মধ্যপ্রাচ্যের উত্তাল ভূরাজনৈতিক অঙ্গনে আবারও ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটল।
পর্যবেক্ষণ বলছে, ইসরায়েল-ইরানের যুদ্ধে সামরিক সক্ষমতায় পিছিয়ে থেকেও ইরান নৈতিকভাবে বড় একটি জয় ছিনিয়ে নিয়েছে। আর এই যুদ্ধের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কূটনৈতিক ব্যর্থতা এবং তার একচোখা পররাষ্ট্রনীতির পরিণতি ফের একবার প্রকাশ্য হয়েছে।
আরও একবার প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র ও নৈতিকতার ধারণা, অপরাপর স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রতি তার 'চোগলখোর' অবস্থান।
সপ্তাহ দেড়েক ধরে ইসরায়েল-ইরান দ্বন্দ্ব এক ভয়াবহ মোড় নিয়েছিল। ইসরায়েলি হামলার জবাবে ইরানও পাল্টা আঘাত হানে। এটি এমন এক মুহূর্তে, যখন মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতা চূড়ান্ত হুমকির মুখে, তখন আন্তর্জাতিক মহলসহ বিশ্ববাসী 'ওসি ওয়ার্ল্ড' ট্রাম্পের কাছে নেতাসুলভ আচরণে 'খামোশ' রণহুংকার আশা করেছিল।
কিন্তু বাস্তবতা হলো—এই পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার বদলে ট্রাম্প প্রশাসন বরং আগুনে ঘি ঢেলেছে।
ইরান যে প্রতিকূলতা সত্ত্বেও যুদ্ধবিরতিতে রাজি হলো এবং দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রী সাঈদ আব্বাস আরাঘচি স্পষ্ট ভাষায় বললেন, 'ইসরায়েল হামলা বন্ধ করলেই আমরা প্রতিক্রিয়া দেখানো বন্ধ করব'—এই বক্তব্য কেবল কূটনৈতিক সংযমই নয়, বরং ইরানের অভ্যন্তরীণ স্থিরতা ও নেতৃত্বের পরিণত মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ। আন্তর্জাতিক আইনের দৃষ্টিতে এই অবস্থান ইরানকে একটি 'নৈতিক উচ্চতায়' নিয়ে গেছে।
অন্যদিকে এই যুদ্ধে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি ডোনাল্ড ট্রাম্প শুরু থেকেই একপাক্ষিক অবস্থান নেন। ইসরায়েলি হামলার সমর্থনে জড়িত হয়ে পড়েন, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের 'বি-টু স্পিরিট' একটি স্টিলথ বোমারু বিমান থেকে সরাসরি ইরানে হামলার মতো ন্যাক্কারজনক ঘটনার সাক্ষী হয় ইতিহাস।
বলা ভাল, 'বি-টু স্পিরিট' হচ্ছে যুদ্ধবিমানের ইতিহাসে সবচেয়ে বিপজ্জনক ও অত্যাধুনিক। এটি রাডার এড়িয়ে নির্ভুলভাবে শত্রুর গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় হামলা চালাতে সক্ষম। যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এমন বিমান খুব কম সংখ্যক রয়েছে। তাই যখনই এই বিমান ব্যবহার করা হয়, তখন তা মিশনের গুরুত্ব বোঝায়। 'বি-টু স্পিরিট' একই সঙ্গে আজকের বিশ্বে আধুনিক সামরিক শ্রেষ্ঠত্বের প্রতীক।
হামলার পর সমাজ মাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে ট্রাম্প নিজেই ঘোষণা দেন—তারা ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় সফলভাবে বোমা বর্ষণ করেছেন।
ট্রাম্প জানান, ইরানের ফোরদো, নাতান্জ এবং এসফাহানে অবস্থিত পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে বোমা বর্ষণ করা হয়েছে।
তিনি লেখেন, 'আমরা আমাদের অত্যন্ত সফল হামলা শেষ করেছি। ফোরদো ছিল মূল টার্গেট, যেখানে পুরোপুরি বোমা বর্ষণ করা হয়েছে। সব বিমান এখন ইরানি আকাশসীমার বাইরে এবং নিরাপদে দেশে ফিরছে।'
তিনি আরও বলেন, 'আমাদের "মহান মার্কিন যোদ্ধাদের অভিনন্দন"। এমন অভিযান পৃথিবীর আর কোনো সেনাবাহিনী পরিচালনা করতে পারতো না। এখন শান্তির সময়।'
হোয়াইট হাউসের অফিসিয়াল এক্স আইডি থেকে ট্রাম্পের পোস্টটি গর্বভরে শেয়ারও করা হয়েছে।
আর এরপরই কাতারে খোদ মার্কিন ঘাঁটিতে প্রতিশোধমূলক মিসাইল হামলা চালিয়ে অসম লড়াইয়ে ইরান তার 'হিম্মতের' পরিচয় দিয়েছে।
এতে একদিকে সংঘাত আরও জটিল হয়, অন্যদিকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ট্রাম্পের যুদ্ধবাজ ভাবমূর্তি নিয়ে আবারও প্রশ্ন ওঠে।
পর্যবেক্ষণ বলছে, ইরানের কৌশলী ও সংযত অবস্থান একদিকে তাদের আন্তর্জাতিক সহানুভূতি এনে দিয়েছে, অন্যদিকে মার্কিন নেতৃত্বের বিশ্বাসযোগ্যতা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। একাধিক ইউরোপীয় কূটনীতিক বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছেন, তারা ইরানের শান্তিচেষ্টা স্বাগত জানাচ্ছেন।
এমন প্রেক্ষাপটে ট্রাম্পের ব্যর্থতা কেবল কূটনৈতিক নয়, রাজনৈতিক হিসেবেও মারাত্মক।
মার্কিন জনগণের একাংশ ইতোমধ্যেই প্রশ্ন তুলছেন—এই সংঘাতে যুক্তরাষ্ট্র কেন ইসরায়েলের পক্ষ হয়ে সরাসরি জড়িত হলো? কেন হোয়াইট হাউস শান্তির দূত না হয়ে এক যুদ্ধবাজ রাষ্ট্রনায়কের ভূমিকা নিল? নিউ ইয়র্ক, লস এঞ্জেলসসহ অন্ততঃ ১২টি বড় শহরে ট্রাম্পের যুদ্ধনীতির বিরোধিতা করে বড় বড় প্রতিবাদ মিছিল হয়েছে। খোদ ন্যাটো সম্মেলনের আগে ট্রাম্প বিরোধী বিক্ষোভে হাজারো মানুষ গলা মিলিয়েছেন।
যুদ্ধে জয়-পরাজয় আপেক্ষিক হলেও নৈতিক লড়াইয়ে ইরান এবার বড় একটি অবস্থান দখল করেছে। আর ডোনাল্ড ট্রাম্প তার কৌশলগত সিদ্ধান্ত, অযৌক্তিক জোটপ্রীতি ও একচোখা নীতির কারণে আরেকবার অপদস্থ হয়েছেন বিশ্বমঞ্চে।
সবশেষ তার একতরফা 'যুদ্ধবিরতির' ঘোষণাও হাস্যকর হয়েছে। ইসরায়েল বিনা উস্কানিতে আবারও হামলা চালিয়েছে। আর দুর্বল প্রতিপক্ষ হয়েও লড়াইয়ে জবাব দিয়েছে ইরান।
সবশেষ, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশে দেওয়া এক ভাষণে যুদ্ধে তার দেশের 'ঐতিহাসিক বিজয়' বলে দাবি করেছেন। অপরদিকে, ইরানের প্রেসিডেন্ট বলেছেন, তার দেশের জনগণই '১২ দিনের যুদ্ধের' অবসান ঘটিয়েছে।
এক অর্থে এ পর্যন্ত ইরান এই যুদ্ধে শুধু জয়ী হয়নি, ইসরায়েলের সীমা দেখিয়ে দিয়েছে। এই যুদ্ধ ইসরায়েল ও মার্কিনের বিশ্ব আধিপত্যের প্রায় অকার্যকারিতা যেমন প্রকাশ্য করেছে, তেমনি আগামী দিনের ভৌগোলিক রাজনীতি, অর্থনৈতিক জোট আর সামরিক মিত্রতায়ও বদল আনার আভাস দিচ্ছে।
সবচেয়ে বড় কথা-- 'মুরুব্বি ডেকে' সন্মান বাঁচাতে হবে, এমনটা মনে হয় না যুদ্ধের শুরুতে ইসরাইল কল্পনাও করেছিল। হামাস, হিজবুল্লাহ এবং সিরিয়ায় সাফল্যের পর ইসরায়েল-মার্কিন জোট ইরানেও তাদের 'শাসক বদলের' ইচ্ছা প্রকাশ্যেই বলছিল। এখন তারা অবশ্য সে অবস্থান থেকে পিছিয়ে আসার কথা বলছে।
অন্যদিকে ইরান প্রায় একার প্রস্তুতিতেই প্রতিরোধ করেছে, চীন বা রাশিয়া তাকে সাহায্য করার বাস্তবতায় ছিল না।
দৃশ্যত, ইসরায়েল জেতেনি কিছুই, হারিয়েছে ভবিষ্যৎ, কুড়িয়েছে বিশ্ববাসীর ধিক্কার।
যুদ্ধে দুই পক্ষই বিপুল ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করলেও ইরানের জন্য এটি এক নৈতিক বিজয়। অন্যদিকে, ইসরায়েলের আত্মবিশ্বাসে তারা ধরিয়েছে বিরাট ফাটল।
আর ইসরায়েলের মিত্রপক্ষ টাম্প যেন সেই লোকগানের বেপরোয়া,
'ঘুম ভেঙে বেশ মজা হয়েছে/এঁড়ে গরু বেড়া ভেঙে খেজুর গাছে চড়েছে!'...
_________
(সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ: এটি একটি তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া মাত্র, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের বিশ্লেষণ মাত্রই মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম মোল্লাতন্ত্রের সমর্থন নয়, বরং লেখকের অবিজ্ঞান ও অজ্ঞতার বিরুদ্ধে দীর্ঘ সংগ্রাম আছে।)
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।