মন ভালোর গল্প
এখনও রাতের অন্ধকার ফিকে হতে অনেকটাই সময় বাকি। বিছানা ছেড়ে উঠে পড়েছে গুলাব, গুলাব যাদব। গরমের আঁচ এখনও তেমন প্রখর হয়নি তাঁদের এলাকায়। ছোটবেলায় নানীর মুখে শোনা কথা মনে পড়ে গুলাবের – হোলি পর্যন্ত সাবধানে থাকতে হবে। ঠাণ্ডার আমেজ এখনও বেশ রয়ে যায়। বিস্তর ছেড়ে ওঠার সময় বিলকুল মালুম হয় গুলাবের। পাশেই শুয়ে আছে অভিষেক, গুলাবের এক লৌতা বেটা। নিজে উঠতে উঠতেই বেটা অভিষেকের গায়ে আলতো করে টোকা মারে। তারপর চাপা গলায় ডাকে - উঠ যা বেটা। সেহরি কা ওয়াক্ত নিকল জায়গা। সবকো জাগানা হ্যায় বেটা।
কথাগুলো শোনার পর বিছানা লেপ্টে আর পড়ে থাকেনা অভিষেক – পিতাজী সিনিয়র বচ্চন সাহেবের বড়ো ভক্ত। তাই ছেলে জন্মানোর খবর পেয়েই বচ্চন সাহেবের বেটার নামে ছেলের নাম রেখেছিল গুলাব। বাপ বেটা দুজনেই উঠে বেড়িয়ে পড়ার তোরজোড় শুরু করে।
রমজান মাস এগিয়ে আসছে তা টের পেয়েই ব্যস্ততা বেড়ে যায় গুলাবের। কোন্ মায়াবী মন্ত্রবলে সে নিজের কিশোর বয়সে ফিরে যায় এক লহমায়। ১৯৭৫ সাল। আজ থেকে ঠিক পঞ্চাশ বছর আগের কথা। তখনও গুলাব এই পৃথিবীর আলো দেখেনি। গুলাবের পিতাজী চিরকিট যাদব শুরু করেছিলেন এমন আশ্চর্য উদযাপন। ইসলাম দিনপঞ্জি অনুসারে নবম চান্দ্রমাস হলো রমাদান বা রমজান। গুলাব জানে, এই মাসটি মহল্লার মুসলিম পরিবারের মানুষজনের কাছে অত্যন্ত পবিত্র। তাই রমজান মাস পড়ার আগেই গুলাব গিয়েছিল গ্রামের মসজিদের ইমাম চাচার কাছে। ইমাম চাচা বড়ো স্নেহ করেন গুলাবকে। বরিষ্ঠ মানুষ। তিনিই গুলাবের হাতে তুলে দিয়েছেন রমজান মাসের সেহরির সম্ভাব্য সময়সূচি। এই অনুসারেই আগামী একটা মাস জুড়ে চলবে গুলাবের নিশি অভিযান।
গুলাব জানে , সেহরির সময়টুকু হলো সমস্ত মুসলিম পরিবারের মানুষজনের কাছে এক প্রয়োজনীয় বিরতির সময়। সারাদিন ধরে উপবাস রেখে সেই বিকেলে আহার গ্রহণ করবেন সফিক, ইমতিয়াজ, মাহমুদ, আসগর, ইরফান ভাইয়েরা। এই উপবাস ভাঙার সময়টাকে বলা হয় ইফতার। গোটা রমজান মাস জুড়েই চলে এমন ইফতারের পর্ব। সে নিজেও হাজির থেকেছে ঘরোয়া ইফতারের আসরে। সেহরির সময়টুকু পার হলেই সব মুসলিম ভাইয়েরা দিনের প্রথম নামাজ ফজরে অংশ নিতে গ্রামের ছোট্ট মসজিদে যাবে। ভোরের আজান শুনতে ভারি ভালো লাগে গুলাবের। ছেলে অভিষেককে পাশে নিয়ে বড়ে তলাবের পৈঠায় বসে দূর থেকে ফজরের আজান শোনা তাঁর রমজান মাসের রুটিনের মধ্যেই পড়ে।
বিছানা ছেড়ে উঠে গুলাব হাত পা মুখ জল দিয়ে ভালো করে ধুয়ে নেয়। শত হলেও একটা পবিত্র মন আর উদ্দেশ্য নিয়ে ঘর ছাড়তে হয় এই জাগানিয়া কাজের জন্য। ঘরের দেয়ালের ঝুলিয়ে রাখা ঢোল আর কাঠি দুটো তুলে নেয় হাতে। আগে ঢোলে কাঠি দিয়ে খালি গলায় হাঁক দিত – সেহরি কা ওয়াক্ত হো চুকা হ্যায় ,সেহরি কর লিজিয়ে। যতক্ষণে বাড়ির ভিতর থেকে কেউ সাড়া না দিত , ততক্ষণ ধরে নাগাড়ে ঘোষণা করে যেত গুলাব। মাঝে মাঝে চলতো ঢোল শোহরত। ৪৫ বছর
বয়সি গুলাব যাদব আর ১২ বছরের অভিষেক উত্তরপ্রদেশের আজমগড় জেলার কৌরিয়া গ্রামের মেঠোপথে ঘুরে ঘুরে গ্রামের মুসলিম পরিবারের রোজাদারদের সেহরির জন্য জাগিয়ে তোলে আপন আনন্দ আর ভালোবাসা আর গভীর বিশ্বাসের টানে।
এ যেন এক অন্য ভারতের গল্প। এক ঘনায়মান অন্ধকারের মধ্যে সন্দীপন দীপশিখার মতো এক শাশ্বত মূল্যবোধ , ভাবনা আর গভীর উপলব্ধির গল্প। কোন্ এককালে, এক ছোট্ট মুদিখানার ভেতরে বসে এক প্রবীণ মানুষ নিষ্ঠাভরে রামায়ণ পড়ছিলেন। বহু বছর পরে সেই দোকানের ভেতরে একই দৃশ্যপটের অবতারণা। খালি সময়ের সাথে সাথে একান্ত চরিত্রগুলো বদলে যায়, কিন্তু জীবনাচরণের সহজিয়া পথের কোনো বদল হয়না। সেই ট্রাডিশন সমানে চলেছে, চলছে এবং হয়তো চলবে আগামী দিনেও । আজ থেকে ঠিক ৫০ বছর আগে গুলাবের পিতাজী ঈশ্বর চিরকিট যাদব ঢোল কাঁধে নিশুতি রাতে পথে নেমেছিলেন তাঁর ভিন্ ধর্মী প্রতিবেশী সুজনদের সেহরির সময় জানান দেবার জন্য। চিরকিটের পর এই দায়িত্ব সামলেছেন গুলাবের ‘ বড়ে ভাইয়া’। চোখের সমস্যার কারণে তাঁকে স্বেচ্ছাবসর নিতে হয়। এরপর বাপ দাদার আরব্ধ কাজ স্বেচ্ছায় মাথায় তুলে নেয় গুলাব। স্রেফ বিশ্বাস আর ভালোবাসার টানে। গুলাব নিজেও বিশ্বাস করে আগামীদিনে তার ছেলে অভিষেকও কাঁধে ঢোল নিয়ে নিশুতি রাতে গ্রামের মেঠোপথে ঘুরে ঘুরে হাঁক দিয়ে ঢোলে ঘা দিয়ে সেহরির জন্য মানুষদের জাগিয়ে তুলবে – জাগো,জাগো সেহরি কি ওয়াক্ত হো চুকা হ্যায়। উঠো উঠো ,সেহরি কি……। রমজান মাসে যে যাদব বাড়ির মানুষদের ঘুমোতে নেই , ঘুম ওদের কাছে যে বিলাসিতা।
পেশায় সামান্য একজন দৈনিক মজুরির শ্রমিক। এই সাধারণ কাজের জন্যও বছরের বেশিরভাগ সময় তাকে কাটাতে হয় দিল্লিতে। কিন্তু রমজান মাসের আগেই ওদিকে ছুটি করে গুলাব সোজা চলে আসে আজমগড়ে দেশের বাড়িতে কেবলমাত্র ঢোল শোহরতের টানে কেননা এই কাজের সঙ্গে
জড়িয়ে আছে গুলাব যাদবের এক গভীর ভালোবাসা আর বিশ্বাসের পুঁজি , পারিবারিক পরম্পরা আর ঐতিহ্যের অমলিন সম্পর্ক। সমস্ত কিছুর থেকে গুলাবের কাছে এসবের গুরুত্ব অনেক অনেক বেশি। কিশোর বয়সে গুলাব যখন তার বাবার সঙ্গে রোজাদারদের সেহরির সময় জানান দেবার জন্য বার হতো সে তখন এমন কাজের গভীর অন্তর্লীন তাৎপর্যকে ঠিকঠাক বুঝতে পারেনি; কিন্তু আজ নিজের কাঁধে ঢোল নিয়ে যখন সে বাইরে যায় তখন তার কাছে সবকিছু বিলকুল পরিস্কার। গুলাব বুঝতে পারে আজকের এই টালমাটাল সময়ে তার মতো একজন সামান্য দিনমজুর মানুষের এই কাজটুকুই কতটা জরুরি।
গুলাবের এই কাজকে কোন নজরে দেখে তার প্রতিবেশী ভিন্ ধর্মী মানুষজন? সফিকের কথায় – “এর থেকে ভালো বন্ধুকৃত্য আর কীইবা হতে পারে? অমন রাতের বেলা ঢোল কাঁধে একটা মানুষ নিজের বিশ্রামের সময়কে জলাঞ্জলি দিয়ে সেহরির সময়টুকুর কথা সবাইকে জানিয়ে ফিরছে এ এক মহান কাজ। আল্লাহই গুলাব ভাইয়ের ওপর এই দায়িত্ব সঁপে দিয়েছেন। কেবল ঢোলে ঘা দিয়ে ফেরাতেই তার কাজ শেষ হয়ে যায়না। আমরা সবাই ঠিকঠাক উঠে সেহরির পর্ব মেটাতে পেরেছি কিনা তা ঘুরে ঘুরে জানার পর গুলাব ভাইয়ের ছুটি। এর থেকে পবিত্র ও মহান কাজ আর হয়না। আমরা সবাই গুলাব ভাইয়ের এই কাজের জন্য তার কাছে গভীরভাবে কৃতজ্ঞ। আমরা সবাই তাকে আমাদের পরম মিত্র বলেই শ্রদ্ধা করি।”
গুলাবের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা সফিককে আবেগঘন করে তোলে। আপ্লুত কন্ঠে সে বলে – “যখন গীতা এবং কোরান,দুইই ভালোবাসা, প্যায়ার মহব্বতের কথা বলে তখন হিন্দু আর মুসলিম পরস্পর পরস্পরের প্রতি বিদ্বেষের মনোভাব পোষণ করবে কেন? মানুষকে মানুষ হিসেবে না দেখা যে মনুষ্যত্বের সবথেকে বড়ো অবমাননা।”
সফিক মনে করে – রমজানের রোজা পালন যেমন ইসলাম ধর্মের মানুষদের কাছে এক পবিত্র সংস্কার, পালনীয় ব্রত, ঠিক একই ভাবে গুলাব ভাইয়ের এই কাজ ভারতবর্ষের বহমান সাংস্কৃতিক যাপনের এক উজ্জ্বলতম নিদর্শন। গুলাব শুধু নিজের ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নয় ,সে সকলকে সহানুভূতি ও সমানুভূতির শিক্ষা দিয়ে যায় নিজের এক আশ্চর্য কাজের মধ্য দিয়ে। পরার্থে উৎসর্গীকৃত এই কাজ গুলাবকে অনন্য করে তুলেছে। আমরা এই কৌরিয়া গ্রামের প্রতিটি মানুষ গুলাবের জন্য গর্বিত। তার কাজে মনুষত্বের জয় , ইনসানিয়াতের জয় হয়েছে।”
আজ রাতেও গুলাব আর অভিষেক পথে নামে। অভিষেক তার পিতাজীকে বলে - ‘আজ মুঝে ঢোল দিজিয়ে, আজ ম্যায় সবকো সেহরিকে লিয়ে জাগাউঙ্গা”। গুলাব আপত্তি করেনা। মুচকি হেসে সে বলে - “ঠিক হ্যায় বেটা! ইসমে কুছ তকলিফ তো নহী। ম্যায় আজ বহুত খুশ হুয়া কিউ কী তুম্হে হিম্মত হ্যায় ঈসি পরম্পরাকো জিন্দা রাখনেকা। সাবাস বেটা,সাবাস।”
নিঝুম রাত। শুনসান রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলে দুই মুসাফির। আজ নবীন হাতের নয়া বোলে সচকিত হয়ে ওঠে কৌরিয়া গ্রামের মুসলিম পরিবারের মানুষেরা – সফিক , সাজাহান, তসলিমা, নাসরিনরা । তাঁরা বোঝে সেহরির সময় হলো। এবার উঠতে হবে। একটু পরেই ফজরের নামাজ আদায় করতে মসজিদে যাবে তাঁরা। মহল্লার ঘরে ঘরে শুরু হয় এক নতুন ব্যস্ততা। গুলাব আর অভিষেক এবার একটু শুতে যাবে।
“তোমার হৃদ্ বাগিচায় এমন সখ্যতাকে প্রতিপালন করো যাতে
ধর্ম কখনও তোমাদের মাঝে বেড়া হয়ে উঠতে না পারে।
তুমি যদি আগ্রহ নিয়ে তাঁদের মন্দিরে নিয়ে যেতে পারো, তাহলে তাঁরাও তোমাকে মসজিদে নিয়ে যাবে।”
** কৃতজ্ঞতা স্বীকার
Rediff.com এ প্রকাশিত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে লেখা।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।