ইদের আসল মজা কখন? বয়স্ক মানুষ, বাড়ির মা খালাদের খবর জানি না, বাকি সবার সম্ভবত একটাই রা হবে, তা হচ্ছে ইদের আগের রাত মানে চান রাত! কোন কথা হবে না, সবাই মেনে নিবে যে আসল মজা আগের রাতেই।
কী হয় এই রাতে? কিচ্ছু না, স্রেফ গুলতানি মারা চলে, লম্বা আড্ডা চলে। এই দিন সবাই দেরি করেই বাড়ি ফিরবে এইটা অলিখিত আইন। আড্ডার মধ্যেই আগামী দিনের নীতি নির্ধারণ হয়ে যাচ্ছে, নতুন কিছুর ইঙ্গিত তৈরি হচ্ছে, প্রেমের চাবি নাড়াচাড়া হচ্ছে, প্রাণ খোলা হাসি হচ্ছে! এই রাতে মন খারাপের কোন জায়গা নেই।
মা খালাদের কথা জানি না কেন বললাম? কারণ এই রাতে তাঁদেরকে প্রচুর খাটাখাটনি করতে হয় ইদের প্রস্তুতি হিসেবে। তাই তাঁদের চান রাত খুব মজায় কাটবে এইটা সম্ভবত বেশি বেশি কল্পনা। তাই জানি না বললাম। কিশোর কিশোরী, তরুণ তরুণী, সবারই একই রকম অনুভূতি হবে। মেয়েরা হাত ভরতি করে মেহেদি দিচ্ছে, এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়ি দৌড়াদৌড়ি চলছে। কারণ মেহেদি শিল্প হাতে গোনা দুই একজনই পারে, আর চান রাতে তাকে ঘিরেই বসে থাকে বাকিরা। উপগ্রহের মতো ঘুরপাক খেতে থাকে এরা যতক্ষণ না পর্যন্ত হাত মেহেদি দিয়ে পূর্ণ হচ্ছে।
আবার আমাদের আড্ডায় ফিরি। ইদ যেহেতু আলাদা করে উদযাপনের কিছু না। সকালে ইদের নামাজ পড়লেই ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয়ে যায়। তাই খাওয়া, আড্ডা, বেড়ানো আর ঘুম ছাড়া ইদের ছুটিতে আর কিছুই করা হয় না। বিশেষ করে রোজার ইদে। চান রাতে ছুটির কয়দিন কী করে কাটানো যায়, কী করা যায় এর পরিকল্পনায় সবচেয়ে বেশি সময় যায়। যেমন এবার সারাদিন শুরু করে মধ্য রাত পর্যন্ত আমাদের কাটছে ইদের পরদিন কী করা যায় এই সলাপরামর্শ করেই। স্থান নির্বাচন হয় তো মানুষ হয় না, মানুষ, স্থান হয় তো যানবাহন মিল হয় না। ঠ্যালা ধাক্কা, ধুর শালা সব বাদ! এই চলছে, চলতে চলতে দেখি ঘড়িতে রাত বারোটা! শেষ পর্যন্ত কী করলাম, কী হইল, ছাতু মাখাইলাম গু হইল...
যাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আছে তাঁদের আমাদের মতো এমন সৌখিন চিন্তা ভাবনা করার ফুসরত নাই। শেষ মুহূর্তে কেনাকাটার হিড়িক লাগে কেন জানি। কিছু মানুষই আছে যারা কোন অজ্ঞাত কারণে সারা মাস কেনাকাটার আশপাশ দিয়েও যেতে রাজি না। প্রথম থেকেই নিয়ত পাকা যে তিনি যাবেন চান রাতেই! কেউ কেউ তো এমনও বলে যে চান রাত ছাড়া শপিং করে মজাই পাওয়া যায় না। কেউ চান রাত ছাড়া আবার ইদ শপিং হয় না কি? এমন প্রশ্নও করে। তো এই খদ্দেরদের জন্য চান রাতে চলে ভোর পর্যন্ত জমজমাট কেনাকাটা। রাত একটা দুইটা তিনটা যেন সন্ধ্যা রাত! ঢাকায় কোন দিন ইদ করা হয়নি। কিন্তু বন্ধুদের অনেকের কাছেই শুনেছি যে ঢাকায় চান রাতের জৌলুসের সাথে কোন কিছুর তুলনাই হয় না। দেড় দুই কোটি মানুষ চান রাতের আগে ঢাকা ছেড়ে চলে গেছে। ঢাকা হাঁফ ছেড়ে গা ঝাড়া দিয়ে দাঁড়িয়েছে। যারা বের হচ্ছে তারা চলে ফিরে, দেখে শুনে, কিনে না কিনে আলাদা সুখ পাচ্ছে। ঢাকার জ্যাম ঘাম গরম যে দেখছে সে চান রাতে না থাকলেও অনুমান করতে পারে যে কতটা হালকা লাগছে সবার এই দিন!
তবে সবার সমান না। শেষ মুহূর্তেও যারা কিছুই কেনাকাটা করতে পারে নাই আপনজনের জন্য তাঁদের চান রাত এক বিভীষিকার নাম! আমার জীবনে আমি এমন বেশ অনেক ইদ করছি যে ইদে একটা সুতাও কেনা হয়নি আমার জন্য। এমন বহু ঈদ কেটেছে যে কোন একটা দেওয়া হবে আমাকে এইটা আগেই বলা হয়েছে! হয় শুধু জুতা, না হয় শুধুই প্যান্ট বা শার্ট! আপদমস্তক নতুন, ইদের জন্য কেনা এইটা সম্ভবত বহু বহু পরে কপালে জুটেছে। তখন যখন নতুন কিছু না হলেও সমস্যা না, যখন জানি নতুন জামা কাপড়ে ইদ নাই, পুরোটাই সম্পূর্ণ ভিন্ন কিছু। যাই হোক, অপ্রাপ্তির ওই চান রাত গুলি কীভাবে কাটিয়েছি এখন চিন্তা করলে বুঝি যে কতটা কঠিন অনেকের জন্য এই রাত। এই বোধটা আমাকে উদার হতে শিখিয়েছে। হাত খুলে সাহায্য করতে শিখিয়েছে। ইদটা যেন সবার জন্য আনন্দের হয় এইটা ভাবতে শিখিয়েছে। এখন আমাদের একটা ফাউন্ডেশন হয়েছে, ওইখান থেকে এমন সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের ইদের জন্য নানা সাহায্য করছে। এগুলা আলাদা তৃপ্তি দেয়।
আরও কিছু মানুষের জন্য চান রাত অভিশাপ! যারা আপনজন হারিয়েছে! সবার সমান অনুভূতি হবে না আমি জানি। কিন্তু আমি আমার খবর জানি। চান রাতের ফুর্তি শেষ হচ্ছে যতক্ষণ সবার সাথে আছি ততক্ষণ। যখন বাড়ির পথে আগানো শুরু করছি তখন থেকে প্রতিটা পদক্ষেপ আমাকে মনে করিয়ে দেয় আমি যেখানে ফিরছি সেখানে যারা আমার শৈশব, কৈশোর, তারুণ্যকে যারা আলোকিত করে রেখেছিল, যারা কিছু নাই নাই করেও রঙিন করে দিয়ে গেছিল আমার ইদ গুলি তাঁরা কেউ নাই! আমার মা, যে খুব সাদাসিধে কিছু পদ রান্না করত ইদের দিন, সেই সামান্য আয়োজনই সম্ভবত স্বর্গীয় কোন উপদান ব্যবহার করে তৈরি করত। হয়ত আঁচল থেকে গোপনে মিশিয়ে দিত কোন জাদুকরী উপদান! হাতের স্পর্শে হয়ত পরশ পাথরের মতো কিছু ছিল, যার স্পর্শে সামান্য সেমাই হয়ে উঠত অমৃত! কাঁচা চুলায় রান্নার সময় আগুন ধরানোর জন্য বাঁশের চোঙায় যখন মা ফু দিত তখন হয়ত সেই ফুঁয়ের সাথে মিশে আম্মার অদ্ভুত স্নেহ, আদর্শ, ভালোবাসা, আর যার ফলে তৈরি হয় ইদের নানান বেহেশতি খাবার, যা আমাদের এখন পর্যন্ত বিস্ময়, এখন পর্যন্ত মুগ্ধ হয়ে বসে থাকি আমি। আমি জানি ভোরে সব সময়ের মতো, যা ছিল আশৈশবের সেরা স্মৃতি। আব্বা আমাদের ঘুম থেকে উঠার অনেক আগেই গোসল করে তৈরি হয়ে গেছেন, আতরের গন্ধ নাকে আসছে যেন এখনও, যা আর কোনদিন আসবে না। আমি জানি নামাজ শেষে বাড়ি ফিরে আর কোনদিনই আম্মা আব্বাকে ইদের সালাম করা হবে না। আমি জানি এই বছর অনেকেই হতভম্ব হয়ে বসে আছে, হয়ত বুঝতেছেই না কেন এমন লাগছে, কোথা থেকে শূন্যতা এসে খোঁচা দিচ্ছে! আমি জানি দিনে দিনে এমন হতভম্ব হয়ে যাওয়াদের সংখ্যা বাড়বে। আর একদিন নিজেদের সময় এসে হাজির হবে!
চান রাতে মন খারাপের জায়গা নেই শুরুতে লিখছিলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত, শেষ লাইনে এসে আমি জানি মনটা খারাপ হবেই। মানুষ উৎসব আনন্দে একটা সময় স্বজন হারানোর বেদনা অনুভব করবেই, এই থেকে কি আর রেহাই আছে? সবাইকে শুভেচ্ছা ইদের। ইদ মুবারক। আমার আত্মীয়, বন্ধু সকলকে শুভেচ্ছা। কত দূর দূরান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে আমার কত শুভাকাঙ্ক্ষী। সকলকে শুভেচ্ছা। অপাত্রে বুঝে না বুঝে যে স্নেহের নানা উপকরণ আমার প্রতি ঢেলে গেছেন তার জন্য আমি কৃতজ্ঞ। ইদ মুবারক, ইদ মুবারক, ইদ মুবারক। সুখি সমৃদ্ধ হোক সকলের জীবন।