পয়লা বৈশাখের সকাল। sskm এর হেড অ্যান্ড নেক সার্জারির ফিমেল ওয়ার্ডের সবাই সকালের খাবার নিতে জমায়েত করে দাঁড়িয়ে। ঠাট্টা তামাশা, গল্প গুজব চলছে। বিষয় - gst। উঁচু গলায় হাসতে হাসতে একজন বললো, - নে নে এবার থেকে জলেও gst দিবি। ফেসবুকে শহুরে শিক্ষিত বাঙালি সেদিন বিচার বিশ্লেষন করছিল, পয়লা বৈশাখ কি আসলে পহেলা বৈশাখ? ওই প্রশ্নের ওপর বাঙালি জাতি সত্ত্বা নির্ভর করেছিল কিনা, তাই জন্য!
শহরের কেন্দ্রে থাকা সবথেকে সেরা সরকারি হাসপাতালগুলোর একটা sskm। এখানে ভর্তি হতে আসে বহু দূর গ্রাম, গঞ্জ থেকে। শহর শুধু বিশাল এই হাসপাতালের অস্তিত্ব জানে। তার ভেতরের মানুষদের চেনে না। এখানে যারা ভর্তি তাদের যদি বাড়ি কাছে হয়, তাহলে তা আন্দুল। আর দূরে হলে - সাগর। শহরবাসী কি সাগরে কি যায়? দীঘা, মন্দারমনি নয়, সেই যেখানে হিন্দুদের প্রিয় সাগরমেলা বসে, সেই সাগরে?
এ বছর চৈত্রের শুরু থেকেই ঝলসে দেওয়া শুকনো গরম। সেই গরমে sskm এর এক একটা লাইনে তিন ঘন্টা দাঁড়িয়ে নারী পুরুষ। মেয়েরা এখানে সংখ্যাগুরু। সংসারের যাবতীয় কাজ ভোর রাতে উঠে সামলে তারা চলে আসে। কখনো নিজের জন্য, কখনো সন্তানের জন্য। এমনকি এমন মেয়ের দেখা পেয়েছি যে sskm চেনে হাতের তালুর মত আর তার হাত ধরে প্রথমবারের জন্য ডাক্তার দেখাতে এসেছে তার স্বামী। মেয়েরা না কি রাস্তা পেরোতে পারে না?
ওয়ার্ডে সময় চলে মন্থর আলস্যে। সন্ধ্যেয় ওয়ার্ডের একটা অংশে আসর বসেছে। মধ্যমণি যে তার গলার সার্জারি দুদিন পড়ে। হঠাৎ আবিষ্কার হয়েছে তার বাম হাতটি ভাঙ্গা। সে নিজে অবিশ্যি টের পায়নি যে হাত ভেঙে গেছে। এক্স রে ভিউয়ার আমার বেডের সামনে। দু টুকরো হয়ে যাওয়া হাড়ের প্লেট আর ভাঙ্গা-হাতের হাসি-মুখের মালকিনকে পর্যায়ক্রমে বার কয়েক দেখে, ভাবার চেষ্টা বন্ধ করতে হয়েছিল। ডাক্তাররা চলে গেলে, সমবেত হইহই প্রশ্নে লাজুক মুখের বউটি বললে, আল্লার দোয়া, সব কটা রোজা রেখেছিলাম তো! স্রোতের মত কথা গড়াতে গড়াতে একজন বলে ওঠে, - "খিদিরপুরে কত যে জবাই হয়, সে কি রক্ত"!সোৎসাহে আরেকজন বলে, - "হ্যাঁ হ্যাঁ, আমাদের গ্রামেও তো। কালী পুজোয়।" ফোন হাতড়ে যত্নে তোলা অস্পষ্ট ভিডিও খুঁজে দেখায় সে।
আমার পাশের বেডের মেয়েটির বাড়ি মসলন্দপুর। বৈশাখের দাবদাহের মধ্যে সারা দিন টসটসে ঘেমে, বিছানায় গড়িয়ে কাটে গলায় ব্যান্ডেজ মোড়ানো আমাদের দুজনের। রাত নামলে তাপমাত্রা সহনীয় হয়। আলো নিভে গেলে আমরা দুজন টুকরো গল্প করি। উদ্বাস্তু পরিবারের মেয়ে সে। বড় শক্ত লড়াই তাদের। বাবা মরে গেছে অল্প বয়সে খাটতে খাটতে। বাবাকে প্রায় না চেনা মেয়ে, দুই দাদার আদরের বোন, এক ছেলের মা কলকলিয়ে গল্প বলে চলে। বাংলাদেশে তাদের আত্মীয়দের বাড়ির গল্প। নিজেদের পুরনো বাড়িতে তার দাদাদের যাওয়ার গল্প। সেখানে আতিথেয়তা, মুসলমান বাড়িতে হিন্দু বাড়ির ছেলে খাবে না, সেই অদ্ভুত পরিস্থিতির গল্প। এক সপ্তাহ ছেলেকে না দেখা মা এর গলা বুজে আসে। ফোন খুলে ছবি দেখায় গোপাল সাজে ছেলের। উদ্বাস্তু মেয়ে, পায়ের তলায় জমি খুঁজতে চেষ্টা করা মা হঠাৎ বলে ওঠে, "জানো তো, একটা যুদ্ধ একটা মুহূর্তে সব শেষ করে দেয়। শুনেছি এখনো হচ্ছে দুটো জায়গায়। কত বাড়ি, কত সংসার এমন এক মুহুর্তে রাস্তায় এসে দাঁড়াচ্ছে"। কিলবিলে প্রশ্ন চাপতে পারি না। জিজ্ঞেস করি, "তোমার রাগ হয় না? এত কষ্ট, মুসলমানদের জন্য.."। অবাক হয়ে তাকিয়ে হেসে ওঠে উদ্বাস্তু মেয়ে। "তাই আবার হয়? মুসলমানের ওপর রাগ কেন হবে গো! তাহলে বলি শোনো.."।
সেই আখ্যান থাক। আমি সেদিন মন প্রাণ ভরে জেনেছিলাম প্রকৃতি-বিচ্ছিন্ন, প্রতিবেশী-বিচ্ছিন্ন, ঘৃণাকাতর যাপনের ঠিক উল্টো পথের এক পথিকের কথা।
দুই মা। একজনের বাড়ি হুগলির গ্রামে, দ্বিতীয়জন বসিরহাটের। দুজনেরই মেয়ের সার্জারি। সেদিনও সান্ধ্য আলাপ চলছে। মেয়েদের এটা সেটা গল্প। সার্জারির আগে সব গয়না খুলে দিতে হয়েছে। বিবাহিত মেয়েদের বহুদিন পর হাত দুটো বড়ই হালকা, মন ভারী - পাছে স্বামীর কিছু হয়। বসিরহাটের বউটি নির্বিকারে বলে উঠলো, ধুর ওতে কিছু হয় না, না পরলে বাড়িতে ঝামেলা শুধু। হুগলির বউটিও ঘাড় নেড়ে সায় দেয় সঙ্গে সঙ্গে। আমার দিকে তাকিয়ে একজন জিজ্ঞেস করে, - সঙ্গে ওটা বুঝি তোমার বর ছিল? প্রেম করে বিয়ে? আরেকজন বলে, - আজকাল প্রেমের বিয়ে, দেখা শোনার বিয়ে কোথাওই শান্তি নেই গো।
হুগলির বউটি মেয়ের ওষুধের ড্রিপ সোজা করতে করতে শান্ত এবং দৃঢ় কণ্ঠস্বরে বলে, - ভুগতে হলে নিজে দেখে শুনে ভোগাই ভালো।
আমি একটু চমকে উঠি। ব্যবহার্য বস্তু থেকে উত্তরণ ঘটুক, মানুষ হয়ে উঠে ভুল করার স্বাধীনতা পাই - এ আকাঙ্খা তাহলে সব মেয়েরই মনের মধ্যে ধিকি ধিকি জ্বলছে।
হৃদয়পুরের মাসিমা ইতিমধ্যে মন্তব্য করেছেন। তাঁর শ্বশুরবাড়ি বেজায় ভালো। সেখানে সবাই শিক্ষিত, রুচিশীল। তাঁকে গড়ে পিটে নিয়েছিলেন শাশুড়ি। কোনোদিন রান্না করতে যেতে হয়নি, বরং পড়তে বসতে বলতেন। তিনি নিজে বড্ড বেশি কথা বলতে ভালোবাসেন, অথচ শ্বশুর বাড়িতে সবাই গুরুগম্ভীর। ওটুকুই একটু অসুবিধে হয়েছিল শ্বশুরবাড়ির সবার। মসলন্দপুরের বউটি ঘাড় নেড়ে বলে, "কিছু মনে করো না কাকিমা। গড়ে পিটে নিলে আর তোমায় নিল কোথায়? পড়তে তোমার ভালো লাগতো না রাঁধতে? তুমি যে বললে গল্প করতে ভালোবাসতে, তারা তোমার সঙ্গে গল্প করতো না? তুমিও তো মানিয়েই নিয়েছো তাহলে। আমাদেরই মত।"
মনে পড়ে এক দুপুরের কথা। সার্জারির পর বেশ কিছুদিন কেটেছে। হেঁটে চলে বেড়ানো, ঘাড় ঘোরানোর নিদান আছে তখন। ওয়ার্ডের মধ্যে দুপুরে ড্রাই রোস্ট হওয়ার থেকে মন ঘোরাতে এদিক ওদিকে হেঁটে বেড়াচ্ছিলাম। চোখে পড়ল, এক নম্বর বেডের শিশুটির মা জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে। একটু দূরে, জানলা দিয়ে চোখের সমান্তরালে ঝাঁ ঝাঁ দুপুরের রোদে ভিক্টোরিয়ার পরী লীলায়ীত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে। রুক্ষ চুল হাওয়ায় উড়িয়ে কোলে এক নম্বর বেডের বাচ্চা নিয়ে তার মা সেই মার্বেলের পরী দেখছে। হঠাৎ পিছু ফিরে দু চোখে দু টুকরো রোদ মাখা হাসি হেসে বললো, "ছুটি হবে যেদিন, আমরা সবাই যাব, বুঝলে? আবার তো নিশ্চই আসবো না"। বড্ড মায়া হলো। আর তার পরমুহূর্তেই খুব লজ্জিত হলাম। "মায়া" হলো! কি স্পর্ধা আমার! ভিক্টোরিয়া আমার কাছে সস্তা, সেই সস্তা জিনিসের প্রতি আকুলতা দেখেছি বলেই তো "মায়া" হলো। তার বদলে যদি উজ্জ্বল হেসে কেউ বলতো, "হাওয়াই দ্বীপ যাবে, বাকেট লিস্ট আইটেম", তখন হতো অক্ষমের জ্বালা। তাড়াতাড়ি সরে চলে এলাম জানলা থেকে।
সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার অভিজ্ঞতা আমার প্রথমবার। জানা ছিল না, খাবারের থালা-বাটি-গ্লাস নিজেকে নিয়ে যেতে হয়। প্রথমদিন সবাই খাবার নিতে যাচ্ছে যখন, সেই সারির মধ্যে আমি খালি হাতে বেকুবের মত দাঁড়িয়ে। বেশ কটা মাথা এগিয়ে এলো। "থালা আনোনি বুঝি?" প্রশ্নের উত্তরে ভ্যাবলা মুখে ঘাড় নেড়ে চুপ থাকি। মনে মনে হিসেব করছি তখন। রাতটা উপোষ, কাল দুপুরের খাবারটা ম্যানেজ দিতে হবে ইত্যাদি। হিসেব বেশিক্ষণ করতে হলো না। অনেকগুলো হাত থালা, বাটি, সাবান নিয়ে চলে এলো। সঙ্গে উৎসাহব্যঞ্জক দু চারটে কথা। "কিছু ভেবো না, এখানে সব পেয়ে যাবে", "খাবার এখানে ভালই দেয়। ডিম, দুধ। তরকারিটায় অবশ্য টেস্ট নেই। ওটুকু মানিয়ে নিলেই হলো"। মানিয়ে নেওয়ার ওস্তাদিতে মেয়েদের মার খাওয়ার সম্ভাবনা বরাবরই কম। খাবারটা নিয়ে তারা যত্নে কিছুক্ষন রেখে দেয়। তিনবেলা ডিম, সকালে দুধ - যে যত বড় গ্লাস নিয়ে যাবে সেই মাপে। সুগার থাকলে আলাদা সবজি। ভোর থেকে খেটে, তারপর বেলা তিনটের সময় জল ঢালা খাবার নয়, বিশ্রামে থেকে খাওয়া। এই ভোর থেকে খেটে বেলা গড়িয়ে খাওয়ার কথা আমি বারবার শুনেছি বাজারের মাসী, পার্লারের মেয়ে, মফস্বল থেকে ট্রেনে করে শহরে ঠিকে কাজ করতে আসা মেয়েদের থেকে।
আমার স্বাস্থ্যসাথী কার্ড নেই শুনে হাসপাতালের এতদিনের পরিচিত মেয়েগুলো হায় হায় করে ওঠে। মেয়েদের ফেরার রাহা খরচ এবং কত দিনের যেন ওষুধের খরচ দেওয়া হয় কার্ড থাকলে। আমি পাব না বলে ওরা দুঃখী। ওদের ম্লান মুখ দেখে আমার মুখও দুঃখী দুঃখী হয়ে যায়। ওই টাকা ক'টা চেয়ে, বারবার তাগাদা দিয়ে, হাত পেতে নিতে হয় না। ওই টাকা না থাকলে সমস্ত ঘাড়টা মুড়িয়ে ব্যান্ডেজ থাকলেও গেদে লোকাল ধরতে হয়।
ওলা উবের চড়া, সরকারি হাসপাতালকে বাস স্টপেজের নাম বানিয়ে ফেলা শহরবাসী ঠিক করে কোন ভাতা শিক্ষিত, "মহার্ঘ", অধিকার আর কোন ভাতা অশিক্ষিত, কদর্য, ভিক্ষা, লোভ। অর্থনীতির তথ্য মুখস্থ রাখা শহরবাসী প্রশ্ন করে না নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস থেকে ওষুধে কেন gst বেশি, কেন এত দাম।
Sskm এ একদিন এক বয়স্ক মহিলা আমার সামনে এক শহুরে পোশাকের ছেলেকে জিজ্ঞেস করেছিলেন এক্স রে কোন দিকে হবে। ছেলেটি বেখেয়ালে উত্তর দেয়নি। প্রৌঢ় মহিলা সরে যেতে যেতে নিজের মনেই বলেছিলেন, পড়াশুনোওয়ালা লোকদের সঙ্গে কেন যে কথা বলতে যাই।
যারা আমাদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করে আলাদা হয়ে যেতে চায়, যারা আমাদের প্রিয় দেশ বা রাজ্য থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চায় গায়ের জোরে তারা "বিচ্ছিন্নতাবাদী"। মনের জেদে যারা মানুষকে দূরে ঠেলে দেয়, অদৃশ্য সীমারেখা টেনে দেয়, প্রাচুর্যের মধ্যে বসে নিজেকে শ্রমিক বলে আর পছন্দের সরকার ভোট না পেলে সৎ, পরিশ্রমী সহনাগরিকদের ভিখারী দাগিয়ে তৃপ্তি পায় - এই দোআঁশলা যাপনকে কি বলে?