পোকাটি বিচরন করছিল মনের সুখে বালতির গায়ের উপর দিয়ে, সোঁদা গন্ধ তাকে টেনে নিয়ে এসেছে সেই জন্মস্থান থেকে এতটা দূর, যেখানে সে ভাইবোনদের সাথে খেলে খেলে হাঁপিয়ে উঠেছিল, বাথরুমের জানালাটার পাশের যে ক্ষুদ্র কোটরে সে প্রথম চোখ মেলেছিল, সেখান থেকে সে এক সময় বেরিয়ে পড়ে, হাঁটতে হাঁটতে এসে পড়ে জানালার গ্রিলের উপর, ক্লান্তিতে ঝিম মেরে থাকে কিছুক্ষণ, তারপর শক্তি সঞ্চয় করে আরো খানিকটা এগোয়, এক অপার্থিব আকর্ষনে তার পুরো দেহটা ঝুঁকে পড়ে… ক্ষুদে চোখগুলো দিয়ে নীচের রহস্যভরা জগত দেখতে থাকে তন্ময় হয়ে, একটা নতুন গন্ধ ছেয়ে ফেলে তার দেহ মন, এক বিচিত্র বায়ুর উথাল পাতাল ঘূর্নিতে সে তলিয়ে যেতে থাকে ক্রমশ …
যে বিপুল বেগে ছিটকে পড়েছিল নীচে, বাঁচার আশা একদম ছিল না। কিন্তু বেশ কিছুটা সময় পর জ্ঞান ফিরে এল তার, একটু একটু করে চোখ খুললো, তখনো ব্যথাটা পুরো বিদায় নেয়নি, নিজের গায়ে চিমটি কাটলো সে… যাদুমাখা সেই জগৎ যা তার মর্মে মর্মে জাগিয়ে তুলেছিল অজানা শিহরন, নিজেকে আবিষ্কার করল তার কুসুম-কোমল পিঠে। মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠেছিল প্রথমে, পরে সামলে নিয়ে চারধার ভাল করে দেখতে শুরু করে সে, খুটিয়ে খুটিয়ে লক্ষ্য করতে থাকে প্রতিটা বস্তু, শেষমেষ আশু বিপদের কোন সংকেত না পেয়ে ফের হাঁটা শুরু করে।
সে কিছু দূর পর পর থামছিল আর শুঁকে নিচ্ছিল, ভাবছিল আর কিছুদূর গেলেই পেয়ে যাবে খাদ্যের সন্ধান, জায়গাটা ভিজে ভিজে…কেমন আঁশটে, মিষ্টি মত লাগছিল তার কাছে। আরো কিছুটা যাওয়ার পর সে একটি স্তুপ দেখতে পেয়ে খুশি হয়ে উঠে, গতিবেগ বাড়িয়ে জায়গাটিতে পৌঁছে শুড় দিয়ে প্রাণপণ খুঁটতে থাকে , কিন্তু অচিরেই আবিষ্কার করে সেসব ধুলোই শুধু। জেদ চেপে বসে তার মধ্যে, এরপর ধুলোর ভিতর থেকেই পা দিয়ে কর্ষন করতে থাকে, ঘাম ছুটতে থাকে তার শরীর বেয়ে দরদর করে হঠাৎ তার চোখ গোল হয়ে যায়, ঝুলে পড়ে শুড়… একটা আস্ত দেহ চিড়েচেপ্টে হয়ে পড়ে রয়েছে…বাছা প্রাণটা হারিয়েছে বেশিক্ষণ হয়নি…হাড়মাংসের গন্ধ তাকে মাতাল করে তোলে।
আয়েস করে আহার সেরে ও কিঞ্চিত জিরিয়ে নিয়ে সে ফের উপরে উঠতে থাকে। চারদিকে এত রূপ-রস, রক্তে তুফান নামতে থাকে আবার! কোন এক অজানা দেশ তাকে দুহাত বাড়িয়ে ডাকতে থাকে… হয়ত আর কিছু দূর, মাত্র কয়েক কদম গেলেই মিলবে খাবারের বিশাল কোন ভান্ডার, তাহলে জীবনের মত খাবারের অভাব ঘুচবে তার, সাত পুরুষ বসে বসে খেতে পারবে। আসন্ন সুখের স্বপ্নে সে বিহবল হয়ে পড়ে, ঘুমের ঝাপি ঢেকে দিতে থাকে তার স্নায়ুর সবগুলো দ্বার।
প্রথমে পায়ের কাছে আগুনের একটি মৃদুমন্দ ছ্যাকা অনুভব করেছিল, পরে তা ছড়িয়ে পড়তে থাকে পুরো ভূপৃষ্ঠ জুড়ে, লাভার স্রোত বেরুতে থাকে ফনা তুলে, তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে থাকে, মোলায়েম পশমগুলো খসে পড়তে থাকে, রোমকুপ ভেদ করে আগুন হানা দিতে থাকে তার শরীরের সবখানে। সে ভাবল, এই বুঝি তার মৃত্যু ঘনিয়ে এল, এই বুঝি রুহু কবজ করতে এল যমদূত! ঈশ্বরের নামে জপ করতে করতে সে দাঁতে দাঁত কামড়ে রইল লাগল।
এভাবে অনেকটা সময় কেটে গেল….কিছু একটা হয়ত একটা হয়েছে নির্ঘাৎ, এতটা সময় সে বেঁচে থাকতে পারে না, মায়ের কাছে শুনেছে, আগুন এলে খুব কমই সময় পাওয়া যায়। ছেড়ে দেয়া কলটি দিয়ে জল ছুটছিল চিতার বেগে, নীচের উত্তপ্ত পানির আঁধারকে লক্ষ্য করে। জ্বরে কাঁপছিল স্ফুটনাংকের সীমা ছাড়ানো সেই জলকুপ, কিন্তু কল তার গর্ভ থেকে সব জল বের করে দিতে প্রস্তুত ছিল, শিশু গ্রহের সব উত্তাপ সেঁচে নিতে সে মরিয়া। আস্তে আস্তে পৃথিবী শীতল হলে পর পোকাটি নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখল। কিন্তু তাও ঘাপটি মেরে রইল বেশ কিছুটা ক্ষণ, হয়ত কোন আফটার শকের অপেক্ষা। ‘নাহ, আর কিছু ঘটবে না, এই যাত্রা বুঝি বেঁচেই গেলাম’- ভাবল পোকাটি…. এরপর সে আবার বেরিয়ে পড়ল, অপরূপ এই পৃথিবীর পিঠে চড়ে চড়ে বেড়াতে লাগলো, কি এক অচেনা আনন্দে সে গাইতে আরম্ভ করল, নাচতে শুরু করল…’হারে রে রে রে রে , আমায় ছেড়ে দেরে দেরে ….’
বেশ কিছুক্ষন বিরতি দিয়ে আরো একজন আসে বাথরুমটিতে, আবার পুরো ব্যাপারটা শুরু হবে - ভূ-অভ্যন্তরে হঠাৎ ভীষন গোলমাল, আগুন, ঝর্না, ঝপ ঝপ, সপ সপ, তা ধিন তা … সে জানে আগে থেকেই, এমন হবে, তাই সে আর ভয় পায় না , বরং সুত্রগুলো মিলিয়ে নিতে থাকে মনে মনে। কিন্তু যে এসেছিল, পকেট ভর্তি ছিল তার বরফকুচিতে, ক্ষনিকের মধ্যে প্রবল তুষার ঝড় গ্রাস করে ফেলল চতুর্দিক, পোকাটা কনকনে শীতে কাঁপতে কাঁপতে অচেতন হয়ে পড়ে। জ্ঞান ফিরলে পরে সে আবারো চিমটি কাটে, ‘যা ঘটছে সব সত্যি তো?’ সে বুঝে আগুন থেকে পিঠ বাচানোটাই যথেষ্ট নয়, তার কাছ থেকে কিছু উত্তাপও সংগ্রহ করে নেয়া দরকার।
তার মন বলছিল এরপর আগুন আসবেই। হলও তাই। বালতিতে যখন গরম পানি ঢালা হল, সাহসের সাথে তাকে মোকাবেলা করল সে… সঞ্চয় করতে শুরু করলো সেই উত্তাপ তার দেহের কোষ্ঠে কোষ্ঠে। কিন্তু পর্বটি সমাপ্ত হওয়ার আগেই ভূপৃষ্ঠ হঠাৎ করেই ভয়ংকর দুলে উঠল, আর পোকাটির আত্মাশুদ্ধ নড়ে উঠল। কে যেন তার পায়ের নীচের মাটিকে একটা প্রবল ঘুটুনি দিয়েছে! পোকাটা প্রাণপণ চেষ্টায় ভূত্বকের কিনার ধরে ঝুলে রইল। প্রতিটা কম্প্নে তার মনে হচ্ছিল, এই বুঝি সে চূর্ণ বিচূর্ন হয়ে মহাশূন্যের ধূলোয় মিশে যাচ্ছে।
এক সময় পাগলটা মনে হয় কিছুটা শান্ত হল, আর পোকাটা বিভিন্ন ইশারা ইংগিতে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানাতে লাগল। কিন্তু বিধিবাম! কিছুক্ষণ বিরতি দিয়ে আবার শুরু হল সেই কম্পন, আগের থেকেও তীব্র ছিল এর মাত্রা। এবার বুঝি আর রক্ষা নেই, পোকাটা ভাবল। কিন্তু তার ভুত্বক তাকে ভীষন করে আগলে রাখল, সে পুনরায় সুস্থির হল, দিগন্তে ভেসে উঠল আশার এক চিলতে চিকন রেখা। কিন্তু মাত্রই ক্ষণিকের তরে….পোকাটির উপর এরপর জলের ফোঁটা পড়তে শুরু করল, প্রথম দু একটা, পরে অযুত-নিযুত সংখ্যায় ….
মোরসালিন ছাদের তারে ধোয়া কাপড়গুলি মেলে দিয়ে আবার সিড়ি বেয়ে নীচে নেমে এল, কল ছেড়ে দিয়ে আগাপাছতলা ধুয়ে নিয়ে বালতিটা যথাস্থানে রেখে ঘরে ফিরল।
এরপর বালতিটা ঝিমিয়ে পড়ল, সারাদিন যা খাটুনি গেছে, ওদিকে পোকাটা ভূপৃষ্ঠে একটা চাটাই বিছিয়ে তাতে নিজের পিঠকেও গুজে দিয়েছে ….চোখ উপরে তোলা, রাতের আকাশ তারায় ভরে উঠেছে!
……
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।