"একি! বসব কোথায়, চারিদিকে তো ভিড়ে ভিড়!", ছোদ্দি ট্রেনে উঠেই গাদাগাদি ভিড় দেখে আঁতকে উঠেছে।
"এই তো টিকিট, আমাদের সিট খুঁজে দেখে বসতে হবে, বেনা তুমিও দেখতো একটু", বলে মা টিকিটটা বের করে বেনাকে এগিয়ে দেয়।
বেনা তিনটে ব্যাগ নিয়ে টানছে, তবুও কোনো হেলদোল নেই, "দিন মেজো-মা", বলে টিকিট হস্তগত করে সিট খুঁজতে থাকে।
আর ওদিকে মহারাজের অবস্থা তো ভিড়ের চোটে হাঁসফাঁস, উনি কোনো মতে দুহাত দিয়ে একখানা ব্যাগ বয়ে নিয়ে চলেছেন আর ভাবছেন কোলকাতার সব লোক কি আজ পুরী যাবে বলে বেরিয়েছে নাকি! এই ট্রেনটায় সবকটা সিট তো ভর্তিই, তার ওপর গেটের কাছেও গুচ্ছের লোক উঠেছে গাদা গাদা মালপত্র নিয়ে, ইয়া বড় বড় সব ঝুড়ি, বস্তা- কী কী নিয়ে যাচ্ছে তাতে করে কে জানে!
বেনা ততক্ষনে টিকিটের নম্বর দেখে অতিকষ্টে ভিড় ঠেলে সিট খুঁজে বের করেছে। সবাই মিলে সেই সিটের সামনে পৌঁছে দেখা গেল ইতিমধ্যেই এক পরিবার সেখানে বাক্স প্যাঁটরা সমেত আসীন। তাদের যতই বলা হয় এগুলো আমাদের সিট, তারা তবুও কিছুতে জায়গা ছাড়বেনা, এটা তাদেরই সিট। তাদের টিকিটেও নাকি একই নম্বর দেওয়া আছে। ওনাদের বলা হল যদি একবার টিকিটটা দেখানো হয়, ওনারা সেই টিকিট এগিয়ে দিতে দেখা গেল কথা মোটে ফেলনা নয়, সত্যিই একই নম্বর!
মা তো সেই দেখে অবাক, "সেকি! দুটো টিকিটে একই নম্বর হয় নাকি?" বেনা মাথা চুলকে বলে,"কি জানি! হতেও পারে, ট্রেনবাবুরা কি লিখতে কি লিখে ফেলেছে।" ছেনু পাশ থেকে বেনার জামা ধরে টানছে,"বেনা, তালে আমরা কোথায় বসব?" বেনাও আসলে এরকম ফ্যাসাদে আগে পড়েনি, দূরপাল্লার ট্রেনে আগে চড়েছেই বা ক'বার! সেই জনকপুর থেকে কলকাতা আসার সময় একবারই চড়ে ছিল বোধহয় জীবনে। আর এই যাত্রার বাকিরা, মানে, মা, ছোদ্দি আর ছেনু, এরা কেউই আজকের আগে অব্দি দূরপাল্লার ট্রেনে পা-ও রাখেনি। জীবনে প্রথমবার পুরী যাওয়ার জন্যই এই পুরী এক্সপ্রেসে চেপেছে আর তাতেই এরকম মহামুস্কিল কাণ্ড!
কিন্তু এই যাত্রার হুজুকটা হল কি করে সেটা জানতে হলে আমাদের পিছিয়ে যেতে হবে আরও হপ্তা দুয়েক আগে। বড়দা সেদিন বেশ দেরি করে হাঁপিয়ে হুঁপিয়ে অফিস থেকে ফিরতে মা চিন্তিত হয়ে জিজ্ঞেস করল, "কিরে আজ এত দেরি? কোথাও গিয়েছিলি নাকি?"
তাতে বড়দা বলল, "আর বোলোনা, আমাদের আপিসের কুঞ্জবাবুর পুরী বেড়াতে গিয়ে পা ভেঙেছে, তাই ওনার বাড়িতে আমরা আপিস থেকে সবাই দেখতে গিয়েছিলাম, তাই আসতে আসতে এত লেট।"
মা সেই শুনে হঠাৎ একটা গভীর শ্বাস ফেলল, "সে ভাগ্য যে আমার কবে হবে কে জানে?"
- সেকি, তুমিও আবার পা ভাঙতে চাইছ নাকি!
- ওফ, তুইও যেমন, পা কেন ভাঙতে চাইব, জগন্নাথধাম যাওয়ার কথা বলছি।
- সে কখনো হবে'খন।
- কবে যে যাবো, আমার কতদিনের ইচ্ছে পুরী, বেনারস, হরিদ্বার সব ঘুরে আসার। তোর বাবা থাকতেই কখনো যেতে পারলাম না, আর কি হবে!
এর মধ্যে আবার ছোড়দাও এসে হাজির,"পুরীর কথা হচ্ছে বুঝি! সামনের যে ব্যাংক আছে, ওরা তো ওখানে হলিডে হোম খুলেছে।"
মা অবাক," সে কথা তুই জানলি কোত্থেকে?"
- বেনাই তো বলল, এই আসছে হপ্তার পরের হপ্তা নাকি ব্যাংকের অনেকে ঘুরতে যাচ্ছে পুরী। সেই হলিডে হোমেই গিয়ে উঠবে।
- জায়গা ভালো?
- হ্যাঁ ভালোই হবে, বাড়িটা নাকি নতুন হয়েছে।
- ভাড়া কেমন?
- অত জানিনা, তবে চেনাশোনা তো, হয়তো একটু কমসম করে দেবে।
- যাবি নাকি?
- আমি কি করে যাবো? আমার তো কলেজে পরীক্ষা রয়েছে।
বড়দা পাশ থেকে জানাল, আমারও হবে না, আপিস কামাই করা যাবেনা মোটে।
- তা হলে?
ওদিকে বেড়ানোর গন্ধে গন্ধে ছোদ্দি আর ছেনু চলে এসেছে দৌড়ে দৌড়ে। ছেনু বলল, আমার তো আপিস আর কলেজ কিচ্ছুটি নেই, আমিই নিয়ে যাব তোমায়। আর ছোদ্দি জানাল তার রোজ রোজ ইস্কুল যেতে মোটেই ভাল্লাগেনা। তাই ক'দিন ঘুরতে যাওয়ার প্রস্তাবে তার ভোট সবচে আগে পড়বে।
কিন্তু আমাদের মহারাজ যতই বীরপুরুষ হন, সেনাপতি না থাকলে কি আর যুদ্ধযাত্রায় বেরোনো যায়! তাই সবার সম্মতিক্রমে এই যাত্রার সেনাপতি হিসেবে বেনাকেই মনোনীত করা গেল। তার ওপরই দায়িত্ব পড়ল হলিডে হোম ঠিক করে সবাইকে নিয়ে পুরী ঘুরিয়ে আনার। বেনা তো এই দায়িত্ব পেয়ে খুব খুশি। সেও কোনোদিন পুরী যায়নি, নতুন জায়গা দেখা হবে, ঘোরাঘুরি হবে। বড়দা এরমধ্যে ওদের ট্রেনের টিকিটও কেটে নিয়ে এসেছে। ট্রেনের নাম আগেই বলেছি, পুরী এক্সপ্রেস, সেকেন্ড ক্লাস সিটিং, মানে বসে বসে যেতে হবে। যাক শেষ মুহূর্তে টিকিট পাওয়া গেছে এই ঢের।
ছোড়দার আগেই পুরী ঘোরা। খুব ছোট্টবেলায় মামা আর দিদিমার সাথে গিয়েছিল। তখন তো এরকম হলিডে হোম ছিল না, পাণ্ডার বাড়িতে আট আনা দিয়ে থাকত। ছেনু গিয়ে তাই ছোড়দার কাছে প্রশ্নের ঝাঁপি খুলে ফেলেছে," হ্যাঁরে, মা বলছিল, ওখানে নাকি এত্ত জল?"
- জল আছে তো, এত বড় সমুদ্র, জল থাকবে না!
- সমুদ্রটা কত বড়? আমাদের এই বাবুঘাটের গঙ্গার মতো?
- না না, বিশাল, বিশাল বড়। আর তাতে সব দোতলা সমান ঢেউ আসে। এক ঝাপটায় লোককে উড়িয়ে নিয়ে চলে যায়। আর সমুদ্রের ধারটা কেমন জানিস তো, পুরো বালি দিয়ে ঢাকা। ওই সামনের বাড়িটা তৈরি হওয়ার সময় এত বালি এসেছিল মনে আছে? তার থেকে অনেক অনেক বেশি বালি ওখানে।
- বাবুঘাটের মতো সবাই নাকি ওখানে গিয়েও চান করে? অত ঢেউ হলে চান করে কি করে?
- ওখানে বেশি দূর যেতেই নেই, গেলেই ভাসিয়ে নিয়ে চলে যাবে। নুলিয়ারা আছে, ওরা বাচ্চাদের ধরে ধরে সেই গভীর সমুদ্রে চান করাতে নিয়ে যায়, তারপর তাদের কি হয় কেউ জানেনা। খুব সাবধান! আর জলটা এমন নোনতা, চোখে মুখে ঢুকে গেলেই জ্বালা করে। আর ঢেউ এসে গেলে ওমনি ছুট্টে পালিয়ে যেতে হয়।
এসব শুনে টুনে ছেনু একটু ঘাবড়ে গেল, যা দেখা যাচ্ছে সমুদ্র ব্যাপারটা বিশেষ সুবিধের নয়, একটু সাবধানেই থাকতে হবে। তবে পিসিমা সব শুনে অভয় দিয়েছে বড় বড় ঢেউ আসলে নাকি মজাই হয়, যত বড় ঢেউ তত মজা। আর মায়ের বা দিদির হাত ধরে থাকলে তেমন কোনো চিন্তা নেই। আর বারবার মনে করিয়ে দিয়েছে, যাই হোক, ওখানে গিয়ে ওখানকার বিখ্যাত খাজা খেতে যেন ছেনুরা ভুলে না যায়, একটা কি দোকানের কথাও বললো, কি যেন টিয়া না তোতাপাখি, এমন একটা নাম।
যাই হোক, যাওয়ার জন্য বাড়ি জুড়ে সমস্ত গোছগাছ শুরু হয়ে গেল। ওখানে গিয়ে রান্নাবান্না করে খেতে হবে, তাই মা হাঁড়ি, কড়া, খুন্তি, ছান্তা, ঘটি, বাটি, বঁটি সবই গোছাতে লেগেছিল। বেনার থেকে জানা গেল, বাসন কোসন সবই ওখানে আছে, আলাদা করে নিয়ে যাওয়ার দরকার নেই। তাতে মাকে কিছুটা নিরস্ত করা গেলেও, ক'টা চামচ, ছুরি, বাটি, গেলাস সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়া থেকে মাকে আটকানো গেল না। ছেনু আর ছোদ্দিও গোছানো শুরু করল, কি কি জামাকাপড় নিয়ে যাবে। শেষমেশ সব গোছাগুছির পর ব্যাগের বহর দেখে বোঝার উপায় রইলনা ওরা যাচ্ছে কোথায় - পুরী না পহেলগাঁও!
তারপর সেই সমস্ত ব্যাগপত্তর নিয়ে ট্রেনে উঠে আজ এই ঝঞ্ঝাট। দুপক্ষের কেউই সিট ছাড়তে রাজি নয়। সমানে সমানে তর্কাতর্কি চলছে। এমন সময় টুক করে দিল ট্রেনটা ছেড়ে। মা কাঁদো কাঁদো মুখেও একবার কপালে হাত ঠেকিয়ে দুগ্গা দুগ্গা করে নিল। সিটের ওপর থেকে কেউই যখন দাবি ছাড়তে রাজি নয়, তখন শেষমেশ ঠিক হল টিকিট চেকার এলে এর ফয়সালা হবে। কিন্তু ততক্ষণ বাকিরা কোথায় বসবে? উল্টো দিকের এক মোটাসোটা ভদ্রমহিলা একটু চেপে চুপে সরে গিয়ে মাকে অল্প জায়গা করে দিলেন বসার জন্য। ছোদ্দি ভিড়ের মধ্যে থাকতে রাজি নয়, তাই সে তড়াক করে ওপরে মাল রাখার বাংকে চড়ে বসল। আর ছেনুর জায়গা হল একটা বিশাল বড় সুপুরির (বস্তায় কি আছে ছেনু একফাঁকে টুক করে জিজ্ঞেস করে নিয়েছিল) বস্তার ওপর। বেনা ওদের যত মালপত্র, তাকের ওপর তুলে দিয়ে দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। আশেপাশে গিজগিজে ভিড়, তিলধারণের জায়গা নেই। রিজার্ভ কামরা হলে কি হবে, দুনিয়ার লোক গেটের কাছে ভিড় করে রয়েছে। মাঝে মাঝে ছেনুর দম আটকে আসছে ভিড়ের ঠেলায়। মাঝখানে ওর খুব জোরে বাথরুম পেয়েছিল, এই ট্রেনে নাকি বাথরুমও আছে, কিন্তু যেতে গিয়ে দেখে সামনে কুম্ভমেলার ভিড়। ও অতিকষ্টে চোদ্দটা ঝুড়ি, সতেরটা বস্তা আর আটটা বাক্স কোনোমতে পেরিয়ে আর লোকজনকে ঠেলেঠুলে টয়লেটের দরজায় পৌঁছতে পারলো। গিয়ে দেখে দরজা বন্ধ। দু চার বার ধাক্কা দিতে দরজা খুলে দুজন উঁকি মারল। তারাও বেশকিছু মালপত্র নিয়ে ওখানেই বসে আছে। ছেনু বাথরুম করবে শুনে বেরিয়ে এল, কিন্তু সেই মালপত্র ওখানেই পড়ে রইল। বাথরুম সেরে ওর মনে হল সত্যিই তো, এখানে বসেও তো দিব্যি যাওয়া যায়, দরজা বন্ধ করে দিলে আর ভিড়ভাট্টা নেই। বাথরুম এর সামনে গাদা লোক বসে থাকায়, ট্রেনের যাত্রীরা কেউই তখনও বোধহয় বাথরুমে বেশি যেতে পারেনি, তাই ভারতীয় রেলের বাথরুমের বিখ্যাত খোশবাই তখনো হাওয়ায় ডানা মেলতে পারেনি। সেকারণেই অত বড়ো ঝুঁকির কথা মহারাজ ভাবতে পেরেছিলেন। যাই হোক দু-চার মিনিটের মধ্যেই দরজায় ধাক্কা পড়তে উনি চট করে দরজা খুলে আবার বেরিয়ে এলেন। ওই লোকগুলো আবার আগের জায়গায় ঢুকে পড়ল, আর মহারাজ ঝুড়ি-বস্তা-বাক্সের মালভূমি টপকে স্বস্থানে ফিরে এলেন।
ফিরে এসে ছেনুর হুঁশ হল, কই আরেকজন এসে যে সব মিটমাট করে দেবে বলল সেই লোকটা তো এখনো এল না! বেনাকে সে কথা বলতে বেনা বলে, আসবে আসবে, সময় হলেই আসবে। কিন্তু সময় চলে যাচ্ছে টিকিট চেকারের আর পাত্তা নেই। রাত যত গভীর হচ্ছে, বেনারও ধৈর্যের বাঁধ ভাঙছে। একসময় ওই সিটের ওখানে গিয়ে আবার চেঁচামেচি শুরু হয়েছে, আর কতক্ষণ আমরা এইভাবে যাব? এর একটা বিহিত হওয়া দরকার। আওয়াজ শুনে আশেপাশের লোকেরাও জড়ো হয়েছে। তারমধ্যে চশমা পরা একজন লম্বা নাকওলা কাকু এগিয়ে এসে বলল দুজনেরই টিকিট দেখান তো, গোলমালটা কোথায়, সেটাই আগে জানা দরকার। ওই লোকটার টিকিট দেখে কাকুটা বলল, "হ্যাঁ, ঠিকই তো আছে, কোচ নম্বর, সিট নম্বর সবই মিলে যাচ্ছে।" এবার বেনার হাতের টিকিটটা খুঁটিয়ে দেখে বলল, "একি! সিট নম্বর এক হলে কি হবে এই টিকিটটা তো অন্য কোচের!" বেনা বলে, " হতেই পারে না, আমি তো স্টেশনের লোককে জিজ্ঞেস করেছিলাম, সে তো এই কামরাটাই দেখিয়েছিল।" চশমাওলা কাকু মাথা নেড়ে বলল, "ভুল করে দেখিয়ে দিয়েছে তাহলে, আপনাদের সিট অন্য কোচে, পরের স্টেশনে নেমে বদলে নিন।"
ছেনু তো সেই কথা শুনে হায় হায় করে উঠেছে, কি কাণ্ড! অন্য জায়গায় ওদের রাজ্যপাট ফাঁকা পড়ে রয়েছে আর ওরা কিনা এখানে এত কষ্ট করে যাচ্ছে! ছি ছি! ওর তো ইচ্ছে করছিল তক্ষুণি লাফ দিয়ে নেমে ওদের সিটে চলে যেতে, কিন্তু বিধি বাম! মা আর ছোদ্দি পরিষ্কার বলে দিল, এই রাতের বেলায় কইটুকু সময়ের জন্য কোন্ না কোন্ অজানা স্টেশনে ট্রেন দাঁড়াবে, তখন এত মালপত্র নিয়ে আবার ঠিক কামরা খুঁজে ওঠা খুব ঝক্কির ব্যাপার হয়ে যাবে, তাই এসবের মধ্যে তারা নেই! তখন কি আর করা, যে যেখানে বসে ছিল, ওখানে বসেই রাত কাটাতে হবে। বেনাও একটা কোণ দেখে পা মুড়ে বসে পড়েছে। মায়ের পাশের সেই ভদ্রমহিলা ছোদ্দিকে বললেন, "আমি ভুবনেশ্বরে আসলে নেমে যাব, তখন তুমি এই সিটে বসে পড়বে'খন।" বাড়ি থেকে কৌটো করে মুড়ি আনা হয়েছিল, সেই মুড়ি আর নারকেল নাড়ু চিবোতে চিবোতে ছেনু বাকি পথ গুম মেরে বসে রইল। রাতে ট্রেনের সব আলো নিভে যেতে, ওই বস্তার ওপর বসেই যে কখন ঘুমিয়ে পড়ল, সে আর ছেনুর খেয়ালই নেই।
সকালবেলা ট্রেন ভালোয় ভালোয় পুরী তো পৌঁছল, কিন্তু ওখানেও যে এখনো আরেকটা বিপদ অপেক্ষা করে আছে কে জানত। ট্রেন থামতে না থামতেই হইহই করে এক গাদা লোক উঠে পড়ল কামরায়। সবাই এক্ষুণি তাদের পাকড়ে জগন্নাথ মন্দিরে নিয়ে যেতে চায়, কেউ কেউ আবার যেচে ঘর ভাড়া দিতে চায়। চারিদিক থেকে সবাই ছেঁকে ধরেছে, ওদের সাথে নিয়ে না গিয়ে ছাড়বে না। মা বলল এরাই নাকি পাণ্ডা, মানে ওখানকার পুরোহিত গোছের। দিদিমা আগেই মাকে বলে রেখেছিল ওদের পাণ্ডার নাম গোপাল খুঁটিয়া। ওনার নাম করতে আর হলিডে হোম বুকিংয়ের কথা এই ভিড়কে বলতে তখন ওরা ছেনুদের নিস্তার দিল। স্টেশন থেকে বেরিয়ে দরদাম করে দুটো রিকশা ভাড়া নিয়ে ওরা হলিডে হোমের দিকে রওনা দিল। বেনা বলে দিল জায়গাটা হরিদাস মঠের পরের গলি। রিকশা চলতে চলতে সমুদ্রের পাশের রাস্তায় পড়তেই প্রথমবারের মতো ছেনুর চোখে পড়ল সমুদ্রটা। নীল জলে সাদা সাদা ঢেউ। রোদ্দুর পড়ে জলের ওপরটা চিক চিক করছে। পাশ জুড়ে খালি বালি আর বালি। কিন্তু ছোড়দা যে বলছিল বিশাল বড় বড় ঢেউ আসে, সেসব কই? রিকশা থেকে সমুদ্রটা দেখে ছেনু এক্কেবারে হতাশ, এতো একটা দীঘির মতো! এ আবার সমুদ্র কি করে হলো? এই দেখতে এত ভিড় ঠেলে এদ্দূর আসা? তবে রিকশাটা চলছে, কিন্তু সমুদ্রটা মোটেই শেষ হচ্ছে না। সেও ওদের পাশাপাশি চলছে। যাক, তাহলে অত ছোটো নয় বোধহয়।
যাইহোক, শেষমেশ হলিডে হোমের দরজায় পৌঁছানো গেল। এতক্ষণ ট্রেন জার্নি করে সবাই ক্লান্ত, কোনোক্রমে বিছানায় শুয়ে পড়ার অপেক্ষা। মালপত্র গেটের সামনে রেখে হলিডে হোমের দরজায় গিয়ে কড়া নাড়া হচ্ছে কিন্তু কারও সাড়া শব্দই নেই। ছেনু তো আবার সেই দেখে চিন্তায় পড়ে গিয়েছিল, ওরা ভুল হলিডে হোমে চলে এল কিনা! বেনার দু তিনবার আকাশ কাঁপানো "কোই হ্যায়" চিৎকারের পর দেখা গেল কেয়ারটেকার গামছায় হাত মুছতে মুছতে আসছে। ও আসতেই জানানো হল, "আমাদের বুকিং আছে, শিগগিরি দরজা খুলে আমাদের ঘর দেখিয়ে দাও, সবাই ভয়ানক ক্লান্ত।" তা শুনে ও ঘাড় নেড়ে বলে, "এক্ষুণি ঘর দিয়ে দিচ্ছি, আপনারা বুকিংয়ের কাগজটা দিন।" বেনাও সেই শুনে মাকে বলছে, "মেজো মা একটু কাগজটা দিন তো।" মা তো সেই শুনে আকাশ থেকে পড়েছে, কাগজ আবার কিসের?
- ওই ব্যাংক থেকে যখন বুক করে আনলাম হলিডে হোম, তখন ওরা একটা কাগজ দিয়েছিল না, ওইটা লাগবে, একে দেখাতে হবে।
- সেকি? তুমি যে সেদিন এসে বললে বুকিং হয়ে গেছে, এই কাগজটা যত্ন করে রেখে দিন, আমি তো আলমারিতে তুলে রেখে দিয়েছি। সে তো আর আনিনি। আমি ভাবলাম ফিরে এসে ব্যাংকে দেখাতে হবে বুঝি।
সেই শুনে তো মাথায় বজ্রাঘাত হওয়ার জোগাড়। বেনা তখন সেই কেয়ার টেকারকে ডেকে বলে, "ভাই কাগজটা ভুলে বাড়িতে রয়ে গেছে, কিন্তু আমরা সব ব্যাংকেরই লোক, খুলে দাও কোনো চিন্তা নেই। ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে বুক করে দিয়েছে ঘর।"
ততক্ষনে কেয়ার টেকারের নাম জানা গেছে, অজিত। তার বক্তব্য খাতায় তো আরো অনেকের বুকিংই হয়, আপনারাই যে বুক করেছেন, আমি বুঝব কি করে! অনেক অনুনয় বিনয় করেও তার মন গলল না। তার সাফ কথা, কাগজ না দেখালে সে কিছুতেই ঢুকতে দেবে না। ছোদ্দি গেটের এপার থেকে অজিতকে বোঝানোর কত চেষ্টা করল। সে তাতে আমল না দিয়ে দরজা আটকে গটমট করে ফিরে চলে গেল। ছেনু আড়চোখে একবার ছোদ্দির দিকে তাকিয়ে দেখে, এক্ষুণি কেঁদেই ফেলবে মনে হচ্ছে, যা ওর মুখের অবস্থা। আবার সেই বসে থাকা ছাড়া কোনো উপায় নেই। শেয়ালদায় রাখা কাগজ এখন পাওয়া যাবে কি উপায়ে!
"বেনারসিপ্রসাদ! কি ব্যাপার তোমরা বাইরে বসে কেন?" ব্যাংকের যাদের ঘুরতে আসার কথা ছিল পুরী, তারাও ততক্ষনে এসে হাজির। তাদের দেখেই তো বেনা আনন্দে লাফিয়ে উঠেছে, "দেখুন না সার, কেয়ারটেকার ঢুকতেই দিচ্ছে না!"
- কেন!
- বলছে কাগজ দেখাও নইলে হবেনা। কি করব, কাগজটা ভুলে বাড়িতে রয়ে গেছে যে!
- এহে, আনতে ভুলে গেছ, ওই তো সেদিন নেপালদার কাছে বুকিং করিয়ে গেলে, মনে আছে আমার। দাঁড়াও আমি অজিতকে বলে দিচ্ছি। চিন্তা নেই।
সবাই হাঁক পাড়তে আবার অজিত দৌড়ে আসে। ব্যাংকের লোকেদের সব কাগজপত্র আছে, তাদের তো এক্ষুণি দরজা খুলে দেবে কিন্তু ছেনুদের কথা সব শুনে তবুও সে কিন্তু কিন্তু করছে। ব্যাংকের লোকেরা সবাই মিলে তখন হইহই করে ওঠে। প্রথমের ভদ্রলোক এগিয়ে গিয়ে বলেন, আরে আমাদেরই হলিডে হোম, আমরা বলছি, তোমার আর সমস্যাটা কি! আমাদের ব্যাঙ্কের পাশেই এনাদের বাড়ি। খুব ভালো করে চিনি। বলা হচ্ছে তো কোলকাতায় গিয়ে কাগজপত্র পাঠিয়ে দেওয়া হবে। তোমার কোনো চিন্তা নেই। তাতে কাজ হল। লটবহর নিয়ে প্রথমে ব্যাংকের লোকেদের মিছিল, পিছু পিছু বাক্স প্যাঁটরা সাথে করে ছেনুরা ঢুকে পড়ল। ওদের দুটো ঘর, একটা ছোটো, একটা বড়। বড় ঘরটা মা আর ছোদ্দিকে দিয়ে ছেনু আর বেনা ছোট ঘরটার দখল নিল। তারপর চট করে জুতো ছেড়ে অবশেষে বিছানায় পিঠ ঠেকিয়ে তবে শান্তি! শুয়ে শুয়ে ছেনু ভাবে, এই ব্যাংকের কাকুগুলোর সাথে দেখা না হয়ে গেলে কি কাণ্ডটাই না আজ হত!
তবে সেই আরাম আর বেশিক্ষণ করা গেল না। দুপুরের রান্নাবান্না আছে, তাই বেনা আবার দৌড় লাগাল স্টোভ, কেরোসিন, বাসন কোসন সব জোগাড় করতে। কোটাল মশাই এত ছুটছেন, মহারাজই বা বসে থাকেন কি করে! তাই ছেনুও গেল পিছন পিছন। আবার মায়ের থেকে টাকা নিয়ে বাজার করার ব্যাপারও ছিল। শেয়ালদায় মাঝে মাঝে ও ছোড়দার সঙ্গে বাজারে যেত, তাই নতুন জায়গায় এসে বাজার দেখার ইচ্ছেও খুব। বাজারহাট, চান খাওয়া, বাগানে ঘোরা, এদিক ওদিক দেখা, এসব করেই প্রথম দিন কেটে গেল।
পরদিন বেনা খুব ভোর ভোর উঠে পড়ে ছেনুকে বলছে, "চলো নৌকো থেকে মাছ কিনে আনি।" ছেনু তো অবাক নৌকা থেকে মাছ! বেনা শুনে এসেছে ভোরবেলা নাকি সদ্য ধরা মাছ সমুদ্রের ধারে বিক্রি হয়। দেখা গেল ব্যাংকের কয়েকজনও ওদের সঙ্গ ধরেছে। এই কিছুক্ষণ আগে মাত্র ভোর হয়েছে, সূর্যের গায়ের লাল ছিটে এখনো কাটেনি পুরোটা। ওরা ধীরে ধীরে সমুদ্রের দিকে যত এগোচ্ছে নাকে একটা নোনা জলের গন্ধ এসে ধাক্কা মারছে। কাল যেটা ছেনুর কাছে দীঘির মতো লাগছিল দূর থেকে, আজ কাছে যেতে যেতে সেই সমুদ্রটাই খালি বড়ো হয়ে যাচ্ছে। যতই খোঁজে কিছুতেই ওই পাড়টা আর চোখে পড়ছে না। তবে এখনও সমুদ্রে তেমন বড় ঢেউ কিছু দেখা যাচ্ছে না। সমুদ্রের ধারে কয়েকটা জেলে নৌকো এসে দাঁড়িয়ে রয়েছে। পাশেই জাল পেতে তার ওপর মাছ বিক্রি করছে আর লোকজন কিনবে বলে তাদের ঘিরে রয়েছে। ছেনু অবাক হয়ে দেখে কত রকম মাছ জালের ওপর শুয়ে আছে, আদ্ধেক মাছই ও আগে কখনো শেয়ালদা বাজারে দেখেনি। এখানকার আঁশটে গন্ধটাও ওই মাছ বাজারের থেকে খানিকটা আলাদা। বেনা আর ব্যাংকের লোকেরা সেইখান থেকে বেছে বেছে মাছ কিনে নিল খাওয়ার জন্য। সেদিন কড়মড়ে মাছভাজাগুলো খেতে দিব্যি হয়েছিল।
দু দুবার সমুদ্রের সাথে দেখা সাক্ষাৎ তো হল, এইবার সরাসরি মোলাকাতের পালা। ছেনু গেঞ্জি আর একটা পুরনো হাফপ্যান্ট পরে তৈরি, বেনা, ছোদ্দি, মা সবাই যাবে আজ সমুদ্রে। উৎসাহের চোটে ও মাঝে মাঝে একটু লাফিয়ে নিচ্ছে। রান্নাবান্না করেই ওরা বেরিয়েছে, চান সেরে ফিরে এসে খাওয়া দাওয়া হবে। ওদের বাড়ির ছাদ থেকেও সমুদ্রটা দেখা যায় বটে, কিন্তু অল্প করে। কিন্তু জলে নামার জন্য ঘরে বসে ও যেরকম ছটফট করছিল, সত্যি সত্যি নামার মুহূর্ত যত এগিয়ে আসছে, পায়ে যেন একটু কাঁপ ধরে যাচ্ছে। সত্যি যদি ঢেউ এর তোড়ে হারিয়ে যায় কি হবে! ও তাড়াতাড়ি গিয়ে ছোদ্দির হাতটা শক্ত করে ধরে ফেলল। কিন্তু বুঝতে তো দেওয়া যাবে না ভয় পেয়েছে, তাই উল্টে ছোদ্দিকেই বলল,"বুঝলি শক্ত করে হাত ধরে থাকবি! নইলে কিন্তু সমুদ্দ এসে তোকে টেনে নিয়ে চলে যাবে।" ছোদ্দি শুনে ঠোঁট উল্টিয়ে বলে,"ভ্যাট, এত্ত লোক চান করছে, কাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে?" ওকে দেখে একটা নুলিয়া কাকু এগিয়ে এসেছে,"খোকাবাবু চলো তোমায় চান করিয়ে দিই, খুব মজা হবে।" তখন অনেকেই নুলিয়াদের সাথে টায়ার ধরে চান করত। কিন্তু ছোড়দার সাবধানবাণী কিছুতেই ছেনুর পিছু ছাড়ে না। ও তাই মাথা নেড়ে বলল, আজ তো শুধু পা ডোবাতে এসেছি, চান পরে করব। সত্যিই চান করা নিয়ে একটু পেট গুড়গুড় করছিল ছেনুর। আসলে এভাবে জলে নামার কোনো অভিজ্ঞতা তো ওর কোনোদিন ছিল না, শুধুমাত্র শেয়ালদার বাড়ির একতলার চৌবাচ্চাতেই মাঝে মধ্যে নেমে যা হুটোপাটি করেছে। তাই ভেতরে খুবই ভয় করছিল ওর। তাই ঢেউমাখা বালিতে অল্প পা ভিজিয়েই ও ধপ করে বসে পড়ল। আর জলে গিয়ে কাজ নেই। বালি নিয়েই আজ দিব্যি খেলা যাবে। প্রথমে হাত দিয়ে ছেনু বালির মধ্যে একটা গর্ত খুঁড়ে ফেলল। ঢেউ এর জল ওই গর্ত অব্দি চলে এলেই ওখানে আটকা পড়ে যাচ্ছে। এই করে দু তিনটে কুচো ঝিনুকও ওই গর্তে জমা হয়ে গেল। ঝিনুক ব্যাপারটা তো ভারি মজার! এটার কথাও পিসিমা বলেছিল, পিসিমা নাকি কোনো একবার এসে এত্ত ঝিনুক জমিয়েছিল। আর গরমকালে একটা ঝিনুক দিয়েই পিসিমা পিঠের ঘামাচি মারত। যাই হোক এই কুচো ঝিনুক গুলো এবার ছেনুর পরবর্তী প্রজেক্ট, মানে মহারাজের জন্য একটা দুর্গের অঙ্গসজ্জার অংশ হলো। এমনিতে দুর্গের জন্য খুব বেশি কষ্ট করতে হলো না, পুকুর বানানোর সময় প্রচুর বালি একজড়ো হয়েছিল। সেগুলোকেই কোনোমতে একটা দুর্গের আদল দেওয়ার চেষ্টা করা গেল। কিন্তু দেখা গেল শেষমেশ ওটা ঠিক দুর্গ না হয়ে একটা ছোটখাটো ঢিপির আকার নিয়েছে। কি করা যায় তবে? মা-ও জলে খুব বেশি নামবেনা বলে একটা লাল মগ সঙ্গে এনেছিল। ওটাও এবার ছেনুর খেলার অংশ হয়েছে। মহারাজ ওই মগ দিয়ে বালি তুলছেন আর থপ থপ করে সেই ঢিপির ওপর সাজিয়ে নিজের জন্য বানানো দুর্গটা মেরামত করছেন। মগের আকারে বালিগুলো জমে জমে সত্যিই এবার বেশ দুর্গ দুর্গ দেখাচ্ছে বটে। মাঝখানে আঙুল দিয়ে বেশ কয়েকটা জানলাও বানিয়ে দেওয়া গেছে। কিন্তু হঠাৎই একটা ঢেউ এসে পুকুর পেরিয়ে সেই নকল বুঁদিগড় ভাসিয়ে নিয়ে চলে গেল। ছেনুর তো মুখ গোমড়া! আবার দুর্গ বানানো শুরু করবে কিনা ভাবছে, এমন সময় ছোদ্দি এসে হাত ধরে টানাটানি শুরু করে দিল, "কি রে, তুই এখনো এখানে বসে আছিস? জলে নামবি না! চ, চ।" ছেনু কোনো প্ৰতিবাদ করার আগেই দিদি ওকে হাঁটু জলে (ছেনুর হাঁটু) টেনে নিয়ে চলে এসেছে। ও হাত ছাড়িয়ে পালাতে যাবে, তার আগেই ঝুপপুস করে একটা ঢেউ এসে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল। আবার উঠে দাঁড়াতে যাবে, ওমনি আর একটা ঢেউ! ছেনুর তো চোখে কানে সবজায়গায় নোনা জল ঢুকে গেছে। ও মাথা নেড়ে নেড়ে কান থেকে জল বার করছে, ছোদ্দি বলল, "ওটা নিয়ে ভাবিস না, ঠিক বেরিয়ে যাবে। আবার ঢেউ আসলে পট করে কাটাবি আমার মতো।" দেখা গেল ব্যাপারটা ভারি মজার, ঢেউ যেই আসছে দুজন মিলে লাফ দিচ্ছে, আর ঢেউ এর ধাক্কাটা তলা দিয়ে চলে যাচ্ছে। এরকম করতে করতে একসময় পা বালিতে রেখেও ঢেউ এর মোকাবিলা করা শিখে গেল। আবার ঢেউটা যখন ফিরে যায় পায়ের তলা থেকে বালি কি সুন্দর সরসর করে সরে যায়। এইসব করতে করতে বেশ মজা পেয়ে গেছে এখন ছেনু। যে জলে নামতেই চাইছিল না, সেখানে আরও ভেতরে যেতে ইচ্ছে করছে। মাঝে মাঝে ছোদ্দির হাত ধরে পা দুলিয়ে সমুদ্রে সাঁতারও কেটে নিচ্ছে। অনেকে আবার প্লাস্টিকের ফোলানো বল নিয়ে খেলছে জলের মধ্যে। ছেনু খালি ভাবছিলো, ইশশ্ ওই রকম একটা বল যদি সাথে করে আনা যেত, কি মজাই না হত! ভাবতে ভাবতেই বলটা উড়ে একসময় ওর কাছে এসে পড়ল। দূর থেকে ওরা ছুঁড়ে দিতে বলছে, ছেনু হেঁইয়ো বলে জোরসে ছুঁড়লেও, দমকা হওয়ায় ওটা আবার ওর কাছেই ফিরে এলো। তাই কি করা যায়, শেষমেশ জলের ওপর শট মেরে মেরে ওটা ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা হলো।
জলে হুটোপাটি করার সময় তো ছেনুর আর সময়ের খেয়াল নেই, ওদিকে বাকিদের পেট চুঁই চুঁই করছে খিদেয়। সব রান্না করা খাবার পড়ে আছে, বেশি দেরি করলে ঠান্ডা হয়ে যাবে। কিন্তু ছেনুকে তো জল থেকে তোলাই যায় না! শেষমেশ মায়ের ধমক আর বেনার আশ্বাসে কোনোমতে তাকে বাড়ির দিকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া গেল। যেতে যেতে ছোদ্দি ফিসফিস করে ছেনুকে বলল, "আরে এখনো তো আছি আমরা। আবার আসব চিন্তা কি!" বাড়ি ঢোকার আগেই ভালো করে পা ধুতে হল, পায়ে বালি ভর্তি। ঘরে ঢুকেও নিস্তার নেই, আবার চান করতে হবে। ছেনু অবাক, এই তো সমুদ্দে চান করে এলাম, আবার কেন? মা শুধু একবার ছেনুর মাথার চুলটা খাবলে দেখাল, "দেখ কত বালি! চান না করলে, মাথায় নুন বসে যাবে।" চান করতে গিয়ে ছেনু সত্যিই দেখল সব জায়গায় বালি কিচকিচ করছে। ওদিন চান করে খেয়ে দেয়ে দুপুরে যে জব্বর ঘুমটা হলো তার কথা আর বলাই বাহুল্য। তবে সব মিলিয়ে মহারাজের প্রথম সমুদ্র অভিযান এক্কেবারে সফল।
পরের দিন ঠিক হলো জগন্নাথ দর্শনে যাওয়া হবে সবাই মিলে। মায়ের তো আজ খুব আনন্দ, এতদিনের ইচ্ছে পূরণ হতে চলেছে। হলিডে হোমেও পাণ্ডার লোক চলে এসেছিল, তার সাথেই কথাবার্তা হয়েছে, সেই আজ আগে আগে সাইকেলে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ওরা দুটো রিকশায় পিছু নিয়েছে। মন্দিরটা দূর থেকে দেখে তো ছেনু অবাক, এরকম মন্দির তো আগে কখ্খনো দেখেনি। ওর সামনে মন্দিরটা তো এক প্রকাণ্ড পাহাড়ের মতো ঠেকছে। কেমন খাঁজকাটা খাঁজকাটা ওপরটা। ওদের সাথের পাণ্ডা আবার জানাল, রোজ নাকি সেই চুড়োর পতপত করে ওড়া পতাকাটা একজন গিয়ে বদলে দিয়ে আসে। ছেনু ভাবে লোকের ওঠার আর কি দরকার, এত গুলো বাঁদর বসে আছে ল্যাজ ঝুলিয়ে, ওদের দিলেই তো দিব্যি গিয়ে লাগিয়ে দিয়ে আসবে। মন্দিরে ঢোকার মুখেই একজন সবার মাথায় 'ধাঁই কিরিকিরি' 'ধাঁই কিরিকিরি' বলে ছড়ির বাড়ি মারছে, আবার সব লোকের থেকে পয়সাও চাইছে। সেই দেখে তো ছোদ্দি ক্ষেপে গেছে,"কি আশ্চর্য, মাথায় মেরে আবার পয়সা! এদের আহ্লাদ তো কম না!" ভেতরে ঢুকে সেই পাণ্ডা সবকিছু একে একে ঘুরিয়ে দেখাল। বেশিরভাগ জায়গাই খুব অন্ধকার অন্ধকার লাগল ছেনুর। দেখেই মনে হয় এই বুঝি একগাদা বাদুর উড়ে আসবে ভেতর থেকে। এবার জগন্নাথদেবের মন্দিরে ঢোকার আগে কি ভাগ্যি মা একবার গোপাল খুঁটিয়ার কথা জিজ্ঞেস করে ফেলেছে। সেই শুনে পাণ্ডা বলে ওনাকে আপনি চেনেন? মা বলেছে উনিই আমাদের পাণ্ডা তো। আগে যারা এসেছে সবাই ওনার কাছেই এসেছিল। সাথে সাথে সেই পাণ্ডা গিয়ে গোপাল খুঁটিয়ার লোককে গিয়ে ডেকে নিয়ে চলে আসল। সে আবার আপ্যায়ন করে ওদের একটা গদি মতো, সেখানে নিয়ে গেল। কথাবার্তা গল্প গুজবের পর, একটা ইয়াব্বড় খাতা বের করে সেখান থেকে ছেনুদের বংশের আগের লোকেরা কে কবে এসেছিল গড়গড় করে বলে গেল। মা তো শুনে অবাক! দেখা গেল, ছোড়দার নামও সেখানে লেখা আছে। ওনারা জিজ্ঞেস করে ওদের নামগুলোও লিখে নিলেন।
এরপর আসল মন্দির দেখার পালা, পাণ্ডা মন্দিরে একদম ঠাকুরের কাছ অব্দি নিয়ে চলে গেল। ছেনু এরকম অদ্ভুত ধরণের ঠাকুর আগে দেখেনি। ও হাঁ করে তাকিয়ে আছে ঘাড় উঁচিয়ে। কেমন গা টা ছমছম ও করছিল। পাণ্ডা জগন্নাথ বলরাম সুভদ্রার মূর্তিটা দেখিয়ে বলল, জানো রথের সময় মন্দিরে এলে তখন কিন্তু এর এনাদের দেখা পাবে না, ওনারাই রথে চেপে সবার সাথে দেখা করতে বেরিয়ে পড়েন।
সেই পাণ্ডা আবার ঠাকুরের ভোগ তৈরির জায়গাও ঘুরিয়ে দেখাল। সেখানে আবার অবাক ব্যাপার, হাঁড়ির ওপর হাঁড়ির ওপর হাঁড়ি চাপিয়ে ভোগ রান্না হচ্ছে। সেখান থেকে বেরিয়ে আনন্দবাজারে সেই ভোগ আবার বিক্রিও হয়, ঠিক হলো দুপুরে ওদিন ঠাকুরের প্রসাদই খাওয়া হবে। কিন্তু সেই ভোগ তো বিকেল তিনটের আগে পাওয়া যাবে না, তবে কি উপায়! সেই পাণ্ডাই মুশকিল আসান হয়ে দেখা দিল, এখন টাকা দিয়ে গেলে সেইই ঘরে গিয়ে ভোগ পৌঁছে দেবে।
বিকেলে বাড়িতে ভোগ আসতে ছেনু দেখে এই টুকু টুকু সব হাঁড়ি, এতে সবার হবে? কিন্তু সেসব খেতে গিয়ে দেখা গেল, বাপরে বাপ, খেয়ে শেষই করা যাচ্ছে না!
ফেরার পথে মন্দিরের কাছ থেকে মা খাজা কিনতে যাবে, এমন সময় ছেনুর পিসিমার বলা সেই দোকানটার কথা মনে পড়ল। তোতাপাখি নয়, দোকানটার নাম আসলে কাকাতুয়া। বেনা আবার জানাল, ব্যাংকের লোকেরা ওকে নাকি নৃসিংহ ভাণ্ডারের খাজার খুব সুখ্যাতি করেছে। যাই হোক মন্দিরের কাছে আসা হয়েছে যখন, আপাতত ওরা নৃসিংহ থেকেই একটা করে খাজা খেয়ে খিদে মেটালো। পরে নয় কাকাতুয়া থেকে বাড়ির জন্য নিয়ে যাওয়া যাবে। ছেনু ভাবে কি সুন্দর মুচমুচে খেতে, আহা এসব জিনিস শেয়ালদায় যে কেন পাওয়া যায়না কে জানে! ওখান থেকে মহারাজের আবার একটা মজার জিনিস প্রাপ্তি হল, পুরীর ছড়ি। সবাই কিনছে, উনিই বা বাদ যান কেন! পিসেমশাই এর কাছেও এরকম একটা আছে, তবে সেটা আলমারির ওপর তুলে রাখা থাকে। উনি সাথে সাথে ভেবেও নিলেন, তেতলার বারান্দা থেকে রাজ্য শাসনে এই ছড়িটা বেশ ভালো কাজে আসবে।
হলিডে হোমে ফিরে ছেনু সেই ছড়ি নিয়ে এদিক ওদিক ছোটা ছুটি করত আর ওখানকার বাগানের মধ্যে পুঁচকে নারকোল গাছগুলোকে অবাক হয়ে দেখত। কি করে এইটুকু গাছেও ডাব হয় কে জানে! ছেনুর খুব ইচ্ছে করছিল এরকম একটা গাছ বাড়ির জন্য নিয়ে যেতে।
ছড়িটা পেয়ে ওই গাছগুলোকেও ছেনু প্রজা বানিয়ে ফেলল। দিনে দুতিনবার করে অ্যাই অ্যাই করে কত কি বলত। তারপর শুধু কি তাই, সেই ছড়িটা হয়ে গেল ওর সর্বক্ষণের সঙ্গী। এই হয়তো ওটা নিয়ে বুড়ো সেজে কেঁপে কেঁপে হাঁটছে, এই আবার পুলিশ হয়ে গিয়ে ছোদ্দির দেখানো আরশোলাগুলোকে ঘরছাড়া করছে। এমনকি বাইরে কোথাও হাঁটতে গেলেও ছড়িটা সাথে নেওয়া চাইই চাই।
হলিডে হোমের যে কেয়ারটেকার ছিল, অজিত, সে প্রথম দিন ওদের ঢুকতে দেয়নি ঠিকই, কিন্তু পরে ওর সাথে দিব্যি ভাব হয়ে গেছিল ছেনুদের। মাঝে মাঝে অজিতকে ওদের সাথেই খাওয়ার জন্য ডেকে নেওয়া হত। ফেরার আগের দিন মা বলল, ব্যাংকের লোকদেরও একদিন খাওয়ানো উচিত। তারই প্রস্তুতি হিসেবে অজিত আর বেনা, বারান্দায় আলু-পেঁয়াজ ছাড়াতে বসল। ছোদ্দির দায়িত্ব পড়ল মশলা বাটার। বাকিসব জোগাড়যন্ত্র মা দেখছে। তার সবকিছু তদারকির জন্য ছড়ি হাতে মহারাজ তো রয়েছেনই।
ছেনু রোজই পুরীর সমুদ্রটাকে দেখত, কিন্তু তবুও সেই ছোড়দার বলা সমুদ্রের গল্পের সাথে কিছুতেই মেলাতে পারতো না। কোথায় গেল সেই দোতলা সমান ঢেউ, সেই জলের ভীষণ ঝাপটা? এত শান্ত শিষ্ট সুবোধ সমুদ্র যেন ও ঠিক মন থেকে মানতে পারছিল না। প্রথম দিনের পর আরও দুদিন জলে নেমে দারুণ হুটোপাটি করা গেছে। এই চান করার সময় ওর ভীষণ মজা হত, ছোট ছোট ঢেউ এর সাথে খেলা করে সময় কেটে যেত। তাই প্ৰথম বার যেটাকে দীঘি ভেবে মুষড়ে পড়েছিল, সেটাকেই শেষমেশ ছেনু খুব ভালোবেসে ফেলেছিল। সমুদ্রের ধার ধরে হাঁটতে হাঁটতে ও টপাটপ ঝিনুক কুড়াত আর মায়ের দেওয়া একটা পুঁটলিতে রাখত। কোন ঝিনুক সেখানে জায়গা পাবে, তার আবার অনেক বাছবিচার আছে। খোলটা গোটা হতে হবে, ভাঙাটাঙা হলে বাদ, সাইজে একটু বড়সড় হতে হবে, আর সবচে বড় কথা, দেখতে বেশ একটা অন্য রকম হতে হবে। যখনই বালির ওপর দিয়ে হাঁটত, ও আর ছোদ্দি নিচের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে যেত, এই বুঝি একটা ভালো ঝিনুক মিস হয়ে গেল। পরদিন এই সমুদ্রটা ছেড়ে বাড়ি ফিরে যেতে হবে, ভাবতেই ছেনুর যেন কান্না পেয়ে যায়।
ফেরার দিন ওদের রাত্তিরে ট্রেন, বিকেলে কি আর করবে, তাই সমুদ্রের পাড়ে এসে বসে আছে। আকাশ আজকেও খুব পরিষ্কার। ওরা মশলামুড়ি খেতে খেতে নানা রকম গল্প গুজব করছে। এমন সময় একটা খুব অদ্ভুত দৃশ্য চোখে পড়ল, একদিকে লাল টুকটুকে সূর্যটা অস্ত যাবে যাবে করছে, আর উল্টোদিকে চাঁদটাও আকাশে উঠবে বলে তাড়াহুড়ো লাগিয়েছে। ফলে যেটা হয়েছে, তা অপূর্ব! সমুদ্রের একদিকের জল সূর্যের আভায় সোনালি হয়ে গেছে, আর অন্যদিকের জল চাঁদের আলোয় রূপোলি। পরে সমুদ্রের কথা ভাবলেই ওই দৃশ্যটার কথা ছেনুর বারবার মনে পড়ত।
যাওয়ার আগে সেই গোপাল খুঁটিয়ার লোক বাড়িতে এসে তাল পাতার বাক্স ভর্তি খাজা আর মালপোয়া দিয়ে গিয়েছিল। ভীষণ ভালো ছিল সেসব খেতে। এছাড়াও সেই কাকাতুয়ার দোকান থেকে ওরা বাড়ির জন্য বেশ খানিকটা খাজা নিয়ে নিয়েছিল। ছেনু তো অবাক, দোকানে সত্যি সত্যিই একটা মস্ত বড় কাকাতুয়া রাখা। সবাই বলেই রেখেছিল, পুরী গেলে খাজা আনতেই হবে। তবে খাজা ছাড়াও আরেকটা মিষ্টি খেয়ে ছেনুর খুব খুব ভালো লেগেছিল, সেটা হল ছানাপোড়া। নামটা বিচ্ছিরি হলেও কি সুন্দর খেতে, কিন্তু এটাও শেয়ালদায় পাওয়া যায় না।
শেষমেশ পুরীকে বিদায় জানিয়ে ওরা আবার ফেরার ট্রেনে চেপে বসেছে। যাক, এইবার আর কোনো ঝামেলা ঝঞ্ঝাট হয়নি। ঠিক কামরা দেখে, মালপত্র গুছিয়ে একদম সঠিক সিট নম্বরেই ওরা চেপে বসেছে। এবার আর ভুল হওয়ার জো নেই। সময়মতো ট্রেনটা ভোঁ বাজিয়ে ছেড়ে দিয়েছে। ট্রেনটা সবে কিছুদূর এগিয়েছে কি এগোয়নি, হঠাৎ দেখা গেল মহারাজ ভারি উত্তেজিত। তাড়াতাড়ি মাকে গিয়ে বলছেন, চট করে ট্রেনটা একবার দাঁড় করানো যাবে?
- কেন কি হয়েছে?
- একবার বলো না ড্রাইভার কাকুকে!
- দূর পাগল, ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে এখন আর দাঁড় করানো যায়, কি হয়েছে বলবি তো!
মহারাজ কি আর বলবেন, এতক্ষণে যে তাঁর খেয়াল পড়েছে, বাগানে খেলা করার সময় তাঁর সাধের ছড়ি ওরফে সর্বক্ষণের রাজদণ্ডখানা যে টবটার পাশে হেলান দিয়ে রেখেছিলেন, সেটা যে এখনও ওইখানেই রয়ে গিয়েছে! ইশশ্ ট্রেনটা একবার থামানো গেলে এক্ষুণি হলিডে হোমের বাগান থেকে একছুট্টে ওটা নিয়ে আসা যেত!