‘জানেন, পৃথিবীতে দুই দল লোক আছে, এক দল কবিতা বোঝে, আর এক দল পৃথিবীর বাকি সব কিছু‘ – আলফাজ সাহেব যখন কথাটা বলছিল, মাথাটা স্বাভাবিকের থেকে অতিরিক্ত ঝাঁকিয়ে তাকে পূর্ণ সমর্থন করলো মোরসালিন, ‘হ্যা, সেই-ই। জীবনানন্দ তো বেঁচে থাকতে সমাদর পেলেন না…।‘ স্থান ও সময় জ্ঞান হারিয়ে ভদ্রলোক এবার চেচিয়ে উঠলেন প্রায়, ‘আপনি জীবনানন্দ ভালবাসেন? সে আমারও প্রিয়। এই যে আসছে শুক্রবার তাকে নিয়ে এক সম্মেলন হচ্ছে, সেখানে এই অধমকেও ডেকেছে দু চার কথা বলতে, আসবেন নাকি?‘ ... ...
একটা সময় অবশ্য দীপ প্রেসিডেন্সিয়াল ক্যান্ডিডেইটের ভাষণটার অর্ধেকটা পর্যন্ত চলে এল হাইলাইট আর নোট করতে করতে। তবে সে ড্রইয়িং রুমের শব্দতরঙ্গের তেজ কমে আসার জন্য, না কি তার মস্তিষ্কের শব্দ-শোষণ ক্ষমতা বৃদ্ধির কারণে, তা নিয়ে দীপ হয়ত কিছুক্ষণ ভাবতে পারত; কিন্তু তার আগেই ... ... ...
“‘স্যার, আপনে মালডা ভাল পান নাই। মটরডা ঠিক হইয়া গ্যালে মোটামুটি চলবো। তয় পুরাপুরি ভাল হইব না! লোড এট্রু কম আছে মেইন লাইনে… যখন ইলেকট্রিসিটি আপ ডাউন করে, একটু জিরাইতে দিবেন মেশিনগুলারে! মেশিন হইলে কি হইব, এইগুলোরও জান আছে! আর একটা কতা স্যার, সমস্যা হইলে নিজেরা হাত না নিয়া দিয়া আমাগো ডাকবেন … সার্ভিসিংডা যদি নিয়মিত করাইতে পারেন… এই ধরেন, দুই মাস পর পর …. আশা করি আরো অনেকদিন চালাইতে ….’ লোকটি নিজের পরিচয় দিয়েছিল কিশোর মেকানিকের ওস্তাদ হিসেবে। তাও তাকে কথাটা শেষ করতে দেন না রসিদ সাহেব; কপার পাইপের মধ্য দিয়ে আসা নিয়ন্ত্রিত বায়ুর মত ভাঁজা ভাঁজা একটা স্বর বের হয় তার মধ্যে থেকে, ‘আর কষ্ট করার দরকার নেই। মেশিনই বদলে ফেলব আমি!‘ ... ...
শুভর পুরো শরীরটা যেন বুলেটবিদ্ধ ডলফিনের মত ঝাঁকুনি খেল ক্ষণিকের তরে! দীপের দিকে এক ঝলক তাকিয়ে সে মাথাটা নীচু করে ফেলল, তারপর সেই অবস্থাতেই মৃগী রোগীর মত স্বর বেরুলো তার মধ্য থেকে, “তার মানে… তোর চোখেও পড়েছে …জানিস, ওকে আমি এখনো স্পর্শ করতে পারিনি! ও শুধু একা থাকতে চায়, কাউকে কাছে দেখলেই ওর গায়ে মনে হয় জ্বালা ধরে! ভাবলাম, বৈবাহিক সম্পর্কটা নিয়ে ওর ভীতি আছে, বেড়াতে এলে কেটে যাবে। দ্বীপটিতে ঢোকার পর ওর চোখেমুখে অন্য রকম খুশীর ভাব দেখে মনে হয়েছিল, বরফ গলতে শুরু করেছে। কিন্তু বিশ্বাস কর, সে খুশী ওর নিজের কাছে! ও যেন আমায় আরও ঘেন্না করতে শুরু করেছে! তাছাড়া, আর …আর একটা… ব্যাপার …’ শেষ করতে পারে না শুভ, এদিক ওদিক তাকায় ভয়ে ভয়ে, মনে হয়, কেউ শুনে ফেললে নেমে আসতে পারে রোজ কেয়ামত! ... ...
আরো কিছু কর্মপরিকল্পণা প্রায় চুড়ান্ত করে এনেছে, এমন সময় তার মনে পড়ে গেল, তার হাতে সময় নেই একদমই। তার তো খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ পড়ে আছে সামনে! তাই সে হনহনিয়ে হাঁটতে লাগল আবার সামনের দিকে। তার পায়ের পাতাটায় অবশ্য একটা আজব স্পর্শ-অনুভূতি হচ্ছিল! সে কি কঠিন শিলা, নরম পলি মাটি, না কি জল, বরফ আর মেঘের তুলোর স্পর্শ, তা সে বুঝতে পারছিল না সে। তার মনে হচ্ছিল, এসবের বাইরে একটা কিছু হবে, আর যা বর্ণনার জন্য কোন শব্দ তার ভান্ডারে নেই! ... ...
যে বিপুল বেগে ছিটকে পড়েছিল নীচে, বাঁচার আশা একদম ছিল না। কিন্তু বেশ কিছুটা সময় পর জ্ঞান ফিরে এল তার, একটু একটু করে চোখ খুললো, তখনো ব্যথাটা পুরো বিদায় নেয়নি, নিজের গায়ে চিমটি কাটলো সে… যাদুমাখা সেই জগৎ যা তার মর্মে মর্মে জাগিয়ে তুলেছিল অজানা শিহরন, নিজেকে আবিষ্কার করল তার কুসুম-কোমল পিঠে। মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠেছিল প্রথমে, পরে সামলে নিয়ে চারধার ভাল করে দেখতে শুরু করে সে, খুটিয়ে খুটিয়ে লক্ষ্য করতে থাকে প্রতিটা বস্তু, শেষমেষ আশু বিপদের কোন সংকেত না পেয়ে ফের হাঁটা শুরু করে। ... ...
ধরা যাক, রাস্তার ধারে একটি কৃষ্ণচুড়া আপাদমস্তক সিঁদুর মেখে দাঁড়িয়ে আছে, কোথাও এতটুকু জায়গা ফাঁকা নেই আর। মন্ত্রমুগ্ধের মত তাকিয়ে থাকবে নাইম। ধ্যানমগ্ন মুনীর মত সে চোখ দুটো জড়ো করে জড় হয়ে পড়বে! আবার, কোন অপূর্ব নকশাকাটা দালান, তাও টানবে তাকে জন্মজন্মান্তরের বাঁধন ছাড়িয়ে! বলতে কী, পাতা বা পাথর দুই-ই সমান করে টানে তাকে। কিন্তু এখানেও সে এক দর্শক, তার কাজ যেন শুধু দেখে যাওয়া, আর ভাল লাগা! এভাবেই হয়ত তার ভাল লাগত ফুটফুটে কোন মেয়েকে। সে দেখত আর চলে যেত। কিন্তু একজন জীবন্ত মানবী পাথরের মত নয়; সেখানে জীবন্ত সাড়া থাকে, বিধি বিধান থাকে – আর এসব যেন অজানাই ছিল নাইমের। তাকে কখনো যেচে আলাপ করতে দেখা যায়নি কোন মেয়ের সাথে। অথচ সেও তো একজন জীবন্ত প্রাণী, সেও তো একটি মেয়েকে নিজের করে নেয়ার জন্য যত প্রকার বুজরুকি আছে, প্রয়োগ করতে পারত। কিন্তু নিজে থেকে মন্ত্র পড়া, তাকতুক তো দূরের কথা, কোন মেয়ে তার প্রতি আকৃষ্ট হলেও সেই সংকেত কখনোই পৌঁছুতো না তার বন্দরে। আসলে সে তো একজন দর্শক, সে তো চলচ্চিত্রটি উপভোগ করতে এসেছে, অ্যাক্টিং করতে নয়! ... ...
একটা বিষয় খেয়াল করার মত - মোরসালিন মারুফের মধ্য কেমন যেন সংকোচ, লোকলজ্জার ভয়! আর আছে এক ধরণের সীমাহীন আকুলতা! দিন নেই, রাত নেই, সমানে নক করে যাচ্ছে সম্পাদকের ইনবক্সে। রুম্পার ধারণা, লোকটা যারপরনাই নিঃসঙ্গ। কেউ কি এসেছিল তার জীবনে, আর মিলিয়ে গেছে কোন জানান না দিয়েই? হঠাৎ বিগলিত স্বরে ডেকে উঠলো ফোনটা, নিশ্চয়ই সুব্রত, কোথাও আটকে গেছে…অনেক বড় বড় অফিসিয়াল অ্যাসাইনমেন্ট তার হাজবেন্ডের চওড়া কাঁধে… উঠতে যাচ্ছিল রুম্পা ল্যাপটপ ছেড়ে, কিন্তু পর্দায় কিছু একটা ভেসে উঠতে দেখে থমকে দাঁড়াল, ‘প্রিয় সম্পাদক, ভালবাসা নেবেন। আমার লেখাটা একটুখানি পড়ে দেখার সময় পেয়েছিলেন? যদি বিব্রত করে থাকি…...বিনীত, মোরসালিন মারুফ।’ শুরু হয়ে গেছে ... ... ...
সেই দিন কাজ শেষে রনি এসে দাঁড়ালো আমার সামনে, এক সাথে যাবে বলে। ওর সেই নখগুলো সাঁড়াশির মত খামচে ধরেছিল আমার ডেস্কের উপরের স্টেইনলেস পাতটা! নখগুলো ভীষণ রকমের কাঁটা দিয়ে গেল আমার গায়ে, যেকোন দিনের থেকে ধারালো দেখাচ্ছিল সেগুলোকে, মনে হচ্ছিল মরুভূমির বালিতে শান দিয়ে আনা হয়েছে!। আমি একবারই তাকিয়েছিলাম ওর দিকে, আর টেবিলের উপর গাদা গাদা ফাইলের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে মাথা নেড়ে সাংকেতিক বিদায় জানিয়েছিলাম। এরপর বাক্য ব্যয় না করে সে যখন সিড়ি দিয়ে নেমে যেতে শুরু করল, আমি এক লাফে পশ্চিম দিকের উইন্ডো ওয়ালের ধারে চলে গেলাম। যেদিকটা দিয়ে রনি বেরুবে, তার সাথের রাস্তার ডান ও বাম বাহু বেশ কিছুটা ধরতে পারে এই উইন্ডো। এমনকি গতকাল যেখানে রনির সাথে দ্বিতীয়বার সাক্ষাৎ হয়েছিল, সে জায়গাটাও ছোট করে হলেও মিস্ হওয়ার কথা না! আমি প্রবল উত্তেজনা নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম লাগলাম। ... ...