আজ মহারাজ ছনেন্দ্রনাথ মনের আনন্দে টগবগিয়ে ঘোড়া ছোটাচ্ছেন, কান ঘেঁষে শনশন করে হাওয়া বইছে, চুলগুলো এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে তাতে। ঘোড়ার ঝাঁকুনিতে কোমরে বাঁধা তরোয়ালের খাপটাও লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছে। মহারাজ আজ বৈঠকখানা বাজারের ক্যাঁচর ম্যাচর ছাড়িয়ে, শিয়ালদা ছাড়িয়ে, কলকাতা ছাড়িয়ে পক্ষীরাজ ঘোড়ার পিঠে চড়ে এসে পড়েছেন সোজা তেপান্তরের মাঠের মাঝখানে। ইয়াব্বড় মাঠটাও আজ বুঝি চোখের নিমেষে পেরিয়ে যাবেন তিনি, তারপর গাছে বসা ব্যাঙ্গমা আর ব্যঙ্গমিকে খুঁজে বের করতে পারলেই হলো...
"উফ্ তোর চড়া হল, এবার তো আমায় চাপতে দে"
পাশ থেকে ভেসে আসা পকাই এর চিৎকার সেইই তেপান্তর মাঠ থেকে ছেনুকে ধরে এনে আবার পকাইদের বাড়ির বারান্দায় একটা দোল-খাওয়া কাঠের ঘোড়ার পিঠে এনে ধপ করে বসিয়ে দিল।
ছেনু দেখল, সত্যিই তো, পকাইকে তো এবার চড়তে দিতেই হয়, বেচারি এতক্ষণ ধরে অপেক্ষায় রয়েছে। তার ওপর ওরই ঘোড়া যখন। আজ সকালে পকাইদের বাড়ি এই ঘোড়াখানা আসতেই পকাই তাড়াতাড়ি ছেনুকে ডেকে এনেছে। সেই ঘোড়াখানা দেখেই তো ছেনু আনন্দে আত্মহারা। উফ্, ঘোড়া বটে একখানা। কি সুন্দর লালের ওপর সাদা,কালো, হলুদ দিয়ে রং করা, পিঠের উপর চওড়া করে বসার আসন পাতা, ঘাড়ের কাছে কেশরের পাশ দিয়ে আবার ধরার জন্য দুটো হাতল রয়েছে, খাড়া খাড়া কান, সাথে তেমনি টানা টানা চোখ - দেখেই চোখ জুড়িয়ে চায়। এ যা ঘোড়া, পক্ষীরাজ না হয়ে যায় না! সত্যিই, মহারাজ যেন এমন একটা ঘোড়ারই সন্ধানে ছিলেন এতদিন ধরে। তাই সে ঘোড়া দেখে আর লোভ সামলাতে পারেননি, পকাইয়ের জন্য আনা ঘোড়ায় নিজেই টপ করে বসে পড়েছেন। আর ঘোড়ায় চেপে টগবগ টগবগ করে সেই যে ছুটিয়েছেন, ডানা মেলে এদিক ওদিক ঘোরার মধ্যে আর সময়ের হুঁশ ছিল না। পকাই ধৈর্য হারিয়ে আবার ঘরে চলে গিয়েছিল, ফিরে এসেও যখন দেখল মহারাজের ঘোড়ায় চড়া শেষ হয়নি, তখন চিৎকার জুড়তেই ছেনুর টনক নড়ল।
দেখেছো, এদিকে পকাই কে আর ওদের বাড়িতে ছেনু এলোই বা কি করে, সেটাই তো এখনো বলা হয়নি।
ছেনু একদিন দুপুরে নিজেদের ঘরে জানলার পাশে বসে এক মনে ছোড়দার একটা ফাউন্টেন পেন হাতে নিয়ে কলকব্জা খুলে খুলে সাজিয়ে রাখছে, এমনি সময় শুনতে পেল, কে একটা তাকে 'অ্যাই অ্যাই' বলে কোথা থেকে ডাকছে। এদিক ওদিক তাকিয়ে শেষমেশ দেখা গেল সেই ডাকটা আসছে ওই জানলার ঠিক সামনের বাড়ির জানলা থেকে। ছেনু যে জানলাটার সামনে বসেছিল, সামনে একটা ঘুণধরা আলমারি থাকায় ওটা বহুদিন খোলা হত না। শেষমেশ সেই আলমারি দেহ রাখায় এই দু'তিনদিন হলো খোলা যাচ্ছে। ছেনু দেখল একটা পুঁচকে মেয়ে, ছেনুরই বয়সী হবে, কি তার চেয়ে ছোটও হতে পারে, তাকে জানলা দিয়ে হাত বাড়িয়ে ডাকছে। ছেনুও মুখখানা জানলার শিকে লাগিয়ে অবাক হয়ে বললো, কি হয়েছে?
-অ্যাই, তোর নাম কি রে?
ছেনু অবাক হয়ে বলল, আমার নাম ছেনু।
-তুই আমাদের বাড়ি আসবি?
-তোকে তো চিনিই না, তোদের বাড়ি আসবো কেন?
-আমি একটা খাবার বানিয়েছি, কেউ আমার সাথে খাচ্ছেই না, তুই খাবি?
এই আহ্বান ছেনুর পক্ষে উপেক্ষা করা কঠিন। ও চেঁচিয়ে বলল, দাঁড়া আমি এক্ষুণি আসছি।
বড়দা অফিসে, ছোড়দা কলেজে, ছোড়দি ইস্কুলে, অগত্যা মাকে গিয়েই বলতে হলো, পাশের বাড়ি থেকে ডাকছে একজন, ঘুরে আসি?
মায়ের অনুমতি পেয়েই সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে নেমে ছেনু পাশের বাড়ির দরজায়। একতলায় একটা দোকানের পাশ দিয়ে দরজা। এই বাড়িতে আগে কখনো যায়নি ছেনু। একটু ঠেলতেই দেখা গেল দরজাটা খোলাই আছে। একতলায় একটা ঘরে এক বুড়ো মানুষ বসে বসে গড়গড়া টানছে, ছেনু তাকে বলল, আমি একটু উপরে যাবো? তিনি শুনতে পেলেন কিনা কে জানে, ছেনু সিঁড়ি দিয়ে তরতর করে ওপরে উঠে গেল। ওপরে উঠেই সামনে যে দরজাটা খোলা পেল সেটা দিয়ে ঢুকেই দেখে কি সুন্দর সাজানো গোছানো একটা বাড়িতে এসে পড়েছে। একটু এদিক ওদিক তাকিয়েই সেই জানলাটা খুঁজে পেয়ে গেল, যেটা দিয়ে তার ডাক এসেছিল। সেই ঘরে যেতেই ও আশ্চর্য হয়ে দেখে এইতো সেই মেয়েটা, মেয়েটাও ওকে দেখে খিল খিল করে হাসছে।
"এসে গেছিস? এই নে এইখানে বস", বলেই মেয়েটা তাকে এক পুঁচকে টেবিলের সামনে বসিয়ে সামনে ছোট্ট একটা থালা এগিয়ে দেয়। ছেনু খুব উৎসাহ নিয়ে বসতেই মেয়েটা সেই থালার থেকেও ছোট্ট একটা হাঁড়ি ও ততধিক পুঁচকে একটা কড়া নিয়ে এসে টেবিলে রেখে, আরেকটা আরও ছোট হাতা দিয়ে হাঁড়ি থেকে কিছু কাগজ কুচি তুলে ছেনুর পাতে দিল। সেই দেখে তো ছেনু চটেমটে অস্থির!
- খাবার বানিয়েছিস বললি সেটা কোথায়?
মেয়েটা নির্দ্বিধায় হাঁড়ি দেখিয়ে বললো, "এই তো ভাত, আর কড়ায় তরকারি আছে।"
এতক্ষণে ওদের কথাবার্তা শুনে পাশের ঘর থেকে মেয়েটির মা-ও এসে দাঁড়িয়েছে। ছেনুকে দেখে বললেন, "তুমি পাশের বাড়িতে থাকো না?" ছেনু মাথা নেড়ে বলে, "হ্যাঁ, এই যে ও আমাকে জানলা দিয়ে খেতে ডাকলো।" ওর মা তখন হেসে বিস্কুটের কৌটো থেকে দুজনের হাতে দুটো করে বিস্কুট দিয়ে বললেন,"পকাই আর তুমি খাও, আমি রান্নাঘরে আছি, কেমন।"
এতক্ষণে ছেনু মেয়েটার নাম জানতে পারল। (পরে জানা যায়, ছোট্টো থেকেই পাকা পাকা কথার ফুলঝুরিতে বড়দের মুগ্ধ/অতিষ্ঠ করে ও এই অদ্ভুত ডাকনাম অর্জন করে)। বিস্কুট খেতে খেতে ও পকাইয়ের ঘরটা হাঁ করে দেখছিল, বাপরে বাপ, কত্তো খেলনা! সারি সারি পুতুল, টিনের রেলগাড়ি, খঞ্জনী বাজানো বাঁদর, দম দেওয়া কুকুর, কি নেই! শুধু পুতুলই যে এত রয়েছে, গুনে শেষ করা যায় না। এতক্ষণ এসব ও খেয়ালই করেনি। বিস্কুট খেয়ে ছেনুর মন এখন ফুরফুরে। পকাইয়ের সাথে রান্নাবাটি খেলায় আর আপত্তি নেই। পুঁচকে পুঁচকে বাসনকোসনগুলো ওরও মনে ধরেছে, হাঁড়ির ভাতের পর আবার কড়া থেকে মিছিমিছি তরকারিও নিল। ছেনুর বাড়িতে তো তেমন কোনো খেলনা নেই আর এখানে এসে যেন পুরো খেলনার সমুদ্রে এসে পড়েছে। ওদের খাওয়া দাওয়া হয়ে যাওয়ার পর পকাই কোথা থেকে একটা তুলোর ভল্লুক এনে হাজির করে বলল, "জানিস তো এর পেট ব্যাথা।" তারপর একটা খেলনা ডাক্তারি সেট টেনে এনে তার থেকে থার্মোমিটারটা ভল্লুকের গায়ে ছুঁইয়ে বলল, "একশো দুই জ্বর এসে গেছে।" জ্বর যখন এসেছে, কিছু তো করতেই হয়, ছেনু তাই স্টেথোস্কোপটা কানে গুঁজে ভল্লুককে ভালো মতো পরীক্ষা করে গম্ভীর মুখে বলল, "চিন্তার কিছু নেই, ওষুধ খেলে ঠিক হয়ে যাবে।" তাই শুনে পকাই আবার সেই ডাক্তারি সেট থেকে ওষুধের কৌটো বের করে দুটো ট্যাবলেট ভল্লুককে খাইয়ে আবার কৌটোর মধ্যে ঢুকিয়ে রেখে দিল। তারপর আবার থার্মোমিটার ঠেকিয়ে পকাই ঘোষণা করল, জ্বর নেমে গেছে। তাই শুনে, জীবনে প্রথমবার ডাক্তারি করে ছেনু মনে মনে নিজের তারিফ না করে পারল না। এই ডাক্তারি আর কার কার ওপর ফলানো যায় সেটাই ভাবছিল কিন্তু এমন সময় যেটা ঘটল, তার জন্য ও একটুকুও প্রস্তুত ছিল না। হঠাৎ করে কে একটা পিছন থেকে এসে ছেনুর চুল গুলো মুঠো করে ধরে টেনে জোরসে ঝাঁকাতে আরম্ভ করল। এরকম আচমকা আক্রমণে ছেনু তো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে। তারপর কোনোমতে মাথা সামলে পিছনে ঘুরে দেখে, পকাইয়ের চেয়েও ছোট আরেকটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে, ডিগডিগে রোগা, চোখ গুলো রাগী রাগী আর বসা বসা, এ তারই কীর্তি। পকাই তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ালো তাকে শাসন করতে, কিন্তু কে তাকে শাসন করবে? উল্টে পুঁচকে মেয়েটাই পকাইকে মেরেছে এক ধাক্কা। পকাই টাল সামলাতে না পেরে পড়ল গিয়ে সেই টেবিলের ওপর। পড়েই ভ্যাঁ করে কান্না জুড়ে দিল,"মাআআ, দেখো না, গোপু আবার এসে মারছে!" মা আর কি করেন, রান্নাঘর থেকে ছুটে এসে গোপুকে আদর করে বললেন,"মারামারি কোরো না, এটা নতুন দাদা তো, সবাই একসাথে খেলা করো, কেমন! পকাই তুই গোপুকে খেলায় নিচ্ছিস না কেন? তাই তো ও রেগে গেছে।"
পকাই মা'র সামনে তবু যুক্তি দেওয়ার চেষ্টা করে,"গোপুকে কি করে নেব, ও এসেই তো সব এলোমেলো করে দেয়!"
ছেনু তো দেখেই অবাক! এ কেমন বিচার হলো, এই আক্রমনের পর আদর!
তা যাই হোক, ভাব করে নিয়ে তিনজন মিলে খেলা আরম্ভ হলো। ছেনুর ডাক্তারিতে পরবর্তী রোগী হল গোপু। তাকেও থার্মোমিটার দিয়ে মেপে যথারীতি জ্বর পাওয়া গেল। এবার পালা স্টেথোস্কোপ দিয়ে দেখার। ডাক্তারি তো ওর শেখা হয়ে গেছে, গম্ভীর মুখে বলে দিল, চিন্তার কিছু নেই, ওষুধ খেলে ঠিক হয়ে যাবে। আশা করেছিল পকাই তাই শুনে সেই ট্যাবলেটের কৌটো বের করে নিশ্চয়ই ভল্লুকের মতো গোপুকেও মিছিমিছি ট্যাবলেট খাইয়ে দেবে। কিন্তু দেখা গেল তা নয়, পকাই বলল, ওকে তো ডাক্তারবাবু দেখে অন্য ওষুধ দিয়েছে, তাকে তুলে রাখা আছে, মা রোজ খাইয়ে দেয়।
ডাক্তারি ছেড়ে এবার পরের খেলা শুরু হল রেলগাড়ি নিয়ে। টিনের রেলগাড়ি তাক থেকে পেড়ে এনে পকাই মেঝেতে ছেড়ে দিল। খুবসে দম দিয়ে দিলে দিব্যি সেটা সোজা চলতে থাকে। তবে শুধু মেঝেতে ছাড়লে একসময় গিয়ে দেওয়ালে বা আলমারিতে আটকে ঝিকঝিক আওয়াজ করে। তবে পকাই বলল, তারও উপায় আছে, রেল লাইন পেতে দিলে, লাইন ধরে নাকি গড়গড়িয়ে চলবে। সেইসব রেললাইনও পেড়ে এক এক করে পাতা হলো, বেশ ঘরময় ছড়িয়ে গেছে লাইনগুলো। এবার দম দিয়ে ট্রেনটা লাইনে ছেড়ে দিতেই দিব্যি ঘুরে বেড়াতে লাগল ঘর জুড়ে। এত খেলনা নিয়ে খেলার আনন্দ ছেনু আগে কক্ষনো পায়নি! এইসব খেলতে খেলতে কখন যে বিকেল হয়ে গেছে খেয়ালই নেই। এমন সময় পকাইয়ের মা ট্রে-তে করে তিনজনের জন্য তিন বাটি ঘুগনি নিয়ে এসে ওদের সামনে এনে বললেন,"নাও অনেক খেলাধুলো হল আজকে, এবার একটু খেয়ে নাও।" চামচ দিয়ে একটু টেস্ট করেই ছেনুর ভীষণ ভালো লাগল, ও তো গোগ্রাসে খাচ্ছে, পাশে পকাইও আনন্দ করে খেতে শুরু করল। কিন্তু গোপু তো খাবেই না, চামচ নিয়ে দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিল। পরে ওর মা কোলে বসিয়ে আস্তে আস্তে খাইয়ে দিতে, তবে সোনামুখ করে খেল। খেয়েটেয়ে হাতমুখ ধুয়ে সবাইকে টাটা করে বাড়ি ফিরে আসার সময় ছেনু মনে মনে বাড়িটার নাম দিয়ে দিল 'খেলনা বাড়ি'। পকাই আর পকাইয়ের মা দুজনেই খুব করে বলল আবার চলে আসতে পরদিন। ফিরে আসতে আসতে ছেনুর মনে একটু আফসোসও হয়, এই পাশেই ছিল এত সুন্দর খেলনা বাড়িটা, কিন্তু কোনোদিন যাওয়াই হয়নি। যাক, এবার যখন চেনা হয়ে গেছে আর চিন্তা নেই!
সেই থেকে ছেনুর নতুন রুটিন শুরু হয়ে গেল। দুপুরে খেয়ে দেয়ে টুক করে খেলনা বাড়ি চলে গিয়ে ও আর পকাই মিলে সারা দুপুর ধরে জমিয়ে খেলাধুলো করত। কোনোদিন আসতে দেরি হলে পকাই এসে জানলা দিয়ে ডাক দিত আর ছেনু তক্ষুণি একছুটে খেলনা বাড়ির দোতলায়। প্রায় প্রত্যেকদিন পকাইয়ের মা বিকেলে দারুণ দারুণ খাবার বানাতো ওদের জন্য, আলুর দম, ঘুগনি, লুচি-তরকারি, ডিমভাজা, পরোটা এইসব। ওফ্, ছেনুর যে কি ভালো লাগত সেইসব খেতে আর কি বলব। আর পকাইও আরেকজন খেলার সঙ্গী পেয়ে ভীষণ খুশি।
এবার ছেনু যেখানে নিয়মিত যাওয়া শুরু করে, সেখানেই যা হয় আর কি, তেতলার পিসিমার বাড়ির মতো, ওটাও মহারাজ ছনেন্দ্রনাথের সাম্রাজ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল। যখন খুশি অবাধ যাতায়াত আর যা ইচ্ছে মজা করা সবই চলত পকাইয়ের সাথে মিলে।
একদিন পকাইদের বাড়িতে ছেনু, পকাই আর গোপু মিলে কুমির-ডাঙা খেলছে। খেলতে খেলতে গোপু কুমির হয়েছে আর ছেনু-পকাই খাটের ওপর থেকে মাঝে মাঝে মেঝেতে পা ছুঁইয়েই উঠে পড়ছে। কুমির হলে ছেনু যেমন সট্ করে ধরে ফেলে, গোপু তো কিছুতেই তেমন ধরতে পারছে না ওদের আর উল্টে ক্ষেপে যাচ্ছে আর মাঝে মাঝে হাঁপিয়ে উঠছে ওদের সাথে পাল্লা দিতে। শেষমেশ রেগে গিয়ে মেঝে থেকে একটা খেলনা চায়ের প্লেট তুলে ছেনুর দিকে ছুঁড়ে মেরেছে। ছেনু চট করে মাথাটা সরিয়ে নিতেই সেটা লাগল গিয়ে সোজা পকাইয়ের চোখের ওপর। ছেনু জলদি খাট থেকে নেমে গোপুকে বকতে যাবে, এমন সময় দেখে গোপু মাটিতে বসে পড়েছে আর জোরে জোরে হাঁপ ছাড়ছে। মুখটা পুরো লাল হয়ে গেছে, আর চোখদুটো যেন বেরিয়ে আসছে! গোপুর অবস্থা দেখে ওর ওপর যত রাগ ছিল ছেনুর, সব নিমেষে জল হয়ে গেল। "কাকিমাআআ, শিগগির এসো", বলে চেঁচিয়ে উঠে ছেনু একছুটে পকাইয়ের মাকে ডেকে আনে। কাকিমা ছুটে এসে দৃশ্য দেখে তো হতভম্ব, কোন মেয়েকে আগে সামলাবেন! একজন কপাল ধরে ভ্যাঁ করে কাঁদছে আর আরেকজন হাপরের মতো হাঁপ ছাড়ছে আর ধুঁকছে। গোপুর অবস্থা গুরুতর দেখে তাড়াতাড়ি ওকে ধরে খাটে শুইয়ে, পাখার স্পিডটা বাড়িয়ে দিলেন। তারপর গোপু একটু ধাতস্থ হলে কি একটা ওষুধ এনে ওকে খাইয়ে বেশি করে জল খাওয়ালেন। গোপুকে কিছুটা সুস্থ দেখে ছেনুরও ভয় একটু কমল। ও তখন পকাইকে ধরে বোতল থেকে কপালে জল দিচ্ছিল। পকাইয়েরও কান্না কমে গেছে ততক্ষণে। কাকিমা ওদের দুজনকে বসিয়ে বললেন,"এত দৌড়াদৌড়ি করিস কেন, তোরা একটু চুপ করে খেলতে পারিস না! দ্যাখ গোপুর শরীরটা কেমন করছে। পকাই, তুই তো জানিস, গোপুর শরীর ভালো নয়, এতদিন ধরে ভুগছে?" মাথা নামিয়ে বসে থাকা ছাড়া তখন ছেনুদের আর উপায় কি! তবে সেদিনের পর থেকে ছেনু আর কক্ষনো গোপুর ওপর একটুও রাগ দেখাতো না। গোপু যখন খুশি এসে ছেনুর চুলের মুঠি ধরে ঝাঁকিয়ে দিত, পিঠের মধ্যে গুদুম গুদুম করে কিল মারত, ঘুঁষি মারত, তবু ছেনু কিচ্ছুটি বলতো না, সব হাসিমুখে মেনে নিত। পকাই কিংবা ওর মা-বাবা দেখতে পেলে তাড়াতাড়ি গোপুকে গিয়ে থামাত, আর ছেনুর ধৈর্য দেখে অবাক হয়ে যেত। আসলে ওইটুকু মেয়ে, ঠিকমত হাঁটতে চলতেই পারেনা, একটুতেই হাঁপিয়ে ওঠে, তার ওপর ছেনু রাগই বা করে কি করে!
তবে অনেক ভেবে গোপুর এই মারধোরের পিছনের আসল কারণ পরে ছেনু খুঁজে পেয়েছিল। সেটা ছিল পকাইয়ের বাবা, মানে নেড়োকাকা। খেলনা-বাড়ির সবকিছু ভালো হলেও একটা জিনিস ভারি বিচ্ছিরি ছিল! মনে করলেই ছেনুর রাগ হয়ে যেত। সেটা হল 'গাঁট্টা'। নেড়োকাকা কোনো একটা স্কুলের রাগী মাস্টারমশাই ছিলেন আর ছাত্রদের ধরে ঠ্যাঙাতে বড্ড ভালোবাসতেন। এসব শুনেই ছেনু ওনাকে ভীষণ ভয় পেত আর পারতপক্ষে ওনার মুখোমুখি হতো না। কিন্তু অভ্যেসবশে নেড়োকাকার বোধহয় সবসময়ই কাউকে না কাউকে মারার জন্য হাত নিশপিশ করতো। তাই বাচ্চাদের দেখলেই মজা করে মাথায় একটা গাঁট্টা বসিয়ে দিতেন। এবার বাড়িতে পকাইকে মারলেই তো সে চিলচিৎকার জুড়ে দিত আর অসুস্থ বলে গোপুকে মারতে পারতেন না, তাই ওনার প্রধান টার্গেট হয়ে দাঁড়ালো ছেনু। বাড়িতে ছেনুকে পেলেই,"কি রে কি খবর?", বলেই একটা আদরের গাঁট্টা বসিয়ে দিতেন মাথায়। কিন্তু তিনি যতই আদর করে বসান, সেসব জিনিস ব্রহ্মতালু ভেদ করে একদম ঘিলু অব্দি নাড়িয়ে দিত। কোনো কোনো দিন এই গাঁট্টা মারার বদভ্যাসের জন্য নেড়োকাকিমা তাঁকে বলেওছেন,"ও কি! ওর মাথায় ওরকম গাঁট্টা মারো কেন?" কিন্তু এতদিনের অভ্যাস কি আর একদিনে যায়! তাই ছেনু ওনাকে দেখলেই টুক করে আড়ালে লুকিয়ে পড়ত।
ভাবলে অবাক হতে হয় এই নেড়োকাকারই আবার নানান রাজ্যের পুতুল জমানোর এত শখ। প্রত্যেকবার পুজোয় একেক রাজ্যে ওনারা সবাই ঘুরতে যেতেন, আর ফেরার সময় সেইসব রাজ্যের হাতের কাজের পুতুল কিনে এনে শোকেসে সাজিয়ে রাখতেন। তাই শোকেস ভর্তি গুজরাট, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, তামিলনাড়ু সব জায়গার অদ্ভুত অদ্ভুত সব পুতুল পকাইদের বাড়িতে দেখতে পাওয়া যেত। কিন্তু সেই সব পুতুলে হাত দিতে গেছ কি খবরদার, নেড়োকাকার চিলচিৎকার এসে তোমার পিলে চমকে দেবে!
তাই এমন বাবার মেয়ে হয়ে পকাই পুতুল ভালোবাসবে না তো কে ভালোবাসবে! তাই পকাইয়েরও তাকজোড়া পুতুল সাজিয়ে রাখা। সেসব অবশ্য হাতের কাজের পুতুল নয়।পকাই শুধু তাদের নিয়ে খেলে তাই নয় প্রত্যেকের আবার আলাদা আলাদা নামও আছে। ছেনুদের মিছিমিছি খাওয়ার টেবিলে তাদের মধ্যে কোনো কোনো ভাগ্যবান চেয়ারে সিটও পায়। পকাই শুধু পুতুলদের নিয়ে খেলেই ক্ষান্ত নয়, একবার কোত্থেকে শুনে ওর মাথায় জেদ চাপলো পুতুলদেরও নাকি বিয়ে হয়, তাই ও ওর দুটো পুতুলের বিয়ে দেবে। বোঝো কাণ্ড! পুতুলের বিয়ে উপলক্ষে সেই পুঁচকে টেবিলের ওপর চাদর পেতে পকাইয়ের যত খেলনা বাসন ছিল সব এক এক করে সাজানো হয়েছিল সুন্দর করে। বিয়ের পুতুলদেরকেও সাজিয়ে চেয়ারে বসিয়ে হাজির করা হয়েছিল। সেদিন পকাই, ছেনু আর গোপুর সাথে নেড়োকাকা আর কাকিমাকেও তাদের পুতুলের বিয়ের আসরে অতিথি করে নিয়ে এসেছিল। মোটকথা, হঠাৎ করে গোপু কি জানি কি কারণে ক্ষিপ্ত হয়ে টেবিল শুদ্ধু উল্টে দেওয়ার আগে অব্দি অনুষ্ঠান খুব ভালো ভাবেই চলছিল বলতে হয়।
এই নেড়োকাকাই আজ পকাইয়ের জন্য সেই দোল খাওয়া ঘোড়াটা নিয়ে এসেছেন, যেটায় চড়ে ছেনু এই সবে তেপান্তরের মাঠ অব্দি ঘুরে এলো। ছেনুর পর এবার পকাইয়ের চড়ার পালা। ততক্ষণ ছেনু বসে বসে কি করবে? কেন এত এত ছবিওলা বই আছে তো! খেলনাপাতির পরই খেলনাবাড়ির সব থেকে বড় আকর্ষণ তো এই সব মজার মজার ছবিওলা বইগুলো। ছেনুকে বাড়িতে কেউ কোনো ছোটোদের বই কিনে দেয়না, বড়রাই তেমন কেউ পড়েনা আর ওকে কি কিনে দেবে! তাই এখানে এসে ও প্রাণভরে পাতা উল্টে পাল্টে ছবিগুলো দেখে, সেইসব গল্পের মধ্যে ডুবে যেত। এত ছবির বই পকাইদের বাড়ি জমিয়ে রাখা ও পড়ে কূল পেতনা। ওর সবচেয়ে প্রিয় একটা বই ছিল, যেটায় পাতা ওল্টাতেই এক একটা পশুপাখির ছবি মুখের সামনে লাফিয়ে উঠত, আর দেখে যে কি আনন্দই না ও পেত। এমনকি ছেনুর এত বইয়ের নেশা, এক একদিন যদি পকাই দুপুরে ঘুমিয়ে পড়েছে বলে ডাকতে ভুলে যায়, ছেনু ঠিক দুপুরবেলায় দোতলায় চলে এসে কাউকে কিচ্ছুটি না বলে ওই বইগুলো নিয়ে টেবিলের তলায় ঘাঁটতে বসে যেত। দুপুরে যেহেতু সেইসব দিন সবাই ঘুমাচ্ছে, তাই জানলায় খড়খড়ি টানা থাকত। ছেনু সেই খড়খড়ি অল্প ফাঁক করে এক চিলতে রোদে দুহাতে ভর দিয়ে মেঝেতে উপুড় হয়ে শুয়ে একমনে সেইসব বই দেখতে দেখতে কল্পনায় কোন এক রূপকথার জগতে পৌঁছে যেত।
তবে ছেনুর মনে একটা দুঃখ ছিল, পকাইয়েরই শুধু এত খেলনা, আমার কিচ্ছুটি নেই! সেই দুঃখ ঘুচল একবার ওর কাকার সাথে রথের মেলায় ঘুরতে গিয়ে। মেলায় গিয়ে পাঁপড় ভাজা খেতে খেতে ইয়াব্বড় রথ দেখে তো ছেনু অবাক। ওর বাড়িতে যে রথটা রাখা আছে, ও বছর বছর যেটা ছাদে এনে দড়ি ধরে টানে, সেটা তো এই রথের সামনে নস্যি! কাকা আর ও মিলে একটা গাছ কিনে মেলা থেকে ফিরছে, এমন সময় চোখে পড়ল, ওই তো ছোটো ছোটো খেলনা হাঁড়িকুড়ি, আসবাবপত্র বিক্রি হচ্ছে। ব্যস, ওখানেই বায়না ধরল কাকার কাছে। কাকা আর কি করে, রথের মেলায় এনে কিচ্ছুটি না কিনে দিলে চলে! ছেনু তো সেইসব কিনে ভীষণ খুশি। পরদিনই দুপুরবেলা পকাইকে গিয়ে ওর সদ্য কেনা খেলনাগুলো দেখাতে পকাইও খুব খুশি, ডবল বাসন মিলিয়ে এবার ভোজসভায় ডবল আয়োজন করা যাবে যে!
যাক, অনেকক্ষণ হলো, এবার গিয়ে দেখা যাক, পকাই এর ঘোড়ায় চড়া কদ্দূর এগোলো। গোপু এসে আবার কিছু গণ্ডগোল পাকানোর আগে নতুন পক্ষীরাজ ঘোড়ার পিঠে আরেক প্রস্থ চেপে নেওয়া গেলে ভালো হয়। যেমন ভাবা তেমনি কাজ। ছেনু গিয়ে পকাইয়ের ঘোড়ায় চড়া দেখে অবাক হয়ে বললো, "একি রে, এত আস্তে আস্তে ঘোড়ায় চড়ে কেউ? এরকম তেজি ঘোড়া, টগবগ করে ছোটাবি তো!" পকাই ঠোঁট বেঁকিয়ে বলল,"এর থেকে আর কত জোরে যাবে? জানিস, আমি এমন জোরে চালিয়েছি, ঘোড়াটা ছুট্টে আমার মামার বাড়ি পৌঁছে গেছিল।" ছেনু মাথা নেড়ে বলল,"ওরম ভাবে হবেই না, শিখে নে আমার থেকে কীভাবে ঘোড়া ছোটাতে হয়। এটা যে সে ঘোড়া নয়, পক্ষীরাজ, এ ছোটানোর কায়দাই আলাদা। এই দ্যাখ" বলে, পকাইকে ঘোড়ার চালনা-কৌশল শেখাতে, ছেনু আবার ঘোড়ার পিঠে চেপে বসল।
হাতলে হাত আর পাদানিতে পা রেখে আরাম করে বসে মহারাজ ভাবলেন, সত্যি একটা ঘোড়ার মতন ঘোড়া বটে, এরকম একটা ঘোড়া আগে জুটলে মহারাজ ছনেন্দ্রনাথ এদ্দিনে নিশ্চই দিগ্বিজয়ে বেরিয়ে পড়তেন। তবে এখনো সময় আছে। ঘোড়াটাকে ভালো করে শিখিয়ে পড়িয়ে নিতে পারলে হয়ে যাবে। এবার মহারাজ জোরে জোরে দোল খেতে খেতে পকাইকে বললেন,"দ্যাখ এইভাবে ছোটাতে হয় ঘোড়া! আর এটা তো পক্ষীরাজ, উড়তেও পারে। একটা কায়দা করলেই ডানা মেলে আকাশে উঠে পড়বে।" এই বলে মহারাজ হাতল ছেড়ে দু'হাতে ঘোড়ার কান দুটোকে শক্ত করে চেপে ধরলেন। এবার কান চেপে ঘোড়াকে টগবগিয়ে ছোটানোর ফলে, যা হওয়ার তাই হল। পক্ষীরাজ এত অত্যাচার সইবে কেন! মট্ করে আওয়াজ হয়ে একটা কান ভেঙে মহারাজের হাতে চলে এল।
এইবার ভয়ে তো ছেনুর হাঁটু কাঁপছে, ও চোখের সামনে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে নেড়োকাকার লাগাতার রামগাঁট্টা ঠিক তার মাথায় বৃষ্টির মতো এসে পড়তে চলেছে। সাথে আলমারির পিছন থেকে সেই তেল চুপচুপে লাঠিটাও বেরোব বেরোব করছে আর তৈরি হয়ে রয়েছে ঠিক ওর পিঠেই ভাঙবে বলে। ছেনু তাড়াতাড়ি করে কানটা আবার জুড়ে দেওয়ার চেষ্টা করে, কিন্তু একবার ভেঙে গেলে সে কান কি আর জোড়ে? এবার এদিকে পকাইও এক্ষুণি ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলবে বলে প্রায় তৈরি হচ্ছে। ছেনু দেখল সেই চিৎকার শুনে নেড়োকাকা ছুটে এলে আজ সমূহ বিপদ। আজ তাহলে ওকে আর আস্ত রাখবে না। তাড়াতাড়ি পকাইয়ের হাত ধরে বলল,"এবার কি হবে রে পকাই?নেড়োকাকা তো জানতে পারলে আমায় আজকে মেরেই ফেলবে!" পকাইয়ের কান্না থামাতে গিয়ে উল্টে ছেনুই তখন ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলেছে। জীবনে প্রথমবার ছেনুকে ওরকমভাবে কাঁদতে দেখে, পকাই নিজেই তখন কাঁদতে ভুলে গেছে।
তবে ভাগ্য ভালো সেদিন মহারাজকে আর কোনো রামগাঁট্টার সম্মুখীন হতে হয়নি। কারণ কান ভাঙার দোষ ছেনুর হয়ে পকাই নিজেই বাবার কাছে গিয়ে ঘাড় পেতে স্বীকার করে নিয়েছিল। তবে পকাইয়ের কপালেও সেদিন কোনো বকুনি জোটেনি। যতই নতুন আনা রাজস্থানী ঘোড়ার কান ভাঙা যাক, নিজের মেয়ের জন্মদিনে তাকে কি আর নেড়োকাকা বকাবকি করতে পারেন!