দুর্মুখ। মহারাজ, বিকৃতদেহী তিনজন ভিক্ষুক এখনও পাশের ঘরে অপেক্ষা করছেন। তাঁরা এখনও মহারাজের দর্শন পাননি।
রাম। আমার স্মরণে আছে দুর্মুখ। এঁরা বিদায় নিলেই আমি তাঁদের সঙ্গে দেখা করব।
দুর্মুখ। কিন্তু পেটিকাটি অপসৃত হলে তাঁরা কী ভিক্ষা আশা করবেন?
রাম। ঠিক কথা দুর্মুখ, আমারই ভুল। (পেটিকাবাহককে) পেটিকাটি এখানেই আপাতত থাক। ভিক্ষাদান শেষ হলে আর্য দুর্মুখ তোমাকে খবর দেবেন।
পেটিকাবাহক। মহারাজের জয় হোক। (পেটিকা রেখে দেয়)
রাম। তোমার বুদ্ধি সদাজাগ্রত দুর্মুখ, ওঁদের ডাকো। তিনজন ভিক্ষুক থাকা সত্ত্বেও পেটিকাটি অপসৃত হলে এমনকি পেটিকাবাহকেরও সন্দেহের উদ্রেক হত।
দুর্মুখ। মহারাজ। (প্রণত)
শ্রেষ্ঠীত্রয়। মহারাজের জয় হোক।
রাম। আপনারা আসন গ্রহণ করুন। (শ্রেষ্ঠীরা আসন গ্রহণ করেন) আপনাদের এভাবে ডেকে আনার জন্য আমি দুঃখিত। আপনারা এ রাজ্যের অতি সম্মানিত শ্রেষ্ঠী। কিন্তু গোপনীয়তা রক্ষায় এটিই সহজতম পন্থা বলে আমার মনে হয়েছিলো। দুর্মুখ, অতিথিদের জলযোগের ব্যবস্থা হয়েছিল?
শ্রেষ্ঠীত্রয়। মহারাজ, আর্য দুর্মুখ যথেষ্ট আতিথেয়তা করেছেন, আমরা পর্যাপ্ত আহার গ্রহণ করেছি।
রাম। তাহলে অযথা সময় নষ্ট করব না। আপনারা অতি ব্যস্ত শ্রেষ্ঠী। আমাকে আর্য দুর্মুখ বলেছেন, কিছুদিন পূর্বে এক অতিথিশালায় তাঁর সঙ্গে আপনাদের তিনজনের সাক্ষাৎ হয়েছিল। বিশেষ রাজাজ্ঞায় দুর্মুখ এ রাজ্যের গ্রামে-নগরে-প্রত্যন্ত প্রদেশে ভ্রমণ করছিলেন। তাঁর প্রতি নির্দেশ ছিল এ রাজ্যে একজন প্রজাও যদি কোন কারণে রাজার ব্যবহারে কিছুমাত্রও অসন্তুষ্ট বা বিচলিত হয়ে থাকেন তাহলে সে সংবাদ রাজার কর্ণগোচর করা। রাজার ব্যবহারের বিষয়ে আপনাদের তিনজনের কিছু অভিযোগ আছে এ কথা দুর্মুখ আমাকে জানিয়েছেন। কিন্তু সেই অভিযোগ কী, তা তিনি আপনাদের কাছ থেকে জানতে ব্যর্থ হয়েছেন। রাজপ্রতিনিধির ওপর আপনারা আস্থা রাখতে পারেননি। এখন আমি স্বয়ং আপনাদের অনুরোধ করছি আপনাদের কী অভিযোগ আমাকে বলুন, আমি যথাসাধ্য তার প্রতিবিধান করবো।
সুলোচন। মহারাজ, আপনার কাছে আমরা মার্জনা ভিক্ষা করছি। আমরা সাধারণ শ্রেষ্ঠী, সারাদিনের নানা কায়িক ও মানসিক পরিশ্রমের ক্লান্তি অপনোদনের জন্য সন্ধ্যায় – করজোড়ে মার্জনা ভিক্ষা করে সত্য নিবেদন করছি মহারাজ – ঈষৎ মদ্যপান করি। মত্ত অবস্থায় সেদিন আর্য দুর্মুখকে যা বলেছিলাম তা মত্তের প্রলাপ মাত্র। তা সত্য নয়।
রাম। (হেসে) মত্ততাই সত্যের প্রকাশ ঘটায়, এ কথা শ্রেষ্ঠী হিসাবে আপনারা ভালোই জানেন। পরিমিত মদ্যপান কুণ্ঠা বা সঙ্কোচ সাময়িক ভাবে খর্ব করে, কিন্তু বুদ্ধিলোপ ঘটায় না। প্রথমটি, অর্থাৎ সঙ্কোচ মুক্ত হওয়ায়, সেদিন স্বতস্ফূর্ত সত্য আপনাদের মুখ দিয়ে বেরিয়েছিলো। কিন্তু একই সঙ্গে বুদ্ধিলোপ না ঘটায় আপনারা ভয়ও পেয়েছিলেন। রাজার বিরুদ্ধে সত্যভাষণও অনেক সময় বিপদ ডেকে আনে, এ কথা জানতেন বলেই আপনারা নিজেদের সংযত করেছিলেন।
সুবুদ্ধি। মহারাজ, অপরাধ নেবেন না। আমরা শ্রেষ্ঠী। শ্রেষ্ঠী এবং ব্রাহ্মণ কি কখনও রাজার বিরুদ্ধাচরণ করে?
রাম। আমি বিরুদ্ধাচরণের কথা বলছি না, কিন্তু মন? মনের ওপর নিয়ন্ত্রণ আছে কার?
সুকণ্ঠ। মহারাজ, স্বয়ং রামচন্দ্রের প্রজা আমরা। আমাদের অপেক্ষা ভাগ্যবান আর কে আছে?
রাম। শুনুন শ্রেষ্ঠীরা। সঙ্কোচ এবং ভয়, দুটিই আপনাদের নিয়ন্ত্রণ করছে এখন। যতক্ষণ সামনে আমি আছি, ততক্ষণ আপনারা তা কাটিয়ে উঠতে পারবেন বলে মনে হয় না। কিন্তু এখন অন্তত আপনাদের সন্দেহের কোন কারণ নেই যে আর্য দুর্মুখ সত্যই আমার প্রতিনিধি। আমি কক্ষ ত্যাগ করছি, দুর্মুখ এখানে থাকবেন। আপনাদের অভিযোগ খোলাখুলি তাঁর কাছে বলুন, এতে আপনাদের ভালোই হবে। আমি এই সিংহাসনে বসে আপনাদের আস্বস্ত করছি এই সত্যভাষণে আপনাদের কোন বিপদ নেই।
দুর্মুখ। স্বয়ং মহারাজ রামচন্দ্রের আশ্বাসের পর আশা করি আপনাদের কী অভিযোগ তা আমার কাছে বলতে আপনাদের আপত্তি হবে না। আপনারা বলেছিলেন রাজা ভরতের রাজত্বের সময় অযোধ্যার আর্থিক স্বাচ্ছল্য বহুগুণ বর্ধিত হয়েছিলো, কিন্তু তৎসত্ত্বেও শ্রেষ্ঠীসমাজ তাদের অবদানের যোগ্য স্বীকৃতি পায়নি। আমি আপনাদের কাছে এই অভিযোগটি একটু বিশদে বুঝতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আপনারা সম্মত হননি। এখন মহারাজ রামচন্দ্রের সঙ্গে কথা বলার পর আপনারা স্বীকৃতি না পাওয়ার ব্যাপারটা একটু কি বুঝিয়ে বলবেন?
সুলোচন। আচ্ছা, রাজা ভরতের সম্বন্ধে আপনার কী ধারণা?
দুর্মুখ। আমার? আমার তো মনে হয় অযোধ্যার যে কোন নাগরিকের যা ধারণা আমারও তা-ই। রামের বনবাসের চতুর্দশ বৎসর রাজা ভরতের আমরা দুটি রূপ দেখেছি। রাজ্যের পরিচালক হিসাবে তিনি যে দক্ষতা দেখিয়েছেন সম্ভবত মহারাজ দশরথের রাজত্বের সময়ও আমরা তা দেখিনি। দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালন এবং বহুবিধ নূতন ক্রিয়াকলাপ এবং তার সুফল, রাজ্যের সকল প্রজাই দেখেছে। অন্যদিকে, আশ্চর্য তাঁর ব্যক্তিজীবন! তিনি নিজেকে রাজা ঘোষণা করেননি, রাজা ভাবেনওনি। শ্রীরামচন্দ্রের পাদুকা তাঁর চন্দ্রাতপ, কাষায় বসন তাঁর পরিধান, জীবনধারণের জন্য অতি সামান্য তাঁর ভোজন। করুণা এবং স্নেহমণ্ডিত তাঁর মুখমণ্ডলে কখনো হাসির ছোঁয়াও দেখেনি কেউ। তিনি রাজত্ব করেছেন, কিন্তু রাজা হননি!
সুবুদ্ধি। আপনি যথার্থ বলেছেন আর্য দুর্মুখ, আমাদের যে কোন একজনকে জিজ্ঞাসা করলে সম্ভবত উত্তর একই হতো। কিন্তু একটি কথা আপনি বললেন যা বিশেষভাবে আমার মনকে স্পর্শ করলো। রাজা দশরথের সময়েও অযোধ্যাবাসী সুখীই ছিলো, কিন্তু রাজকার্যে ভরত সম্ভবত তাঁর চেয়েও বেশি দক্ষতা দেখিয়েছেন।
সুকণ্ঠ। কিন্তু তবুও, দশরথ-প্রবর্তিত একটি বিশেষ কার্যপ্রণালী ভরত তাঁর রাজত্বকালে বারংবার ব্যবহার করেছেন এ কি আপনি লক্ষ্য করেছেন?
দুর্মুখ। কী বলুন তো।
সুকণ্ঠ। মহারাজ দশরথের রাজত্বকালের শেষ দিনে তিনি এটি প্রবর্তন ও ব্যবহার করেন।
দুর্মুখ। আপনি কিসের কথা বলছেন?
সুবুদ্ধি। শেষ দিনটি মনে আছে আপনার?
দুর্মুখ। মনে নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু শেষের সেই ভয়ঙ্কর দিনটির কথা আমি আবার মনে করতে চাইনা।
সুলোচন। আপনি অতি অনুভূতিপ্রবণ আর্য দুর্মুখ। সেই অনুভূতিতে আঘাত না করে আপনাকে একটু স্মরণ করিয়ে দিই। সেদিন প্রাসাদে আমাদের সবায়ের নিমন্ত্রণ ছিলো। আমরা জানতাম প্রাসাদে একটি অনুষ্ঠান আছে, উৎসব হবে। কিন্তু কী সে অনুষ্ঠান, কিসের উৎসব, সে বিষয়ে কোন ধারণা আমাদের ছিলনা। অনেকে অনেক কিছু বলাবলি করছিল, কিন্তু কেউই ঠিকমত জানত না কিসের উৎসব!। আমরা যখন পৌঁছোলাম, প্রাসাদতোরণে একটি চমক অপেক্ষা করছিল আমাদের জন্য। স্বয়ং আর্য সুমন্ত্র একজন কর্মচারিকে সঙ্গে নিয়ে আমন্ত্রিত সবায়ের কাছে ছোট ছোট লেখ্যপত্র বিতরণ করছিলেন। প্রতিটি আমন্ত্রিত ব্যক্তিকে উপদেশ দেওয়া হচ্ছিলো লেখ্যপত্রটিতে অযোধ্যায় মহারাজ দশরথের পর কাকে সে অভিষিক্ত দেখতে চায় তাঁর নামটি যেন লিখে দেয়। আমি এ বিষয়ে আর কিছু বলতে চাইনা, কিন্তু সেদিন কী আশ্চর্য পদ্ধতিতে রামের নির্বাচন হয়েছিলো যুগ যুগ ধরে ইতিহাস তা মনে রাখবে।
দুর্মুখ। হ্যাঁ, অতি আশ্চর্য এক পদ্ধতি সেদিন আবিষ্কার করেছিলেন মহারাজ দশরথ। সাধারণ প্রজা থেকে আমন্ত্রিত দেশবিদেশের রাজন্যবর্গ – সবাই ধন্য ধন্য করে উঠেছিলো সেদিন।
সুকণ্ঠ। রাজা ভরত সেদিন উপস্থিত ছিলেন না ঐ সভায়, কিন্তু পরে তিনি নিশ্চয়ই বিশদ শুনেছিলেন। নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তিনি যখন কোশলের প্রশাসনের দায়িত্ব নিতে বাধ্য হন, তিনি বারংবার মহারাজ দশরথ প্রবর্তিত ঐ নির্বাচনের পন্থা প্রয়োগ করেছেন, ফলে বহু আপাতদুরূহ সমস্যার সহজ সমাধান হয়েছে।
সুবুদ্ধি। কিন্তু আর্য দুর্মুখ, ধরুন আজ, চতুর্দশ বৎসর পার হয়ে এখন পঞ্চদশ বৎসর শুরু হয়েছে, কোশলের প্রজারা এতদিন ধরে ভরতের সুশাসনে অভ্যস্ত হয়েছেন। আজ যদি মহারাজ দশরথের মতদান সভার মতো একটি সভা আবার আহ্বান করা হয়, আপনি কি মনে করেন সমস্ত অযোধ্যাবাসী আবার শ্রীরামচন্দ্রকেই বরণ করে নেবে?
দুর্মুখ। এ-এ এ ক-কথার উত্তর আমি কী-কী ক্করে দেব? আর, এ প্রশ্নই বা ওঠে ক্কী-কীভাবে? এ তো সবাই জানে স্বয়ং রাজা ভরত রামের পাদুকার নীচে বসে তাঁরই প্রতিনিধি হয়ে এতদিন রাজত্ব চালিয়েছেন। আর তা ছাড়া প্রজারা তো সকলেই জনস্থানে সেদিন শ্রীরামচন্দ্রের পুনরাভিষেকের পক্ষেই মত দিয়েছিলেন, এবং স্বয়ং ভরতও যে তা-ই চান সে বিষয়ে তো কোন সন্দেহই নেই।
সুবুদ্ধি। যথার্থ। স্বয়ং ভরতও যে তা-ই চান সে বিষয়ে কোন সন্দেহই নেই। এবং যদি আপনাকে বলি আমাদের যাবতীয় ক্লেশের কারণ তাই-ই, তাহলে আপনি কী বলবেন?
দুর্মুখ। ক্লেশ? আমি বুঝলাম না আর্য সুবুদ্ধি। ভরত তাঁর প্রতিশ্রুতি পালন করবেন তাতে ক্লেশের প্রশ্ন কোথায়?
সুকণ্ঠ। ক্লেশ তাতে নয় আর্য দুর্মুখ। বরঞ্চ যে কোন মূল্যেই ভরত, যিনি কোশলের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত শ্রেষ্ঠ প্রশাসক, যে কোন মূল্যেই তিনি যে তাঁর প্রতিশ্রুতি পালন করতে চান, তাতেই আমাদের ক্লেশ। আমরা নির্বাচনের কথা বলছিলাম। এ রাজ্যে শেষ নির্বাচন কবে এবং কী বিষয়ে হয়েছে আপনার হয়তো খেয়াল নেই। আপনাকে মনে করিয়ে দেব? যে পান্থনিবাসটিতে আপনার সঙ্গে আমাদের শেষ দেখা হয়, সেখানে আমরা তখন পানরত ছিলাম। পান্থনিবাসে মদ্যপানের ব্যবস্থা এ রাজ্যে নূতন। তিন বৎসর পূর্বে আমাদের ঐ শ্রেষ্ঠীপল্লীর কিছু অধিবাসী পান্থনিবাসটিতে একটি পানশালা প্রতিষ্ঠার অনুমতি ভিক্ষা করে রাজসমীপে আবেদন করেন। অক্ষত্রিয় প্রজাদের প্রকাশ্য মদ্যপান ততদিন পর্যন্ত অযোধ্যায় নিষিদ্ধ ছিলো। যে শ্রেষ্ঠীরা আবেদনটি করেছিলেন তাঁরা এ রাজ্যে প্রধান শ্রেষ্ঠীদের মধ্যে গণ্য। তাঁদের সঙ্গে রাজা ভরতের পরিচয় ছিলো। ভরত তাঁদের যুক্তি শুনে ওই পল্লীতে এ বিষয়ে একটি নির্বাচনের আদেশ দেন, এবং নির্বাচনের ফল অনুযায়ী অযোধ্যারাজ্যে প্রথম পানশালাটির প্রতিষ্ঠা হয়।
দুর্মুখ। হ্যাঁ, আমার মনে পড়ছে। তার পর আরও কোন কোন অঞ্চলে পানশালার অনুমতিও দেওয়া হয়।
সুলোচন। আর্য দুর্মুখ, আমাদের মনে রাখতে হবে, মহারাজ দশরথ প্রবর্তিত নির্বাচনটির পর বিভিন্ন মতদানের প্রয়োজনে অযোধ্যায় অন্তত দশটি নির্বাচন সংঘটিত হয়েছে। এত নির্বাচন পরিচালনা করতে করতে তার কূটকৌশল এখন আমাদের আয়ত্বে। এমন তো হতে পারে, শ্রেষ্ঠীপল্লীতে পানশালা স্থাপনের ব্যাপারে নির্বাচনটি পরিচালনা করেছিলেন যিনি, তাঁর ব্যক্তিগত প্রভাবের জোরে বিরুদ্ধমতের মানুষদের মতদানের অনুষ্ঠানে সেদিন আসতেই দেওয়া হয়নি। তাঁদের গৃহ থেকে মতদানকেন্দ্র পর্যন্ত রাস্তায় নানারকমের দুর্ঘটনা ঘটেছিলো, অথবা তাঁদের শকটের চালকরা সবাই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন, বা এরকম কিছু একটা হয়েছিলো!
দুর্মুখ। এ তো কূটতর্ক। এ কী হয়?
সুলোচন। আর্য দুর্মুখ, নির্বাচনটি আমারই নেতৃত্বে পরিচালিত হয়।
দুর্মুখ। আপনি এই হীন কাজ করেছেন?
সুলোচন। আমি আপনাকে বলছি, এরকমটা হওয়া সম্ভব!
সুকণ্ঠ। একটা কথা জিজ্ঞাসা করবো আর্য দুর্মুখ? মহারাজ রামচন্দ্রের বনবাসের চতুর্দশ বৎসর পূর্ণ হয়েছে কবে?
দুর্মুখ। গত বছর ফাল্গুন মাসের দ্বিতীয় রবিবার।
সুকণ্ঠ। হ্যাঁ, তিথি-নক্ষত্র হিসাবে তাই। দিনপঞ্জীর হিসাবে কিন্তু ওই মাসের প্রথম বৃহস্পতিবার। বৃহস্পতিবার এ রাজ্যে বিপণীসকল বন্ধ থাকে, ব্যবসা-বাণিজ্যের বিরতি, কর্মচারিরা শ্রেষ্ঠীরা সকলেই সাপ্তাহান্তিক বিশ্রাম অথবা অন্য ব্যক্তিগত কাজ করেন। অপর দিকে রবিবার ব্যস্ততার দিন। এতৎসত্ত্বেও ভরত বৃহস্পতিবারের বদলে পরবর্তী রবিবার রামকে নিয়ে আসার দিন স্থির করেন। যখন জনস্থানে শ্রীরামকে রবিবার তিনি শোভাযাত্রা সহকারে আনতে যান, তখন তাঁর সঙ্গে কতো জন অযোধ্যবাসী যেতে পেরেছিলেন? আমরা সকলেই জানি শ্রীরামকে অযোধ্যায় ফিরিয়ে এনে সিংহাসন ফিরিয়ে দিতে কতটা ব্যগ্র ছিলেন ভরত নিজে, সেক্ষেত্রে এ কথা ভাবলে কি খুব ভুল হবে যে যাঁরা ভরতের সঙ্গে গিয়েছিলেন তাঁরা তাঁরই অনুগামী? ব্যস্ত শ্রেষ্ঠীরা অথবা অন্য ব্যস্ত প্রজারা তো যেতেই পারলেন না!
দুর্মুখ। কিন্তু শ্রীরাম আপত্তি করায় ভরত তো তৎক্ষণাৎ জনস্থানে উপস্থিত প্রজাদের মতগ্রহণের ব্যবস্থা করেছিলেন।
সুকণ্ঠ। হ্যাঁ করেছিলেন, ঠিকই। কিন্তু সে নির্বাচন তো প্রকাশ্য । আপনি কী মত দিচ্ছেন তা কারো অগোচর থাকছে না। আর তাছাড়া আমরা, অর্থাৎ শ্রেষ্ঠীরা, সেখানে তো উপস্থিতই ছিলাম না! মতামতের প্রশ্নই আসেনি!
সুবুদ্ধি। এত কিছু সত্ত্বেও স্বয়ং সীতা যখন রামচন্দ্রের মনোভাব বুঝতে পেরে রামের মহিষী হিসেবে অযোধ্যায় প্রত্যাবর্তনে অনিচ্ছা প্রকাশ করেন, আমরা শুনেছি তখন উপস্থিত প্রজাবর্গ, ভরতের অনুগামী প্রজাবর্গও, নিরুত্তর ছিলো। পরিস্থিতি শেষ পর্যন্ত সামাল দেন সীতা নিজেই। মিথিলায় রাম-লক্ষ্মণ-ভরত-শত্রুঘ্নের বিবাহ বাসরে বিবাহের শেষে যখন ভ্রাতারা এবং তাঁদের বধূরা তিনবার অগ্নিপরিক্রমা করেন, তখন থেকেই তো তাঁরা অগ্নির আশীর্বাদধন্য! সীতা জানতেন অগ্নি কোনদিনই তাঁর কোন ক্ষতি করবেন না! অতএব অগ্নিপরীক্ষা! কই, রামচন্দ্র তো কোন প্রতিবাদ করলেন না তখন!
দুর্মুখ। রামচন্দ্র প্রতিবাদ করবেন? কেন?
সুবুদ্ধি। ঠিকই তো। প্রতিবাদ করবেন কেন? প্রকৃতপক্ষে, সীতার সঙ্গ, তাঁর সম্ভোগজনিত সুখ, রামের হৃদয়ে এবং শরীরে এত প্রবল যে তাঁকে ছাড়া তিনি থাকার কথা ভাবতেই পারেন না! তা না হলে, পূর্বে রাবণ যাঁকে সবলে ক্রোড়ে তুলে লঙ্কায় নিয়ে গিয়ে অশোকবনে নিজের আয়ত্বে রেখেছিলো, যিনি রাক্ষসের বশে ছিলেন, সেই সীতাকে রাম কেন ঘৃণা করেন না? এখন যদি আমাদের পত্নীরাও ধর্ষিতা হন, আমাদেরও তা মেনে নিতে হবে, কারণ রাজাই সর্ববিধ প্রজার আদর্শ!
দুর্মুখ। (কানে আঙুল দিয়ে) দোহাই আপনাদের, আপনারা চুপ করুন শ্রেষ্ঠীরা। আপনাদের সঙ্গে বাক্যালাপেও পাপ! আপনারা যান। আমার আর আপনাদের কথা শোনার প্রবৃত্তি নেই। আমার যা বলার আমি মহারাজকে বলবো।
রাম। দুর্মুখ, আমি কক্ষান্তর থেকে সবই শুনেছি। তুমি স্থির হও দুর্মুখ, বিলাপ কোর না। এখনই ভরত, লক্ষ্মণ আর শত্রুঘ্নকে পাঠিয়ে দাও। বলো, তারা যে যে অবস্থায় আছে তা ত্যাগ করে এই মুহূর্তে এখানে আসুক। তোমাকে আমার এখন আর প্রয়োজন নেই।
দুর্মুখ। জয় হোক্ মহারাজ।
ভরত। প্রণাম, আর্য, আমাদের ডেকেছেন?
রাম। হ্যাঁ বৎস, বোস। (বসেন)
রাম। (খানিকটা অন্যমনস্ক ভাবে) তোমাদের কে পাঠাল?
লক্ষ্মণ। দুর্মুখ, মহারাজ।
রাম। দুর্মুখ। হ্যাঁ দুর্মুখ। দুর্মুখকে আমি দায়িত্ব দিয়েছিলাম এ রাজ্যে রাজ্যশাসন বিষয়ে কোন প্রজার অসন্তোষ আছে কিনা সে বিষয়ে খোঁজ নিতে। খোঁজ নিতে নিতে সে তিনজন শ্রেষ্ঠীর সঙ্গে পরিচিত হয়। এই শ্রেষ্ঠীরা সীতার চরিত্রের শুদ্ধতা সম্বন্ধে সন্দেহ প্রকাশ করেন।
শত্রুঘ্ন। কে তাঁরা? কোন্ সাহসে তাঁরা এই সন্দেহ প্রকাশ করেছেন?
রাম। উত্তেজিত হোয়ো না বৎস। তাঁরা স্বতঃপ্রণোদিত কিছুই বলেননি, প্রশ্ন করায় তাঁদের মত ব্যক্ত করেছেন মাত্র।
লক্ষ্মণ। কিন্তু দেবী সীতা সর্বসমক্ষে স্বেচ্ছায় অগ্নিপরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন, অযোধ্যার সবাই এ কথা জানেন। স্বয়ং অগ্নি আপনাকে এবং তাঁকে আশীর্বাদ করে নিরাপদে ফিরিয়ে দিয়ে যান। তারপর আর সন্দেহের অবকাশ কোথায়?
ভরত। আর তাছাড়া অযোধ্যার প্রায় সব প্রজাই নিজের চোখে সে অগ্নিপরীক্ষা দেখেছে।
রাম। প্রায় সব প্রজাই দেখেছে! প্রায়! সকলে নয়! অনেকে নয়! যাঁরা আপত্তি তুলেছেন তাঁরা বিশেষ ব্যস্ত শ্রেষ্ঠী, তাঁরা সেদিন জনস্থানে ছিলেন না।
শত্রুঘ্ন। কিন্তু প্রতিটি মানুষের সামনে এক এক করে, ভিন্ন ভিন্ন সময়ে, অপাপা এবং অপাপবিদ্ধা দেবী সীতা তাঁর শুদ্ধতা প্রমাণ করবেন এ কথা যারা বলে, তাদের গুরুত্ব দেওয়ার কী দরকার?
রাম। প্রশ্নটা তাদের গুরুত্ব দেওয়ার নয়। রাজা যে, তার দায়িত্ব অনেক বড়। আমি পাপী নই, শুধু এ জ্ঞানই যথেষ্ট নয়, আমাকে পাপী মনে হচ্ছে না, এটা প্রমাণ করাই গুরুত্বপূর্ণ। সে তর্কে যাওয়ার আর প্রয়োজন আছে এমন মনে হয় না। সীতার চরিত্রের শুদ্ধতা নিয়ে যেমন আমার মনে কোন সন্দেহ নেই, তোমাদের কারো মনেও তা নেই আমি জানি।
লক্ষ্মণ। আর্য, আপনি আমাদের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা। পিতা নেই, আপনিই আমাদের পিতা, আমাদের গুরু। আপনি যা বলবেন
তা-ই আমাদের শিরোধার্য। এ কথা জেনেও বলছি আপনি কি এ কথা চিন্তা করেছেন যে মাতৃসমা দেবী সীতার বিষয়ে এই অপবাদ শোনাও আমাদের পক্ষে পাপ!
রাম। জানি বৎস, কিন্তু অকীর্তি রটিত হয়েছে। যত কাল অকীর্তি তত কাল নরকবাস। কালে কালে সমস্ত মহাপুরুষ কীর্তির জন্যই চেষ্টা করেন, অপবাদ সর্বত্রই নিন্দনীয়। কেবলমাত্র প্রিয়া সীতা কেন, অপবাদ খণ্ডনের জন্য আমি সকলের জীবন ত্যাগ করতে পারি, নিজেরও।
ভরত। আপনি তাহলে কী করবেন? দেবী সীতাকে ত্যাগ করবেন?
রাম। যতই দুঃখ হোক্, যতই কষ্ট হোক্, তা-ই করতে হবে। (লক্ষ্মণের উদ্দেশে) লক্ষ্মণ, গত রাত্রে সীতা সরযূর অপর পারের অরণ্যে মুনিদের আশ্রম দেখার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। মহামাত্য সুমন্ত্রের সঙ্গে তুমি কথা বলে রাখ। আগামী কাল সকালে আশ্রম দেখাবার ছলে সীতাকে তুমি নিয়ে যেও। কিছুদূর যাওয়ার পর তমসা অতিক্রম করে ঋষি বাল্মিকীর আশ্রমে তাঁকে পৌঁছিয়ে দিও। সেখানে পৌঁছবার পরেই তাঁকে জানিও আমার আদেশে তুমি তাঁকে ত্যাগ করে যাচ্ছ। কঠিন কাজ, আমি জানি লক্ষ্মণ, কিন্তু এ ছাড়া আর উপায় নেই!
লক্ষ্মণ। আর্য, আমি আপনার কথার অবাধ্য কখনো হইনি, কিন্তু এ ঘোরতর অন্যায় আমি কী ভাবে করবো? মাতৃসমা তিনি, ভরসা করে আমার সঙ্গে যাবেন, আমি তাঁকে বিসর্জন দিয়ে আসব!
রাম। লক্ষ্মণ, কর্তব্যের প্রয়োজনে মাতৃসমা কেন, মাতাকেও ত্যাগ করতে হতে পারে। যাও।
লক্ষ্মণ। হে ভগবান! হে দেবী সীতা! (কাঁদতে কাঁদতে এগিয়ে যান)
ভরত। দাঁড়াও লক্ষ্মণ। (রামকে) আর্য, আর একটি কর্তব্যের কথা আপনাকে স্মরণ করিয়ে দিই।
রাম। বলো বৎস।
ভরত। রামরাজ্যে শুধুমাত্র রাজা একা রাজ্যপালক নন, মহিষী সহ তিনি রাজত্ব করেন। আপনার মনে আছে, জনস্থানে যখন আপনি অভিষেকে সঙ্কোচ প্রকাশ করছিলেন, তখন আপনার মনোগত অভিপ্রায় বুঝে দেবী সীতা অগ্নিতে প্রবেশ করেছিলেন, এবং নিজের শুদ্ধতা ও যোগ্যতা প্রমাণ করে আপনার সঙ্গিনী হিসাবে রামরাজ্যের রাজ্যলক্ষ্মীর পদ অলঙ্কৃত করেছিলেন। আজ যদি আপনি আপনার মহিষীকে নির্বাসন দেন, রামরাজ্যের কী হবে? মহিষীর সিংহাসন গ্রহণ করবে কে?
রাম। দেবী সীতা, দেবী সীতা গ্রহণ করবেন।
ভরত। কিন্তু তাঁকে তো আপনি নির্বাসন দিচ্ছেন আর্য।
রাম। বৎস ভরত, বৎস লক্ষ্মণ, বৎস শত্রুঘ্ন, তোমাদের ক্লেশ কি আমি বুঝি না? দেবীকে আমি নির্বাসন দেব না, নির্বাসন দেব তাঁর অবয়বকে। সীতা আমার রানি, তিনি আমার মনে থাকবেন, শত্রুঘ্ন রাজভাস্করকে খবর দিন, আমি সীতার কাঞ্চনপ্রতিমা প্রস্তুত করে আমার সিংহাসনের পাশে বসাবো, রাজকার্য চলবে।
শত্রুঘ্ন। দেবীর পরিবর্তে দেবীর প্রতিমা! (ভরত, লক্ষ্মণ ও শত্রুঘ্নের প্রস্থান, তাঁদের পিছন পিছন রামও যান)
নটী। এ নাটক কি এখানেই শেষ হল আর্য?
সূত্রধার। হ্যাঁ, আপাতত। ত্রেতায় তো এ ভাবেই হলো। এরপর তো রামের রাজত্ব চলবে না বেশি দিন, সরযূর পবিত্র জলে মৃত্যু বরণ করবেন রাম এবং তাঁর ভাইরা।
নটী। তার মানে এ নাটক বিয়োগান্ত?
সূত্রধার। হ্যাঁ, আর্যে! রামরাজ্য চাইলেন যাঁরা, দশরথ এবং সীতা, দুজনেই তো শেষ পর্যন্ত শুধুই প্রতিমা! তবুও রামরাজ্যের আদর্শ হয়তো বেঁচে থাকবে আদর্শেই। এই ত্রেতা থেকে দ্বাপর পেরিয়ে কলি পর্যন্ত! হয়তো কলিতেও রামরাজ্যের কথা বলে কোন একজন ― কলিতে হয়তো তিনি ব্রাহ্মণ বা ক্ষত্রিয় হবেন না ― হতে পারেন বৈশ্য অথবা
শুদ্রও, অথবা এমনকি এমনও হতে পারে যে নিজের মনের গভীরে তিনি ঘোরতর রামরাজ্যবিরোধী, কিন্তু মুখের ভাষায় এবং ভঙ্গীমায় চাইবেন রামরাজ্য, আর তাঁরও শেষ পর্যন্ত পরিণতি হবে প্রতিমায়!
নটী। আমাদের কী হবে? আমাদের নাটকের?
সূত্রধার। তখন যাঁরা রাজ্যের কর্ণধার হবেন, যাঁদের নির্দেশে আদর্শ ক্রমে ক্রমে পর্যবসিত হবে প্রতিমায়, তাঁরা যে নির্দেশ দেবেন, তা-ই মেনেই আমরা করব আমাদের নাটক, প্রতিমানাটক! আমরা তো নট-নটী, জীবনের বাইরে আর কী ভাবে যাব বল!