"বাপরে, তুই এত্তসব বিখ্যাত লোকজনের বিয়েতে খেয়ে বেড়াচ্ছিস, সেই খবর জামাইবাবুকে দিয়েছিস?", বলেই বদ্দি মহারাজের টোবলা গালদুটো টেনে একটু আদর করে দিল।
সেই শুনে পাশ থেকে জামাইবাবু আরেকবার হাত দিয়ে চশমাটা নাকের ওপর তুলে বলল,"তাই নাকি ছেনুবাবু! কার বিয়েতে খেয়ে এসেছ?"
এই শুনেই বলার আগে ছেনুর বুক গর্বে তিন হাত হয়ে গেল, ও একটা স্বর্গীয় হাসি হেসে বলল,"ছায়ার বিয়েতে।"
জামাইবাবু তো অবাক,"ছায়াটা আবার কে?"
- তুমি ছায়াকে চেনো না, এই যে সামনে ছায়া স্টোর্স বলে এতবড় দোকানটা যার নামে, সেই ছায়া।
- ও তাই নাকি! তাহলে তো খুব বিখ্যাত বলতে হবে!
ছেনু যবে থেকে বেনার সঙ্গে গিয়ে ওই বিয়েবাড়িতে খেয়ে এসেছে, সেদিন এসে থেকে ওর মুখে খালি সেই ছায়ার গল্প। বাড়িতে এসেই বাড়ি শুদ্ধু লোককে জানানো হয়ে গেছে, পারলে পাড়াশুদ্ধু লোককে ডেকে জানাতে পারলে ভালো হয়। এবার সবাই ভাববে, আচ্ছা ছায়া স্টোর্স যার নামে, সেই ছায়ার বিয়ে তো নয় হচ্ছে, কিন্তু সেখানে বেনার হাত ধরে ছেনুই বা গেল কী করে, আর বাড়ির বাকি লোকদেরই বা নেমন্তন্ন করলনা কেন! আহা ভুলে গেলে, ছেনুদের বাড়ির সামনের ব্যাংকটাতেই তো বেনা এখন কাজ করে, আর ওই দোকানের মালিকের তো যাতায়াত লেগেই রয়েছে সেই ব্যাংকে, তাই বোনের বিয়েতে অফিসশুদ্ধু লোকের নেমন্তন্ন ছিল। আর সেখানে বেনা একা যাবে, ছেনু যাবে না, তাই কখনো হয়! এবার কলকাতার কেউ ছায়া স্টোর্স চিনুক না চিনুক, ছেনুদের পাড়ার সবার কাছেই ওটা একটা বিখ্যাত দোকান, যার মাটির নিচেও একটা বিশাল দোকান আছে। তাই ছেনুর কাছে সেই 'ছায়া স্টোর্স'-এর ছায়ার বিয়েতে নেমন্তন্ন খেতে যাওয়ার আনন্দ আলাদা তো হবেই।
আজ সকালেই বদ্দি আর জামাইবাবু ছেনুদের বাড়ি ঘুরতে এসেছে। বদ্দিকে পেয়েই ছেনু ব্যাপারটা আর চেপে রাখতে পারেনি। হোক না সাত দিনের বাসি খবর, কিন্তু একটা জব্বর ব্যাপার তো, এটা না জানালে চলে!
যাইহোক, সেই নিয়ে তো বেশ খানিকটা হাসাহাসি হল। এবার জামাইবাবু ছেনুকে বলে,"তুমি আসল ছায়াকে তো দেখে এলে, এবার আমাদের সাথে একটা ছায়াছবি দেখতে যাবে নাকি?"
বদ্দির বিয়ের আগে জামাইবাবুকে যেরকম ভয় পেত, এখন আর পায় না, দিব্যি ভাব হয়ে গেছে। জামাইবাবু বেশ সুন্দর সুন্দর চকলেটও আনত ওর আর ছোদ্দির জন্য। ভাব হওয়ার পর সন্ধির শর্ত হিসেবে ছেনু একবার জামাইবাবুর চশমাটা পরার দাবি জানিয়েছিল। ওটা তাই ওকে একবার পরতেও দেওয়া হয়, এমনিতেই ছেনুর মুখে সেটা ঢলঢলে, কিন্তু সে চশমায় এমন পাওয়ার একবার পরেই ছেনুর এমন মাথা ঘুরে ওঠে, ও ধপ করে মেঝেয় বসে পড়ল। তারপর তাড়াতাড়ি সেটা জামাইবাবুর হাতে ফেরত দিয়ে তবে শান্তি।
তাই ছেনু তো 'ছায়াছবি'-র নাম শুনেই রাজি, জামাইবাবু বলেছে যখন, তখন নিশ্চয়ই ভালো কিছু হবে। কিন্তু ছায়াছবি ব্যাপারটা কি?
তখন জামাইবাবু বলল,"আরে বাবা সিনেমা। ওকেই তো বাংলায় ছায়াছবি বলে। মুশকিল হলো, ছেনু তো কোনোদিন সিনেমা দেখেনি! শুনেছে অবশ্য সেই ব্যাপারে অনেক কিছু। ওদের বাড়ির কাছেই বেশ কয়েকটা সিনেমাহলও রয়েছে। ওদের বাড়িতে বড়দা, ছোড়দা, বদ্দি, ছোদ্দি এমনকি মা পর্যন্ত সিনেমা দেখে এসেছে কখনো না কখনো, কিন্তু ছেনুরই কখ্খনো দেখা হয়নি। ও তো মায়ের সিনেমা দেখা নিয়ে অনেক গল্পও শুনেছে, বাবা যখন মাকে নিয়ে সিনেমা দেখতে যেত, তখন নাকি বাবা দুপাশের দুটো সিটের টিকিটও বাড়তি কেটে নিত, যাতে আশেপাশের লোকের কথা কানে এসে বিরক্ত না হয়। তা সেসব শুনেই ছেনু বুঝেছে সিনেমা দেখতে দেখতে কথা বলতে নেই, চুপটি করে বসে থাকতে হয়।
জামাইবাবু যখন বললো এটা নাকি বেশ অন্যরকম সিনেমা, কিছুদিন হলো হলে এসেছে, খুব মজার মজার কাণ্ড কারখানা আছে, সেসব শুনে তো ছেনু খুব উৎসাহই পেল। কিন্তু সে সুখ কপালে সইলে তবে তো! 'গুপি গাইন বাঘা বাইন' দেখতে যাওয়া হবে শুনে ছোড়দা এসে বললো, হ্যাঁ নাম শুনেছি, কিন্তু তুই কি আর দেখতে পারবি? অনেক গুলো ভূত আছে কিন্তু ওতে, এই বড় বড় সব ভূত! তুই আবার ভয় পাবিনা তো অন্ধকারে! এটা শুনেই ছেনুর উৎসাহে এক ঘটি জল। তাড়াতাড়ি জামাইবাবুকে জিজ্ঞেস করলো সিনেমায় সত্যি সত্যি ভূত আছে নাকি? জামাইবাবু ভেবে টেবে বললো,"আছে বোধহয়, তবে খুব বেশি নয়, বেশির ভাগটাই আরো অন্য ব্যাপার স্যাপার, অনেক গানও আছে।"
কিন্তু ছোড়দা যেই বলেছে অন্ধকারে ভূতের কথা, ছেনুর তো হাঁটু কাঁপা শুরু হয়ে গেছে। ওর আসলে ভয় পেতে বড্ড ভয় লাগে। সেখানে ভূত তো মার্কামারা ভয়ের জিনিস। একবার কোনো মতে ভূতের হাত থেকে খুব বাঁচা বেঁচেছিল, আবার কি সেই খপ্পরে পড়া ঠিক হবে!
একবার তেতলার ভাড়াটে বুড়িদি, বুড়িদির বোন আর বুড়িদির বোনের মেয়ে একটা নাটক দেখতে যাচ্ছিল- লব কুশ। একটু দূরেই ওই ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট না কি একটা হল আছে, সেখানে হচ্ছে। ওরা ছেনুর মাকে জিজ্ঞেস করল ছেনু যাবে কিনা। একটা নতুন জিনিস দেখা হবে ছেনুর, তাই মা-ও আর আপত্তি করল না। ওদের সাথে দিব্যি আনন্দ করে ছেনু লব-কুশ দেখতে চলে গেল। গিয়ে দেখল বেশ বড় হল, সার সার চেয়ার পাতা, সামনে পর্দা ঝুলছে। ওরা একটা জায়গা দেখে পরপর চেয়ারে বসে পড়ল। একসময় ঝুপ করে হলের সব আলো নিভে গিয়ে পর্দা উঠে নাটক শুরু হয়ে গেল। বেশ ভালোই এগোচ্ছিল নাটকটা, দুটো বাচ্চা ছেলেকে নিয়ে গল্প- তারা তীর ধনুক নিয়ে বনে বনে ঘুরে বেড়ায়। তাদের মা নাকি আবার সেই রামায়ণের সীতা। ভালোই চলছিল নাটক, একটা দৃশ্যে হঠাৎ অন্ধকারের মধ্যে দুজন কোথা থেকে ময়ূর সেজে এসে নাচতে শুরু করল। তাই দেখে ছেনুর পাশ থেকে কে একটা ওমনি বলে উঠল,"এই রে, আবার ভূতের নেত্য শুরু হয়ে গেল!" ব্যস, সেই শুনেই তো মহারাজের চুল খাড়া হয়ে গেছে। সামনা সামনি মোলাকাত হোক না হোক, ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছেন ভূত মানেই ভয়ানক একটা কিছু ব্যাপার, আর ঠিক অন্ধকারেই তারা ঘাপটি মেরে থাকে। পাশ থেকে লোকটা যখন বলল, তাহলে ভূতই হবে। নইলে ময়ূর দুটো এরম মানুষ মানুষ দেখতে কেন, আসল ময়ূর তো আরো পুঁচকে হয়, ও কি চিড়িয়াখানায় দেখেনি! তাই আর ঝুঁকি নেওয়া নয়, নিমেষের মধ্যে চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠে মহারাজ সোওজা দরজার দিকে ছুট লাগালেন! হল থেকে বেরিয়ে নিচে নেমে রাস্তায় এসে পড়েই তো গেছেন ঘাবড়ে। সবকিছুই যে অচেনা! আসার সময় গল্প করতে করতে আসা হয়েছিল, রাস্তা তো কিছুই চেনা হয়নি। শেষমেশ গলাটা একটু ভারী করে, বুকে সাহস নিয়ে একজনকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, "কাকু শেয়ালদাটা কোন দিকে?" ভদ্রলোক সেটা শুনেই দেখিয়ে দিলেন এই তো সিধে রাস্তা চলে গেছে শেয়ালদা। কিন্তু তারপরেই সম্বিৎ ফিরল, এইটুকু পুঁচকে একটা বাচ্চা হঠাৎ শেয়ালদার রাস্তা জানতে চাইছে কেন? হারিয়ে গেছে নাকি! উনি জিজ্ঞেস করতে যাবেন সেকথা, কিন্তু ততক্ষণে মহারাজ আর সেখানে থাকলে তবে তো। তখন আর থামাথামি নেই, সোজা রাস্তা ধরে গাড়িঘোড়া টপকে তিনি দৌড়াচ্ছেন। একটা ভূতে রক্ষে নেই, দু-দুটো ভূত ময়ূর সেজে নাচছে। ধরতে পারলে নির্ঘাত ক্যাঁক করে ঘাড় মটকে দেবে। তিনি শেয়ালদা মোড়ে পৌঁছে তবে হাঁপ ছাড়লেন। এরপর বাকিটা চেনা রাস্তা, আর চিন্তা নেই।
অত তাড়াতাড়ি ফিরে আসতে দেখে মা একটু অবাক,"হয়ে গেল নাটক?" ছেনু তো কাঁধ অব্দি ঘাড় নেড়ে দিয়েছে।
ওদিকে ছেনুর চিন্তায় বুড়িদিদের তো পাগল পাগল অবস্থা। প্রথমে ভেবেছিল অত জোরে ছুটে গেল, নিশ্চয়ই বাথরুম টাথরুম কিছু পেয়েছে। কাজ সেরে ফিরে আসবে এখনই। বড় বাইরেও হতে পারে। কিন্তু প্রায় আধ ঘন্টা পরেও ফিরে আসছেনা দেখে ভীষণ চিন্তা শুরু হয়ে গেল। শেষমেশ নাটক দেখা মুলতুবি রেখে ছেনুকে খুঁজতে খুঁজতে ওরাও বাড়ি ফিরে এসে দেখে সে নিশ্চিন্তে দোতলার বারান্দায় বসে লাট্টু ঘোরাচ্ছে। সেদিন পুরো ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর মা আর বুড়িদির যুগপৎ চিৎকারে শিয়ালদার সবকটা কাক একসাথে উড়ে পালিয়েছিল।
তাই এই সিনেমাতে ভূত আছে শোনা ইস্তক ছেনুর গলা শুকাতে আরম্ভ করেছে। ওরা ছবিঘরের যত কাছে যাচ্ছে ততই ছোড়দার সাবধানবাণী মনে পড়ছে আর ভয়টা আরো জাঁকিয়ে বসছে। ছোড়দা যে আসলে মজা করার জন্য বলেছে, সেটা ছেনুকে কে বোঝাবে! টিকিট কাটা হয়ে গেছে, শুধু হলের ভেতর ঢোকার অপেক্ষা, ঠিক এমন সময় মহারাজ বেঁকে বসলেন। তিনি কিছুতেই ভেতরে ঢুকবেন না। জামাইবাবু আর বদ্দি মিলে যতই বোঝায়, ছেনুকে তবু কিছুতেই রাজি করা যায় না। যতই বলা হচ্ছে সবার টিকিট কাটা হয়ে গেছে, ছেনু বলে তোমরা দেখে এসো, আমি বাইরে বসে থাকছি। বাকি দর্শক যারা 'গুপি গাইন বাঘা বাইন' দেখতে হলে ঢুকছে সবাই অবাক হয়ে দেখে একটা বাচ্চা ছেলে দারোয়ানের পাশের টুলে চুপটি করে বসে রয়েছে। পুরো সিনেমা জুড়ে ছেনু ঠিক ওভাবেই বসে রইল আর মাঝেমধ্যে দারোয়ানের লাঠি নিয়ে নাড়াচাড়া করে গেল। জামাইবাবু মাঝে মাঝেই এসে দেখে যাচ্ছে ও ঠিক আছে কিনা, এসে বলছেও যে, ভূতের সিন পার হয়ে গেছে এবার চল, তবুও শেষপর্যন্ত ছেনুকে টলানো গেল না।
এরফলে যা হওয়ার তাই হল, পুরো বাড়ি জুড়ে রাষ্ট্র হয়ে গেল, বাড়িতে যতই লাফিয়ে বেড়াক, সিনেমা দেখতে গেলেই মহারাজ ভয়ের চোটে কাঁপেন। ছেনু কোনো কোনোদিন দুপুরে পিসিমার কাছে শুয়ে পড়ত। দেওয়ালে একটা শকুন্তলার ছবিওলা ক্যালেন্ডার টাঙানো ছিল। ছেনু ঘুমের বদলে খালি এদিক ওদিক নড়াচড়া করতে থাকলে পিসিমা মাঝে মাঝে ঘুম পাড়ানোর জন্য সেই শকুন্তলার গল্প ছেনুকে শোনাত, শকুন্তলার দুঃখের গল্পগুলো শুনে ছেনুর চোখ দিয়ে টসটস করে জল পড়ত, আর ও উমম উমম করে শব্দ করতে করতে একসময়ে ঘুমিয়ে কাদা হয়ে যেত। পিসিমাও সেই ঘটনা শুনে বলল,"হ্যাঁরে! তুই নাকি গুপি গাইন বাঘা বাইন দেখতে পারিসনি ভয়ের চোটে! ওটা তো মজার বই শুনেছি। তাহলে ক্ষুধিত পাষাণ দেখলে কি করবি রে?"
- ওটা বুঝি খুব ভয়ের সিনেমা?
- ভয়ের মানে ভয়ের, ওখানে তো সবই ভুতুড়ে ব্যাপার স্যাপার। দুর্গ ভর্তি ভূত ঘুরে বেড়াচ্ছে আর লোকের ঘাড় মটকে দিচ্ছে। দাঁড়া তোকে একদিন হঠাৎ করে ক্ষুধিত পাষাণ দেখিয়ে দিতে হবে।
ছেনু কাঁচুমাচু হয়ে বলে,"তাহলে ওটা দেখলে তো আমি মরেই যাবো।"
সেই থেকে ওর মনে খুব ভয় হতো এই বুঝি কেউ ওকে ভুল করে ক্ষুধিত পাষাণ দেখিয়ে দিল। তাই সিনেমার কথা উঠলেই ও আর বেশি ধারে পাশে থাকত না।
কিন্তু সিনেমা ছেনুকে ছাড়লে তবে তো। আবার কিছুদিন পর একদিন খবর এলো জামাইবাবুদের অফিস থেকে নাকি পূরবীতে 'ঝিন্দের বন্দি'-র স্পেশ্যাল শো এর বন্দোবস্ত করা হয়েছে। জামাইবাবু ছেনুকে এসে বলল, "দেখো এটাতে কিন্তু ভূতটুত কিচ্ছুটি নেই। খুব বিখ্যাত সিনেমা, ভীষণ ভালো লাগবে। আর সিনেমাহলে ভয় পাওয়ার দুর্নাম ঘোচানোর এটাই সুবর্ণ সুযোগ।" তা ছেনুও সেই শুনে রাজি। জামাইবাবুর অফিসের অনুষ্ঠান বলে কথা, সেজেগুজে যেতে হবে। এই বারের পুজোয় ওকে যে সুন্দর কোটটা কিনে দিয়েছিল জামাইবাবু, ওটাই পরে যাওয়া মনস্থির করল। যাওয়ার দিন সকাল থেকে ছেনু চান টান করে চুল আঁচড়ে তৈরি। হাফ প্যান্টের সাথে কোটটা মানিয়েছেও খুব ভালো। টাইম মতো জামাইবাবু চলে এলো ওকে নিতে। ওখানে গিয়ে হলটা দেখে তো ছেনুর ভারি ভালো লাগল। অনেক লোকও এসেছে। সবার সাথে প্রথম বারের মতো ছেনু কোনো সিনেমা হলের মধ্যে ঢুকল। ঢুকেই দেখে সামনে বিশাল সাদা পর্দা। এখানেও সেই ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট এর মতো পরপর চেয়ার পাতা। প্রথমে বেশ কয়েকজন মিলে প্রদীপ জ্বালানোর পর, হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান শুরু হল। সেটা শেষ হতেই নানারকম গুরুগম্ভীর বক্তৃতা। একে একে সব মিটলে, শুরু হল আসল আকর্ষণ - সিনেমা।
সিনেমা শুরু হয়ে যখন হঠাৎ বিশাল পর্দা জুড়ে মানুষের মুখ ভেসে উঠল, ছেনু তো সেই দেখে বেজায় ঘাবড়ে গেছিল। ও বুঝেই পাচ্ছে না এসব ছবি আসছে কোথা থেকে। এই লোকগুলো কি পিছনে দাঁড়িয়ে আছে পর্দার? এসব গাছপালা, মাঠ, জঙ্গল, ট্রেন এসব কোথায় রাখা আছে? সিনেমার পর্দায় এসব দেখে তো ও হতবাক। সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিল, কিন্তু যখন হঠাৎ করে দুটো মুখোশ পরা লোক সাঁই সাঁই করে তরোয়াল চালাতে শুরু করল, সেই দেখে তো ছেনুর আত্মারাম খাঁচাছাড়া! অত বড়ো তরোয়ালে তো মহারাজ ছনেন্দ্রনাথকে এক নিমেষে কচুকাটা করে ফেলবে। আর সেই ভয়ে ও সোজা চেয়ারের তলায়। নতুন কোট ধুলোয় মাখামাখি। জামাইবাবু প্রথমে অন্ধকারের মধ্যে ব্যাপারটা ঠাহর করতে পারেনি। আশপাশের লোকও যখন অন্ধকারের মধ্যে সিটের সামনে দিয়ে যাতায়াত করছে, তাদের পা-ও লাগছে গিয়ে ছেনুর গায়ে। খেয়াল হতে জামাইবাবু মুখ বাড়িয়ে দেখে, ছেনুর এই অবস্থা! ফিসফিস করে বুঝিয়ে সুঝিয়ে ধুলো ঝেড়ে ছেনুকে চেয়ারে বসানো হল। ভালোই চলছে সিনেমা, হঠাৎ দেখে একটা লোক ঘোড়া ছুটিয়ে তেড়ে আসছে।
তাকে দেখেই ওর বুক পুরো ধড়াস করে উঠেছে, তাই আবার জায়গা বদলে মহারাজ সিটের নিচে। এভাবে যতবারই ছেনু একটু সাহস করে দেখার চেষ্টা করছে, আবার সে এসে সব মাটি করে দিচ্ছে। শেষমেশ বাকিটা সিটের তলাতেই কানে আঙুল দিয়ে বসে রইল। সিনেমা শেষে সেই ধূলিধুসরিত ছেনুকে বাড়িতে ফিরিয়ে এনে জামাইবাবু হার স্বীকার করে কাঁচুমাচু মুখে ঘোষণা করল এই ছেলেকে সিনেমা দেখানো আমার কম্ম নয়!
একজন ব্যর্থ হলে কি আছে, দায়িত্ববান মানুষজন কি পৃথিবীতে কম পড়িয়াছে? আবার ছুটি পড়তে মামা যখন শিয়ালদা ঘুরতে এসে ছেনুর সিনেমা অভিযানের কথা শুনল, তখনই ঠিক করে নিল, নাঃ, এর একটা বিহিত করতেই হচ্ছে। খবর নিল, কাছেই বীণা সিনেমা হলে বেশ মজার একটা ছোটদের সিনেমা চলছে। তাই একদিন দুপুরে সেটাই দেখতে যাওয়া মনস্থির হল। সেইমতো মামার হাত ধরে হলে গিয়ে ছেনু দেখতে পেল বাইরের পোস্টারে ইয়াব্বড় ছোরা হাতে একটা খোঁচা খোঁচা দাড়ি ওলা লোক, সাথে পিস্তল উঁচিয়ে আরেকটা গোঁফওলা হিংসুটে লোকের ছবি সাঁটা। মামা কাউন্টারে গিয়ে জিজ্ঞেস করে এসে বলল ছোটদের বইটা নাকি দুদিন হল, হল থেকে উঠে গেছে। তার জায়গায় একটা নতুন হিন্দি সিনেমা এসেছে।
"এটা দেখবি?"
ছেনু তো সেই প্রস্তাব শুনেই এক কথায় নাকচ করে দিল। সকাল সকাল এত বড় ঝুঁকি তার পক্ষে নেওয়া সম্ভব নয়। ছেনু বলে এইসব ভয়ানক সিনেমা দেখলে তার ভীষণ মাথা ঝিমঝিম করে আর পেটের ভিতরটা গুড়গুড় করে ওঠে, তাই আর যাই হোক এই সিনেমা দেখা তার পক্ষে সম্ভব নয়। অগত্যা মামা ভাগ্নে আবার ব্যাক টু প্যাভিলিয়ন।
শেষমেশ এই দোষ গিয়ে পড়ল ছোড়দার ঘাড়ে। সবাই ওকে বললো সত্যিই তো, কি দরকার ছিল প্রথম বার ওরকম করে ভয় দেখানোর। সিনেমা হলের কথা ভাবলেই বেচারা এখন ভয় পায়। ছোড়দা সেই শুনে গুম হয়ে গেল।
তারই প্রতিক্রিয়ায় কিনা কে জানে, এর বেশ কিছু মাস পর ছোড়দা একদিন ছেনুকে ডেকে বললো," চ, তোকে আজ নিউ মার্কেট থেকে ঘুরিয়ে নিয়ে আসি।" ছোড়দা, যে কিনা সারাক্ষন তার পিছনে লাগে আর বকাবকি করে সে যেচে ঘুরতে নিয়ে যেতে চাইছে, ব্যাপারটা ছেনুর খুব সন্দেহজনক মনে হল। ও ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল," তুই আমায় হঠাৎ নিউ মার্কেটে ঘুরতে নিয়ে যাবি?"
ছোড়দা হেসে বলে," কেন তোকে আমি কলেজ স্কোয়ারে নিয়ে যাইনি? শ্রদ্ধানন্দ পার্কে নিয়ে যাইনি? চ, ওখানে গিয়ে তোকে আজ কেকও খাওয়াব।"
সে কথা শুনে তো ছেনু খুব খুশি। দাদার সাথে নিউ মার্কেট ঘুরতে চলে গেল। নিউ মার্কেটে এক চক্কর ঘোরার পর ছোড়দা বলল চল ওদিকে কর্পোরেশন অফিসের সামনে থেকেও একবার ঢুঁ মেরে আসি। ছেনু ভাবে, ওদিকে আবার কি দেখার আছে? ওই তো ইয়াব্বড় লাল রঙের একটা বাড়ি, নিউ মার্কেটে ঢোকার আগেই তো দেখা গেল। ছোড়দা তবু যাবেই। ওমা, কর্পোরেশনের সামনে গিয়ে ছোড়দা তার ঠিক উল্টো দিকে হাঁটা লাগাল। সামনে এলিট সিনেমা হল। ছোড়দা সেইটা দেখিয়ে বলল," চল এলিটে আজ একটা সিনেমাই দেখে আসি।" ছেনু তো আঁতকে উঠেছে শুনে।
"কি সিনেমা?"
- একটা দারুণ রাশিয়ান সিনেমা চলছে, 'বুলেট ফিয়ার্স দা ব্রেভ!'
ছেনু হলের বাইরে পোস্টারের দিকে তাকিয়ে দেখে বিশাল একটা নল লাগানো যন্ত্রের ছবি, ওই ট্যাংক না কি বলে। সাথে মিলিটারির লোকজন সব বিশাল বিশাল বন্দুক হাতে দাঁড়িয়ে রয়েছে। সেটা দেখে তো ছেনু আর কিছুতেই ভেতরে ঢুকবে না। ছোড়দা যত ঢোকাতে চায় ভেতরে, ছেনু সমানে গেট আঁকড়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে, ওকে আজ মেরে ফেললেও ও ঢুকতে রাজি নয়। ছোড়দা তখন রেগেমেগে বলে,"ঢুকবি না মানে, আমি কি এমনি এমনি এলাম এতদূর?" এতক্ষণে মহারাজের বিরুদ্ধে চলা ষড়যন্ত্রের ছবিটা স্পষ্ট হল! তার মানে ছোড়দা ছেনুকে নিয়ে এই সিনেমাটা দেখবে আগেভাগেই ঠিক করে এসেছিল।
"এটাতে হাতিঘোড়া ভয়ের আছেটা কী? চল চুপচাপ" বলে নিমেষের মধ্যে ছেনুকে চ্যাংদোলা করে তুলে নিয়ে ছোড়দা হলে ঢুকে পড়ল।
সিনেমা শুরু হতেই নানা রকম গোলাগুলি, দৌড় ঝাঁপ, বিস্ফোরণ শুরু হয়ে গেল। দেখে তো ছেনু রীতিমতো আতঙ্কিত। এই বুঝি সব গায়ে এসে পড়ল। ও কানে আঙুল দিয়ে সিটের মধ্যে মাথা গুঁজে রয়েছে ভয়ের চোটে। সেটা দেখেই ছোড়দার এক ধমক, হচ্ছেটা কি! ছেনু বলে," গায়ে এসে পড়বে তো!" দাদা অভয় দিয়ে বলল," এই তো আমরা সবাই বসে রয়েছি, আমাদের গায়ে এসে লাগছে গুলি? যা হওয়ার তো হচ্ছে পর্দায়।" তাতে ছেনু কিছুটা আশ্বস্ত হলেও পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারলো না। সোজা হয়ে বসেও চোখে হাত চাপা দিয়ে রেখেছে। আবার খেয়াল করে দেখল, যদিও সিনেমাটার কথাবার্তা কম, কিন্তু সেসব কথাবার্তার কিচ্ছুটি বোঝা যাচ্ছে না, এমন ভাষায় তারা বলছে। ছোড়দাকে সেকথা বলতে ছোড়দা বলল," কথা বোঝার আছেটা কি, হাত সরিয়ে দেখ না কি হচ্ছে পরপর, তাহলেই বুঝতে পারবি।" ও তখন সাহস করে মাঝে মাঝে আঙুলের ফাঁক দিয়ে সিনেমাটা দেখতে লাগল। মোটের ওপর খারাপ না। নানান রকম ঘটনা একের পর এক হয়ে চলেছে, বেশির ভাগই সৈন্যদের নিয়ে। কখনো তারা লুকিয়ে পড়ছে, কখনো বন্দুক উঁচিয়ে গুলি করছে, কখনো আবার কাকে স্যালুট করছে। মাঝে মাঝে আবার সেই ট্যাংক এসে পড়ছে। সেটা দিয়েও গোলাগুলি চলছে। একটা ট্যাংকের সাথে আবার বাকি ট্যাংকদের যুদ্ধ চলছে। যেহেতু ও কথাবার্তা বা ঘটনাক্রম কিছুই খুব একটা বুঝতে পারছিল না, তাই ভয়ও তেমন লাগছিল না। তবে শেষের দিকটা বেশ ভালোই লাগল। সিনেমা শেষ হতে ছোড়দা বিজয়ীর হাসি হেসে ছেনুকে বগলদাবা করে আবার নিউমার্কেটে ঢুকল। সেখান থেকে নাহুমের কেক কিনে খেতে খেতে যখন দুজনে ফেরার পথ ধরেছে, ছোড়দা জিজ্ঞেস করল,"কি? দারুণ সিনেমা না! দেখলি শেষে একটা ট্যাংক কিরকম বাকি ট্যাংকগুলোকে হারিয়ে দিল!" ছেনুও সেই শুনে হেসে বলে,"তারপর যেই সবাই মিলে ট্যাংকটার ওপর উঠে দাঁড়াল আমার তো খুব মজা লাগছিল।"
তাই শুনে ছোড়দা ওর পিঠ চাপড়ে বলে,"বাঃ, এই তো সিনেমা দেখতে শিখে গেছিস।"
যাই হোক, বুঝুক না বুঝুক, সিনেমাহলে যাওয়ার প্রাথমিক ভয়টা সেদিনই অনেকটা কেটে গিয়েছিল ছেনুর।
এর বেশ কিছুদিন পরের ঘটনা। মামা ততদিনে বদলি হয়ে ধানবাদে। দিদিমাও কৃষ্ণনগর থেকে এখানে চলে এসেছে। আর ছেনুই কি করে দূরে থাকে। ও তাই এখানে ঘুরতে এসেছে ক'দিনের জন্য। অবশ্য ও একা একা আসবে কী করে, দিদিমাকে আনার সময়ই মামা কলকাতা থেকে ওকে নিয়ে এসেছে। সেবার ধানবাদে গিয়ে ছেনু কি কি মজা করল, সেসব ব্যাপার পরে কখনো গুছিয়ে বলা যাবে'খন, আপাতত আসল ব্যাপারটায় আসা যাক। মামার বাড়ির খানিকটা দূরেই মাঠে পর্দা টাঙিয়ে সিনেমা দেখানো হবে। সকাল থেকে তাই নিয়ে তোড়জোর চলছে। অনেকের দেখতে আসার কথা। মামা ছেনুকে বলল," কি রে, যাবি নাকি দেখতে?" ছেনু তো একপায়ে খাড়া। এরকম মাঠের মধ্যে খোলা হাওয়ায় সিনেমা ও আগে কখনো দেখেনি। সন্ধ্যে থেকে শুরু হয়ে রাত এগারোটা-বারোটা অব্দি চলবে হয়তো। তো সেদিন পায়ে চোট লেগেছিল না কি একটা কারণে মামা আর যেতে পারলো না, ছেনুকে বলল,"আমি তো আজ যেতে পারছি না, এই পাশের বাড়ির কাকুটাও যাচ্ছে, ওনার সঙ্গে গিয়ে দেখে আয়। পারবি তো?"
ছেনু তো এত্তখানি ঘাড় কাত করে দিল।
ওদের যেতে ওইদিন একটু দেরিই হয়ে গিয়েছিল। কাকুটা বলল,"দুটো সিনেমা হবে আজ, কিন্তু অত দেখতে গেলে রাত হয়ে যাবে, আমরা একটা দেখেই চলে আসবো, কেমন।" ওরা গিয়ে দেখে সিনেমা ততক্ষণে শুরু হয়ে গেছে। পেছনে রাখা একটা বড় যন্ত্র থেকে আলো এসে পড়ছে পর্দার ওপর। তাড়াতাড়ি একটা ভালোমতো জায়গা দেখে ছেনুরা বসে পড়ল। সিনেমাটার নামটা যে কী, সেটা আর জানা গেল না। তবে নামে কিবা আসে যায়। বেশ অন্যরকম সিনেমাটা। সবাই বাংলাতেই কথা বলছে। কোনো মারামারি, খুনোখুনি, তরোয়াল ঘোরানো, কিচ্ছুটি নেই। ধানবাদের লোকজন কতটা আনন্দ পাচ্ছে বলা মুশকিল, কারণ মাঝে মধ্যে শুধু ফিসফিস করে কথা বলার আওয়াজ আর মশা মারার চটাস চটাস শব্দ শোনা যাচ্ছে। তবে ছেনুর বেশ ভালোই লাগছে। একটা লোক একটা বড় বাড়িতে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মাঝে মধ্যে নানা রকম গান হচ্ছে। তবে যত এগোচ্ছে তত কেমন কেমন একটু অদ্ভুত লাগছে সিনেমাটা। কোন কোন জায়গা একটু যেন গা-টা ছমছম করেও উঠলো। দর্শক এমনিতে চুপ ছিল, অনেকক্ষণ পর নায়িকাকে দেখানোয় সবাই একটু নড়ে চড়ে বসলো। তা ছেনু সেসব খেয়াল করছে না, ও সিনেমাটাই মন দিয়ে দেখছে। মাঝে মধ্যে আবার নানা রাজা বাদশার ঘটনাও চলে আসছে। দরবারে নাচ গান হচ্ছে। তবে কখন কি যে হচ্ছে, খুব একটা বোঝা যাচ্ছে না। মাঝে মাঝে একটা জায়গা একটু ভয় ভয়ও করে উঠল। এভাবে চলতে চলতে একসময় সিনেমাটা শেষ হয়ে গেল। শেষের দিকটা একটু কেমন দুঃখ দুঃখ মতো ছিল। যাই হোক, বেশ ভালোই লাগল সব মিলিয়ে। তবে মনে একটাই খিঁচ রয়ে গেল, সিনেমাটা যে কি সেটাই আর জানা হল না। কি আর করা যাবে। বাকি দর্শকরা তখন আবার পরের হিন্দি সিনেমাটার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। এমনিতে সন্ধ্যের পর ধীরে ধীরে রাস্তাঘাট সব শুনশান হয়ে যায় ওদিকে। তার ওপর রাস্তার আলোও তেমন থাকেনা। ছেনু কাকুর সাথে গুটিগুটি পায়ে বাড়ির পথ ধরেছে। ছেনুর কি মনে হল, হঠাৎ কাকুকে জিজ্ঞেস করল,"আচ্ছা, এই যে সিনেমাটা এক্ষুণি আমরা দেখলাম, ওটার নামটা কি গো?"
কাকু ওর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে বলল,"এই বইটা, এটা তো ক্ষুধিত পাষাণ!"
সেই কথা শুনে মহারাজের মুখ নিমেষের মধ্যে সাদা হয়ে গেল। যদি নাটকের দৃশ্য হত, নির্ঘাত পাশে ছোট ছোট করে লেখা থাকত,'পতন ও মূর্ছা'। একটু সামলে উঠে সামনের অন্ধকার রাস্তার দিকে একবার সভয়ে তাকিয়ে, চোখ বুঁজে মহারাজ বাড়ির দিকে সেই যে দৌড়টা মারলেন, পাশাপাশি দৌড়ালে মিলখা সিংও বোধহয় কয়েক কদম পিছনে পড়ে থাকত।