রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'নৌকাডুবি' পড়াচ্ছিলাম অনলাইনে। পড়াতে গেলে সবকিছু আবার নতুন করে বারবার পড়তে হয়।
নোট নিতে হয়। পুরাতন ব্যাখ্যা বদলে যায়।
ওখানে দেখি, অন্নদাবাবু রমেশকে কাগজে কলেরায় মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার কথা বলছেন। নৌকাডুবি-- ১৯০৬ এ প্রকাশিত।
আমার যেটুকু পড়াশোনা ও অনুমান, তাতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা পরিকল্পনা করে যেমন মন্বন্তর ঘটিয়েছে তেমনই ম্যালেরিয়া কলেরার মতো মহামারীও ছড়িয়েছে।
আমাদের গ্রামে মহামারী লাগে ১৯০৭ এ। মহামারী মানে কলেরা।
বর্ধমানের ধানে ফসলে ভরা গ্রামে। আমার নানা তহুর চৌধুরীর বাপ-মা দুজনেই কলেরায় মরে যান। ধনিয়াখালির হাজিপুর গ্রামের এক জমিদার খোকা মিঞার শালির বাড়ি ছিল আমাদের গ্রামে। তাঁর সঙ্গে কলকাতা চলে আসেন নানা। কাজ শেখেন। এক ব্রাহ্মণ মেয়ের সঙ্গে প্রণয় হয় যৌবনে। তাঁকে বিয়ে করেন। নামটা একটু অদ্ভুত। বৈতন ব্যানার্জি। নানার সঙ্গে বিয়ের পর বৈতন বেগম অনেক দিন অপেক্ষা করেও বাচ্চা হলো না দেখে নানাকে বলেন, একটা বিয়ে করো। নানির বাপের বাড়ি ছিল বীরভূমের মাড়গ্রামে। নানির বাবা আবার বিয়ে করায় নানির তেজি মা ১৯১০ নাগাদ মেয়েকে নিয়ে বোনের বাড়ি বর্ধমান চলে আসেন। নানা সুপুরুষ। নানি আকারে খাটো। কিন্তু সুন্দরী। অতি সরল মানুষ। নানার চাকরি চলে গেলে গ্রামে ফেরেন। এই সময় ১৯৩৭ নাগাদ নানির এক ভাই সাব ইন্সপেক্টর হয়ে শ্যামসুন্দরে চাকরি করতে আসেন। তখন নিজের গ্রামের লোকের কাছে শোনেন, তাঁর এক বোনের বিয়ে হয়েছে কাছের গ্রামে।
একে তাকে বলেন নানা তহুর চৌধুরীকে খবর দিতে। শেষে নিজেই চলে আসেন।
শোনেন, গাঁয়ে স্কুল নাই।
বলেন, স্কুল খোলো।
কেমন করে?
আমার নানা ছুটে এলেন, আমার বাপের দাদোর কাছে। হেকিম সাহেব।
দাপুটে মানুষ।
নীলামে সম্পত্তি গেছে। তারপরও ২৫০ বিঘা আছে। কারো আলে পা দেন না।
ছিলেন ব্রিটিশ নিয়মে বিচারক।
তাঁর বিচারের সুনাম ছিল। কী যেন বলতো পদটাকে। তলস্তয় যেমন ছিলেন আর কী!
জনশ্রুতি, একবার দারোগা গ্রামে এসে সেলাম না ঠোকায় পাইক পাঠিয়ে ডেকে এনে সেকালে ১০০ টাকা নজরানা দিয়েছিলেন।
নানা এসে আর্জি পেশ করলেন, স্কুল খুলবো। খানকাখানা দেন।
বড়ো শখ করে এক দহলিজ/ কাছারি/ খানকা/ বৈঠকখানা বানিয়েছিলেন হেকিম সাহেব। সেটা আমিও দেখতে পেয়েছি। খড়ের বদল পাট দিয়ে পাঠ। দেওয়াল শোনা কথা, ডিমের লালা দিয়ে পালিশ করা। বেতের চাল। তারপরে খড়। আর দামি কাঠের হরেক কাছ। প্রতিটা খুঁটি বরগায় কাজ। লোকে দেখতো আসতো, এই শখের কাজ। দরজাও সেকালের মতো কারুকার্যময়। ঝাড়বাতি ঝুলতো। পাঙ্খাটানার ব্যবস্থাও ছিল। দহলিজের দখিন দিকে নিমগাছ। নিমের হাওয়া খাবেন, তাই।
দিল্লিতে শিল্পী বন্ধু মিঠু সেন এক জাদুঘর দেখিয়েছিল, কাঠের হরেক রকমের মজাদার কাজের।
আফশোস হয়েছিল, আমরাও কেন কড়ি বড়গা দরজাগুলো এ-রকম কোনো জাদুঘরে দিই নি। দহলিজ অযত্নে পড়ে যাওয়ায় কাঠ উই খায়
তা নানার কথা শুনে আমাদের বড়ো আব্বা মানে বাবার দাদু বলেন, তোমার তো ছেলে নাই মিঞা। ইস্কুল খুলে কী করবে?
নানা জবাব দেন, মেয়ে বলে কী পড়তে পারে না।
জবাব ভারি পছন্দ হয় হেকিম সাহেবের।
বৈঠকখানা ঘরে আমার বড়ো মাসি, মেজো মাসি, এহিয়া চাচা, কাজী কামরুজ্জামান প্রমুখকে নিয়ে স্কুল বসে। আত্মীয় ইন্সপেক্টরের পরিদর্শনে স্কুল অনুমোদন পেল। তারপর এটা গেল এখন যেটা কয়েতপাড়া/ আদমপুর সেখানে। সেখানে ছিল একটা বড়ো আমগাছ। এরপর হেকিম সাহেব জায়গা দিলেন নিজের জায়গায়। স্কুল হলো ১৯৩৭-এই।
তখন বৃত্তি পরীক্ষা চালু ছিল।
তিন/চার টাকা ফি দিতে হতো। আমার বড়ো মাসি/ এহিয়া চাচা বৃত্তি পাস করলেন। গ্রামের মেয়ে হিসেবে গ্রাম থেকে প্রথম চতুর্থ শ্রেণি পাস হলেন আমার বড়ো মাসি। নানার শিক্ষার প্রতি আগ্রহে পাঁচ মেয়েই চতুর্থ শ্রেণি উত্তীর্ণ হোন। এবং সবার হাতের লেখাই ছিল খুব সুন্দর। আমার মা ডাবল প্রমোশন পান।
গ্রামে থেকে প্রথম এম এ পাসও আমার ছোটো মামা। বড়ো মামা কলকাতায় হেয়ার স্কুলে পড়েছেন ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত। তারপর নানার চাকরি চলে গেলে এলাকায় ফেরেন। পরে আই এ পাস করেন সিটি কলেজ থেকে। পড়তে পড়তেই গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চাকরি। হন প্রধান শিক্ষক। কড়া ধাঁচের শিক্ষক ছিলেন। তাঁর কলমের জোরের কথা খুব শোনা যেতো। আমার বাবা কমিউনিস্ট পার্টির নেতা। মামা জেলা কংগ্রেসের। কিন্তু দুজনে খুব ভালো সম্পর্ক। বাবার দাপট ছিল বেশি। দুজনেই দুজনকে সম্মান করতেন। লোকে বলতো, শালা বোনাইয়ের গাঁ।
বড়ো মামা আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রচুর বিদেশি চকলেট আনতেন। বস্তা ভর্তি। ভেঙে ভেঙে দেওয়া হতো। নেদারল্যান্ডের একটা চকলেট বস্তা জুড়ে ছিল। অপূর্ব খেতে। জায়গার অভাবে আমাদের বারান্দাহীন দোতলা মাঠকোটার ওপরে রাখা হতো।
চুরি করা মহাপাপ জেনে খেতে পারি নি। স্কুলে শনিবার প্রচুর ছেলে মেয়ে আসতো। ৩৭০ জন ছাত্র ছাত্রী। সাতজন শিক্ষক। শনিবার মাইলো (একধরনের ভাঙা মিষ্টি আমেরিকান গম!) দেওয়া হতো। প্রথম প্রথম রান্না করে দেওয়া । পরে লোকের অভাব দেখে বাড়িতে।
কতো মানুষের যে জীবন বেঁচেছে ওই মাইলো খেয়ে। আমরা মধ্যবিত্তের পোলাপানরাও পেতাম। খেতে ভারি সুন্দর। এমনিই খাওয়া যেতো। রান্না করে গুড় হলে তো কথাই নাই।
এখন শুনি ডালিয়া--বড়োলোকের খাবার।
আগে ডালিয়ার পূর্বপুরুষ মাইলো ছিল ভুখা পেটের আহার।
প্রসঙ্গত, আমাদের গ্রামের বিদ্যালয়ের প্রথম শিক্ষকের নাম, ছোটোমামা বললেন, ড্যাং সাহেব।
পাশের গ্রাম পলাশন থেকে আসতেন।