এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  গপ্পো

  • নেক

    মোহাম্মদ কাজী মামুন লেখকের গ্রাহক হোন
    গপ্পো | ১৫ নভেম্বর ২০২৪ | ২৯ বার পঠিত
  • একটি সৎ, পরিশ্রমী আর অনুগত ছেলে চেয়েছিলাম আমি। যে চলে গিয়েছিল, তার মধ্যে স্পষ্টতই এগুলোর অভাব ছিল। ওদিকে আমার সামনে পোস্টিং অর্ডার নিয়ে দাঁড়িয়েছিল যে হ্যাংলা-পাতলা ছেলেটি, সেও কোনভাবেই আস্থা কুড়োতে পারল না আমার। ও যে কাজগুলি করবে, তা এমনিতে গুরুত্বহীন মনে হতে পারে; কিন্তু কোন ভুলটুল হয়ে গেলে বড় খেসারত গুণতে হতে পারে কোম্পানিকে এবং একই সাথে আমাকেও!     

    ‘স্যার, আমারে দিতে পারেন…যেমনে যেমনে কইবেন, সেই মতনই পৌঁছাইয়া দিমু।‘  ওর বাচনভঙ্গিটাও পরিষ্কার ছিল না; সেখানে কেমন একটি খসখসে টান; শব্দ-বিরতিগুলো আকস্মিক আর অনুমানযোগ্যতাহীন। পুরনো পিয়ন জামিল খবরটা দিতেই ডেকে পাঠিয়েছিলাম ওকে।  একটা হাত ওর পুরোই অকেজো, তাও বাইরে বেরুনোর আবদার ধরেছে -  ওদের জগতে মর্যাদাপূর্ণ বলে বিবেচিত ডকুমেন্ট আনা নেয়ার কাজটি করতে চাইছে!

    ওর নাম ছিল সুখন। আর সে যে একজন পরহেজগার মুসলিম, কদিনেই তার পরিষ্কার ধারণা পেয়ে গিয়েছিলাম আমরা। আযান হওয়া মাত্রই সে প্যান্টের নীচটা টাকনুর উপর বটে ফেলত, আর মাথার উপর গলিয়ে দিত একটা নিখুঁত রকমের গোলাকার  ও জরিপেড়ে খয়েরী টুপি। তবে শুধু নামাযের সময় নয়, অন্য সব পর্বেও সে ছিল এক অক্লান্ত ঘোড়া, ছোটাতেই যার সুখ! যখন বিধিবদ্ধ কাজ ফুরিয়ে যেত, তখন সে চেয়েচিন্তে কাজ জুটিয়ে নিত অফিসের স্যার ও ম্যাডামদের ডেস্কে ডেস্কে ঘুরে; আবার তাদের  অন্যায্য বকা খেয়েও  সে হাসিটা যেভাবে ধরে রাখত ঠোঁটের কিনারে, তাতে মনে হতেই পারত, তার মধ্যে ভর করেছে অপূর্ব এক মহাকর্ষ বল! পানকৌড়ির গলার মত একখানি গলা ছিল ওর। আর মুখটা ছিল গড়পড়তা মাপের থেকেও কিছুটা লম্বা। মুখের গর্ভে মুহুর্মুহুঃ আন্দোলিত হত যে এনামেল প্লেটগুলো, তাও সাধারণের থেকে উল্লম্ব আর চকচকে ছিল!

    অথচ এমন অসাধারণ সব বৈশিষ্ট্য ধারণ করেও সে সাধারণের কাছ থেকে ‘একটা নুলো’ ছাড়া আলাদা কোন খেতাব জোটাতে পারেনি।  এই সুখনের বিরুদ্ধে অচিরেই অভিযোগ আসতে শুরু করল। ঐ নুলো হাত দিয়ে কাউকে মারধোর করতে পারে, বিশ্বাস হতে না চাইলেও ডেকে পাঠাই আমি তাকে। কিন্তু সে বরাবরের মতই মাথাখানি ভূত্বকে স্থির রেখে, যেন কেউ শুনতে না পায় এমন একটা ভঙ্গিতে জানাল, “আপনি আমারে পছন্দ করেন, এইডা হেগো সহ্য না!“

    আমি অফিসে কখনোই কাউকে পছন্দ করিনি; সে যদি সুখন বা তার প্রতিদ্বন্দ্বীরা অমনটা বিশ্বাস করে থাকেও, তাতে কিছু আসে যায় না আমার! আমি তো শুধু কাজকে ভালবাসি, আর যে কাজ করে, তার আচরণ কিছুটা এদিক-সেদিক হলেও মেনে নেই আমি। আর তাইতো দু’চারটে সতর্কবাণী উচ্চারণ করে ছেড়ে দিয়েছিলাম তাকে আর পিয়নের মর্যাদাপূর্ণ কাজেও নিযুক্ত করেছিলাম! কিন্তু সে-ই একদিন পাক্কা তিনদিন ছুটি চেয়ে মেজাজটা বিগড়ে দিল আমার।  

    ‘এই না মাস দুয়েক আগে ছুটি কাটিয়ে এলে?’ প্রশ্নটা করার সময় আমার কুঁচকে থাকা ভ্রুটা সোজা হওয়ার জন্য সংগ্রাম করতে লাগল।

    ‘আফনে না দিলে লমু না। তয় ছুটিডা না দিলে আমার বিশাল ক্ষতি হইয়া যাইব, স্যার! বছরের এই টাইমডায় ক্ষেতিডা করলে বাড়তি কিছু ইনকাম হয়!’ বলেই সে আবার ভূমিমুখি হয়।
    ‘নিজের ক্ষতি দেখলেই হবে? প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি দেখার কোন দরকার নাই?’

    ‘আফনে না দিলে করনের কিছু নাই, স্যার! আমারে নানা টাইমে যে উপকারডা করছেন, সারা জীবনেও শুধতে পারমু না!’ 

    ‘এই শেষবারের মত বলতেছি, আবার যদি পাম দেয়ার চেষ্টা কর, তাইলে লগে লগে চাকরি শ্যাষ! আর ছুটি যদি নিতেই হয়, দুইদিনের বেশী এক সেকেন্ড না!’ কথাগুলো বলার পর আমি হাঁপাতে থাকি আর উপসর্গটা বেছে বেছে শুধু এই  সময়গুলিতেই হয়!

    প্রার্থিত ছুটি কমানোই নিয়ম, এমনকি বিধাতাও তার বান্দাকে চাহিদামাফিক অবকাশ মঞ্জুর করেন না। তবে কর্তিত ছুটি কাটিয়ে যখন আগের থেকেও থলথলে হাসির মেদ নিয়ে ফিরে এল সে, বোঝা যায়নি যে, মাসখানেকর মধ্যেই  আবার ছুটির দরখাস্ত নিয়ে দাঁড়াতে যাচ্ছে সে।

    ‘আমার মনে হয়, বোধ-বুদ্ধি সব গুলে খেয়ে ফেলেছ তুমি!’ একটা বিষ্ময় আমায় এমনভাবে আবিষ্ট করে যে রেগে উঠতেও ভুলে যাই।

    ‘স্যার, সব কিছু আপনার মর্জি! আপনি না দিলে লমু না!... তয় গত রাইতে একটা খবর আইল বাড়ি থনে..’ ওর কণ্ঠে  সেই ‘নাকি’ সুরটা ফিরে আসে, আর  একটি বেসুরো গানকে  জোর করে শোনার মত ওর কথা শোনাকেও অত্যাচার মনে হতে থাকে আমার!   

    ‘ঐসব খবর অন্য কারো শোনাও। পরিষ্কার বুঝতে পারতেছি, চাকরির প্রতি আর কোন মায়া নাই তোমার!’ যদি সত্যিই বাড়াবাড়ি করে, সেক্ষেত্রে ওকে ছাঁটাই করার পর সামনে কিভাবে চলবে, কয়দিন লাগবে নতুন লোক পেতে, তা নিয়ে ভাবতে শুরু করে দেই আমি।

    ‘স্যার, যমজ পোলা দুইডারে এক নজর দেইখাই চইলা আমু। খালি একটা দিন, স্যার….’ কথাটা যখন বলছিল, ফ্যাসফেসে স্বরটা ওর ভেতরের আর্তিটাকে পুরো চেপে রাখছিল। কিন্তু সেদিকে কোন খেয়াল ছিল না আমার; বিষ্মিত নেত্রে তাকিয়ে ছিলাম ওর দিকে! ঠিক শুনলাম তো! যমজ! এই বেঢপ, নুলো আর নাকাটার ঘরে দুই-দুইটা মানবশিশু!  

    সুখন সেবার ছুটি থেকে ফেরার সময় প্রায় আধমন মিষ্টি আর দই নিয়ে এসেছিল। কিন্তু আমার তো মিষ্টির সাথে বিচ্ছেদ ঘটেছে দুই বছর হল। খবর শুনে ছুটে এল সুখন।  

    ‘স্যার, আমাদের রাজু ঘোষের নিজ হাতে তৈরী! যারাই একবার মুখে দিছে, সারা জীবনেও ভুলতে পারে নাই!’ নিজের মুসলমানিত্ব নিয়ে সর্বদা বড়াই করলেও হিন্দুর হাতে মিষ্টিতে সমস্যা নেই সুখনের! কিন্তু সে নিয়ে ভাবছিলাম না আমি। আমার মাথায় তখন অন্য চিন্তা। এই যে এত টাকা খরচ করে এল, ভবিষ্যতে চলবে কেমন করে?  যে রোজগার, তাতে একজনের চলাই কষ্ট! সামনে নিশ্চিত ধার-কর্জ করার অভিপ্রায় করবে সুখন!

    বলতে কী, একটা নিশ্চিত ধ্বংসের প্রতীক্ষা করছিলাম যেন আমি! কিন্তু সুখনকে কোন ঋণের দরখাস্ত জমা দিতে দেখা গেল না আমার টেবিলে। উল্টো অফিসে তার কাজের মনযোগ ও গতি দুই-ই লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে লাগল।  আর এরই মাঝে একদিন বদলী আদেশ চলে এল আমার।

    ‘স্যার, আমার বিষয়টা?’

    আমার আর দিন তিনেক ছিল এই অফিসটাতে; শেষ পর্যন্ত গুছিয়ে উঠতে পারব কিনা, তা নিয়ে টেনশানে ছিলাম; অথচ এই অপসৃয়মান সময়ে  তৃতীয়বারের মত হাজির হয়েছে সে আমার সামনে! তারও একটা বদলি চাই, আর তা আমার সাথেই, আমার নতুন কর্মস্থলে! আমি যাওয়ার সময় যতটা সম্ভব সদ্ভাব রাখতে চাইছিলাম সবার সাথে, তাই তাকে জানিয়েছিলাম - উপরে বলে দেখব কিছু করা যায় কিনা! কিন্তু তা-ই অক্ষরে অক্ষরে বিশ্বাস করে নেবে সুখন, একদমই কে ভেবেছিল!

    ‘না, তুমি এখানেই থাক। পরে সময় সুযোগ হলে দেখবোনে।‘ বলে আমি ল্যাপটপের ফাইলগুলি ডিলিট করতে শুরু করে দিয়েছিলাম। এগুলো একান্তই আমার ব্যক্তিগত। এই অফিসটাতে রেখে যাওয়ার মানে হয় না।  

    ‘স্যার, আফনে যা করছেন, ভুলতে পারমু না জীবনে! তয় যদি কোন বেয়াদবি কইরা থাকি, মাফ কইরা দিয়েন।‘ আবার সেই নাকি কণ্ঠে শব্দের মেঘ, এমন ধোঁয়াটে যে বোঝা যায় না কিছু!
    এরপর প্রায় মাস তিনেক পার হয়ে গিয়েছিল। একটি করে ঘন্টা, মিনিট আর সেকেন্ড এগুচ্ছিল, আর নতুন সব ছবি দখলে নিয়ে নিচ্ছিল আমার পৃথিবীটাকে, পুরনোদের হটিয়ে দিয়ে।
    ‘স্যার, আসতে পারি?’  

    নতুন বিজনেস প্লানটাতে পুরো ডুবে গিয়েছিলাম, তাই ভূত দেখার মতই চমকে উঠি আমি! সুখন আমার চেম্বারের কোনাকে আলো করে রাখা কাঁচের স্তম্ভটা ঘেঁষে দাঁড়িয়েছিল; আর ওর সেই ‘নুলো’ হাতটাতে একটা কিছু শোভা পাচ্ছিল। দ্বিতীয়বার চোখটা নিক্ষেপ করে সেখানে একটা গ্যালন আবিষ্কার করতে সক্ষম হলাম; যতদূর দেখে মনে হচ্ছে, ভেতরে দুধ ভর্তি।

    ‘আরে! কিভাবে এলে? কেমন আছে?’ প্রাথমিক ধাক্কা কেটে যাওয়ার পর আমি নিরাসক্ত কণ্ঠে বলি। এদ্দিন বাদে এসেছে এত দূর থেকে; একটুখানি সময় সুখনের অবশ্যই প্রাপ্য হয়েছে! আর একটু ভাল ব্যবহার!  

    ‘স্যার, অফিসের একটা কাজে আইছিলাম। তয় ভাবলাম, আপনের লগে দেখা কইরা যাই। আর আমার বাড়ির গাইয়ের দুধটাও দিয়া যাই।‘

    আমি অনেক কষ্টে নিঃশ্বাসটা চাপা দেই। এই ব্যাপারগুলি কি পৃথিবীতে শেষদিন পর্যন্ত চলতে থাকবে? ওর কেন খরচ করে আমার জন্য এতদূর থেকে দুধ বয়ে আনতে হবে? তাও তো আমি আর ওর বস্‌  নই এখন!

    ‘বাহ, তোমার নিজের গাই বুঝি! খুব খুশি হলাম, সুখন।‘ এই বলে যেই আমি মানিব্যাগে হাত দিয়েছি, সে প্রায় আর্তচিৎকার করে উঠে!

    ‘স্যার, এইডা আমার বউবাচ্চার পক্ষ থাইকা আফনের লাইগা উপহার। কষ্ট পাইব হুনলে!’ মরাকান্না ধরেছিল সে,তাই মানিব্যগটা জায়গামত রাখতেই হয় আমায় তাকে থামাতে!

    উপহারটা বাসায় নিয়ে গিয়েছিলাম যতটুকু মনে পড়ছে। তবে দুধের কোয়ালিটি সেইরকমই কিনা যার জন্য আমার মত নাগরিক-মানুষের মনে আহলাদের ঢেউ উঠে – তা নিয়ে ভাবার সত্যি সময় ছিল না! কারণ নতুন অফিসে আমায় সব কিছু নতুন করে চিনতে হচ্ছিল, আর মনেও রেখে দিতে হচ্ছিল। নতুন জায়গার সব থেকে বড় চ্যালেঞ্জ হল, গ্রাহকেরা প্রতিনিয়ত পুরনোদের সাথে তুলনা করতে থাকে। এমন নয় যে, পুরনো মানুষটিও সব সময় তাদের প্রত্যাশা শতভাগ পূরণ করতে পেরেছে। কিন্তু নতুনদের বেলায় প্রত্যাশার সামান্যতম হেরফের হলেও যেন রক্ষে নেই, নির্ঘাত বেঁধে যাবে কুরুক্ষেত্র!  

    এরই মাঝে একদিন যখন সুখনের নাম্বারটা রকেটের মত ধেয়ে এসে ভেসে উঠল আমার স্মার্ট মনিটরে, অস্বীকার করব না যে ভীষণ বিরক্তিতে ছেয়ে গিয়েছিল মনটা! ফোনটা রিসিভ না করায় আরো কয়েকবার ফোন টিউনের উপর্যুপরি আঘাত বরাদ্দ হল আমার জন্য। একটা প্রবল হতাশা থেকে হাতের কাজ ফেলে রেখে দুহাতের খোলে মুখটা ঢাকতে যাচ্ছিলাম; হঠাৎ বাসা থেকে ফোন এল, একটি ছেলে না কি বাসার সদর দরজায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। পোশাক, আর শরীরের যে টুকরো বর্ণনা ফোনের ওপার থেকে ভেসে এল, তাতে আমি নিশ্চিত হলাম ছেলেটি কে।  তারপর যখন আমায় জানানো হল, ছেলেটির হাতে পোরা রয়েছে দশ কেজি দুধ আর পাঁচ কেজি সরিষার তেল, চোখ-মুখ পুরোই শুকিয়ে গেল আমার!

    ‘একটা ফুল স্কেল স্টুপিড!’ আমার মনের মধ্যে এই গালিটার সঙ্গে  ‘চলে যেতে বল’ বা, ‘দরজা বন্ধ করে দাও মুখের উপর’ ইত্যকার সম্ভাব্য সংলাপ জুড়তে জুড়তে ভেঙে গেল, আর শেষমেশ ঠোঁটজোড়াকে ভীষণ গতিতে ধাক্কা মেরে বের হল  ‘দামটা দিয়ে জিনিসগুলো রেখে দাও।‘  এরপর সেদিন রাতের ডাইনিং টেবিলে একটা পারিবারিক ঐকমত্যেও পৌঁছুনো সম্ভব হল  - সুখনটাকে নিষেধ করে দিতে হবে কড়া করে, এমন যেন আর না করে!

    কিন্তু কাগুজে সিদ্ধান্তের মত এর কোন আইনি তাৎপর্য ছিল না; মৌখিক এ নীতিগুলো মুখে মুখেই ভেঙে পড়ত আর পুনরায় গড়ত। ঐ ঘটনাটার পরে আরো অনেকবারই সুখন এসেছে আমার বাসায়; দুধটা, সরিষার তেলটার সাথে প্রতিবারই আরও কিছু যুক্ত করেছে সে; তারপর গাট্রি-বস্তা নামিয়ে দিয়ে টাকা নিয়ে চলে গেছে।  পণ্যে ‘ভ্যারাইটিস’ নীতিকে অবলম্বন করলেও বিক্রয় বিরতিতে সে একটা একতা ধরে রাখত। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছিল যে, তিন মাসের বাঁধা সীমাটা পার হয়ে গেলে আমার মধ্যেও  একটা অপেক্ষা জেগে উঠত; মনে হত সুখনের পণ্যসম্ভারে স্নাত না হলে আমার চলবে না কিছুতেই!

    একবার এমন হল যে অপেক্ষার প্রহর পাঁচ মাসে গিয়ে ঠেকল,  তাও সুখনের দেখা নেই! এমন নয় যে, তার সাথে যোগাযোগ করা যেত না এই মুঠোফোনের দুনিয়ায়। কিন্তু কিছু পণ্যের জন্য ওকে ফোন দেব ভাবতেই গা’টা শির শির করে উঠত আমার।

    প্রায় বছরখানেক বাদে একদিন সুখনের ফোন অবশ্য বেজে উঠল! হুড়ুমুড় করে ধরা ফোনটা অবশ্য অচিরেই খুব ভারী বোধ হতে লাগল! ওর বউটা না কি অনেকদিন ধরেই একটা জটিল সমস্যার কথা বলে যাচ্ছিল আপনজনদের - কেমন যেন শূন্য শূন্য লাগে, আর মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠে! অনেক ডাক্তার-বৈদ্য দেখানো হয়েছিল; কিন্তু চক্করটা শুধু আরো বেশী সময় নিয়ে আরো বেশী করে হামলে পড়ছিল! নিরুপায় হয়ে সুখন এক সময় ইস্তফা দেয় চাকুরিতে।  তিন-তিনটে  শিশু সন্তানের তাকিয়ে নিজের এক ফোঁটা জমিতে ক্ষেতি করতে লেগে গিয়েছিল সে,  কিন্তু সেখানেও একের পর এক লস! তবে এত কিছুর মধ্যেও এক পশলা বাতাস বইয়ে দিয়েছে যে ঘটনাটা তার বাড়িতে সম্প্রতি, তা হল, তার গাভীটা বিইয়েছে আর দুধ দিতেও শুরু করেছে!
    ‘কিন্তু সুখন, আমার তো আর দুধের দরকার নেই।‘ বেরিয়ে আসতে চাওয়া দীর্ঘশ্বাসটাকে প্রাণপণে রুখতে চেষ্টা করি আমি।

     ‘মিছা কমু না, স্যার, যত্ন নিতে পারি নাই গাইডার! তয় কইতে পারি, আমার থিকা ভাল দুধ আর কোনহানে পাইবেন না, স্যার।‘ কেমন একটা বেপরোয়া সুর সুখনের কণ্ঠে!  

    ‘আমায় দুধের জন্য কোথাও যেতে হয় না, সুখন! আমার নতুন যে অফিসটা তার সাথেই রয়েছে একটি বেশ উন্নত মানের খামার…’

    ‘ও.. স্যার… আবার বদলি হইছেন!’ কাঁপা কাঁপা কথাটা বলার সময় খুব বিমর্ষ দেখায় তাকে। তারপর একটা কিছু যেন মনে পড়েছে এমন ভঙ্গিতে বলে, ‘আচ্ছা স্যার… তাইলে …সরিষার তৈলডা… একদম খাঁটি …’

    ‘না, না, তারও আর দরকার নাই! এখানে সরিষার মিলও আছে একাধিক’ এক নিঃশ্বাসে বেরিয়ে পড়ে শব্দগুলো আমার মধ্য থেকে।

    এরপর আর কথা এগোয়নি সেদিন। দোয়া চেয়ে ফোনটা রেখে দেয় সে। কিন্তু তারপর থেকেই বুকের মধ্যে কিছু একটা দলা পাকাতে পাকাতে অসুস্থ করে দিতে থাকে আমায়। রাতে বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করতে করতে আবারো একটা পারিবারিক ঐকমত্যে পৌঁছুনো সম্ভব হয়- এবার সুখনের হাতে কিছু টাকা গুঁজে দেয়া হবে, আর তা ওর দেয়া পণ্যের মূল্য থেকে বেশী হবে অবশ্যই!  

    পরদিন সিদ্ধান্তটা জানানোর জন্য হ্যালো করতেই ওপাশ থেকে চকচক করে উঠে সুখনের কণ্ঠটা, ‘স্যার, ভাল আছেন? আমার মন কইতেছিল আফনের ফোন আইব!’ আমি নিশ্চিত, সে ধরে নিয়েছে যে, মতটা বদলেছি আমি আর অর্ডারটা শেষ পর্যন্ত করেই দেব।  

    ‘শোন, অন্য একটা বিষয়ে ফোন দিচ্ছিলাম আমি..’ তরতর করে বলে উঠি আমি।

    সে চুপ থাকে; আর সেই নীরবতা এত গভীর যে, তার তীব্রতা ফোনের এপ্রান্ত থেকেও আমায় ঘা মারতে থাকে!  

    ‘দেখ, আমি তোমার জন্য একটা ব্যবস্থা করেছি। তোমার একাউন্ট নাম্বারটা দাও …প্রতি মাসে…’

    ‘না, না, স্যার…’

    ‘না কেন?’ আমি হতবাক কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করি।

    ‘স্যার, এমনে টাকা নিলে নেক হইব না। তয় জানি, আফনে খুব মায়া করেন আমারে! কই কী, আমার কাছ থোন মাল লইয়া টাকা দেন, স্যার। খুব উপকার হইব…স্যার!‘ আমি ধাক্কা খেলাম না তড়িতাহত হলাম, ঠিক বলতে পারব না। কিন্তু আর বিদায়টুকুও না নিয়ে ফোনটা রেখে দিয়েছিলাম মনে আছে।

    এরপর বিষয়টা নিয়ে অনেক ভেবেছি আমি; কিন্তু ‘নেক’ শব্দটা অধরা থেকে গেছে বলে সুখনের কাছ থেকে মাল নেয়া বা ওকে টাকা দেয়া – কোনটাই আর সম্ভব হয়নি আমার পক্ষে!  
     
    (সমাপ্ত)
    ………………………………………………………………………………………………………….
     

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • গপ্পো | ১৫ নভেম্বর ২০২৪ | ২৯ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা খুশি প্রতিক্রিয়া দিন