মায়েরা মুঠো করে চাল রেখে দিতেন আলাদা জালা/ কলসি বা বড় হাঁড়িতে।
হিন্দু মুসলমান সব বাড়িতেই ছিল এই রীতি।
দীনদুঃখীদের সাহায্য দেওয়া হতো।
পোশাক আসাক। মেয়ের বিয়ে হয়ে গেলেই সাদা শাড়ি। সেটা সাধারণত ৩২-৩৩ বছরেই হতো।
বিধবা হলে একটু আলাদা। হিন্দু হলে সাদা ধুতি। মুসলিম মেয়েরা সবাই সাদা শাড়ি পরতেন না।
হিন্দু বিধবা মাছ মাংস ডিম পেঁয়াজ রসুন খেতে পারবেন না।
মুসলিম মহিলা সব খেতে পাবেন।
আবার বিয়ে করতেও পারবেন।
আমার গ্রামেই এমন বিয়ে দেখেছি।
তবে মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েরা বিয়ে করতেন না।
ভদ্রলোক হয়ে গেছেন যে!
বর্ধমান শহরে একজন কলেজের দিদির বিয়ে হতে দেখেছি, স্বামীর মৃত্যুর পর।
তাঁর স্বামী বিয়ের অল্পদিন পরেই খুন হয়ে গিয়েছিলেন।
বাংলাদেশের মনীষা ব্যক্তিত্ব বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খানের স্ত্রী হেলেনা খান একটা প্রশ্ন করেছিলেন, তোমাদের এখানে এত কুঁজো হয়ে হাঁটা বয়স্ক মহিলা দেখি কেন?
ঢাকায় দেখেন না?
না, তেমন দেখিনি।
কথাটা শোনার পর আমার মনে হয়েছিল, এমনিতেই বেশিরভাগ বাড়িতে মহিলারা খাবারের বিষয়ে বঞ্চনার শিকার। তার ওপর বিধবাদের খাওয়া দাওয়ার উপর প্রচুর বিধিনিষেধ। মাছ ডিম মাংস -- আমিষ জাতীয় খাবার খাওয়া নিষেধ। এর একটা কারণ হতে পারে।
আরেকটা ঘটনা মনে পড়ল। ১৯৯৮। গুজরাট যাচ্ছি লোকসভা নির্বাচনের খবর সংগ্রহে। ট্রেনে এক গুজরাটি ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হল। তিনি বাঙালির ইংরেজি শিক্ষার খুব প্রশংসা করলেন। তারপর বললেন, আপনাদের বাঙালিদের ভাবা উচিত কাশী মথুরা বৃন্দাবনে এত বাঙালি বিধবা কেন?
এটা তো একটা জাতির লজ্জা। কীভাবে কষ্ট করে ওঁদের বেঁচে থাকতে হয়, খোঁজ নিয়েছেন কখনও?
আমি নিরুত্তর।
আমার নিজের ধারণা, বাংলায় এত খাদ্য বৈচিত্র্যের পিছনে আছে বিধবাদের অবদান।
রান্নাবান্নার দায়িত্ব তাঁদের কাঁধে। খাদ্যাখাদ্যের কঠিন বাছবিচার।
তাঁরাই নানাবিধ নিরামিষ মুখরোচক খাবারের স্রষ্টা।
আলুর খোসা, লাউয়ের খোসা, কুমড়োর খোসা দিয়েও কীসব চমৎকার রান্না করেছেন।
এবং এর ফলে একটা ক্ষতিকর দিকও আছে। প্রচুর তেলের ব্যবহার।
আমার দাদার এক বন্ধু ছিলেন বাসুদেব পণ্ডিত। প্রধান শিক্ষক হিসেবে অবসর নিয়েছেন। তিনি ১৯৭৯তে নুরপুর ক্যানেলের ধার দিয়ে হেঁটে আসার সময় একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেন, সেটা আজ মনে পড়ছে।
তাঁর কথা, তোদের (মুসলমানদের) রান্না এত ভালো কেন জানিস?
আমি চুপ।
বললেন, তোদের রান্না সেজে রান্না। ভাজাভুজি কম। সব সব্জি একসঙ্গে চাপিয়ে দিয়ে একটু তেলে নেড়ে নিয়েই জল দিয়ে সেদ্ধ। খালি মাংসতেই যা একটু তেলঝাল।
পরে কথাটা খেয়াল করেছি।
আমাদের বাড়িতে মাছ ভাজা খেলে আলাদা বিষয়। না হলে মাছ ইলিশের মতোই না ভেজে রান্না করা হতো। এবং তার স্বাদ ছিল অসাধারণ।
আমি নিজে রান্না করলে মায়ের পদ্ধতিতেই করি। মা সরাসরি মাছ দিতেন। আমি একটু সাঁতলে নিই।
রান্না পদ্ধতির এই তফাৎটুকু বাদ দিলে খাদ্যাভ্যাস পোশাক রীতি সব এক।
আরও দুটো তফাৎ আছে। আমার আবার বেনেপাড়ায় জগন্নাথ দত্তের মায়ের পাঁচফোড়ন দিয়ে ছ্যাঁকছোঁক করে আলু বাঁধাকপি রান্নার গন্ধটা দারুণ লাগতো। শীতকালে আমি বেলা এগারোটা নাগাদ বেনেপাড়া যেতাম ওই গন্ধের ঝোঁকে।
কোনদিন কথাটা বলা হয়ে ওঠেনি। ফলে খাওয়াও হয়নি।
কিন্তু গন্ধ নাকে লেগে আছে।
আরেকটি তফাৎ দেখেছিলাম।
পরোটার বিষয়ে। মুসলিম বাড়ির পরোটা বড় গোল। বেশ মোটা। পারলে ১০০ গ্রামে একটা পরোটা বানিয়ে ফেলবে। তার আবার পরত ছাড়বে মাখামাখির গুণে।
১৯৭৭ -এ ধারান গ্রামে ফুটবল খেলা দেখতে গিয়ে আমার পত্রবন্ধু দীনবন্ধু দাসের বাড়িতে রাতে থেকে গেলাম। ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ি। সন্ধ্যায় পরোটা খেতে দিলেন কাকিমা। তেকোনা। এবং আলু কালোজিরার পাতলা তরকারি। পরোটা পছন্দ হলো না। কিন্তু তরকারিটির প্রেমে আজও পড়ে আছি।
মুসলিম বাড়িতে পরোটার সঙ্গে আলু ভাজা দেওয়া ছিল রীতি। সঙ্গে চিনির সিরা। পারলে ডিমের ভুজিয়া।
গ্রামে ধর্ম কর্মে খুব মতি ছিল না।
বাঙালি জীবন যেমন হয় আর কী!
কথায় কথায় আল্লার কিরে (দিব্যি), মা কালীর দিব্যি খুব চালু ছিল বটে-- কিন্তু ১৯৭৮ এ মসজিদে নামাজ পড়তে যেতেন নিয়মিত চার পাঁচজন।
২০০৪ এ সংখ্যাটি দাঁড়ায় ১৮ জন।
এখন প্রায় ১০০ জন।
জনসংখ্যা আড়াই হাজারের বেশি।
সত্তর দশক থেকেই তাবলিগ জামায়াতের আনাগোনা। আশির দশকে শুক্রবার শুক্রবার শুরু হল, বাড়ি বাড়ি ঘুরে নামাজের দাওয়াত দেওয়া।
তবে গ্রামে বছরে একবার জলসা হতো।
সে বহুদিন আগে থেকেই।
তবে সব বছর হতো না।
কারণ অনেক পয়সা কড়ির ব্যাপার। ইসলামি জলসার বক্তাদের টাকা দিতে হতো বক্তৃতা করাতে। পূজারীদের যেমন পূজার মন্ত্র পড়ার জন্য টাকা দিতে হয়। এছাড়া রাতে সবার খাওয়ার ব্যবস্থা হতো।
একবার মাংসের খিচুড়ি তথা তেহারি খেয়েছিলাম। এখনও মুখে লেগে আছে। শুক্রবার মসজিদে নামাজের পর বাচ্চারা গেলে ক্ষীর বা পায়েস পাওয়া যেত। ৬৫ ঘর মুসলমান ছিলেন গ্রামে। কেউ না কেউ কারও নামে বা কল্যাণকামনায় ক্ষীর বা পায়েস রেঁধে পাঠাতেন। নামাজি শুক্রবার বড়জোর ১০ জন।
আর আমরা বাইরে বসে থাকা ক্ষীরের অপেক্ষায় অন্তত ২০-২৫ জন।
ছোটরা কেউ নামাজ পড়তেন না। কেউ জোর করতোও না।
ক্ষীর খাওয়ার দলে হিন্দু মুসলমান সব বাচ্চারাই থাকতেন।
ওলাইচণ্ডী পূজার প্রসাদ তো হিন্দু মুসলমান সবাই খেতেন। সরস্বতী পূজার প্রসাদ তো বলাই বাহুল্য।
সরস্বতী পূজার পাণ্ডা তো গ্রামের মুসলমান ছেলে-মেয়েরাই। তাঁরাই তো বিদ্যালয়ের ৯০%।
শিক্ষক একজন মুসলমান। তাতে কী?
আমি যে হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় পূজার রীতিনীতি অনেকেরই চেয়ে বেশি জানি, তার একটা বড় কারণ আমার গ্রাম।
এখন কিছুটা বদলেছে ভিতরে ভিতরে। তবে একটা নতুন সংযোজন হয়েছে, তৃণমূল জমানায় মাঘ মাসের ওলাইচণ্ডী পূজার মেলার শেষ দিনে একসঙ্গে বসে খিচুড়ি খাওয়া।
আর কয়েকটা পরিবর্তন হয়েছে। ফুটবল খেলার মাঠে লোক নেই। সেখানে কিছুটা ঘিরে ঈদগাহ তলা। বেনে পাড়া বামুনপাড়ায় খেলার জায়গা ছিল না। দুটি পরিবার হাওড়া প্রবাসী হওয়ায় জায়গা মেলে। ছোটখাটো খেলার মাঠ হতেই পারতো। সেখানে এখন বড় দুর্গামন্দির। শিবমন্দির ছিল আগে মাটির। এখন শিব আর ওলাইচণ্ডীর আলাদা ঘর হয়েছে। আগে দুর্গাও ওখানে আসতেন। শিব লিঙ্গ সারা বছর থাকে। ওলাইচণ্ডীর বিসর্জন হয়। দুর্গারও। তবু আলাদা দুটি মন্দির।
খেলার জায়গা নেই। গোলাম হল ছিল ২০০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত খেলার জায়গা। বিক্রি হয়ে গেছে। এখন সেখানে কয়েকটি বাড়ি।
সবে বরাত আর কালীপুজোর সময় মোমবাতি জ্বালানো, ধূপ জ্বালানো ছিল। আছে। বোম ফাটতো, তারা বাজি হতো। হয়। তবে সবে বরাত বা বিজয়ায় বাড়ি হিন্দু মুসলমান বন্ধুর দল মিলে খাবার বা নাড়ু সংগ্রহ বন্ধ। ইদ বকরিদে বাড়ি বাড়ি ঘুরে বড়দের সালাম করা কমেছে। বিজয়া দশমীতেও তাই। নতুন বউ এলে পীরতলা বা বারোয়ারি তলায় এসে একবার থামতো। কমে গেছে। প্রায় নেই। ধর্ম বেড়েছে। লোকাচার কমেছে। বিয়েতে হিন্দু মুসলমান একসঙ্গে বসে খাচ্ছে। জাতপাত অস্পৃশ্যতা প্রায় নেই। কিন্তু একটা বিদ্বেষী আবহাওয়া তৈরির চেষ্টা হচ্ছে। দু'পক্ষের কিছু লোক অপচেষ্ট।
গ্রামে অদ্ভুত বিষয়, রাজনৈতিক ঝামেলা আছে। ১৯৭০ -৭৫ রাজনৈতিক হিংসা ছিল। ২০০৯ থেকে ২০১৯ আবার তা অল্প হলেও দেখা দেয়।
কিন্তু শক্তিশালী রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ। কিন্তু মারদাঙ্গা নেই।
আর সাম্প্রদায়িক ঝামেলা এখনও আমাদের তিনটি গ্রামে হয়নি।
এই ঐতিহ্য চিরবহমান থাকুক।