কল্যাণীতে মামুনুর রশীদের লেখা ও পরিচালনায় 'রাঢ়াং' দেখতে এসে প্রিয় ভাই বন্ধু অধ্যাপক প্রবীর প্রামাণিকের বাড়িতে থাকলাম। 'রাঢ়াং'-এ এখন বহুখ্যাত চঞ্চল চৌধুরী ও আখম হাসান অভিনয় করছেন। চমৎকার মানুষ এঁরা। চলচ্চিত্রের বিখ্যাত অভিনেতা টানা চারদিন নাটক অভিনয় করবেন। এঁর মধ্যে দুদিন দুবেলা। আদি বাসিন্দাদের জীবন সংগ্রাম নিয়ে লেখা নাটক--রাঢ়াং। কল্যাণীতে আমার বেশ কিছু প্রিয়জন থাকেন । এলেই মনে হয় থেকে যাই থেকে যাই। তবে আগে একবার ছাড়া নাটক দেখে রাতেই ফিরেছি। এবার হলো না।
কল্যাণীতে রাতে থাকতেই হলো। ভেবেছিলাম আসবো না। মামুন ভাইয়ের ফোন পেয়ে আসতেই হলো। এসে একটা খুব বড় লাভ হয়েছে। সুদীপ্তার চমৎকার রান্না খাওয়া ছাড়াও মিলল ভোরের আলোর অভিজ্ঞতা।
কলকাতায় তো সবসময় ঘরে আলো জ্বালিয়ে রাখতে হয়। বিরক্তিকর ব্যাপার। কল্যাণীতে ঝিলের ধারে বাড়ি। ভোর পাঁচটায় ঘুম ভেঙ্গে গেল। অভ্যাসে এবং পাখির কলকাকলিতে। তার চেয়ে বেশি উজ্জ্বল আলোর ঝলমলে ডাকে।
প্রয়াত অর্থনীতিবিদ অশোক মিত্র শেষ বয়সে বলতেন, আজকাল পড়তে পারি না। ভোরের আলোয় বারান্দায় এসে বসলে জানলার ধারে বসলে পড়তে পারি নিজে।
আজ কথাটার তাৎপর্য বুঝলাম।
কতকাল ভোরের আলোয় পড়ি না।
জীবনটা টিউব লাইট হয়ে যাচ্ছে।
ভোঁদাটে, কৃত্রিম আলো থেকে কবে মুক্তি পাবে নাগরিক মানুষ?
সৈকত, সায়নকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছিল, ওঁদের ওখানে, আমেরিকাতেও কি কৃত্রিম আলোই চোখ ভাসায়?
ভোরের শিশির মেখে স্কুল যাওয়া ছিল দস্তুর।
আজ যত রোমান্টিক মনে হোক, তখন পা শিশিরের ঠান্ডায় জমে যেত। তখন তো অজন্তা হাওয়াই চপ্পল।
আমি একা নয়, গ্রামের প্রায় সবাই তাই পরতেন।
ক্যাম্বিসের তৈরি একটা জুতো বা ফিতে দেওয়া প্ল্যাস্টিকের জুতোও অনেকে পরতেন। আমি কোনোকালেই ওইসব বাঁধনে বিশ্বাসী ছিলাম না।
আমার বাবার জেঠতুতো দাদার ছেলে নন্দ কোট ও চামড়ার জুতো পরতো, নন্দকে দেখলেই আমার হাসি পেতো, কালো সাহেব মনে হতো।
অবশ্য আমার বাবা ছাড়া, তাঁর বংশের সবাই কোট প্যান্টে অভ্যস্ত ছিলেন। কলকাতা বা কানপুরে চাকরি করতেন। কেউ কেউ করতেন গ্রেট ইস্টার্নে। গ্রেট ইস্টার্নের বেকারির কর্মীদের একটা বড় অংশ ছিল আমার ঠাকুরদার গ্রামের মানুষ। পরে ঠাকুরদা তাঁর পিসির অনুরোধে আমাদের বর্তমান বাসভবনে আসেন। ঠাকুরদা প্রথমে কানপুর পরে কলকাতায় চাকরি করতেন। ইংরেজদের চাকরি। একটাই ছবি ছিল তাঁর, কোট প্যান্ট পরিহিত সাহেব। লম্বা চওড়া পাঠান চেহারা। ফর্সা। আমার বাবা কিন্তু শ্যামবর্ণ। তামাটে চেহারা। বাবা ছোটবেলায় মাতৃহারা ও পিতৃহারা। ঠাকুরদার পিসিমা ও বাবার সৎমা বাবাকে মানুষ করেছেন স্নেহে ভালোবাসায়।
বাবার ঠাকুমা ছিলেন দাপুটে মহিলা। তাঁকে দেখিনি। রাতদিন তাঁর গল্প শুনেছি, আমার ঠাকুমা ও মা দিদিদের মুখে।
থাকতো নবিসন, দেখতে মজা।
আমি কল্পনায় নবিসনকে দেখতাম, এখনও দেখি, টিকালো নাক, পাঁচ ফুট আট ইঞ্চি লম্বা।
আমার বড়দিও এমন লম্বা ছিলেন। বোনেরাও প্রায় সবাই পাঁচ ফুট ছয় বা সাত ইঞ্চি।
নবিসন বিবি রুপোর গড়গড়ায় তামাক খেতে খেতে বিচার করতেন পুরুষদের মতোই। চল্লিশ পঞ্চাশ ষাটের দশকে।
কী কথায় কী চলে এল। হচ্ছিল আলোর কথা। আমাদের তো মাটির দোতলা বাড়ি। সামনে বিরাট উঠোন। ভোর থেকেই আলোর লুটোপুটি।
এগারো ক্লাসে থাকতে শুরু করেছি, শহরে, বদভ্যাস ধরেছে। সকাল ছয়টায় উঠি।
দেখি, একদিন আব্বা মাকে বলছেন, তোমার লাটসাহেব ছেলেকে উঠতে বলো। ছটা বাজে। ঘুমোচ্ছে। গাঁয়ে মানসম্মান বলে কিছু থাকবে না।
এখন তো গাঁয়েও দেখি ছেলেরা বেলা আটটা সাড়ে আটটার সময় উঠছে।
আমার সঙ্গে বাবার সম্পর্ক ছিল মন্দমধুর। কথায় কথায় তর্ক এবং ঝগড়া।
তখন 'তারাস বুলবা' পড়েছি। সে পড়ে অনুপ্রাণিত হয়ে এক কাণ্ড।
কথায় কথায় ঝগড়া। কিন্তু আমারও বাবাকে ছাড়া চলে না। বাবারও আমাকে ছাড়া। আমাদের এলাকায় অঘ্রাণের নবান্নের দিন থেকে নানা জায়গায় মেলা আর যাত্রা শুরু হতো।
বামফ্রন্ট ক্ষমতায় আসার পর একটা নতুন জিনিস শুরু হল। গ্রামে গ্রামে কবিতা ও গল্প পাঠের আসর। সঙ্গে গান।
কখনও কারও বাড়িতে, কখনও মঞ্চ বেঁধে এ-সব চলতো।
আজকের দিনে বিশ্বাস হবে না, মানুষের।
নবম শ্রেণিতে পড়ি। ১৯৮০ সাধারণ অব্দ। সাহাজাপুর গ্রামে মঞ্চ বেঁধে কবিতা পাঠ ও গানের আসর।
এরপর বোধহয় বাবাদের নাটকের দল এলএমজি বা লাইটম্যান গ্রুপের নাটক ছিল। কাকদ্বীপের এক মা। সে নাটক দেখে স্বয়ং স্রষ্টা উৎপল দত্ত প্রশংসা করেছিলেন। সিপিএমের বর্ধমান জেলার পরবর্তীকালের বহু দাপুটে নেতা ওই নাটকে অভিনয় করতেন।
বাবাকে পার্টির লোকরা সবাই 'কাকু' বলতেন, আর পার্টির বাইরের লোকেরা এনামভাই, বা মাস্টারমশাই।
তো, আমি সাহাজাপুরে কবিতা পড়তে গেলাম।
সাহাজাপুর ১৯৩৬ থেকেই কমিউনিস্টদের ঘাঁটি। কৃষক আন্দোলনের শক্ত জমি। বিনয় চৌধুরীও এখানে কাজ করেছেন কৃষকদের নিয়ে।
শহিদ হয়েছেন গ্রামের মানুষ। শহিদদের স্মরণেই কবিতা গান ও নাটকের আয়োজন।
আমি একটা কবিতা ও একটা ছড়া পড়েছিলাম।
ছড়াটি যতদূর মনে পড়ছে, জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি নিয়ে ছিল।
বাবা তখন 'খণ্ডঘোষ সমাচার' বলে পত্রিকায় নিয়মিত ছড়া লিখতেন, অনুভব কারিগর বা কাকু ছদ্মনামে।
এর পরের সাহিত্য বাসর হলো ছোটবৈনান গ্রামে মহান্তি বাড়িতে। সে-বাড়ির ছেলে অশোক মহান্তি বিসিএস অফিসার। যুবকল্যাণ দপ্তর আয়োজিত রাজ্য স্তরের ছোটগল্প লিখে প্রথম হয়েছেন। বিরাট ব্যাপার। সবাই গর্বে উদ্বেলিত। তখন তো এত ঈর্ষার ব্যাপার ছিল না। ঘটনাটা এমন দাঁড়াল, রায়না থানার সবাই যেন সেই পুরস্কার পেয়েছেন।
অশোক মহান্তির বাবা ছিলেন অত্যন্ত সজ্জন ও ভদ্র মানুষ।
তাঁর বড় মেয়ে আমাদের এক তখন প্রিয় দাদাকে বিয়ে করেছেন। তাঁদের প্রেম কথা মুখে মুখে ঘোরে।
পুলিশের ভয়ে পালিয়ে বেড়ানো সেই দাদাকে নাকি লুকিয়ে লুকিয়ে মাঝ মাঠে ১০ পয়সা ২০ পয়সা দিয়ে আসতেন আর কিছু মুড়ি ছোলা।
যাই হোক, অশোক মহান্তি না আসতে পারলেও তাঁর গল্প নিয়ে নানাজন আলোচনা করলেন। এগারো ক্লাসে পড়লেও প্রায়ই বর্ধমানের কাগজে পত্রিকায় লেখা ছাপার কারণে আমার একটু আলাদা জায়গা হয়েছে। বিশেষ করে কৃষক নেতা শক্তিমান ঘোষ তখন গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সংঘের দায়িত্ব নিয়ে বেশ একটা সাড়া ফেলেছেন, তিনি আমাকে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় থেকেই 'ছোট সুকান্ত' বলে ডাকতে শুরু করেছেন। আমিও সেটা একটু আধটু উপভোগ করছি। ভারিক্কি চাল হয়েছে। শহুরে লব্জ শিখলেও বলি না বলে বাড়তি সম্মান।
দুদিন ধরে চলল সাহিত্য আড্ডা। চমৎকার খাওয়া গান কবিতা আর গল্পগাছার আসর।
আমাদের এক সিনিয়র তখন ওখানকার ছোট মেয়ের সঙ্গে প্রেম করে। সে-ও এসে ঘুরে গেল।
বড় আনন্দে কাটল।
এবং অশোক মহান্তির গল্প পুরস্কার পাওয়ার পর কবিতার পাশাপাশি গল্প লেখার ধুম পড়ল।
এবং গল্প সংগ্রহের।
এখন কত বদলে গেছে সবকিছু ভাবি।
একজনের ছোটগল্প পুরস্কার পাওয়ার পর গ্রামে গল্প লেখার কারিগর তৈরি হচ্ছে! ভাবা যায়।
ওখানে থাকতে থাকতেই খবর এলো, আমাদের পাশের বাড়ির চাকর নেনোকে চন্দ্রবোড়া সাপে কামড়েছে। বর্ধমান হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। হাসপাতাল জবাব দিয়েছে। পিজি নিয়ে যেতে হবে ডায়ালিসিস করতে।
আশি নব্বই এমনকী একুশ শতকেও পিজিতে রোগী ভর্তি করতে পার্টি অফিস থেকে চিঠি নিয়ে রাজ্য দপ্তরে যেতে হতো। সেখান থেকে চিঠি নিয়ে গেলে বা ফোন করে দিলে ভর্তি। সেইভাবেই করলাম।
আরেকজন ছিলেন মন্টুদা নামে। লোকে বলতো, মন্টু খ্যাপা। বড়শুলে শক্তিগড় এলাকায় বাড়ি। বড় ভালো মানুষ। মন্টুদার চিঠি থাকলে পিজির সুপার ফেরাতেন না।