাবা আমার অমন কোন নিয়ম কানুন নেই। আমি কান্না পেলেই কাঁদি, সে নিজের লোক হোক আর পরের। তবে কান্না টান্না আমার বিশেষ পায়ই না। হাসি ... হাসিই আমায় খেলো জানো। সেই সেবারে বোনটা শ্বশুরবাড়িতে মরে গেল আর বোনজামাই গড়াগড়ি দিয়ে কানছিল, সবাই বলল জামাই খুব ভালবাসত বোনটাকে। আমার হাসি পেয়ে গেল জোরে। সে এমন হাসি কিছুতেই আর থামাতে পারি না গো। হাগার বেগ এলে যেমন লোকে দৌড়োয় ওইরকম জোরে আমার হাসির বেগ আসে। ‘চিকমিকে মিচকে হাসিটা কি একটু ফ্যাকাশে দেখায়? রোগা হিলহিলে চেহারার এই মেয়েটার নাম দিই বরং ‘সে’।
২)
সারি সারি দাঁড়িয়ে থাকা ছোটবড় গাড়িগুলো আর রাস্তাজুড়ে দাঁড়িয়ে বসে থাকা মানুষগুলোর মধ্যে একটু চাঞ্চল্য দেখা দেয়, উল্টোদিক থেকে আপেলের ট্রাক আসছে। গুড়গুড়িয়ে পা টিপে টিপে আসছে বটে, কিন্তু বেশ বড়সড় আটচাকার ট্রাক। একটা নয় পরপর ছ’টা গেল। লাইনের সামনের দিকের তিন চারখান টেম্পো ট্রাভেলারের চালকেরা নিজেদের আসনে উঠে বসে যাত্রীদের দ্রুত গাড়িতে উঠতে বলে। ওদিকটা ছেড়েছে যখন, এদিকটাও ছাড়বে হয়ত শীগগির। ম্যাগির দোকানটায় ব্যস্ততা বেড়ে যায় কয়েকগুণ। যারা চা অথবা ম্যাগী অর্ডার করেছিল খোঁজ নিতে থাকে কতক্ষণ লাগবে আরো। যাদের কেনাকাটা শেষ তারা হুমড়ি খেয়ে পড়ে কিউয়ার কোডের ওপরে, খুচরো ফেরত নেওয়ায়। পঞ্চম গাড়ির চালক, প্রায় বাচ্চা একটা ছেলে তখনো দরজায় এক পা রেখে সামনে কি যেন দেখছিল, বলে নাহ এদিকের লাইন এখন ছাড়বে না।
সামনের পুলিশ চেকপোস্টে দুজন পুলিশ রাস্তা থেকে সরে এসে পাশে রাখা চেয়ারে আবার বসে পড়েছে। বাকী চালকেরাও আবার নেমে পড়ে গাড়ি থেকে। একটু পেছনে বাঁকের মুখে বাঁদিকের পাহাড় থেকে নেমে এসেছে বেশ ভরন্ত চেহারার একটা ঝরণা, সেখানে তখনো নানা ভঙ্গীতে ছবি নেওয়া চলছিল। গাড়ির লাইন এখন ছাড়বে না বুঝে কয়েকজন ভিডিও করা শুরু করল। তুমি একটু বিরক্তমুখে গজগজ করে ‘এমন সুন্দর ঝর্ণাটার একটা ফোটো নেবার জো নেই এদের জ্বালায়! দুদ্দুর!।' পাশ দিয়ে যেতে যেতে একজন ধুমসো জ্যাকেট পরা লোক বলে যায় ‘আরে দিদি মানুষও তো প্রকৃতির অংশ, তাকে বাদ দিলে চলবে কেন।' সে খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে আর তুমির ভুরুজোড়া একেবারে কেন্নোর মত দলা পাকিয়ে যায়। সেদিকে তাকিয়ে ধুমসো জ্যাকেট চটপট পা চালিয়ে এগিয়ে যায়।
আমি আঁচলটা টেনে কোমরে গুঁজে পুলিশচৌকির দিকে হাঁটা দেয়, হাসতে হাসতে সে’ও তার পেছনে যায়। ওদের সাথে যাবে কি যাবে না ভাবতে ভাবতেই তুমি শোনে ভিকি, ওদের গাড়ির চালক বলছে ‘পোলিসচৌকিমে আচ্ছেওয়ালে সাফা টয়লেট হ্যায়।' ও এইজন্যই আমি গেল, অনেকক্ষণ থেকেই গুনগুন করছিল বটে। যতদূর চোখ যায় রাস্তার একপাশ জুড়ে সারি দিয়ে দাঁড়ানো ট্রাক ভ্যান আর গাড়ির কাতার। এগিয়ে পিছিয়ে গুণতে শুরু করে তুমি। ‘করিব ঢাই তিনশো হোগা ম্যাডামজি’ – ভিকি জানায়। ওদের গাড়িতে আরো দুজন ছিল, পঞ্চাশ পঞ্চান্ন বছরের দুজন লোক। তারা গেল কোথায়? ভিকি হাত উলটে দেয় ‘ক্যায়া পাতা, হোঙ্গে ইধার উধার কঁহি।' সকাল সাড়ে এগারোটা থেকে দাঁড়ানো, এখন বাজে বিকেল সাড়ে তিনটে। সামনে ধ্বস নেমেছে ফলে রাস্তা বন্ধ। মিলিটারি এসে গেছে সারাতে, সারানো হলে ছাড়বে গাড়ি। ওদিক থেকে দুই ক্ষেপে কয়েকটা আপেলের ট্রাক এসেছে কেবল।
৩)
এবড়ো খেবড়ো পাথরের ধাপ বেয়ে বেয়ে অনেকটা উঁচুতে ঝর্ণাটা যেখানে পাথরের ছোট্ট খোঁদল থেকে চলা শুরু করেছে তার পাশে থেবড়ে বসে ও নীচের দিকে দেখছিল। এদিকটা দিয়ে সবসময়ই দুপেয়েরা যাতায়াত করে, শীতবুড়ো যখন ধবধবে সাদা অন্ধকারের পর্দা ঝুলিয়ে দেয় চারপাশে তখনো এরা এদের বয়ে নিয়ে যাবার জন্তুগুলোর সামনে দুটো চারটে নকল সূর্য লাগিয়ে নুন ছেটাতে ছেটাতে চলে। ওদের বয়ে নেবার জন্তুগুলোও নকল। দুপেয়েরা চালালে তবেই চলে, থামালে থামে। শীতবুড়োর এদিকে আসতে এখনো দেড় কুড়ি রাত্তির বাকী, এইসময়টায় দুপেয়েদের চলাফেরা অনেক বেড়ে যায়। কিন্তু আজ কদিন ধরে এরা সব এখানে এসে দাঁড়িয়ে পড়ছে। কী ব্যপার কে জানে! ওদের দলটা আরেকটু উপরে গেছে, উপরের ঘাস শুকিয়ে আসছে খুব তাড়াতাড়ি। তার আগে যতটা জমা করে নেওয়া যায়।
কয়েকটা ছোট বড় মেঘ নিজেদের মধ্যে জটলা করছিল পাশের জাঙ্গালের কিনারা বরাবর। ও ঘাড় তুলে তাকাতেই পাতলা চেহারার সাদা মেঘ বলে ‘শুনেছ মা’য়ের চিঠি এসেছে।' ওর মাথায় তখনো দুপেয়েদের জমা হওয়ার ব্যপারটা ঘুরছিল, একটু থতমত খেয়ে জিগ্যেস করে ‘কার মা?’ মোটাসোটা কালো মেঘ চোখে বিদ্যুৎ ঝিলকিয়ে রাগী মুখে বলে ‘কার মা আবার কেমনধারা প্রশ্ন? আমাদের সবার মা। আজ সূর্যদাদু বাড়ি পৌঁছে যখন বিশ্রাম নিতে বসবে মা তখনই সব আবার উল্টেপাল্টে সাজাবে। এই ঘর দুয়ার পাথর মাটি সব নেড়েচেড়ে ঠিক করে সাজাবে বলে লিখে পাঠিয়েছে। বিপাশা আর শতদ্রুর অবস্থা খুব খারাপ। দুপেয়েরা এমন আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধেছে যে ওরা ঘোর বর্ষাতেও পাশ ফিরবার জায়গা পায় না। আর বিপাশার জানই তো একটু নেচে নেচে চলা অভ্যাস বরাব্বর।'
তা সত্যি কথা। শতদ্রু এমনিতে শান্ত হলেও তারও তো একটু এপাশ ওপাশ করতে লাগে। কিন্তু এই যে দুইকুড়ি রাত্তির আগে বিপাশা আর মা সব এলোমেলো করে ওদের জন্য রাস্তা বানিয়ে দিল? ‘হ্যাঁ, কিন্তু তাতেও দুপেয়েদের শিক্ষা হল কই! সেই আবার পাথরগুঁড়ো গুলে গুলে বেঁধে রাখছে এদিক ওদিক সব পথ। দুপেয়েগুলো বড্ড বিচ্ছিরি প্রাণী' নীচের পাথর ফিসফিসিয়ে বলে। পাশের পাথরটা অমনি বলে ‘না না সব দুপেয়ে খারাপ নয়। ওই যে একলা আসে একজন, সে তো কেমন চুউপ করে বসে থাকে, কাউকে উৎপাৎ করে না। তারপরে সেই যে কারা সব ঘুরে ঘুরে পাহাড়ের খাঁজে খোঁজে ছোট্ট গাঁওগুলোতে দুপেয়েদের বলছিল সবাই মিলে রুখে দাঁড়াতে,পাহাড়ে এত বাঁধাবাধি করায় বাধা দিতে।' হাল্কা একটা সাদাকালো মেঘ ফিক করে হেসে বলে ‘সবাই তো ভয়েই মোলো ওরা, রুখে আর দাঁড়ালো কই?’
৪)
‘চল চল সবাই এ পাহাড়খানা টপকে আমাদের ওপাশের ঢালে নেমে বুগিয়াল পেরিয়ে পরের পাহাড়ের জাঙ্গালে উঠে যেতে হবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। শীগগির শীগগির পা চালাআ আ ও ও।' সর্দারবুড়োর গলার আওয়াজে চমকে ওঠে ও। ওদের পুরো দলটাই নেমে এসেছে কখন যেন। বক্রশৃঙ্গকে দেখে এগিয়ে যায় ও, কিছু জিজ্ঞাসা করার আগে বক্রশৃঙ্গ নিজেই বলে ‘চল অনেকটা রাস্তা যেতে হবে, দেরী করলে চলবে না।' ও বলে ‘এত তাড়াহুড়ো কেন? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।' ‘আরে শোনো নি, মা জানিয়েছে যে আজ তান্ডব হবে। যেতে যেতে বলছি সব।' ‘আরে সেটাই তো বলছি, মা তোমাদের কখন কোথায় জানালো?’ ওর কথায় প্রায় গোটা দলটা হেসে ওঠে। ‘কি বোকা দেখো। এই যে পাথরগুলো টপকাচ্ছ, একটু থেমে দেখো ওরা খুব আস্তে আস্তে কাঁপছে নড়ছে, গাছের পাতাগুলো দেখো, মেঘেদের দেখো। সবাই বলছে।'
উপরে উঠতে গেলে আগে নীচে নামতে হবে এখানের এই নিয়ম। হালকা পাতলা সাদা মেঘেরা ভেসে ভেসে চলে যাচ্ছে ওই দক্ষিণের দিকে। ওদের জায়গা নিচ্ছে মুশকো মুশকো কালো গাব্দাগোব্দা মেঘেরা। সূর্যদাদুকে ঢেকে ফেলল কয়েকজনে। ও দেখল নীচের দুপেয়েরা কয়েকজন ঘাড় উঁচিয়ে চোখের উপরে হাত রেখে সূর্যদাদুকে দেখার চেষ্টা করছে। কয়েকজন আবার গায়ে মাথায় একগাদা রঙচঙে কিসব চাপিয়ে নিচ্ছে। অনেক নীচের উপত্যকা থেকে পাক খেয়ে উঠে আসছে হু হু বাতাস, মেঘেদের সাথে লুটোপুটি করে ঠান্ডা মেখে নিয়ে ছড়িয়ে যাচ্ছে আনাচে আনাচে। নীচে এক মাদী দুপেয়ে মাথায় দুই তিন পরত করে জড়িয়েছে যে জিনিষটা, সেটাকে দেখে খুব চেনা চেনা লাগে। কিন্তু জিনিষটা কী বুঝে উঠতে পারে না ও। মেজ সর্দার ফিসফিস করে বলে ‘ইয়াঙ্গির, আমাদেরই কারুর শরীর থেকে নিয়েছে।'
পুরো দল তড়বড়িয়ে নামতে থাকে। পায়ের চাপে দুলে ওঠে পাথর, ঠোক্করে উড়ে যায় আলগা নুড়ি। একটা নুড়ি গড়িয়ে দেয় আরেকটাকে, সে আবার আরো দুটোকে। টকাটক টকাটক খটখট খটাখট আওয়াজে দুপেয়েরা তাকায় এদিক ওদিক। নীচে ততক্ষণে আমি আর সে ফিরে এসেছে গাড়ির কাছে। আকাশে যত মেঘ জমেছে ভিকির মুখেও প্রায় তত। প্রাণপণে চেষ্টা করছে ট্যুর ম্যানেজারকে ফোনে ধরতে। ওদের আরো দুটো গাড়ি অনেকটা পেছনে আছে, এদিকে নেটওয়ার্ক নেই। হঠাৎই কেমন ঠান্ডা লাগছে, জোরালো হাওয়া শুরু হয়েছে, তুমি শালটা ভাল করে মাথায় গায়ে পেঁচিয়ে নেয়। ‘আরেহ ওটা কী?’ একটা অল্পবয়সী ছেলে চেঁচিয়ে ওঠে। ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে উপরে তাকিয়ে আমি দেখে একজোড়া বাঁকানো শিঙ আর একটা বাদামী ঝলক খাড়া ৫ ফুট লাফিয়ে উঠে জাঙালের ওপারে অদৃশ্য হয়ে গেল।
৫)
‘আইয়ো ট্যাঙরোল! ম্যাডামজি দেখা আপনে?’ ‘ট্যাঙরোল আবার কী? এগরোল হলেও বুঝতাম।’ নিজের রসিকতায় নিজেই হেসে গড়ায় সে। ‘আইবেক্স! আইবেক্স! একটা দল ছিল।' ‘লাফটা কিরকম দিল দেখলে?’ ‘ধুর আইবেক্স বসে আছে এখানে, ছাগল হবেখনে।' আরে বাবা আইবেক্স তো একরকম ছাগলই, পাহাড়ি ছাগল।’ ‘হ্যাঁ হ্যাঁ বেশ তাগড়া মাটন।' ইত্যাকার নানা কথায় এলাকা যখন গমগম করছে, ঠিক তক্ষুণি বৃষ্টিটা নামল। সূর্য ডুবে গেছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না, চারিদিকে অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে। ভিকির কাছে কল এসেছে ওদের অন্য একটা গাড়ি থেকে, ম্যানেজার সবাইকে এই মুহূর্তে ফিরতি রাস্তা ধরতে বলেছেন। ওদের গাড়ির অন্য দুজন যাত্রী ওদেরই অন্য একটা গাড়িতে উঠে গেছেন, সে গাড়ি অনেকটা এগিয়েও গেছে। তিনজনকে ঝপাঝপ গাড়িতে তুলে ভিকি চাপ দেয় অ্যাক্সিলারেটরে।
বৃষ্টি বেশ চড়বড়িয়ে পড়ছে, লোকে রাস্তা ছেড়ে দৌড়ে গিয়ে গাড়িতে উঠছে, এরই মধ্যে আরো কটা গাড়ি মুখ ঘুরিয়ে ফিরতি পথ ধরার চেষ্টায় এঁকেবেঁকে এগোচ্ছে। ‘তাহলে এগিয়ে থেকে আসলে আমরা সবার পেছনেই পড়ে গেলাম।' আমির কথায় সে খিলখিলিয়ে হেসে বলে ‘দেখো এগোন মানে আসলে পেছোনই।’ তুমি গম্ভীরভাবে বলে ‘তুমি এগিয়ে গেলে পেছনের লোক খেলা ঘুরিয়ে তোমাকে পিছিয়ে দেবে।' বৃষ্টির বেগ যত বাড়ে ভিকি তত গতি বাড়ায়, সামনেমুখো গাড়িগুলো তত বেশি করে মুখ ঘুরিয়ে পেছনমুখো দৌড়ায়। সামনে পেছনে চড়চড় দুমদাম করে তীব্র আওয়াজে পাহাড় থেকে নেমে আসছে ছোট বড় পাথর, ছোট কম মাঝারি বড়ই বেশি। সাথে সাথেই কোথা থেকে কে জানে নেমে আসছে শত ধারায় কাদামাটিগোলা জল। আকাশ চিরে বিদ্যুৎ ঝলসে উঠে দেখিয়ে যাচ্ছে উপরে বাঁদিক থেকে নেমে আসা পাথর মাটির ঝাঁপ ডানদিকের খাদে।
তীব্র কানফাটানো আওয়াজের সাথে গাড়ির সামনেটা ঢেকে যায় মাটি পাথরে আর ভিকির পা প্রাণপণে চেপে বসে ব্রেকের উপর। ঠিক পেছনের গাড়িটা পুরো ব্রেক ধরাতে না পারায় এসে ঢুঁসো মারে। দুলে ওঠে গাড়ি, ভিকি জানলার কাচ নামিয়ে চীৎকার করে কিছু বলে। পেছনের থেকে উত্তর আসতে না আসতে আরো পেছন থেকে তেমনি তীব্র কানফাটানো আওয়াজ আর দুই তিনজন মানুষের মর্মান্তিক আর্তনাদ। আমি খামচে ধরে তুমির হাত, তুমি দুই হাত দিয়ে দুপাশে আমি আর সে’কে জড়িয়ে ধরে। ঠকঠক করে কাঁপছে তিনজনেই। ঝলসে ওঠা বিদ্যুৎএর আলোয় দেখা যায় মাঝারি বড় পাথর আর মাটির স্তুপ নেমে এসে সামনের পথ সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিয়েছে, রাস্তার চিহ্নও নেই কোথাও। জানা যায় পেছনে এরকমই পাথরের স্তুপ এসে পড়েছে একটা ছোট গাড়ির উপরে। প্রায় চ্যাপ্টা হয়ে যাওয়া সেই গাড়ির একজনও বেঁচে আছে কিনা সন্দেহ।
৬)
রাত আটটা বাজে, বৃষ্টির এখনো বিরাম নেই। তবে পাথর পড়াটা একটু কমেছে। গত আধাঘন্টায় আর সেরকম আওয়াজ পাওয়া যায় নি। ভিকির আদেশে গাড়ির সবকটা জানলার কাচ একচুল করে নামিয়ে রাখা হয়েছে হাওয়া চলাচলের জন্য। আমি গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ানর কথা বলায় প্রায় ধমকে ওঠে ভিকি। যে কোন সময় পাথর পড়তে পারে, এখন নামা চলবে না। বরং ওরা যে যার ভগবানকে ডাকুক। তুমি সঙ্গে সঙ্গেই বিড়বিড় করে কিছু প্রার্থনা করতে শুরু করে। একটু চুপ করে থেকে আমি স্বগতোক্তি করে ‘সে পাথর এসে গাড়ির ওপরেও পড়তে পারে, যেমন ওই গাড়িটায় পড়েছে।' চালক উদাসীন গলায় জানায় সে সম্ভাবনা তো আছেই, সেইজন্যই ভগবানকে ডাকতে বলা। এমনিও আজ রাত্রে তো বটেই কালকেও কতক্ষণ এখানে থাকতে হবে কেউ জানে না। মিলিটারি এসে রাস্তা বানাবে তবে বেরোন।
তুমি একমনে কিছু জপ করে যাচ্ছে, আমি সে’র দিকে তাকায়। ‘আমার কোন ভগবান নেই। কোন ভগবান কোনদিন কিচ্ছু করে নি আমার জন্য, আমিও তাই আর ...’ সে নিঃশব্দে হাসে, অন্ধকারে দেখা যায় না অবশ্য। ফিসফিস করে ‘ভগবানকে অনেক ডেকেছিলাম বোনটাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য, বাঁচিয়ে দেবার জন্য। বিয়ের পরে য্যাতবার এসেছে একবারও শ্বশুরবাড়ি ফেরত যেতে চায় নি। মায়ের সাথে সাথে আমিও জোর করে ফেরত পাঠাতাম। আমার যা রোজগার তাতে একটা বাড়তি পেট টেনেই দিতাম। আর ও-ও কিছু না কিছু করতই। একটু যদি পিঠ শক্ত করে দাঁড়াতাম বোনটার পাশে। খুঁ খুঁ করে হাসতে থাকে সে। তুমি জপ থামিয়ে গরগর করে ওঠে ‘পিঠ শক্ত হলে আর আমায় আজ ঘরবাড়ি ছেড়ে মেয়েদের হোস্টেলে পাঁচরকম কাঁইকিচিরের মধ্যে থাকতে হয়! বাপ আর স্বামী কেমন মিলেজুলে আমায় একটেরে করে বের করে দিল। ফালতুই এদিক সেদিক দৌড়ালাম, ওদের কিচ্ছু করতে পারলাম না।'
আমি একঢোঁক জল খায়। আস্তে আস্তে বলে আমি খুব মুখরা, কেউ আমায় দেখতে পারে না। মা বলত বিয়ের পর শ্বশুরবাড়িতে সামনের দরজা দিয়ে ঢুকিয়ে পিছের দরজা দিয়ে বের করে দেবে। এই বলে বিয়ের কোন চেষ্টাই করল না। আমিও মা মরে যাবার একমাসের মধ্যে মায়ের ঠাকুরের আসন তুলে বিছানা কাপড় ফেলে দিয়ে, কাঁসা তামা পেতলের বাসনগুলো আর গোপালের সোনার চোখ, সোনার মুকুট বিক্রি করে দিয়েছি।' ‘গোপালের মটুক চোখ বিক্কিরি করে দিলে?’ কাৎরে ওঠে সে। ‘হ্যাঁ দিলাম তো। লক্ষ্মী আর গোপালকে স্কচ ব্রাইট দিয়ে মেজে তাকে তুলে রেখেছি। সেই নিয়ে দিদি কত্তগুলো কথা শোনালো। কিছু উত্তর দিতে পারলাম না জানো। মুখের জন্য এত বদনাম হয়েছে অথচ ঠিক কথাগুলো ঠিক সময়ে বলতে পারি নি। পিঠের মধ্যেটা কেমন তলতলে নরম ঠ্যাকে তাই আর ...’
৭)
রাত সাড়ে বারোটা বাজে। বৃষ্টি থেমে আকাশ ভরা চিকমিকে তারা। মোবাইলের নেটওয়ার্ক একেবারেই নেই, চার্জ শেষ হবার ভয়ে তুমি তিনজনের মোবাইল ফ্লাইট মোডে রেখেছে। সঙ্গে থাকা বিস্কুট চিপস খায় সকলে, সে ব্যাগ থেকে মুড়ি আর টমাটো বের করে সবাইকে দেয়। ভিকি সামনের সিটেই লম্বা হয়ে শুয়ে পড়েছে, অল্প অল্প নাকও ডাকছে। তুমি গুনগুন করে ‘সামনের ওই দুই ট্রাকসমান উঁচু পাথরের ঢিপি হেঁটে পেরিয়ে ওদিকে গেলে রাস্তা পাওয়া যাবে, গাড়িও থাকতে পারে দু’একটা। আমি আর সে একসাথেই হেসে ওঠে ‘ওদিকটায় হয়ত খাদ হয়ে গেছে পুরোটা।’ ‘তাহলে আর কি, এই বাঁদিকের পাহাড়ে উঠবো ওওই উঁচুতে। দেখবো কোনদিক দিয়ে যাওয়া যায়।' ‘ওরে বাবা আমার হাঁটু খুলেই যাবে।‘ কাতরে ওঠে আমি। তুমি বলে ‘আমার তো পিঠের খানিকটা নেইই। বললাম না তোমাদের তখন পিঠটা শক্ত নয় একদম।'
ওদের দলটা দুই পাহাড় টপকে তিন নম্বর পাহাড়ের একদম উপরের জাঙালে নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। মা যতক্ষণ সব উল্টেপাল্টে সাজাচ্ছিল ততক্ষণে ওরা দুই পাহাড় পেরিয়ে মাঝের ঘাসেভরা বুগিয়ালে একটু থেমে এই পাহাড়ের একদম চুড়োর কাছে উঠে এসেছে। এখন কয়েকদিন নিশ্চিন্ত, দুপেয়েরা আর ওদের ফটফট আওয়াজ করা নকল ঘোড়া, ভ্রররর করা চারপেয়ে নকল জন্তুদের নিয়ে এসব জায়গায় ঘুরে বেড়াতে আসবে না। শীতবুড়ো আসার আগে অবধি এই বুগিয়ালেই খাবার যোগাড় হয়ে যাবে। দুপেয়েরা না এলে ওদের লোমগুলো থেকে যাবে। গত শীতের আগে একটা মস্ত দল এলো, হাতে হাতে লম্বা লম্বা নলের মত কী যেন। তাই দিয়ে ওদের দলটাকে সেইই পাহাড়ের মাথায় খুঁজে পেয়ে গেল। অমনি দুটো লোককে পাঠিয়ে সব্বার লোম ঘ্যাস ঘ্যাস করে নিয়ে নিল। শীতকালটা ওরা কেমনি করে কাটায় বল দিকি!
নিশ্চিন্ত জীবনের স্বপ্নে ঘুম গাঢ় হয় ওদের। নীচে তখন আমিদেরও চোখ লেগে আসছে। ঠিক পেছনের গাড়িটায় এক দম্পতি, তাদের সাড়াশব্দ সেই সবদিক দিয়ে আটকে যাবার সময়েই যেটুকু পাওয়া গেছিল। আমি আস্তে করে দরজা খুলে মাটিতে পা রাখে। দরজা ধরে মুখ তুলে একেবারে চুপ হয়ে যায়। আকাশে একটা মস্তবড় হীরের নেকলেস উপুড় হয়ে ঠিক ওদের মাথার উপরটায় বিছিয়ে রয়েছে। তুমি আর সে’কে ডেকে বার করে তিনজনে আচ্ছন্ন হয়ে তাকিয়ে থাকে। এত তারা আকাশে! 'আমার পিঠটা শক্ত হয়ে উঠছে জান।' ফিসফিস করে বলে সে। ‘যারা আমাকে বাড়িছাড়া করেছে, ফিরে গিয়ে তাদের আমি উকিলের চিঠি একটা দেবই।’ তুমি বিড়বিড় করে। আমি কিছুই বলে না। মনে মনে টের পায় ওর পিঠেও কেউ স্টীলের রড ভরে দিয়েছে। ঠিক করে এখন থেকে কথা বলবে একবার কি দুবার, কিন্তু তা হবে একদম মোক্ষম। তেরোশ আলোকবর্ষ দূর থেকে ওদের দিকে তাকিয়ে মিচকি হাসে কালপুরুষ নীহারিকা।