অলংকরণ: রমিত
গিন্নির হাত দেখে কিশোরী বয়সে কোন এক জ্যোতিষী নাকি ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন যে কোন ব্যবসায়ী পরিবারেই তার ভাত কাপড়ের ব্যবস্থা হয়ে রয়েছে।
বাড়ির অন্যরা যথাসময়ে সেই কাহিনী ভুলে গেলেও তার মনে সেই কথা বেশ দাগ কেটে যায়।
এরপর বন্ধুরা যখন কুঁড়িকুসুম থেকে ফুলদল হয়ে উঠছে, এদিক ওদিক থেকে উড়ো বাতাসে ভেসে আসছে গোলাপী প্রেমপত্র, ছেলের দল বাল্যসাথী থেকে পরাণসখা হয়ে ওঠার পথে কদমতাল করে এগিয়ে চলছে, জীবনের ঠিক সেই প্রাক্বসন্ত বেলা থেকেই কেন জানা নেই তার মনে এই বদ্ধ ধারণা জন্মেছিল যে কোথাও কোন এক বাসন ব্যবসায়ীর ঘরে, দোকান ভর্তি সোনালি, রূপোলী, তামাটে বাসনের মধ্যেই তার মন বাঁধা পড়বে।
পৃথিবীর তাবৎ লোভনীয় বানিজ্য ছেড়ে দিয়ে কেন ঠনঠনে বাসনের শব্দ শোনার জন্য তাঁর মন ব্যগ্র হয়েছিল তা ভগবানই জানেন। সেই বাড়িতে নাকি থালার নাম থাকবে রাধাকান্তি বা রাজভোগী। কৃষ্ণচূড়া, ময়ূরকণ্ঠী, আঁধারমালিকা জগে থাকবে প্রাণহরা শরবৎ। আর খোশবেয়ে পরমান্ন খেতে হবে ফুলতুলি বাটি থেকে।
‘মানুষের মনের গতি বিচিত্র’ কবি এ কথা ভুল বলেননি।
তখন সে নাকি মাঝেমাঝেই ভাবত দুপুরে বাসনের দোকান বন্ধ করে স্বামী বাড়ী এলে একসঙ্গে দুজনে খাওয়া দাওয়া করে, পানের বাটা থেকে পান মুখে দিয়ে দুপুরে ঘুমোতে যাবে।
স্মৃতি রোমন্থনের ঠিক এইখানটিতেই আমি আসরে নেমে পড়তাম। বাসন ব্যবসায়ীর সঙ্গে খেয়ে দেয়ে পান মুখে দিয়ে সেই ঘন দুপুরে তারপর আর কী কী করতে চাইত তার ব্যাখ্যা শুরু করতেই সে ছদ্ম রেগে হেসে ফেলত।
ঠোঁটে ফুটে উঠত পানের লালের চেয়েও গভীর অনুরাগের হাসি।
সে যাই হোক, জীবনের নিজস্ব যোগ বিয়োগের খেলায় সে আর কাঁসার ফুলকারি থালায় ভাত খেতে পায়নি। পানের বাটা থেকে সাজা পান তুলে খাওয়াও হয়নি তার। পরিবর্তে বর্তমানে স্কুল শিক্ষকের ঘরেই তিনি অন্নপূর্ণা হয়ে আমাদের ভাত মাপছেন।
তবে সব কয়েনেরই যেমন দুটি পিঠ রয়েছে, তেমনি যে কোন ঘটনারই ভালো, মন্দ দুটি অবস্থাই রয়েছে। দোকান বন্ধ করার অধিকারী ব্যবসায়ীর মত দ্বিপ্রাহরিক ভোজন ও শয়নের সুবিধা না থাকলেও বাড়ির কাছের স্কুলে শিক্ষকতার সুবাদে আমার স্কুলের কাজকর্মের পাট সন্ধ্যের আগেই মিটে যায়। বিয়ের পরে পরেই বন্ধুকৃত্যে কিছু ব্যস্ত থাকলেও, কদিন পর খোকা হওয়ার পর থেকেই সেই সন্ধ্যেবেলাটি পরিবারের সঙ্গেই কাটাই।
সন্ধ্যে বেলার চা আড্ডায় আমি আর গিন্নি পার্মানেন্ট শাকরেদ।
সঙ্গের লোক বদলায়।
আগে মা থাকতেন। তারপর খোকাও জুটল। সে তার দুধের কাপটি নিয়ে আমাদের চায়ের কাপের সানকিতে রেখে বিজ্ঞের মত নানা বিষয়ে দরকারি মতামত দিতে থাকল।
যেমন, “দানো বাবা আদ না মানিকপ্যান গাতে দানো এতে বতেছিল। থাম্মু এত সাগোস করে তালিয়ে দিল।” জানা গেল মানিপ্ল্যান্ট গাছটাতে আজ একটা বদখৎ গিরগিটি এসে বসেছিল। মা তাকে তাড়িয়ে নাতির কাছে সাহসের বলে বলীয়ান হয়ে বীর উপাধি পেয়েছেন। খোকার কথা শুনে আমরা হেসে উঠি।
খোকাকে নিয়ে ব্যস্ত থাকতে থাকতেই মা’র বিস্মৃতিব্যধি হল।
তিনি পয়সা, পয়সালতা, নাতি, সংসার একে একে সব ভুললেন।
একসময় নিজের অস্তিত্বও মনে রাখতে পারলেননা।
ওদিকে খোকার ফুটবল দাপানোর দল হয়ে গেল। চায়ের আড্ডার ক্ষুদ্রত্বে তাকেও আর এঁটে রাখা চলেনা। বাইরের জগত তখন তাকে বীর আহবানে ডাকছে।
সংসারে কাটাকুটি খেলা এমনি করেই তো চলতে থাকে। কেউ এসে জোটে, কেউ ঘর কাটে, কেউ ঘুঁটি সাজায়, কেউ আবার সাজানো গুটি এলোমেলো করে জেতা খেলা ছেড়ে চলে যায়।
চা নিয়ে প্রথমটা আমরা বসতাম রান্নাঘরের সামনের চাতালটিতে।
পরে সেখানটা ঘিরে একটা স্টোর রুম বানানো হল। তখন আমরা বসতাম মায়ের ঘরে। পরে মা অসুস্থ হতে তিনি সারাদিন ঘরেই থাকতেন। তাই সন্ধ্যেবেলায় চা খেতে তাঁকে একটু জোর করেই নিয়ে আসতাম বাড়ির পিছনের দিকের সিঁড়ির চাতালে। শেষ বিকেলের মিঠে রোদ, পেয়ারা গাছের সবজে হলুদ রঙের মাঝে লঙ্কা ঠোঁটের টিয়াপাখির খেলা দেখে যদি এই মরজগতের আঁকিবুকিতে মা’র মন ফেরে।
কিন্তু মা’র চোখে হয়তো এসব পড়লনা। মা ইহজগতের মায়া ভুলেছেন।
বিরল স্নায়ুরোগে তিনি সমসাময়িক পারিপার্শ্ব আর কিছু মনে করতে পারেন না।
তখন মা কখনো উনিশ কুড়ির সদ্য যুবতী।
কলেজের বন্ধুদের সঙ্গে সিনেমা যাবেন বলে খোকার কাছে নাকি একদিন পাঁচ টাকা চেয়েছেন।
খোকা, খোকার মাকে তো নয়ই, আমার দিকেও মাঝে মধ্যে অপরিচিতের চাহনিতে যখন তাকান আমার বুকটা মুচড়ে ওঠে।
আগে আমার মুখে কষ্টের ছায়া দেখলেও মা ব্যস্ত হয়ে উঠত, এখন চিনতেও পারেননা।
সেই মা এখন আমার দিকে তাকিয়ে নির্দ্বিধায়, “মোহনদা আমার চিঠি নেই? ন কাকা বুঝি এবারেও আমায় চিঠি পাঠায় নি? বলেছিল যে ফোরে উঠলে আমাকে,আলাদা চিঠি দেবে?” বলে পা টেনে টেনে ঘরের দিকে চলে যান।
বুঝলাম মা তখন এগারো বারোর দু’ বেণীর কিশোরী। সেই কিশোরীবেলার কোন এক ডাকপিওন মোহনদার কাছে মায়ের পাওনা চিঠির আব্দারে আমার আর কোন ভূমিকা নেই।
আমি বুঝতে পারি মা এজন্মের মত এ’জগতের সঙ্গে লেনাদেনা সাঙ্গ করেছে।
একসময় মা চলে গেলেন।
এরপর আমাদের খুকী হল। নাম রাখলাম মিহি।
একটু বড় হতে দাদার জায়গায় সে নিজের দুধের কাপটি নিয়ে আমাদের সঙ্গে বসতে থাকল।
অবশ্য ক’দিন পর খুকির জন্য এই সময়ে একটি গৃহ শিক্ষিকা রাখায় এখন আমরা কর্তা গিন্নিই চায়ের আসরের সঙ্গী।
তবে মা চলে যাওয়ার পরও কিন্তু আমরা সেই পিছনের সিঁড়ির চাতালেই রোজ সন্ধ্যার চা খেতাম। আমার মনে হত মায়ের গায়ের গন্ধ যেন এখনো সেই দালানে লেগে রয়েছে।
আমাদের বাড়ির পিছনের এই চাতালের দিকে মুখ করে ধরবাবুদের বাড়ী। বাড়ী বলতে উঠোন।
আমরা যখন চা খেতাম তখন কোন কোন দিন ধরদার ছোট মেয়ে শ্রীলতা আর ওর মা ওদের উঠোনে তারে মেলে দেওয়া শুকনো জামা কাপড় তুলতে আসে।
কথা না হলেও দেখতে পাই ওদের।
একদিন দাঁতে একটা বাদাম কেটে গিন্নি বলল, “শ্রীলতা কে আর স্কুলে নিয়ে যায় না বৌদি।”
খানিকটা চমকে উঠলাম। ধরবৌদি দু একটা জামা কাপড় তুলে নিয়ে গিয়ে বাকিগুলো শ্রীলতাকে তুলতে বলে ঘরে চলে গেলেন।
“বাকি জামাগুলো তুলে নিয়ে আয়। ক্লিপগুলোও তুলে নিয়ে আসবি।” এদিক থেকে দিব্যি শোনা গেলো।
শ্রীলতাও বাকি জামাকাপড় ও কাপড় শুকানোর ক্লিপগুলো খুলে নিয়ে ঘরে ঢুকে গেল।
আমি বললাম, “বৌদি নিজেই তো সব জামাকাপড় তুলে নিয়ে যেতে পারত, মেয়েটা এমনিতেই……”
মিহি’র মা বলল, “মেয়েটা এমন বলেই ওর মা এরকম করে। বৌদি ওকে সংসারের কাজে জড়িয়ে রাখে। নাহলে ও নিজে থেকে তো কিছু করবে না।’’
এমনিতে খুবই স্বাভাবিক দৃশ্য। কিন্তু শ্রীলতার কথা আগে থেকে জানলে তা আর স্বাভাবিক থাকেনা।
এমনিতে বাড়ির খিড়কি দুয়ারের বিষয়ে বাড়ির মেয়েরা ছেলেদের থেকে বেশী জানে। আমার বাড়ীতেও দেখলাম শ্রীলতার বিষয়ে গিন্নি এখন আমার থেকেও অনেক বেশী ওয়াকিবহাল।
শ্রীলতা ধরদা’র ছোট মেয়ে। বড় মেয়ে কনক। দু’ তিন বছরের ছোট বড় ওরা। মেয়ে দুটো চোখের সামনেই বড় হচ্ছিল। এক দিন খেলতে খেলতে শ্রীলতা পড়ে গেল পাঁচিলের ওপর থেকে।
খেলতে গিয়ে অমন বাচ্চারা তো কতই পড়ে যায়। খোকা পড়েছে, মিহিও পড়েছে। হয়তো আমিও পড়েছি। পড়তে, পড়তে, উঠতে দাঁড়াতেই তো জীবনের পথে চলতে শেখা মানুষের।
কিন্তু শ্রীলতার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা সহজ হল না। রাতে শুরু হল বমি। ছোট্ট মেয়েটার শরীর মন্থন করে হলদে, জলসাটে কে জানে কোন বিষ উঠে আসতে লাগল সারা রাত।
কনক ঠিকঠাক কিছু বলতে পারেনি। হয়তো বোন সন্ধ্যে বেলায় পড়ে গেছিল, সে খেলতে খেলতে অতটা লক্ষ্য করেনি। উঠেও তো পড়েছিল নিজেই।
সত্যিই তাই শিশুর নমনীয় হাড় মাংসে কেটে ছিঁড়ে যাওয়াটা একান্ত স্বাভাবিক।
কিন্তু হাসপাতালে নিয়ে যেতে ডাক্তার ভর্তি করে নিলেন। শ্রীলতার পড়ে যাওয়াটা স্বাভাবিক ছিল না।
দীর্ঘ চিকিৎসার পর সে বেঁচে ফিরল বটে কিন্তু মগজের কোথাও কোন প্রকোষ্ঠে প্রকোষ্ঠে ঢেউ খেলে বেড়ানো প্রয়োজনীয় তরঙ্গের খেলা থেমে গেল। বাচ্চাটা নিজের গরজে কিছুই করেনা।
এমনিতে দেখলে কিছু বোঝা যাবেনা। শ্রীলতা ইচ্ছাবিহীন একটি জীবিত পুতুল হয়ে রয়ে গেল।
কখনো নিজে থেকে কিছু বলেনা, নিজে থেকে কিছু করেও না। কিন্তু অদ্ভুত ভাবে নির্দেশ পালন করার অভ্যাসটা ভুলে যায়নি।
বলে দিলে, বা আদেশ দিলে সেই কাজ একবার ঠিক দম দেওয়া পুতুলের মত করে দেয়।
এভাবেই সে মা'র নির্দেশে যন্ত্রের মত জল খায়, খাবার খায়, বর্জ্য ত্যাগ করে, বই নিয়ে বসে, টিভির দিকে তাকিয়ে দেখে। এবং একই সঙ্গে সে খিদের কথা কখনও বলেনা, জল চেয়ে খায়না, বই খুলে বসে থাকলেও পাঠের বক্তব্য আত্মস্থ করেনা, টিভির দিকে তাকিয়ে থাকলে বিনোদনে আমোদ করেনা।
এতটুকু আমি জানতাম।
পুরুষের বহির্জগতের লেনাদেনা, কর্মক্ষেত্রের বোঝ কেমন করে জানিনা তার আর তার নিজের পরিবারের মাঝেই এসে পড়ে তাকে নিজের পরিবারের মানুষের থেকেই আলাদা করে দেয়। সে ক্ষেত্রে প্রতিবেশী তো অনেক দূরের ব্যাপার।
আমিও নিজের জীবনডোবায় এমন ডুবেছি যে, পাশের বাড়ির ধরদা’র ছোটমেয়ে কেমন বড় হচ্ছে সে সম্পর্কে আর খবর রাখতে পারিনি। বরং দেখলাম গিন্নি সে ব্যাপারেও এখন বেশী জানে। উঠোন দুটো একই দেওয়ালে মেশায় বৌদির সঙ্গেও ওর বেশ ভাবও রয়েছে।
ওর কাছেই শুনলাম, শ্রীলতার জীবনটা এখন আর ওর একার নেই। শ্রীলতার মাও ওর সঙ্গে একইভাবে জীবন বাঁচছে।
গিন্নি ঠিক এইভাবে বলেছিল কিনা মনে নেই। তবে বিষয়টা দাঁড়ায় এরকমই।
ধরদা একটি বহুজাতিক সংস্থায় মাঝারি পদে কাজ করেন। কনকটাও এতদিনে বেশ মাথা ঝাড়া দিয়েছে।
ছেলেমেয়েরা খানিক বড় হলে মায়েদের জীবনেও কিছুটা পরিবর্তন আসে। নিরন্তর শিশুর সঙ্গে দৌড়োদৌড়ি, টানাপোড়েন আর অবোধ শিশুর ইচ্ছা, চাহিদা, যন্ত্রণা বুঝে নেবার কাল শেষ হবার পর তারা একটু বড় হলে সামান্য শৈথিল্য আসে মায়ের জীবনে।
কিন্তু ধরবৌদির জীবনে সেই নিশ্চিন্ততা যাপনের সুবিধা হয়নি। বরং শৈথিল্যের বিপরীতে আরও ডিসিপ্লিনড, আরও চৌকশ হতে হয়েছে তাঁকে।
সকালে উঠেই তিনি শ্রীলতাকে নিয়ে লাল স্কুটি চড়ে স্কুলে দিয়ে আসেন। ফিরে এসে কনক আর ধরদাকে স্কুলে অফিসে রওনা করিয়ে ফের ফিরে যান শ্রীলতার স্কুলে।
স্কুলের সামনের প্রতিষ্ঠাতার নির্জন আবক্ষের সামনে সমস্ত স্কুলবেলাটা একলা বসে থাকেন তিনি।
মেয়েটাও তো স্কুলে কেবল বসেই থাকে। বলে না দিলে নিজের উদ্যোগে কিছুই করেনা। ক্লাসে শিক্ষকের আদেশ থাকলেও বিরতিতে জল বা খাবারও খাবেনা। প্রস্রাবের বেগ আসলে উস্খুস করতে থাকবে, কিন্তু প্রয়োজনটি জানাতে পারবেনা। প্রতিদিন ওকে চিনিয়ে দিতে হয় প্রস্রাবখানার চেনা মোড়।
এসব মফস্বলের স্কুলে এত আয়াদিদি থাকেনা যে একা শ্রীলতাকে সমস্ত কাজে কেউ সাহায্য করতে থাকবে। বৌদি তাই নিজেই মেয়েকে টিকিয়ে রাখেন স্কুলে।
তবে প্রাথমিকের পর্যায়টা শেষ হতে ওকে স্কুলে আর নিয়ে যায়নি বৌদি।
কারণ শারীরিক সমস্যায় যে বাধা সৃষ্টি হয়েছে তাতে বাইরের প্রচেষ্টায় সাহায্য় করা গেলেও বুদ্ধির প্রতিবন্ধকতায় কোন সাহায্য করা যায় নি। বিভিন্ন সহায়তাতেও প্রাথমিক শিক্ষার বুনিয়াদি ভিত মেয়েটির মাথায় গেঁথে তোলা যায়নি।
দুই আর দুই যোগ করে চার করার বা কথার পর কথার মালা বুনে মনের ভাবটা প্রকাশ করে ফেলার যে সাধারণ সক্ষমতা এই বয়সে আশা করা যায় শ্রীলতা তার কোনটাই করেনা। কিন্তু প্রাথমিক স্কুলে তার বোধহীনতার ওপর, অপারগতার ওপর শিক্ষকদের স্নেহের যে প্রলেপ ছিল এখন উচ্চতর শিক্ষার স্কুলে তার আর জায়গা নেই।
এখানে এবার মেধা আর পরিশ্রমের কষ্টিপাথরে যাচাই করে তবে একধাপ উঠতে দেওয়া হবে ছাত্রদের।
এখানে শ্রীলতার আর জায়গা হয়নি।
তাই ওকে বৌদি আর স্কুলে নিয়ে যায় না।
গিন্নির কাছে এটুকু শুনেই বিষয়টা মাথা থেকে সরিয়ে দিতে পারলাম না।
মাষ্টার হবার একটা জ্বালাও আছে। কোথাও কেউ ইস্কুল কলেজ থেকে ছিটকে যাচ্ছে শুনে কলজেটা দু একবার জানান দেয়।
ধরদার সঙ্গে একদিন সকালে বাজারে মুখোমুখি দেখা হয়ে গেল। আমাদের এই গঞ্জ শহর থেকে মিনিট চল্লিশ বাসে চড়ে উত্তরে গেলে একটি বিশেষ ভাবে সক্ষম বাচ্চাদের জন্য স্কুল রয়েছে।
যাদের বুদ্ধি বা জ্ঞানের বিকাশ ঠিক সাধারনের মাপকাঠিতে মিলল না তাদের জন্য আলাদা স্কুলে কিছু লাইফ স্কিল বা হাতের কাজ শেখানো হয়। খবরটা জেনেছিলাম এক সহকর্মীর দৌলতে।
কিন্তু ধরদাকে বলতেই, পেট ফোলা মরা আড় মাছটা থেকে তাঁর হাতটা হঠাৎ ছিটকে গেল। চোখে মুখে একটু বিড়ম্বিত আহত ভাব।
একটু যেন ঘাবড়ে গিয়ে বললেন, “ওদের মাকে বলে দেখি। আমি, আমি…… আমার তো সময়……।”
সত্যিই বাচ্চাদের বিষয়ে তাদের মা’ই ভালো বুঝবেন। তাই ভেবেছিলাম ধরদা কিছু না করলেও আমিই বৌদির কাছে যাব।
ধরদা হয়তো বৌদিকে বলেছিলেন বিশেষ স্কুলের বিষয়ে।
কিন্তু বৌদি সেই কথায় আমল দিয়েছিলেন কিনা সেই খবর পেলাম বাড়িতে।
আমার স্ত্রীকে বৌদি বলেছেন, “ওসব স্কুলে দিলে লোকে বলবে পাগলের স্কুলে পড়েছে। তাহলে কী আর ওর বিয়ে হবে?”
আমি কেমন যেন স্তম্ভিত হয়ে গেলাম।
সমাজের চোখে এই ধরণের স্কুলের নাম ‘পাগলের স্কুল’! এটা কোন মতে গিললেও এখনই অভিভাবকেরা অসুস্থ শিশুটির বিয়ে পর্যন্ত ভেবে ফেলেছেন! এতটা আমার কল্পনাতেও আসেনি।
আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল। শ্রীলতার বিয়ের কথা শুনে আমার কেমন যেন সেই কবিতাটা মনে পড়ে গেল।
“আমার ন্যাংটাপুটো ছেলেটাকে
কে ভুলিয়ে নিয়ে চলে গেল!
কথা বলতে পারেনা,
মা কোথায় জিজ্ঞেস করলে
চোখ দিয়ে মা দেখায়।
কে তাকে নাইয়ে দেবে, খাইয়ে দেবে
চুল আঁচড়ে দেবে।”
যদিও শ্রীলতা আর শিশু নেই। তবু তার চিন্তা জগতের বিকাশ হয়নি। এক অর্থে অবোধ তো বটেই।
এখন সে কিশোরী হলেও নিজেকে প্রকাশ করার স্বাভাবিক বুদ্ধি নেই তার। বিয়ের মত জটিল একটি বন্ধন যেখানে প্রতি মুহূর্তে নিজেকে প্রমাণ করতে হয়, সেখানে কী টিঁকে থাকতে পারবে মেয়েটি? বিবাহ পরবর্তী জীবনে মেয়েদের যে সমঝ আর সমঝোতার ভারসাম্যের খেলার কৌশল আয়ত্ত করতে হয় তা কি জানেন না তার মা?
আর যৌনতা? সেই বিষয়টা কী ভাবে অনুভব করবে শ্রীলতা?
প্রকৃতির ইচ্ছায় প্রাণীজগতের এই উদ্গমের মানসিক তাগিদ কি ওর প্রাণে প্রজাপতির তরঙ্গের খেলা দেখাবে? না কেবলই শরীর জেগে উঠবে?
নাকি তাও নয়। বিবাহের বৈধতায় অপর পক্ষের জৈবিক তাড়নার শিকার হয়ে যাবে?
আর ভাবতে ইচ্ছে করল না।
আমার মুখে মেঘের ছায়া দেখে হয়তো গিন্নি কিছুটা আন্দাজ করতে পারল।
গিন্নি বলল, “এখুনি কী বিয়ে হয়ে যাচ্ছে? আর দশ পনেরো বছর পর কিছুটা ভালোও তো হতে পারে মেয়েটা। আর একেবারে কিছু বোঝেনা তাও তো নয়। নিজে থেকে কিছু করেনা এটুকুই। কোন এক ডাক্তারের ওষুধও খাওয়াও ওরা মেয়েটাকে।।”
অনেক সময় নিজে থেকে অনেক কিছু করেও যে বিবাহিত পরবর্তী জীবনের চাহিদার অতল স্পর্শ করতে পারা যায় না তা খোকার মা জানে। শ্রীলতার সত্ত্বার স্ফুরণে যে গিঁট পড়ে গেছে তা যে সমাজের নিয়মের চাহিদার যোগান দিতে পারবেনা সেটা সেও কিছুটা বোঝে নিশ্চয়ই।
খানিক থেমে সে আবার বলল, “দেখো ভাগ্যে কার কি আছে কে জানে! নাহলে নাড়ুদাদের সংসারও তো চলে যাচ্ছে।
কীসের সঙ্গে কীসের তুলনা!
কোথায় জড়বুদ্ধি শিশু শ্রীলতা আর কোথায় নাড়ুদা।
তবে তলিয়ে ভাবলে মেলতাল একেবারেই নেই তা নয়।
দুজনেই কোন কাজকে পরিণামে নিয়ে যেতে অপারগ। মানে যাকে বলে ফেলিওর ইন একম্পলিশন অফ ওয়র্ক।
তবে নাড়ুদার জীবনে গিঁটটা ভিন্ন প্রকৃতির।
সাধারণ বুদ্ধি থাকলেও নাড়ুদা একজন নামকরা অলস।
সম্পর্কে নাড়ুদা আমার দূর সম্পর্কের শালা। গিন্নির কোন তুতো সম্পর্কের পিসি এঁদের পৈতৃক বাড়ির একচিলতে বাস্তু ভাগে পেয়েছেন। পিসেমশাই ছেলেমেয়েকে নিয়ে অনেকদিনই এসে উঠেছিলেন এই বাড়িতে।
জন্মগত আলস্য সম্ভবত নাড়ুদাদের পারিবারিক ঐতিহ্য। আর বাড়ি একচিলতে জুটলেও পিসেমশাই কর্মহীন বসে থাকতেন। কিন্তু মাথার ছাদের অনিশ্চয়তার আগে পিছে যা ভনভন করে বেড়ায় তা হল পেটের ভাতের চিন্তা। পিসেমশাইয়ের সংসারের কথা না ভাবলে চলে গেলেও পিসিকে ছেলেমেয়ে দুটোর খাবারের ব্যবস্থা করতে হত।
গ্রামের মুরুব্বিদের ধরে করে গ্রামের স্কুলের রাতপাহারার কাজটা পিসেমশাইকে পাইয়ে দিয়েছিল পিসিই। কালক্রমে সেটি একটি সরকারী পাকা চাকরি হয়ে দাঁড়ায়।
পেটের ভাত আর মাথার ছাতের অসুবিধা আর ছিল না।
মিহির মা বলে আগে ওরা গরীব হলেও এমন হা-অন্ন ছিল না।
নাড়ুদা অবশ্য পিতৃদত্ত সম্পত্তিতে গভীর নিষ্কর্মা স্বভাবটা ঠিকই পেয়েছিল।
এবং ধারাবাহিক ভাবে সেই অলসতার ভারে কোন জীবনকৃত্যের কোন বৃত্তই সম্পূর্ণ করতে পারেনি।
প্রথাগত শিক্ষার জগতে পরিচিতি বহন করে যেসব বোর্ডের পরীক্ষাগুলো, সেখানে পৌঁছনোর আগেই সে হাল ছেড়ে দেয়। ইস্কুলের পড়া তাই কোন কাজে আসেনি। এরপর বিভিন্ন ধরণের প্রশিক্ষণ মূলক কাজ শিখতে চেষ্টা করেছিল নাড়ুদা। সোনার কাজ, জরির কাজ, ইলেক্ট্রিশিয়ানের সহযোগীর কাজ। কিন্তু কোথাতেও মন বসেনি।
এরপর কোন রঙের মিস্ত্রির সঙ্গে ঘুরে ঘুরে রঙের কাজ করত নাড়ু।
কোন একটি সম্পন্ন বাড়িতে রং করতে গিয়ে সেই বাড়ির মেয়ের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। বাড়ী রং শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও নাকি সেই বাড়ির আশে পাশে ঘোরাঘুরি করত। মেয়েটির কাছ থেকে সাড়া পেয়েছিল কিনা জানা নেই।
তবে কেবল মেয়েটিকে ধাওয়া বা ইশারা করতে গিয়ে ধরা পড়লেই হয়তো ভালো হত। তাতে অন্তত প্রেম পিরিতির একটা আলতো হলেও আড়াল থাকতো।
কিন্তু একদিন বিকেলে গোয়ালাবৌ সে বাড়ির গোয়াল থেকে নাড়ুদাকে উদ্ধার করে। নাড়ু তখন গোয়ালে বাড়ির ছাগলের সঙ্গে সঙ্গমরত।
মেয়েটিকে না পেয়ে ওদের বাড়ির ছাগলের সঙ্গেই সে নিজের কাম চরিতার্থ করছিল। দীর্ঘদিন ধরে কোন বিষয়ে লেগে থাকার যে ধাত নেই নাড়ুর, এটি তার চরম উদাহরণ।
এইভাবে ধরা পড়ার পর যা ঢি ঢি পড়ে গেল তাতে নাড়ুর কাজের বাজারে ভারি বদনাম হয়ে গিয়েছিল। তবে ঘটনাটি নিয়ে পাড়ায় খিল্লি কম হয়নি। শেষে পাড়ার লোকেরাই ধরে রেল লাইনের ধারের বস্তির অনাথ মেয়ের সঙ্গে নাড়ুর বিয়ে দিয়ে দেয়।
সমাজের মানুষের মধ্যে এরকম আমোদগেঁড়েমি রয়েছে। কেউ একটু বেকায়দায় পড়লে তাকে নিয়ে খেলা করার চল রয়েছে আমাদের আশেপাশেই। এতে আর কিছুই হয় না, কেবল নাড়ুদাদের পরিবারে তিনটি খাওয়ার মুখ ক্রমে জুড়ে যায়। বৌটি, আর নাড়ুদার দুটি ছেলে মেয়ে।
নাড়ুদার মা এর মধ্যে কখনো মারা গিয়েছিল। সমস্ত পরিবারটি কেবল ঘণ্টাওলা বাপের পেনসনের ওপর কোনমতে টিঁকেছিল।
আমার বিয়ের পর অনেকবার শুনেছি, পিসেমশাই মারা গেলেই পেনসনটি বন্ধ হবে। আর তখনই গেরস্থের মর্যাদার চাদরটা আর থাকবে না। নাড়ুদার বৌ আর অবিবাহিত বোনকে লোকের বাড়ির বাসন মেজে খেতে হবে।
নাড়ুদার স্ত্রী আর বোন বেবিদিদির নিয়মিত চাউন্তে স্বভাবের জন্য শাশুড়িমাও বিরক্তই ছিলেন। এঁরাও শালাবাবুর একার রোজগারের উপর চলা মধ্যবিত্ত পরিবারই।
শাশুড়িমা রেগে গজগজ করতেন, “নিত্য রোগী দেখে কে? আর নিত্য নেই দেয় কে?”
কালের নিয়মে পিসেমশাই একদিন মারা গেলেন। স্ত্রীর মুখে সেই কথা শুনেছিলাম বটে এবং তার পরিণামে পরিবারটির কী অবস্থা হবে সেই নিয়ে আলগা আলাপ চললেও আদতে ভুলেই গেছিলাম ওদের কথা।
কথাটা উঠল জামাইষষ্ঠীতে নিমন্ত্রণে গিয়ে।
বিকেলের দিকে ওদিক থেকে উচ্চস্বরে চটুল গান ভেসে আসায় শালাবাবুর বৌ রেখাবৌদি চা করতে করতে মুচকি হেসে বলল, “বেবীদিদি এসেছে যে।'’
আমি খানিক অবাক হয়ে শাশুড়ির দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘’বেবীদিদি এসেছে মানে? সে এখন অন্য কোথাও থাকে নাকি!
বৌদি বললেন, “হ্যাঁ। বেবী দিদির তো বিয়ে হয়েছে মাস তিনেক হল। এখন ভালোই আছে ওরা।”
গল্প যা শুনলাম তাকে এদের মাপকাঠিতে রূপকথা বললেও কম হয়।
এদিকে মফস্বলে রাজনীতিতে ভোট উৎসবের একটা নিজস্ব আমেজ আছে।
টিভিতে মুণ্ডু নিয়ে গেণ্ডুয়া খেলার যে ছবি দেখা যায় তা একেবারে হয়না তা নয়। তবে, সে ছাড়াও সারাদিন একটা উৎসবের মেজাজও খেলা করে। সব থেকে বেশি মেজাজে থাকে পার্টির ছোকরা মনসবদারেরা।
বেবিদিদি কদিন হাতে গড়া রুটি বিক্রি করছিল দাওয়ায় বসে। এক ভোটের রাতে সেই গুমটিতে একটা দলের মাংস রুটির অর্ডার ছিল।
সেই ভোটে সরকারি ভোটবাবুদের সঙ্গে রক্ষীপুলিশও এসেছিল দুজন। রাতের রুটি কিনতে তারা এসেছিল বেবীদিদির খোলা বারান্দার গুমটিতে।
বেবিদিদি ভোটপুলিশদের রুটি বিক্রি করার সঙ্গে সঙ্গে ছেলেদের ফিষ্টের মাংস থেকে কিছুটা সেই রাতের অতিথিদের দিয়েছিল। অবশ্য তার জন্য পয়সা নেয়নি, বলেছিল সেটা ফাউ।
ভোট সেবার মিটে গিয়েছিল নির্বিঘ্নে। ভোটবাক্স গুছিয়ে বাবুরা চলেও গিয়েছিলেন।
তবে জানলায় সাঁটানো একাব্যাঁকা পেনের কালি দিয়ে লেখা রুটি ডেলিভারি করার নম্বরে ফোন এসেছিল একদিন। সেই কনস্টেবলদের একজন কখন সেই নম্বরের ফটো তুলে নিয়ে গিয়েছিলো কেউ খুব একটা লক্ষ্য করেনি।
তিনি বেবিদিদিকে বিয়ে করতে চেয়ে যোগাযোগ করেন।
ভদ্রলোক বিপত্নীক। দক্ষিণের সাগরঘেঁষা জেলার কোন এক প্রান্তিক গ্রামে বাড়ি। জমি জিরেত আছে। মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। কিন্তু স্ত্রীর মৃত্যুর পর বছর বারোর ছেলেটিকে নিয়ে সমস্যায় পড়েছেন। তাঁর রান্না আর রাঁধুনি দুইই পছন্দ হয়েছে। কেবলমাত্র যৌনতা ছাড়াও আরও বিবিধ পাঁচমেশালী বিষয় এভাবেই বিয়ে থা’র উদ্দেশ্যের মধ্যে ঢুকে থাকে।
নাড়ুদা প্রথমটায় ঠিক রাজী হচ্ছিল না।
একে তো চেনাজানা কেউ নয়। আজকাল কী না হয়! হয়তো মানুষটাকেই বেচে দিল। বা নিতান্ত কিডনি কেটে নিল। তাছাড়া উতসাহ নিয়ে খোঁজখবর করে বোনের বিয়ে দেবার উদ্যোগও ছিলনা।
যেমনি চলছে তেমনি না চললেই ভারি অসুবিধে হয় নাড়ুদার।
কিন্তু এবার বেবিদিদি উদ্যোগী হয়।
সে একবার নিজের ভাগ্য পরখের এই সুযোগ ছেড়ে দিতে চায়নি। দোজবরে হলেও নিজের সংসারের একটা চাহিদা তো থেকেই যায়। আর এখানেও তাহলে একটা খাওয়ার মুখ কমে।
সামান্য আয়োজনে বিয়ে হয়ে গেছিল।
এখন অব্দি সব ভালই হয়েছে। পুলিশ জামাইবাবু নাড়ুদাকেও একটা কাজ পাইয়ে দিয়েছে।
কোন মোটরগাড়ির শোরুমে রাতে থাকতে হয় নাড়ুদাকে। বাইরে পাহারা থাকলেও মালিক ভিতরেও একজন কেয়ারটেকার রাখতে চান। সেখানেই রাতে নাড়ুদা থাকে, ঘুমোয়। যা মাইনে পায় অন্তত দুবেলার ভাতটা জুটছে।
বৌদিও রুটি বিক্রি করছেন। সেটিই আসল লক্ষ্মী কি না!
জামাইবাবু আলাদা গ্যাস কিনে দিয়েছেন। জোরদার লাইট লাগিয়ে রুটির দোকানটাকে ঝকঝকে করে সাজিয়ে দিয়েছেন। সুখ আলো চিনে এসে ঢুকেছে বেবিদিদি, নাড়ুদাদের ডুবন্ত সংসারে।
মোটামুটি এখন সোনার সংসার বলা যেতে পারে।
বেবি দিদি যখন আসে খেতের কলা-মুলো-শাক-তরকারী খুব আনে। ছোট ছেলেটাও নতুন মায়ের ন্যাওটা হয়েছে বেশ।
এঁদেরও দিয়ে গেছেন সেইসব শাক, সব্জি, মধু।
রেখাবৌদি বলল,’’ বেবিদিদির দেওয়ার হাত খুব।’’
তা খানিক আশ্চর্যের, খানিক রোমাঞ্চকরও বটে। একেবারে ডুবে যেতে বসা পরিবারের চাউন্তে বেবীদিদি কী ভাবে হাত খুলে কলা মুলো পেঁপে দান করছে, সে এক তাজ্জব।
শাশুড়িমাকে এক শিশি সুন্দরবনের খাঁটি মধু দিয়েছে বেবীদিদি।
সত্যিই সে আগের শ্রমিক মৌমাছির খোলসটি ছেড়ে নতুন মৌচাকের রাণী হয়েছে বটে।
গিন্নির মাথায় নাড়ুদাদের এই শাপমোচনের ইতিবৃত্তটি ঘুরছিল বোধহয়।
কিন্তু নাড়ুদার অপকর্ম, অকর্মন্মণ্যতার দায় আর শ্রীলতার বোধহীন অপারগতা এক নয়। একভাবে সেই সমস্যার সমাধানও হবার নয়।
তবে, জীবন অবশ্যই এক অদ্ভুত মৌচাক।
খোপে খোপে ভরে রাখে জীবনধারণের গ্লানি, টিঁকে থাকার জন্য মানুষের প্রতিদিনের মরণপণ চেষ্টার ইতিহাস।
প্রতিটি মুহূর্তের শ্রম শুষে নিয়ে, সমস্ত স্বেদ-রক্ত বিন্দুর স্বাদ বুঝে নিয়ে সে তবেই একবিন্দু সুখের মধু উপহার দেয়।
আমিও সেই মধুরই আশায় ব্যস্ত পড়েছি সংসারে। মিহির নাচ-ইস্কুল-রোগ-ব্যধি ইত্যাদি, খোকার পরীক্ষা, আমার স্কুলের বিবিধ কাজকর্ম যেন দায়িত্বের চাঁদোয়া বানিয়ে দৃষ্টিকে সংকীর্ণ করে ফেলেছে। এই ঘেরাটোপের বাইরে কারা পড়ে রইল তাদের খবর আর রাখা হয়না।
সময় যে দু শালিখের মত মুহূর্ত খুঁটে খেয়ে চলেছে খেয়াল করিনি। দিন চলে গেছে।
সেদিন বিকেলের দিকে সামান্য অন্যমনস্ক ছিলাম। স্কুলের দুই সহকর্মীকে কাল থেকে আর আসতে বারণ করা হয়েছে।
স্কুলে যে কেবল বর্ষে, বর্ষে, দলে দলে ছাত্ররাই আসেন বা যান তা তো নয়, নির্দিষ্ট সময় অন্তর শিক্ষকরাও বিদায় নেন। আবার নতুনেরা এসে যোগদান করেন।
এদের অবশ্য অবসরের বয়স হয়নি, এরা চাকরিচ্যুত।
নিয়োগের সময়েই কি সব কারচুপি হয়েছিল। কোর্টের নির্দেশে এখন এদের চাকরি নিয়ে টানাটানি পড়েছে।
যাবার সময় একজন বলে গেল, “বাড়িতে ছেলেটার চোখের দিকে কী করে তাকাবো বলুন তো? লজ্জায় মাথা তুলতে পারছি না। আমাদের কী দোষ?”
ভাঙাচোরা মানুষগুলো চলে গেলো।
তাদের মুখের দিকে তাকাতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল আমরা সবাই ধরদার মেয়ে শ্রীলতার মত। পরিস্থিতি আমাদের ধরবৌদির মত নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে।
আজ বিকেলে টিভিতে সেই খবরটাই দেখাচ্ছিল।
“ছি ছি, আমাদের সময় এই ধরণের টিচার ছিলনা” রুক্ষভাবে খোকা বলে উঠল।
আমি অন্যমনস্ক থাকায় কথাটা ঠিক শুনতে না পেয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। ও বুঝতে পেরে, আবার বলে উঠল, “বুঝলে না? শিক্ষক বলতেই মানুষের মনে যে রেসপেক্ট থাকতো সেটা আর করা যাচ্ছে না।”
“হুম”, ওর কথার বিরোধিতা করলাম না। চারিদিকে বিবিধ খবরের হররা ছুটেছে। যে যার মত করে মতামত তৈরি করে নিচ্ছে।
তবে খোকার মুখে ‘আমাদের সময়’ কথাটা শুনে ওর দিকে তাকিয়ে দেখলাম। কয়েক বছর হল ওর স্কুলজীবন শেষ হয়েছে।
সত্যি তো, খোকারও ‘আমাদের সময়’ বলার মত স্মৃতির পুঁজি তৈরি হয়েছে তাহলে।
খোকার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি প্রাক যৌবনের সবজে চিবুকে অনভিজ্ঞ দাড়ি। জিন্স আর ফতুয়ার মধ্যে যেন ভবিষ্যতের লম্বা দৌড়ের শক্তি চুপ করে বসে আছে।
কখন যে আমার খোকা এত বড় হয়ে গেছে।
দরজায় শব্দ শুনে মুখ ঘোরাতেই দেখি দরজার ওপরে দাদুর ছবির মারজিনে ছোপ ছোপ দাগ পড়েছে। হয়তো স্যাঁতসেঁতে আর্দ্রতার, হয়তো সময়ের বা হয়তো অবহেলার।
সেইসময়ে দরজা দিয়ে ঘেমে নেয়ে গিন্নি কোথা থেকে এসে ঢুকল।
“চা করছি, একটু পরে। খুব হাঁপিয়ে গেছি।”, বলেই সোফায় বসে পড়ল।
খোকা সিলিং ফ্যানের সুইচ অন করতে করতে বলল, “ তা, না হয় হবে। কিন্তু তুমি দুপুরবেলা থেকে কোথায় গায়ের হয়ে ছিলে শুনি?”
“ঐ কনকদের বাড়ি’রে। বৌদি ডাকল। আজ শ্রীলতার বিয়ের পাকাকথা মিটে গেল।” বলে গিন্নি চোরা চোখে একবার আমার দিকে তাকিয়ে নিল।
হয়তো, বহুবছর আগের শ্রীলতার বিয়ের বিষয়ে সেইসব কথাবার্তা হয়তো তার মনে পড়ে গেল।
আমি আর চমকে উঠলাম না। একদিন তো এ হওয়ারই ছিল।
খোকা অন্যমনস্ক ভাবে বলল, “আরে শ্রীদিদি কী ওসব বিয়ে ফিয়ের ভ্যাজর নিতে পারবে?” বলে সে নিজের ঘরের দিকে চলে গেল।
আমরা দুজনে চুপচাপ সোফায় বসে রইলাম।
বিয়ে হয়ে গেল শ্রীলতার। ঘরোয়া ভাবেই।
কনকের বিয়েতে ধরদা যা জাঁকজমক করেছিল এবারে তার মত হলনা। ঐ কয়েকজন ঘনিষ্ঠ আত্মীয় ছিলেন। প্রতিবেশী বলতেও পাড়ার দু’এক ঘর।
বৌদি যেমন ভাবে নির্দেশ দিলেন, বিয়ের আচারে শ্রীলতা সে ভাবেই উঠল, বসল, দাঁড়াল। ওকে জমকালো শাড়িতে মোড়া মাটির পুতুলের মত দেখতে লাগছিল।
জামাই ছেলেটি বৌদির বোনের শ্বশুরবাড়ীর আত্মীয়, অনাথ। এখানেই থাকবে ওরা বিয়ের পর।
একটা ওষুধের দোকানের কাউন্টারে বসার ব্যবস্থা করেছেন দাদা।
এখন জামাইকে দেখি নিয়মমতো সাইকেলে যায়, ফেরে।
চলন্ত মূর্তির মত শ্রীলতার সঙ্গে দু একবার ঘুরতেও দেখেছি তাকে।
গিন্নির কাছে শুনলাম, ধরবৌদি ওদের সারা দিনের রুটিন বেঁধে দিয়েছেন। শ্রীলতা বা ওর বর কখন, কে সংসারের কোন কাজ করবে।বা দোকান ছুটি থাকলে কবে এবং কোথায় শ্রীলতাকে নিয়ে ছেলেটি বেড়াতে যাবে।
ওরাও সেই অনুযায়ীই সংসার করে বা সংসারে থাকে।
ছেলেটিও নাকি বেশ মানিয়ে নিয়েছে।
একদিন চা খাচ্ছিলাম সেই উঠোন লাগোয়া বারান্দায়। বিকেলের আলো মরে এসেছে। একটা নেউল হুড়মুড়িয়ে দৌড়ে চলে গেল। হয়তো বৃষ্টি হবে, বাতাসে গুমোট।
ধরদা’র বাড়ির দিক থেকে কথা ভেসে এল।
গলার স্বর শুনতে পেলাম, “বাকি জামাকাপড়গুলো তুলে নিয়ে এসো, শ্রী। ক্লিপগুলোও তুলে আনবে।’’
এবারে ভরাট কন্ঠ। যুবক পুরুষের।