শাঁ করে একটা তির চলে গেল মহারাজ ছনেন্দ্রনাথের কান ঘেঁষে। নেহাৎ তিনি ভাঙা দেওয়ালের পিছনে লুকিয়ে আছেন তাই রক্ষে! মাথাটা বের করলেই আবার এসে বিঁধতে পারে তির। যুদ্ধের এই পর্যায়ে এসে তিনি আর তাঁর রক্ষী বাহিনী এখন এই ভাঙা দেওয়ালের আনাচে কানাচে লুকিয়ে রয়েছেন আর ভাবছেন বিপক্ষের সৈন্য কাকে কাকে ধরে ফেলল এতক্ষণে। দেখা গেল সেই সৈন্যটা ভীষণ চালাক, সবাইকেই পট পট ধরে ফেলছে। বাকি শুধু মহারাজ ও বুচকুন। কিন্তু টুকাইটা খুব চালাক, বুচকুনের একটুখানি ছায়া ওর চোখে পড়ে গেছে। টুকাই অর্থাৎ আজকের বিপক্ষ সৈন্য এবার নিশ্চিত জয়ের মুখোমুখি, পা টিপে টিপে বুচকুনের দিকে এগোচ্ছে। টুকাই প্রায় পৌঁছে গেছে, একবার পিছনে ঘুরলেই মহারাজ ধরা পরে যাবেন আর সামনে গেলে বুচকুন। বুচকুনকে প্রায় ধরে ফেলে ফেলে, এমন সময় মহারাজ এক লাফে টুকাইয়ের পিঠে ঝাঁপিয়ে পড়ে চেঁচালেন, "ধাপ্পা!" ব্যস, আর কি, টুকাই আবার চোর! হুঁ হুঁ, নিজের জমিতে মহারাজকে হারানো কি এতই সহজ!
এই মাঠ, ভাঙাচোরা দেওয়াল, বিশাল দরজা, আর ইটের স্তুপ ঘিরে ছেনু আর ওর বন্ধুরা প্রায়ই লুকোচুরি, কুমির ডাঙা, কানামাছি, এইসব খেলে। ও তখন আরো ছোটো, বাড়ির বাইরে অন্য কোথাও যাওয়া মানা। কিন্তু বাড়ি থেকে দেখা যায় বলে, এইখানে আসতে কোনো বারণ নেই। ওখানেই এক ছোট ঘরে, এক কোণে টুলের ওপর বসে বেনা (বেনা-কে পাঠকদের মনে আছে নিশ্চই, আর না থাকলে নো চিন্তা, চট করে ছনেন্দ্রনাথ আর মার্কণ্ডেয়র চিঠি পর্বটা একবার পড়ে নিলেই হবে) সবার উপর নজর রাখতো, খেলাধুলোর মধ্যে কেউ ধাক্কাধাক্কি করলে বা বেশি হুল্লোড় পাকালে, "অ্যাই!" বলে একটা বাজখাঁই ডাক ছাড়ত, ওমনি সবাই ঠাণ্ডা। মাঠের এই জায়গাটা ছেনুর ভারি ভালো লাগে, কি সুন্দর একটা দুর্গের অংশ মতো মনে হয়। কেমন ভাঙা দেওয়ালের ফাঁক বেয়ে রোদ্দুর এসে মাটিতে পড়ে, কোণে কোণে আগাছা আর ঘাস, কত পুরোনো কথা যেন সব এই দেওয়াল আর মাটি জুড়ে লেগে রয়েছে। ছেনুই একমাত্র কান পেতে সেইসব কথাগুলো শুনতে চেষ্টা করে। মাঝে মাঝে ও হাঁ করে বিশাল দরজাটার দিকে তাকিয়ে থাকে। পুঁচকে ছেনুর সামনে সেটা এতটাই উঁচু, ও ভাবে এটা সাধারণ দরজা হতেই পারে না, ছবিতে দেখা রাজবাড়ির সিংহ দুয়ারের মতোই মনে হয়। সাধারণ মানুষ টানুষ নয়, নির্ঘাত কোনো রাজা মহারাজাই ঘোড়ায় চড়ে যাতায়াত করতো, তাই এত উঁচু করে বানিয়েছে। কিন্তু হঠাৎ রাজা-রাজরাই বা এলো কোত্থেকে? কি আশ্চর্য! দরজাটা এতো উঁচু, দেওয়াল গুলো এত উঁচু, এমনকি ভাঙা ঘরটার ছাদও এতটা উচুঁ, তাহলে রাজাদের জন্য ছাড়া আর কার জন্য হবে? তাই তো ছেনু এটার নাম দিয়েছে বিরাট রাজার মাঠ। সেই বিরাট রাজা আর তার সৈন্য-সামন্ত, ঘোড়া টোড়া এখন সব উধাও হয়ে গিয়েছে, এই যা। আগে রাজার ঘোড়াগুলো নিশ্চয়ই এই মাঠটা জুড়েই ঘুরে বেড়াত, আর দুপুর বেলা ঘরের মধ্যে এসে ঘুমিয়ে নিত।
কিন্তু ছেনু ভুল করে যাদেরকেই এই বিরাট রাজার কথাটা বলে ফেলেছে, তারা সবাই হেসেই উড়িয়ে দিত। পাগল নাকি? শেয়ালদার এই বিতিকিচ্ছিরি ভিড়ের মধ্যে বিরাট রাজার ঘোড়া আসবে কোত্থেকে!
ছেনু কি করে তাদের বোঝায়, আশেপাশে এত ঘোড়া ঘুরে বেড়ায় সেগুলোও তো দেখা যায়না! কিন্তু তাদের কথা তো সবাই জানে, সেগুলোর কথা তো কেউ হেসে উড়িয়ে দেয়না। উল্টে তাদের নিয়ে গভীর আলোচনা লেগেই রয়েছে। মাসদুয়েক অন্তর অন্তর ছেনুর জন্য একটা বিচ্ছিরি দিন টুপ করে চলে আসে। আগের দু-তিনদিন যেই মা বলে, "এবার কিন্তু চুল গুলো বেশ বড়ো হয়ে গেছে, চোখের ওপরে এসে পড়ছে।" তার ঠিক পরেই এক সকালে ছোড়দা এসে পাকড়ে ধরে চুল কাটার দোকানে এনে বসিয়ে দিয়ে যায়। সেখানে ছেনুর আবার আলাদা খাতির। সবাই চেয়ারেই বসে, কিন্তু ওর জন্য চেয়ারের হাতলের ওপর আবার একটা পাটাতন পেতে তাতে বসানো হয়। সেখানে বসে বসে দিব্যি সবার মাথার সাথে সমান সমান হয়ে যায় ওর মাথাটা। তারপর শুরু হয় সেই ভয়াবহ ব্যাপার। সেলুনকাকু মাথার মধ্যে একগাদা জল ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করে ছিটিয়ে দিয়ে একটা ইয়াব্বড় কাঁচি আর চিরুনি নিয়ে তেড়ে আসে। ওই দেখেই তো মহারাজ আঁতকে ওঠেন। তবে সেই কাকু আবার গপ্পে ঢুকে পড়লে কিছুক্ষণের নিশ্চিন্তি। ওই সেলুনে সারাক্ষণ যতরাজ্যের ঘোড়ার গপ্প চলতে থাকে, কোনটা জোরে দৌড়ায়, কোনটা আস্তে দৌড়ায়, কোনটা তাজা, কোনটা বুড়ো হয়ে গেছে এসব নিয়েই তাদের যত গল্প। শুনতে শুনতে কানের পোকা বেরিয়ে যায়। কিসব নাম সেই ঘোড়াদের- ডায়মন্ড, মর্নিং গ্লোরি, এটলাস, সুপারস্টার, সিকান্দার, ব্ল্যাক জুয়েল। এইসব ঘোড়ারা নাকি দৌড়ে ফাস্টও হয় মাঝে মাঝে। বদ্দি একবার এরকম দৌড়ে ফাস্ট হয়েছিল ইস্কুলে, তাই একটা টিপিন বাক্স বাড়ি নিয়ে এসেছিল। তাহলে এইসব ঘোড়াদের বাড়ি কতগুলো টিপিন বাক্স জমে গেছে ভাবো! ছেনু একবার সেলুনকাকুকে জিজ্ঞেসও করেছিল, "তুমি দেখেছ এইসব ঘোড়াদের?" কাকু কোনোদিন দেখেনি। কিন্তু তবু তো সবাই মিলে তাদের নিয়েই গল্প করছে! এতগুলো অদৃশ্য ঘোড়া দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে আশেপাশে, শুধু বিরাট রাজার ঘোড়াগুলো চলে এলেই দোষ!
তবে ওই মাঠ আর ভাঙা ঘরদোর, বিকেল বেলায় মহারাজ ছনেন্দ্রনাথের দখলে থাকলে কি হবে, সকাল বেলায় তার ভোল যেত বদলে। এত এত কলার ঝুড়ি নিয়ে লাইন দিয়ে সব কলাওলারা বসে পড়ত সেইখানে। সিঙ্গাপুরি, মর্তমান, কাঁঠালি, সবরি, চাঁপা কলা, কাঁচ কলা কি নেই! সকালে ওখানকার নাম হয়ে যেত কলাপট্টি। ছেনু একদিন সকালে বড়দাকে ডেকে বললো, আচ্ছা শোন না, এই বিরাট রাজার মাঠে সকাল হলেই এত কলাওলা কোত্থেকে চলে আসে রে? ছোড়দা, বদ্দি, ছোদ্দিরা সব ইস্কুলে, বড়দা তখনও চাকরিতে ঢোকেনি, কোথাও যাওয়ার তেমন কোনো তাড়াহুড়ো নেই। কি একটা উত্তর দিতে যাচ্ছিল ছেনুকে, কিন্তু ছেনুর মুখে 'বিরাট রাজার মাঠের' নাম শুনে চুপ করে গেল, খালি অস্ফুটে বলল, ঠিকই তো, বিরাট রাজার মাঠই বটে।
বড়দা তখন আর কথা বলবে কি, চোখের সামনে যেন দেখতে পাচ্ছে মাঠটা পুরো গমগম করছে, ভাঙা বাড়িটাও গোটা হয়ে গিয়ে ঝকঝকে তকতকে, লোকে লোকে জায়গাটা ছয়লাপ। মাঠ জুড়ে বড় বড় টেবিল পাতা, পাশে সার দিয়ে চেয়ার। ওয়েটাররা রান্নাঘর থেকে প্লেটে করে সব গরমাগরম খাবার দাবার এনে টেবিলে রেখে যাচ্ছে। বড় ঘরটা জুড়েও সব বড় বড় শ্বেত পাথরের টেবিল রাখা।
সেখানেও লোক ভর্তি। ওয়েটাররা এদিক সেদিক ছোটাছুটি করছে। রান্নাঘরে বিশাল বিশাল হাঁড়ি, ডেকচি, কড়া নিয়ে ঠাকুররা সব রান্না করছে। বাড়িটার সামনে জ্বল জ্বল করছে নাম- 'শিয়ালদা রেস্টুরেন্ট'। বড় ঘরের এক কোণায় সাদা গদি পাতা। তাতে বালিশে হেলান দিয়ে আয়েশ করে বাবা বসে আছেন। পাশের টেবিলে ক্যাশ বাক্স সামলিয়ে হিসেব দেখছে জগন্নাথদা। ওয়েটাররা এসে মুখস্ত হিসেব বলছে আর সেই অনুযায়ী লিখে নিচ্ছে পরপর। ঠিক যেন কালকের ঘটনা।
সেই বাবা এখন বিছানায় শয্যাশায়ী। চোখে দেখা যায় না মানুষটার কষ্ট। কি ছিল আর কোথা থেকে কি হয়ে গেল।
বড়দার সেই দিনগুলো ভীষণ ভাবে মনে পড়ে যায়, তখন আর সামলাতে পারে না নিজেকে। ছেনুকে বলল,"বিরাট রাজার আমলের একটা গুপ্তধন দেখবি?" ছেনু তো শুনেই লাফিয়ে উঠেছে, "সত্যি! দেখাও, দেখাও।"
বড়দা বলল,"দাঁড়া, দেখি কোথায় রয়েছে।"
সেদিন অনেক খুঁজে টুঁজে বড়দা আলমারির পেছন থেকে একজোড়া পুরোনো ধুলোমাখা ফুটবল খেলার বুট বের করে আনল। সেই দেখে ছেনু খুশি হবে কি, উল্টে রেগেমেগে বলল,"এই বিচ্ছিরি জুতোটা তোমার গুপ্তধন?"
বড়দা একটুও না চটে হেসে বলল,"এই জুতোটা কার জানিস?"
- কার?
- মেওয়ালালের জুতো।
- সেটা আবার কে?
- মেওয়ালালের নাম শুনিস নি? বিশাল বড় ফুটবল প্লেয়ার। সে আমায় এই জুতো দিয়েছিল। আমি আসলে ফুটবল খুব ভালোবাসতাম তো।
- সে তোমায় আবার চিনল কি করে?
- চিনবে না! কত আসত আমাদের দোকানে। কত গল্প করত বাবির সাথে। শুধু কি মেওয়ালাল, সাথে পি কে ব্যানার্জি, বাঘা সোম, বলরাম সবাই আসত। বাঘা সোম তো বাবির খুব ভালো ব্ন্ধু ছিল। রেলের হয়ে যারাই খেলত সবার খাওয়া দাওয়া ফ্রি ছিল আমাদের দোকানে।
- ফ্রি ছিল কেন?
- বাবিও তো ফুটবলের খুব ভক্ত ছিল, তার ওপর জেঠুও তো রেলে চাকরি করত, তাই বাবির নিয়ম ছিল, রেলের প্লেয়ারদের খাওয়া ফ্রি। তবে জেঠু কিন্তু ছিল ক্রিকেটার। তখন এত ভালো খেলত, ইংল্যান্ডেও গেছিল খেলতে। সেই ক্রিকেট খেলেই রেলে চাকরি পেয়েছিল। রেলের প্লেয়াররা বাবিকে এত ভালোবাসত, ইস্টার্ন রেল যেবার আই এফ এ শিল্ড জিতেছিল, তারা আনন্দ করে শিল্ডটা আমাদের দোকানে নিয়ে চলে এসেছিল। সেটা আমাদের দোকানে রেখে সেদিন খুব আনন্দ উৎসব চলেছিল। সেদিন আনন্দে দোকানের সব খদ্দেরকে ফ্রিতে খাইয়েছিল বাবি। ইস্টার্ন রেলের সেই একবারই আই এফ এ শিল্ড জেতা।
- তাই! তুমি দেখেছ সেটা?
- নাঃ আমি দেখিনি, তখন তো জন্মই হয়নি আমার। কিন্তু আমি শুনেছি, বাড়ির সবাই গল্প করতো।
- বাবি তো দেখেছে। বাবি বলতে পারবে না?
- সে তো পারবেই, কিন্তু বাবি এখন শুয়ে আছে, একটু শুয়ে থাকতে দে।
- বাবি আজকাল এত শুয়ে থাকে কেন রে?
- ডাক্তার কাকু বলেছে তো শুয়ে থাকতে। আর এখন শুয়ে আছে আবার পরে উঠে পড়বে'খন। তুই এইসব নিয়ে ভাববি না একদম, ঠিক আছে?
- ঠিক আছে। চল না তাহলে আমরা ছাদ থেকে ঘুরে আসি।
- দাঁড়া, তোকে একটা মজার গল্প বলি আমাদের ছাদ নিয়ে। এই ছাদটা একদিন জানিস পুরো লোকে লোকে ভর্তি হয়ে গেছিল!
- কেন?
- সেটাই তো বলছি, একদিন রাত্তিরে শিয়ালদায় কোন একটা ট্রেন ক্যানসেল হয়ে গেছে, ছাড়বে নাকি আবার পরদিন সকালে। এবার এত লোক সব ট্রেন ধরতে এসে আটকে পড়েছে। তারই মধ্যে কেউ কেউ বাবির দোকানের চেনা খদ্দের, বাবি তাদের মুখে সেই কথা শুনে ওমনি বলল, স্টেশনে থাকতে হবে না, আপনারা পরিচিত যারা আছেন, সবাই মিলে এখানে চলে আসুন, আমি ব্যবস্থা করছি। সেই শুনে সেই লোকগুলোর চেনাশোনা যারা, তারা ছাড়াও সেই ট্রেনের আরো লোক এসে হাজির। যা খাবার দাবার বেঁচে ছিল সব তাদেরকে খাওয়ানো হল। খাওয়া দাওয়ার পর সবার জন্য চাদর টাদর পেতে আমাদের ছাদে বিছানা করা হল রাত্রে। সেই বাড়ি জুড়ে হইহই ব্যাপার। বাড়ির মধ্যে এত ভিড় দেখে মা সেদিন খুব ঘাবড়ে গেছিল।
- অত লোকের খাবার দাবার এলো কী করে?
- আসবেনা কেন? ঢালাও রান্না হতো তো। প্রত্যেকদিন দোকানে সব টাটকা খাবার খাওয়ানো হত। তাই যেদিন যা খাবার বেঁচে যেত, সেসব রাত্রিবেলা গরিব লোকেদের সার করে বসিয়ে খাইয়ে দেওয়া হত। সেদিনও যা খাবার বেঁচে ছিল সব ট্রেনের লোকেদের দেওয়া হয়েছিল। একটাও তো কোনো খারাপ নয়। সবই সেদিনের গরমাগরম রান্না।
- বাপরে! এত খাবার রোজ রোজ আসতো কি করে?
- বেনা আছে না! বেনাই তো সকাল সকাল দু'জন মুটে নিয়ে শেয়ালদা বাজারে গিয়ে দেখেশুনে সব বাজার করে নিয়ে আসতো, ঝাঁকা ভর্তি বাজার! সব সেদিনের রান্নার জন্য। সকালে চলত হোটেল, বিকেল থেকে রেস্টুরেন্ট।
মানে কেমন জানিস, সকালে ভাত, ডাল, মাছ, মাংস, তরকারি এসব পাওয়া যেত, আর বিকেল থেকে ফিশ চপ, ফিশ ফ্রাই, ডিমের ডেভিল, ফাউল কাটলেট, ফিশ কাটলেট, চিকেন দোপেঁয়াজা, মাটন দোপেঁয়াজা, পোলাও, মোগলাই পরোটা, রুটি চালু হয়ে যেত। ঠিক বিকেলবেলা আবার মাটন স্ট্যু, চিকেন স্ট্যু এসব হতো, প্লেয়াররা এসব টোস্ট দিয়ে খেতে ভারি ভালোবাসত। আবার ভোরবেলা চা, কফি, টোস্ট, ডবল ডিমের অমলেট এসব তো ছিলই।
- উফ্, এসব কবে আমাদের বাড়িতে হবে বলো তো!
- তুই তো এইটুকুনি পুঁচকে, তুই আবার এসব কি খাবি! তোর জন্য শুধু ভাত আর শিঙ্গি মাছের ঝোল।
- নাআআ!!
- আচ্ছা ঠিক আছে, তাহলে বাকি ঘটনা শোন।
বাবির দোকানের খুব নাম ছিল টাটকা খাবারের জন্য। তাই সারাদিন খদ্দেরের ভিড়। একদিন কাছেরই আরেকটা দোকান ব্যারন'স এর ম্যানেজার হঠাৎ আমাদের বাড়ি চলে এসেছে, বাবিকে বলছে, আপনি কিছুটা দাম না বাড়ালে তো আমরা আর ব্যবসা করতে পারছি না। দোকান ফাঁকা যাচ্ছে। সেই শুনে বাবি হেসে বলল, সে আপনাদের ব্যাপার, বাসি খাবার খাওয়ালে তো দোকান ফাঁকা যাবেই, আমি কি করব। ওই যে ফিশ চপের কথা বলছিলাম সেটা ছিল দোকানের সবচেয়ে বিখ্যাত আইটেম। চপটায় পুর হিসেবে মাছ ছাড়া আর কিচ্ছু থাকতো না। এই বড়ো বড়ো পিস মাছ একটা চপের মধ্যে মণ্ড করে দেওয়া হত। এটা দোকানে দিয়ে কুলানো যেত না। কেউ কেউ খেয়ে বাবির কাছে চপের এত সুন্দর টেস্টের রহস্য জানতে চাইলে বাবি হা হা করে হাসত, আর এই মোটা গোঁফে একবার তা দিয়ে বলতো, সেরা মাছ আনাই বাজার থেকে, বুঝলে। এর আর কোনো বিকল্প নেই! মামা একবার গল্প করেছিল, তখন তো মামা এখানে থেকে পড়াশোনা করত। একবার একটা লোক এসেছিল দোকানে খেতে, কথায় কথায় বেরিয়ে পড়ল, সে নাকি কৃষ্ণনগরের লোক। ব্যস, বাবি সেই শুনেই তো আর পয়সা নেবে না কিছুতেই, বলছে আমার শ্বশুরবাড়ির লোক আপনি, কি করে পয়সা নেব! সেই লোকটা কৃষ্ণনগরে গিয়ে নাকি সবাইকে এই দোকানের কথা গল্প করত। আসলে এত সুন্দর পোর্সেলিনের প্লেটে করে সব খাবার পরিবেশন হত, সমস্ত বিদেশি সব কাটলারি, ব্যাপারই আলাদা ছিল। দোকানের ভেতরে মাথার ওপর দশটা বড় বড় পাখা ঘুরত। অবশ্য বিদেশি কাটলারি পরে কমিয়ে দেওয়া হয়, নইলে মাঝে মাঝে চুরি হয়ে যেত, নজর করে থাকতে হতো সেইদিকে। একবার একটা খদ্দের দারুণ একটা পোর্সেলিনের প্লেট হাত থেকে ফেলে ভেঙে ফেলায় বাবি এমন বকুনি লাগিয়েছিল, সে সেখানেই প্রায় কেঁদে ফেলে আরকি। বাবির চেহারাটাই তো এমন রাশভারী, আর রেগে গেলে চোখগুলো আরো গোল গোল হয়ে যেত। তবে বকাঝকা করলেও বাবি প্লেট ভাঙার জন্য ওর থেকে কোনো ক্ষতিপূরণ নেয় নি।
- আমার তো বাবির সামনে যেতেই ভয় লাগে। আর ওই লোকটাকে এমন বকেছিল বলছ, তার তো ভয় লাগবেই।
গল্পটা ভালোই জমেছিল, এমন সময় মা অন্য ঘর থেকে বড়দাকে ডাকতে, বড়দা সেই শুনে মা'র কাছ থেকে কি একটা কাগজ নিয়ে হুট করে বেরিয়ে চলে গেল।
আধঘন্টা পর যখন ফিরে এলো, ছেনু দেখে বড়দার মুখ জুড়ে অন্ধকার। মাকে গিয়ে বড়দা বললো, কিছুতেই ফেরত দিল না মা, শুধু মাসখানেক দেরি হয়েছে মাত্র, তবুও গয়নাগুলো ফেরত দিল না। ওর সাফ কথা, এক মাসের চুক্তি ছিল, দুমাস পেরিয়ে গেছে, ও আর ফেরত দেওয়া যাবে না। মা সেই শুনে গুমরে উঠে কান্না চেপে মুখ ঘুরিয়ে নিল। আসলে কান্না পাওয়ারই কথা, একসময় এমন ছিল, ছেনুর মা, ছেনুর বাবার সাথে বৌবাজারে গয়নার দোকানে গেলে কোনো রেডিমেড গয়না কিনত না, বাড়ি থেকে নিজের হাতে কাগজে ডিজাইন এঁকে নিয়ে যেত, সেই ডিজাইনের গয়না তৈরি হত। এরকম বছর বছর নিত্য নতুন সমস্ত গয়না জমতে থাকতো মায়ের। বড়ই প্রিয় সে সমস্ত গয়না একে একে মোটা সুদে বন্ধক দিয়ে চালাতে হচ্ছে আজকাল, কখনো কখনো মামলার খরচ যোগাতে, কখনো সংসার খরচ, কখনো বা চিকিৎসার খরচ। অথচ একসময়ে এই ছেনুর বাবার কাছেই পাড়ার যত দীন দরিদ্র লোক টাকা ধার চাইতে আসত। উনি অকাতরে সেসব টাকা কখনো ধার হিসেবে, কখনো সাহায্য হিসেবে বিলিয়ে দিতেন। বেশিরভাগ সময়ই সেই টাকা আর ঘরে ফেরত আসত না। সেদিনের জমিদারি মেজাজের দিল দরিয়া মানুষটার সাথে যখনই আজকের শয্যাশায়ী মানুষটাকে মেলাতে যান, মায়ের চোখ দিয়ে শুধু টপ টপ করে জল পড়ে।
আসলে যবে থেকে মামলা শুরু হল জমি আর দোকান নিয়ে, প্রথমেই কোর্টের রায়ে দোকানটা গেল বন্ধ হয়ে। ছেনুর বাবাও উকিলকে বিশ্বাস করে যেখানে বলত সেখানে সই করে দিতেন, যখন যত টাকা চাইতো সব ধরে দিয়ে দিতেন মামলার খরচ হিসেবে। কেউ তা নিয়ে ভুলেও যদি কথা বলতে যেত, প্রথমত ওনার মেজাজের সামনে মুখ খোলার জো ছিলনা, এইসব সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে কারোর কথা তিনি শুনতেন না, চেঁচিয়ে বলতেন,"তোমরা কি আমার থেকে বেশি বোঝো?" আর দ্বিতীয়ত, উকিলবাবুকে নিয়ে প্রশ্ন তুললে সাফ বলতেন,"ও আমাকে ঠকিয়ে যাবে কোথায়? ওর সেই হিম্মত আছে নাকি!" তাই একদিনও কোর্ট কাছাড়িতে না দৌড়ে দিনের পর দিন শুধু সেই উকিলের ওপর ভরসা করে টাকা দিয়ে গেছেন। মামলা চলাকালীন দোকানের ভাড়া রেন্ট কন্ট্রোলে জমা করতে হত। সেই টাকাও উকিলকেই দেওয়া হত জমা করার জন্য। সে কোনোদিনই রসিদ দিত না, তবুও ওনার টনক নড়েনি। কিন্তু এত দান ধ্যান করে, কর্মচারীদের সংসার টেনে, নিজের সংসার চালিয়ে জমা টাকায় আর কতদিন চলবে। কোন এক কোর্টের রায়কে হাতিয়ার করে জমির মালিক ও প্রমোটার মিলে লোকজন নিয়ে দোকানটা অর্ধেক ভেঙেও দেয়। তাড়াতাড়ি আবার স্থানীয় নেতার হস্তক্ষেপে সেই ভাঙচুর আটকে দেওয়া হয়। আসলে দোকানটা ছিল ওনার প্রাণ। সেই দোকানটাই বন্ধ হয়ে যাবে এই ব্যাপারটা তিনি কিছুতেই মন থেকে মেনে নিতে পারেন নি। একে একে সব কর্মচারী ছেড়ে চলে যায়। পাশে রয়ে গিয়েছিল একমাত্র বেনা। তার দেশের বাড়িতে জমিজমা, গোরু-মোষ সবকিছুই ছিল, তবুও সে কিছুতেই তার 'বাবুজি'-কে ছেড়ে যেতে রাজি নয়। ও বলল আমায় এক কোণে থাকতে দিও, তোমরা যা খেতে দেবে তাই খাবো, কিন্তু বাবুজি কে এই বিপদের দিনে ছেড়ে যেতে পারবো না। দোকান বন্ধের পর থেকেই একে একে ছেনুর বাবার শরীরে নানা অসুস্থতা দানা বাঁধতে থাকে। এই দুর্বল অবস্থায় নানা লোক তাঁর মাথায় জ্যোতিষীর কাছে যাওয়ার বুদ্ধি ঢোকায়। একের পর এক জ্যোতিষী ক্রমাগত আশ্বাস দিতে থাকে, সব ঠিক হয়ে যাবে, দোকান ফিরে আসবে, স্বাস্থ্য ফিরে আসবে, আর তাদের আশ্বাসে ভুলে তিনি আংটি, পাথর এইসব কিনে ভাগ্য ফেরানোর চেষ্টায় আরো অনেক টাকা জলাঞ্জলি দিতে থাকেন। কিছুতেই কিছু হল না। তাই কালের নিয়মে জমা টাকা কমে আসলে, সংসার টানতে হাত পড়লো গিয়ে মায়ের গয়নায়। বদ্দি, বড়দা, ছোড়দা, ছোদ্দি সবারই এই অভাবের দিন মেনে নিতে ভীষণ কষ্ট হতো। এক সময়ে যে মানুষটাকে একসাথে তিন জন লোক মিলে গা-হাত-পা দলাই মলাই করে মালিশ করে দিত তার চোখ জুড়ে তখন শুধু এক শূন্য দৃষ্টি।
একদিন সকাল থেকে অঝোরে বৃষ্টি হচ্ছে। ছেনু বারান্দা দিয়ে তার বিরাট রাজার মাঠটার দিকে একমনে তাকিয়ে বসে আছে। সেইদিন হঠাৎ বড়দা এসে জানালো, কোর্ট থেকে নাকি চিঠি এসেছে, বাবি মামলা হেরে গেছে, তাই দোকানের বাকি অংশটাও ভাঙা পড়ে, সেখানে নাকি বিশাল বড় এক বাড়ি উঠবে। সেই বাড়ির একতলায় একফালি জায়গা তাদের দেওয়া হবে দোকানের ক্ষতিপূরণ হিসেবে। কোথায় সেই সুবিশাল জায়গা জুড়ে অত জমজমাট দোকান আর কোথায় এই একফালি জায়গা। যেন এক ঘড়া গুড়ের পাশে একটা মিছরির দানা। বাড়ি জুড়ে সবারই চোখে জল। বড়দা এসে ছেনুর কাঁধে হাত রেখে আস্তে করে বললো, কাল থেকে আর তোর সেই বিরাট রাজার মাঠে খেলতে যাস না, কেমন।
পরদিনই সেই মাঠ কারা এসে টিন দিয়ে ঘিরে দিল। তারপর একদিন কাঁধে গাঁইতি, শাবল, কোদাল নিয়ে এত এত লোক কাজে নেমে পড়ল। সারাদিন তাদের আর কোনো কাজ নেই, শুধু বিরাট রাজার মাঠের আধভাঙা ঘরগুলো ভেঙে চলেছে আর মাঠ জুড়ে মাটি খুঁড়ে বড় বড় গর্ত করছে। ঘর গুলো সাফ হয়ে গেলে একে একে সব দোতলা সমান শাল খুঁটি নিয়ে এসে সেখানে কপিকলে লাগানো সিমেন্টের চাঙর ঠুকে ঠুকে সেসব মাঠের বুকে পোঁতা শুরু হল। সেসব দেখে মহারাজের মনে হতো মাঠে শাল খুঁটি নয়, কেউ যেন তাঁর বুকের মাঝখানে এরকম করে পেরেক পুঁতে ভরিয়ে দিচ্ছে।
যখন ধীরে ধীরে তিনতলা পর্যন্ত উঠে গেল নতুন বাড়িটার, তখন আর সেটা পেরিয়ে ট্রাম দেখা যেত না, রাস্তা দেখা যেত না, কাটা ঘুড়িগুলো জমতে থাকতো, কেউ আর আনতে যেতে পারতো না, এমনকি মাঠের পিছনে হাইকোর্টের জজসাহেবের যে লাল বাড়িটার দিকে মহারাজ মাঝে মাঝে তাকিয়ে থাকতেন, সেটাও যেই ঢাকা পড়ে গেল তখন বারান্দা দিয়ে বাইরে তাকালেই মহারাজের মনটা গুম হয়ে যেত, গলার কাছটায় কি একটা দলা পাকিয়ে উঠত, মনে হতো ওনার সাম্রাজ্যের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ কেউ যেন জোর করে কেড়ে নিল। কিন্তু সেইসময় বাড়িতে মায়ের, দাদাদের, দিদিদের সবার চোখের কোণটাও যে কেন চিকচিক করতো, সেটাই মহারাজ বুঝে উঠতে পারতেন না।