সম্প্রতি ইউনুস সরকারের অধীনে বাংলাদেশ শিশু একাডেমী ময়মনসিংহের ঐতিহাসিক রায়চৌধুরী বাড়ি ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়। কাজও বেশ খানিকটা এগিয়ে যায়। এই নিয়ে বাংলাদেশের মধ্যেই তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। ভারতেও তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়। সর্বত্র বিক্ষোভের মুখোমুখি হয়ে বাংলাদেশ শিশু একাডেমী বাড়ি ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত আপাতত স্থগিত রেখেছে। এই নিয়ে বাংলাদেশের প্রতিবেদন প্রকাশিত হোলো।
আগ্রহী হলে পড়তে পারেন।
---------------------------------------------------------------------
ময়মনসিংহ শহরের ঐতিহাসিক হরিকিশোর রায়ের প্রায় ২০০ বছরের পুরোনো বাড়িটি ভেঙে ফেলা হচ্ছে। ভবনটি ভেঙে সেখানে নতুন ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ শিশু একাডেমি। এ ঘটনায় ক্ষোভ জানিয়েছেন প্রত্নতত্ত্ববিদ ও ইতিহাস সচেতন নাগরিকেরা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও চলছে ব্যাপক সমালোচনা।
শিশু একাডেমির এই উদ্যোগে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তাদের দাবি, এই ভবনটি সত্যজিৎ রায়ের পূর্বপুরুষদের স্মৃতিবিজড়িত এবং স্থানীয় ঐতিহ্যের অংশ। হরিকিশোর রায়ের নামে শহরের একটি রাস্তার নামকরণ হয়েছিল ‘হরিকিশোর রায় রোড’।
ঘটনার পরপরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে নিন্দার ঝড় ওঠে। ঐতিহাসিক এই স্থাপনা ভাঙায় তারা মর্মাহত বলেও জানান।
‘ময়মনসিংহ সিটি’ নামের একটি ফেসবুক গ্রুপে মুসরিন আক্তার মিম মন্তব্য করেন, কেন ভাঙল? এসব প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন তো সংরক্ষণ করা উচিত। ফাল্গুনী চক্রবর্তী লেখেন, শিশু একাডেমির ক্লাস করতাম এখানে।
আশিকউজ্জামান নামে একজন মন্তব্য করেন, কী আর বলবো, পুরোনো স্থাপনা ময়মনসিংহে আর তেমন কিছুই রইলো না। অথচ জমিদারবাড়ির আধিক্যের কারণে ময়মনসিংহ শহরকে বলা হতো জমিদারদের শহর। পুরাতন বিল্ডিংয়ের শহর। আজ সেটা অস্তিত্ব সংকটে। অথচ এই ময়মনসিংহ শহরকে কলকাতার মতো রাজকীয় শহর হিসেবে সাজানো যেত।
সরেজমিনে দেখা গেছে, ভবনটির সামনের অংশ ইতোমধ্যে ভেঙে ফেলা হয়েছে। ইটগুলো ছড়িয়ে–ছিটিয়ে রয়েছে। ভবনের ভেতরের অংশও প্রায় গুঁড়িয়ে গেছে। তবে সোমবার বিকেল ও মঙ্গলবার সকালে গিয়ে কোনো শ্রমিকের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়নি। আপাতত ভাঙার কাজ বন্ধ রয়েছে।
হরিকিশোর রায় ছিলেন কিশোরগঞ্জ জেলার কটিয়াদী উপজেলার মসূয়া জমিদারবাড়ির জমিদার। তিনি উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, সুকুমার রায় ও সত্যজিৎ রায়ের পূর্বপুরুষ।
জানা যায়, উপেন্দ্রকিশোর মাত্র পাঁচ বছর বয়সে তার পিতা কালীনাথ রায়ের জ্ঞাতিভাই হরিকিশোর রায়ের কাছে দত্তক হিসেবে আসেন। হরিকিশোরের স্নেহ-ভালোবাসায় উপেন্দ্রকিশোরের শিক্ষাজীবন শুরু হয় এবং তিনি ময়মনসিংহ জিলা স্কুল থেকে ১৮৮০ সালে বৃত্তি নিয়ে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।
বাড়িটি ১৯৮৯ সাল থেকে বাংলাদেশ শিশু একাডেমির কার্যক্রমের জন্য ব্যবহৃত হয়ে আসছে। একতলা এই বাড়িটির সামনে একটি ছোট মাঠ রয়েছে। দীর্ঘদিন অব্যবহৃত থাকায় ভবনটি আগাছায় ঢেকে যায় এবং মাদকসেবীদের আশ্রয়স্থলে পরিণত হয়।
গত কয়েক দিন ধরে বাড়িটি ভাঙার কাজ শুরু করেছে শিশু একাডেমি। ভবনটি ময়মনসিংহে বিএনপির কার্যালয়ের পাশেই অবস্থিত।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের মাঠ কর্মকর্তা সাবিনা ইয়াসমিন সমকালকে জানান, এ সম্পর্কে তথ্য চেয়ে জেলা শিশুবিষয়ক কর্মকর্তার কাছে লিখিতভাবে আবেদন করেছি। এটি রায় পরিবারের ঐতিহাসিক বাড়ি এবং সত্যজিৎ রায়ের পূর্বপুরুষের নিবাস ছিল। যদিও এটি এখনও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসেবে তালিকাভুক্ত নয়, তবে এ বছর নতুন জরিপে এটি তালিকাভুক্ত হতে পারে।
তিনি আরও বলেন, আজ ময়মনসিংহের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের সঙ্গে দেখা করেছি। তিনি জানিয়েছেন, শিশু একাডেমির সঙ্গে কথা বলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন। তবে শতবর্ষী এই ভবনটি ভাঙা মোটেও ঠিক হয়নি। এটি রক্ষা করে নতুন ভবন নির্মাণ সম্ভব ছিল।
ময়মনসিংহ শিশু একাডেমির জেলা শিশুবিষয়ক কর্মকর্তা মো. মেহেদী জামান বলেন, ২০১০ সালের পর থেকে ভবনটি ব্যবহার করা যাচ্ছিল না। একাডেমির কার্যক্রম চালানো হচ্ছিল ভাড়াবাড়িতে। ঝুঁকি বিবেচনায় একবার মেরামতের চেষ্টা করা হয়েছিল, কিন্তু সম্ভব হয়নি।
তিনি আরও বলেন, বর্তমানে প্রতি মাসে ৪৭ হাজার টাকা ভাড়া দিতে হয়। এতে সরকারের আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে। তাছাড়া শিশুদের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ভাড়াবাড়ি উপযুক্ত নয়।
তিনি জানান, যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে সব প্রক্রিয়া অনুসরণ করে ভবনটি ভাঙা হচ্ছে। মেসার্স ময়ূর বিল্ডার্স নামের একটি প্রতিষ্ঠান কাজটি করছে। ভাঙার কাজ শেষে আপাতত একটি আধাপাকা ভবন নির্মাণ করা হবে এবং পরে পাঁচতলা ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে।
ভবনটি সংরক্ষণ করে নতুন ভবনের কাজ সম্ভব ছিল কিনা—এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ভবনটি অনেক আগেই পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। গণপূর্ত অধিদপ্তর এ বিষয়ে কাজ করে রিপোর্ট দিয়েছে।
লেখক ও কবি ফয়েজ আহমেদ বলেন, ২০০ বছরের পুরোনো এই স্থাপনাটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব রক্ষা করে ভবন নির্মাণ করা যেত। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর ও স্থানীয় ইতিহাসবিদরা যখন সংরক্ষণের পক্ষে, তখন শিশু একাডেমি এই ভবন ভেঙে দিচ্ছে—এটা খুবই দুঃখজনক। ইতিহাস-ঐতিহ্য এভাবে ধ্বংস হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে আমাদের শহরের পরিচয় কী থাকবে?
ময়মনসিংহের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) রেজা মো. গোলাম মাসুম প্রধান বলেন, শিশু একাডেমি কীভাবে এ ভবনটি ভেঙে নতুন ভবন নির্মাণ করছে, তা জানতে তাদের ডাকা হয়েছে। কাগজপত্র দেখে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।