ছবি: সায়ন কর ভৌমিক
পুজোর গন্ধ, নাকে ভক করে লাগত, এক রক্তচক্ষু জ্যাঠার আগমন বার্তা হয়ে। হাতের ভাঁড়ে কষা মাংস। তখন হ্যান্ড ক্রিকেট বয়স, তাই মা-মা-মা (মা মাটি মানুষ নহে) র মা একটা-এই ধারনাই ছিল। এসোশিয়েসন সূত্রে শিশুমন গন্ধটিকে আমুল ভ্যানিলার সঙ্গে মনবাক্সের একটা কুঠুরিতে রেখে দিয়েই নিশ্চিন্ত । পরে সপ্তমীর দিন বাড়ির বহুদিনের কাজের লোক রামকাকা সাট্টার বার্ষিক অধিবেশন থেকে ফিরে রান্নাঘরে খুব ডাইলিউট প্রেপারেশান বানিয়ে রাখতেন। খেতাম। এরও পরে ১১, ১২ জমানায় ট্যাক্সি করে ম্যাডক্স যাত্রাকালে হাতে হাতে কোকের বোতল ধরিয়ে দেয়া হল, কিন্তু বোতলের ভেতর ভূতটি খুব চেনা। তখন নেশার মাঠে অন্য টিম ও রমরমিয়ে নামছে, মনবাক্সর খাপখোপ ঘেটে ঘুটে গুবলেট, চিনচিনে ব্যথা মস্তির সদর রাস্তা খুড়ে চলে গেছে যতদূর "লাল ফিতে সাদা মোজা' দের দেখা যায় । তখন উনি জাঁকিয়ে বসলেন আরো।
তার আগে প্রপার মজলিশ বলতে একটাই। যখন নর্থবেঙ্গল বেড়াতে গেলাম বাবা ও তার বন্ধুদের সাথে। শিলিগুড়িতে আমাদের থাকার জায়গা সোমেনদার শ্বশুরবাড়ী। বাবার বাল্যবন্ধু বিনয়দার জড়ানো গলায় ঘোষণা, "আজ ডুমস ডে, আজ বিনয় দাই আউট।' বাড়ি ঢোকার মুখে হঠাৎ সোমেনদা অ্যাবাউট টার্ন নিয়ে ফিশফিশ করে বললেন, "এখন, এখন সবাই স্টেডি।' ৫০- ঊর্ধ্ব বাবা ও তার বন্ধুরদল টিন-এজ গিল্ট আক্রান্ত ভাব এনে সন্তর্পনে পা ফেলে ফেলে এগোচ্ছেন, টিন-এজারটি মহা আনন্দে টিমটির সামনে সামনে। উদ্দেশ্য কোনরকমে বারান্দা পেরিয়ে দোতলায় চলে যাওয়া। সে হল নি। বাড়িতে তখন জ্যেঠি কাকি বউদি একটা ঘরে রবি ঠাকুরের গানের আসর নামিয়েছেন, বাবারা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে ঢুকে পড়লো। প্রথমে শ্রোতা হয়ে, তারপর সারা রাত ধরে সকলে মিলে গান- অবাক হয়ে বাবাকে প্রথম গাইতে দেখলাম আর কখন যে বিনয়দার মুখ থেকে রুমাল (গন্ধ প্রতিরোধকারী) সরে গেল, খেয়াল করিনি।
কলেজে পড়তে পুজোর দিনে হোস্টেলের ছাদে। বা দোতলার সেই বিখ্যাত টেরাসটাতে। দুদিকে খোলামালা ইস্ট উইং, ওয়েস্ট উইং আর মাঝের টিভি লাউঞ্জ থেকে টেরাস পেট বার করে সামনের পুকুর পাড়ে ছায়া দিত খানিকটা। তালগাছ। ফুরফুরে হাওয়া। ওলিপাব, ম্যাগস, ছোঃ। এরকম অ্যাম্বি থাকতে বিকল্প অবস্থান ভাবা যায়? জমিদারদের বাগানবাড়ি ছিল, আমাদের ছিল হোস্টেলটি। এধার ওধার থেকে ধার করে কোনরকমে দু একটা ওল্ড মঙ্ক এর খাম্বা দাঁড় হত বা তিন চার পাইট। সোর্স উল্টোদিকের ভাটি, সেখানেও অহেতুক রোমাঞ্চ জোগাতেন মালিক। খুব রহস্য করে চাপা গলায় প্রশ্ন আসত "কি চাই'। (মুখে রুমাল থাকলেও আশ্চর্য হতাম না) তারপর চোখের ইশারায় একটা কর্মচারীকে বলা হত, সে স্যাট করে হাতে ধরিয়ে দিত।) রাত্তিরবেলা ভাটি বন্ধ থাকলে বি টি রোডের নিঃশব্দ রাস্তা (হু হা ট্রাকের শব্দ বাদে) ধরে রিকশা করে দক্ষিণেশ্বর। একটাই ঠেক খোলা থাকত। টিম টিম আলো। তারপর দারোয়ান আর প্রফ কোয়ার্টারের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময়, নিপ হলে শার্ট এর পেটের বোতাম খুলে গুঁজে দেওয়া, তারপর শার্ট থেকে বের করে টেরাসে অপেক্ষারত সিনিয়রদের সামনে থপ করে রাখা। আর সর্বান্তে দাঁত কেলিয়ে সগর্ব ঘোষণা, "এনেছি'।
বিদেশ থেকে সিনিয়ররা এলে দামি হুইস্কি বা ওয়াইন চাখা হত। আর গোয়া ট্যুরের বছরে ছিল ফেনি। মন্দার বাজারে (মেস বিল ডিউ, উদার দাদাদের স্টাইপেন্ড কাট, ইত্যাদি) "পশ্চিমবঙ্গ সরকার কর্তৃক...' স্ট্যাম্প মারা সাদা বোতলই ছিল ভরসা।
থার্ড ইয়ারে থেকে আমার কেমন করে একটা নতুন নাম হল। "সভাপতি'। তবে তখন থেকে মাল-পার্টিগুলোকে একটা স্ট্রাকচার দেওয়ার চেষ্টা করতাম। প্রথমে একটা উদ্বোধনী স্পিচ । তারপর এনাউন্সমেন্ট হত আধঘণ্টা অন্তর। "এবারে পানু পাঠ করে শোনাবেন' এই রকম আর কি। বাইরে সিকিউরিটি বসার পর আমার রুমে ভেন্যু শিফট হল, সিগগি ফেলার জন্য আলাদা ট্রাশের দরকার হত না, কারন গোটা রুমটাই ছিল মোটামুটি তাই। আর ছিল আমার একখান স্পেশাল লাল ব্যাগ। কাঁধে ঝোলানো। এই ব্যাগটা করে নোংরা জামা কাপড় নিয়ে শনিবার বাড়ি ফিরতাম আর বাড়ি থেকে কাচা জামা নিয়ে আসতাম। ঐ ব্যাগ নিয়েই বেরোতাম মাল কিনতে। ঐ ব্যাগটাও কেমন করে জানি লেজেও, একরকমের প্রতীক হয়ে গেল। ঐ লাল দেখলেই মাল পাড়ায় উত্তেজনার সঞ্চার। দিগ্বিদিকে খুশির ছোঁয়া। "আজকে হচ্ছে নাকি, আমাদের তো আজকাল ডাকিস না'। একটা বিশ্বস্ত অ্যাসিস্টান্ট ছিল, যার অ্যাসাইন্ড জব ছিল সোডা ও চাট জোগাড় করে রাখা। রাত্তিরের সঙ্গে, সভাসদদের গানের গলাও তুঙ্গে উঠত। কখনো কখনো পেছনের বস্তি থেকে বৌদিদের চিল আর্তনাদ ভেসে আসত "রাত দুটোয় কিশোর কুমার হয়েছে সব...****'। স্বাভাবিক রিএকশান। ঐ ডেসিবেলে। একদিন ইঁট ছোঁড়া শুরু হল। লাইট নিবিয়ে টিবিয়ে আমরা ডাক করে বসে রইলাম কিছুক্ষণ। তারপর অন্যরুম। অন্যপ্রান্তে। আবার জানলা বেয়ে ইট। শেষ আশ্রয় টিভি ঘরে।
বাবার সঙ্গে একটা কোডেড কমিউনিকেশান চালু ছিল। "সামনে পরীক্ষা আসছে, এই পুজোর কদিন শরীরের একটু যত্ন নিস, ধকল নিস না'। সেমি আউট বিধ্বস্ত অবস্থাই বাড়ি ফিরলে বলা হত " প্রচুর ধকল গেল এই সপ্তাহে তাই না, পরের সপ্তাহে তাড়াতাড়ি বাড়ি আসিস'।
মালপার্টির চরিত্রদের নিয়ে বলতে গেলে হামেশাই যাদের ভুলে যাওয়া হয়, তাদেরকেও একটু স্মৃতিতে আনা যাক- সেই নিরাসক্ত পাব্লিক, একাধারে ব্যাকস্টেজ ও দর্শক, যাবতীয় কান্ডকারখানা দেখতে কোক নিয়ে বসে থাকতো আর কনসিস্টেন্টলি নিরলস ভাবে এক এক করে জনতা কে ঘরে পৌঁছে দিতো। কারণ রুম তো ভুল হত আকছার। (রিসার্চ স্কলার মামু যেমন ঠিক গুটি গুটি পায়ে একতলার "১৭' নম্বর রুমে গিয়ে খাটে সটান গা এলিয়ে দিলেন, যেমন ৫ বছর ধরে করে এসেছেন, শুধু "১৭' কেন এখন কোন রুমই আর মামুর নয়, এটি বেমালুম ভুলে মেরে।)
কবিতার মতই প্রতিটা মাল পার্টির একটা নিজস্ব রিদম থাকত। বা বলা যায় প্রত্যেক মাল গ্রুপের। বন্ধুদের অন্য কলেজের বন্ধুরা এলে যেটা টের পাওয়া যেত। এমনকি একই হোস্টেলেই দুটো এক্সট্রিম। ফার্স্ট-সেকেন্ড ইয়ারে মুখ্য খেলোয়াড়রা বলত কম। শম্বুক গতিতে সিগারেটের খোলে গাঁজা ঠুসতে ঠুসতে বড়জোর দুটো একটা কমেন্ট। আবার অনেকক্ষণ চুপ। ভালই লাগত। আবার পরের দিকে হুপ-হাপও, (এক ডেবুটেন্ট তো গোটা ছাদ ডিগবাজি খেয়ে হোস্টেল শুদ্ধ সবাইকে স্যালুট করতে করতে নির্বস্ত্র হলেন, আবার আর একজন মাল খেলেই চুড়ান্ত উল্লাসে প্রত্যেক কথার জবাব পিঠে অ্যায়সা চাপড় মেরে দিতেন, যে ব্যাগ নিয়ে বেরনোর সময় তাকে এনগেজ করে রাখা হত, যাতে দেখতে না পায়) মন্দ লাগত না। কান্নাকাটি, লাঠালাঠি, হঠাৎ প্রেমিকা দূরে চলে যাচ্ছে ঠাউরে রাত দুটোয় তাকে ফোন করে তুলে হাই পিচ বেদনার্তি শোনানো যা তাকে শ্যামবাজারের পি জি থেকে ট্যাক্সি করে নিয়ে আসে বরানগরে। আবার পড়া বোঝার জন্য আউট হওয়া বন্ধুকে ইন কি করে করতে হবে ভেবে না পেয়ে সরাসরি বন্ধুর বাবাকে ফোন করে "কাকু, বিকি আউট হয়ে গেছে, ওকে কি খাওয়াব বলুন তো'। কাকু আবার ওদিক থেকে স্টেপ বাই স্টেপ ইন্সট্রাকশান দিলেন। হ্যাঁ, কনফিউশান ছিল। অভিমানও ছিল পোচ্চুর। সভাপতি হয়ে যাদেরকে ডাকতে ভুলে যেতাম। লালব্যাগ নিয়ে ডানলপে দেখা হ'লে একটা ম্লান হাসি ঠেকাত শুধু। অথচ ব্রাত্য ছিল না কেউই।
একবার দশমীর দিন ফেরার কথা। কিন্তু সকাল থেকে ঘুম। স্বপ্ন কি ছিল মনে নেই, তবে একটা মেগাস্কেল বিস্ফোরণ ছিল শেষে। ঘুম থেকে উঠে বুঝলাম দরজা ধাক্কাচ্ছে। খুলে দেখি বাবা। সকালবেলা পিসিদের আসার কথা, বাড়িতে, আমারো। হোস্টেল ভর্তি মাতাল বমি ও বোতল, এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে। চাটুদা (যার আবার শুনেছিলাম সেদিনই নাকি শ্বশুরমশায় এসেছিলেন) "কি রে ঠিক আছিস' বলে স্খলিত চরণে রুমে ঢুকে একটা স্বর্গীয় হাসি ছেড়েই ছুটে বাথরুমে।
বাবা ট্যাক্সি করে যেতে আস্তে আস্তে বললেন, "জানি খুব ধকল গেল কালকে।'
আমিঃ "হ্যাঁ এই, সারারাত ঘোরা'।
পুজোর সময় হোস্টেল দিনগুলিতে এরমই পাকস্থলী বেয়ে সন্ধ্যে নামত। আর ব্রেনের বিশেষ বিশেষ জায়গায় জমাট করে ছায়া ঘনাত। ডিসকন্টিনুয়াস এবড়ো খেবড়ো কার্ভের মাঝে একটা ম্মুথ ইনফ্লেকশান পয়েন্ট। দিনটাকে কুচি কুচি করে কেটে কাঁটা চামচ সহকারে খেয়ে নিতাম সকলে, আর তার অশ্লীল ঢেঁকুর ধ্বনি সারা রাত। সাইন্যাপটিক জাংশানে ট্রাফিক জ্যামের মন্থরতা, আর নিউরনগুলোর চাইমসের মত টুং টাং টুং টাং।
এভাবেই নিজেদের ভেতরেই জগৎ তৈরি হত।
ভাগ হত।
সেই সময় মনে হত আজীবন কার্নিভাল।