মা বর্ধমান শহরে গেলেই নিত্যনতুন ধরনের খাবারের সামগ্রী নিয়ে আসতেন।
তখন আর খাবারের বৈচিত্র্য তেমন কোথায়? নিজের ভালো লাগলেই সেটা বাড়িতে করার চেষ্টা করতেন।
এভাবেই একবার এলো, আমলকি আর হর্তুকি। আমলকি খুব মজার। খাওয়ার পর জল খেলে মুখ খুব মিষ্টি হয়ে যায়।
আর একবার এলো কস্তুরী মেথি।
লুচির সঙ্গে আলুর দম বানিয়ে তাতে দেওয়া হল।
আলুর দম আমাদের এলাকায় সেভাবে প্রচলিত ছিল না। খানিকটা আলুর ঝোল বলা যায়। দোকানেও তাই হতো। মা বানালেন, কষা কষা আলুর দম।
বর্ধমান শহরে এসেও দেখলাম, ওটাই আসল কষা কষা আলুর দম। শহরে টমেটোও মেশানো।
লুচির সঙ্গে আলু ভাজা, ডিম ভুজিয়া, চিনির সিরাই বেশি চলতো। আর ছোট ছোট করে আলু কেটে কালো জিরা কাঁচা লঙ্কা দিয়ে আলুর ছক্কা। এটি আজও আমার খুব প্রিয়। হলুদ দিলেই মুশকিল। যেমন পোস্তয় হলুদ চলে না। লুচির চেয়ে বেশি চালু ছিল পরোটা। মুসলিম বাড়িতে পরোটা বেশ পুরু। এবং গোলাকার। হিন্দু বাড়িতে পরোটা পাতলা এবং তেকোনা।
আমার বাবা রান্না করতে পছন্দ করতেন মাঝে মাঝে। তরিবত করে। পরোটার ময়দা তেল / ঘি দিয়ে মাখিয়ে রাখা হল অন্তত আধঘন্টা। একটু অল্প খাবার সোডা। বেকিং পাউডার নাম তখন শুনিনি। তারপর সেটি বেলে মাঝখান থেকে কেটে রম্বস আকারে পাকিয়ে আবার বেলা। তাতে ঢাকাই ধরনে ভাঁজ হতো অনেক। তেল ঢুকতো স্তরে স্তরে। বর্ধমান শহরে এসে এর দুটি নাম শুনলাম।
এক ঢাকাই পরোটা।
দুই লাচ্চা পরোটা।
বর্ধমান শহরের বড়বাজারের কাছে মহাজনটুলির উল্টোদিকের গলিতে ঢাকাই পরোটা আর গুলি কাবাব পাওয়া যেতো।
অমৃত।
কাবাব বোধহয় আট আনা করে ছিল। পরোটা চার আনা করে। গুলি কাবাব দ্বিগুণ।
আমাদের তখন চাহিদা খুব অল্প। সপ্তাহে একবার কেন, মাসে একবার গুলি কাবাব পরোটা খেলেই মনে হতো জীবন সার্থক।
প্রসঙ্গত, বলা ভালো মুসলিম বাড়িতে লুচির চেয়ে পরোটার চল ছিল বেশি। অন্তত আমার জানাশোনা সব এলাকায়।
ছেলেমেয়েদের দল যত স্কুল কলেজ বেশি করে যেতে লাগল লুচি চিঁড়ের পোলাও চাওমিন/ নুডলস টোস্ট ঘুগনি ইত্যাদি খাবার বাড়তে লাগল।
মা আর আব্বা ১৯৭৯ তে রাজ কলেজের বার্ষিক অনুষ্ঠান দেখতে গেলেন। বড়ভাই তখন কলেজের জিএস। পরপর দুবার জিএস।
সেবার ক্যালকাটা পিপলস কয়ার অনুষ্ঠান করে। সমরেশ বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর স্ত্রী ছিলেন দলের প্রাণ। সমরেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিখ্যাত গান ছিল, মাথা নীচুর আগে যেন রক্তে আগুন জাগে, কাফেতে মোড়েতে যারা বসে আছো, চারটি নদীর গল্প শোনো... ইত্যাদি।
তৃতীয় গানটি উদয় ভট্টাচার্যের গলায় ১৯৭৮ তেই শুনেছি। শ্যামসুন্দর কলেজে এস এফ আই সম্মেলনে। মাথার নীচুর আগে রক্তে আগুন জাগে, আব্বার গলায় শুনে আমার খুব মনে ধরে গেল। পরে রজতদা (বন্দ্যোপাধ্যায়) র কাছে শুনেছি, এটা রজতদার লেখা। কত শত পোস্টারে যে এই কথা কটি আমি লিখেছি।
আমি ছোটবেলায় খুব র চা বা লাল চা খেয়েছি। মুড়ি আর লেড়ো বা পাঁউরুটি ভিজিয়ে দারুণ লাগতো। একটু বড় হতেই ছেড়ে দিই।
কোনও নেশা করবো না-- এই প্রতিজ্ঞা করে।
আমি একা নই, তখন এস এফ আই রায়না লোকাল কমিটির সব সদস্যই ১৯৭৯তে এই প্রতিজ্ঞা করেন।
চা অবশ্য নেশা হিসেবে ধরা হয়নি সেদিন। বিড়ি সিগারেটকেই ধরা হয়েছিল। মদের কথা কেউ কল্পনাও করতে পারতেন না সে-সময়।
গ্রামে হাতে গোনা কয়েকজন মদ খেতেন। তাঁদের মাতাল বলেই লোকে জানতেন। তরুণ প্রজন্মের লোক মদ খান না, এমন লোক কম।
তবে পঞ্চাশোর্ধ্ব ৯০ এখনও মদ খান না।
ষাটোর্ধ্ব শতকরা ৯৫ ভাগ মদ বিরোধী।
গ্রামে আগে ছেলেদের প্রচুর কাজ ছিল। চাষে সাহায্য করা পড়াশোনা করা ছাড়াও ক্লাব করা ফুটবল খেলা, হাডুডু কবাডি নুনচিক / গাদি/ জাহাজ খেলা, শীতে ভলিবল খেলা, ডাংগুলি পেটানো, মার্বেল খেলা, ভাটা খেলা, নিদেন পক্ষে দাবা চাইনিজ চেকার লুডো বা বাগ বন্দি বা তাস খেলা। নাহলে আড্ডা দেওয়া।
যাত্রা নাটকের মহলা দেওয়া। সবাই নাটক যাত্রা না করলেও মহলা দেখতে বা শুনতে ভিড় করতেন। নানা ধরনের খেলার দর্শক হতেন। আড্ডায় গিয়ে কথা শুনতেন।
মধ্যবিত্ত বাড়ির মেয়েরা বিকেলে পাড়া বেড়াতেন। এ ওর চুল বেঁধে দিতেন। কেউ নতুন কোনও সেলাই ফোঁড়াই কুটুম বাড়ি গিয়ে শিখে এলে শিখতে যেতেন।
আমাদের সময় যেমন ঘরে ঘরে নাইলন/ উলের ফুলদানি।
বড়দিদের সময় ছিল টেবিল ক্লথ/ খাঞ্চা ঢাকনি, রুমাল, বালিশের নকশা করা। সুতোর কাজ করে ঘরে কাচ দিয়ে বাঁধিয়ে রাখা।
আসন বোনা একসময় হিন্দু বাড়িতে বেশি হলেও সত্তর দশকে গ্রামে জুনিয়র হাইস্কুল হওয়ার পর মুসলিম বাড়িতেও চট বা কাপড়ের আসন বোনা শুরু হল। আগে মুসলিম বাড়িগুলো কাঁথার নকশার জন্য বিখ্যাত ছিল। আমার বড়মাসির সতীন কাঁথায় তাজমহল আঁকতেন সুতো দিয়ে। তিনি পাণ্ডুয়া থেকে নানার বাড়িতে বেড়াতে এলে মেয়েদের ভিড় জমে যেতো শেখার জন্য। মুসলিম বাড়িতে খেজুর পাতা দিয়ে চমৎকার তালাই বানানো হতো। এজন্য পাতা কেটে আলাদা করে শুকনো করা হতো তারপর পাতা রাঙানি দিয়ে রাঙানো হতো। নানা রঙের মেলা। ২০ পয়সা করে পাতা। শুকনো। হালকা গরম জলে গুলতে হতো। আমরা প্রচুর পোস্টার লিখেছি ওই রঙ দিয়ে।
খেজুর পাতার ডাঁটি কেটে তুলিও বানিয়েছি। ডগাটার একপাশ ছুঁচলো করে কেটে চমৎকার তুলি।
শ্যামসুন্দর কলেজ থেকে এক ছাত্র নেতা প্রতি বৃহস্পতিবার আসতেন আমাদের বাড়ি। রাত জেগে পোস্টার লিখতাম দুজনে।
কিছু তিনি নিয়ে যেতেন। বাকিগুলো গ্রামের দেওয়ালে মারতাম। খবরের কাগজে লেখা হতো বেশিরভাগ পোস্টার।
খেজুর পাতার রঙ দিয়ে খেজুর পাতার চাটাই দারুণ হতো। সেগুলোতেও নানা নকশা আঁকতেন মেয়েরা। ময়ূর আঁকা ছিল কঠিন। ফনু দাদোর মেয়ে ও আমার বড়দি খুব ভালো ময়ূর আঁকতেন খেজুর পাতার তালাইয়ে।
তালাই নাকি অন্য কিছু বলা হতো?
তাল পাতা হলে তালাই? খেজুর পাতা হলে?
নামাজ পাটি বা জামাই পাটি হতো খুব সরু সরু পাতা দিয়ে। এগুলোর নাম ছিল চিকন পাটি বা শীতলপাটি। আসল শীতলপাটি পরে জেনেছি।
নামাজ পাটিতে কেউ কেউ মসজিদের ছবি আঁকতেন। মানুষের ছবি আঁকা হতো না। খেজুর পাটিতে। তবে কাপড়ের নকশায় কেউ কেউ রবীন্দ্রনাথ নজরুল আঁকতেন। সাধন কাকার মা ছিলেন কাপড়ে সুতোর সেলাইয়ে ওস্তাদ। হিন্দু মুসলমান সব মেয়েই সুতোর কাজ শিখতে তাঁর কাছে ভিড় করতো।
সেলাই ফোঁড়াই ছাড়াও রান্নার পদ্ধতিও আদান প্রদান হতো।
বামফ্রন্ট আসার পর প্রতি বছর গ্রাম থেকে এক দুজন মেয়েকে কামারপুকুর রামকৃষ্ণ মিশনের তত্ত্বাবধানে হাতের কাজ ও রান্না শিখতে পাঠানো হতো।
আমার সেজদি গিয়ে চিঁড়ের পোলাও শিখে এলো। গ্রামে ছড়িয়ে পড়লো সেটা।
আর শিখিয়ে এল ডিমের ঘরোয়া বিস্কুট।
ডিম ময়দা নুন চিনি মিশিয়ে ঘি দিয়ে ময়েন দিয়ে নিমকির মতো দেখতে একটা অপূর্ব জিনিস তৈরি করতেন আমাদের গ্রামের মেয়েরা।
যেকোনও বড় কুকিজ কোম্পানি ফেল মেরে যাবে।
কী নাম।
মনে পড়ছে না এখন।