একি! এখানেও এত জন উঠবে নাকি? আমরা তালে বসব কোথায়?, মহারাজ রীতিমতো ঘাবড়ে গিয়েছেন কাণ্ড দেখে। ঘাবড়ে যাওয়ার কারণ আছে বৈকি। এইটুকু ট্যাক্সির সামনের সিটে টপাটপ চার জনকে উঠে বসতে দেখে তিনি হাঁ হয়ে গেছেন। আগের গাড়িগুলোতেও কেমন আট দশজন করে লোক ঠেসেঠুসে উঠে পড়ছিল। এই গাড়িতে যে এত লোক ধরতে পারে এটাই মহারাজের ভাবনার বাইরে। এবার কি হবে ভেবেই ওনার দম আটকে আসছে। মামা পাশ থেকে আশ্বাস দিলো, না না, চিন্তা নেই, পেছনে শুধু চার জনই উঠবে আমাদের গাড়িতে, একটা সিট বেশি নেওয়া হয়েছে দিদিমার জন্য। পিছনে মহারাজ ছনেন্দ্রনাথ, মামা আর দিদিমাকে ঠেলেঠুলে আরও এক জন এসে চেপে বসল। মালপত্র যা কিছু ছিল সব ডিকিতে ঢুকিয়ে দেওয়া গেছে। ওদিকে সামনে চারজন বসেছে বললে ভুল হয়, কোনমতে এঁটে গেছেটাই সঠিক কথা, কিন্তু এর পর ড্রাইভারকাকুই বা বসবে কোথায়? দেখা গেল ড্রাইভার তো উঠলই আরেকজন লোকও উঠে পড়ল, সে নাকি সামনে নেমে যাবে। উঠে তো সবাই পড়েছে, এদিকে গাড়ির দরজা তো কিছুতেই বন্ধ হয়না। মহারাজ ভাবছিলেন, এ নিয়ে সবাই বুঝি ভয়ানক চিন্তায় পড়বে, কিন্তু কোথায় কি, দিব্যি নিশ্চিন্ত মনে একটা মোটকা মতো নারকেলের দড়ি বের করে ড্রাইভারকাকু খুব কষে দরজাটা আটকে দিল। আটকে দিল মানে একেবারে গাড়ির সথে ফট করে লেগে গেল, তা কিন্তু নয়, দরজা হাওয়াতেই দাঁড়িয়ে, তবু গাড়ির ফ্রেমের কিছুটা কাছাকাছি আনা গেল, সেটাই সান্ত্বনা। গাড়ি জোরসে ঝাঁকুনি দিলে কেউ অন্তত যাতে ছিটকে পড়ে না যায়। পড়ে গেলে ড্রাইভারেরই মুশকিল, একটা সিটের টাকা মার যাবে, তাই এই ব্যবস্থা - মামা উবাচ। এদিকে ড্রাইভারকাকুও অর্ধেক সিটের বাইরে বেরিয়ে আছে, কোনোমতে বাঁ হাত বাড়িয়ে স্টিয়ারিং ধরে আছে। ওইদিকটা পরের গাড়ির ড্রাইভার এসে শক্ত করে বেঁধে দিয়ে গেছে। শেষমেশ দড়িদরা বেঁধেছেঁদে গাড়ি ধানবাদ স্টেশন থেকে যাত্রা শুরু করল। রাস্তায় একগাদা ধুলো ওড়াতে ওড়াতে গাড়ি ছুটে চলেছে আর খানাখন্দে চাকা পড়লেই সব যাত্রীরা মিলে শূন্যে লাফিয়ে উঠছে।
কিন্তু ছেনু হঠাৎ গাড়িতে করে লাফাতে লাফাতে ধানবাদে কি করছে জানতে হলে প্রথমেই একটু খানি রিওয়াইন্ড করে নিতে হবে রিলটা। অবশ্য যারা মোটামুটি মন দিয়ে পড়ছেন তারা এর ইঙ্গিত আগেই পেয়ে গেছেন (মহারাজ ছনেন্দ্রনাথ ও চলচ্চিত্তচঞ্চরি দ্রষ্টব্যঃ)। ছেনুর মামা সেই বিলাসপুর থেকে বদলি হয়ে এখন চলে এসেছে ধানবাদে। এখন অনেক দিন নাকি এদিকেই থাকবে। ওদিকে কৃষ্ণনগরে দিদিমারও আর একা একা ভালো লাগেনা, মাঝে তাই কদিন ছেনুদের কাছে এসেই ছিলেন। এবার মামা তাই ঠিক করেছে দিদিমা আর ছেনুকে ধানবাদে নিয়ে আসবে। তাই বাক্স প্যাঁটরা বেঁধে ছেনু আর দিদিমা মামার সাথে পাড়ি দিয়েছে ধানবাদে। ওখানে যাওয়া যেদিন ঠিক হয়েছে, সাথে সাথে ছোড়দার চিমটি শুরু, ভেবে দ্যাখ যাবি কিনা, ওখানে কিন্তু এখানকার মতো ডাল ভাত পাবিনা শুধু রুটি খেয়ে থাকতে হবে। ছেনু তো অবাক, কেন ভাত পাবো না কেন? ছোড়দা ছেনুর মাথায় একটা টোকা মেরে বলল, আরে নামেই তো বলা আছে, ধান-বাদ। তাই ভাতের জন্য চালটা পাবে কোত্থেকে! পরে অবশ্য মামা ছেনুকে আশ্বস্ত করেছে, যদিও সত্যিই ওখানে বেশির ভাগ লোক রুটি খায়, ভাত-ডাল-মাছও দিব্যি পাওয়া যায়, কোনো অসুবিধেই নেই। ভালো করে জামা-কাপড়, জুতো সব গুছিয়ে নিয়েছে ছেনু, এবার গিয়ে নাকি অনেক দিন থাকা হবে। মা আর দিদিমা মিলে আবার যাওয়ার আগের দিন এত নারকেল নাড়ু বানিয়েছে বসে বসে, অর্ধেক এখানে বয়ামে করে রাখা থাকবে আর বাকি নিয়ে যাওয়া হবে সাথে করে। সমস্ত ঝক্কি সামলে, ট্রেনে চেপে ধানবাদে স্টেশনে পৌঁছনোর পর জানা গেল বাড়িটা ওইখানে নয়, ওখান আরও অনেক দূরে। প্রায় দেড়-দু ঘন্টা ওই গাড়িতে লাফাতে লাফাতে ওরা চলল পাথরডির দিকে, যেখানে মামার কোয়ার্টার।
কোলকাতার তুলনায় বেশ ভালোই ঠান্ডা তখন ওখানে। ফুলহাতা জামা ওপর হাফ সোয়েটার পরেও ছেনুর বেশ শীত শীত করছে। ওখানে আশেপাশে অনেকটাই রেলের কোয়ার্টার, কোয়ার্টারগুলোর সামনে অল্প অল্প ঘাস জমি, পাশে পাশে ছোটো খাটো গাছ, মানুষজনও খুব বেশি নয়। সব মিলিয়ে চট করে জায়গাটা বেশ ভালো লেগে গেলো ছেনুর, শেয়ালদার মতো সারাক্ষণ একটা বিতিকিচ্ছিরি ভিড়ভাট্টা লেগে নেই, রাস্তায় হাঁটতে গেলেই চারটে লোকের সাথে ধাক্কা লেগে যায় না। ফুরফুরে হয় বেশ মনটা। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা জিনিস নজরে পড়ল, গাছপালা, রাস্তাঘাট সব কিছুর ওপরেই যেন কালো কালো গুঁড়ো গুঁড়ো মতো কি পড়ে রয়েছে। এরকম কালো ধুলো মতো জিনিসটা কি? মামা বললো ওগুলো নাকি কয়লার গুঁড়ো। পাশেই কোল ওয়াশারি, তাই সব উড়ে উড়ে চলে আসে।
এই সমস্ত জায়গা আসলে নাকি কয়লা খনি অঞ্চল, প্যাসেঞ্জারের থেকেও আসলে কয়লা নিয়ে যাওয়াটাই এখানে রেলগাড়ির কাছে সবচে জরুরি। ছেনু তো অবাক, "আমরা রেলগাড়িতে যেসব সিটে বসে এলাম, ওখানে কয়লারা যায় বসে বসে? কোথায় যায়? শেয়ালদা ফিরে যায় আবার?"
- না না, কয়লা যাওয়ার আলাদা ট্রেন আছে, তাকে বলে মালগাড়ি। তাতে কোনো সিট নেই, খালি মালপত্রই যায়। সেই মালগাড়িতে চেপে কয়লা নানান জায়গায় পৌঁছে যায়।
সেটা শুনেই মহারাজের মনে হল, দারুণ ব্যাপার তো, একদিন সরেজমিনে গিয়ে দেখে আসতেই হবে এইসব ব্যবস্থা।
ততক্ষণে দিদিমা জিনিসপত্র সরিয়ে গুছিয়ে রেখে হাত পা ধুয়ে বিছানায় এসে বসেছে, ট্রেন আর গাড়ি মিলিয়ে ধকল নেহাত কম যায়নি।
-যাও ছোট্টু চান করে নাও গিয়ে।
ছেনুর তখন মনে হচ্ছে এক্ষুণি ছুট লাগিয়ে আশপাশটা ঘুরে দেখি, নতুন নতুন লোক, গাছপালা, বাড়িঘর। যদি নতুন কোনো বন্ধু জুটে যায় এই খানে! কিন্তু দিদিমা বলছে যখন চানই করে নিতে হবে এখন। বাথরুম টা শুকনো পাওয়া যাবে আগে গেলে, শুকনো বাথরুমে চান করার মজাই আলাদা।
এখানেও উনুন আছে, কয়লার উনুন। চান টান করে এসে দিদিমাও রান্নার দিকে এগোল, আজ বেশি কিছু না, শুধু চাল ডাল দিয়ে খিচুড়ি হবে, বাজার করা নেই কিনা! একটু আলু ছিল বাড়িতে, তাই একটু ডুমো ডুমো করে কেটে খিচুড়িতে দেওয়া হবে, মামা বসে বসে ছাড়াচ্ছে। খেয়ে দেয়ে উঠে ছেনুরও একটু ঘুম ঘুম পেয়ে গেছিল, খিচুড়ির সাথে ঘুমের কিছু একটা সম্পর্ক আছে বোধহয়।
বিকেলে মামা ডেকে বলল, চ, একটু ঘুরে আসা যাক।
ছেনু তো ঠিক এই মুহূর্তের জন্যই অপেক্ষা করছিল, ও তড়াক করে লাফিয়ে উঠল সেই শুনে।
- কোথায় যাব?
- আরে চলনা, দেখতে পাবি।
ও কিছুতেই বুঝতে পারছে না, এই শীতে হঠাৎ মামা হাফপ্যান্ট পরে ওর সাথে বেরিয়ে পড়ল কেন, শিয়ালদায় কখনো হাফপ্যান্ট পরে বেরোতে দেখেনি মামাকে। আশেপাশে দেখতে দেখতে বেশ অনেকখানি হেঁটে ওরা একটা ছোট ঘেরা মাঠের কাছে এসে পৌঁছল। গেট খুলেই ছেনু দেখে মামার চেয়েও বয়সে বড় দুটো কাকু হাফ প্যান্ট পরে মাঠের মধ্যে নেট লাগিয়ে ব্যাডমিন্টন খেলছে। পাশে চেয়ারে আরো তিনজন বসে আছে। এত বড় বড় কাকুরা সবাই এখানে খেলাধুলো করতে এসেছে! ছেনু তো দেখে অবাক।
যে দু'জন খেলছে, একজন সপাট সপাট করে র্যাকেট চালাচ্ছে,আর অন্যজন সেই সব মার ফেরাতে ঘেমে নেয়ে অস্থির। কিছুক্ষণ খেলার পর সেই কাকুটা ঘাম মুছতে মুছতে বললো, "নাও ব্যানার্জী, ফিল্ডে নামো। তুমিই মনোজকে হারাতে পারবে, ব্যাটা আজ ঘাম ছুটিয়ে ছেড়েছে।" পাশে যারা চেয়ারে বসে ছিল, তারা হাঁ হাঁ করে উঠল," ব্যানার্জী সবে এল, বসুক। আমরা যে আগে থেকে লাইনে আছি।"
-আরে তোমরাও তো মনোজের কাছে হেরেই বসে আছো, ব্যানার্জী ওকে হারাক আগে, ততক্ষণ একটু জিরিয়ে নাও।
মামা হেসে র্যাকেট হাতে নেমে পড়ল। দেখতে না দেখতেই দুজনের খেলা ভালো জমে উঠেছে। ছেনু অবাক হয়ে প্রথম বারের মতো মামার খেলা দেখছে। প্রথমে ধীরে ধীরেই চলছিল, এবার শট গুলো ধারালো হচ্ছে আস্তে আস্তে, মনোজেরও এবার প্রেস্টিজ ফাইট। মাঝে মধ্যে একটা দুটো চাপ মারছে, মামাও হাত বাড়িয়ে ফেরাচ্ছে সে সব। মামাও মাঝে মাঝে দু একটা ঘোর প্যাঁচের শট মেরে মনোজকে বিপদে ফেলছে। এরকম চলতে চলতে মনোজ একটু লাফিয়ে একদম তীর বেগে মাটিতে একটা শট মারল, মামা ঠিক মতো প্রস্তুত ছিল না, তবুও কোনোমতে র্যাকেট ছুঁইয়ে উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করল। করতে গিয়ে ব্যালেন্স হারিয়ে মাটিতে পড়তে পড়তেও আরেক হাতে কোনোমতে সামাল দিল। কিন্তু ছেনুর চোখ তখন শাটল ককটার দিকে। সে ঠিক কোর্টের গা ঘেঁষে টুক করে ওপারে গিয়ে পড়ল। বাকিরা চেয়ার থেকে লাফিয়ে হাততালি দিয়ে উঠেছে। মনোজের কিচ্ছুটি করার ছিল না।
আসলে ছেনুর মামা আর মনোজ কেউই আহামরি কিছু ভালো খেলত না, কিন্তু দুজনেই বাকিদের তুলনায় তরুণ, এনার্জি বেশি, ছোটাছুটি করে খেলতে পারে। কখনো সখনো একটু ঘুরিয়ে অন্য শট মারলেই বাকিরা ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে। তাই মামার আর মনোজের ওখানকার ব্যাডমিন্টন এর আসরে বেশ খাতির। ততক্ষনে ধুলোটুলো ঝেড়ে উঠে মামা র্যাকেটটা আরেকজনকে দিয়ে বলল, "নিন খেলুন, আমি ভাগ্নেকে জায়গাটা একটু ঘুরিয়ে দেখাই।" ওরা যেখানে এসেছিল জায়গাটার নাম রেলওয়ে রিক্রিয়েশন ক্লাব। রেলের কর্মচারীরা মাঝে মাঝে খেলাধুলো করে, এসে আড্ডা টাড্ডা দেয়। ছেনু জানতে পারল নাইট ডিউটি না থাকলে মামা মাঝে মধ্যেই এখানে এসে নাকি ব্যাডমিন্টন খেলে যায়। “আয় আয়, চপটা অসাধারণ বানায় এখানে”, বলে ছেনুকে হাত ধরে টেনে মামা পাশেই ক্যান্টিনে এনে বসাল। গোপালদা বলে একজন এই ক্যান্টিন চালায়। অর্ডার দেওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই ওদের জন্য একটা চা আর দুটো গরমাগরম ইয়াব্বড় ডিমের চপ চলে এল। এতক্ষণ ওদের খেলা দেখে ওরও ইচ্ছে করছিল খুব ব্যাডমিন্টন খেলতে। কিন্তু ওকে কেউ খেলায় নিচ্ছে না, বড়রাই খেলছে খালি, তাই মহারাজের মুখটা একটু ভার হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু চপটা সামনে পেয়ে সেইসব ভাবনা নিমেষে মিলিয়ে গেছে, ফুঁ টুঁ দেওয়ার তোয়াক্কা না করেই খপাৎ করে ধরে কামড় বসিয়ে দিয়েছে চপে। কামড় দিতেই বিপদ! কি গরম ভেতরটা! তখন কোনোমতে হু হা করে সামাল দেওয়ার প্রাণান্তকর চেষ্টা। গরম চপও মুখের ভিতর কিছুতে ঠান্ডা হতে চাইছে না, আর মহারাজও তাকে গলাধঃকরণ করবেনই, দুজনেই নাছোড়বান্দা। কিছুক্ষণ মুখ দিয়ে নানা রকম শব্দ টব্দ করে কোনোমতে প্রথম কামড়টা খাওয়া গেল। মামা তখন ছেনুর কাণ্ড দেখে হাসছে। মামা তখন সবে চায়ে চুমুক দেওয়া শুরু করেছিল, চপে হাতও দেয়নি, জানে তো কি গরম হয় ভেতরটা। ছেনু যাতে বাকিটাও এক্ষুণি মুখে পুরে বিপদে না পড়ে, মামা তাড়াতাড়ি ছেনুর চপটা একটু সরিয়ে দু'টুকরো করে জুড়াতে দিল হাওয়ায়।
এরপর যতদিন মহারাজ ধানবাদে ছিলেন বা পরেও যতবার গেছিলেন ওই গোপালদার ক্যান্টিনের ডিমের চপের আকর্ষণে বারে বারে মামার সাথে রেলওয়ে রিক্রিয়েশন ক্লাবের পথে পা বাড়িয়েছেন।
ধানবাদে মামার কোয়ার্টারে আর আশেপাশে শীতকালে রাত নেমে যেত খুব তাড়াতাড়ি। সন্ধ্যে সাতটা আটটার মধ্যেই সবাই খেয়েদেয়ে লেপের মধ্যে। রান্না তো আগেই যেরকম বলেছি কয়লার উনুনে হত, কারণ আশেপাশে কোল ওয়াশারি থাকার কারণে কয়লা ভীষণ সস্তায় পাওয়া যেত। কিছুটা দূরে ছিল চাষনালা কয়লা খনি, যেখানে আরও কিছু বছর বাকি সেই ভয়ানক ঘটনা ঘটার। একটা লোক আসত, বাড়ি বাড়ি কয়লা দিয়ে যেত। সেই কয়লা আবার বড় চাঁই এর মতন, ঠুকে ঠুকে ভাঙতে হতো বসে, এক এক দিন মামা ভাঙত, একদিন দিদিমা। রাতে লেপের মধ্যে শুয়ে মামা ছেনুকে একের পর এক রোমাঞ্চকর ডাকাতির গল্প শোনাত, এসব কিন্তু আবার সেই হা রে রে রে করা রঘু ডাকাত, বিশু ডাকাতের গল্প নয়, সব ছিনতাইবাজ, ট্রেন লুঠ, ওয়াগন ব্রেকারদের গল্প। মামা ট্রেনের গার্ড ছিল বলে সব ঘটনা কানে আসত। সেসব ঘটনায় ছেনু যত না ভয় পেত, তার থেকে বেশি ভয় পেয়ে যেত দিদিমা, বলত,"এদের সামলে তোরা ডিউটি করিস কি করে রে? একদম আটকাতে যাবি না এদের, দেখলেই পালাবি, পুলিশরা যা করার করবে।" মামা শুনে হাসে, "কত রেল পুলিশ রাত্রে মুখে গামছা বেঁধে ডাকাতি করে জানো!" ছেনু তো শুনে অবাক, যে পুলিশ, সেই ডাকাত!
যেদিন করে মামার নাইট ডিউটি থাকত, ভোররাতে ফিরে এসে মামা দিদিমাকে আর ডাকত না। আস্তে আস্তে রান্নাঘরে ঢুকে উনুন না জ্বেলে, একটা হিটারে ডিমের পোচ আর টোস্ট বানাত। ছেনুও দেখতে দেখতে কায়দাটা শিখে ফেলে, একদিন মামা ফিরতে ও-ই নিজে নিজে পোচ বানাতে বসিয়ে দিয়েছে। মামা তো দেখে অবাক। সেই থেকে ছেনুই নাইট ডিউটির পর মামার ব্রেকফাস্টের দায়িত্ব নিয়ে নিল। দুজনে মিলে ভোর ভোর পোচ দিয়ে জমিয়ে ব্রেকফাস্ট সেরে ফেলত।
ওরা এসেছে ক'দিন মাত্র হয়েছে, তার মধ্যেই পাশের বাড়ির নতুনদার সঙ্গে বেশ ভাব জমে গেছে ছেনুর। নতুনদা ওর থেকে তিন চার বছরের বড়, মাঝে মাঝে সাইকেল চালিয়ে হাটিয়া মানে হাটে যায় বাজার করতে। দিদিমা তো আশপাশ কিছুই চেনে না। নতুনদা যায় শুনে, ছেনুকে বলল নতুনদার সঙ্গে গিয়ে হাট থেকে একটু মাংস কিনে আনতে পারবি। ছেনু তো কাঁধ অব্দি মাথা নেড়ে দিয়েছে, এদিকে নিজেও কিচ্ছু চেনেনা। ছেনু ব্যাগ নিয়ে নতুনদার সাইকেলের ক্যারিয়ারে চড়ে বসেছে, নতুনদা একটা কি সুর ভাঁজতে ভাঁজতে প্যাডেল করছে। দেখতে দেখতে এক সময় পৌঁছে গেল হাটে। বেশ ভালোই লোক হয়েছে, প্রচুর শাক সবজি, ডিম, ওল, মুলো, গাজর, লাল লাল আলু, ফুলকপি, টমেটো নিয়ে হাটুরেরা বসে আছে। যদিও ছেনুর খুব বেশি অভিজ্ঞতা নেই, তবু তো মাঝে মধ্যে ছোড়দার সাথে শিয়ালদা বাজারে যেত, এই সবজিগুলো দেখেই বোঝা যায় এক্কেবারে তাজা। নতুনদাকে ছেনু বলল, কিন্তু দিদিমা তো বলেছে মাংস কিনে আনতে, মাংসের দোকান কোথায় চেনো? নতুনদা বলে, ওই তো আরেকটু এগিয়ে, ওখানেই তো দেখি কেটে বিক্রি হয়, চল দেখি। দোকানে গিয়ে ছেনু যেই বলেছে মাংস দাও, দোকানদার সাথে সাথে জিজ্ঞেস করেছে রাং দেব না সিনা দেব। ছেনু বলে না না পাঁচশো মতো দাও। দোকানদার বলে, পাঁচশো তো বুঝলাম, তোমায় রাং থেকে দেব নাকি সিনা থেকে দেব? এতো অদ্ভুত ধাঁধা, এর উত্তর কি হবে ছেনু তো কিছুতেই ভেবে পায় না! নতুনদাকে জিজ্ঞেস করতে দেখা গেল নতুনদাও জানে না, কারণ মাংস কেনে না। শেষমেশ নতুনদাই বুদ্ধি দিল, কিছু একটা বলে দেনা, দুটো একই হবে, একটাই তো পাঁঠা ঝোলানো। ছেনু কিছুতেই ভেবে পায়না কি বলবে, রাং না সিনা। ইশশ্, এখন ছোড়দা থাকলে নিশ্চয়ই ঠিক বুদ্ধিটা বের করতে পারত। শেষমেশ সাতপাঁচ ভেবে ছেনু বলে দিল রাং। দেখা গেল ওটাই ঠিক উত্তর, রাং বলতেই দোকানের লোক মাংস কেটে ওজন টজন করে ছেনুর হাতে ধরিয়ে দিল। টাকা পয়সা মিটিয়ে ফেরার পথে ওরা দেখল আকাশ কালো করে আসছে, চারদিকটা কেমন যেন থমথমে। নতুনদার কিছু শাকসব্জি কেনার ছিল, দু’একটা কিনতে না কিনতেই আকাশের অবস্থা দেখে বলল নাঃ, এক্ষুনি ফিরতে হবে, ঝড় উঠছে মনে হচ্ছে। ওরা সাইকেল চালিয়ে ফিরছে রাস্তা দিয়ে, তার মধ্যেই জোরসে ঝড় উঠে গেল। চারদিকে ধুলো বালি উড়ছে, গাছের মাথাগুলো ভয়ানক দুলছে, ছেনু তো দেখে ভীষণ ঘাবড়ে গেছে, এরকম ঝড় তো ওদের ওখানে কক্ষনো দেখেনি, খোলা জায়গায় যেন তাণ্ডব অনেক বেশি মনে হচ্ছে। এমনই ঝড় যে সাইকেল আর সোজা চালানো যাচ্ছে না, হাওয়ায় টাল খেয়ে খেয়ে যাচ্ছে। শিগগিরই দুজন মিলে একটা বড়ো গাছের নীচ দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল। তার মধ্যে নতুনদার একটা থলে দুম করে কোথায় যেন উড়ে চলে গেল হওয়ার তোড়ে। ছেনু এদিকে ভেবে পাচ্ছে না এই ঝড়ের মধ্যে কোনটাকে শক্ত করে ধরে থাকা বুদ্ধিমানের কাজ হবে, নতুনদাকে, সাইকেলটাকে, নাকি গাছটাকে? মুশকিল হলো, গাছটার গুঁড়িটা এত চওড়া, যে ছেনু হাতে নাগাল পাচ্ছেনা ঠিকঠাক, তার ওপর দেখা গেল, গাছের গায়ে কয়েকটা ডেঁয়ো পিঁপড়েও ঘুরঘুর করছে। তাই শেষমেশ একহাতে বাজারের থলে আর অন্য হাতে নতুনদার হাতটাকেই শক্ত করে চেপে ধরাই মনস্থির করল।
ওরা যখন বাড়ি ফিরেছে, সারা গা হাত পা ধুলোয় মাখামাখি, চুলে এক গাদা গুঁড়ো বালি ঢুকে বসে আছে, এমনকি চোখে মুখেও কি সব কিচকিচ করছে। বাজারের থলে হাতে চোখ পিটপিট করে ছেনু দেখতে পেল মামা এর মধ্যেই বাড়ি ফিরে এসেছে আর হাঁ করে ছেনুদের অবস্থাটা তাকিয়ে দেখছে। নতুনদা বাড়ি ফিরে যেতেই, মামা তো দিদিমার ওপর ভীষণ রেগে গেছে, ছেনু কি এখানকার কিছু চেনে, কি করে তুমি ওকে বাজারে পাঠালে? আজ এই ঝড়ের মধ্যে হারিয়ে গেলে বা কিছু হয়ে গেলে কি হতো! সেসব বকুনি শুনে মহারাজের ছাতি গর্বে একহাত ফুলে গেছে, যাক আজ তাহলে বিশাল বীরত্বের একটা কাজ করে আসা গেছে!
তবে দিদিমা ওদিন মাংস আনতে বললেও দিদিমা কিন্তু মাছ মাংস কিচ্ছুটি খেত না। ছেনু মাঝে মাঝে খুব জোর করত, খাও না, আমরা খাচ্ছি, তুমিও একটু খাও। দিদিমা তাড়াতাড়ি হাত নেড়ে বলত না না, তোমরাই খাও, আমার বাবা খুব গন্ধ লাগে। ছেনু কিছুতেই বুঝতে পারত না কি এত গন্ধ লাগে দিদিমার, কই আমরা তো দিব্যি খাচ্ছি, মোটে কোনো গন্ধ নেই। এমনকি রান্নাবান্নাও তো দিদিমাই করত, তখন তো কোন গন্ধ লাগত না দিদিমার, তাহলে খাওয়ার সময় গন্ধ লাগে কেন! একদিন সকাল সকাল বাজার থেকে একটা বড় রুইমাছ এনেছে মামা। ফ্রিজ তো নেই, দিদিমাও খাবে না, মামা আর ছেনু মিলেই গোটা মাছ খেতে হবে একদিনে। সকাল, বিকেল, রাতে তিন চার পিস করে মাছ খাচ্ছে দুজন মিলে। রাতে তখন ছেনুও আর পেরে উঠছে না, বলে আর থাক, কাল খাওয়া হবে খন। দু তিন পিস রেখে দেওয়া হল কাল সকালের জন্য, ঠান্ডার দিনে খারাপ হবে না, এই ভরসায়। সেদিন রাতে মাছের টুকরোটা ধরে ছেনু খুব শুঁকছে, মামা অবাক, কি হয়েছে রে?
- কোনো গন্ধ আছে কিনা দেখছি।
- কিসের গন্ধ, একদম টাটকা মাছ তো।
- না ওই দিদিমা যে গন্ধ পায়, সেইটা দেখছি!
পরে মহারাজ বুঝেছিলেন বড় হয়ে, কিসের গন্ধে দিদিমা মাছ খেতে পারত না। গন্ধটা মাছে নয়, বিধবাদের জন্য যে হাজারো বিধেন দিয়ে রাখা ছিল সমাজে, গন্ধটা সেখান থেকেই বেরোত।
ছেনু একে একে আরো বন্ধু বান্ধব জুটিয়ে ফেলেছে ধানবাদে, প্রশান্ত, অনিল, রঞ্জন, মুরলি, রাজু, রুমু, তনিমা, আরো কত নাম। তাদের সাথে বেশ ভালোই হুটোপাটি, দৌড়ঝাঁপ, কানামাছি, কুমিরডাঙা খেলা চলে। আশেপাশের কোয়ার্টারেরই বাচ্চারা সব। ও কোলকাতা থেকে এসেছে শুনে সবার মধ্যে খুব কৌতূহল, কোলকাতার নাম সবাই জানে, মস্ত বড় শহর, সারক্ষণ রাস্তায় গাড়ি চলে, জ্যাম লেগে থাকে, অনেকেই কোনোদিন যায়নি সেখানে, বাবা-মার কাছে নামই শুনেছে কেবল। ছেনুর কাছে তাই কোলকাতার গল্প শুনতে সবার খুব উৎসাহ। কিন্তু ও ভিক্টরিয়া মেমোরিয়াল, যাদুঘর, তারামণ্ডল কোত্থাও যায়নি শুনে ওরা অবাক। ছেনু নিজেই জানত না কোলকাতায় এত কিছু আছে।
বাড়িতে বানানো সেই বয়াম ভর্তি নারকেল নাড়ুও ফুরিয়ে গেছিল কবেই। এরকম উদ্যোগী ও উৎসাহী এক মহারাজ বাড়িতে থাকলে তা ফুরিয়ে যাওয়া খুব আশ্চর্যের কিছু না, বরং আশার কথা হলো দিদিমা, মামা আর পাশের বাড়ির চক্কোত্তি কাকুরাও কিছু কিছু পেয়েছিল। এদিকে ছেনুর খুব প্রিয় 'পোষ পাব্বণ' -ও সমাগত প্রায়, বাড়িতে থাকলে মা অল্প করে মালপোয়া বা পাটিসাপটা বানায়, এখানে কি বানাবে দিদিমা, ছেনু সেটাই ভেবে অস্থির। শেষমেশ থাকতে না পেরে জিজ্ঞেসই করে ফেলল গিয়ে, এবার কি পিঠে হচ্ছে গো!
দিদিমা বলে," ও বাবা, পিঠে তো আমি অনেকদিন বানাই না গো ছোট্টু, অনেক খাটনির কাজ, আমার হাত টনটন করে। এই নারকেল নাড়ুও তো তোমার মা সব কুরে কেটে দিল বলে না হল। খুব পিঠে খেতে ইচ্ছে করছে বুঝি? আচ্ছা ঠিক আছে দেখি, আমি সরুচাকলি বানাবো খন, মামাকে ঝোলাগুড় আনতে বলবো, তুমি ঝোলাগুড় দিয়ে খেও।"
ছেনু কি আর বলবে, আমতা আমতা করে বলল, "আচ্ছা তাই হোক।"
এদিকে খেলতে গিয়ে শুনতে পাচ্ছে বন্ধুদের বাড়িতে সব নানান রকম পিঠে তৈরির প্রস্তুতি চলছে, কল্পনাতেই সেসব গন্ধ মহারাজের নাকে এসে ঢুকে পড়ছে। আবার ওই সময় নাকি কুয়াশার জন্য ট্রেনের খুব প্রবলেম হয়, তাই মামার ওভারটাইম চলছে। কিন্তু অন্তর্যামী বলেও তো কেউ কেউ থাকে নাকি! দেখা গেল সেই অন্তর্যামীও কি করে যেন একটা, ছেনুর মনের কথাটা শুনে ফেলেছে। 'পোষ পাব্বন'-এর দিন বিকেলে হঠাৎ প্রশান্তর দুই ভাগ্নি মানু আর তিন্নি, তারা ছেনুর থেকেও বয়সে আরো ছোটো, দুজনে টুক টুক করে এসে জানাল, তাদের মা ছেনুকে জরুরি ভিত্তিতে তলব করেছে! মানুর আবার পায়ে একটু সমস্যা ছিল, একটু বেঁকে বেঁকে হাঁটত সেই জন্য, সে আর তিন্নি মিলে ছেনুকে দু'পাশ থেকে হাত দুটো পাকড়ে নিমেষের মধ্যে হাইজ্যাক করে ফেলে তাদের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে হাজির করল ছেনুকে। কি ব্যাপার, না ব্যাপার ছেনু তো কিছুই বুঝতে পারছে না। যেতেই ওদের মা ছেনুকে বলল, নাও নাও তাড়াতাড়ি হাত ধুয়ে বসে পড়ো। হাত ধুয়ে আসতেই ছেনু আবিষ্কার করল সামনে একটা বিশাল থালা ভর্তি নানান রকম পিঠে। এতরকম পিঠে, আগে খাওয়া তো দুরস্থান, এত রকম যে আদৌ পিঠে হতে পারে সেটাই ছেনুর জানা ছিল না। দুধ পুলি, চন্দ্রপুলি, মালপোয়া, পাটিসাপটা, গোকুল পিঠে, পোয়া পিঠে, চিতুই পিঠে, চুষির পায়েস আরো কত কি। ওইদিন ওদের বাড়িভর্তি লোক, প্রশান্তদের দিদির বাড়ি নাকি খুব বড় করে পৌষ পার্বণের অনুষ্ঠান হয়, সবাই মিলে তোড়জোড় করে পিঠে বানায়। কি সুন্দর খেতে ছিল পিঠে গুলো, ছেনু আর প্রশান্ত মিলে খাচ্ছে আর হাসছে, এত আনন্দ হচ্ছে নতুন নতুন পিঠে খেয়ে। বাড়ির বাকি ছোটরাও খাচ্ছে ওদের পাশে বসে, তিন্নি, মানু সবাই। অনেক কটা খেয়ে শেষমেশ মহারাজ ক্ষান্ত দিলেন, পেট ভরে গেছে এক্কেবারে, আর একটুকু জায়গা নেই। ফেরার সময় তিন্নিদের মা আরেকটা বড় বাটি ধরিয়ে দিল, তাতে নাকি মামা আর দিদিমার জন্যও পিঠে রাখা আছে। সেটা শুনে ছেনুর খুব ভালো লাগল, এতক্ষণ তো ও লোভীর মতো টপাটপ সাঁটিয়ে যাচ্ছিল পিঠে, বাড়ির কথা মাথাতেই ছিল না, ফেরার আগে দিদিমা আর মামার কথা মনে পড়তে একটু খারাপ লাগছিল। যাক ওদেরকেও খাওয়ানো যাবে, চিন্তা নেই!
আলগা হাওয়ায় ক্যালেন্ডারের পাতা উড়তে থাকে, সাথে ধানবাদের আকাশে শুরু হয় একটা দুটো করে ঘুড়ির আনাগোনা। আশ্চর্য ব্যাপার, বিশ্বকর্মা পুজোর তো ঢের দেরি! জানা গেল, এখানে নাকি বসন্তপঞ্চমীতে ঘুড়ি ওড়ানোর রীতি। তাই সরস্বতী পুজোর বেশকিছুদিন আগে থেকেই ঘুড়ি ওড়ানো, মাঞ্জা দেওয়া এসব শুরু হয়ে যায়। একদিন নতুনদা দূরে কার একটা সাথে প্যাঁচ খেলছে আর ছেনু লাটাই ধরে সুতো ঢিল দিচ্ছে, এমন সময় ছেনুর হঠাৎ প্রশ্ন জেগে উঠল মনে, আচ্ছা এখানে সরস্বতী পুজো কোথায় হয় গো?
- ইস্কুলে হয়, আমাদের এখানে হয় না।
- সেকি, এই পাড়ায় সরস্বতী পুজো হয় না?
- নাঃ, কে করবে!
- কেন এতজন আছে, সবাই মিলে করলে তো খুব মজা হবে।
- খারাপ বলিসনি, দাঁড়া, দেখি কি করা যায়।
সেদিনই বিকেলে জরুরি ভিত্তিতে ছোট ছোট বিশিষ্টজনেদের নিয়ে একটা মিটিং ডাকা হল। কনভেনর- নতুনদা ও মহারাজ ছনেন্দ্রনাথ। আলোচনায় দেখা গেল, এরকম নিজেরা নিজেরা মিলে পুজো করায় সবার ভীষণ উৎসাহ। সেখানেই নিলয় জানাল সে শুনেছে ঝরিয়ার কোথায় নাকি ঠাকুর বানানো হয়, ঠিক হল সেখান থেকেই ঠাকুর আনানো হবে। রুমুর থেকে জানা গেল, তাদের বাড়ির পাশের 'মিশরাজি' নাকি পার্ট টাইম পুরোহিত, তাই ওনার অজ্ঞাতসারেই 'মিশরাজি' কে পুরুত হিসেবে মনোনীত করে ফেলা হল। এবার প্রশ্ন প্যান্ডেল কি করে হবে, সবাই দেখেছে, প্যান্ডেল করতে একগাদা বাঁশ লাগে, সেসব কি করে জোগাড় হবে? এবার মুশকিল আসান ছেনু, সে জানাল ঘুরতে ঘুরতে তার চোখে পড়েছে যে, কাছেই মজুমদার মামাদের বাড়ির পাশে এত লোহার পাইপ রাখা আছে। সেই পাইপগুলোই ধরে বেঁধে প্যান্ডেল বানিয়ে ফেলা যেতে পারে। সেই প্রস্তাবও সর্বসম্মতিক্রমে পাশ হয়ে গেল। একজন অবশ্য মিনমিন করে জিজ্ঞেস করছিল, পাইপ তো হলো কিন্তু কাপড়ও তো লাগবে প্যান্ডেলের জন্য। সমবেত "ও ঠিক জোগাড় হয়ে যাবে" ধ্বনির মধ্যে সে কথা চাপা পড়ে গেল। শেষমেশ কথা উঠল যে পুজোটা হবে কোথায়? নানা আলাপ আলোচনার মধ্যে দিয়ে ঠিক হল, অনিলদের বাড়ির সামনে যে জায়গাটা আছে ওখানেই ভালো করে মাটি দিয়ে বেদি বানিয়ে গোবর লেপে নিকিয়ে নিয়ে ওখানেই ঠাকুর বসানো হবে। এইসব সিদ্ধান্ত হয়ে যাওয়ার পর উঠল আসল প্রসঙ্গ। যে কোনো পুজো উদ্যোক্তার কাছে যেটা আসল ইভেন্ট, সেটা হল দল বেঁধে চাঁদা তোলা।
নতুনদার বুদ্ধিতে খাতার পাতায় স্কেল দিয়ে দাগ কেটে চাঁদার বই বানিয়ে বাড়ি বাড়ি চাঁদা তুলতে বেরোনো হল। চাঁদার দলে মোট পাঁচজন- নতুনদা, প্রশান্ত, অনিল, ছেনু আর রুমু। রুমুকে নিতেই হবে কারণ সরস্বতী বানান ওদের মধ্যে সবচে ভালো ওই পারে। নতুনদা টাকার হিসেব রাখবে, অনিল কাগজ কাটবে স্কেল দিয়ে, প্রশান্ত নাম লিখবে আর ছেনু - আরে সবাই ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করছে কিনা একজনকে দেখতে হবে না? সেটা মহারাজ ছাড়া আর কে দেখবেন!
রেলওয়ে কোয়ার্টারের সব বাড়িতে ঘুরে ঘুরে চাঁদা তোলা শুরু হল। এত ছোট বাচ্চারা ভালবেসে উৎসাহ নিয়ে পুজো করবে শুনে সকলেই খুব খুশি। পাড়ায় প্রথমবার সরস্বতী পুজো বলে কথা। বাচ্চাদের দাবি অল্পই ছিল, তবুও কেউ কেউ একটু বেশিই দিচ্ছে নিজে থেকে। কোনো কোনো বাড়ি থেকে এও বলল, ওদিন ফলমূল কাটতে হবে তো, ডেকে নিয়ে যেও, সকাল সকাল চলে যাবো। চক্কোত্তি কাকিমা তো ছেনুকে দেখে অবাক, এই কদিন আগে এসেছে, এও তোদের চাঁদার দলে ঢুকে গেছে? ছেনু সেই শুনে লজ্জা পেয়ে শিগগির পেছনে গিয়ে লুকায়। একটা বাড়িতে রুমুকেও কাজে লাগল, চাঁদা দেওয়ার পর সত্যি সত্যি বানান জিজ্ঞেস করেছিল।
ধীরে ধীরে পুজোর দিন এগিয়ে আসছে। পাইপের জন্য মজুমদার মামাকেও রাজি করানো গিয়েছে কোনোমতে। মামার অফিসের একজনের শালার ধানবাদে কিসের একটা ব্যবসা, তার থেকে নাকি কাপড় পাওয়া যাবে প্যান্ডেলের জন্য। রুমুর পাশের বাড়ির 'মিশরাজি'-ও পুজো করতে রাজি হয়েছেন। ঝরিয়াতে নিলয় আর নিলয়ের বাবা গিয়ে ঠাকুর অর্ডার দিয়ে এসেছে। এখন ওদের দলের প্রধান কাজ দাঁড়িয়েছে গোবর কুড়ানো। যেখানেই গোবর দেখছে প্যাকেটে পুরে জমাচ্ছে - আহা সেই বেদি নিকোতে হবে না! ক্রমে ক্রমে ওদের পুজোর কথা পুরো কোয়ার্টার পাড়ায় রাষ্ট্র হয়ে গেল, কটা পুঁচকে বাচ্চা মিলে প্রথমবার সরস্বতী পুজো করবে। তনিমার মা এসে ওদের একদিন বলেছে সবাইকে একটা করে ছড়া মুখস্থ করতে, পুজোর দিন বলার জন্য, তনিমাও নাকি একটা গান গাইবে। সেই শুনে ওরা একটু ভেবলে গেছে। এসব মুখস্থ করা ছাড়া অন্য সব বিষয়ে দলের উৎসাহ অটুট। পুজোর দিন সাতেক আগেই ঠাকুর এসে গেছে, মুখে কাগজ বাঁধা, কিন্তু বাকিটা দেখা যাচ্ছে। ঠাকুরের গায়ের রং একটু লালচে, পুরো ঠাকুরটাই মাটির, এমনকি শাড়ি, বীণা সবই। বীণাটা দেখে ছেনুর খুব বাজিয়ে দেখতে ইচ্ছে করছিল, কিন্তু মাটির বলে তার থেকে কিছুতেই কোনো আওয়াজ বের করা গেল না। আগে তো ঠাকুর এত কাছ থেকে কখনো দেখা হয়নি, পুজোর দিনই আগে দেখেছে প্রতিবার, আর ওদিন ঠাকুরের সাথে সবসময় একটা দূরত্ব থাকে। সবমিলিয়ে এবার মহারাজের মনে ভীষণ আনন্দ, এতদিনে একটা দায়িত্বের কাজ পাওয়া গেছে। ওরা নিজেরা মিলে একটা পুজো করছে পাড়ায়, সবকিছু ঠিকঠাক এগোচ্ছে, সত্যি ওর ধানবাদে আসা সার্থক। এবার ও শেয়ালদায় যখন ফিরবে বুক ঠুকে ছোড়দাকে বলে দেবে, যাঃ যাঃ, আমিও আর পুঁচকে নেই, বড়ো হয়ে গেছি, অন্য জায়গায় গিয়ে পুজোর আয়োজন অব্দি করে ফেলেছি, আর কি চাই। শুধু ছোড়দাকে কেন, ওর তখন ইচ্ছে করছে ওদের শেয়ালদার বাড়ির ছাদে উঠে গোটা শেয়ালদাকে মহারাজের ধানবাদের কীর্তিকলাপ চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে শোনাতে।
কিন্তু মহাপুরুষরা বলে গেছেন, ধীরে বৎস ধীরে। বিকেলে মাঠের মধ্যে ওদের পুজোর মিটিং বসেছিল। মিটিং মানে সবাই জমায়েত হয়ে আনন্দে হইহুল্লোড় করছে আর পুজোর দিন কে কি পরবে সেই নিয়ে কথা চলছে আরকি। তখন পাড়ারই কিছু দায়িত্বশীল দাদা এগিয়ে এল, এরা সব নতুনদার থেকেও অনেক বড় বয়েসে। ওরা এসে ছেনুদের মিষ্টি মিষ্টি করে বলল, বাচ্চারা সবাই মিলে সরস্বতী পুজোর উদ্যোগ করেছে, খুব ভালো হয়েছে। পাড়ায় সত্যি একটা পুজোর দরকার ছিল, কিন্তু প্রথমবার হচ্ছে বলে কথা, এইটুকু করে করলে হবে! ধুমধাম করে হওয়া চাই, 'পোগ্রাম' হবে, গানবাজনা হবে, লাইটিং হবে, মাইক লাগানো হবে, ভোগ খাওয়ানো হবে তবে না পুজো। এইটুকু টাকা দিয়ে কি আর হবে, নতুন করে চাঁদা তুলতে হবে সবার থেকে। এতকিছু তো আর বাচ্চারা পারবে না, তাই কষ্ট করে হলেও ওই দাদারাই দায়িত্ব নিয়ে করবে সব। বাচ্চারাও পাশে পাশে থাকবে।
এরকম বিনা মেঘে বজ্রপাতে সবাই হকচকিয়ে গেছে, অনেকে শুনে বুঝেই উঠতে পারছিলনা দাদাগুলো কি বলতে চাইছে। ততক্ষণে নতুনদা যা বোঝার বুঝে ফেলেছে। ছেনু বুঝতে পারছে না কি হচ্ছে, নতুনদা মাথা নাড়ছে কেন বিরক্তিতে। ও বলল, দাদারা তো ভালই বলছে, কত্ত কিছু হবে। নতুনদা বলল, কিচ্ছু বুঝিস নি, পুজোটা আর আমাদের রইলই না, আমরা বাতিল। সেই শুনে ছেনু ঠোঁট ফুলিয়ে দৌড় মেরেছে বাড়ির দিকে। খুব বিচ্ছিরি লাগছে ওর, ওরা পুজো থেকে বাতিল? আর কিচ্ছুটি ভালো লাগছে না মোটে। ও বাড়ি গিয়ে দিদিমাকে জড়িয়ে ধরেছে। দিদিমাও অবাক, ছোট্টুর হঠাৎ হলটা কি! পাড়ার বড়রা কেউ বুঝতে পারলো না বাচ্চাদের কষ্টটা, সবাই ভাবলো দাদারা হেল্প করছে, এ তো ভালো কথা! মুষড়ে পড়ার কি আছে এতে। ভালোই তো, ওরা যেটা দায়িত্ব নিয়ে শুরু করেছিল সেই পুজোটা আরো ভালো করে হবে। কিন্তু আসলে বাচ্চারা যে উদ্যোক্তা থেকে সাইডলাইন হয়ে দর্শক হয়ে গেল নিমেষের মধ্যে সেটাই সবাই বুঝতে পারেনি।
পুজোর দিন খুব ধুমধাম করে পুজো হল। পাইপ নয়, আসল বাঁশ দিয়েই প্যান্ডেল করা হয়েছে, বারবার করে অঞ্জলি হচ্ছে। গোটা পাড়া জড়ো হয়েছে পুজোর জন্য। বড় দাদারাই সবকিছু সামলাচ্ছে, কখন অঞ্জলি হবে, কে ফুল পায়নি, আর কতটা দই লাগবে, চন্দন কোথায় বাটা হবে সওব। নিলয়, রুমু, অনিল সাথে সাথে ছোটাছুটি করছিল কিছুটা, নানা দিকে দেখছিল কি হচ্ছে না হচ্ছে, কিন্তু ওরাও বুঝতে পারলো যে ওদের কথা আসলে কেউ শুনছে না। ছেনুকে ডেকে একটা দাদা আবার জিজ্ঞেস করল, কি প্রাসাদ পেয়েছ তো খোকা? নিজেদের পুজোতেই ছেনুর কেমন যেন অন্য পাড়ার লোকের মতো লাগছে। সত্যিই পুজোর উদ্যোক্তা থেকে ওরা বাতিল হয়ে গেছে।
দুপুরে নতুনদা আর ছেনু পাশাপাশি পাঁচিলের ওপর বসে আছে। সরস্বতী পুজোয় পরবে বলে ঝরিয়া থেকে মামা ওকে যে পাঞ্জাবিটা কিনে দিয়েছে, সেটা পরে ও আজ অঞ্জলিও দিয়েছে। তবুও মহারাজের মুখ ব্যাজার। নতুনদা ওকে ফিসফিস করে বলল, "মজুমদার কাকু, বুঝলি..."
- কি?
- এটার পিছনে মজুমদার কাকুই ছিল।
- মানে?
- আমাদের ওই পাইপগুলো চাওয়া উচিত হয়নি, তখন মজুমদার কাকু কেমন পুজো নিয়ে গাঁই গুঁই করছিল, অথচ পুজো নিয়ে মজুমদার কাকুর ছেলে বিনুদাই এত বেশি বেশি করে এগিয়ে এল? আর আমাদের ফেকলু করে দিল! তার মানে কে আছে পিছনে ভাব।
ছেনুর দূরতম কল্পনাতেও এ ভাবনা মাথায় আসেনি, শেষে ওর কারণে এমনটা হল, ভীষণ ভীষণ খারাপ লাগছে ভেতরে, তখন কি আনন্দ করেই না পাইপের কথাটা বলেছিল। আর শেষে কিনা...
আর ভাল্লাগছে না মহারাজের, পুজো টুজো ভুলে গিয়ে মহারাজ শুধু ভাবছেন কবে মামার নাইট ডিউটি কমবে, আবার কবে মামা ব্যাডমিন্টন খেলতে যাবে। এখন শুধু একটা জিনিসই চট করে ওনার মন ভালো করে দিতে পারে, গোপাল কাকুর ক্যান্টিনের দুটো গরমাগরম ডিমের চপ!
পুনশ্চ:
আপনারা ওমনি ভেবে নিলেন ধানবাদ অভিযান এখানেই শেষ হয়ে গেল? এদিকে গোপন টেলিস্কোপে দেখা যাচ্ছে, হঠাৎ ছোড়দা কেন কে জানে একগাদা কলাপাতা সঙ্গে করে নিয়ে ধানবাদে হাজির, আবার অন্য দৃশ্যে মহারাজ পাজামা পাঞ্জাবি পরে গাড়ি চড়ে কার সাথে কোথায় একটা যেন যাচ্ছেন, আবার একদিন কেন কে জানে একদল লোক হঠাৎ শিশির ব্যানার্জীর খোঁজে ওদের বাড়িতেই বা চলে এল কেন, যখন শিশির ব্যানার্জী বলে কেউ ওখানে থাকেই না? সব কথা এখানেই বলে দিলে চলবে? কিছু কিছু নয় আপাতত একটু তোলা রইল মলাটবন্দি হয়ে আসার জন্য। :-)