ছবি: রমিত
অরিন্দম চক্রবর্তী
লন্ডনে কফি হাউসের মত আড্ডা গড়ে ওঠেনি। তেমন করে মনের মিলন হয়নি কারো সঙ্গেই, তাই গভীর বন্ধুত্বের সুত্রপাত হয়নি কোথাও। তবু পরিচিত হয়ে, কথা বলে, যে গুটিকয় মানুষের সংস্পর্শে এসে আনন্দ পেয়েছি তাদের নাম উল্লেখ না করলে আমার এ লেখা অসম্পুর্ণ থেকে যাবে।
আমার অনুজ প্রতিম এক বন্ধু, ডাঃ দেবাশিস বিশ্বাস, একদিন আমাকে বলল, “দাদা, চন্দনদাকে তোমার কথা বলেছি। চন্দনদা বলেছে তোমার সঙ্গে দেখা করতে আসবে একদিন।” চন্দন মানে অরিন্দম চক্রবর্তী। দেবাশিস আমাকে অরিন্দমের সঙ্গে পরিচয় করে দিয়েছিল। অরিন্দম মেধাবী কৃতি ছাত্র, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঈশান স্কলার, গান গায়, ছবি আঁকে, কবিতা লেখে, নামী ও উঁচু মানের সাহিত্য পত্রিকায় তার প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। দর্শন শাস্ত্রের অধ্যাপক; সম্প্রতি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার কাজ নিয়ে লন্ডনে এসেছে। এক আধারে এত গুণ, এমন মানুষ বিরল; এমন মানুষের সঙ্গ কে না চায়। অরিন্দম লন্ডনে নাকি কথা বলার লোক পাচ্ছে না। দেবাশিস আমার কথা বলায় আমার সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে।
এক বিকালে দরজায় ঘন্টা বাজল। দরজা খুলে দেখি শ্মশ্রুশোভিত, দীর্ঘকেশ, ধুতি-পাঞ্জাবী পরিহিত এক যুবক। অচকিতে ঢিপ করে একটা প্রণাম করে বলল, “আমি আরিন্দম চক্রবর্তী।” আমি বললাম, “জানি, দেবাশিস আমাকে তোমার কথা বলেছে। ভিতরে এসো।” অনুর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলাম। সেই শুরু; আমরা হয়ে গেলাম ওর অনেক দিনের দাদা-বৌদি। তারপর প্রায় প্রতি শুক্রবার সন্ধ্যায় আসত আমাদের বাড়ি। আমরা তিনজনে গানে গল্পে অনেক সময় কাটিয়েছি। মোটামুটি আমাদের আড্ডার উপাদান ছিল, গান, কবিতা,সাহিত্য, আমাদের জীবনের অভিজ্ঞতা আর ছিল দর্শনের প্রথম পাঠ, যেখানে আমি শুধুই শ্রোতা। বাংলা আধুনিক কবিদের মধ্যে সুধীন দত্ত আমার প্রিয় কবি। লন্ডনে আসার পর আধুনিক বাংলা কবিতা বা সুধীন দত্তের কবিতা নিয়ে আলোচনা করার বা পড়ার সুযোগ হয় নি। কবিতার আলোচনায় একদিন অরিন্দম অনর্গল সুধীন দত্তের “শাশ্বতী” আবৃত্তি করে শোনাল।
“একটি কথার দ্বিধাথরথর চূড়ে
ভর করেছিল সাতটি অমরাবতী;
একটি নিমেষ দাঁড়াল সরণী জুড়ে
থামিল কালের চিরচঞ্চল গতি;
একটি পণের অমিত প্রগলভতা
মর্ত্যে আনিল ধ্রুবতারকারে ধরে;
একটি স্মৃতির মানুষী দুর্বলতা
প্রলয়ের পথ ছেড়ে দিল অকাতরে।।”
আমি অবাক হলাম, রোমাঞ্চিত হলাম, আনন্দিত হলাম। স্বস্তি পেলাম, সুধীন দত্ত পড়া আরো একজনকে খুঁজে পেলাম। অরিন্দমের সঙ্গে তাহলে আমার সময় কাটাতে কোনো অসুবিধা হবে না।
বাসা বদলের অন্তবর্তিকালে বেশ কিছুদিন অরিন্দম আমদের বাড়িতে ছিল। সেদিন গুলো আমাদের স্মরণীয় দিন। সকালে উঠে অরিন্দম হারমোনিয়ামটা টেনে নিয়ে গান গাইতে বসত। অনু তাতে যোগ দিত। আমি একমাত্র শ্রোতা। কখনো অনু বলে উঠত, চন্দন আমাকে তোমার ওই গানটা শিখিয়ে দেবে? অরিন্দম মহা উৎসাহে বৌদিকে গান শেখাতে বসত। দুজনে মিলে ঘন্টার পর ঘন্টা গান গাইত। তারপর হঠাৎ অনু উঠে পড়ে বলত, “ইস, অনেক দেরী হয়ে গেল। এবার তো খাবার ব্যবস্থা করতে হবে।”
অরিন্দম গান করতে ভালবাসত। সন্ধ্যে বেলাতেও গানের আসর বসত। বুবাই এলে অরিন্দম, বুবাই, অনু মিলে আড্ডাটা জমত খুব।
লেখক, অরিন্দম (হারমোনিয়াম), বুবাই ( তবলা)
চন্দন অরিন্দমের ডাক নাম। প্রথম দিন থেকেই আমরা ওকে ওই নামেই ডেকেছি। বুবাই (অংশুমান) আমার পুত্র।
কোনো কোনো দিন এমন হয়েছে, আমরা তিনজন, অনু আমি চন্দন, বসে গল্প করছি তখন হঠাৎ বাড়িতে কোনো বন্ধু এসে পড়েছে। অরিন্দম কোন একটা অজুহাত দেখিয়ে উপরে নিজের ঘরে চলে যেত। অরিন্দম, সাধারণ অর্থে আমরা যাকে আড্ডা বলি, গল্প গুজব, গাড়ি বাড়ি, চাকুরি ইত্যাদি নিয়ে কথা বার্তা বলা, তেমন আড্ডা পছন্দ করত না। এক কথায় অরিন্দম আড্ডাবাজ মিশুকে লোক ছিল না। শুধু একটি ব্যতিক্রম ছিল। যখন কবিরাজ দম্পতি (সুদীপ্ত ও নীলাঞ্জনা কবিরাজ) আসত তখন আর ও উঠত না; আমাদের পাঁচজনের আড্ডা তখন অন্য ধারায় নির্ঝরিণীর মত ঝরত। সেই আড্ডায় প্রায়শঃই আমি ছিলাম নিছক শ্রোতা। অরিন্দম ও সুদীপ্ত দুজনে দর্শন ও সংস্কৃত রস শাস্ত্র, অভিনব গুপ্ত চর্চায়, এমন মত্ত হয়ে যেত যে সেখানে আমার প্রবেশাধিকারের সুযোগ থাকত না। ওদের আলোচ্য বিষয়ে আমার ভাল পড়াশুনা ছিল না, আর ওদের পান্ডিত্যের কাছাকাছি যাওয়ার ধৃষ্টতাও ছিল না আমার।
অরিন্দম সংস্কৃত ভাষায় দক্ষ। শুনেছিলাম ওর যখন একুশ বাইশ বছর বয়স তখন সর্ব ভারতীয় সংস্কৃত ভাষা সম্মেলনের সেক্রেটারী বা ওই রকম কোন এক গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিল। সংস্কৃত ভাষায় অরিন্দম অনায়াসে কথোপকথন করতে পারত। আমার অনেক ইচ্ছার মধ্যে একটা ইচ্ছা ছিল সংস্কৃত ভাষায় উপনিষদ পড়ার। অরিন্দমকে বললাম, “আমাকে উপনিষদ পড়াবে ?” ও রাজী হল, তবে একটা শর্ত আছে। ও যা পড়া দেবে সেগুলো আমাকে তৈরী করতে হবে। কঠিন শর্ত। শেষ পর্যন্ত আমাদের পাঠশালা দিনের আলো দেখেনি। অরিন্দমের সময়ের অভাব ছিল; আর আমারও ইচ্ছা যত ছিল উদ্যোগ ছিল না তত।
কিছুদিন পরে আমাদের বাড়ি ছেড়ে ও নিজে একটা আলাদা ফ্ল্যাট নিয়ে চলে যায়। অরিন্দম আমাদের বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার পর অনেকদিন পর্যন্ত আমাদের যোগাযোগ ছিল চিঠি পত্রের মাধ্যমে। মাঝে মাঝে ও কবিতা লিখে পাঠাতো; আমিও কবিতায় তার উত্তর দিতাম। দু-একটা চিঠি তুলে দিলাম নীচে।
বিদ্যোৎসমাজ ও সংগীত জগতের অনেক গুণী ও ওস্তাদ-পন্ডিতদের সঙ্গে অরিন্দমের আলাপ পরিচয় ছিল। ও হঠাৎ হঠাৎ তাঁদের কোন একজন নিয়ে আমাদের বাড়ি চলে আসত। একদিন হঠাৎ দুজন অতিথি সঙ্গে নিয়ে চলে এল। অধ্যাপক ও সঙ্গীতজ্ঞ মুকুন্দ লাট আর অল ইন্ডিয়া রেডিওর মিউজিক ডাইরেক্টর ওস্তাদ হাফিজ আমেদ খান। খান সাহেব গান শুনালেন অনেক; মুকুন্দ লাট মহাশয়ও। সঙ্গে যোগ দিয়ে ছিল অরিন্দম আর অনু।
অরিন্দম, মুকুন্দ লাট, ওস্তাদ হাফিজ আমেদ খান ও অরুন্ধতী
ওস্তাদ হাফিজ আমেদ খান
খান সাহেব অতি ভদ্র ও বিনয়ী। অনুকে মা বলে সম্বোধন করলেন। তাঁর গলা ও গান অতি উচ্চমার্গের। খান সাহেবের ভারী ও গভীর গলার তান আলাপে সে সন্ধ্যা স্বপ্নময় হয়ে উঠেছিল। আরো ভালো লাগছিল কেন না এর জন্য আমরা প্রস্তুত ছিলাম না– হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতো এসে আমাদের চমৎকৃত করেছিল। গান আর গল্প করতে করতে রাত হয়ে গেল। অনু রাত্রের খাওয়ার জন্য অনুরোধ করল। উত্তরে খান সাহেব বাঙালি মায়ের হাতে লুচি খাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। অনু তাড়াতাড়ি উঠে রান্নাঘরে উধাও হল।
কিছুদিন আমাদের বাড়ি থাকার পর অরিন্দম রিচমন্ডে টেমসের তীরে একটা ফ্ল্যাটে চলে গেল। আমার গাড়িতে জিনিষ পত্র ভর্তি করে ওকে রিচমন্ডে পৌঁছে দিলাম। চলে যাওয়ার পরেও নিয়মিত আমাদের কাছে আসত; আমরাও রিচমন্ডে যেতাম, সকলে মিলে টেমসের পাড়ে ঘুরে বেড়াতাম। এমনি করে অরিন্দম সংসর্গে দিনগুলো ভালই কাটছিল। হঠাৎ একদিন জানাল, ও আমেরিকার হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার কাজ নিয়েছে; লন্ডন ছেড়ে চলে যাবে। শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল।
চলে য়াওয়ার পরেও চিঠি পত্রের মাধ্যমে বেশ যোগাযোগ ছিল। লন্ডনে এলে দেখা করত। একদিন হঠাৎ একটা ফোন পেলাম, “দাদা, কেমন আছেন। আমি কেম্ব্রিজ ইউনিভার্সিটিতে এসেছি – ভিজিটিং ফেলো হিসেবে।” দু-একটা কথার পর বলল, “ট্রিনিটি কলেজে হাই টেবিলে ডিনারে আমি আপনাকে নিমন্ত্রণ করছি। বৌদিকে নিয়ে আসবেন। আপনাকে কিন্তু ভাল স্যুট পরে আসতে হবে, আর বৌদিকে বলবেন একটা ভাল শাড়ি পরতে। অবশ্যই আসতে হবে কিন্তু।”
আমি তো অবাক। ট্রিনিটি কলেজে হাই টেবিলে ডিনার! আরো অবাক হলাম ওর পোষাক-পরিচ্ছদের ফরমাইশ শুনে। নিজে তো মালকোঁচা বাঁধা ধুতি আর মোটা পাঞ্জাবী পরে ঘুরে বেড়ায়। অন্য কোনো পোষাকে ওকে দেখিনি কখনো- বাকিংহাম প্যালেসে ডিনার হলেও বোধ হয় ওই পোষাকেই হাজির হবে। তবে আমাদের জন্য এমন কড়া নির্দেশ কেন?
ইতিমধ্যে হাই টেবিল ডিনার ব্যাপারটা কী তা জেনেছি। ডিনার হলে ছাত্রদের সঙ্গে কয়েকজন অধ্যাপক ও বিশেষ অতিথিও আহার করেন। কিন্তু সে টেবিলটা একটা উঁচু বেদীর উপর আড়াআড়ি ভাবে রাখা থাকে। একটাই টেবিল এবং তাতে মাত্র আট দশটি চেয়ার থাকে। এই টেবিলের মেনু বা খাদ্যতালিকাও ছাত্রদের খাদ্যতালিকা থেকে আলাদা। এটি একটা বিশেষ টেবিল।
ডিনারের সময় ছিল বোধহয় সন্ধ্যা ছ’টা। অরিন্দম বলেছিল দুপুরের মধ্যে চলে আসতে। চারটার সময় ওর লেকচার। তার আগে ও পরে আমাদের নিয়ে চারিদিকে ঘুরিয়ে দেখাতে চায়– ওর থাকার ঘর, কলেজ ও কেম্ব্রিজের সুন্দর গার্ডেন ইত্যাদি। যথাসময়ে আমরা গিয়ে পৌঁছলাম। অরিন্দমের ঘর, ছাত্রদের থাকার ব্যবস্থা, অতিথি অধ্যাপকদের বাসঘর, কলেজ ইত্যাদি ঘুরে প্রায় ক্লান্ত হয়ে অরিন্দমের সেমিনার ঘরে এসে বসলাম। অরিন্দমের লেকচার শেষ হল। তখনও কিছু সময় বাকি আছে ডিনার শুরু হওয়ার। অরিন্দম বলল, “চলুন প্রণবদার সঙ্গে আপনাদের আলাপ করিয়ে দিই।” প্রণব বর্ধন, বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ, অরিন্দমের মতই কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে অতিথি অধ্যাপক হয়ে কেম্ব্রিজে আছেন। আমি উৎসুক হয়ে উঠলাম। অরিন্দম আমাদের বর্ধন দম্পতির সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিল। অমায়িক ভদ্রলোক ও ভদ্রমহিলা। কথা বলতে বলতে হঠাৎ অরিন্দম বলে উঠল, “ইস, অনেক দেরী হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি চলুন।”
আমরা যেখানে ছিলাম সেখান থকে ডিনার হল বেশ দূরে। দ্রুত পা চালিয়ে ডিনার হলে এলাম। আমরা যখন এলাম তখন দেখি ডিনার শুরু হয়ে গিয়েছে। আমাদের জন্য তিনটে চেয়ার খালি। আমরা ত্রস্ত হয়ে বসলাম। পরিচারিকা এসে ওয়াইন তালিকা এগিয়ে দিল। অনু ও অরিন্দম ও রসে বঞ্চিত। আমি একটা ওয়াইন নিলাম। অরিন্দম সকলের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিল। কারোরই নাম মনে নেই আজ; শুধু মনে আছে তাঁদের মধ্যে একজন বা দুজন ছিলেন নোবেল লরিয়েট। এত জন গুণী মানুষের সঙ্গে একাসনে বসিনি কখনো। মনে মনে ভাবছিলাম অরিন্দমের তো ইংল্যান্ডে জানাশোনা ও বন্ধু বান্ধব আরো আছে, তাদের সকলকে বাদ দিয়ে আমাদের জন্য এই বদান্যতা কেন? ভাবতে ভাল লাগছিল আমরা ওর কত আপন।
ডিনার শেষ করে সেই বিরাট হল ঘরের মধ্য দিয়ে হাঁটছিলাম, আমাদের সঙ্গে ছিলেন একজন শেফ (পাচক)। চলতে চলতে দেয়ালে ঝুলানো বিরাট একটা ছবির সামনে এসে সে দাঁড়িয়ে পড়ল। বলল আমি ছবিটা চিনতে পারছি কি না। আমি দেখলাম দেয়ালে অমর্ত্য সেনের একটি বৃহৎ পোট্রেট। বলল, “ইনি তোমার দেশের মানুষ।” আমি বললাম- “হ্যাঁ, আমি এঁকে চিনি।” মনে মনে বললাম, ইনি শুধু ভারতীয় নন, ইনি বাঙালি; আমরা একই ভাষায় কথা বলি। গর্বে আমার বুক ভরে উঠল।
এরপর অনেকদিন নিয়মিত যোগাযোগ ছিল অরিন্দমের সঙ্গে। কিন্তু বেশ কিছুকাল হল ওর সঙ্গে কোন যোগাযোগ নেই; একেবারে হারিয়ে গেছে আমার জগৎ থেকে। এখন মাঝে মাঝে নীলাঞ্জনাকে ফোন করে ওর খবর নিই।
কিছুকাল আগে খবরে পড়েছিলাম অরিন্দম চক্রবর্তী আনন্দ পুরস্কার পেয়েছে। খুব ভালো লাগল শুনে। ও দর্শনের চর্চা আরো এগিয়ে নিয়ে চলুক।
অরিন্দমের উপহার, ওর আঁকা রবীন্দ্রানাথের ছবি।