

"ফিরলেন? উইক এন্ডে কী করছেন?"
এই অনিবার্য প্রশ্ন আসতেই আমি মনে মনে হেসে ফেলি। এক গতে বাঁধা সবকিছু। এতটুকু বৈপরীত্য নেই একটা দৃশ্যের সাথে আরেকটা দৃশ্যের। এই নিপুন অভিনয়ের পুনরাবৃত্তি আমাকে কম বয়েসের একটা পাগলামির কথা মনে করিয়ে দেয়। বক্সঅফিস-হিট হিন্দি সিনেমা দেখতে যাচ্ছি মফঃস্বলী সিনেমা হলে। পরপর তিনবার। তিনবারই আলাদা করে রিকোয়েস্ট এসেছে শুধু আমার জন্য। কারণ, আমি স্মার্ট, আমি কথা বলতে জানি। ওদের ভাষায় বললে, আমি 'অ্যাকটিং ভালোই জানি।' এসব ক্ষেত্রে কী করে অজুহাতকে প্রায়োরিটি হিসাবে সেট করতে হবে তা আমার জানা। কোন গলি দিয়ে অভিসারিকাকে নিয়ে গেলে সবচেয়ে কম লোক দেখবে, কোন চায়ের দোকানের পিছনে নিভৃত গুমটি আছে, মেলার মাঠের কোন দিকটার লাইটপোস্টের আলোটা জনস্বার্থে ভাঙা থাকে এসব নিগূঢ় তথ্য সাপ্লাই করে মফঃস্বলের প্রধান দূতী হয়ে উঠেছি তাই, এইসব গোপন অভিসারে আমি ফার্স্ট চয়েস। এ বিষয়ে অন্য ছেলেপিলেরা চেষ্টা করেও বিশেষ সুবিধা করতে পারত না।
পড়াশোনা শিকেয় তুলে সঙ্গদানে না যে বলিনি তার আসল কারণ অবশ্য আলাদা। প্রতিবারেই জানি যার বাড়িতে আমাকে শিখন্ডী সাজিয়ে সামনে দাঁড় করানো হবে, সেইই নিয়ে যাবে সাথে করে রিকশা ভাড়া দিয়ে। তারপর রঙ্গমঞ্চে আসবে লক্কা পায়রার মতো একটি প্রেমাস্পদ। তারপর তিনজনের মধ্যে শুরু হবে একটা পূর্বপরিকল্পিত অভিনয়। কাপলটি ভান করবে আমাকে গুরুত্ব দেওয়ার যা আমি অ্যাপ্রিশিয়েট করব, আসলে জানি তারা দিচ্ছে না। জানি সিনেমা হলের ভিতরের অন্ধকারে পর্দার আলো এসে পড়লে আমাকে চোখ ফিরিয়ে রাখতে হবে ঘনিষ্ঠদৃশ্যের একদম বিপরীতে আর কখনো ওঠার দরকার হলে জানান দিতে হবে আগেভাগে যাতে তারা চট করে নিজেদের হাত-পাকে সামলে নিতে পারে আর, আলো জ্বললে এমন ভান করতে হবে যেন কিছুই বুঝিনি এতক্ষণ। যেন প্রকৃত ভালোবাসার পাত্রপাত্রীকে কাছাকাছি আনার মতো পবিত্র কাজ করে আমি জাস্ট মহান হয়ে গিয়েছি। এত অবধি ঠিকঠাক থাকে ব্যাপারটা কিন্তু প্রধান সমস্যা হয় পর্দা পড়লে। কার্টেন ড্রপের পরে লোভটা বাড়ে।
লোভ ব্যাপারটাই এমন জটিল, বহুমাত্রিক যাকে অগ্রাহ্য করার স্পর্ধা দেখানোর মানে বাতুলতা এটা সেই সময় থেকে জানি। ফলে এইসব ভণিতার দরকার নেই জেনেই আমি সর্বপ্রথম দরাদরিটা করে রাখতাম। একটা শো মানে, একটা কোল্ড ড্রিংকস অথবা আইসক্রিম আর তার সঙ্গে এক প্লেট চাউমিন অথবা চিকেন রোল নিদেনপক্ষে এগ ডেভিল। সস্তার দোকান হলেও অসুবিধা নেই কিন্তু শর্তটা হলো, আমাকে সর্বশেষ টুকরোটা তৃপ্তি নিয়ে খেয়ে ফেলার যথেষ্ট সময় দিতে হবে এবং তাই নিয়ে পরে কোনো খোঁটা দেওয়া চলবে না। তাতে করে একই অভিসারিকার প্রণয়ীর মুখ পালটে পালটে গেলেও মা কসম আমি চোখে জাজমেন্ট নিয়ে তাকাবো না কারণ, ঐসব গিল্ট- ফিলিং বাজারে বেচে একটা ভেজ রোলেরও দাম ওঠে না। সুতরাং বছর ষোলোর শরীরের দুদ্দাড় দাপিয়ে ওঠা খিদেকে রেশনের চালের ভাত আর কুচোচিংড়ির ঘ্যাঁট দিয়ে দমিয়ে রাখা ব্রহ্মচর্য থেকে কম নয় আর অত তিতিক্ষা আমার সাবজেক্টও নয়। অবশ্য গিল্ট-ফিলও হত কারন প্রায়শই ঢেঁকুরটা আসতো ভাড়াটে ঘরের প্রায়ান্ধকার, স্যাঁতস্যাঁতে বারান্দায় পা রেখে বা ভেসলিন লাগানো উদ্ধত ঠোঁটের পাশে লেগে থাকা খাবারের গুঁড়ো দেখে ছোটো ভাই বোনেরা নিষ্ফল তাকিয়ে থাকতো বলেও, তবু, ওসবের পরোয়া আমি কোনোদিন করিনি। এড়িয়ে থাকার, বুঝতে না পারার দক্ষতা অর্জনের শুরু সেই সময় থেকে। সব অভিনয়ের একটা দাম থাকে, সেটা বুঝে নেওয়াই ভালো।
অতিরিক্ত সময় নিয়ে চুপ থাকতে দেখে ছেলেটা প্রশ্ন করল, "কই বললেন না যে?" স্পষ্ট দ্বিধা গলায়। এ সমস্ত দীর্ঘ নিস্তব্ধতা আসলে একটা লটারি খেলার মতোই রিস্কি। উত্তর, প্রত্যাশিত পরিস্থিতির সাথে মিলে যেতে পারে আবার বন্ধ কারখানার লোহার গেটের মতো বরাবরের জন্য বন্ধ হয়ে যেতে পারে যোগাযোগ। যদিও আমি জানি যে অভিনয়টা শুরু হয়ে গেছে খুব ক্যাজুয়াল ভাবেই তবু, "দিনকাল ভালো নয়"- আমি বললাম। দিনকাল নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র অভিযোগ নেই। কিন্তু, অকারণে সম্পূর্ণ অন্য রুটে কথা বলার ফলে এই যে ওপারের দমবন্ধ আগ্রহটা তৈরি হল, তা উপভোগ করার ইচ্ছা আমার বেশ তীব্র। ওপারের স্তব্ধতাকে সময় দিয়ে আমিই ইচ্ছাকৃতভাবে ধীরে ধীরে ভেঙে বললাম, "ইচ্ছা আছে, শর্ট ট্রিপে যাবো, কাছাকাছি কোথাও। কেন?"
বলা বাহুল্য তার উত্তর নেগটিভ হয়নি এবং প্রত্যাশিত উত্তরে গা ভাসিয়ে আপাততঃ বেরিয়ে পড়েছি বাইকের পিছনে বসে। বর্ধমানের কোনো একটা গ্রামে যাচ্ছি এইটুকুই জানি এবং ফেরা সম্মন্ধে নিশ্চিত কোনো প্রশ্ন করিনি। এসব ক্ষেত্রে অনাবশ্যক দেরি হবে জানি আর মোটামুটি রাত কাটানোর জায়গা হঠাৎ কপালজোরে যোগাড় হয়ে যাবে, তাও জানি। চালক কিন্তু সে সব আভাসমাত্র দিচ্ছে না, এমনকী বাইকের পিছনে বসিয়েও অযথা আমার পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা অবধি করছে না দেখে, আমার একটু রাগ হল। সাইড মিররের ভিতরে দেখছি সামনে তাকিয়ে গাড়ি চালাচ্ছে, একবারও আয়নার দিকে তাকাচ্ছে না । এদিকে শহর ছাড়াতেই আমি খুলে ফেলেছি হেলমেট, উড়তে দিয়েছি চুল, রোদের আঁচ লেগে ঠোঁট ঝিকমিক করতে করতে হাঁফিয়ে উঠেছে। রাস্তার পাশে চা আর জলখাবার খেতে খেতে আমি কপট রাগে বললাম, "ভীষণ জোরে গাড়ি চালান আপনি!" সে প্রশ্নের উদ্দেশ্য পাশ কাটিয়ে বললো, না হলে পৌঁছাতে বিকেল হয়ে যাবে।" আমি চাপদাড়ির দিকে ঘন চোখে তাকিয়ে আলগোছে হেসে বললাম, "তাতে কী? হোক না দেরি?" অন্যমনস্কভাবে আর একদিকে তাকিয়ে সে বললো, "না না, তাহলে আপনার ফিরতে সমস্যা হবে।" আমি তার দৃষ্টি অনুসরণ করে দেখলাম, একটা বুড়ি বোঁচকাবুঁচকি সমেত গাছতলায় বসেছে, সাথে একটা ন্যাংটো ছেলে। তার দিকে তাকিয়ে থাকার মতো কী এমন আছে, আমি তো বুঝলাম না!
সারা দিনটা মাঠেঘাটে আর দেওয়ালে ছবি আঁকা একটা গ্রামে ঘুরে ঘুরে গেল। কয়েকটা হাটুরে চাষা, খামখেয়ালী গাইবাছুর আর আধল্যাঙটো ছেলেমেয়ের সাথে অজস্র কথা বলার পর তার খেয়াল হলো, আমি ক্লান্ত, বিরক্ত। বাইক দাঁড় করালো একটা প্রায়-নিঃশব্দ নদীর পাশে। বিকেলের রোদ তখন ঝাঁকড়া গাছের গায়ে হেলান দিয়েছে। সে জিভ কেটে বললো, "সরি। আপনাকে নদী দেখানোর কথা ছিল, ভুলে গেছিলাম!" বাস্তবিক এমন কোনো কথা ছিল না। যা ছিলো তা ফেসবুকে নদী নিয়ে ফেনিয়ে তোলা বিষণ্ণতা। একবছর আগের পোস্টে করা কমেন্ট তাকে এমন দায় দিয়ে দিয়েছে দেখে মনে মনে অবাক লাগলেও আমি নদীর কাছে গিয়ে বসলাম। কেউ কোত্থাও ছিলো না। গাছের ছায়ায়, বড় বড় ঘাসের প্রশ্রয়ে অনায়াসে রাজি হয়ে যাওয়া যায়। চারটে কৌতুহলী কাক আর দুটো পাটকিলে কুকুর ছাড়া কেউ আশেপাশে নেই, তবু আমার শরীর এলিয়ে দিয়ে বসা উপেক্ষা করে ধুসর পাঞ্জাবি, নীল জিনস বসলো একটু দূরে। আমি অপেক্ষা করলাম, ভাঙলাম না। ছোটোবেলায় একবার সিনেমাতে দেখেছিলাম একটা সিংহ আর মানুষ মুখোমুখি। মানুষটার হাতে বন্দুক। এত নিপুণভাবে দুজন, দুজনকে দেখছে যে চারপাশের সবকিছু রঙিন হলেও, তারা একে অপরের চোখে সাদা কালো। আমার মনে হয়েছিল ঐ সাদাকালো রঙটা আসলেই বেঁচে থাকা আর মরে যাওয়ার মধ্যেকার বৈপরীত্য। জাস্ট একটা সামান্য সময়ের হেরফের হলে শিকারী ও শিকার চরিত্র পরিবর্তন করতে পারে কিন্তু ঐ রঙটা কনস্ট্যান্ট, অপরিবর্তিত। তখন, সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছিল ঐ তাকিয়ে থাকাটা। আর সবকিছু তুচ্ছ রেখে, শিকার ও শিকারীর পোটেনশিয়াল আইডেনটিটি এক্সপোজ না করেও, অন্যের চোখের দিকে ঐ রকম মুগ্ধ, আশা আর নিরাশার দোলাচলতার মধ্যে তীব্র, আবেদনময়, অনিবার্য, অনগ্রাহ্য দৃষ্টি। এরকম দৃষ্টি আমি প্রায়শঃ দেখেছি এক্সট্রিম ভদ্রতা করে দূরত্ব রাখার অভিনয় শেষ হলে পুরুষের চোখে, অভিপ্রেত রমণেচ্ছার আগে তীব্র আশ্লেষে। ভোগে আমার অনীহা নেই। আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম আরেকটা কার্টেন ড্রপের জন্য।
কিছুক্ষণ বাদে সে আমার দিকে না তাকিয়েই জিজ্ঞাসা করলো, "কেমন লাগলো বলুন তো আপনার?" আমি পালটা প্রশ্ন করলাম, "আপনার?" সে এইবার, এতক্ষণে আমার দিকে মুখ ফিরিয়ে হাসলে দেখলাম চাপদাড়িতে মুখ ঢেকে রাখলেও তার চোখদুটোতে সতের আঠেরোর যুবকের আলো লেগে আছে। এলোমেলো চুলে লেগে আছে কৃষ্ণচূড়ার পাতা। সে বললো, "খুব ইচ্ছা ছিল, আপনাকে একদিন এই গ্রাম ঘোরাই। ফেসবুকে আপনি এত লিখতেন, এদেরকে সামনে থেকে দেখাই আপনাদের, নিজে। খুব ভালো লাগছে!" আমি অকৃত্রিম বিস্ময় ঢাকতে পারলাম না চোখে, মুখে। বললাম, "ব্যস? এই জন্য শুধু নিয়ে আসতে চেয়েছিলেন? আর কিছু নয়?"
তার মুখটা চিন্তিত দেখালো। প্রশ্নের তল খুঁজে না পাওয়া স্কুলের ছেলেদের মতো সারল্য নিয়ে জিজ্ঞাসা করলো, "আর...কী বলুন তো? আপনি কি অখুশি হলেন? আপনার ভালো লাগেনি, না?"
আমি দেখলাম, কার্টেন ড্রপ হয়ে গেছে। আমার আর কোনো চরিত্র থেকে বেরোনোর দরকার নেই। কোনো চরিত্রে ঢোকার দরকার নেই। ইনফ্যাক্ট, অভিনয়টাই একটা অদরকারী জিনিস এখানে, ফর্মালিনে চুবিয়ে রাখা কাটা অঙ্গের মতো গা ঘিনঘিনে ব্যাপারমাত্র।
আমি ঘাসের উপর লম্বা হয়ে শুয়ে বললাম, "ভালো লাগবে, যদি যাওয়ার সময় ঐরকম আরেকটা চা খেতে পাই। হ্যাপি এন্ডিং।” উপরের দিকে এতটুকু আড়াল না হওয়া আকাশের বদলানো দেখতে দেখতে, আমি নিশ্চিন্তে চোখ বুজলাম।
. | ২৮ এপ্রিল ২০২৫ ১১:১৮542713
kk | 172.58.***.*** | ২৮ এপ্রিল ২০২৫ ২১:০৫542725
স্বাতী রায় | ২৯ এপ্রিল ২০২৫ ১৬:৪৮542740
Amit Chatterjee | ০২ মে ২০২৫ ০৯:৫৩731025
সুরমিতা রায় | 2405:201:8043:a01f:bd12:81f5:bd4e:***:*** | ০৩ মে ২০২৫ ০৯:৫৮731043