“পাখিরা পেয়েছে বাসা, মানুষ পেয়েছে পথ”। রবীন্দ্রনাথের কাব্যিক কথা অনেকসময় একেবারে সরাসরি ঠিক না হলেও
সত্যে পৌঁছোবার কাজে লাগে। এ কথা শুনলে মনে হয় তিনি ভাবতেন সুদূরের কামনায় চঞ্চল বা প্রবাসী হওয়াই মানুষের প্রকৃতি। সেটা সত্যি না হলেও, আজকের পৃথিবীতে প্রবাসীত্ব একটা বিশাল সংখ্যক মানুষের পৃথিবী- ব্যাপ্ত অভিজ্ঞতা। অমলেন্দু বিশ্বাসের ‘সেই দিন সেই মন’ আজকালকার ইতিহাসে বাঙালি প্রবাসীত্বের স্মৃতি এবং অনুচিন্তা / শোচনা। এক ব্যক্তি জীবনের ঘটনাবলীর মধ্যে দিয়ে এর মধ্যে কেবল একটা বিশাল সমস্যা নিয়ে অনেক ভাবনা আছে - সেই বিষয় হলো প্রবাস ও অপ্রবাস। প্রবাসী হওয়া ও অপ্রবাসী থাকার অর্থ কি? এক অর্থে এর সঙ্গে আমাদের প্রাচীন চিন্তার একটা যোগ আছে। মহাভারতের ধর্মবকের প্রশ্নে যুধিষ্ঠিরের উত্তর ছিল জীবনের অন্যান্য অবস্থা যাই হোক, যে লোক অনৃণী(অ-ঋণী) এবং অপ্রবাসী তাকেই যথার্থ সুখী বলা যায়। কি সাংঘাতিক কথা: যতই জাগতিক উন্নতি হোক এনারাইদের সুখী হবার পথ বন্ধ। আত্মজীবনী এক অর্থে উপন্যাসের মতো কাহিনী। আধুনিক উপন্যাসের নায়করা আজকাল আমরা মনে করি পুরোনো কালের অসাধারণ নায়কদের বিপরীত: আগের নায়কেরা সবসময়েই অসাধারণ হতেন। আধুনিক চিন্তা সেই নায়কদের সম্পূর্ণ বিলুপ্ত করে আমাদের মতোই সাধারণ লোককে নায়কের সিংহাসনে বসিয়েছে। আমরা তাই সাধারণ লোকের অসাধারণ গল্প পড়তে ভালোবাসি - উপন্যাসে ও আত্মকথায়। কিন্তু এখানে অসাধারণ কথাটার অর্থ একক, অনন্য - প্রত্যেক জীবনই অন্য প্রত্যেক জীবনের থেকে স্বতন্ত্র রেখায় চলে। তাই সেই এককত্ব সম্পর্কেই পাঠকের কৌতূহল।
অমলেন্দু বিশ্বাস সেই প্রজন্মের লোক যাদের সম্পর্কে ঠাট্টা করে বলা হতো যে তাঁদের জীবনের সংকল্প ছিল ‘আমার এই দেশেতে জন্ম, যেন ওই দেশেতেই মরি’। কিন্তু ঠাট্টায় যেটা ধরা পড়ে না তা হলো এই জন্ম আর মৃত্যুর ঠিকানা আলাদা হয়ে যাওয়া ব্যাপারটা সহজ নয়। যাঁরা এর মধ্যে দিয়ে গেছেন, এবং যাবার সময়ে ভেবেছেন যাওয়াটা কিরকম, কোথায় যাচ্ছি, যেতে যেতে আমার আমিটার কি হচ্ছে - তাঁদের নিজের জীবন সম্পর্কে লেখার, আমাদের জগতে, একটা বিশাল প্রয়োজন আছে। একশো বছর আগে যা লেখা হতো সেগুলো ইউরোপ যাত্রীর পত্র, বা স্বল্প প্রবাসের কথা, সে প্রবাস যে বাসিন্দা তার সত্তাকেই পরিবর্তিত করে দেয় না। কিন্তু আজকের পৃথিবীতে এই প্রবাস অতি সাধারণ; অনেক সময় মনে হয় মধ্যবিত্ত ব্যক্তিদের জীবনের প্রথমটা এই প্রবাসেরই সুদূর ভূমিকা বা প্রস্তুতি। মনে রাখতে হয় অবশ্যই এই প্রবাসও পরিবর্তনশীল - ষাট-সত্তরের পাশ্চাত্য সমাজ এখনকার পাশ্চাত্য সমাজের মতো ছিল না; ষাট সত্তরের মধ্যবিত্ত বাঙালি সত্ত্বাও তার এখনকার অবতারের থেকে আলাদা ছিল। তার থেকেও বড়ো কথা, প্রত্যেক ব্যক্তিমানুষ এই প্রবাসের ইতিহাসকে নিজের মতো করে তৈরী করে নেয়। এই সততভিন্নতার জন্যেই একজন ব্যক্তির এক বিশাল ইতিহাসের মধ্যে দিয়ে যাত্রার কাহিনী আমাদের পড়তে ভালো লাগে।
একটা বাস না হলে প্রবাস হয় না। তাই, স্বভাবতই অমলেন্দুদার বইয়ের প্রথম দিকের অনেকটায় তাঁর স্বত্ব তৈরী হয়ে ওঠার - অর্থাৎ আমি হয়ে ওঠার - কাহিনী আছে। সকলেরই এই আমি অন্য সকলের থেকে আলাদা। স্বত্ব এবং স্বতন্ত্রত্ব এক জিনিস। এই গল্পে অনেক গুলো বিশেষত্ব চোখে পড়ে। একটা বড়ো বিশেষত্ব অবশ্য ব্যক্তির নয় সংস্কৃতির - তাঁর সময়কার বাংলার। সবথেকে প্রথমেই চোখে পড়ে মধ্যবিত্ত জীবনের একটা উঁচু তারে বাঁধা থাকার কথা। উনি ওঁর স্বল্পবাক কাহিনীরই মধ্যে দিয়ে ওঁর পরিবারের পরিশীলিত ভদ্রতার পরিচয় দিতে পেরেছেন। এর মধ্যে তাঁর বাবা এবং মার বিভিন্ন কিন্তু একের অন্যের উপর নির্ভরশীল এক ধরণের গভীর দাম্পত্য সম্পর্কের কথা আছে। কিন্তু মধ্যবিত্ত আর্থিক জীবন বাইরে থেকে যতই নিস্তরঙ্গ নিরাপত্তার আভাস দিক, তার মধ্যে হঠাৎই গভীর দুর্যোগ এসে পড়তে পারতো। সেই সময়ের একটা স্বল্পায়ত কিন্তু স্পষ্ট ছবি দিয়েছেন তাঁর লেখায়। তাঁর বাবার আর্থিক অস্বাচ্ছল্য যখন স্পষ্ট হলো তাঁর কাছে , তখনকার গল্প কৈশোরের গভীর দুঃখের: অনেক লোক - যাঁদের কাছে সাহায্য আশা করা যেত - তাঁরা উদাসীন, অপেক্ষা করতে অসম্মত। এর মধ্যে তিনটে অসাধারণ চরিত্র আছে সাধারণ বাঙালি মধ্যবিত্তের অসহায়তার : তাঁর বাবার আত্মশক্তির, আত্মবিশ্বাসের,আত্মসম্মানের ক্ষয়।তাঁর মার নির্বাক কিন্তু অবিচলিত শক্তিময়ীর মূর্তি; এবং তাঁর নিজের অসহায়তার জন্যে আত্মনিকৃতি। এই অনুশোচনার বোধ কেবল লেখার এই পর্বে নয়, পরেও তাঁর জীবনের মধ্যে সূক্ষ্ম হলেও বিস্তৃত হয়ে রয়েছে। এই প্রথম জীবনের আর দুটো বড়ো বিষয় হলো অরুন্ধতীদির সংগে তাঁর সম্পর্কের সৃষ্টি, এবং তার মধ্যে দিয়ে যে আত্মবিশ্বাস এসেছে তাই দিয়ে জীবনের আর্থিক বা অন্য সব সংকটকে অতিক্রম করবার ক্ষমতা। যদিও সবসময়েই বাঙালি ভদ্রলোকের সভ্যতার রুচি অনুসারে এই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার সম্পর্ক একটু অনুক্ত প্রচ্ছন্নতার মধ্যে আঁকা আছে, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে ওঁর জীবনের এটাই কেন্দ্র। তাঁদের পরবর্তী জীবনের সব বড়ো সিদ্ধান্তই একসাথে নেয়া। বাঙালি ভদ্রলোক সংস্কৃতির দাম্পত্য আদর্শের এটাই চরিত্র।
আরেকটা বিরাট সূচনা এই পর্বে অমলেন্দুদার সাহিত্য জীবনের। লাইব্রেরি থেকে বই নিয়ে পৃথিবীর সঙ্গের ক্রমশ পরিচিত হওয়া থেকে শুরু করে, কাব্য-সাহিত্যের রসাস্বাদ করতে শেখা এই জীবনের আরেকটা বিরাট দিক - যেটা ছাড়া ওঁর প্রবাস-অপ্রবাসের সমস্যাকে বোঝা সম্ভব নয়। একটা কায়িক ও মানসিক নিবাস বা গভীর বসবাস হলেই প্রবাসের কথা ওঠে। এই অংশটাতে উনি অনবদ্যভাবে দেখিয়েছেন কি করে একজন কিশোরবয়স্ক বাঙালি একটা সাহিত্যসংসারের সঙ্গে পরিচিত হয়ে, তাকে আস্বাদ করতে শিখে , পড়ে , লিখে, কথা বলে, গল্প করে তার একটা গভীর অর্থে বসবাসী/বাসিন্দা হয়ে উঠত। এই পর্বটা পড়তে ভালো লাগে খুবই, কারণ এতে একই সাথে দুটো গল্প আছে - একটা অমলেন্দু বিশ্বাস নামের এক একক ব্যক্তির, অন্যটা তাঁর মতো অসংখ্য সহৃদয় লোকের । এই এক এবং অনেকের রুচিসামান্যের মধ্যে দিয়েই বাঙালি সাহিত্যিক সংস্কৃতি তৈরী হয়ে উঠেছে: সব সংস্কৃতিই এই রকম ভাবেই হয়ে ওঠে। এবং আমরাও ব্যক্তি হিসেবে সংস্কৃতির বসবাসী এই রকম করেই হয়ে উঠি। তাই এখানে অমলেন্দুদার কাহিনী ওঁর এবং আমাদের সবারই।
এর পরে অনেকটাই লেখকের কর্মজীবনের কাহিনী - কিন্তু সেখানেও একটা লক্ষ্য করার ব্যাপার আছে। বাঙালি পরিবারের নিয়ম মতোই তিনি প্রথমে তাঁর আর্থিকভাবে বিপর্যস্ত পরিবারকে সারিয়ে তোলবার চেষ্টা করেছেন, কেবলই নিজের আণবিক পরিবারকে না দেখে। তার পরে, যখন তাঁর পারিবারিক অবস্থায় স্থিরতা এসেছে, তিনি পাশ্চাত্যের প্রতি কৌতূহল মিশ্রিত এক ধরণের আকর্ষণে ইংল্যান্ডে পাড়ি দিয়েছেন। এই তাঁর প্রবাসের শুরু। এই পর্যায়ের কাহিনীতে দুটো মূল রেখা আছে - যা সেই সময়ের সব প্রবাসীর জীবনেরই অঙ্গ ছিল। একদিকে দেখা যায় নানা রকম কর্মকান্ডে লিপ্ত হয়ে ক্রমশ তিনি নতুন কম্পিউটার যুগের উন্মেষ দেখতে পারছেন, এবং তার মধ্যে ঢোকার জন্যে কিরকমভাবে লন্ডন ইউনিভার্সিটির বার্কবেক কলেজে ও ওয়েস্টমিন্স্টার ইউনিভার্সিটিতে পড়াশুনা করে নিজেকে প্রস্তুত করে নিয়েছেন। সেদিকে থেকে তাঁর জীবনের এটা একটা সাফল্যের কাহিনী। কিন্তু দেখা যায়, কাজের ব্যাপারেও লেখক দেশের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার জন্যে কতটা আগ্রহী। বিলিতি কোম্পানিগুলোতে কাজ করেও, উনি সব সময়েই চেষ্টা করেছেন দেশের সদ্যোজাত কম্পিউটার কুশলীদের এইসব কোম্পানির সঙ্গে যোগ করিয়ে দিতে। এই অংশের কাহিনীতেও অনেক লক্ষণীয় ব্যাপার আছে - যার ভেতর দিয়ে বোঝা যায় ভারতীয় শিল্পের বা ব্যবসার উদ্যোগ অনেক সময়ে সাময়িকভাবে সফল হলেও, পরে কেন সেই সাফল্যের ধারাকে ধরে রাখতে পারে না।
ইংল্যান্ডের ব্যবসার সূত্রে লেখকের পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলের ব্যবসায়ীদের সঙ্গেও পরিচয় হয়েছে। সেই পরিচয়ের সূত্র ধরে তিনি ইংল্যান্ড থেকে চলে গেছেন শাহের সময়কার ইরানে। সেখানকার পরিবর্তিত পরিবেশেও দেখা যায় একদিকে ভারতীয় অন্যদিকে পাশ্চাত্যের প্রতিবেশীদের সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্ক তৈরী করতে পেরেছিলেন। ওঁরা যেখানেই গেছেন একটা পরিচিত প্রতিবেশী বন্ধুর বৃত্ত তৈরী করতে পেরেছেন সবসময়েই - সেটা তাঁদের চরিত্রের আতিথেয়তাকে প্রকাশ করে। কিন্তু এই পর্যায়ের কাহিনীর শেষের দিকটা একেবারে থ্রিলারের মতো। ইরানের বিপ্লবের মধ্যে একা, সম্পূর্ণ অপরিচিত লোকেদের সাহায্যে কি করে শেষ ট্রেন ধরে বাড়িতে ফিরে এলেন, সেটা একেবারে রোমহর্ষক কাহিনী: কিন্তু এখানেও নিজের ব্যক্তিগত বিপদের অভিজ্ঞতা, এক বিদেশের রাজনৈতিক বিপ্লবের আবর্তের বিবরণ দিতে গিয়েও যেটা বিশেষ করে জোর দিয়ে বলেছেন তা হলো এক ধরণের সাধারণ সহজ মানবিকতা - সম্পূর্ণ অপরিচিত বিদেশিরা কি রকম করে তাঁকে বিপদের থেকে উদ্ধার করেছে। তার জন্যে তাদের ধন্যবাদ দিতে ভোলেন নি। তার পর থেকে লেখক লন্ডনেই কাটিয়েছেন তাঁর জীবন - যদিও চেষ্টা করেছেন কলকাতায় একটা দ্বিতীয় আবাস তৈরী করে সেখানেও এসে থাকতে - যাতে প্রবাস - অপ্রবাসের সমস্যার সমাধান হয়।
প্রবাসের জীবনের সবসময়েই দুটো বড়ো দিক থাকে - একটা সেখানকার কর্মকান্ডের জগতের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরী করা। অনেকেই সেই সম্পর্ক সফলভাবে তৈরী করে নিতে পারেন না, তাতে তাঁদের জীবন রিক্ত হয়, বিরক্তি বা বিষন্নতা আসে। কিন্তু আবার ফেলে আসা দেশে - বিদেশে যাওয়াটাই এতো বড়ো একটা সাফল্য - যে সেটাকে স্পষ্ট করে স্বীকার করাও শক্ত। লেখক এই কর্মজীবনের দিকে থেকে পাশ্চাত্য সমাজের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন খুবই সাফল্যের সঙ্গে। তিনি সেখানকার শ্রেষ্ঠ বিদ্যায়তনে শিক্ষা নিয়েছেন, সেখানকার বড়ো কোম্পানিগুলোতে অনায়াসে কাজ করতে পেরেছেন। কিন্তু প্রবাসের অন্য দিক হচ্ছে কেবল অর্থনীতির সঙ্গে নয়, সেখানকার সমাজের সঙ্গে - আদান প্রদানের যোগাযোগ করা। সে ব্যাপারটা সহজ নয়; সেখানকার সামাজিক ব্যবহার অন্য রকমের, ভাষা আলাদা (যদিও আমরা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রজা হিসেবে সে ভাষায় পারদর্শী), এবং তার এক বিশাল সংস্কৃতি আছে যার সঙ্গে যোগাযোগ না করাও ঠিক নয়, আবার যার মধ্যে একেবারে নিমজ্জিত হয়ে যাবারও সমস্যা আছে। তাহলে নিজের সংস্কৃতিকে একেবারে হারিয়ে ফেলতে হয়। ইউরোপীয় সমাজগুলোতে তাদের বিশাল ঐশ্বর্যময় এবং উপনিবেশে স্ফীত সংস্কৃতির একটা অ্যাসিমিলেশন এর চাপ থাকে, যাকে রোধ করা শক্ত। প্রবাসের এটা একটা বিরাট সমস্যা। দেখে আশ্চর্য্য হতে হয় কিভাবে বিশ্বাসেরা এই সমস্যার সুন্দর উত্তর তৈরী করতে পেরেছিলেন নিভৃতে তাঁদের লন্ডনের জীবনে। অবশ্য তাঁদের অনেক resource ছিল। অমলেন্দুদার স্বনির্মানের গল্পে দেখা যায় খুব প্রসারিত অর্থে সাহিত্য ব্যাপারটা তাঁর কাছে কতটা মূল্যবান ছিল; এবং সব রকম অসুবিধের মধ্যেই তিনি সাহিত্যের মধ্যে দিয়ে শান্তি চেয়েছেন - সে দেশের জীবনের আর্থিক বিপর্যয় হোক, আর বিদেশের জীবনে নিঃসঙ্গতার বিরুদ্ধেই হোক। তার পাশে অরুন্ধতীদির সংগীতচর্চার কাহিনী পাশাপাশি রাখতে হয়। বিদেশেও উনি বাংলা সংগীত চর্চাকে ধরে রেখেছেন -যেটা অত্যন্ত কঠিন। প্রত্যেকদিন দুটো করে কবিতা না লিখলেও কবিতা লেখার ক্ষমতা হ্রাস পায় না, কিন্তু রেওয়াজ না করলে গান করার নৈপুণ্য চলে যায়। তাকে বিদেশের সাংস্কৃতিক নিঃসঙ্গতায় ধরে রাখা বিরাট সাধন। তাঁদের দুজনের এই সামাজিক যুগলবন্দীর আকর্ষণে লন্ডনের অনেক বাঙালিরা তাঁদের হ্যারোর বাড়িতে প্রায়ই মিলিত হতেন নানা রকম অনুষ্ঠানে। কখনো আন্তরিক বন্ধুদের আড্ডায়, কখনো কোনো বাঙালি সাহিত্যিকের অভ্যর্থনায়, বছরে অনেকবার নানারকম সামাজিক অনুষ্ঠানে -কিন্তু কখনো ধর্মীয় পুজো-আর্চায় নয়। সেখানে রবীন্দ্রনাথের চিন্তার থেকে তুলে আনা মানুষের ধর্মই যথেষ্ট ছিল, উৎসব আর আতিথেয়তার জন্যে আর কোনো বাড়তি ধর্মের প্রয়োজন ছিল না। আরেকটা লক্ষ্যণীয় বৈশিষ্ট্য ছিল সেখানে পশ্চিম বঙ্গের ও বাংলাদেশের দুদিকের শিল্পী লেখক বুদ্ধিজীবী সকলেই আসতেন। বাইরের রাষ্ট্রিক পার্টিশনের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের কিছু করার নেই; কিন্তু বাঙালি সংস্কৃতির মানসিক পার্টিশনকে এই পরিচিতদের পরিসরে অস্বীকার করে আনন্দ লাভ করা যেত।
অমলেন্দুদা আরো প্রাতিষ্ঠানিক ভাবেও লন্ডনে বাংলা সংস্কৃতিকে পরিচিত করার চেষ্টা করেছিলেন নানাভাবে - যার পরিচয় পাওয়া যায় তাঁর টেগোর সেন্টার পরিচালনার গল্প থেকে। তার সঙ্গে দেখেছি অনেক সময়ে সুযোগ পেলেই দুই বাংলার লোকদের একত্র করে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করা - যেমন করতে পেরেছিলেন তাঁর বন্ধু সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লন্ডনে আসার অবসরে। টেগোর সোসাইটি অবিরাম রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যকে বিশ্বের কাছে পৌঁছে দেবার চেষ্টা করতো - কেবল বিলেতের সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবীদের সমাবেশ করেই নয়, পৃথিবীর নানান কোন থেকে রবীন্দ্রানুরাগী অনুবাদক ও লেখকদের নিয়ে এসে, এবং তাঁদের পরস্পরের সাথে পরিচিত করিয়ে।
এই বইয়ে যেটা সবথেকে স্পষ্ট ব্যাপার সেটা হলো অমলেন্দুদার প্রবাসে অপ্রবাসী হয়ে থাকার চেষ্টা- যাতে তিনি সফল হয়েছিলেন। আমি দুভাবে সেটা দেখেছি, এক হলো আমাদের নিজেদের লন্ডনে থাকার অভিজ্ঞতায় এবং আবার দেখেছি তাঁর আত্মজীবনীর পাতায়। প্রবাসে যেটা পরিচিত, অন্তরঙ্গ আর যেটা উপস্থিত, প্রত্যক্ষ্য সে দুটোর মধ্যে ব্যবধান হয়ে যায়। প্রবাসে থাকবার এক ধরণের নিঃসঙ্গতা আছে -যে সংস্কৃতি আমার চারপাশে সতত ঘিরে রয়েছে, সেটা আমার নয় , তার যে ঐশ্বর্য তা আমার সংস্কৃতির ঐশ্বর্য নয় - এর থেকে অনেক সময় দেখা যায় এই নিঃসঙ্গতাই নিজের ফেলে আসা সংস্কৃতির সঙ্গে যোগাযোগকে আরো নিবিড় করে তোলে। দেশে থাকলে যে সংস্কৃতি চার দিকে অপৰ্য্যাপ্তভাবে ছড়ানো থাকে, না চাইলেই পাওয়া যায়, যাকে পাওয়ার জন্যে কোনো প্রয়াসের প্রয়োজন নেই, সেখানে, অনুপস্থিতি আর অপ্রাচুর্যের জন্যেই তাকে চেষ্টা করে ধরে রাখতে হয়, এবং এই নিঃসঙ্গতাই নিজের সংস্কৃতির সঙ্গে একটা অন্যরকমের ঐকান্তিক সম্পর্ক সৃষ্টি করে। অমলেন্দুদার স্মৃতিচারণার সেটাই প্রধান বিষয়। তিনি সেই সম্পর্ক ধরে রেখেছেন নানাভাবে - নিজে সাহিত্যের পাঠক ও লেখক হিসেবে, বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে আলোচনা কথাবার্তায়, আর সবথেকে বেশি, সংগীত ও সাহিত্যের নিরন্তর চর্চার মধ্যে দিয়ে। আমার বিশেষ করে মনে পড়ে গান শোনার কথা। সাহিত্য নিয়ে কথা বলাতেও এক ধরণের একাগ্রতা থাকতে পারে, কিন্তু কথাবার্তার মধ্যে একটা কোলাহল আছে - এক বিষয়ে সবাই কথা বলে; কিন্তু যখন গান হয়, তখন সেই কোলাহল বারণ হয়ে কেবল সংগীতের কথা আর সুরই শব্দিত হয়, আর সবার স্তব্ধতার মধ্যে। এই রকম পরিবেশে ওঁদের বাড়িতে বাংলা সাহিত্য আর সুরের সঙ্গে তখন একটা অদ্ভুত অন্তরঙ্গ দেখা হতো মনে আছে - বাইরের পৃথিবীকে অস্বীকার করে। কিন্তু এতে অতি-জাতীয়তার লেশমাত্র ছিল না। এতে তিনি যে সেখানকার সংস্কৃতির ঐশ্বর্যকে অবহেলা করেছেন তা নয়; কিন্তু তার মধ্যে থেকেও বাংলা সংস্কৃতিকে নিজের মধ্যে জাগ্রত রেখেছেন।
এই আত্মজীবনীর পাঠকেরা এক পরিশীলিত জীবনের ছবি দেখতে পাবেন যা একই সঙ্গে অন্তর্মুখী এবং বহির্মুখী। যাতে লেখকের সাহিত্যিকের একাকিত্ব ও সমঝদারের সামাজিকতার সুন্দর সমন্বয় আছে। আর তাঁর লেখায় লেখকের শিল্প দেখা যায় সব সময়েই - নিজের জীবনে ক্ষুব্ধ অবস্থাকে বিবৃত করার মধ্যেও এক ধরণের অনুত্তেজিত শান্তভাব আছে, আর লেখার একটা ক্ষমতা আছে যা এই জীবনের বহুবিচিত্র অভিজ্ঞতাকে প্রকাশ করতে পেরেছে - এর মধ্যে একটা ঔপন্যাসিকের দক্ষতা আছে, আবার অনেক জায়গায় যখন কাব্যের সাথে প্রণয়ের প্রসঙ্গ আছে তাকে ধরতে পারার কবিত্বও আছে।
বাঙালি সংস্কৃতিতে প্রবাসীত্ব অনেক দিনের ব্যাপার। প্রথমে সেটা ভারতবর্ষের অভ্যন্তরের পরবাস ছিল, আমাদের যে ঐতিহাসিক কাল তাতে পরদেশে প্রবাস একটা বড়ো বিষয় - অনেক লোকের অভিজ্ঞতার ব্যাপার। অমলেন্দু বিশ্বাসের আত্মজীবনী পাঠকদের এই প্রবাসের সত্য কি , তার বিভিন্ন দিককে গভীরভাবে বুঝতে সাহায্য করবে। সব মানুষের জীবনই একটা পথরেখা বলা যায়: জীবনী সেই পথের কাহিনী, যে সব জায়গায় সেই পথ সেই ব্যক্তিকে নিয়ে গেছে তার আলেখ্য। অমলেন্দু বিশ্বাসের কাহিনী মনোজ্ঞ এইজন্যেই যে এখানে দুটো কাহিনি চলেছে পাশাপাশি: এতে অনেক স্থান-কাল-পাত্রের পরিচয় আছে - বসিরহাট, কলকাতা, আসানসোল, লন্ডন, ইরান থেকে আবার লন্ডনে ফিরে আসার কাহিনী; আর আছে অনেক পাত্র পাত্রীর পরিচয় - নিজের পরিবার, প্রেম, বন্ধুত্ব, কিছু অপ্রেম যা সব মানুষের জীবনেই থেকে যায়; কিন্তু তার থেকে বড়ো একটা পরিচয় আছে এতে - যে মন এগুলো দেখে, এই অভিজ্ঞতায় স্নিগ্ধ এবং দগ্ধ হয়, এবং যে আমি বুঝতে চেষ্টা করে সেই আমি কে, এবং এই পথের যাত্রায় তার কি হচ্ছে। তাই এতে পৃথিবীর আর আমির কাহিনী চলেছে পাশাপাশি: এতে আমরা একটি ব্যক্তি এবং তার দেখা ব্যক্তিগত কিন্তু অশেষ বিস্তৃত পৃথিবীকে দেখতে পাই।
সুদীপ্ত কবিরাজ
২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫
প্রখ্যাত লেখক ও রাজনীতি বিশারদ সুদীপ্ত কবিরাজকে পাঠকদের সথে নতুন করে পরিচয় করানো বাহুল্যমাত্র। বর্তমানে তিনি কলম্বিয়া ইউনিভারসিটির দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি ও বুদ্ধিজীবী ইতিহাসের অধ্যাপক ( Professor specializing in South Asian Politics and South Asian Intellectual History)। পূর্বতন লন্ডন ইউনিভারসিটির ( SOAS) -র রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও অক্সফোর্ডের সেন্ট এন্টোনি কলেজের ফেলো (Fellow).
তাঁর লিখিত বহু গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য
Politics in India, Oxford University Press, 1999, ISBN 0-19-564873-0
ও
মার্ক্স ও স্বর্গের সন্ধান , অনুস্টুপ প্রকাশনী , জানুরারি ২০২২, ISBN 978-93-93472-01-4