শহর আমাকে দিয়েছে অনেক। নিয়েছেও।
আমার জ্ঞানক্ষুধার তীব্রতাকে ধারণ লালন ও পালন করেছে শহর। রাস্তার কাগজ কুড়িয়ে আর পড়তে হয় না। এ-পাড়ায় ও-পাড়ায় বইঘর। কয়েকজন গুণী মানুষের বাড়ি যাই। বই নিয়ে আসি। তাঁরা নিজেরাও পড়তে বলেন। এক একটা জানালা খুলে যায়।
আমার বন্ধুর বাবা সুধীর রায় নেশা ধরান অসীম রায়ের। সায়নদের বাড়িতে রাতে আছি। বন্ধুদের বাড়িতে রাত কাটানো তখন জলভাত। ভোরে উঠে বুদ্ধদেব গুহ পড়ছি। শ্রেষ্ঠ প্রেমের গল্প। প্রাক্তন প্রেম। বাকিরা ঘুমোচ্ছেন।
উনি জেগে গেছেন।
জিজ্ঞেস করলেন, চা না কফি? বলেই, ও তুমি তো আবার ওসব খাও না, সরবত খাবে?
খেতে পারি। আমি করে নিচ্ছি।
না, আমিই করছি, দেখো কেমন লাগে।
সুধীর রায় তখন সাংসদ। রাজ কলেজের নামী অধ্যাপক।
কী পড়ছো?
বুদ্ধদেব গুহ।
এই বইটা পড়তে পারো।
বলে দিলেন 'দেশদ্রোহী'।
প্রেমের ঘোর কেটে গেল।
দেশদ্রোহী, শব্দের শৃঙ্খল, গোপাল দেব খুঁজে খুঁজে পড়ি।
কালীঘাট ট্রামডিপোর পাশে পার্ক আবিষ্কার করি।
একদিন পেয়ে যাই, কলেজ স্ট্রিট এলাকায় শব্দের শৃঙ্খল।
প্রথম পাতায় লেখা, অরুণ মিত্রকে অসীম রায়।
কোনো বইশিকারী বইটি এনে বেচে দিয়েছেন।
সুধীর রায়ের সঙ্গে আমার আলাপ মাধ্যমিক পরীক্ষা কেন্দ্রে। ১৯৮২ তে। তখন এক অতি অমানবিক প্রথা ছিল। দুরে পরীক্ষাকেন্দ্র। ২৬ কিমি দূরে বাড়ি থেকে। বর্ধমান শহরে। দিনে দুবার পরীক্ষা। তিন তিন ছয় ঘন্টা। আলাদা বিষয়। চূড়ান্ত অবৈজ্ঞানিক। তখন বাসে বর্ধমান যেতে সময় লাগতো দু থেকে আড়াই ঘন্টা। বাস খারাপ হলে তো কথা নেই। পরীক্ষার আগের দিন অভিভাবকদের শহরে আসতে হতো ছেলে মেয়েদের নিয়ে ঘর ভাড়া করে থাকতে হতো রান্না করে খেতে হতো।
বহু খরচ ও ঝক্কি।
আমি ছিল দাদার এক বন্ধুর বাড়িতে এক অসাধারণ মাসিমার কাছে। ওরকম মানুষ কম জন্মায়।
বাকিরা রইল এদিক ওদিক ছিটিয়ে।
প্রথম দিন দাদা টিফিন নিয়ে এলো।
দ্বিতীয় দিন দাদার বাইরে কোনো সভা।
এদিক ওদিক দেখছি।
কিছু কিনে খাওয়া যায় কিনা? বাইরে যাওয়াও নিষেধ।
কী করি!
হঠাৎ দেখি, এক ভদ্রলোক এসে পাশে। মুখ চিনি। ছবি দেখেছি।
একটা ডাব, সন্দেশ আর কী ছিল মনে নেই।
তোমার দাদা আজ আসতে পারবে না। খাও।
সায়নের নাম জানতাম। পার্টিতে তখন সবাই সবাইকে না দেখেও চিনতো। আত্মীয় ভাবা হতো সবাইকে।
পরীক্ষার বাকি কদিন সুধীর রায় টিফিন নিয়ে আসতেন।
উচ্চমাধ্যমিক আসার কেউ নেই।
তখন চৌকস হয়েছি শহরে।
তবু বেরিয়ে দেখা সুব্রত চ্যাটার্জির বাবা রসায়নের রাসভারি অধ্যাপক কম কথার মানুষ মধুসূদন চট্টোপাধ্যায়।
মাসিমার সঙ্গে আমার খাতির। ওঁকে এড়িয়ে চলতাম।
উনি ডাকলেন, এসো তোমার মাসিমা দুজনের খাবার দিয়েছে। প্রতিদিন আমিই আনবো বাইরে যাবে না।
দু কাঁধে দুটো ফ্লাস্ক। তাতে অরেঞ্জ গ্লুকোজের ঠান্ডা সরবত। প্রচণ্ড গরম। তাই। এবং সন্দেশ ও অন্যান্য খাবার।
সায়নদের বাড়িতে মাসিমাকে এড়াতাম। গম্ভীর মানুষ।
বিখ্যাত অধ্যাপক নেতা কালী ব্যানার্জির বোন। রাশভারি মন।
সুধীরবাবু উল্টো। বাড়ির ছোটোকাকা।
সবকিছু বলতে পারো। তবে শান্ত সংযত। ছোটোকাকাদের মতো ছটফটে নন।
বর্ধমানে অনেকগুলো সারস্বতসমাজ ছিল।
এক, সুকুমার সেনকে ঘিরে।
দুই, রবীন্দ্র ভবনকে কেন্দ্র করে ডা. সুবোধ মুখোপাধ্যায় এবং চিত্রমন্দির কেন্দ্র করে ডা. শৈলেন মুখোপাধ্যায়। দানশীল এই সংস্কৃতিপ্রেমী চিকিৎসক বর্ধমানের বিধান রায় বলে পরিচিত ছিলেন।
তিন. সুকান্ত ভট্টাচার্যের বন্ধু অরুণাচল বসু প্রতিষ্ঠিত নতুন সংস্কৃতি। আমাদের সময় কার্তিক গঙ্গোপাধ্যায় অনিল ভট্টাচার্যদের পরিচালনায় চলতো।
চার, হকার মার্কেটে উৎপলদাদের আড্ডা
পাঁচ, অভিযান সাহিত্য গোষ্ঠী
ছয়, নতুন চিঠি
সাত, বিভিন্ন পত্রিকার নিজস্ব আড্ডা
আট মুক্তবাংলার আড্ডা
নয়, হরিসভা বালিকা বিদ্যালয়ের কাছে বর্ধমান সাহিত্য সভা
দশ, কংগ্রেসের দুই নেতা সুধীর দাঁ ও সুধীর নন্দীর আড্ডা।
এগারো, শ্যামাপ্রসাদ কুণ্ডুর 'ভাবনাচিন্তা' ঘিরে এক কেন্দ্র
বারো, অরবিন্দ সেবাশ্রমে সাহিত্য বাসর
তেরো, চিত্ত ভট্টাচার্যের কথা বলতেই হবে। লোকে বলতো বর্ধমানের সত্যজিৎ রায়।
ষাঁড়খানা গলিতে বাড়ি। যাই।
আর ছিলেন কবি কামাক্ষ্যাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়।
খুব বেশি মেশার সুযোগ হয় নি।
লোকজন খুব সমীহ করতো মানুষটিকে।
চোদ্দ, বাকচর্চা। বর্ধমানের দলহীন মেধাবী চর্চাকেন্দ্র।
পনেরো, নাটকের দল, গানের দল, নাচের দল ঘিরেও আড্ডা।
ষোলো, বন্ধুবৃত্ত কী ছিল না, পিকে অমল দত্ত থেকে কামু কাফকা সার্ত্রে।
একটা আড্ডা একটা জ্ঞানপীঠ
সতেরো, কয়েকটি চায়ের দোকান ছিল বিখ্যাত। মেডিকেল মোড়ের চায়ের দোকান, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে গাছতলায় দুটি ঠেক। একটা চাপ দোকান একটা মাটিতে পাতা বইয়ের দোকান। ধারে কেনা যেতো।
কোর্ট প্রাঙ্গণে রবিবার জমজমাট একগাদা আড্ডা।
বিভিন্ন শহরে পড়তে যাওয়া চাকরি করতে যাওয়া বন্ধুর দলের আড্ডা।
আঠারো, শিল্পী সমর মুখোপাধ্যায়ের চিত্রমন্দিরে আড্ডা
উনিশ, টাউন হলের মাঠে
বিশ, খালুইবিল মাঠে চলচ্চিত্রপ্রেমীদের আড্ডা
একুশ, হাসপাতালে ডাক্তারদের ক্যান্টিনে
বাইশ, হাউস স্টাফ হোস্টেলে
তেইশ, রাজ কলেজ মোড়ে
চব্বিশ, গোলাপবাগ গেটের বাইরে চায়ের দোকানে
পঁচিশ, রাজবাড়ির উল্টোদিকে কমলদার চা দোকানে
আমি সবগুলোতেই ঢুঁ মারি বুঝে না বুঝে।
বাবুরবাগে অমল বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ির বই ও ব্যবহার খুব টানতো।
নতুন সাহিত্য পত্রিকা ভালো আলোচনার ব্যবস্থা করতো শ্যামবাজার গলিতে।
শ্যামাপ্রসাদ কুণ্ডু গৌরকিশোর ঘোষকে নিয়ে আলোচনা সভা বসাতেন।
কত নতুন কথা শিখতাম। আর এর সঙ্গে ছিল পার্টির গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সঙ্ঘ। তবে রায়না থানার মতো তোড়জোড় এখানে নেই। ম্রিয়মান।
বরং আসানসোল দুর্গাপুরে রামশঙ্কর চৌধুরী দেবদত্ত রায় কেষ্ট চট্টোপাধ্যায়রা জোর কদমে সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চায় মগ্ন।
রূপনারায়ণপুরে ১৯৮২র ডিসেম্বরে বসলো সাহিত্য সভা। দুদিনের। সারাজীবন সেই অভিজ্ঞতার সুস্বাদ ভুলবো না।
টিকা টিপ্পনি নেই, নির্ভেজাল আড্ডা। সাহিত্য আলোচনা।
কবিতা গল্প নাটক পাঠ।
ইন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বলা ও গলার ভক্ত হয়ে গেলাম।
পাহাড়ে উঠলাম।
নামকরণ করা হলো।
এখানেই আলাপ হলো বীরেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে।
বিনয়ী দৃঢ় লেখক। আলাপন অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের পিতা।
আলাপ হলো বিশ্বনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখার সঙ্গে।
কবি মন।
রাণীগঞ্জ টিডিবি কলেজের নামী অধ্যাপক।
ছেলে অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্যায়কে চিনতাম বাবাকে চিনলাম।
স্নেহশীল পিতা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে কী ছিল জানা নেই, তবে রবিরঞ্জন চট্টোপাধ্যায় পাঁচুগোপাল রায় মিহির চৌধুরী কামিল্যা সুকুমার সেনের খুব কাছের মানুষ ছিলেন।
আর ব্যক্তি হিসেবে কমলেশ চট্টোপাধ্যায় কালীপদ সিংহ ভাস্কর চট্টোপাধ্যায়দের জ্ঞান ও গরিমার খ্যাতি ছিল।
পণ্ডিত বক্তা হিসেবে অধ্যাপক জ্যোতির্ময় ভট্টাচার্য আলাদা সম্মান পেতেন। দাদাভাই দুজনেই পণ্ডিত। দাদা গম্ভীর। বর্মভেদ হলে দারুণ। গানের ক্যাসেটের বিশাল সংগ্রহ কল্যাণ ভট্টাচার্যের। সলিল ভট্টাচার্য বলতেন কাব্যিক ভাষায়।
গিরীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় ভাষাতত্ত্ববিদ। বড়ো মনের সাহসী মানুষ। আমার খুব কাছের জন।
ডাক্তারদের মধ্যে বহু বিখ্যাত মানুষ।
আলাদা করে লিখতে হবে।
বর্ধমানের শিক্ষক চিকিৎসক ও সংস্কৃতির জগৎ নিয়ে।
আর এই শহরেই বাস করতেন ধ্রুবতারা যোশী।
তাঁর কাছে ঘেঁষার যোগ্যতা ছিল না।
সঙ্গীত বাসরে না বুঝেই হাজির হয়েছি।
সুর বুঝি, স্বর জানি না।