ছবি: রমিত
টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিসের তীরে
সনটা ১৯৭৮। একদিন একটা চিঠি পেয়ে অবাক হলাম। জীবনে অতর্কিতে কোনো কোনো ঘটনা ঘটে যা জীবনের গতিপথ পালটিয়ে দেয়। এমন অনিশ্চয়তার হাতছানি আমাকে আগেও ডাক দিয়েছে। কখনও এমন ঘটনা ঘটাবার জন্য সক্রিয় ভাবে কাজ করেছি এবং অন্তর দিয়ে আকাঙ্ক্ষা করেছি সে ঘটনা ঘটুক, আবার কখনও সে মনের অবচেতনে ঘুমিয়ে ছিল, হলে-কি-ভালো-না-হত-র মত ঘটনা।
ইতিমধ্যে জীবনের এই সময়ক্ষণে আমার মানসিক একটা স্থিতাবস্থা এসেছে। পাহাড়ী খরবেগ নদী এখন সমতলে এসে যেন স্বস্তি পেয়েছে। আমার পেশার আরো উচ্চস্তরে উঠা বা আরো স্বচ্ছল জীবন ধারণের উদ্যম আকাঙ্ক্ষা আমাকে আর আগের মত উত্তপ্ত করে রাখে না। নিজস্ব আবাসে নিশ্চিন্ত চাকুরিতে স্বচ্ছন্দ জীবন। আবার নতুন কোনো চ্যালেঞ্জ নেওয়ার আগ্রহ নেই আর।
চিঠিটা এসেছে সুইজারল্যান্ডের একটা কম্পিউটার কনসাল্টেন্সি কোম্পানি থেকে। তারা আমার সঙ্গে দেখা করতে চায়। কোনো এক এজেন্সি থেকে আমার নাম পেয়েছে। প্রফেসর কালিজুরি ঐ কোম্পানির পক্ষ থেকে লন্ডনে এসেছেন কিছু কম্পিউটার পেশাদারকে ইন্টারভিউ করবেন মধ্যপ্রাচ্যের এক দেশে কাজের জন্য।
আমি উৎসুক। জীবনে যখন যা আমার সামনে এসেছে তাকে আমি নেড়ে চেড়ে দেখেছি। কখনো কিছুকে সরিয়ে দিইনি, সে যেমনই হোক না কেন, ছোট বড়, সহজ কঠিন, আমার সাধ্যের মধ্যে বা আমার সীমানার বাইরে। সুতরাং প্রফেসর কালিজুরির সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। লন্ডনের একটা পাঁচতারা হোটেলে…কাজের পর সন্ধ্যা বেলা। প্রফেসর কালিজুরির সঙ্গে আরও একজন আছেন। তিনি প্রফেসর তাহিনি। দেশটা ইরান। কাজটা আবাদান ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজিতে। ওদের কম্পিউটার ইনস্টলেশনের ইন-চার্জ। প্রফেসর তাহানি ইউনিভার্সিটির কম্পিউটার ডিপার্টমেন্টের হেড। যথারীতি ইন্টারভিউ হল… অনেক টেকনিকাল প্রশ্ন, কিছু ব্যক্তিগত জীবন, আমার পেশাগত উচ্চাশা ইত্যাদি নিয়ে। ওঁরা বললেন আমি এখানকার কাজ ছেড়ে দিয়ে ওখানে গেলে ক্ষতিপূরণ স্বরূপ আমি কি কি সুযোগ সুবিধা পেতে পারি। সপরিবারে থাকার মত বড় বাংলো, ছেলেদের পড়াশুনার এবং দৈনন্দিন জীবন যাপনের খরচ ছাড়াও মাসিক মাইনে পাব যেটা সুইজারলান্ডের ব্যাঙ্কে জমা পড়বে। মাসিক মাইনের অংক যা বলল সেটা আমার তৎকালীন বেতনের তুলনায় কয়েক গুণ বেশি। সব মিলিয়ে অর্থনৈতিক ভাবে খুবই লোভনীয়। কিন্তু প্রস্তাব যেমনি হোক না কেন, আমি জানি, অনু রাজী হবে না। আর কাজটা আপাতত এক বছরের জন্য…অনিশ্চিত ভবিষ্যত। আমার এখানে একটা স্থায়ী চাকরি আছে। পরিচিত পরিবেশ। আত্মীয় বন্ধু বান্ধব নিয়ে একটা স্বচ্ছন্দ জীবন।
এসব ছেড়ে আবার নতুন একটা জীবন শুরু করতে দ্বিধা হচ্ছিল। কিন্তু আমার মধ্যে একটা বোহেমিয়ান, চঞ্চল, এডভেঞ্চারিস্ট সত্তা আছে সে বলতে শুরু করল---
‘ভয় পাচ্ছ কেন? এই তো কিছুদিন আগে স্ত্রী ও শিশু পুত্রের হাত ধরে কপর্দক শূন্য অবস্থায় ভারতবর্ষ ছেড়ে জাহাজে পাড়ি দিয়েছিলে, তবে আজ এত ভয় কেন? যা পেয়েছ তা হারানোর ভয়! আবার নতুন করে শুরু করার মত মনের জোর নেই আর। দ্বিতীয়বার যুদ্ধ করার সাহস নেই আর? আগে তো কখনো অজানাকে এতো ভয় করনি…।’
অনেক ভেবে প্রফেসর কালিজুরিকে সোজাসুজি ‘না’ বলতে ইচ্ছে করল না। তাই অন্য ভাবে ‘না’ বলার মত বললাম। ওকে একটা লম্বা ফর্দ দিলাম আমি কি চাই তা দিয়ে। সেটা আরো অনেক শর্ত দিয়ে, আরো অনেক বেশী মাইনে চেয়ে, অনেক বেশী সুযোগ সুবিধা চেয়ে। আমি জানি এতে ওরা কিছুতেই রাজী হবে না। সুতরাং আমাকে ওরা কিছুতেই মনোনীত করবে না। আমি ওদের অন্য ভাবে ‘না’ করলাম।
বাড়ি এসে অনুকে সব কথা বললাম। যা ভেবেছিলাম তাই হল। ও কিছুতেই লন্ডন ছেড়ে যেতে রাজী হল না। বলল, না করে দিয়েছ, ভালো করেছ।
তারপরে প্রফেসর কালিজুরি আর আমাকে ফোন করেনি বা কোন যোগাযোগ করে নি।
এ ঘটনার পর প্রায় ছ’মাস কেটে গেছে। হঠাৎ একদিন সন্ধেবেলায় একটা ফোন এল।
“হ্যালো মিস্টার বিসয়াস, হাউ আর ইয়ু? দিস ইস প্রফেসর কালিজুরি।”
আমি তো অবাক। এতকাল পরে প্রফেসর কালিজুরি! প্রফেসর বলল, “কয়েকদিনের জন্য লন্ডনে এসেছি। তোমার সঙ্গে একটু দেখা করতে চাই। কাল কি তোমার সময় হবে?” আমি কৌতূহলী; না করলাম না।
পরের দিন অফিসের কাজ সেরে প্রফেসর কালিজুরির হোটেলে গেলাম দেখা করতে। এবার আর ইন্টারভিউ রুম নয়। দেখি হোটেলের বিরাট লাউঞ্জের এক নিরিবিলি কোনে প্রফেসর কালিজুরি বসে আছে। আমাকে দেখে হাসিমুখে অভ্যর্থনা করল।
“গুড টু সি ইয়ু এগেন, মিস্টার বিসয়াস। কি ড্রিঙ্ক করবে বল।”
কথাবার্তা শুরু হল। বেশীরভাগই কম্পিউটার বিষয়ক, উন্নয়ন ও পরিবর্তনের গতি, ভবিষ্যতে কি হবে বা হতে পারে ইত্যাদি। প্রফেসর অত্যন্ত ভদ্রলোক, সদালাপী, কথা বলতে ভালোবাসেন। ড্রিঙ্ক ও স্ন্যাক্সের সঙ্গে গল্প কথায় মশগুল হয়ে গিয়েছিলাম। সব মিলে বেশ ভালো লাগছিলো, নরম পরিবেশ, শিথিল চিন্তাহীন মস্তিষ্ক।
হালকা আমেজে ভরেছে মন।
“শ্যাল আই গেট ইয়ু এনাদার ড্রিঙ্ক।“
গ্লাসের উপর হাত রেখে বললাম, আর না, এবার উঠব। আচমকা হঠাৎ প্রোফেসর কালিজুরি জ্যাকেটের পকেট থেকে একটা খাম বার করে আমার হাতে দিল। এতক্ষণ পরে কাজের কথা, বুঝলাম কি উদ্দেশ্যে এই মিটিং।
বলল, “দেখো, তুমি যা যা চেয়েছিলে তা সব আছে এখানে। সই করে দাও।”
আমি অবাক। কন্ট্রাক্ট পড়ে দেখি, সত্যি তাই। একটু চিন্তা করে বললাম, “আমি আমার ওয়াইফ-র সঙ্গে কথা না বলে সই করতে পারব না।"
প্রফেসর বলল, “আর সময় নেই, কাল ভোরেই আমি চলে যাচ্ছি। এখন সই না করলে আর হবে না।” প্রফেসর নাছোড়বান্দা।
সারাদিনের ক্লান্তির শেষে একটু ড্রিঙ্ক ও মেজাজি আড্ডার পর হাল্কা মস্তিষ্ক তখন কোনো গুরুত্ত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে প্রস্তুত ছিল না। নতুন জীবনের আহ্বান, এডভেঞ্চারের ইঙ্গিত, অর্থের প্রলোভন বনাম অনিশ্চিত ভবিষ্যত ও সম্ভাব্য বিপদ ইত্যাদি সব যুক্তিগুলো একসঙ্গে মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে লাগলো। অঙ্ক কষার সময় নেই। সিদ্ধান্ত একটা নিতেই হবে এবং সেটা এই মুহুর্তেই। সেই সন্ধিক্ষণে অর্থের লোভই জয়ী হল। প্রফেসর কলমটা এগিয়ে দিল। আমি কাগজে সই করলাম।
হোটেল থেকে বেরিয়ে ভাবতে শুরু করলাম --- এর পরের কাজটা আরো কঠিন। অনুকে রাজী করাতে হবে।
বাড়ি এসে অনুকে বুঝিয়ে বললাম। অনু রেগে গেল… আমাকে না জানিয়ে তুমি সই করলে কেন? গোমড়া মুখে রাত্রের খাওয়া শেষ হল। রাতের বিছানাতে আবার কথা হল এই নিয়ে। অনুর তখন অত রাগ নেই… যুক্তি দিয়ে ভালমন্দর বর্তমান ভবিষ্যতের খতিয়ান তৈরি করে বিশ্লেষণ করে কথা বলছি দুজনে।
বেশ কিছুক্ষণ পরে অনু বলল, “তুমি যখন সই করেই দিয়েছ তখন আর কি। ঠিক আছে, চল, আমি তোমার সঙ্গে আছি।”
স্বস্তিতে ক্লান্ত শরীর বিছনাতে আশ্রয় নিল, আস্তে আস্তে নিদ্রা এসে আমাকে আছন্ন করল।
এরপর অনেক ব্যস্ততার মধ্যে দিন কাটল। প্রায় প্রতিদিনই প্রফেসর কালিজুরির সঙ্গে কথা হয়… এটা চাই ওটা চাই। সুইস ব্যাঙ্কে একাউন্ট খুলতে হবে তার জন্য কাগজ পত্রে সই করতে হবে। তাছাড়া সঙ্গে কি কি মালপত্র যাবে তার একটা লিস্ট দিতে হবে। হারমোনিয়াম ছাড়া অনু যাবে না। বুবাই গৌতমের সাইকেলও নিয়ে যেতে হবে। প্রফেসর আপত্তি করে নি কিছুতে। যাওয়ার দিন ঠিক হয়ে গেলে টিকিট কাটার সময় প্রফেসর কালিজুরিকে ফোন করে বললাম, এ বছর আমি এখনো কোনো হলিডে নিই নি। এক সপ্তাহ কোথাও ছুটি কাটাতে চাই।
প্রফেসর বলল, “ঠিক আছে। যাওয়ার পথে কয়েক দিন ছুটি কাটিও। সেটা কোনো সমস্যা নয়। আবাদান যাওয়ার পথে কোথাও একটা ব্রেক নিয়ে নিয়ো। “
আমরা ঠিক করলাম গ্রিসের এথেন্স শহরে এক সপ্তাহ কাটিয়ে যাব।
আমরা তখন সাউথ হ্যারোতে একটা সেমি-ডিটাচড বাড়িতে থাকি। বাড়িটা ভাড়া দিয়ে যাওয়ার কথা ভাবছি। আশ্চর্য যোগাযোগ, এক ইরানি পরিবার বাড়িটা ভাড়া নিল।
গ্রিস সভ্যতার পীঠস্থান। কত কিছু দেখার আছে। ছবিতে পার্থেনন দেখেছি। পার্থেনন নিয়ে কবিতা লিখেছি। সেখানে দাঁড়িয়ে এক অদ্ভুত অনুভুতি হল। পার্থেননের ভগ্নাবেশের উপর দাঁড়িয়ে প্রাচীন গ্রিক স্থপতির বিশালত্বে মুগ্ধ না হয়ে পারিনি। কতক্ষণ যে আমি সেখানে ছিলাম মনে নেই; বোধ হয় অনন্তকাল!
পার্থেনন
সেটা গ্রীষ্ম কাল। এথেন্স শহরে প্রচণ্ড গরম, কলকাতাকেও হার মানায়। ঘুরে ঘুরে শহর দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে পড়লাম, পিপাসায় গলা শুকিয়ে আসছে। একটা ফলের দোকানের দেখি সাজানো আছে চকচকে গোল গোল পিচ। দেখে লোভ হল। আমরা কয়েকটা পিচ কিনলাম। কামড় দিয়ে অবাক হলাম; নরম, মিষ্টি আর অত্যন্ত রসাল। অতি সুস্বাদু, গাল থেকে গড়িয়ে রস পড়ল জামায়। তৃষ্ণা মিটল। তৃপ্ত হলাম। আমের পর পিচ আমার প্রিয় ফল। জীবনে অনেক পিচ খেয়েছি তারপর, কিন্তু অত রসাল নরম মিষ্টি পিচ উপভোগ করিনি কখনো। সব ভুলে গেলেও শুধু এই একটা কারণেই গ্রিস আমার মনে থাকবে চিরদিনের জন্য।
আমরা সকলে মিলে সমুদ্রে জাহাজে করে জল ভ্রমণে বের হলাম। আসে পাশে সুন্দর ছোট ছোট দ্বীপ। সে দ্বীপগুলো সমতল নয়--- নিচু নিচু পাহাড়ে ভরা। আর সেই সব পাহাড়ের উপর ছোট ছোট বাড়ি। সব বাড়িগুলোর রং শ্বেত শুভ্র। কদাচিৎ দুএকটা বাড়ি হাল্কা রঙের। জাহাজ থেকে সেই দ্বীপগুলো অপরূপ সুন্দর দেখাচ্ছিল – যেন কোন স্বপ্নপুরী!
গ্রিসের চারিদিক ঘিরে অসংখ্য দ্বীপ ছড়িয়ে আছে। নীচে দুটো দ্বীপের ছবি দিলাম।
একটি গ্রিক দ্বীপ
অপূর্ব সুন্দর আরো একটি ছোট গ্রিক দ্বীপ
গ্রিসের সে ক’টা দিন আমার কাছে অবিস্মরণীয় হয়ে আছে।
গ্রিসে সাত দিন কাটিয়ে আবাদান, ইরানে পৌঁছলাম। আমরা আসার সাত দিন আগেই মালপত্র পৌঁছে গিয়েছিল। ইরান মরুভূমির দেশ। দিনে প্রখর সূর্য, প্রচন্ড তপ্ত আবহাওয়া। সেই কাঠফাটা রোদে আমাদের জিনিসপত্র সব এয়ারপোর্টের বাইরে পড়ে ছিল সাত দিন। যাদের এ-সব কাস্টমস ক্লিয়ারিং করে আমাদের বাংলোতে রেখে দেওয়ার কথা ছিল যে কোনো কারণেই হোক তারা সেটা করেনি। সত্যিই কাঠফাটা রোদ; অনুর হারমনিয়ামটা ফাটিয়ে দিয়েছিল। অনুর মনটা খারাপ হয়ে গেল। হারমোনিয়ামটা থেকে আগের মত আর শ্রুতিমধুর আওয়াজ বার হত না।
এলেম নতুন দেশে। ডঃ তাহানি আমাদের অভ্যর্থনা করলেন। কিন্তু কর্তৃপক্ষ আমাদের পাসপোর্ট গুলো নিয়ে রেখে দিলো। জিগ্যেস করেছিলাম কেন। উত্তর এসেছিল নিরাপত্তার কারণে। অনেক পরে আসল কারণ জানতে পেরেছিলাম। আমাদের মত এক এক জনকে বিদেশ থেকে নিয়ে আসতে অনেক পরিশ্রম ও অর্থ ব্যায় হয় ওদের। নতুন আগন্তুকের যদি এই কাজ বা এই দেশ ভাল না লাগে তবে সে কয়েক দিনের মধ্যেই ফিরে যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে এদের অনেক সময় নষ্ট ও অর্থ ক্ষতি হতে পারে। তাই এরা পাসপোর্ট রেখে দেয়।
ইরান সম্পর্কে কিছু পড়াশুনা করেছিলাম আসার আগে। কিন্তু আবাদানে আমরা যেখানে থাকতাম তার সঙ্গে ইরানের অন্য কোনো শহরের কোনো সাদৃশ্য নেই। চোখ বন্ধ করে কাউকে যদি এখানে ছেড়ে দেওয়া যায় তবে সে অনায়াসে ইয়ুরোপের কোনো শহরতলি বলে ভুল করতে পারে। এটা বৃহত্তর আবাদান অঞ্চলের পাচিল দিয়ে ঘেরা এক অংশ। প্রায় চার পাঁচশ (ঠিক জানিনা কত গুলো) বাংলো, দোকান পাট, স্কুল কলেজ, হাসপাতাল, ক্লাব, লাইব্রেরী, মায় নিজস্ব বন্দর নিয়ে এই বসতি। এক স্বয়ং সম্পুর্ণ আধুনিক শহর। এক প্রান্তে আছে বিশাল অয়েল রিফাইনারি অন্যপ্রান্তে আবাদান ইন্সটিটিউট অফ টেকনলজি যার অন্য পরিচয় এ আই টি।
Abadan Institute of Technology, এ আই টি
অয়েল বা পেট্রলিয়াম ইন্ডাস্ট্রি অথবা আই ও সি (Iranian Oil Company, I O C) থেকে যা আয় হয় প্রায় তাই দিয়েই ইরানের রাজত্ব চলে। আই ও সি এবং এ আই টি-তে প্রচুর অ-ইরানীয় বিদেশীরা কাজ করে। মূলতঃ তাদের বসবাসের জন্যই তৈরি হয়েছিল এই বসতি। এখন অবশ্য উচ্চপদস্থ ইরানীয় কর্মীরাও এখানে বাংলো পায়। ইরানের রাজা রেজা শাহ। আমেরিকা শাহ-র বন্ধু, অন্য অর্থে উপদেষ্টা ও রক্ষকও বটে। তাই আই ও সি এবং এ আই টি তে আমেরিকানরাই সংখ্যা গরিষ্ঠ।
আমার লেখাতে আমি আবাদানের এই অঞ্চলটাকেই আবাদান বলে উল্লেখ করব। আসলে এটা আই ও সি আর এ আই টি-র ক্যাম্পাস। সারা ক্যাম্পাসটা বিভিন্ন সেক্টরে ভাগ করা। ছোট বড় মাঝারি বাংলো আর ফ্ল্যাটবাড়ি দিয়ে সেকটরগুলো ভাগ করা। পদমর্যাদা অনুযায়ী বাসস্থান বন্টন করা হয়। আমার বাংলোটা বেশ বড়, মনে হয় উঁচু দিকের সেক্টরেই এর অবস্থান। সব বাংলোই শীতাতপনিয়ন্ত্রিত। পাইপের মধ্যে দিয়ে ঠান্ডা হাওয়া আসত দূর কোনো এয়ারকন্ডিশন প্লান্ট থেকে।
পৃথিবীর বহু দেশ থেকে এরা শিক্ষক, অধ্যাপক, ডাক্তার, ইঞ্জিনীয়ার, দক্ষ কারিগর ও বিশেষজ্ঞদের এনেছে এদের দেশকে সমৃদ্ধ করতে। এটা যেন একটা ছোট ইয়ুনেস্কো। একটা বড় সংখ্যা ভারতীয় – ভারতবর্ষ থেকে আসা ভারতীয়। এদের বেশীরভাগই পেশায় ডাক্তার এবং দক্ষিণ ভারতীয়। এদের একটা সামাজিক গোষ্ঠী আছে। প্রায় প্রতি সপ্তাহ শেষের সন্ধ্যায় কারো না কারোর বাড়িতে আড্ডা বসে – সেখানেই রাত্রের ভোজন শেষ করে সবাই বাড়ি ফেরে। এরাই অনেক দিনের পরিচিত বন্ধুর মত আমাদের আপন করে নিল। আমরাও এই দলের সামিল হয়ে গেলাম। এদেরি মধ্যে তিন পরিবারের সঙ্গে আমাদের ঘনিষ্ঠতা গভীর হয়ে গিয়েছিল। শর্মা পরিবার, রাইডু পরিবার ও রাজু-রাধা দম্পতি। ডঃ শর্মা এ আই টির অঙ্কের অধ্যাপক, আমেরিকা থেকে এসেছেন, ইউপির মানুষ। ডঃ রাইডু এখানকার হাসপাতালের ডাক্তার, অন্ধ্র প্রদেশ থেকে এসেছেন। আর রাজু ইঞ্জিনীয়ার, মাড্রাস থেকে এসেছেন।
ডঃ রাইডুর বাড়িতে ব্যাডমিন্টন কোর্ট আছে। প্রতিদিন সূর্য ডোবার পর ডঃ শর্মা ও আমি ব্যাডমিন্টন খেলতে যেতাম ডঃ রাইডুর বাড়িতে। এটা প্রায় নেশার মত হয়েগিয়েছিল। অনু যেখানে আছে গান সেখানে আছে। অনুর গানের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল। দুচার জন বন্ধু ওর গানের অনুরাগী হয়ে গেল। আমাদের বাংলোয় তাই প্রায়ই গানের আসর বসতো। এমনি করে দিন গুলো ভালই কাটছিলো। লন্ডন ছেড়ে আবাদান জীবন তখন আর তত অসহনীয় বলে মনে হচ্ছিলো না। কিন্তু হঠাৎ পরিস্থিতির পরিবর্তন হতে শুরু করল।
আমি যখন ইরান যাত্রার পরিকল্পনা করছি তখনই ইরানে রাজনৈতিক ডামাডোল শুরু হয়ে গিয়েছে। বন্ধু বান্ধবরা ভয় দেখিয়েছিল, আত্মীয় স্বজনরা ‘না’ করেছিল। শাহ আমেরিকার মদতে কঠোর হাতে রাজত্ব শাসন করছে। আর অন্য দিকে প্যারিস থেকে আয়াতোল্লা খোমেনি ধর্মীয় বিপ্লবের ইন্ধন যোগাচ্ছে। আয়াতোল্লার অগ্নিগর্ভ বক্তৃতার ক্যাসেট মসজিদে মসজিদে বাজতে থাকল। প্রায়ই পুলিশের সঙ্গে জনতার ছোট ছোট সংঘর্ষ হতে থাকল। শাহ-র গোপন বাহিনী (secret service) দুদ্ধর্ষ ও নির্মম। এদের নাম সাভাক। এরা সমাজের সব স্তরে ভাইরাসের মত মিশে গেছে। কে যে সাভাকের চর আর কে যে না, তা কেউ জানে না। স্বামী জানে না স্ত্রী সাভাকের চর কি না, স্ত্রী জানে না স্বামী কি না। বন্ধু বন্ধুর সঙ্গে প্রাণ খুলে কথা বলতে ভয় পায়।
আমি তখন সবে কাজ শুরু করেছি। টি ব্রেক-র সময় ডঃ শর্মার সঙ্গে লাউঞ্জে গিয়ে চা নিয়ে বসেছি। আরো দু এক জন এসে যোগ দিল আমাদের চায়ের টেবিলে। এ ঘরটা বেশ বড়। প্রায় গোটা তিরিশেক সোফা আছে। চারটে পাঁচটা সোফার মাঝখানে একটা করে কফি টেবিল --- এমনি করে সাজানো লাউঞ্জ। প্রত্যেক টেবিলেই চা বা কফি পান করতে করতে নীচু স্বরে আলাপ আলোচনা চলছে। আমি সদ্য এসেছি এদেশে। কোনো এক আলোচনার মধ্যে আমি বুঝি খুবই হাল্কা ভাবে ইরানের তাৎক্ষনিক রাজনীতি নিয়ে কিছু একটা মন্তব্য করেছি। হঠাৎ সারা লাউঞ্জটা নিশ্চুপ হয়ে গেল। একে একে আস্তে আস্তে সকলে উঠে গেল। ডঃ শর্মা তড়িৎ বেগে উঠে যেন আমাকে সাপের ছোবল থেকে বাঁচাতে চেয়ে হাত ধরে টেনে বাইরে চলে এলেন। সমস্ত ঘটনা মুহুর্তের মধ্যে ঘটে গেল। বাইরে বেরিয়ে ভাল করে শ্বাস নিয়ে আমাকে বললেন, আর কখনো কোথাও ইরানের রাজনীতি নিয়ে বিশেষ করে শাহ-র নাম করে কোনো মন্তব্য করবেন না।
তারপরে যা গল্প শোনালেন তা শুনে আমার চক্ষু চড়ক গাছ। শিরাজ ইউনিভার্সিটির এক অধ্যাপক দম্পতির গল্প বললেন ডঃ শর্মা। মধ্য রাত্রে অধ্যাপকের বাড়ির দরজায় টোকা পড়ল। সাভাক পদধুলি দিয়েছে। তারা অধ্যাপকের হাতে কতকগুলো কাগজ ধরিয়ে দিল। এই তোমাদের পাসপোর্ট আর তোমাদের প্লেনের টিকিট। কাল ভোরে তোমাদের প্লেন। ঘুম চোখে অধ্যাপক ঠিক বুঝলেন না কি বলল ওরা। কি করেছে ওরা যে কয়েক ঘন্টার মধ্যে দেশ ছেড়ে চলে হবে। কোনো উত্তর নেই, কোনো ব্যাখ্যা নেই। নিশ্চয়ই উনি কোথাও কিছু বলেছেন যা সাভাকের পছন্দ হয়নি। এটাই নিয়ম। স্থানীয় কেউ হলে তাকে গারদে পোরা হত। বিদেশি বলে তাকে দেশ থেকে বিতাড়িত করা হল। আমার শিক্ষা হল। রাজনীতি নিয়ে আর কোনো কথা নয়।
এ আই টি-র কম্পিউটার ডিপার্টমেন্টের হেড ডঃ তাহানি। তিনিই আমাকে লন্ডন থেকে মনোনীত করে নিয়োগ করেছেন। এদের একটা আমেরিকান কোম্পানি ইয়ুনিভ্যাকের কম্পিউটার ইনস্টলেশন (Installation) আছে। সেই কম্পিউটা সিস্টেম-র রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনার দায়িত্ব আমার। এ আই টি-র চাহিদার থেকে এ মেশিনের কার্য ক্ষমতা অনেক বেশী। সুতরাং এ মেশিনের অব্যবহৃত ক্ষমতা এ আই টি বাইরের সংস্থাকে অর্থের বিনিময়ে ব্যবহার করতে দিত। আমি ইউনিভার্সিটির বাইরের এই সব সংস্থার কাছেও দায়বদ্ধ ছিলাম।
আমার ডিপার্টমেন্টে মূলত অপারেশন স্টাফ ছাড়াও হার্ডওয়ার ইঞ্জিনীয়ার, প্রোগ্রামার, সেক্রেটারি ও কয়েকজন করণিক ছিল। প্রধান অপারেটার হ্যারল্ড, ইংরেজ ভদ্রলোক, আমারই মত ইংল্যান্ড থেকে এসেছেন। অভিজ্ঞ, বয়স প্রায় ছয় দশক পার হয়ে গেছে। অনেক বছর হল এ আই টি তে এই পদে কাজ করছেন। আবাদানে তিনি একাই থাকেন। স্ত্রী থাকেন ইংল্যান্ডে। যত দূর মনে পড়ছে তার পুত্র কন্যার সংখ্যা সাত। কনিষ্ঠ পুত্র ছাড়া সকলেই পিতৃ আবাস ত্যাগ করেছে। হ্যারোল্ডের বন্ধু বান্ধব বেশি কেউ নেই। একা থাকতেই ভালবাসেন, কারো সাতে পাঁচে নেই। হ্যারোল্ড আমাকে এ আই টি সমন্ধে অনেক উপকারী উপদেশ দিয়েছিলেন – কি করা উচিত, কি করা উচিত নয়, কি বা কাকে এড়িয়ে চলা উচিত। জানতে পারলাম হ্যারোল্ড দাবা খেলতে ভালোবাসেন। সুতরাং আমাদের বন্ধুত্বের আরো একটি সূত্র দৃঢ় হল। ওর বাড়িতে আমি মাঝে মাঝে দাবা খেলতে যেতাম। এক বিচিত্র চরিত্রের মানুষ।
অনেকদিন হল এই কম্পিউটার সিস্টেম আধুনিকরণ (update) করা হয় নি। ডঃ তাহানি চাপ দিচ্ছিলেন যত শীঘ্র সম্ভব সেটা করার জন্য। সেটা করতে গেলে আমাকে কিছু তথ্য সংগ্রহ করা দরকার ইয়ুনিভ্যাকের হেড অফিস থেকে। ইরানে ইয়ুনিভ্যাকের হেড অফিস তেহেরান শহরে। আমি তেহেরানে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলাম।
বিপ্লবের আগুন তখন ধিকি ধিকি জ্বলছে। একটি দুটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া কোথাও তখনো প্রকট ভাবে দেখা দেয় নি। চারিদিকে একটা গুমোট আবহাওয়া ছাড়া আমাদের দৈনন্দিন জীবনে কোনো ব্যাতিক্রম নেই। একদিন অনু বুবাই গৌতমকে রেখে আমি তেহেরানের পথে প্লেনে উঠলাম।
তেহেরানে অফিসের কাজ দুদিনে শেষ হয়ে গেল। তেহেরানে এসে দুদিনই অফিসের মধ্যেই বদ্ধ ছিলাম। রাত্রে রেস্তোরায় ডিনার খেতে যাওয়া ছাড়া শহরের কিছুই দেখা হয় নি। অফিসের এক সহকর্মী বন্ধু স্টিভ আমাকে প্রস্তাব দিল। “আরো দু এক দিন তেহেরানে থেকে যাও, শহরটা ঘুরে দেখ। হোটেল ছেড়ে দাও। আমাদের ফ্ল্যাটে আমাদের সঙ্গে থাকো।” সত্যিই তো, এত দূরে এসে বিখ্যাত তেহেরান শহরটা আবিষ্কার না করেই ফিরে যাব!
লোভনীয় প্রস্তাব। মনস্থির করতে বেশী সময় নষ্ট হয়নি। আমি রাজি হয়ে গেলাম। হোটেল ছেড়ে স্টিভের ফ্ল্যাটে গিয়ে উঠলাম। প্রশস্ত ফ্ল্যাট, স্টিভ ও তার গার্ল ফ্রেন্ড দুজন বাসিন্দা। অবশ্য আরো এক প্রাণী থাকে ওদের সঙ্গে। একটি সুন্দর আদর করার মত সাদা বিড়াল। আমার জন্য বাথরুম সহ সাজানো এক ঘর। শুধু একটা ব্যাপারে অস্বস্তি বোধ করতে লাগলাম। বসার ঘরে ও বারান্দার এখানে সেখানে ছড়ানো ক্যাট লিটার। যা হোক আমি আর বাড়ি থাকব কতক্ষণ। আমি বেড়াতে বের হলাম।
১৯৭০-র তেহেরান
তেহেরান শহরটা খুব সুন্দর ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। বড় বড় রাস্তা, তার দুধারে গাছ গাছারিতে তে ভরা। একটাই বিরাট প্রধান রাস্তা শহরের বুক চিরে। সেই রাস্তার পাশ দিয়ে এক জলের ধারা, একটা ছোট খাল বা বড় নালার মত। এর জলই এই শহরের প্রধান জলের উৎস। এটা পাহাড়ের উপর থেকে নীচে নেমেছে। উপরের জল স্বচ্ছ পরিষ্কার। জলের ধারা যত নীচে নেমেছে জল তত ঘোলা অপরিষ্কার হয়ে গেছে। উপরে যারা থাকে তারা এই জল পানীয় হিসেবে ব্যাবহার করতে পারে কিন্তু নীচের বসবাসী কাপড় কাচা ছাড়া আর কিছু করতে পারে না।
ঘুরতে ঘুরতে তেহেরানের এক হস্তশিল্প বিপনি কেন্দ্রে গিয়ে থামলাম। অনেক কিছু কিনতে ইচ্ছা করছিল। কিন্তু ইচ্ছার অনেক সামগ্রীই আমার সামর্থ্যের বাইরে বা বহনযোগ্য নয়। আমি অনেক দেশই ভ্রমণ করেছি আর যেখানেই গেছি সে স্থানের কিছু দ্রব্য স্মৃতি স্বরূপ কোনো অভিজ্ঞান নিয়ে রেখেছি। তেহেরান থেকে শূণ্য হাতে ফেরার ইচ্ছা নেই। কাঠের উপর উটের অস্তি বসিয়ে কাজ করা এক বাদ্যরত যুবক যুবতীর ছবি -- শিল্প দেখে আমার ভালো লাগল।
তেহেরানে কেনা সেই শিল্প সামগ্রী
সেটা কিনলাম। এটি এখন আমাদের লন্ডনের নর্থউইক এভেনুএর বাড়িতে বসার ঘরের দেওয়ালে ঝোলানো আছে। এই ছবিটার সঙ্গে আমার আরো এক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। সে এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতা, প্রায় মৃত্যুর মুখোমুখি। পরে বলছি।
ক্রমশঃ