স্মরণ করা যাক, বিবেকানন্দ ভাবানুরাগী সমিতি বলে ১৯৮২ তে একটা সংগঠন গড়ে ওঠে। আকাশবাণীর সাংবাদিক প্রণবেশ চক্রবর্তীর উদ্যোগে। আমিও যুক্ত হই। জেলা বিতর্ক প্রতিযোগিতায় স্থান পাই। 'দৈনিক যুগান্তর' তখন রমরম করে চলতো। সাংবাদিক নিরুপম চৌধুরী খবর করেন।
পরে দেখি আর ডাকে না।
আমার সঙ্গে যাওয়ারা কেউ কেউ যোগ দিল বিশ্ব হিন্দু পরিষদে। মিউনিসিপ্যাল স্কুলের দেওয়াল, যেখানে মূলত সিপিএমের লোকরাই দেওয়াল লিখতেন, সেখানে একদিন দেখা গেল, বিরাট আকারে লেখা, আমি হিন্দু হিসেবে গর্বিত।
তলায় বিবেকানন্দ।
মুসলিম এলাকাগুলোতেও তবলিগ জামায়াতের শুক্রবার শুক্রবার ঘোরা শুরু হল। দ্বীনের পথে আসুন।
মসজিদে শুক্রবার অন্তত চলুন। জুম্মার নামাজ পড়তে। তাঁদের সঙ্গে বাইরে থেকে আসা নানা উচ্চবর্গের লোকজনদের দেখা যেতে লাগল। চল্লিশ দিন জামাতের সঙ্গে নিজের পয়সায় ঘোরাকে চিল্লা বলা হতো। তাতে কিছু সংখ্যা যোগ হল।
এই দুটো বিষয় নিয়েই না ছাত্র সংগঠনে না পার্টিতে কোনও হেলদোল দেখা গেল!
দুর্গাপূজার সংখ্যা ও চাকচিক্য বাড়ল।
চন্দননগরের শ্রীধরের আলোর সুনাম ছড়াচ্ছে। সেই মতো চমকানো আলো এবং প্যান্ডেল হলে ভিড় বাড়ছে।
পুরাতন দেবী শীতলা ওলাইচণ্ডী দেবী ওলাবিবিরা পিছু হঠতে লাগলেন।
বসন্ত যাতে না হয়, শীতলা দেবীর কাছে হিন্দু মুসলমান সবাই কমবেশি যেতেন। ওলাইচণ্ডী কলেরা ঠেকানোর দেবী। রাঢ় বাংলায় বিশেষ করে বর্ধমান বাঁকুড়ায় বিরাট দাপট। মেলাগুলো রইল। কিন্তু দুর্গাপূজার জাঁকজমকের কাছে ম্লান। পীরের দরগাহে হিন্দু মুসলমান সবাই যেতেন।
রাজনৈতিক জীবনে ধর্ম নিয়ে প্রথম শোরগোল পড়ল শাহবানু মামলার পর। রাজীব গান্ধী শাহবানু মামলার রায় উল্টে দিতে মুসলিম মহিলা বিল আনলেন। মুসলিম মৌলবাদীরা তুষ্ট হলে অসন্তুষ্ট হিন্দু মৌলবাদীদের সন্তুষ্ট করতে বাবরি মসজিদের তালা খুলে দিলেন।
এর মাঝেই ১৯৮৬-তে এল জাতীয় শিক্ষানীতি। চারদিকে বিরাট তোলপাড়। জেলায় জেলায় মডেল স্কুল চলবে না।
পরে দেখলাম, মডেল স্কুল হয়ে গেল। কোনও বাধা পার্টি বা সরকার দিল না। এবং জানাই গেল না, কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা পড়ানোই হয়। মাতৃভাষা নিয়ে আন্দোলন করতে গিয়ে ১৯৯৮ এ জানতে পারি।
আগের দুটো স্কুলে চুটিয়ে রাজনীতি করেছি। গ্রামের স্কুলে ৬৭ জন ছাত্রের মধ্যে ৫২ জন ছিল সদস্য হওয়ার যোগ্য। ষষ্ঠ শ্রেণিতে না পড়লে সদস্য করা হতো না। ৫২ জনই সদস্য। ২৫ পয়সা দিয়ে। সেনারা স্কুলে ১৪০০ মতো ছাত্র ছিল। ১৯৮১ তে ১০২০ জনকে সদস্য করে ফেলতে পারি।
মিউনিসিপ্যাল স্কুল খুব নামী স্কুল। তক্কে তক্কে থাকি। কী করে সংগঠন করা যায়।
আগে থেকেই এই স্কুলে সংগঠন ছিল। কিন্তু তখন নিস্তেজ।
শুধু গিম্পাদা সংগঠন করে।
আমি স্কুলে বিতর্ক তাৎক্ষণিক এইসব বিষয়ে নিয়মিত অনুষ্ঠান করার জন্য চেষ্টা করতে থাকি। সেহারা স্কুলে প্রতি শুক্রবার দুপুরে এক ঘণ্টা টিফিন থাকতো। বিতর্ক ও তাৎক্ষণিক বক্তৃতার আসর বসানো যেত। ওই স্কুলে ছাত্র সংসদ ধরনের একটা সাবকমিটি গঠন করা গিয়েছিল আন্দোলন করে।
এখানে তো উপায় নেই!
শিক্ষকদের মধ্যে দুটো দল। বাম বিরোধীরাই সংখ্যায় বেশি। আর এস এসের এক নেতা বাম বিরোধী শিক্ষক সংগঠনের দাপুটে নেতা।
এর মধ্যে দেখা গেল, স্কুলের জলের ট্যাঙ্কে কাক মরে পড়ে আছে। তখন ৯৯ শতাংশ ছেলে স্কুলের জল খেতো। কারও সঙ্গে বোতল দেখিনি।
বোতল শব্দটাই ছিল গালাগালের সমতুল্য। বোতলের লোক মানে মাতাল।
তিন চারবার কাক মরে পড়ে থাকার ঘটনার পর একদিন জলের ট্যাঙ্কের গায়ে ভালো পানীয় জলের দাবিতে পোস্টার লাগাই।
তলায় ছাত্রকল্যাণ সমিতি।
এর মধ্যে আমি স্কুলে নাটক বিতর্ক তাৎক্ষণিক কুইজ স্বাধীনতা দিবসে ভাষণ, কেউ মারা গেলে শোকসভায় বক্তব্য পেশ ইত্যাদি করে পরিচিত মুখ।
পোস্টার লাগানোর ঘণ্টাখানেক পর টিফিন। জল খেতে গেছি, চার পাঁচজন আমাকে ঘিরে ফেলল। একজন মারতে শুরু করল। সে ছিল স্কুলের এক প্রভাবশালী কর্মচারীর ছেলে। আর এস এস ও কংগ্রেস তখন মিলে মিশে থাকতো স্কুলে।
আমি ছুটে শিক্ষকদের বসার ঘরে ঢুকে যাই।
আমাকে বাঁচাতে এগিয়ে আসেন আর এস এস নেতার ঘনিষ্ঠ শিক্ষক শ্যামাপ্রসাদবাবু।
তিনি খুব ভালো মানুষ ছিলেন।