চারিদিকে শিমুল পলাশের রক্তিম হাতছানি তীব্রভাবে জানান দিচ্ছে ‘বসন্ত এসে গেছে’। রোদের খরত্ব এখনও ছাপ ফেলতে পারেনি শীতটানে আড়মোড়া ভাঙা ত্বকে। এমন এক অনুভূতিপ্রবণ সময়ে এইবছর হৈ হৈ করে এসে পড়েছে রমজান মাস। চান্দ্রমাস মেনে চলা ইসলামি ক্যালেন্ডারে প্রতিবছর ১১ দিন করে এগিয়ে আসে রমজান সহ প্রতিটি অনুষ্ঠান। তাই শারদোৎসবের মতন মুসলমানরা শুধু রমজান কেন কোন ধর্মীয় ঘটনা বা উৎসবকে ঋতুর সঙ্গে যুক্ত করতে পারি না। শুধু দোষেগুণে আমরা সাধারণ মানুষ মনে মনে হিসেব কষি,” এবছর রোদের তাত তত গায়ে লাগবে না। পিপাসায় কষ্ট পাবে না রোজদাররা।”
কষ্ট হয় বৈকি। প্রায় তেরো চোদ্দ ঘন্টা বিন্দুমাত্র খাদ্য পানীয় ব্যতিরেকে থাকা মোটেও সহজসাধ্য না। কিন্তু কোথা থেকে মানসিক জোর এসে যায়, ধনী দরিদ্র নির্বিশেষে শারীরিক ভাবে ধর্মপরায়ণ সক্ষম নারী পুরুষ হাসি মুখে পার করে দেন পুরো রমজান মাস।
বিশেষ কোন ঋতুর সঙ্গে যুক্ত না হলেও রোজার আনুষঙ্গিক আচার বিচার একই থাকে। শুধু সময় সীমার খানিকটা কম বেশি হয়। যেমন শীতকালে দিন ছোট বলে রোজায় অভুক্ত থাকার সময়কাল ছোট, ঠিক তেমনভাবে গ্ৰীষ্মকালে রোজদারকে সবথেকে বেশি সময় কাটাতে হয় বিনা খাদ্য পানীয় ব্যতিরেকে।
ভোররাতে সেহরি খাওয়া দিয়ে প্রতিদিনের উপোস শুরু আর সূর্যাস্তের পর খেজুর বা কোন মিষ্টি জাতীয় খাবার ও জল দিয়ে রোজার শেষ। খাবারে আমিষ নিরামিষের বাছবিচার নেই। ইফতার থেকে সেহরির মধ্যবর্তী সময়ে যার যেমন ইচ্ছে ও রুচি সেই অনুযায়ী যেকোন হালাল খাবার খেতে পারে ও জীবন যাপন করতে পারে।
খুব ছোটবেলার রোজার স্মৃতি হিসেবে মনে পড়ে, মা পাশ থেকে উঠে গেছেন গভীর রাত্রে। কত রাত বলতে পারব না। দূরের মসজিদ থেকে ভেসে আসছে,” সেহরির জন্য উঠে পড়ুন….”
তখন অত সময়ের হিসেব বুঝতাম না। আঠার মতন ঘুম লেগে আছে চোখে কিন্তু বেশ বুঝতে পারছি মা পাশে নেই। রান্নাঘর থেকে ভেসে আসছে প্রেশার কুকারের হুইসেল, থালা বাটি গ্লাস নাড়াচাড়ার শব্দ। বন্ধ চোখে টলতে টলতে পৌঁছে যেতাম রান্নাঘরে। বাবুজী ব্যস্তসমস্তভাবে বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসছেন অজু করে। ডাইনিং স্পেসে মাদুর দস্তরখানা বিছিয়ে মাকে বলতেন,”আর কুড়ি মিনিট বাকি আছে।”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ হয়ে গেছে। তুমি খেতে বসো।” বলে মা দস্তরখানায় গরম করা ভাত তরকারি গুছিয়ে রেখে সেহরির খাবার বেড়ে দিতেন থালায়। পরিমানে খুবই সামান্য। আসলে এই অসময়ে খেতে পারতেন না দুজনের কেউই। তবে সেহরি খাওয়া সুন্নত তাই নিয়ম রক্ষার্থে এক থেকে দুই চামচ ভাত পাতলা ডালের জল অথবা এক পিস মাছ বা মাংসসহ পাতলা ঝোল দিয়ে গলর্ধকরণ, আরকি।
আমাদের বাড়িতে সেহরি হোক বা ইফতার, আয়োজন খুব সামান্য। রাত্রের জন্য যে ভাত/রুটি ও তরকারি করা হতো প্রথমেই তার থেকে কিছু অংশ তুলে রাখা হতো সেহরির জন্য। ভোর রাত্রে সেই খাবার স্টিমে গরম করে নিতেন মা। কিন্তু গ্ৰামের আত্মীয়দের মুখে শুনতাম তাঁদের রাত্রি দুটো আড়াইটায় উঠে নতুন করে রান্না চাপাতে হতো। ভাত, রুটি, তরকারি যে যেমন খাবে সব টাটকা রান্না করে দিতে হবে বাড়ির বৌদের। এক সহকর্মীর মুখে শুনেছিলাম তাঁদের বাড়ির পুরুষরা নাকি এগরোল সহ মোগলাই, বিরিয়ানি ইত্যাদি খাবার খেতে চান। বান্ধবীর মা-দাদি তাই করে দেন রাত জেগে। অথচ রমজান সংযমের মাস।
সংযম শুধু খাদ্য চাহিদায় না, শারীরিক মানসিক এমনকি মুখের কথারও সংযম করতে হয় এই এক মাস। ন্যূনতার অভ্যেসের মাস। নিজেকে ক্রমাগত সংযত ও সংশোধন করে ওপরওয়ালার কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নেওয়ার মাস এই রমজান। বলা হয় এই একমাসে বান্দার প্রতিটি ইবাদত ও সৎকাজের পুরস্কার সাত থেকে সত্তরগুণ বাড়িয়ে দেওয়া হয়। তাই বেশি বেশি কোরান পড়া, নামাজ আদায় করা, তসবিহ পাঠ বিধেয়। কিন্তু সাধারণ গেরস্থ মেয়েদের কপালে সে সুযোগ আর কতটুকু জোটে?
সারারাত ধরে প্রায় না ঘুমিয়ে সেহরির জন্য খাবার দাবার তৈরি, পরিবেশন ও শেষে নিজে খেয়ে এই পর্ব সারতে না সারতে ফজরের আজান হয়ে যায়। নামাজ পড়ে দু এক ঘন্টা হয়ত কেউ গড়ান দিতে পারেন তবে বেশিভাগ মহিলাই কোরান শরীফ পড়তে বসেন। সকালে সংসারের কাজ শুরু হওয়ার আগে এক কি দুই পারা (খণ্ড) পড়ে ফেলতে চান তাঁরা। রমজান মাসে কমপক্ষে একবার পুরো কোরান শরিফ পড়া নিয়ম। এক খতম বলা হয় তাকে। তারপর যে যার মত যত খুশি বার পড়তে পারেন। বাড়ির মেয়েদের মধ্যে চাপা প্রতিযোগিতা চলে দুই খতম, তিন খতম, চার খতম দেওয়ার। গ্ৰামে রমজানের ভোরবেলাগুলি ভরে ওঠে কোরান তেলাওয়াতের মেয়েলি মিহি গুঞ্জনে ।
তারপর সকাল হয়ে গেলে শুরু হয়ে যায় সংসারের ঘানি। রাত্রের বাসি থালাবাটি, ঘর দুয়ার পরিষ্কার, জামাকাপড় কাচা ইত্যাদি কাজের জন্য মাস-মাইনের কাজের লোক থাকলে তাও খানিকটা আসানি নয়ত এইসব প্রতিটি কাজ করতে হয় বাড়ির মেয়েদের। এরপর আবার রান্নাঘরে ঢোকা। বাড়ির সবাই তো আর রোজা রাখেনি। শিশু, অতিবৃদ্ধ, অসুস্থ এবং কিছু নামাজ রোজা না মানা শক্ত সমর্থ পুরুষমানুষ থেকেই যায় প্রতিটি সংসারে। তাদের জন্য চা জলখাবার থেকে দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে তো এই রোজদার মেয়েদেরই।
এসবের পাকেচক্রে নমো নমো করে সেরে নেয় জোহর ও আসরের নামাজ। এই দুই নামাজের মাঝের সময়ে ঘন্টাখানেক বিশ্রাম করে নেন মহিলারা। এরপর শুরু হয়ে যাবে ইফতারের আয়োজন পর্ব।
মা-বাবুজী ছিলেন স্কুল শিক্ষক। সমস্ত ছাত্রজীবনে রোজা রাখার জন্য কোন চাপ ছিল না আমার উপর। বাবুজী বলতেন,” ছাত্র ও সীমান্ত রক্ষাকারী সৈনিকের ওপর রোজা সহজ করে দেওয়া হয়েছে।” সুযোগ নিতাম এই নিয়মের, রোজা রাখতাম না পরীক্ষা বা অন্য কোন বাহানায়। মাকে রান্না করতে হতো আমার জন্য। আমার পড়াশোনা, ঘরকন্না সামলে মা স্কুলে চলে যেতেন সাড়ে নটার মধ্যে। দূরের পথ। বাসে প্রায় ঘন্টাখানেকের যাত্রা। স্কুল শেষে মায়ের বাড়ি ফিরতে প্রায় পাঁচটা বেজে যেতো। বাইরের জামা কাপড় ফেলে ঘরোয়া পোষাকটুকু পরার সময়টাই বোধহয় মায়ের বিশ্রামকাল। আমি, বাবুজী মিলে চিনি-নুন-পাতিলেবুর সরবত করা ছাড়া আর কোন কাজই ঠিকঠাক করে করতে পারতাম না। মা সুচারু হাতে বিভিন্ন মরসুমি ফল কেটে সাজিয়ে রাখতেন থালায়। ছোলা ভাজা, তেলেভাজা করে ফেলতেন তারই ফাঁকে ফাঁকে। কেটলিতে পরিমাপ মতো জল চিনি দুধ দিয়ে তৈরি করে রাখতেন চায়ের ব্যবস্থাও। মগরিবের নামাজ পড়েই গ্যাসে বসিয়ে দিতেন কেটলিখানা। মুড়ি তেলেভাজা নিয়ে বসতে না বসতে চা তৈরি। আমেজ করে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে ক্ষণিক বিশ্রাম।
কিন্তু ওই যে বল্লাম আমাদের বাড়িতে সেহরি হোক বা ইফতার, সবই খুব সাদামাটা। অন্যান্য অবস্থাপন্ন বাড়িতে ইফতার মানে সে এক এলাহি আয়োজন। কী নেই সেখানে, ফল থেকে শুরু করে দুতিন রকমের সরবত, কোফতা, কাবাব, রোস্ট, তন্দুর, ভাজা মাছ মাংসের অঢেল ব্যবস্থা। শুধু সংযম নেই। আর নেই মেয়েদের জন্য বিশ্রামের ব্যবস্থা। কারণ এই ইফতার শেষ হলেই ঢুকতে হবে হেঁসেলে রাত্রের খাবার তৈরির সময় যে বয়ে যায়।
সেই ছোটবেলা থেকে আজ পর্যন্ত এই নিয়মের কোন ব্যত্যয় চোখে পড়ে না। হ্যাঁ পরিবর্তন এসেছে বৈকি তবে তা খুবই নগণ্য। এখন আমি দুই সন্তান, স্বামী নিয়ে ঘোরতর সংসারী। বছরভর পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ রোজ ঠিকঠাক না পড়তে পারলেও রোজা রাখি পুরো রমজান মাস। স্বামী ও ছোটছেলে রোজা রাখতে পারে না। চেষ্টা করে হাতে হাতে সাহায্য করার। আগের দিনের মানুষদের মতন,” তুমি রোজা রেখেছ তো আমার কী! আমাকে আমার প্রাপ্য কড়ায় গণ্ডায় বুঝিয়ে দিতে হবে” সেই মানসিকতা থেকে মুক্ত অনেকটাই। গ্ৰামের আত্মীয়দের মুখেও শুনি এমন পরিবর্তের কথা। মেয়েদের প্রতি কিছুটা সহমর্মিতা কথা শুনে সহজ হয়ে ওঠে আমাদেরও পথ চলা।