মহারাজ ছনেন্দ্রনাথ ওরফে ছেনু তখন থেকে অপেক্ষা করে রয়েছে কখন চিঠিটা সবার পড়া শেষ হবে। বাড়িতে কারুর চিঠি আসা মানেই ওর খুব মজা, আরেকটা ডাকটিকিট এসে খাতায় জমা হবে। খাতায় ডাকটিকিটটা সাঁটার কায়দাটা একটু খটোমটো। ওকে তেতলার দাদাই পুরোটা শিখিয়েছিল। প্রথমে খামের পিছনদিকটা অল্প জল দিয়ে ভিজিয়ে তারপর আলতো করে ব্লেড ঘষে ঘষে খুউব সাবধানে স্ট্যাম্পটা তুলে শুকিয়ে নিতে হবে। এরপর পাতলা একফালি সেলোফেন পেপার আধভাঁজ করে স্ট্যাম্পের পিছনে অল্প একটুকুনি আঠা লাগিয়ে সেলোফেন পেপারের আরেকটা দিক আলতো করে ধরে খাতায় চিপকে দিতে হবে। এই করে করে ছেনুর খাতায় এত্তোগুলো ডাকটিকিট জমে গেছে।
আজকে সকালে তেতলার পিসিমার কাছে যে চিঠিটা এল, দাদা মানে পিসিমার ছেলে অনেকক্ষণ ধরে পিসিমাকে পড়ে পড়ে শোনাচ্ছে। ছেনু গিয়ে দু'বার দরজার সামনে থেকে ঘুরেও এল, কত লম্বা চিঠি রে বাবা! শেষে আর থাকতে না পেরে ছেনু গিয়ে পিসিমাকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করেই ফেলল, কার চিঠি গো? দেখা গেল অদ্ভুত ব্যাপার, পিসিমা হাসছে, অথচ চোখের কোণে জল, পিসিমা হেসে বলল, কে আসছে জানিস? কান্টু আসছে রে কান্টু, তোর কান্টু দাদা। এদ্দিন পর ও আসছে, শুনে বিশ্বাসই করতে পারছি না, তাই তো বারবার করে শুনছি।
ছেনু ছোট্ট থেকে পিসিমার কাছে কান্টুদার অনেক গল্প শুনেছে, কিন্তু কোনোদিন কান্টুদাকে চোখে দেখেনি আজ পর্যন্ত। অবশ্য দেখবেই বা কি করে, ছেনুর জন্মের আগেই তো পিসিমার বড় ছেলে কান্টুদা সেই সাত সমুদ্দুর তেরো নদী পার করে কি একটা দেশ আছে, কানাডা না কি নাম, সেইখানে চলে গিয়েছিল। সেই থেকে সেখানেই থাকে আর মাঝে মধ্যে চিঠি লিখে খবরাখবর জানায়। শুরুর দিকে বাংলায় লিখত বটে কিন্তু পরে কি জানি কেন শুধু ইংরেজিতেই চিঠি পাঠায়, তাই অন্যরা পিসিমাকে তর্জমা করে পড়ে পড়ে শোনায় কি লিখেছে।
পিসিমার মুখেই ছেনু শুনেছে, কান্টুদার নাকি ছোটো থেকেই খুব বিদেশ যাওয়ার শখ, বড় হয়ে কলকাতার চাকরিতে মন টিঁকছিল না, কান্টুদা শেষমেশ ঠিক করল, না, আর কোলকাতায় না, খাস বিলেতেই যেতে হবে। যেমন কথা তেমনি কাজ, পরিবারের কিছু টাকার সাথে, নানা আত্মীয়স্বজনদের থেকে আরো কিছু টাকা ধার নিয়ে একসাথে জমিয়ে জাহাজে চেপে সোজা রওনা দিল বিলেতে। লন্ডনে নেমে নানা জায়গায় ঘুরে তেমন কিছু সুবিধা করতে না পেরে মুখ ভার করে বসেছিল, এমন সময় কার কাছে শুনেছে, নানা জায়গার লোক এসে নাকি লন্ডনে প্রচুর ভিড় হয়ে গেছে আর ওদিকে আরও দূরে কানাডায় নাকি প্রচুর কাজের লোকের দরকার। কান্টুদা শুনেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল, তাহলে এখানে বসে থেকে লাভ নেই, চলো কানাডা! আবার লন্ডন থেকে জাহাজে চেপে পাড়ি দিল আটলান্টিক মহাসাগর পেরিয়ে কানাডায়।
সেখানে তো ভীষন ঠাণ্ডা, কান্টুদার সাথে গরম জামা বলতে একটাই কোট ছিল। যাই হোক রাস্তা থেকে আরেকটা ওভারকোট কেনার পর খোঁজখবর করে কম পয়সায় একটা বাড়িও ভাড়া করা হল। সেই কোট পরে কান্টুদা এদিক ওদিক কাজের খোঁজে যায়, কিন্তু যে সব কাজ জোটে সেসব মনে ধরে না পুরসভার চাকরির পাশাপাশি যাদবপুরের নাইট থেকে ইন্জিনিয়ারিং পাশ করা কান্টুদার। সারাদিনে খুব সামান্য কিছুই পেটে পড়ে, সারাদিন ঘুরে ক্লান্ত হয়ে রাত্রে ঘরে ফিরে ঘুমিয়ে পড়ে। নতুন দেশে গিয়ে তো কিছুই ঠাহর করতে পারছে না, খাবার দাবার খেতে, টুকিটাকি জিনিসপত্র কিনতেই জমা টাকা হুহু করে খরচ হয়ে যাচ্ছে! দেখতে দেখতে দুটো মাস কেটে গেল, প্রথম মাসের বাড়িভাড়া তো শুরুতেই দিয়ে দিয়েছিল, বাড়িওলা এবার এসে পরের মাসের ভাড়া চাইছে। কান্টুদা অনেক করে বোঝায়, ক'টা দিন দাঁড়াও, আমি চাকরি পেয়েই ভাড়া মিটিয়ে দেব। বুঝিয়ে সুঝিয়ে দিন দশেক কোনোক্রমে আটকে রাখা গেছিল, কিন্তু কপালের লেখা কে আটকাবে! একদিন খুব বৃষ্টি পড়ছে তার মধ্যে বাড়িওলা খুব চিৎকার চেঁচামেচি করে কান্টুদাকে বাক্সপ্যাঁটরা সমেত বাড়ি থেকে বের করে দিল। কান্টু দা কি আর করে, কোটখানা গায়ে চাপিয়ে বাক্স হাতে করে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে রাস্তায় অন্য একটা বাড়ির নীচে একটু আড়াল মতো পেয়ে দাঁড়িয়ে রইল। আড়াল পেলেও, এমন জোর বৃষ্টি শুরু হল যে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাকভেজা ভিজে গেল।
এমনি সময় হঠাৎ একটা মেয়ে পাশের বাড়ির জানলা থেকে মুখ বাড়িয়ে, কান্টুদাকে দেখতে পেয়ে বলল, ওখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন? ভিজে যাবে তো! কে তুমি? কান্টুদা কি আর করে, মুখ কাঁচুমাচু করে বলল, ইন্ডিয়া থেকে এসেছি চাকরি করতে, একটু বিপদে পড়েছি, বৃষ্টিটা ধরলেই চলে যাব।
তাতে মেয়েটা বলে, ওখানে দাঁড়িয়ে থেকো না, বৃষ্টির মধ্যে ঠাণ্ডায় জমে যাবে, দরজা খুলে দিচ্ছি, ওপরে এসে বসো। তারপর গরম চা খেতে খেতে মেয়েটা কান্টুদার মুখ থেকে গোটা ঘটনা শুনল। নরম মনের মেয়ে, শুনে টুনে বলল, এটা আমার দিদার বাড়ি, আমি দিদার সঙ্গেই থাকি। তোমার তো থাকার কোনও জায়গা নেই, এক কাজ করো, যদ্দিন না চাকরি পাচ্ছো এখানে আমাদের সাথেই থাকো, আমি দিদার সাথে কথা বলছি। আপাতত জামাকাপড় বদলিয়ে শুকনো কিছু পরে নাও।
পিসিমা যখন গল্পটা ছেনুকে বলেছিল, ছেনু তো শুনে অবাক, এতো দারুণ ব্যাপার! কান্টুদাকে আর ভিজতে হল না, আচ্ছা ওদিন যে অত করে সাহায্য করল, সেই মেয়েটা কে গো? পিসিমা বলেছিল, দাঁড়া দেখাচ্ছি, বলে কোন একটা ডায়েরির মধ্যে থেকে একটা টুকটকে ফর্সা গোলগাল মেয়ের ছবি বের করে ছেনুর হাতে দিয়ে বলল, এই দ্যাখ। ছেনু হাতে নিয়ে সেই মেমসাহেবের ছবি দেখে অবাক হয়ে বলল, সেই ছবি তুমি কী করে পেলে? পিসিমা বলে, ওমা পাবো না কেন? কান্টুই তো পাঠিয়েছে। ভালো করে দেখে রাখ, এই হল তোর বৌদি, জুলি বৌদি। ওখানে চাকরি বাকরি জুটিয়ে সেই জুলির সাথেই তো পরে ওর বিয়ে হয়েছে।
তারপর অনেক দিন কেটে গেছে, কান্টুদা পাকাপাকিভাবে কানাডাতেই থাকে আর মাঝে মাঝে চিঠিতে খবরাখবর পাঠায়, তেমনই এক চিঠি আজ সকালে এসেছিল। তাতে কান্টুদা জানিয়েছে, সে জুলি বৌদি আর বাচ্ছাদের নিয়ে এবার কোলকাতায় আসছে সবার সাথে দেখা করতে। সেই কথা শুনে তো সারা বাড়িতে হইহই পড়ে গেল। বিদেশের অতিথি তার ওপরে আবার বাড়ির বউ! তার সামনে তো বাড়ির একটা প্রেস্টিজ আছে নাকি? সাথে সাথে রংমিস্তিরির কাছে খবর গেল, সারা বাড়ি চুনকাম করা হবে। তিন বোতল অ্যাসিড কিনে আনা হল, পুরো বাথরুম সেই দিয়ে পরিষ্কার করা হবে ঝকঝকে তকতকে করে। খাবার পরিবেশনের জন্য এল চকচকে নতুন কাঁসার থালা-বাটি-গ্লাস। আরও হ্যানো ত্যানো নানান নতুন নতুন জিনিস কেনার লিস্টি তৈরি হল। মোটকথা যেভাবেই হোক শেয়ালদার সম্মান যাতে বজায় থাকে সেই চেষ্টার কোনও ত্রুটি রাখা যাবে না।
এই সব দৌড়াদৌড়ির মধ্যেই টুকটুক করে কান্টুদাদের আগমনের দিন এসে পড়ল। পিসেমশাই আর দাদা মিলে সেই দমদম এয়ারপোর্ট থেকে আনতে যাবে, সকাল থেকে তার প্রস্তুতি চলছে। ছেলের জন্য নানান রকম রান্না করা চলছে পিসেমশাযের চিন্তা কানাডার বৌমা প্রথম দেখায় প্রণাম করবে, হ্যান্ডশেক করার জন্য হাত বাড়িয়ে দেবে, নাকি আবার ওদেশের রীতি মেনে দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরবে! তেতলার দাদা জামা প্যান্ট পরে রেডি, বাবাকে বোঝাচ্ছে, আরে দাদা তো আছে, তুমি ঘাবড়াচ্ছ কেন। ওদিকে আবার রান্নাঘর জুড়েও প্রস্তুতি তুঙ্গে। ছেলের জন্য নানান রকম রান্না করা চলছে, পঞ্চব্যঞ্জন দিয়ে আপ্যায়ন না করলে চলবে! ওদিকে আবার চিন্তা পাঁঠার মাংস তো ঠিক আছে কিন্তু কানাডার লোকে পাকা রুইয়ের কালিয়া, আলু পটলের ডালনা, উচ্ছে ভাজা, বেগুন ভাজা এসব ঠিকমতো খাবে তো? আসলে এগুলো কান্টুদার খুব প্রিয় পদ ছিল তো।
বাড়ির নিচে দুটো ট্যাক্সির হর্ন শোনা যেতেই বাড়িজুড়ে যেন হাজার ওয়াটের বাল্ব জ্বলে উঠল। কেউ রান্নাঘরে ছুটছে, কেউ গ্লাসে করে জল নিয়ে আসছে আর বাকিরা সবাই মিলে সিঁড়ির দুধারে ভিড় করে দাঁড়িয়ে উঁকি ঝুঁকি মারছে। ছেনুও মনে মনে উত্তেজনায় ফুটছে, এতদিনের গপ্পের চরিত্রদের সাথে আজ দেখা হবে! ওরা সমস্ত বাক্স-প্যাঁটরা নিয়ে উঠতেই সটান বরণডালা হাতে পিসিমার মুখোমুখি। বিয়ে অনেকদিন হতে পারে, কিন্তু এবাড়িতে তো প্রথমবার, বরণ না করলে চলবে! সাথে চলল বাড়ির বাকি মহিলাদের সমবেত উলুধ্বনি।
কিন্তু এদিকে মহারাজ ছনেন্দ্রনাথের মন ভেঙে গেছে, ছবির সাথে বাস্তবের বিন্দুমাত্র যে মিল নেই! ছবিতে যে গুবলু গাবলু মিষ্টি দেখতে বিদেশি মেয়েটাকে দেখেছিল, সে কই? এ তো বেশ রোগা, চোখ বসে গেছে, আর গরমের দেশে এসে ঘেমেনেয়ে একসা। সাথে আবার দুটো বাচ্চা ছেলেও আছে, ছেনুর থেকে বয়সে বোধহয় একটু ছোটই হবে কিন্তু দেখতে পুরোদস্তুর সাহেব। তারা কী যে বলছে ছেনু কিছুই বুঝতে পারছে না, তবে দেখল কান্টুদা কিছু একটা বলতেই টুক করে নিচু হয়ে পিসিমাকে প্রণাম করে ফেলল আর মুখে তাদের সারাক্ষণ হাসি লেগেই রয়েছে।
বৌদিও ঢুকেই হাতজোড় করে সবাইকে নমস্কার করল, যা দেখে সবাই ইমপ্রেসড। প্রণাম টনামের পালা চুকিয়ে মালপত্র নিয়ে বাড়িতে ঢুকতে ঢুকতে পিছনে দেখা গেল বিশাল বিশাল দুটো সুটকেস নিয়ে দাদা আর পিসেমশাই আসছে, পিসেমশাইয়ের মুখটা বেশ হাসি হাসি। আবার তার পিছনে দেখা গেল ছেনুর বড়দাও চলে এসেছে কান্টুদাদের জন্য প্রচুর সন্দেশ, রসগোল্লা, জিলিপি, সিঙাড়া, চমচম বাক্সভর্তি করে নিয়ে। কখন যে টুক করে এসব আনতে চলে গিয়েছিল, ছেনু টেরই পায়নি।
তা সেসব সাজিয়ে দেওয়া হল প্লেটে করে। পিসেমশাই আবার বকাবকি করছে বড়দাকে, এত বেশি মিষ্টি টিষ্টি আনার জন্য, পিসেমশাইয়ের ধারণা সিঙাড়া, জিলিপি, এসব আনা উচিৎই হয়নি, এসব আনহেলদি খাবার ওরা ছুঁয়েও দেখবে না। কিন্তু কি আশ্চর্য! ওই বাচ্চা দুটো প্লেটের সবকিছু নেড়েচেড়ে দেখে প্রথমে সিঙাড়াটা ভেঙেই মুখে দিল। নতুন রকমের খাবার খেয়ে মুখ খুশিতে আরো উজ্জ্বল হয়ে বলে উঠল, বলে, ভেরি ভেরি টেস্টি, আই লাইক ইট! তা শুনে বড়দার আনন্দ আর দেখে কে! কান্টুদা ও একটু নিশ্চিন্ত হলো ওদের ভালো লেগেছে দেখে। শেষমেশ দেখা গেল, এখানকার খাবার দাবার সবারই পছন্দ হয়েছে, সাথে চামচ দিয়ে জিলিপি আর সিঙাড়া খাওয়ার কায়দা দেখে বাড়ির লোকেরা একটু মুখ টিপে হেসেও নিল।
জলখাবার পর্ব মিটতে ওদের খাটে নিয়ে গিয়ে বসানো হল একটু বিশ্রাম নেওয়ার জন্য, এতটা পথ জার্নি করে এসেছে। দুটো বাচ্চার নামও জানা গেল, পিটার আর ম্যাক্স। পদবি অবশ্য ব্যানার্জি। তো খাওয়া দাওয়ার পর পিটারের বড় বাইরে পেয়েছে, দাদা দেখিয়ে দিল বাথরুম- ওই যে বারান্দার শেষ প্রান্তে। যাক, এই মুহূর্তের জন্যই বাথরুম ভালো করে চুনকাম করিয়ে অ্যাসিড ঢেলে খুবসে পরিষ্কার করা হয়েছে, অবশ্য তাতেও একটা খিঁচ রয়েই গেছে। এই বাড়ির বাথরুমে তো আর ইউরোপিয়ান কমোড নেই, পা ভাঁজ করা দেশি প্যান, সেটায় বসতে পারবে কিনা চিন্তার বিষয়। তবে দেখা গেল বিশেষ বেগ মানুষকে প্যান আর কমোডের পার্থক্য নিয়ে মাথা ঘামাতে দেয় না, ও দিব্যি ভালো ছেলের মতো কাজকর্ম সেরে ভেতরে না পেয়ে, বাইরে মাথা বাড়িয়ে টয়লেট পেপার চাইছে। তারপর দাদা গিয়ে বোঝাল, টয়লেট পেপারের কোনো ব্যবস্থা নেই, জলেই ধুতে হবে। ছেনু দেখল সে পড়েছে ভারি মুশকিলে, অবশেষে কান্টুদা ভিতরে গিয়ে ব্যাপারটা সামাল দেয়। এখানকার কায়দা দেখে বাচ্ছাটা তো অবাক! তবে ভালো ভাবেই মানিয়ে নিয়েছে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে।
এরমধ্যে পিসেমশাই গেলেন রান্নাঘরে ব্যস্ত পিসিমাকে ডাকতে, চলো চলো, রান্না তো হয়েই এসেছে প্রায়, এবার একটু ধাতস্থ হয়ে ছেলের সাথে বসে দুটো কথা বলো। একবার দেখো ছেলে কিরকম ফুল সায়েব হয়ে গেছে, চোস্ত ইংরেজিতে কথা বলছে, উফ্, শুনেও গর্ব হয়! পিসিমা হাতের কাজ সামলে ভীষণ উজ্জ্বল মুখ নিয়ে ঘরে গিয়ে বসলেন, কতো বড়ো হয়ে গেছিস রে, আসতে কষ্ট হয়নি তো?
কান্টুদা বলে, নো নো নট অ্যাট অল। হাউ আর ইয়ু?
শুনেই পিসিমা ভেবলে গেলেন, বলে কি? তারপর উনি যাই বলছেন কান্টুদা উত্তর দিচ্ছে ইংরেজিতে। আর পিসিমা আরো ঘাবড়ে যাচ্ছেন। শেষে পিসেমশাইকে হাঁক পাড়লেন, ওগো শুনছ, এসব কী বিড়বিড় করছে গো, ছেলে কি পাগল হয়ে গেল!
অবস্থা বেগতিক দেখে কান্টুদা বলে উঠল, নো নো, আয়াম ফাইন। জাস্ট ফরগট হাউ টু টক ইন বেঙ্গলি, বাট আই আন্ডারস্ট্যান্ড ইয়োর ওয়ার্ডস পারফেক্টলি। পিসেমশাই তখন এসে পড়েছিলেন, পুরো ঘটনাটা পিসিমাকে বোঝাতে, পিসিমার চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল পড়তে লাগল। ছেনু পাশ থেকে ব্যাপারটা পুরো দেখছিল, এতক্ষণ কান্টুদা কী যে বলছিল সেও একবর্ণ বুঝতে পারেনি, কিন্তু পিসিমাকে কাঁদতে দেখে আর থাকতে পারলনা। দাদাকে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে গো, পিসিমা কাঁদছে কেন! কান্টু দাদা কি পিসিমাকে বকেছে? দাদা আর পিসেমশাই ইংরেজি ভালোই বুঝত। দাদাই গোটা ঘটনাটা ছেনুকে বুঝিয়ে বলল, কান্টুদা আর বাংলায় কথা বলতে পারছেনা বলে পিসিমা খুব দুঃখ পেয়েছে।
ব্যাপারটা শুনেও ছেনুও মনে খুব কষ্ট পেল, ভাবল দূর দূর, বিদেশ থেকে এসছো তো কি হয়েছে, যাও কথাই বলবোনা তোমার সাথে।
ঘরে এসে দেখে ছোড়দা কী একটা কাগজ খুলে পড়ছে, ছেনু বলে এই শোন না, কানাডা কত দূরে রে?
- অনেক দূর এখান থেকে, আমাদের হলো এশিয়া, তার পাশে ইউরোপ, তারপর আটলান্টিক মহাসাগর পেরিয়ে উত্তর আমেরিকার মধ্যে হলো গিয়ে কানাডা।
- আমেরিকা মানে ওই দেশটা, যেটার ওপর তোর রাগ?
- না উত্তর আমেরিকা একটা মহাদেশ, তার মধ্যে একটা দেশ আমেরিকা, তার পাশেই কানাডা।
- যেখানেই হোক গে, একদম যাবি না কানাডায়, একদম যাবি না।
ছোড়দা যারপরনাই অবাক হয়ে বলে, কেন কী হয়েছে কানাডায় গেলে? আর আমি খামোখা কানাডা যেতেই বা যাবো কেন?
ছেনু ঠোঁট উল্টে বলে, ওখানে গেলেই তো সবাই বাংলা ভুলে যায়, বিচ্ছিরি দেশ!
তবে ছেনু বেশিক্ষণ রাগ করে থাকতে পারলো না, একটু পরেই বদ্দি আর ছোদ্দির ডাক পড়ল পিসিমার ঘরে। ছেনুও পিছু পিছু গিয়ে দেখে, সেই সুবিশাল সুটকেসের একটা খোলা হয়েছে আর তার পেটের ভেতর কত্তো জিনিস। বদ্দি আর ছোদ্দির জন্য নকশাকাটা রঙিন কাঁচের শিশিতে করে কি একটা এনেছে। শিশির ওপরে একটু চাপ দিতে কি সুন্দর একটা গন্ধ বেরোলো। জিনিসটার নাম নাকি অডিকোলন, দুজনেই তো পেয়ে খুব খুশি (পরে একবার ওই শিশি কি ভেবে মা মাথাব্যথার ওষুধ হিসেবে মাথায় লাগাতে গিয়েছিল, মাঝে মধ্যে টুকটাক রাগ করলেও, বদ্দিকে ওইদিনের মতো অমন রেগে যেতে ছেনু কক্ষনো দেখেনি)। ছেনু সব বাইরে থেকেই দেখছিল। যদিও অন্য সময় পিসিমাদের ঘরে ছেনুর অবাধ যাতায়াত থাকে, তবে এখন তো ওকে ডাকেনি, কাছে যাবে কেন! মানসম্মান বলেও তো একটা জিনিস আছে না কি, মহারাজ বলে কথা। তবে ও বুঝতে পারল ওর কপালেও একটা দারুণ বিদেশি উপহার নাচছে। কারণ এ বাড়িতে তাকেই সবাই সবচে ভালোবাসে, দিদিদেরকে যদি এত সুন্দর জিনিস দেয়, তবে ওকে না জানি কি দেবে, ভেবেই ওর পেটের মধ্যে বুড়বুড়ি কেটে উঠল।
ওই তো সুটকেস থেকে কি সুন্দর একটা জামা বের করছে, তবে বেশ বড়ই হবে ওর গায়ে। ওঃ, ওটা এনেছে কান্টুদার ভাইয়ের জন্য। এরপর বেরোল আর একটা কাঁচের বোতল , ওটা পিসিমার জন্য, পিসিমা সুগন্ধি খুব ভালোবাসে কিনা। এরপর একে একে বার হতে থাকল ছাতা, কলম, ব্যাগ, আরও কত কি। এক একটা জিনিস এক এক জনের জন্য। তারপর বেরিয়ে এল একটা বড়ো রঙচঙে টিনের গোলমতো বাক্স। ওমা! বাক্সটা কি সুন্দর দেখতে। একটা বরফের পাহাড়ের সামনে চকোলেটের ছবি। তাহলে এটা নিশ্চই বিদেশি চকলেটের বাক্স। যাক, এটাই তাহলে ছেনুর জন্য এনেছে। সত্যি কান্টুদার পছন্দের তারিফ না করে ছেনু পারে না। ওকি! বাক্সটা পিসেমশাইকে দিয়ে দিল কেন? আচ্ছা রাখতে দিল বোধহয়, পরে ওকে ডেকে দিয়ে দেবে, থাক যখন ডাকবে তখন আসবো, এখন আর দাঁড়িয়ে কাজ নেই।
দুপুরে যখন কান্টুদারা খেতে বসল, সেও যেন এক দর্শনীয় বিষয়। সবাই দূরে দাঁড়িয়ে গোল হয়ে দেখছে। বেগুন ভাজা, পটল ভাজা, আলু ভাজা এসব খুবই পছন্দ হয়েছে বাচ্চাদের। সবকিছুই 'ডেলিশিয়াস' বলে হাসি মুখে খাচ্ছে চামচ দিয়ে। কান্টুদা হাত দিয়েই খাচ্ছে আর এটা ওটা করে ওদের খেতে সাহায্য করছে। জুলিবৌদি কান্টুদাকে ফিসফিস করে কি একটা জিজ্ঞেস করল, সম্মতি পেয়ে মাথা নেড়ে নিজেও হাত দিয়েই খাওয়া শুরু করল। পটলের ডালনা শুধু শুধু খেতে যাচ্ছিল, ডালটাও, কান্টুদা ভাতে মেখে খাওয়া দেখিয়ে দিল। মুশকিল হলো মাছের কালিয়া নিয়ে। বড় বড় পেটির মাছই দেওয়া হয়েছে কিন্তু না বুঝে বোনলেস ভেবে কামড় বসাতেই বিপত্তি। ঘটনা বুঝতে পেরে পিসিমা জলদি এসে কাঁটা গুলো টেনে বের করে দিলে, সবাই তৃপ্তি করে খেতে পারল। নতুন স্বাদের খাবার পেয়ে সবাই খুব খুশি, জুলিবৌদিও হেসে বলল, রিয়েলি আমেজিং ফুড। তা আবার পিসিমাকে রিলে করা হতে পিসিমার মুখে অবশেষে একটু হাসির রেখা দেখা গেল।
এরপর আবার পাঁঠার মাংস খেয়ে সবারই পেট দমসম। কান্টুদা ছাড়া কেউ আর চাটনি খেতেই পারলো না। খাবার নিয়ে পিটার আর ম্যাক্সের আনন্দ দেখে পিসিমা পিসেমশাইকে শুনিয়েই দিলেন, কি গো তবে যে বলছিলে বাঙালি খাবার ওরা নাকি খেতে পারবে না!
খাওয়া দাওয়ার পর পিসেমশাই বললেন, দাঁড়া বালিশ টালিশ সব পেতে বিছানা করে দিই, তোরা একটু গড়িয়ে নে। কান্টুদা শুনেই বলে, আরে না না, আমি হোটেল বুক করেছি তো! আসলে ওরা এখানে এডজাস্ট করতে পারবে কিনা ভেবে আগে থেকেই হিন্দুস্তান ইন্টারন্যাশনালে রুম বুক করে রেখেছি। আর এইটুকু জায়গায় এতজন আঁটবেও না।
অবশ্য পিসেমশাই এর মনের মেঘ আবার কেটে গেল পরদিন যেই ওরা আবার হই হই করে হাজির। আজ পিটার আর ম্যাক্স এর দাবি বাড়িটা তাদের ভালো করে ঘুরে দেখাতে হবে, এই বাড়িটা নাকি তাদের ভারি পছন্দ হয়েছে। তাদের কথায়, ভেরি নাইস হাউস, লাইক অ্যান ওল্ড ম্যানসন, ফিলস ভেরি চার্মিং। কান্টুদার ভাইই আজ গাইড, ওর পিছন পিছন পিটার আর ম্যাক্স লাফাতে লাফাতে চলেছে। কান্টুদার সুটকেস থেকে আজকে আবার একটা দারুণ জিনিস বেরিয়েছে - একটা ঝকঝকে ইয়াশিকা ক্যামেরা। ব্যাগের মধ্যে থেকে লেন্স বের করে তাতে এঁটে, ফিল্মের কৌটো থেকে ফিল্ম বের করে পরালো। সেই ক্যামেরা চোখে লাগিয়ে এদিক ওদিক খচ খচ করে ছবি তুলছে আর মাঝে মাঝে জুলিবৌদিকে সব স্থান মাহাত্ম্য ব্যাখ্যা করছে। সাথে ছোড়দাকে নিয়ে ছেনুও তাদের পিছু ধরেছে, আরে হাজার হোক নিজের রাজত্বে বেড়াতে আসা বিদেশি অতিথিদের প্রতি মহারাজেরও তো একটা দায়িত্ব আছে নাকি! ছাদে গিয়ে তো ওরা ভীষণ আনন্দিত। দূর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে, ওপর থেকে নিচের সবকিছু খুদে খুদে দেখাচ্ছে, দারুণ হাওয়াও দিচ্ছে। এমনকি তখন সেই ছাদের থেকে হাওড়া ব্রিজ পর্যন্ত দিব্যি দেখা যেত। ছাদেও কান্টুদা অনেক ছবি টবি তুলল। ছেনুর মনে হলো আহা, পিটার, ম্যাক্স আর জুলি বৌদির সাথে দাঁড় করিয়ে ওর ছবিও যদি একটা তুলত!
তবে মহারাজ ছনেন্দ্রনাথ সবচেয়ে বেশি দুঃখ পেলেন যখন দেখলেন, তাঁর জন্যই উপহার হিসেবে নিয়ে আসা বিদেশি চকলেট বাক্স থেকে বের করে পিটার, ম্যাক্স আর পিসেমশাই দিব্যি আনন্দ করে খাচ্ছে। সোনালি রাংতা দেওয়া কি সুন্দর দেখতে গোল গোল চকলেটগুলো! সে দৃশ্য দেখে তিনি নিজেকে সান্তনা দিলেন, আসলে চকলেটগুলো শুধু তাঁর জন্য নয়, সবার খাওয়ার জন্যই আনা হয়েছে, ঠিকই তো, ভালো জিনিস সবাইকে দিয়ে থুয়েই খেতে হয়। পরে যখন পিসিমা ডেকে হাতে দেবে, তখনই খাওয়া যাবে না হয়।
কান্টুদারা মোট দিনদশেকের মতো ছিল কোলকাতায়। তারই মধ্যে ঠিক হল, ওরা নাকি দার্জিলিং ঘুরতে যাবে। একবার এতদিন পর ভারতে আসা হয়েছে, কলকাতার বাইরেও দু একটা জায়গা একটু ঘুরে দেখে নেওয়াই ভালো। শুনে ছেনুর ভারি মনখারাপ হয়ে গেল, সবে দুজনার সঙ্গে বন্ধুত্ব হবে হবে করছিল, তার মধ্যেই আবার ঘুরতে চলে যাবে। পাঁচ দিনের মধ্যেই অবশ্য ওরা আবার ঘুরেটুরে ফেরত আসতে বাড়িটা আবার হইচইয়ে ভরে উঠল। আর দুদিন পরেই কানাডায় ফিরে যাবে।
কান্টুদাদের চলে যাওয়ার দিন তেতলার দাদা ছেনুকে ডাকতে এলো, যাবি নাকি প্লেন দেখতে? ছেনু তো শুনেই একলাফে রাজি। ছোড়দাকেও ডাকতে, ছোড়দা বললো আজ কলেজ আছে হবে না। যাই হোক, ছেনু মাকে বলে, একটা ভালো দেখে জামা পরে, পিসেমশাই আর দাদার সাথে রওনা দিল হিন্দুস্তান ইন্টারন্যাশনাল হোটেলে, দার্জিলিং থেকে ফিরে কান্টুদারা আবার ওখানেই উঠেছে, রাত্রে হোটেলে থাকত, আবার সকাল সকাল চান টান করে শেয়ালদায় চলে আসতো। হোটেলের লবি দিয়ে চারিদিকে তাকাতে তাকাতে ছেনু লিফটে চড়ে ওদের ঘরের দিকে গেল। ঘরে ঢুকে দেখে ওরাও বেরোনোর জন্য তৈরি। সুটকেস টুটকেস হাতে নেওয়ার পর জুলিবৌদি পিটার আর ম্যাক্সের দিকে একবার তাকাতেই তারা তড়াক করে উঠে খাটের তলা, বাথরুম, আলমারি, টেবিলের ড্রয়ার কোথাও কিছু জিনিসপত্র পড়ে আছে কিনা সব খুঁজে দেখে ফেলল। ছেনু তো কাণ্ড দেখে তাজ্জব।
যাই হোক হোটেল থেকে দুটো ট্যাক্সিতে চেপে ওরা সবাই দমদম এয়ারপোর্টে পৌঁছে গেল ঠিক সময়ে। ব্যাগপত্র চেকিং টেকিংয়ের পর এবার বিদায়ের পালা। ক'দিনেরই বা দেখা, তবুও ছেনুর গলায় যেন একটা মনখারাপ দানা বাঁধছিল। ওরা একসময় শেষবারের মতো হাতটাত নেড়ে ঘেরাটোপের মধ্যে হারিয়ে গেল। পিটার আর ম্যাক্সও অনেকক্ষণ ধরে হাত নাড়ছিল ওদের দিকে ফিরে ফিরে, মানে যতক্ষণ পর্যন্ত দেখা যাচ্ছিল আর কি। ওরা চলে যেতে দুঃখ কাটাতে পিসেমশাই দুজনকে নিয়ে গেলেন প্লেনের নামা ওঠা দেখাতে। তখন টিকিট কেটে একটা ঘেরা বারান্দা মতো জায়গায় দাঁড়িয়ে প্লেন দেখা যেত। ছেনু তো সার দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা প্লেনগুলো দেখে পুরো হাঁ। অবাক হয়ে দেখছে কত বড় বড় সব ডানাওলা বাস। জানলাগুলো সব এই পুঁচকে পুঁচকে লাগছে। ছেনু ভাবে এগুলো সব আকাশে ওড়ে কী করে? এতে চেপেই তো কান্টুদারা এসেছে! ওমনি দাদা আঙুল দিয়ে দেখাল দূউউরে একটা প্লেন মাঠের মধ্যে দৌড় লাগিয়েছে। যত এগোচ্ছে দৌড়ের বেগ বাড়ছে। এক সময় সামনের চাকাটা টুপ করে মাটি ছেড়ে আকাশে উঠে পড়ল।
বাড়ি ফিরেও ছেনু ওদের কথাই ভাবছিল। এক সময় আর থাকতে না পেরে তেতলায় পিসিমার ঘরের দিকেই পা বাড়াল। গিয়ে দেখে পিসিমা কি সব সেলাই টেলাই করছে, সব ছুঁচ সুতো বের করেছে। পিসিমা ওকে দেখেই হেসে বললো কেমন প্লেন দেখলে বলো? ছেনু মাথা নাড়তেই পিসিমা বললো ওখানে একটা বাক্স রাখা আছে, আনো তো দেখি একবার। ছেনু তাকিয়ে দেখে সেই বিদেশি চকলেটের বাক্স। দৌড়ে গিয়ে তাক থেকে সেটা পিসিমার কাছে নিয়ে আসতে আসতেই ওর মনে একটা খটকা লাগল, এত হালকা কেন? তবে কি মাত্র অল্প ক'টা পড়ে আছে আর!
পিসিমা বললো এনেছ, দাও তো। পিসিমা বাক্সটা খুলতেই ছেনু দেখে চকলেটের কোথায় কি, বাক্স বেবাক ফাঁকা! পিসিমা ছেনুকে বললো খেয়েছিলে তো চকলেট? কেমন লাগল? ছেনু বলে, কই না তো!
- সে কি পিসেমশাই দেয়নি? আসলে চকলেট ভালোবাসে বলে বাবার জন্য এই চকলেটের বাক্সটা এনেছিল কান্টু। পিসেমশাই শুরুর থেকেই এমন টপাটপ খাচ্ছে, আমি বললাম দিও কিন্তু সবাইকে। তারপর খোকনও ওর বন্ধুদের কয়েকটা দিয়েছে। তারপর যে ক'টা পড়েছিল ওরা দার্জিলিং যাওয়ার সময় আমি সঙ্গে করে পাঠিয়ে দিলাম। ইসসস্ মাঝখানে যে তুমি বাকি পড়ে গেছ, এই দৌড়াদৌড়ির মধ্যে আমি খেয়ালও করিনি। তারপর বাক্সটা ধুয়েমুছে সরিয়ে রেখেছিলাম ছুঁচসুতো রাখব বলে।
ততক্ষণে মহারাজ ছনেন্দ্রনাথ আর ওখানে থাকলে তবে তো! তিনি চোখের জল মুছতে মুছতে দোতলায় দৌড় মেরেছেন।
পুনশ্চ: দুদিন পর আবিষ্কার হলো, কান্টুদা সেই দারুণ ইয়াশিকা ক্যামেরাখানা ভুলে এই বাড়িতেই ফেলে চলে গেছে। দার্জিলিং থেকে ফিরে রিল বদলাবে বলে বোধহয় সরিয়ে রেখেছিল, আর বের করা হয়নি। বাড়িতে ফটোগ্রাফি একমাত্র ছেনুর বড়দাই ভালো জানতো। তাই পিসেমশাই আর কি করবেন ভেবে না পেয়ে, সেই ক্যামেরা বড়দাকেই দিয়ে দিলেন। বড়দার হাত বেয়ে কালক্রমে সেই ক্যামেরাখানা বহুদিন পর মহারাজ ছনেন্দ্রনাথের হস্তগত হয় ও তা দিয়েই পরবর্তীকালে তিনি দেদার ছবিছাবা তোলেন। মহারাজের সিন্দুকেরই কোনো এক কোণে সেই প্রাচীন ক্যামেরা, লেন্স টেন্স সমেত আজও বহাল তবিয়তে বিদ্যমান। তা বিদেশি চকলেটের বদলে বিদেশি ক্যামেরা - এই বা মন্দ কি!