বর্ধমান শহরে এসে যাত্রার প্রতি আগ্রহ কমল। কারণ, শহরে যাত্রাকে ব্যঙ্গাত্মকভাবে দেখা হয়। এখানে নাটক হচ্ছে সংস্কৃতি, যাত্রা ঠিক অপসংস্কৃতি নয়, তবে উচ্চকিত ব্যাপার। যাত্রা নিয়ে উদাসীনতা শুধু নয়, গোপন ও প্রকাশ্য বিরুদ্ধতা বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের প্রভূত ক্ষতি করেছে। কারও গোপন নির্দেশ ছিল কি না জানি না, যাত্রার অনুমতি দিতে খুব বেগড়বাঁই করতো প্রশাসন। করের ঝামেলা বাড়ল। একটা কারণ হতে পারে, যাত্রার আয়োজকদের বড় অংশ ছিলেন কংগ্রেসের লোক। কিন্তু তাঁরা তো রক্তে রোয়া ধান, পদধ্বনি, মা মাটি মানুষ, হোচিমিন--এর মতো অজস্র প্রগতিশীল যাত্রা মঞ্চস্থ করিয়েছেন। হয়েছে, বামপন্থীদের পরোক্ষ উদ্যোগে, হিটলার, কার্ল মার্কস, লেনিন, মাও সেতুঙ, রক্তাক্ত তেলেঙ্গানা র মতো তরুণ অপেরার অসাধারণ সব যাত্রাপালা। হরেকৃষ্ণ কোঙার বলতেন, আমাদের একটা জনসভায় বক্তব্যের চেয়ে এইসব যাত্রা অনেক কাজের।
উৎপল দত্ত যে সব পালা লিখেছেন, রাইফেল, বৈশাখী মেঘ, অরণ্যের ঘুম ভাঙছে, কুঠার, নীল রক্ত, সাদা পোষাক, তুরুপের তাস-- রাজনৈতিক চেতনা গড়তে বিপুল ভূমিকা নেয়।
সিপিএমের লোকদের হাতে আশির দশকের শুরুতেও তেমন পয়সা ছিল না। তাঁরা খুব বেশি পেশাদার যাত্রার আয়োজন করতে পারতেন না। তবে অপেশাদার বা অ্যামেচার যাত্রায় বামপন্থীরা সচেতনভাবে যোগ দিতেন।
অভিনয় নৈপুণ্য দিয়ে জনমন জয় করে দলের ক্যাডার ও সমর্থক বাড়াতে। ফুটবল দাবা এইসব খেলাও খুব কাজে আসতো। আশির দশকের শেষ দিক থেকে দলে মুখে মারিতং জগৎ ও গ্রুপবাজদের খুব প্রাধান্য বেড়ে গেল।
এরা জনগণের নেতা নয় দলের একটা গোষ্ঠীর জোরে নেতা হতে লাগলেন।
তার বিষফল ফলল।
আগে নেতা হতো নৈপুণ্যের জোরে। জনগণের পছন্দ। এখন হল ইয়েসম্যান তৈরির নেতা প্রকল্প।
সিপিএমকে আশির দশকের মাঝ পর্যন্ত মিল মালিকরাও খুব একটা চাঁদা দিতে চাইতেন না। তাঁদের ধারণা ছিল, এই সরকার ইন্দিরা গান্ধী বেশিদিন চলতে দেবেন না। আমেরিকাও চায় না, ইন্দিরাও চান না। অতএব সরকার ভেঙে দেওয়া হবে। সিপিএমের লোকেরাও অনেকেই তাই ভাবতেন। ইন্দিরা গান্ধীর অকাল মৃত্যু সব হিসেব, জল্পনা বদলে দিল। ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যু মহিলাদের মনে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। আমাদের পিসি, ময়না ফুফু, ভোটের দিন মার পর্যন্ত খেয়েছেন, ভাইয়ের পার্টি কাস্তে হাতুড়িতে ভোট দেন বলে। লুকিয়ে দিতে পারতেন, তা স্বভাবে নেই। যা করবেন, বলেই করবেন। ভাইয়ের মতো। সেই ময়না ফুফু টিভিতে ইন্দিরা গান্ধীর শেষ যাত্রা দেখে কেঁদে ভাসিয়ে দিলেন। এবং ভোটের পর ভাইকে খবর পাঠালেন, এবার ইন্দিরা গান্ধীর পার্টিকেই ভোট দিয়েছি। মেয়েটাকে এমন করে মেরে দিলে গো!
ইন্দিরা গান্ধী জীবিত থাকতে আমার ফুফু কোনওদিন কংগ্রেসকে ভোট দেননি। অমানবিক নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর দিলেন। এটা শুনে আমার আব্বা বললেন, এবার আর রক্ষা নেই। ময়না পর্যন্ত কংগ্রেসের হাত চিহ্নে ছাপ দিলে। তখন ব্যালট পেপারে ভোট হতো। স্ট্যাম্প মারতে হতো পছন্দের প্রার্থীর নামের পর চিহ্নের পাশে। ইভিএম তখন কল্পনাতেও আসেনি। সেবার ৪২টার মধ্যে কংগ্রেস ১৬ টা আসন পেল পশ্চিমবঙ্গে। আর জ্যোতি বসু বললেন, জীবিত ইন্দিরার চেয়ে মৃত ইন্দিরার শক্তি বেশি।
একথাও বললেন, জনগণও মাঝে মাঝে ভুল করেন। আবেগের বশে।
এই শক্তি বৃদ্ধির কারণেই কিনা জানি না, আর ভুল পরামর্শদাতাদের প্ররোচনায় বামফ্রন্ট সরকারের ওপর খড়্গহস্ত হয়ে উঠলেন রাজীব। সেই পরামর্শদাতাদের অধিকাংশই এখন বিজেপির সঙ্গে। সংসদে শাউটিং ব্রিগেড নামে রাজীবের বন্ধু বান্ধবের একটা দল ছিল।
আলুওয়ালিয়া, টাইটলাররা ছিলেন সেই ব্রিগেডের সদস্য। কাছের মানুষ ছিলেন অরুণ নেহরু, আরিফ মহম্মদ খান ( এখন কেরালার রাজ্যপাল। জাতীয় পতাকার পাশাপাশি রাজভবনে সঙ্ঘের পতাকা তুলে বিতর্কিত)।
কলকাতাকে সম্ভবত জওহরলাল নেহেরু বলেছিলেন, মিছিল নগরী। (এখন আর নেই!)। নাতি রাজীব গান্ধী আস্ফালন করে বললেন, মুমূর্ষু নগরী। আরও বললেন, জ্যোতি বসু রিটায়ার করুন। জ্যোতি বসু কম কথা বলতেন, বললেন, আগে ওঁকে রিটায়ার করাই তারপর ভাবব। রিটায়ার করিয়েই ছাড়লেন। তবে এই বাদ প্রতিবাদ ভারতের ইতিহাসের জন্য ভালো হয়নি। সঙ্ঘ পরিবারের পোয়া বারো হলো। শাহবানু মামলা, তার জেরে মুসলিম মৌলবাদীদের সন্তুষ্ট করতে মুসলিম মহিলা বিল, এবং এর প্রতিক্রিয়ায় হিন্দু মৌলবাদীদের সন্তুষ্ট করতে রাম মন্দিরের তালা খোলা, রাজীবের মাচান বাবার আশির্বাদ নিতে যাওয়া-- সব মিলিয়ে দলে ভাঙ্গন ধরলো। সাংবাদিক অরুণ শৌরির তখন দেশজুড়ে খ্যাতি। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকা ঝড় তুলল, বোফর্স কেলেঙ্কারি হয়েছে। অরুণ শৌরি পরে বিজেপির শিল্প বেচা দপ্তরের মন্ত্রী হন। জলের দরে হোটেল বা অন্য শিল্প বেচেন। সঙ্ঘ পরিবারের ইন্ধনে বামপন্থীদের গোপন সমর্থনে রাজীব গান্ধীর সরকারের অর্থমন্ত্রী বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং অর্থমন্ত্রীর পদ ছাড়লেন দুর্নীতির অভিযোগ করে।
১৯৮৭তে কলকাতায় ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে জ্যোতি বসু, ভিপি সিং, বাজপেয়ী মিলে বিশাল সমাবেশ। রাজীবকে উৎখাত করার ডাক দেওয়া হল।
কদিন আগে, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির নেতা মুক্তিযোদ্ধা হায়দার আলী খান রনো ভাইয়ের আত্মজীবনী পড়ছিলাম। শতাব্দী পেরিয়ে।
ঢাকায় যখন যাই, তিনি নিজে উপহার দিয়েছিলেন। পড়া হয়নি। এইবার পড়লাম। অশোক মিত্রের আত্মজীবনী 'আপিলা চাপিলা', অমর্ত্য সেনের 'জগৎকুটির' ফিরে পড়লাম।
হায়দার আকবর খান রনোকে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির বিপ্লবী নেতা রণদিভে একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছিলেন।
রনো ভাই সিপিএমের নেতাদের বলেন, বাংলাদেশের পরিস্থিতি কমিউনিস্টদের জন্য ভালো।
রনদিভে তার জবাবে বলেন, মুশকিল কী জানেন, গোটা পৃথিবী জুড়েই এই অভিজ্ঞতা, পরিস্থিতি যখনই খুব ভালো, তখনই কমিউনিস্টরা মারাত্মক ভুল করে বসেন।
আমার ব্যক্তিগত বিচারে ১৯৭৫-এ সঙ্ঘ পরিবারের সঙ্গে জোট, ১৯৮৭ &তে আবার পরোক্ষ জোট এবং লাগাতার কংগ্রেস বিরোধিতা ও সঙ্ঘ পরিবারের বিপদ সম্পর্কে ভুল ধারণা-- ভারতের বর্তমান অবস্থার জন্য অনেকখানি দায়ী।
মুখে বলা হয়েছে, কংগ্রেস বিজেপি দুটোই সমান বিপদ। কাজে, কংগ্রেস বিরোধিতা মূল।
যাই হোক, আবার ফিরে যাই যাত্রার কথায়। একথা সত্য, কংগ্রেসের নেতারা অনেক অত্যাচার করেছেন সত্তর দশকে। কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে, পশ্চিমবঙ্গ সিপিএমের কোনও বড় নেতা জেলে যাননি জরুরি অবস্থার সময়।
যাত্রা গ্রাম বাংলার ও মফস্বল শহরের বিবেকের কাজ করতো। যে কাজ করতো একসময় গ্রিক নাটকগুলো। করতো সমাজ শোধন ও বিপ্লবী চিন্তা প্রসারের কাজ। নাটকের প্রভাব আছে। তবে তা সীমিত। নির্দিষ্ট দর্শকদের মধ্যে ঘোরাফেরা।
যাত্রার দর্শক প্রকৃত অর্থে আমজনতা।
গ্রামের নিঃস্ব হতদরিদ্র মহিলাকেও যাত্রার আসরে খুঁজে পাওয়া যেত। সেটাই তাঁর বিনোদন ও লোকশিক্ষা আসর।
নাটকে দর্শক আসে। যাত্রা দর্শকের কাছে যেত।
যাত্রা দলের বাসের পিছনে হাজার হাজার লোক ছুটতো। যে পথে বাস যেতো ভিড় জমে যেতো রাস্তার দুপাশে।
যাত্রার নায়ক নায়িকাদের মতো জনপ্রিয়তা জ্যোতি বসু মমতা ছাড়া আর কেউ পাননি পশ্চিমবঙ্গে। তবে রাজনৈতিক নেতারাও এতটা পেয়েছেন কিনা সন্দেহ। আইনজীবী একরামুল বারি যাত্রার বাসের পেছনে ছোটার গল্প করছিলেন সেদিন।
শহরে এসে রথের দিন আলাদা করে কাগজ কেনা রইল। তবে এবার সেটা দেওয়াল লেখার টাইপ নকল করার জন্য।
গ্রামে খবরের কাগজ সকালে নয়, পৌঁছাতো নটা দশটার সময়। এটা বর্ধমানের গ্রাম। বাঁকুড়ার গ্রামে পৌঁছাতে পৌঁছাতে বেলা তিনটা চারটা হয়ে যেত। বলছিলেন কবি ভজন দত্ত। আর বাঁকুড়ার পাত্রসায়রের ছেলে প্রদীপ কেজরিওয়ালও তাই জানাল। প্রদীপ কেজরিওয়াল মাড়োয়ারি পরিবারের সন্তান। তাঁর বাবা বাংলা মাধ্যমে পড়েছেন। যুগান্তর কাগজের গ্রাহক ছিলেন। প্রদীপ কেজরিওয়াল নিজেও বাংলা মাধ্যমে পড়েছে। আমাদের সঙ্গে। এখন বড় ব্যবসায়ী। কিন্তু ছেলেমেয়েকে ইংরেজি মাধ্যমে পড়ায়নি। বাংলা মাধ্যমেই পড়িয়েছে। প্রদীপ কথায় কথায় এত বাংলা প্রবাদ বলে, চমকে যেতে হয়।
গ্রামে সকাল সকাল বাংলা কাগজ ঢোকানোর মূল কৃতিত্ব 'ওভারল্যান্ড' নামে এক চিটফান্ডের। কাগজের সম্পাদক ছিলেন অজিত ভাওয়াল। ওভারল্যান্ড কাগজ প্রথম গ্রাম বাংলার খবরকে গুরুত্ব দেয়। আগে কলকাতার কাগজ মানে সেখানে গ্রাম বাংলার খবর মানে খুন খারাপির কথা।
ওভারল্যান্ড বাধ্য করেছে বাংলা কাগজকে গ্রাম বাংলাকে গুরুত্ব দিতে । বাঁকুড়া পুরুলিয়া বীরভূম জেলায় গ্রামে সকাল সকাল কাগজ পৌঁছানোর কৃতিত্ব 'সংবাদ' পত্রিকার। নয়ের দশকে।
এক টাকা দামের কাগজ। এত জনপ্রিয় হয় যে আনন্দবাজার পত্রিকাকেও দাম কমাতে হয়। বাকিদেরও।