এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ধারাবাহিক  স্মৃতিকথা  শনিবারবেলা

  • সেই দিন সেই মন পর্ব ১০

    অমলেন্দু বিশ্বাস
    ধারাবাহিক | স্মৃতিকথা | ৩১ মে ২০২৫ | ১০৬ বার পঠিত
  • ছবি: রমিত 



    লন্ডন আসার সময় ভিক্ষাপাত্র নিয়ে বেরিয়েছিলাম। যে যা দিয়েছিল তা কৃতজ্ঞতাসহ গ্রহণ করেছিলাম। তাদের সব অর্থঋণ আমি মিটিয়ে দিয়েছি। কিন্তু তাদের মানবিকতার ঋণ আমি কোনোদিন মেটাতে পারব না। তাদের কাছে আমি চিরঋণী হয়ে থাকব। দীপু আমাকে ২০০ টাকা ধার দিয়েছিল। কেশবও দিয়েছিল ২০০ টাকা।

    নতুন দেশ, নতুন জীবন। আবার সব প্রথম থেকে শুরু করতে হবে। জীবন ধারণের জন্য অর্থ উপার্জন, আকাঙ্ক্ষার রূপায়ণ, মা-ভাই-বোনদের সংসারের চিন্তা -আমার সমস্ত সময় ও শক্তি লুটে নিয়েছিল। দেশের বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ কমে গেল। তবু মাঝে মাঝে দু-একজনের চিঠি পেতাম। আর দেশে গেলে দেখা হতো। শুধু দীপু একমাত্র ব্যতিক্রম। চিঠি, টেলিফোন ও নিয়মিত সাক্ষাৎকার মিলিয়ে আমাদের হৃদ্যতা গাঢ় থেকে গাঢ়তর হতে থাকল যা জীবনের এই শেষ প্রান্তে এসেও অটুট আছে। দীপুকে প্রায় হারিয়ে ফেলেছিলাম। দেশ ছাড়ার পর দেশে যাইনি অনেক বছর। ও কেমন আছে, কী করছে কিছু ভালো করে জানতাম না। কফি হাউসের সেই অনার্সের বই বিক্রি করার ঘটনার পর দীপুর বিষয়ে কোনো সঠিক ধারণা ছিল না। কিছুদিন পরে শুনেছিলাম দীপু বাচ্চুকে (রীণা) বিয়ে করেছে।

    বাচ্চুর কথা আগে শুনেছিলাম কিন্তু আলাপ ছিল না। একদিন দীপু আলাপ করিয়ে দিল- কবে কোথায় কীভাবে মনে নেই। বাচ্চুকে চিনতাম না, ওর সম্বন্ধে বেশি কিছু জানতামও না। কিন্তু অবাক হয়ে কয়েক মিনিট পরেই জানতে পারলাম ও আমার সম্বন্ধে অনেক কিছু জানে। আমাদের কফি হাউসের আড্ডা, ‘সৃষ্টি’ ও ‘সময়ের’ ইতিহাস মায় অনু-আমার গল্প পর্যন্ত। দীপুটা যে কী? আমার নাড়িনক্ষত্র সব বলেছে ওকে। দু মিনিটের মধ্যে বাচ্চু আমাকে আপন করে নিল। আমরা গল্প শুরু করলাম যেন কত যুগের পরিচয়। দীপুর বন্ধুরা সবাই বাচ্চুর বন্ধু – একই পরিবার।

    উত্তরকালে অনুর সঙ্গেও গভীর বন্ধুত্ব হয়েছিল বাচ্চুর। বাচ্চুকে যারা না দেখেছে তাদের বলে বোঝানো যাবে না বাচ্চু কত সরল প্রাণের, কত সহজে অন্যকে আপন করে নিতে পারে।
    ততদিনে জেনেছি দীপু যাদবপুর ইউনিভার্সিটি থেকে লাইব্রেরিয়ানশিপ পাস করেছে। এবং কলকাতার ব্রিটিশ কাউন্সিল লাইব্রেরিতে কাজ নিয়েছে। (সাবাস দীপু, অনার্সের বই বিক্রির সঙ্গে সঙ্গে নিজের ভবিষ্যতকেও যে বিক্রি করিসনি তাতে আমি দারুণ খুশি!)

    তখন আমরা সাউথ হ্যারোতে একটা ছোট সেমি-ডিটাচড বাড়ি কিনে সবে উঠে এসেছি। বাড়ি তখনো ভালো করে সাজানো গোছানো হয়নি। দুটি পুত্র বুবাই-গৌতম খুবই ছোট। আমি কাজে ব্যস্ত, অনু পুত্রদের নিয়ে।

    হঠাৎ একদিন দীপুর চিঠি পেলাম --- “ব্রিটিশ কাউন্সিল লাইব্রেরিতে কাজ নিয়েছি। ওরা আমাকে লন্ডনে ট্রেনিংয়ে পাঠাচ্ছে কিছুদিনের জন্য। তোর ওখানে থাকব। আপত্তি নেই তো?”

    আপত্তি? আমি তো উচ্ছ্বসিত। অনুকে বললাম। অনু এককথায় রাজি। দীপু এল। কত দিন ছিল মনে নেই। তখনো দেশে ফেলে আসা আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধব সঙ্গের জন্য মনটা আকুল হয়ে থাকত। দীপু আসার পর সে বেদনা কিছু কমেছিল। দীপু, আমি, অনু সকলে মিলে হাসি, আনন্দে, গল্পে দিনগুলো ভালোই কেটেছিল। এ বাড়িতে কয়েক বছর থাকার পর ১৯৭৮ সালে আমি লন্ডন ছেড়ে সপরিবারে ইরানে চলে যাই আবাদান ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি (AIT)-তে কাজ নিয়ে।

    লন্ডনের কাজ সেরে দীপু দেশে ফিরে গেল। কিছুকাল পরে ও-ও দেশ ছেড়ে বিদেশে পাড়ি দিল। এক বছর ইরানে থাকার পর আমি আবার লন্ডনে ফিরে এলাম। দীপু-বাচ্চু গেল আমেরিকা -- নিউ ইয়র্ক। তখন দীপু-বাচ্চুর সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ, কথাবার্তা খুবই বেড়ে গেল। টেলিফোন তো ছিলই। তাছাড়া দেখা হতো, কখনো দীপু-বাচ্চু লন্ডনে কখনো বা আমি-অনু নিউ ইয়র্কে। মনের আনন্দে আড্ডা দিতাম সকলে মিলে। সে সব অবিস্মরণীয় মুহূর্ত। দু-একটা উদাহরণ দেওয়া যাক।

    সে বারে দীপু-বাচ্চু এসেছে লন্ডনে। আমরা তখন নর্থউইক অ্যাভিনিউ, হ্যারোতে একটা বড় বাড়িতে উঠে এসেছি। রাত্রের খাওয়া সেরে আমরা গল্প করতে বসলাম। দীপু ভালো আবৃত্তি করে। সুরেলা গলা – অকৃত্রিম সুন্দর উচ্চারণ। দীপু কবিতা পড়তে শুরু করল। জীবনানন্দ, বুদ্ধদেব, শক্তি। তারপর আমাকে বলল - তোর বইটা বার কর। আমার কবিতা পড়তে শুরু করল। দীপুর গলায় নিজের কবিতা শুনে রোমাঞ্চিত হয়ে উঠেছিলাম। সঙ্গে অনু নিচু গলায় গান গাইছিল। বাচ্চুও পড়ল। অনু একা গান গাইল অনেক। দেখতে দেখতে রাত প্রায় শেষ হয়ে এল। কবিতা গান বন্ধ করে শুরু হলো নিছক আড্ডা গল্প। কথা হচ্ছিল পরের জন্মে (যদি পরজন্ম বলে কিছু থাকে) আমরা কে কী হব। আমাদের বলা শেষ হলে বাচ্চু বলল, “আমি পরের জন্মে কাক হয়ে জন্মাব। গেরস্তর উঠানে বসে কা-কা করে কান ঝালাপালা করে দেব।” তারপর দীপুকে জিগ্যেস করল, “তুমি কী হবে, দীপু?” দীপু বলল, “আমি পর জন্মে ছুঁচো হয়ে জন্মাব। এমন গন্ধ ছড়াব যে কেউ আমার কাছে আসবে না।” আমরা হাসতে হাসতে কার্পেটে লুটিয়ে পড়লাম।

    বোধহয় পরের বছর আমি আর অনু, দীপুদের কাছে নিউ ইয়র্কে গিয়েছিলাম। ওদের একটা ফ্ল্যাট ছিল। বেশ বড় একটা বসার ঘর আর একটা শোবার ঘর। বসার ঘর ভরা বই, বই আর বই। দেয়াল জুড়ে নানা রকমের ছবি। কিন্তু ঘরে ঢুকেই যে ছবিটা চোখে পড়ে সেটা মেঝে থেকে সিলিং ছোঁয়া এক বিরাটাকার সেঁজান বা মাতিস। মনে পড়ছে না কোন ফরাসী শিল্পী। বলা বাহুল্য ছবিটা কপি, তবে প্রথম দৃষ্টিতে মনে হবে অরিজিনাল। বেডরুম একটাই। দীপু-বাচ্চু সেটা আমাদের ছেড়ে দিল। আমি সঙ্কোচ করছিলাম কিন্তু ওদের আন্তরিক ইচ্ছাকে মেনে না নিয়ে উপায় ছিল না।

    পরের দিন দীপুর গাড়ি নিয়ে আমরা বেড়াতে বের হলাম। ঘুরতে ঘুরতে অনেক দূরে গিয়ে পড়েছিলাম। জায়গার নাম মনে নেই। মনে আছে সেটা একটা বেশ বড় মাঠ, সবুজ ঘাসে ঢাকা। পাশে একটা সুন্দর লেক, সেখানে কতকগুলো রাজহাঁস সাঁতার কাটছে। মাঠের একধারে একটা থিয়েটারের মঞ্চ আছে। আসলে এটা একটি ওপেন এয়ার থিয়েটার। মুক্ত মঞ্চ। একেবারে ফাঁকা। চারিদিকে কোন জনপ্রাণী নেই। আমরা হঠাৎ যেন কোথায় হারিয়ে গেলাম। বাচ্চু শাড়ির আঁচলটা কোমরে বেঁধে মঞ্চে উঠে নাচতে শুরু করল। অনুকে বলল --- তুমি একটা গান গাও।

    অনু গান ধরল,

    “আমরা—মলয় বাতাসে ভেসে যাব শুধু কুসুমের মধু করিব পান
    ঘুমোব কেতকী-সুবাস-শয়নে, চাঁদের কিরণে করিব স্নান।”

    আজ মনে নেই ঠিক এই দ্বিজেন্দ্র-গীতিটা কিনা। দীপু স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে… “অবনী বাড়ি আছো” শুরু করল -- “এখানে মেঘেরা গাভীর মত চরে…”।

    কী মনোরম অভিজ্ঞতা! সে সুধারস আমাকে মাতাল করেছিল। একেই কি বলে স্বর্গীয় আনন্দ!
    ধন্যবাদ দীপু-বাচ্চু, এক সুন্দর সন্ধ্যার জন্য।

    নিউ ইয়র্ক থাকাকালীন বাচ্চুর সঙ্গে আমার-অনুর টেলিফোনে কথা হতো প্রায় প্রতিদিন। তখন কোন এক সময়ে বাচ্চুর মনে কিছু অশান্তির আলোড়ন উঠেছিল। আমাকে ফোন করত, একান্তে মন উজাড় করে দিত। ও বিশ্বাস করত আমি দীপুর অন্যতম বন্ধু; তাই আমাকেই বুঝি বলা যায় সে সব অন্তরঙ্গ কথা। বাচ্চুর সঙ্গে অনু আর আমার ঘনিষ্ঠতা গাঢ় হয়েছিল অনেক। এই সময়ে দীপুর একটা চিঠি উল্লেখযোগ্য। সেটা নীচে দিলাম। 
     

     



    কিছুদিন পরে দীপুর গাড়ির দুর্ঘটনায় গুরুতর আঘাত পায় বাচ্চু। সেই ক্ষত ওকে প্রায় পঙ্গু করে দিয়েছিল। তার জের ওকে শেষ দিন পর্যন্ত কষ্ট দিয়েছে। অবসর নিয়ে ওরা দেশে ফিরে গেল। সল্ট লেকের করুণাময়ীতে ওদের একটা ফ্ল্যাট ছিল, সেখানেই নতুন করে বসবাস শুরু করল। সল্টলেকে আমাদেরও একটা বাড়ি আছে। দেশে গেলে আমরা সল্টলেকেই থাকি এবং সেটা করুণাময়ীর বেশ কাছে। আবার সকলে একসঙ্গে আড্ডা দেওয়া যাবে জেনে কী ভালো লেগেছিল। কয়েকবার দীপু-বাচ্চুর সঙ্গে এই বাড়িতে আমি, অনু, হেমন্ত, কেশব, মলয়, সুবিনয় আবার মিলেছি, তর্কের ঝড় তুলেছি। লন্ডনে ফিরে এসেও ওদের সঙ্গে নিয়মিত ফোনে কথা হতো।

    একদিন হঠাৎ লোকমুখে শুনলাম বাচ্চু আর নেই। বিশ্বাস করিনি, কেননা বোধ হয় বিশ্বাস করতে চাইনি। দীপুকে ফোন করলাম। খবরটা সত্যি। দীপু হারাল ওর প্রিয়তম আপনজন, ওর চিরসখা, আমি হারালাম এক নিকট বন্ধু।

    বাচ্চু শ্রাদ্ধ ইত্যাদি আচার অনুষ্ঠানে বিশ্বাস করত না, দীপুও করে না। তাই ও সব কিছু করেনি দীপু। দীপু একটা স্মৃতিসভার আয়োজন করেছিল। আত্মীয়, বন্ধু আর গুণমুগ্ধের ভিড়ে সভাঘর ভরে গিয়েছিল। আমার আফসোস আমি থাকতে পারিনি। আমি তখন লন্ডনে।

    দীপু এখন একা। আমরা দুজনে এখনো টেলিফোনে স্মৃতিচারণ করি আর শোক, বেদনা, দেশের রাজনীতি, বর্তমান পৃথিবী নিয়ে গল্প করি।

    হেমন্তর সঙ্গে কবে কোথায় প্রথম দেখা হয়েছিল সে স্মৃতি আবছা হয়ে গিয়েছে। ওর কথাবার্তা, দৃষ্টিভঙ্গি, জ্ঞানের ব্যাপ্তি ও গভীরতা আমাকে আকৃষ্ট করেছিল। আমাদের বন্ধুত্ব গভীর হয়েছিল। হেমন্ত আর কেশব (হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও কেশব মুখোপাধ্যায়) দুজনেই হাওড়ায় থাকত। আমিও তখন হাওড়ায় মামার বাড়িতে থাকতাম। হেমন্ত একদিন আমার সঙ্গে কেশবের আলাপ করিয়ে দিয়েছিল। হেমন্ত আমাকে কেশবের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়ে বলেছিল --- অমল, কেশবের সঙ্গে তোমার মিলবে খুব। কেশব ফিল্ম ও বঙ্গ সংস্কৃতির চলমান জ্ঞানকোষ (walking encyclopedia)। সত্যি সেই সময়ে সেই বয়সে নানা দেশের ফিল্ম ও বাংলার সংস্কৃতির অন্দরমহলের সব খবর কেশবের নখদর্পণে ছিল। এ সব বিষয়ে কিছু জানার থাকলে কেশবের বন্দরেই প্রথম পাড়ি দিতাম। ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটির প্রথম গুটিকয়েক সদস্যের মধ্যে কেশব একজন। পরে অবশ্য আমিও সদস্য হয়েছিলাম। ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউট (BFI) প্রকাশিত সাইট অ্যান্ড সাউন্ডের (Sight and Sound) গ্রাহক সংখ্যা সে কালে ভারতবর্ষে খুব বেশি ছিল না। কেশব নিয়মিত সেই “সাইট অ্যান্ড সাউন্ড” নিতো। ভারত সরকার হঠাৎ বিদেশী মুদ্রায় বিদেশী বই কেনার কড়াকড়ি শুরু করল। আমি যখন ইংল্যান্ডে আসি তখন কেশব আমাকে কিছু অর্থ সাহায্য করেছিল। বলেছিল – “তোমার সুবিধামত আমাকে ‘সাইট অ্যান্ড সাউন্ড’ পাঠিও।” আমাদের অনেকের মত কেশবও কলেজে পড়ার সময় টুইশনি করত। যা পেত তার বেশির ভাগই খরচ করত বই আর ম্যাগাজিন কিনে। কলেজের পাঠ্যপুস্তক নয় – কিনত ফিল্ম, শিল্প, সঙ্গীত বিষয়ক পুস্তক বা প্রবন্ধের বই। কবিতা বা সাহিত্য অনুপস্থিত ছিল।

    আমার একদিন একটা পুরনো ম্যাগাজিনের দরকার ছিল। কেশবকে জিগ্যেস করলাম সেটা ওর কাছে আছে কিনা। কেশব বলল – “আছে, কিন্তু তোমাকে গিয়ে নিয়ে আসতে হবে।” কেশব হাওড়ায় থাকত, আমার মামাবাড়ি থেকে বেশি দূরে নয়। সুতরাং বললাম তাহলে একদিন যাব। কেশব থাকত ওর বিধবা পিসিমার সঙ্গে। আগে কখনো কেশবের বাড়ি যাইনি। আমাদের দেখা হতো হয় কফি হাউসে বা থিয়েটার বা সিনেমা হলে। গেলাম কেশবের বাড়ি। ওর ঘরে ঢুকে একটু অবাক হলাম। ঘরটা ছোট, চারিদিকে বই আর বই। কোনো তাক বা শেলফ নেই। বইগুলো সব একটার উপর একটা স্তূপের মত রাখা আছে মেঝের উপর – সযত্নে তৈরি যেন এক স্তম্ভ। একটা স্তূপ যখন উঁচু হতে হতে হাতের নাগাল ছাড়িয়েছে তখন আরেকটা শুরু হয়েছে। কেশবের বিছানা মেঝেতে। বইর স্তূপের সংখ্যা যত বাড়ে কেশবের বিছানা তত সঙ্কুচিত হয়। কেশব আমাকে একটা স্তূপের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, এটার মধ্যে কোথাও আছে। আমি খুঁজে দেখলাম আমার কাঙ্ক্ষিত ম্যাগাজিনটি সেই স্তূপের একেবারে নিচের দিকে আছে, উপরে অন্তত আরো কুড়ি-পঁচিশটা পত্রিকা।

    কেশব বি.এস.সি. পড়ছিল, অনার্স নিয়ে। ভালো ছাত্র, কিন্তু পরীক্ষা দিল না। পণ্ডিত রাধিকামোহন মৈত্রর কাছে সরোদ শিখত। গানের গলা ছিল, একটু আধটু গানও গাইত। কিন্তু আর পরীক্ষা দিতে ইচ্ছা ছিল না। পরের বছর পরীক্ষার সময় এসে গেল কিন্তু কেশবের আগ্রহ নেই। আমরা ওকে অনেক বোঝালাম কিন্তু ওর কোন গ্রাহ্য নেই। শেষে একদিন আমরা বললাম --- “তুমি যদি পরীক্ষা না দাও তাহলে আমরা কেউ তোমার সঙ্গে আর কথা বলব না।” এ বড় মারাত্মক কথা। এতবড় শাস্তি ও নিতে প্রস্তুত নয়। আমাদের বন্ধুত্ব রক্ষার জন্য ও সব কিছু করতে রাজি — পরীক্ষা তো তুচ্ছ। বলল, “আমি তো কিছু পড়াশুনা করিনি। আর তো মোটে মাস দুই আছে পরীক্ষার।” শেষ পর্যন্ত পরীক্ষা দিয়েছিল। অনার্সে বসতে দেয়নি, তবে বোধহয় ডিস্টিংশন নিয়ে পাস করেছিল।

    দেশে যখন যেতাম তখন রাইটার্স বিল্ডিংসে ওর অফিসে গিয়ে দেখা করতাম। অফিস থেকে বেরিয়ে আমরা হাঁটতে হাঁটতে চাঁদনী চকের ওর এক জানাশোনা রেকর্ডের দোকানে যেতাম রেকর্ড কিনতে। কেশব জানত আমি কী ভালবাসি। কেশব তখন রীতিমত সংসারী, স্ত্রী-পুত্রসহ গার্হস্থ্য জীবন যাপন করছে। তবে ওর বাড়ি যাওয়া হয়নি, ওর অর্ধাঙ্গিনীর সঙ্গেও আলাপ হয়নি। গানের আসর, একাডেমিতে থিয়েটার, সিনে ক্লাব-ফিল্ম সোসাইটিতে যাতায়াত আর আগের মত নেই। তবু সব খবরাখবর রাখে, পত্র পত্রিকা পড়ে নিয়মিত। ও-ই বলে দিত কোন থিয়েটার দেখতে যাব, কোন ফিল্মটা দেখার মত, কে এখন ভালো গাইছে।

    ইতিমধ্যে কেশব অবসর নিয়েছে। পুত্র মেডিকেল কলেজ থেকে ডাক্তারি পাস করেছে। শুনলাম কেশব অসুস্থ। ওকে দেখার জন্য মনটা চঞ্চল হয়ে উঠল। ওর বাড়ি গেলাম হাওড়াতে। বেশ বড় ফ্ল্যাট। বইগুলো আর মেঝেতে নেই। তাদের জন্য একটা সম্পূর্ণ ঘর। ওর স্ত্রীর সঙ্গে আলাপ হল। সেই প্রথম ও শেষ। আমাদের কথাবার্তার বেশিরভাগই ছিল কেশবের অসুখ ঘিরে। রোগটা গুরুতর – বুকে জল জমছে। আবহাওয়ায় কেমন যেন এক বিষাদের ছায়া। কেশবের হাসি ছিল বিখ্যাত। খোলা গলায় উঁচুস্বরে হা-হা করে হাসত। সরল মনের সে হাসি এখনো আমার কানে বাজে। ভারাক্রান্ত মন নিয়ে ফিরে এলাম। সেই শেষ দেখা। কিছুদিন পরেই শুনলাম কেশব আর নেই।

    সেবারে দেশে আমাদের আড্ডায় হেমন্ত এল না। হেমন্ত অসুস্থ, হাঁটা চলা করতে পারে না, প্রায় ঘরবন্দী, শয্যাই একমাত্র আশ্রয়। আমি, দীপু, অনু, বাচ্চু সকলে গেলাম শিবপুরে হেমন্তকে দেখতে। হেমন্ত বিছানায় আধশোয়া অবস্থায় আমাদের সঙ্গে কথা বলল। গলার স্বর একটু স্তিমিত। সেই বলিষ্ঠ কন্ঠের জোরাল বক্তব্যে নেই আর সেই বিদ্যুতের ঝলকানি। হেমন্তর কথার পিছনে সর্বদাই থাকত ওর নিজস্ব যুক্তি ও দৃঢ় প্রত্যয়, যাতে সায় দিতে না পারলেও অবহেলা করা যেত না। হেমন্তর সঙ্গে কথা বলে সুখ পেতাম – অমন সুন্দর, সুবিন্যস্ত, স্বতঃস্ফূর্ত কথায় পারদর্শী মানুষ খুব কম দেখেছি। সেদিন বেশি কথা হল না, মন ভরল না। হেমন্তর সঙ্গে আর দেখা হয়নি। দীপুর সঙ্গে টেলিফোনে কথা হতো ওর কখনো কখনো। দীপুর কাছেই শুনলাম একদিন হেমন্ত আর নেই।

    ক্রমে ক্রমে মনের কথা বলার মানুষ হারিয়ে যাচ্ছে। একে একে নিভিছে দেউটি।

    “সৃষ্টির” যুগে দীপু ওর দুই বন্ধুকে আমাদের আড্ডায় এনেছিল --- গৌতম ও রঞ্জন। এরা দুজনেই ছিল নাটক পাগল। এরা আমাদের পত্রিকার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিল প্রথমে। দুজনেই সৃষ্টিতে লিখত। পরে আস্তে আস্তে আমাদের আড্ডা থেকে দূরে চলে গিয়েছিল। গৌতম আদিম গুহামানবদের নিয়ে একটা নাটক লিখেছিল। আমাকে পান্ডুলিপি পড়তে দিয়েছিল। তাতে বিভিন্ন অঙ্কে কোন দৃশ্য কেমন হবে তার স্কেচ করেছিল। সে নাটক কখনো স্টেজে দেখিনি। কখনো রূপায়িত হয়েছিল কিনা তাও জানিনা। ওদের কলেজ স্ট্রিট ও হ্যারিসন রোডের মোড়ে আর্য ভান্ডার নামে একটা চর্মশিল্পের দোকান ছিল। সেই দোকানে গিয়েও ওর সঙ্গে মাঝে মাঝে দেখা করতাম। আমি যখন ইংল্যান্ড যাত্রা করি তখন আমার বন্ধুরা আমাকে এই দোকান থেকেই একটা স্যুটকেস কিনে উপহার দিয়েছিল। বহু ভ্রমণে ক্লান্ত সে স্যুটকেস এখনো আমি সযত্নে আমার বেডরুমে রেখে দিয়েছি। ততদিনে বন্ধু গৌতম হারিয়ে গেছে --- আর দেখা হয়নি।

    রঞ্জন ঘোষ আমাদের পত্রিকায় লিখত। রঞ্জন নাটক ভালবাসত। শম্ভু মিত্রর ভক্ত ছিল, বহুরূপীতে গিয়ে নাটকের মহড়া দিত। দীপুর কাছে শুনেছিলাম রঞ্জন পরে এক নকশালপন্থী নাটক দলে যোগ দিয়ে ঘুরে ঘুরে নাটক করত। এই রঞ্জন একদিন আমাকে মোহিত মৈত্র মহাশয়ের কাছে নিয়ে গেল। মোহিত মৈত্র শ্যামবাজার লোকসভা কেন্দ্র থেকে কমিউনিস্ট পার্টির প্রার্থী ছিলেন। সৌম্যকান্তি, দীর্ঘকায়, শুভ্রকেশ এই মানুষটিকে দেখলে আপনিই শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে। সে কালে পার্টির প্রায় সব নেতাদের মত মোহিত বাবুও খুব ভালো বক্তৃতা দিতে পারতেন। মোহিত বাবু জিগ্যেস করলেন আমি কী করি। আমি তখন টুইশনি ছাড়া আর কিছু করতাম না। জানিনা রঞ্জন ওঁকে আমার কথা কী বলেছিল। আমাদের পত্রিকার কথা অবশ্যই বলেছিল, আমার লেখার কথাও। মোহিতবাবু বললেন আরো পড়াশুনা করার ইচ্ছা আছে কিনা। জানালাম, ইচ্ছা আছে কিন্তু সুযোগ ও সংগতি নেই। বললেন, “জার্নালিজম পড়বে?” আমি তো অবাক! লোভী চোখে তাকিয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ। বললাম, সুযোগ পেলে পড়ব। বললেন ইউনিভার্সিটি থেকে একটা ফর্ম এনে আমাকে দিও।

    ফর্ম এনে মোহিত বাবুর কাছে আবার গেলাম। উনি ফর্মে একটা কিছু লিখে স্বাক্ষর করে দিলেন। আমি ফর্মটা জমা দিয়ে এই অবিশ্বাস্য ঘটনাটা ভুলে গেলাম। কয়েক দিন পরে চিঠি পেলাম, আমাকে ইন্টারভিউতে ডেকেছে।

    যথাসময়ে ইন্টারভিউ দিতে গেলাম। ইন্টারভিউ বোর্ডে পাঁচজন নামী ও বিখ্যাত মানুষ ছিলেন। সকলের নাম মনে নেই। শুধু দুটি নাম মনে আছে, যাঁদের লেখা আমি সে যুগে প্রায় প্রতিদিন পড়তাম। একজন বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়, যুগান্তরের সম্পাদক। অন্যজন চপলাকান্ত ভট্টাচার্য, আনন্দবাজার পত্রিকার সম্পাদক। অনেক প্রশ্ন করলেন সকলে --- সাম্প্রতিক খবরাখবর, পৃথিবীর ও দেশের রাজনীতি, নানা দেশের সংবাদপত্র, কিছু ইতিহাস কিছু সাহিত্য। এ সব বিষয় আমাদের আড্ডায় নিয়মিত চর্চা হতো। সুতরাং ওঁদের প্রশ্নের উত্তর দিতে আমার কোনো অসুবিধা হচ্ছিল না। ইন্টারভিউ প্রায় শেষ হয়ে এসেছে তখন একজন জিগ্যেস করলেন, “তুমি কী কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য?” এমন প্রশ্নের জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না। বললাম – না। আবার প্রশ্ন “মোহিত বাবুর সঙ্গে তোমার সম্পর্ক কী?” আজ আর মনে নেই ঠিক কী উত্তর দিয়েছিলাম। কিছুদিন অপেক্ষার পর ভর্তির টাকা জমা দেওয়ার আমন্ত্রণ এল। পঁচাত্তর টাকা লাগল ভর্তি হতে। সে যুগে ওই টাকা অনেক, আমার আয়ত্তের বাইরে। সে টাকা আমাকে ধার করতে হয়েছিল।

    বিকাল-সন্ধ্যায় ক্লাস হতো। দুঃখের বিষয় বেশি দিন ক্লাস করতে পারিনি। অর্থ উপার্জনের তাগিদে চাকরি ও টিউশনি আমার সে সুযোগ থেকে বঞ্চিত করল। লজ্জায় আর কোনোদিন মোহিত বাবুর সামনে দাঁড়াতে পারিনি।

    রঞ্জনও হারিয়ে গিয়েছিল আমার জীবন থেকে। হঠাৎ যেন উধাও হয়ে গেল। আর কোনদিন দেখা হয়নি।

    জীবনে অনেক সুযোগ এসেছে, অনেক পথ হাতছানি দিয়েছে আমাকে। যে পথে যাইনি সে পথে গেলে কী হতো কেউ জানে না। যে পথ অনুসরণ করে আজ যেখানে এসে পৌঁছেছি তা আমার আশাতীত। একদা হতাশ এক দরিদ্র যুবক অসীম আত্মবিশ্বাস, কর্মসাধনা ও ভাগ্যের সহায়তায় এই কাঙ্ক্ষিত জীবনের অন্তিমে এসে দাঁড়িয়েছে। এই পথ পরিক্রমায় যাঁরা আমার সহায়ক হয়েছেন তাঁদের সবার কাছে আমি আন্তরিক ভাবে কৃতজ্ঞ।

    ভারতবর্ষে আমার জীবনের শেষ কর্মস্থান জর্জ সল্টার। এখানে আমার প্রধান দায়িত্ব ছিল এস কিউ সি (Statistical Quality Control) বিভাগ স্থাপন করা আর তা পরিচালনা করা। আরও এক দায়িত্বের গুরুভার ছিল। ফ্যাক্টরির তৈরি জিনিস ও বহিরাগত দ্রব্যের গুণগত মান পরীক্ষা করে তা অনুমোদন করা। প্রথম কাজটি নিজের অভিজ্ঞতা ও ব্যক্তিত্বের ব্যবহার। কিন্তু দ্বিতীয় কাজটি জটিল। এখানে বিশেষজ্ঞ দক্ষতার সঙ্গে মানবিকতা, সততা ও আদর্শের পরীক্ষা। কন্ট্রাক্টর বা সাপ্লায়ার্সরা যোগান দেয় উৎপাদিত যন্ত্রের নানা অংশ (parts)। সেই যন্ত্রাংশের গুণমান পরীক্ষা করে তা অনুমোদন করার দায়িত্ব আমার। গুণমান সঠিক না হলে সে গুলো নাকচ হয়ে যেত। নাকচ হয়ে গেলে কন্ট্রাক্টররা অনেক টাকা লোকসান করত। সে অবস্থায় তারা নানা প্রলোভন এমন কি হুমকি ও ভয় দেখাত। এই সব অবস্থার সঙ্গে মোকাবিলা করার মত আমার মানসিক প্রস্তুতি ছিল না। আমি অশান্তিতে ছিলাম। কিন্তু সৌভাগ্যের বিষয় আমাকে এমন কোন অবস্থার মধ্যে পড়তে হয়নি যা আমাকে আদর্শচ্যুত করে।

    তবু এমন একটা ঘটনা ঘটেছিল যা আমাকে মৃত্যুর মুখোমুখি নিয়ে গিয়েছিল। ফ্যাক্টরির মধ্যে উৎপাদিত যন্ত্রাংশ গুণমান বজায় রাখছে কিনা তার দায়িত্বও ছিল আমার। তার জন্য ছিল ফিল্ড ইন্সপেক্টর যারা পনেরো-কুড়ি মিনিট অন্তর উৎপাদিত জিনিস পরীক্ষা করে দেখত। একবার বেশ কিছু জিনিস নাকচ হয়ে গেল। যে ছেলেটির উপর ওই কাজের ভার ছিল তাকে ডেকে সাবধান করে দিলাম। পরের দিনও সেই অবস্থা। ওয়ার্কস ম্যানেজার আমার উপর চাপ দিতে শুরু করল। আমি ছেলেটিকে আবার ডেকে বললাম। আমি তোমার চাকরি আর রাখতে পারব না। ছেলেটি কেঁদে ফেলল। ছেলেটির নাম সানু (ঠিক নাম মনে নেই)। অল্প বয়স্ক তরুণ, হয়তো আঠারো বা উনিশ। বলল, বাবার অসুখ, কাজ করতে পারে না আর। ও তাই পড়াশুনা ছেড়ে কাজ নিয়েছে ফ্যাক্টরিতে। আমি সমব্যথী, বুঝতে পারলাম ওর মনের অবস্থা। কিন্তু আমার কিছু করার নেই। ভারতবর্ষের লক্ষ হাজার তরুণের একই কাহিনী।

    আমিও ওরই মত। আমারও বাবা অসুস্থ ছিলেন। তবে আমি ভাগ্যবান, কলেজের পড়াশুনাটা শেষ করতে পেরেছিলাম। ছেলেটাকে এসব কথা বলার পর মনটা খারাপ হয়ে গেল। পরের দিন কাজ শেষ করে বাড়ির দিকে পা বাড়াচ্ছি এমন সময় দুটি ছেলে এসে বলল, “স্যার, আজ আপনি একা একা বাড়ি যাবেন না।” ছেলে দুজনকে দেখেছি, ওরা এখানেই কাজ করে, তবে অন্য ডিপার্টমেন্টে।

    আমি একটু অবাক হলাম, জিগ্যেস করলাম, “কেন?”
    একটি ছেলে বলল, “ওরা আপনাকে মেরে ফেলবে ঠিক করেছে। সানু পাড়াতে গিয়ে বলেছিল ওর চাকরি চলে যেতে পারে। পাড়ার গুণ্ডারা বলেছে আপনাকে শেষ করে দেবে। আপনাকে মেরে বাসের চাকার তলায় ফেলে দেবে। তাহলে আর ওর চাকরি যাওয়ার ভয় থাকবে না।” জর্জ সল্টার টিটাগড়ে। এ অঞ্চলটা জুট মিল আর ফ্যাক্টরিতে ভরা। এ রকম খুন খারাপি, মারধর হামেশাই ঘটে থাকে এখানে। আমি প্রমাদ গুণলাম।

    ফ্যাক্টরি থেকে বাস ধরতে অনেকটা পথ হাঁটতে হতো। আমি পথে নামলাম, সঙ্গে ছেলে দুটি। নির্বিঘ্নে বাস স্ট্যান্ডে পৌঁছলাম। ঐ সময়ে বাস স্ট্যান্ডে যারা থাকে তাদের সকলকেই প্রায় আমি চিনি; প্রতিদিন ফেরার পথে এই মানুষগুলোকেই আমি দেখি। সাধারণ অফিস কারখানায় কাজ-করা দিনশেষে কর্মক্লান্ত মানুষ। সেদিন কয়েক জন নতুন মুখ দেখলাম। চারজন যুবক, এদের হাবভাব, পোশাকপরিচ্ছদ অন্য রকমের। আমি যে আশঙ্কা করেছিলাম, যা অসম্ভব বলে উড়িয়ে দিচ্ছিলাম সেটা আমার বুকে গেঁথে বসল।

    আমার শুভাকাঙ্ক্ষী রক্ষী ছেলেদুটি বোধ হয় ওদের চিনতে পেরেছিল। আমাকে বলল, “আপনি এখানে দাঁড়ান। বাসে উঠবেন না। আমরা আসছি।”

    আমি দেখলাম, ওরা ঐ ছেলেগুলোর কাছে গিয়ে কথা বলতে শুরু করল। হাত পা নেড়ে তর্ক বিতর্ক হচ্ছে, দু পক্ষই উত্তেজিত। কিছুক্ষণ পরে দেখলাম ওরা চলে গেল। আমি স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়লাম। ছেলে দুজন আমার কাছে এসে বলল, এবার আপনি বাসে উঠতে পারেন। গুণ্ডাগুলো চলে গেছে।

    সানুর চাকরি যায়নি। অনেক পরে জেনেছিলাম সানুর কাজে গাফিলতি ছিল না। আসলে যে মেশিন থেকে ঐ নিম্ন মানের জিনিস তৈরি হচ্ছিল সে মেশিনটাই ছিল বহু পুরাতন ও অযোগ্য। সে কালে ভারতবর্ষে এ রকমই হতো। ব্রিটিশ কোম্পানিগুলো ভারতীয় কোলাবোরেশনে ভারতে আধুনিক শিল্প ও ফ্যাক্টরি তৈরির লাইসেন্স পেত। আর সেখানে ব্রিটেনের পুরাতন ও বাতিল মেশিনগুলো পাঠাত। এই ফেলে-দেওয়া মেশিনগুলোর আর ভালো জিনিস তৈরি করার ক্ষমতা থাকত না। জর্জ সল্টারে এই রকমেরই কিছু মেশিন ছিল। সেই মেশিন থেকেই নিম্ন মানের দ্রব্য তৈরি হতো। ব্রিটেনের সেই ঔপনিবেশিক মনোবৃত্তি!!

    এখানে আর কাজ করতে ইচ্ছা করছিল না। মনটা অশান্ত ও চঞ্চল হয়ে উঠছিল। এমনই এক অসহনীয় মুহূর্তে আমি ব্রিটিশ হাই কমিশনের অফিসে গিয়ে জব ভাউচারের জন্য আবেদন করি।

    কয়েক মাস পরে খবর পেলাম আমার আবেদন সফল হয়েছে।

    আমি ইংল্যান্ড আসছি শুনে সল্টারের ম্যানেজিং ডাইরেক্টর ব্রাইডেন সাহেব আমাকে ডেকে পাঠালেন। আমি আশ্চর্য হলাম। ব্রাইডেন সাহেব বললেন, “ব্রিটেনে এখন চাকরির অবস্থা খুব ভালো নয়। বেকারের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। তোমার যোগ্যতা মত কাজ পাবে না হয়তো। বার্মিংহামে আমার এক বন্ধু আছে; সে তোমার কাজের ব্যবস্থা করে দিতে পারবে।”

    তিনি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে একটা চিঠি লিখে দিলেন। কৃতজ্ঞতায় আমার মন ভরে গেল। এমন মানুষও আছে! কী বলে যে ধন্যবাদ দেব ভেবে পেলাম না।

    ক্রমশঃ 
     


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ধারাবাহিক | ৩১ মে ২০২৫ | ১০৬ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। খেলতে খেলতে প্রতিক্রিয়া দিন