এখানে এই এক আপদ—দরজা সবসময় খোলা, যে যখন এসে ঢুকে পড়লেই হল, যেন ওদের বাবার লঙ্গরখানা। সাতসকালে ইংরেজের খোঁচড়টা দরজা দিয়ে ঢুকছে দেখেই সিরাজের মাথাটা গরম হয়ে যায়। দূর থেকে চিৎকার করে বলে, এই হারামির বাচ্চাটা এখানে কেন?
নামে দরবার হলে কী হবে, সিরাজের এই চিড়িয়াখানায় চ্যাংড়া ছোঁড়া প্রচুর। উৎপটাং হোমরাচোমরারা মুরুব্বি বনে গেলেও সবকটা আসলে আমোদগেঁড়ে। একটু ফুর্তির ফুলঝুরি আসতে চলেছে দেখে, তাদেরই কে একটা বলে, নবাব, এ তো ইংরেজের উকিল।
- জানি তো। চোখ লাল করে বলে সিরাজ। সাদা ঘোড়াচোদ একটা। ওরে কে আছিস রে, এটাকে দরজা দেখা।
সিরাজের কারবারই এরকম। খচে যখন গেছে, ঘাড়ধাক্কাই দিয়ে দেবে। অতদূর অবশ্য গড়ায় না ব্যাপারটা। লোকটা নবাবের মেজাজ আর দরজা দুইই বিলক্ষণ চেনে। নিজেই চটপট পাতলা হয়। সিরাজ পিছন থেকে চিৎকার করে বলে, এই ফিরিঙ্গি জাতটাকে আমি খতম করেই ছাড়ব।
ইয়ারদোস্তরা শুনে হইহই করে ওঠে। এই না হলে তেজ? নবাব হল বফাদারের ফরিশতা, বেত্তমিজের যম। কম লোককে শায়েস্তা করেছে নাকি? এর আগে একবার জগৎশেঠকে তো এক চড় মেরেছিল। আর মিরজাফরকে খিস্তি করে যা হাল করেছিল, যে, সে হারামজাদা লজ্জায় মুখ দেখাত না ক-দিন। এখন অবশ্য আবার ল্যাল্যা করে দরবারে আসছে।
গালমন্দ করে সিরাজের মন একটু খুশ হয়। একবার আড়মোড়া ভাঙে। তারপর, কোথাও কিছু নেই, বলে, মিইইইর জাফর।
- জি।
- আপনি কিন্তু কুচ করবার জন্য তৈয়ার হন।
মীরজাফর তো শুনে হাঁ। কুচ মানে? এ কি রাজকার্য না ফুক্কুড়ি, যে সক্কালবেলা একটু মেজাজ খারাপ হয়েছে বলে লালমুখোদের সঙ্গে একদম যুদ্ধে নেমে পড়তে হবে? রাজা-বাদশাদের খেয়ালকে একটু তোয়াজ করতে হয়—সবাই জানে, কিন্তু এই আস্ত গাছপাঁঠাটা যেমন আহাম্মক, তেমনই বদমেজাজি—রাজনীতি তো বোঝেই না, আদবকায়দাও না। নবাব না হনুমান বোঝা মুশকিল, ওদিকে ধড়িবাজি আছে দুশো আনা। কোন এক ভাগাড় থেকে তুলে এনে মোহনলালকে মহারাজা বানিয়ে মাথার উপর বসিয়েছে, সেটা আবার ওর চেয়েও এককাঠি বাড়া। সে মালটা বিষ খেয়ে অবশ্য এখন আধমরা, দরবারে নেই—এই এক রক্ষে।
- এত কী ভাবছেন? সিরাজ বলে। ঝুঁকির কথা, না টাকার কথা?
টাকা আবার এখানে কোথা থেকে এল? মীরজাফর কানে হাত দিয়ে বলে, টাকা কেন হুজুর?
- জনাব। আপনি টাকা ছাড়া আর কিছুর কথাও ভাবেন?
সাঙ্গপাঙ্গরা এবার হ্যাহ্যা করে হাসে। আজ সিরাজ তো ভয়ানক খেলছে। পুরো মুন্ডু নিয়ে গেন্ডুয়া। জ্জিও নবাবজাদা। মিরজাফর বলে, তা কেন হুজুর? এই দরবারি ইমান, এই নবাবি...
- বাজে কথা ছাড়ুন। দশ লক্ষ টাকা দেব। করবেন কুচ?
মিরজাফর ফাঁপরে পড়ে মাথা নাড়ে। যার মানে হ্যাঁ-ও হতে পারে, না-ও। দশ লক্ষ টাকা চাই-ও হতে পারে, অথবা কুচ করবে না-ও হতে পারে।
সিরাজ বলে, তাহলে তাইই ঠিক রইল। আপনি কুচ করবেন আগে। আমি পিছনে আসব।
ইয়ার্কি হচ্ছে, নাকি সত্যি-সত্যি, ইয়ারদোস্তরা বুঝতে পারে না। বুজুর্গরাও। আমিরচাঁদ বহুদিন দরবার করছে। কিন্তু এ জিনিস এর আগে কখনও দেখেনি। এত দুমদাম করে কেউ যুদ্ধ করে নাকি? কিন্তু এ ছোঁড়াকে বিশ্বাস নেই। যা খুশি করতে পারে। সে একটু ঘাড় ঝুঁকিয়ে নিখুঁত দরবারি কায়দায় জিজ্ঞাসা করে, কিন্তু হুজুর, এই হামলার কারণ?
সিরাজ মাছি ওড়ানোর ভঙ্গিতে বলে, ওরা হরদম ফরাসিদের ধরিয়ে দেবার জন্য লিখছে। ওদের রোকা আমি আর নেবো না। তারপর মিরজাফরের দিকে ফিরে বলে, তাহলে ফয়সালা তাই-ই রইল। আপনি তৈয়ার হোন। আজ দুপুরে একটু মৌজ করে নিন। কাল থেকে কুচ।
মিরজাফর আর আমিরচাঁদ ফরমান শুনে থ। আর ছোকরারা মৌজের কথাটা শুনে আমোদে আটখানা। সবাই জানে, মিরজাফর দুপুরে একটু ভাঙ খেয়ে দিবানিদ্রা দেয়। তখন পুরো কুম্ভকর্ণ। কাড়ানাকাড়া বাজালেও ঘুম ভাঙবে না।
আমিরচাঁদ কালো মুখ করে বেরিয়ে আসে দরবার থেকে। ইংরেজদের বড়কর্তা স্ক্র্যাফটন বাইরেই ছিল। আমিরচাঁদ তাকে দেখে বিড়বিড়িয়ে বলে, ছোঁড়া ক্ষেপে গেছে। মানিকচাঁদ ক্ষেপিয়েছে। মনে হয় আবার কোনো ফন্দি এঁটেছে।
ফন্দি-টন্দি কিন্তু তখনও কিছুই ছিল না। দুপুরে স্রেফ একটু আয়েশ করবে ভেবেছিল, কিন্তু তখনই আর এক আপদ। এবার দুয়ারে গুপ্তচর। গোয়েন্দা দপ্তরের এক হোমরাচোমরা, যার নাম নারায়ণ। কী একটা খবর এনে বলছে, জরুরি। গুরুতর ব্যাপার না হাতি, যত ফালতু হুজ্জুতি, গোয়েন্দাদের ফিকির। কিন্তু মসনদে বসলে এইসব ফালতু ঝুটঝামেলা এক-আধটা হবেই। সিরাজ লোকটাকে ভিতরে ডেকে জিজ্ঞাসা করে, বল রে ব্যাটা। এত জলদবাজিটা কীসের?
এই গোয়েন্দা দপ্তরের লোকগুলোকে দেখতে হয় মুদির দোকানদারদের মত। কী ভাবছে কিচ্ছু টের পাওয়া যায় না। দেখলেই গা চিড়বিড় করে। ‘এক সের চাল দিচ্ছি’ বলার মত মুখ করে নারায়ণ বলে, হুজুর কামগর খান। সিমাইয়ের জমিদার।
- তাকে নিয়ে কী করতে হবে? মাথায় তুলে নাচব?
নারায়ণ আরও নির্বিকার মুখে বলে, না হুজুর। কামগর খান আর পাটনার নায়েব রামনারায়ণের ফৌজ মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। কাল সাত ক্রোশ দূরে ছিল। আজ কতদূরে জানি না।
শুনে সিরাজের পিত্তিটা চটে যায়। এটা খবর? দুই জমিদার লাঠালাঠি করছে শুনে আমি এখন কী করব? লেঠেল পাঠাব? আমার আর কাজ নেই?
নারায়ণ ঘাঘু লোক—এসবে ঘাবড়ায় না, এমনি এমনি তো আর গুপ্তচর বিভাগের কর্তা হয়নি। সে শান্তভাবে বলে, না হুজুর। সেটা যুক্তিযুক্ত হবে বলে মনে হয় না। তবে আরেকটা খবর আছে।
- কী?
এবার নারায়ণ আসল বোমাটা ফাটায়, আহমদ শাহ আবদালি। মোগল বাদশাহ-র উজির গাজিউদ্দিন খান আর দুই শাহজাদাকে নিয়ে বাংলার দিকে কুচ করার তোড়জোড় করছেন। আগ্রা থেকে পাটনার দিকে আঠারো ক্রোশ চলেও এসেছেন।
অ্যাঁ? সে কী? এইবার সিরাজ নড়েচড়ে বসে। ই কী রে ভাই, এ তো জিনিস একটি। শিয়রে মোগল, আর এইটা এতক্ষণ পেটে চেপে রেখেছিল? দাঁত খিঁচিয়ে বলে, সেটা এতক্ষণ বলতে কী হয়েছিল? হারামজাদা, তোমার ঘাড়ের উপর মুন্ডুটা কেন দিয়েছে আল্লাতালা? যাতে আমি কুচ করে গর্দানটা নামিয়ে নিতে পারি, সেজন্য?
এতক্ষণে, দিনের মধ্যে প্রথমবার, সিরাজের মাথায় আসে, ফন্দির কথাটা। একা ইংরেজে রক্ষে নেই, তার সঙ্গে এবার এরাও এসে জুটেছে, শাকের আঁটির মত মারাঠারা তো আছেই। আর এর মধ্যে কামগর আর রামনায়ারণ চুলোচুলি করছে। বলিহারি বুদ্ধি। নবাব না থাকলে তোদের জমিদারি থাকবে রে বজ্জাতের বাচ্চা? সিরাজ মোহনলালকে এত্তেলা দেয়। তারপর অস্থির হয়ে একটু পায়চারি করতে শুরু করে। নাঃ, এবার একটা ফন্দি খাটানো দরকার। কিন্তু এই বাজারের মধ্যে নিরিবিলিতে একটু মাথা খাটানোর উপায় আছে? পরের আপদ হাজির হয়ে যায়, তৎক্ষণাৎ। এবার খাস চাপরাশি।
- এখন কী চাই?
- দু-খানা চিঠি এসেছে। জরুরি মনে হয়। হুজুর যখন বিশ্রাম নিচ্ছেনই না, তখন দেখবেন কি?
এর মধ্যে আবার চিঠিচাপাটি, লেখাপড়া? এর নাম নাকি নবাবি। যত্তসব। কার চিঠি? দেখা যায়—একটা ওয়াটসনের, আরেকটা ক্লাইভের। দেখে সিরাজের মাথাটা আরও গরম হয়ে যায়। এত আস্পর্ধা ক্লাইভ হারামজাদাটার, যে, স্পষ্টই লিখেছে—ফরাসি লকে পালাতে দিয়ে নবাব আলিনগরের চুক্তি লঙ্ঘন করেছেন। সুযোগ পেলেই ল ব্যাটা মোগল বা মারাঠাদের সঙ্গে যোগ দেবে। আর ওয়াটসনের চিঠিতে এত প্যাঁচ-পয়জারও নেই, পরিষ্কার তম্বি। হ্যাঁ রে অজরাইলের বাচ্চা, আমি বাংলার নবাব, আর তোরা শিখিয়ে দিবি—কাকে আমি ছেড়ে দেব, আর কার গর্দান নেব? সিরাজ দাঁত কিড়মিড় করতে থাকে। সকালে যদি চিঠিটা পাওয়া যেত, তখনই একটা হেস্তনেস্ত হয়ে যেত। ওই উকিল ব্যাটার, গর্দান না হোক—গোটা কতক আঙুলই কেটে বাক্সে পুরে ভেট পাঠানো যেত। ওয়াটসন টের পেত কত ধানে কত চাল।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল আসে। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা। গরম কমে আসে। এই সময়টায় যথারীতি গঙ্গা থেকে মিঠে হাওয়া আসে এই দিকে। কিন্তু মোহনলাল আসে না। বিষ খেয়ে উল্টে পড়েছিল, এখন একটু হাঁটাচলাও করছে, কিন্তু সবসময় সে খাড়া থাকতে পারে না। নইলে আসত অবশ্যই। গা চিড়বিড় করে সিরাজের। প্রাসাদভর্তি ষড়যন্ত্র। এই সবকটাকে জ্যান্ত জ্বালিয়ে দিতে পারলে তবে কলিজা ঠান্ডা হত।
আর তখনই, এই প্রায়ান্ধকার প্রাসাদচত্বরে দাঁত কিড়মিড় করে পায়চারি করতে করতেই, সিরাজের মাথায় বিদ্যুৎচমকের মত ফন্দিটা খেলে যায়। প্রথমবারের মত। এই চুতমারানিদের বড্ড বাড় বেড়েছে তো। ওদের ওষুধই ওদের দেওয়া দরকার। চিৎকার করে চাপরাশিকে ডাকে সিরাজ।
- জি হুজুর।
- ইংরেজের উকিলকে এত্তেলা দাও।
- উকিল মানে? ওই সকালের লোকটা?
- আবার কে? এখনই তলব কর। মুর্শিদাবাদ ছেড়ে যাবার আগে।
- এই রাতেই আসতে বলব?
- হ্যাঁ। আর তার আগে নারায়ণকে। এখনই।
- জি হুজুর।
সিরাজ পায়চারি করা বন্ধ করে। ছোটো দরবারে গিয়ে বসে। মাথার মধ্যে কিলবিল করে রাজনীতি। এক এক করে পিণ্ডি চটকাতে হবে। আজকে থেকেই খেলা শুরু। মেজাজ আবার খুশ হতে শুরু করে সিরাজের। কী করতে হবে বোঝা হয়ে গেছে। এবার শুধু সামান্য প্রতীক্ষা।
নারায়ণ আসে হাঁপাতে হাঁপাতে। এই কাজের তো দিনরাত নেই। অন্য খবরের সন্ধানে যাচ্ছিল, তার মধ্যেই জরুরি তলব। এখন কপালে কী নাচছে কে জানে।
কিন্তু সিরাজ, এই রাতে—খুবই শান্ত। সোজা কাজের কথায় চলে আসে, শোনো। বিশ্বস্ত দু-জন ঘোড়সওয়ার লাগবে। এখনই।
- হবে নবাব। কী হুকুম তাদের উপর?
- এখনই পলাশি যেতে হবে। রায়দুর্লভের ফৌজ যেখানে ছাউনি ফেলেছে। কোথায় জান তো?
নারায়ণ মৃদু হাসে। জানাটাই তো তার কাজ। সিরাজ বলে, রায়দুর্লভকে হুকুম, বাগানের গাছ কেটে, নদী আটকে দিতে হবে। কাল সকালের মধ্যে।
- কেন হুজুর? যদি জানতে চায়?
গুপ্তচরের বাচ্চা কি সাধে বলে? সব জানা চাই। কিন্তু সিরাজ কোনো গালাগাল দেয় না। সোজাসাপ্টা করে বলে, ওই ইংরেজ ওয়াটসনের নওয়ারা যেন নদী দিয়ে এ তল্লাটে ঢুকতে না পারে। সেইজন্য। যাও।
ব্যস, প্রস্তুতি সম্পূর্ণ। এবার শুধু সকালের খেলাটা শেষ করতে হবে। আসুক উকিলের বাচ্চাটা। সেও একটু বাদেই চলে আসে। মুর্শিদাবাদ ছেড়ে তো যায়নি, বরং ধারেকাছেই ছিল। চাপরাশির মত সেও সিরাজের মেজাজের ব্যাপারে বিলক্ষণ ওয়াকিবহাল। ঢুকে সেলাম করে নবাবকে। সিরাজ মুখ তুলে বলে, বোসো বোসো। অ্যাই কে আছিস। এদিকে আয়।
চাপরাশি এগিয়ে আসে, যাও একটু পান নিয়ে এসো।
- আপনি এখন পান খাবেন?
- না। আহাম্মকের বাচ্চা। এই মেহমানকে একটু খাতিরদারি করব।
অ্যাঁ? এইবার চাপরাশি টের পায় কী হতে যাচ্ছে। শান্তমনে খাতিরদারি, যেমন ছাগল কাটার আগে কাঁঠালপাতা। এ জিনিস সিরাজ আগেও করেছে। উকিলও সব খবরই রাখে। সে বলে, হুজুর আমি খাস কোম্পানির উকিল। মেহমানদারির জন্য কোম্পানির তরফে অনেক ধন্যবাদ। তারও গলা শান্ত। অর্থাৎ কিনা মনে করিয়ে দেওয়া, যে, তার কিছু হলে কোম্পানি কিন্তু ছেড়ে দেবে না।
এইসব সময়ে সিরাজের চোখ দেখে কিছু বোঝা যায় না। ঝাড়বাতির আলো ঝিকমিক করে চোখে। চেঁচায় তো নাই, একটুও দাঁত কিড়মিড়ও করে না। বরং পান এলে বলে, খাও, খাও। খাতিরদারি যতক্ষণ, আরাম করে নাও।
লোকটা শান্তমনে পান খায়। সিরাজ বলে, তা, তোমাদের ওই স্ক্র্যাফটন লোকটা এখনও এখানে?
উকিল বলে, জি।
- তুমিও এখানে। পুরো কোম্পানিই মুর্শিদাবাদে। কেন বল তো?
উকিল চুপ করে থাকে। সিরাজ মুখটা একটু সরু করে কাছে এনে বলে, ওই স্ক্র্যাফটন, ওই বাইজির বাচ্চা বেটিচোদ ঢাকা চলে যাচ্ছে না কেন?
উকিল শান্তভাবে বলে, নবাব সাহেব, উনি বকেয়ার জন্য অপেক্ষা করছেন।
সিরাজ বলে, ও। যার যা পাওনা—সব মিটিয়ে দেওয়া হবে। এখনই। কেন বল তো?
উকিল কী ঘটতে চলেছে, আন্দাজ করে, নিষ্পলক তাকিয়ে থাকে। সিরাজ বলে, কারণ, ওকে আর আমি কোনোদিন দেখতে চাই না।
উকিল তখনও তাকিয়ে। তার দিকে তাকিয়ে সিরাজ হেসে বলে, আর তোমার পাওনা? সেটা মেটাবো না?
উকিল এবার চোখ বুজে ফেলে। সিরাজ চিৎকার করে বলে, এই কে আছিস, আমিরচাঁদকেও ডেকে আন। দু-জনকে একসঙ্গে সম্মান জানাব আমি।
আমিরচাঁদকে নিয়ে আসা হয়। সে তখনও জানে না কী ঘটতে চলেছে। সিরাজের জমানাই এরকম। সিরাজ বলে, তোমরা এরকম মুখ করে আছ কেন? নবাবের দেওয়া সম্মান কি তোমাদের পছন্দ না?
সেই রাতেই বহুমূল্য খেলাৎ সহযোগে নবাবি সম্মাননা দেওয়া হয় দু-জনকে। জারি হয়ে যায় ঢাকার কুঠি বাবদ স্ক্র্যাফটনকে ক্ষতিপূরণের টাকা মিটিয়ে দেবার ফরমানও। সত্যি-সত্যিই। আমিরচাঁদ আর ইংরেজের উকিল এতক্ষণে টের পায়—খেলা সত্যিই ঘুরে গেছে। ইংরেজের উপর চড়াও হবার সিদ্ধান্ত বাতিল, এই উনিশে এপ্রিল ১৭৫৭ সালে। এর কয়েক মাসের মধ্যেই হবে পলাশি। চাপরাশি বা সিরাজ, কেউই অবশ্য তখনও সেটা জানে না।
এখানে যা লেখা হয়েছে—তা বর্ণে বর্ণে না হলেও, অনুচ্ছেদে অনুচ্ছেদে সত্য। উনিশে এপ্রিল, সত্যিই ইংরেজের উকিল এসেছিলেন সিরাজের দরবারে। সিরাজ তাকে দূর-দূর করে তাড়িয়ে দেন। সংলাপগুলোও মোটের উপর ঠিক। আমিরচাঁদ খুবই বিমর্ষ হয়ে পড়েছিলেন এবং সেদিন রাতেই সেই উকিল এবং আমিরচাঁদকে সম্মাননা প্রদান হয়, এ সবই সত্য কথা (সূত্র: রজতকান্ত রায়ের ‘পলাশীর ষড়যন্ত্র ও সেকালের সমাজ’, পৃষ্ঠা ২১২। তিনি মূল সূত্রও উল্লেখ করেছেন, কিন্তু সেটা যাচাই করা হয়নি)। ক্লাইভ এবং ওয়াটসনের চিঠিও বয়ানসহ সম্পূর্ণ সত্য। তবে সিরাজ সেই দিনই সেটা পড়েছিলেন কিনা—জানা নেই। পরেরদিনও পড়ে থাকতে পারেন। ওইটুকু এই কাহিনির কল্পনা।
তার চেয়েও বেশি জরুরি হল, সিরাজের দরবারের আবহ এবং ভাষা। সমসাময়িক ফার্সি লেখক, গুলাম হুসেন খান—যিনি সিরাজ এবং শওকত উভয় দরবারের সঙ্গেই ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত ছিলেন, তিনি খুব স্পষ্ট করে লিখেছেন, সিরাজ অত্যন্ত রূঢ় ছিলেন, নিত্যদিন মুখ খারাপ করতেন। খোলাখুলিই বুজুর্গদের অপমান করতেন এবং অর্বাচীনদের মাথায় তুলে রাখতেন (সাইর উল মুতাখিন, দ্বিতীয় খণ্ড, ইংরিজি অনুবাদে পৃষ্ঠা ১৮৯। তাঁর নৈতিক অবস্থানটি বাদ দিয়ে, শুধু পর্যবেক্ষণটুকুই এখানে নেওয়া হয়েছে)।
এবার কথা হল, মুখ খারাপ মানে ঠিক কী? সেটাও বাস্তবানুগ। উনিশে এপ্রিল রাতে ইংরেজ উকিলকে সিরাজ যা বলেছিলেন, সেটি ওয়ালশকে লেখা চিঠিতে স্ক্র্যাফটন স্বয়ং লিপিবদ্ধ করে গেছেন। ইংরিজিতে কথাটা হল, “The metichut of a garden chap”। রজতকান্ত রায় বলেছেন, মেটিচুৎ কথাটার কোনো মানে হয় না, ওটা বেটিচোৎ হবে (পূর্বোক্ত বই, পৃষ্ঠা ২১৩)। গার্ডেন চ্যাপ কথাটারও কোনো মানে হয় না ওখানে। কথাটা “দা বেটিচোদ সান অফ আ বিচ” জাতীয় কিছু হলেই ঠিকঠাক হত। ইংরেজ কান খিস্তিটা নিঃসন্দেহে ঠিকঠাক শোনেনি। আমি তাই ‘গার্ডেন চ্যাপ’ কে ‘বাইজির বাচ্চা’ করে দিয়েছি। সেটা হওয়া খুবই সম্ভব। এমনকি ‘বাইজি ছাপ’ ও হতে পারে। না হলেও কিছু এসে যায় না। মুখ-খারাপের মাত্রাটা এখানে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে।
এবার, শান্তির আলোচনায়, শান্তমনে যে লোক এইরকম খিস্তি দিতে পারে, অপমান করার সময় সে কী করতে পারে, সেটা সহজবোধ্য। সেটুকু ধরে নিয়েই বাকি সংলাপগুলি রচিত।
এতে যদি কিছু ধাক্কা খায়, তা আমাদের অতীত সম্পর্কিত বানিয়ে তোলা ধারণা—যা বস্তুত প্রতিটি লোক তার বর্তমান থেকে নির্মাণ করে। সেটুকুই এখানে শুধু বর্জন করা হয়েছে। সচেতনভাবে। ইতিহাস তো আদতে এত পেলব না। মোগল শাহজাদারা শিখতেন—বাকি ভাইদের মেরে যে টিকবে, সে-ই পরবর্তী বাদশাহ। টোলের পন্ডিত ও ছাত্ররা ব্যাকরণ ও সাহিত্যের পাশাপাশি আদিরসের লব্জে ওস্তাদ ছিলেন। বিলিতি পাদ্রীরা যখন সতীদাহ নিয়ে চোখের জলে ভাসছেন, তার কিছুদিন আগেও ওই দ্বীপে ডাইনি পোড়ানো হয়েছে সোৎসাহে। আমাদের কোনো আখ্যান যদি এসব ধারণ না করে, তো সে সমস্যা আখ্যানের।
* মাও-এর প্রকৃত উদ্ধৃতিটি (ইংরিজি অনুবাদে) যা বদলে নিয়ে গল্পের উপরে ব্যবহার করা হয়েছে: A revolution is not a dinner party, or writing an essay, or painting a picture, or doing embroidery; it cannot be so refined, so leisurely and gentle, so temperate, kind, courteous, restrained and magnanimous. A revolution is an insurrection, an act of violence by which one class overthrows another.
(Report on an Investigation of the Peasant Movement in Hunan)