এই তীব্র বিষাদ সময়ে বই পড়ছিলাম। আমেরিকা প্রবাসী পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'ঘটিকাহিনি'।
উত্তর কলকাতার গোয়াবাগান অঞ্চলে সঙ্ঘ পরিবারের একনিষ্ঠ প্রচারকের বাড়িতে বেড়ে ওঠা এক শিশু কিশোর তরুণের কাহিনি।
কী আশ্চর্য দক্ষতায় মনে রেখেছেন প্রায় সবকিছু।
পূর্ব বঙ্গ থেকে আগত উদ্বাস্তু জীবনের যন্ত্রণার কথাও আছে। আছে যাদবপুর গান্ধি কলোনি এবং খড়্গপুরের ঘটনাও।
মুরগির দরমা থেকে মুরগির আশ্রয় থেকে ডিম বের করে আনার ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিষয়ও তাঁর মনে আছে।
এই ডিমগুলো গরম ঠেকতো।
কোনও প্রাণীই তো মানুষের জন্য কিছু তৈরি করে না।
মানুষ গায়ের জোরে কেড়ে নেয়।
গোরু মোষ ছাগল ভেড়ার দুধ লুঠ করে নেয়। ক্ষমতার জোরে। সামান্য খাবার দিয়ে। প্রাণীরা তাঁদের সন্তানের জন্য এসব রাখতে চান।
আমি তো দেখেছি, বাছুরকে বেঁধে রেখে পিতলের বালতিতে দুধ দুয়ে নিতে।
এই দুধ হতো গরম ফেনাময়।
মুরগি হাঁস তেমন ডিম পেড়ে তা দিত, যাতে বাচ্চা জন্মায়।
আমরা খাই।
শাকসবজিও তাই।
তাঁদেরও সন্তান আছে। অক্সিজেন দেয়। আমরা কেটে খাই অক্সিজেন ভাণ্ডার।
আমিষভোজী নিরামিষভোজী--সবাই নিজের নিজের মতো ক্ষমতা দেখাই।
আর মুখে বলি, চিকেন ভালোবাসি।
মানে চিকেন মেরে চিকেনের মাংস ভালোবাসি।
তেমনি শাক সব্জি খানেওয়ালারাও তাই।
শাক সবজির চোদ্দো গুষ্টি উদ্ধার করেন পাতে।
পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখায় পড়ছিলাম বিয়েতে ভিয়েন বসানোর কথা। বালিতে ছোট দাদুর বিপুল আয়োজনবা ওড়িশার বালাসোরের বিয়ে বাড়িতে।
পুকুরের পর পুকুর উজাড় করে মাছ আসছে। অন্ধ্রপ্রদেশের চালানি বরফ দেওয়া মাছ নয়, নিজেদের বা পড়শির পুকুরের জ্যান্ত মাছ। রুই বা কাতলা।
কাতলাই বেশি পছন্দ।
এসব তো আমরাও দেখেছি শৈশবে কৈশোরে।
পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায় বালাসোরে খান পঞ্চাশেক ভাজা মাছ খেয়েছেন।
অনেকেই খেতে পারতেন।
আমরাও তো পুকুরে মাছ ধরা হলে এই সেদিনও পেতে ভর্তি মাছ ভাজা নিয়ে বসেছি ভায়েরা।
বিয়ে বাড়িতে তিন থালা হাড় কুমড়ো মাংস খাওয়া আমার কাছে ছিল জলভাত।
কেজি দেড়েক কষা মাংস খেয়েছি বকরিদের দিন কিছু দিন আগেও।
এখন নানা বিধি নিষেধ।
পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা পড়তে পড়তে মনে পড়ল, আমরাও তো মাস্টারমশাইদের নানা মজার নাম পেতাম উত্তরাধিকার সূত্রে। গ্রামের জুনিয়র হাইস্কুলের হেডমাস্টারের কোড নাম ছিল দাঁড়কাক। বোধহয় প্রচুর লম্বা আর বর্ণের কারণে।
সেহারা স্কুলের হেডমাস্টার মশাইয়ের নাম -- কোলা ব্যাঙ। বিশাল ভারি থপথপে চেহারার জন্য।
কিন্তু এটা ভালোবাসার নাম ছিল। ব্যঙ্গের নয়।
আগের রবিবার ২০ এপ্রিল১৯৮২ মাধ্যমিক ব্যাচের পুনর্মিলন ছিল।
আমাদের বন্ধু সুজিত তা ভালোবেসে সবাইকে একটা করে বাংলা ক্যালেন্ডার ডায়েরি ও প্রধান শিক্ষক নিরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবি দিল।
স্যারের ছবি দেখে সবার কী আনন্দ।
নি:সন্তান এই মানুষের সন্তান ছিল ছাত্রছাত্রীরা।
এলাকার সবাই শ্রদ্ধায় নত।
ছাত্র ছাত্রীদের দল তো বটেই অভিভাবকরাও স্যারকে দেখলে সাইকেল থেকে নেমে পড়তেন।
বর্ধমান মিউনিসিপ্যাল স্কুলের প্রধান শিক্ষক অমলেন্দু চক্রবর্তী অসাধারণ বাংলা পড়াতেন।
আমরা বিজ্ঞান বিভাগে পড়তাম। তাঁর পড়ানোর আকর্ষণে ছুটির ঘণ্টা অগ্রাহ্য করতাম। সংস্কৃত বাংলা ইংরেজি তিন সাহিত্যে অনায়াস যাতায়াত।
৪৫ মিনিটের ক্লাস প্রায়ই দেড় থেকে দু ঘণ্টা হয়ে যেত। শেষ ক্লাস ছিল তাঁর।
আমাদের বাস ফেল হয়ে যেত। ভুলে যেতাম।
অসাধারণ এই শিক্ষক যদি প্রধান শিক্ষক হিসেবে একটু কড়া হতেন আমাদের ও বিদ্যালয়ের অনেক উপকার হতো।
অবশ্য সহপাঠী সদানন্দের ভিন্ন মত।
ওঁর মত, সিপিএম এবং কংগ্রেস ( আর এস এস) দু পক্ষের শিক্ষক দল খুব শক্তিশালী।
দুপক্ষকে সামলে স্কুল চালানোই অনেক।
আমার কেমন যেন ধারণা ছিল, একদিন প্রতিদিন, খারিজ --এইসব চলচ্চিত্রের গল্পকার অমলেন্দু চক্রবর্তী আমাদের প্রধান শিক্ষক।
স্যারের বাড়িতে বহুবার গিয়েছি। মুড়ি বাদাম খেয়েছি। অকালে প্রয়াণ ঘটে এই সুদর্শন শিক্ষকের।
সহকারী প্রধান শিক্ষক রাজেন নাগ যেমন দেখতে তেমনি রাশভারি। অসম্ভব বিদ্বান মানুষ। ইংরেজির জাহাজ।
ইংরেজি অঙ্ক দুটোতেই পারঙ্গম। গল্প ছিল, অনিল বন্দ্যোপাধ্যায় এবং মৃত্যুঞ্জয় খানের মত দুই পণ্ডিত গণিত শিক্ষকের অঙ্ক আটকে গেলে রাজেন নাগ সহায়।
তিনি সিগারেট বের করে একটু ঠুকে হাতের মাঝখানে সিগারেট ধরে খেতেন।
তাঁর মুখ ছিল টকটকে ফর্সা। লাল। লোকে বলতো, লালদাদু।
স্যার একটু পান করতেন।
আমি, সুব্রত ( এখন সেচ দপ্তরের চিফ ইঞ্জিনিয়ার), ইন্দিরা ব্যানার্জি, সুরঙ্গমা, পালিত-- জনা সাতেক তাঁর কাছে টিউশনি পড়তাম।
তিনি আমাদের লিখে দেখাতে বলতেন। দেখালে তিনি সেটি কেটে বলতেন, দেখো তো আমি কেমন করে লিখি।
আমি তো মহা ফাঁকিবাজ। রাজনীতি, বিজ্ঞান ক্লাব, বিতর্ক, তাৎক্ষণিক, কুইজ, নাটক করে বেড়াচ্ছি।
একবার সপ্তাহ খানেক যাইনি।
গিয়েছি, সুব্রত বলল, তুই এই লেখাটা স্যারকে দেখা।
স্যার কী বলেন দেখি।
আমি দিলাম।
সুব্রতদের ধারণা ছিল, আমার লেখা কাটবেন না বা আরও কিছু।
আমি দেখলাম নির্ভুল লেখা।
দেখানোর কী আছে।
সুব্রত ইন্দিরা সুরঙ্গমা পালিত দেবব্রত সবাই বেশ ভালো পড়াশোনায়।
সুরঙ্গমা সুব্রত জয়েন্ট পায় প্রথমবার পরীক্ষা দিয়েই।
সুরঙ্গমা ডাক্তার সুব্রত ইঞ্জিনিয়ার হয়েছে।
তো, স্যার এসে বসতেই আমি দিলাম লেখাটা।
স্যার, একটু তাকালেন, তারপর বললেন, যথারীতি, ভালোই হয়েছে,দেখো তো আমি কেমন করে লিখি।
সবাই হো হো করে হেসে উঠল।
স্যার বললেন, হাসছো কেন?
সুব্রত কম কথার ছেলে, সে বলল, আপনি এই নিজের লেখা সাতবার কাটলেন।
আপনার লেখাই আপনাকে বিভিন্ন জন দেখিয়েছি।
আপনি প্রতি বার বলেছেন, ভালোই হয়েছে, দেখো তো আমি কেমন করে লিখি।
আপনার প্রিয়পাত্র ইমানুল বাকি ছিল, তার বেলায় কী করেন, দেখার জন্য।
আমাদের স্যাররা ছিলেন এই রকম। নিজেদের লেখাই নিজেরা কাটতেন। রাজেন নাগ অসাধারণ বললে কম বলা হয়, একটা বাক্যে চার থেকে পাঁচটির বেশি শব্দ থাকতো না।