এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ইস্পেশাল  উৎসব  ইস্পেশাল

  • দুই ঘর

    উপল মুখোপাধ্যায়
    ইস্পেশাল | উৎসব | ০১ অক্টোবর ২০২৫ | ১৬৫ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • অলংকরণ: রমিত 




    গাছটার তলায় বিজয়দা পড়ে আছে। পাইন গাছ, বহু পুরনো, তার শেকড় তলা থেকে বেরিয়ে গিয়ে গিয়ে জল আনতে যায় আর দেখে জল আনার জন্য বোধহয় সব জায়গায় খুঁজতে হবে। নীচে, মধ্যে, পাশে, আশপাশে এমনকি মাটির ওপরেও। তাই তারা মাটির ওপরেও উঠে পড়েছে, তারাও অদ্ভুতভাবে বিজয়দাকে ঘিরে রয়েছে। পাখিরা শিস দিচ্ছে। পাখিরাও শিস দেয় এটা বোঝার জন্য পাখিদের নাম মুখস্থ করতে হচ্ছে। অথচ বিজয়দা পড়েই আছে। পাইন গাছটা দেখে দেখে বার বার দেখতে লেগেছি যতবার তাকাচ্ছি মাটির ওপর জেগে থাকা ওর বড় বড় শেকড় দেখতে পাচ্ছি। অল্প কুয়াশা চাদরে ঘিরে রয়েছে চারপাশ। সূর্য উঠে বাতাস হাল্কা করে দিতে পারছে না। সিংকোনার ছাল গাদা হয়ে পড়ে আছে। সরু সরু সিংকোনার গাছ পাহাড়ের ঢালু দিয়ে গজিয়ে রয়েছে। তারা যে কোন সময় পড়ে যেতে পারে এ কথা পাইন গাছটা জানে তাই তারা এত বড় বড় হয় আর সব দিকে শেকড়দের পাঠিয়ে দিয়ে মাটি ও পাহাড়কে ধরে রাখে। জল এলে জল শুষে নেয়। তারা কি সেই সব জলেদের কুয়াশার মতো হাল্কা করে দিচ্ছে? ভারী ভারী জল গাছেদের খপ্পরে পড়ে কুয়াশা বা তার মতো একটা কিছু হবেই একি ঠিক করা আছে? নইলে পাইন গাছটা যেখানে যেখানে ঘন ও বড় বড় হয়ে প্রাচীনতম হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে দেখছি সেখানে সব সময় কুয়াশা হবে কেন? নবকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘সব সময় কুয়াশা হয় কেন?’
    -হয়।
    -গাছ আছে বলে?
    -উল্টোটাও হতে পারে কুয়াশা আছে বলে গাছ হয়।
    -গাছেদের অনেক আগেও কুয়াশা ছিল?

    নব চুপ করে থাকল। বন্ধুদের নাম করতে নেই। নাম লিখতে নেই বন্ধুদের তবু নবর নাম লিখে ফেলেছিলাম। ভুল করলাম কি? বিজয়দার নামও লিখেছি, দেখছি ও পড়ে আছে। কুয়াশা ঘন হলে দেখা যাচ্ছে না। ঘন কুয়াশার মধ্যে দেখতে পাচ্ছি। সূর্যের অভাব অনুভব করলেই দৃষ্টি আরো তীক্ষ্ণ হচ্ছে তখনই সব দেখতে পাচ্ছি। কুয়াশা ভেদ করে সিংকোনার বাকল মাথায় বেঁধে নিয়ে একজন চলে গেল। সে যেন কুয়াশাকে সঙ্গে নিয়ে গেল আর আমি দেখছি বিজয়দার মাথায় টুপি। সে পড়ে আছে, অদ্ভুত একটা টুপি পরেছে। সেই ঝোপের মধ্যে দিয়ে কুয়াশার আগে পড়ে রয়েছে। তারপর থেকে কুয়াশার অঞ্চল শুরু হয়েছে। সেখানে সব আবছা। কিছু দেখা যায় না। দেখা দিয়েই আবার আবছা হয়ে যায়। বিজয়দার সারা শরীরটা পাইনের জেগে জেগে ওঠা শেকড়ের ভেতর বেঁকে টেকে পড়ে আছে। একটা প্যান্টও দেখছি, জামাও--- তাদের রঙও স্পষ্ট নয়। কুয়াশার মধ্যে সেটা আরো অস্পষ্ট লাগছে। সময় বোঝার চেষ্টা করছি। নব আর আমি টিলার ওপর দিয়ে হাঁটছিলাম। পাহাড়ের ওপর এত বড় চাতাল পাওয়া মুশকিল। পেলেই ওপর থেকে অনেক নীচে দেখা যাবে। ওই চাতালের ওপর এঁকে বেকে চলেছে কাঠের বাংলো। আমরা কাল সকালে সকালে উঠেছিলাম। আজ রাতের জন্য অপেক্ষা করছি সেই সকাল থেকে। আজ রাতেও আমরা এই চাতালের ওপর, পাহাড়ের ওপর থাকব। কাল কলে জল ছিল না। জল না থাকার জন্য আমাদের খুব অসুবিধা হচ্ছিল। জল না পেলে আমরা বাংলোর কথা মনে করতে পারছিলাম না। পাহাড়, পাইন গাছ, এতো বড় চাতাল সব ভুলে গিয়েছিলাম। শুধু সিংকোনার কথা ভুলতে পারিনি কারণ দুটো ঘরে সিংকোনার দুটো রকমের নামে চিহ্নিত ছিল লেডজেরিএনা আর সুসিরুব্রা। খাবার জন্য জল আনতে গিয়েছিল টুবাই। সে অনেক রকম জলের বোতল নিয়ে এসেছিল আর ফিরে এসে বলল, ‘একশো বাইশ বছরের পুরনো একটা দোকান দেখলাম।’
    -কোথায়?
    -এই পাহাড় থেকে একটু নেমে।
    -সেখানে কী পেলি?
    -সব পেলাম সেখানে।
    -সব?
    -হ্যাঁ। গরম মশলা। পেঁয়াজ , আদা, প্যাকেজড জল সব পাওয়া যায়। আর হ্যাঁ চিজও পাওয়া যায়। খাবে, আমূলের চিজ।
    -আমূলের?
    -হ্যাঁ, আমূলের চিজও পাওয়া যায়।
    -কালিম্পংয়ের দেশি চিজ?
    -সে পাওয়া যায় না।
    -জিজ্ঞেস করেছিলি।
    -না, নিজেই বলল কালিম্পংয়ের চিজ পাওয়া যায় না।
    -সেকি!
    -একটু খাবে?
    -দে।

    চিজটা একটু একটু করে কাল সন্ধেবেলা থেকে খেয়েছি, খানিকটা রেখে দিয়েছিলাম ব্যাগের ভেতর। কাল মদ টদ খেয়ে সুসিরুব্রা নামের ঘরটাতে ঘুমিয়েছিলাম আমি আর নব, কে যেন একজন রাতে আমার পাশে শুয়ে আছে বলে মনে হচ্ছিল। পাশ ফিরে কাউকে দেখতে পাইনি। কোন একটা কোণ থেকে কিছু আওয়াজ আসছিল। সেটা কি কারু নিশ্বাসের শব্দ নাকি আমি নিজের নিশ্বাসের শব্দ নিজেই পেতে আরম্ভ করেছি কাল ভোর রাত থেকে ? কোনও গন্ধ পাওয়া যাবে কিনা বুঝতে বেশ সকাল সকাল প্রশস্ত চাতাল ঘুরতে বেরিয়ে দেখি নব আগেই ক্যামেরা নিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখতে বেরিয়ে গেছে। আমি নবকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কাল রাতে তোর বিছানার পাশে কেউ শুয়েছিল কি ?’ নব কোন উত্তর না দিয়ে অনেক ওপর থেকে তিস্তার ছবি তুলছিল। তিস্তাকে দেখলাম বেশ নিচু দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। জুম লেন্সে তাকিয়ে থাকলে তার জলের বয়ে যাওয়া দেখা যাবে ও বোঝা যাবে কোন হিমালয়ান ব্ল্যাক বিয়ার ভালুক তার আশপাশ দিয়ে চলছে কিনা। ক্যামেরা নবর হাতে থাকায় আমি ওসব কিছুই দেখতে পাইনি কেবল একটা সুতোর মতো আবছায়া কিছু উঠছে নামছে বলে আঁকা আছে আর তাতে নদীর চলাটলা বোঝায় না। কেবল রেখা যা দেখে নেশা লাগে না বরং আর একটু একটু করে সিংকোনার রোগা রোগা গাছেদের দিকে চোখ চলে গেল আর অনেক নিচে এক রাস্তা দিয়ে একটা ট্রাক চলাচল করছে বলে স্পষ্ট দেখতে পেলাম। ক্রমশ রাস্তাটা ও ট্রাকটা আরো স্পষ্ট হওয়ায় আমি বাড়ি ফেরার আতঙ্কে সরে যাই সেখান থেকে। রাস্তা আমাকে টানতে টানতে নিয়ে যেতে চায়। নব এক মনে ক্যামেরায় চোখ রেখেছিল। ট্রি হাউজে সিঁড়ির ঠিক তলায় লেখা আছে কোন কোন আমলা এই ট্রি হাউসটা উদ্বোধন করে গেছে অথচ তা খোলার কোন উপায়ই নেই। আমরা থাকতে থাকতে রাস্তার টান অমোঘ হওয়ায় একটা অদ্ভুত আর্তনাদ বেরিয়ে এসেছে। সেই শুনে নব বলল, ‘কী বলছিস?’ আমি বললাম, ‘কাল রাতে তোর বিছানার পাশে কেউ শুয়েছিল কি ?’ এবার নব মনোযোগ দিয়ে শুনে বলে উঠল, ‘ওটা স্বাভাবিক।’
    -কোনটা?
    -সুসিরুব্রায় শুলে ওরকম আগেও হয়েছিল।
    -তুই আগেও এসেছিস।
    -আসিনি তবে শুনেছি।
    -শুনেছিস?
    -পড়েওছিলাম।
    -কোথায়?
    -মনে করতে পারছি না।
    -অনেক পুরনো জায়গা তাই না?
    -একশো তিরিশ বছরের।
    -এতো।
    -হ্যাঁ, কাল যে দোকানটায় গেলাম সেটাই তো একশো বাইশ বলছে।

    আমার মনে পড়ে গেল চিজটা একটু একটু করে খেয়ে বাকিটা রাখাই আছে। কোথায় রেখেছি মনে করতে পারছি না। তাই ঘরের দিকে গেলাম। ঢোকার মুখে দেখছি বড় বড় করে ঘরটার নাম লেখা আছে সুসিরুব্রা। এ ঘরটা অদ্ভুত নিঃশব্দ। চার দিকে কাচের জানালা বাইরে চাতাল থেকে ঘন কুয়াশা ঢুকে পড়তে পারে সঙ্গে ঢাল বরাবর পাইন গাছের মোটাসোটা গুঁড়ি ছোঁয়া হাওয়া। সেই হাওয়ার সঙ্গে ছায়ারাও ঘরটার ভেতর ঢুকে পড়ে। পর্দা ফেলে দিলেও একটা অদ্ভুত আলো ঘরটা জুড়ে রয়েছে। দেওয়াল বেয়ে টিকটিকির মতো উঠতে চেষ্টা করে দেখেছি কোথাও টিকটিকি নেই। রাতে শুধু হাওয়ার আওয়াজ শোনা যায়। সারা বছরই ঠাণ্ডা থাকে বলে কোন পাখার ব্যবস্থা নেই। আগে কি টানা পাখা ছিল? তাই বা থাকবে কেন পাঁচ হাজার ফুট উচ্চতার এইখানে কখনও গরম ছিল না। একশো ত্রিশ বছর আগেও না নব্বই আশি সত্তর বছর আগেও না। ছাদ অবধি তাকাতে গিয়ে পাইন গাছের উচ্চতার কথা মনে পড়েছে। তার শেকড়ের কথা মনে পড়েছে। ব্যাগ থেকে চিজের টুকরো বার করে খানিকটা খেলাম। বিজয়দা কি এখনও গাছটার তলায় পড়ে আছে? সুসিরুব্রা থেকে বেরিয়ে ওদের ঘরটায় গেলাম। ওটার নাম লেখা থাকে লেডজেরিএনা। বড় বড় করে লেখা। সেটাও সিংকোনার আর একটা রকম। এ রকম নাকি চব্বিশটা রকম আছে। এই ঘরটায় বিজয়দা, বাবাই আর টুবাই থাকছে। বেশ বড়সড় ঘর। এখন কেউ নেই। সুসিরুব্রার মতো এটাও কাচের বড় বড় জানলা দিয়ে ঘেরা। অনেক উঁচু উঁচু দেওয়ালের তলায় ফায়ার প্লেস বয়েছে। দেওয়ালের ওপর একটা ছোট মতো টিকটিকি দেখছি। সেটা ফায়ার প্লেসের দিকে সড়সড় করে নেমে এলো। ফায়ার প্লেসে বেশ কিছু ছাই পড়ে রয়েছে। দু একটা পোড়া কাঠ যাদের কী ভাবে বর্ণনা করে বুঝতেই পারছিনা। টিকটিকিটা পোড়া কাঠের মধ্যে ঢুকে গেল। কাছে গিয়ে দেখছি ছাই আর কাঠের মধ্যে ওটা আমার দিকে দেখছে। ছোট ছোট চোখ-দিয়ে এক দৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছে আর আমি কিছুতেই ফায়ার প্লেসের কাছ থেকে সরতে পারছি না। শুধু ছাই দেখছি, সম্প্রতি যা পোড়ানো হয়েছে সেই কাঠের টুকরো দেখছি। কত ঠাণ্ডা পড়েছিল যে ফায়ার প্লেসে আগুন দিতে হয়েছিল? কত ঠাণ্ডা পড়লে ফায়ার প্লেসে আগুন দিতে হয়? বাইরে কাঠ চেরা ইলেকট্রিক করাতের তীক্ষ্ণ আওয়াজে হুঁশ ফিরছে। চারপাশ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিলাম লেডজেরিএনা ঘরটা অনেক বড়। পেল্লায় খাটের ওপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে জিনিসপত্র পড়ে আছে। বাবাইয়ের আন্ডার প্যান্ট, গেঞ্জি আর বিজয়দার গলার মাফলারটা পড়ে থাকতে দেখেছি। বাবাই ঘরে ঢুকল। আমাকে দেখে বলল, ‘দেখেছো?
    -কী?
    -চারজন কাঠের মিস্ত্রি এসেছে।
    -কোথায়?
    -এখানে। বাংলোর কাঠের কাজ করতে।
    -ও।
    -এখানেই থাকছে।
    -খাচ্ছে কোথায়?
    -এখানেই।
    -জলের কী হচ্ছে?
    -জল?
    -জলের তো সাপ্লাই নেই।
    -ওরা নিজেরাই ট্যাংক থেকে জল তোলে।
    -বিজয়দাকে দেখলি?
    -না তো। কোথায়?
    -পাইন গাছের তলায় পড়ে আছে।
    -কী করে বুঝলে?
    -একটা টুপি দেখলাম।
    -টুপি?
    -একজন টুপি মাথায় দিয়ে পড়ে আছে গাছতলায়।
    -সেকি!
    -হ্যাঁ পাইন গাছের বড় বড় শেকড় সব রাস্তায়--- জেগে রয়েছে তার মধ্যে।
    -হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল না তো।
    -কেমন গুটিয়ে শুটিয়ে। পড়ে রয়েছে। পুরোটা দেখাও যাচ্ছে না।
    -ওখানে তুমি কাছে গিয়েছিলে?
    -না ওপর থেকে দেখেছি। পুরোটা বোঝা যাচ্ছে না।
    -কাছে গেলে না?
    - অনেকটা ঢাল বেয়ে নেমে গিয়েছিল মনে হয়। রাস্তার ধারেই পাইন গাছটা খুব পুরনো।
    -এখানে সব গাছই পুরনো। নেমে দেখলে না কেন?
    -ভালো করে দেখতেই পারছিলাম না। কুয়াশায় ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। মাঝে মধ্যে কুয়াশা কাটছে।
    -কাছে গেলে না কেন?
    -বুঝতেই পারছিলাম না।
    -কী ?
    -কী করব বুঝতেই পারছিলাম না। তবে টুপিটা দেখেছি।
    -ওটা বিজয়দার টুপি এটা বুঝলে কী করে?
    -পুরোটা বুঝিনি।

    বাবাই লেডজেরিএনা থেকে ছুটে বেরিয়ে গেল। আমিও বেরিয়ে পড়ি তবে সুসিরুব্রায় ঢুকিনি। ভাবছিলাম একটা ঘরে ফায়ার প্লেস আছে, পোড়া কাঠ ও ছাই আছে অন্যটায় নেই কেন? দুটো ঘরের মধ্যিখানে বসার জায়গা আছে সেখানে সোফা রয়েছে কৌচ আছে। সোফাটার স্প্রিং ঠিক নেই। কৌচ দুটো ঠিকঠাক রয়েছে। মধ্যিখানে সেন্ট্রাল টেবিল পাতা। তার ওপর কালকের খাওয়া সিগারেটের টুকরো পড়ে আছে। মদের গেলাস পড়ে আছে। মদ পড়ে আছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। দুটো ঘরের মাঝখানে জায়গাটার কোন নাম দেয়নি। কাল মদ খেতে খেতে যা কথা হল , সে সব একটু একটু করে শোনা যাচ্ছে। দু ঘরের মাঝের জায়গাটায় সব কথা মিলিয়ে গিয়েছিল বলে মনে হচ্ছিল আসলে মেলায় নি। যে সব খাবার দেওয়া হয়েছিল মদের সঙ্গে সে সবের টুকরো খাবার জন্য একটু ছোট পাহাড়ি কুকুর ঢুকে পড়েছিল। বাবাই কুকুর দেখে লাফিয়ে উঠেছিল। নব ওকে বলল, ‘কুকুর দেখে লাফিয়ে ওঠার কী আছে?
    -নেই।
    -না।
    -তা বলে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়বে।
    -ওরা এতে অভ্যস্ত।
    -কিসে?
    -মাঝেমধ্যেই আসে।
    -কেন আসবে?

    নব ওকে বোঝানোর চেষ্টা করেও লাভ হয়নি। অনেকগুলো কুকুর আছে তার মধ্যে সবচেয়ে ছোটখাট কুকুরটা বার বারই দুটো ঘরের মাঝটায় এসে পড়ছিল। সব সময় বাবাইয়ের চোখে পড়েনি। দেখছি ওই কুকুরটাই আবার ঢুকে এসেছে। লেডজেরিএনা আর সুসিরুব্রার মাঝে দাঁড়িয়ে আছি। কুকুরটাকে দেখে কৌচে বসে পড়লাম আর ও ছোট ছোট পাটা আমার গায়ে তুলে দিয়েছে। কুঁই কুঁই আওয়াজ করছে, আদর খেতে চাইছে। বুক পকেট থেকে একটু ছোট চিজের টুকরো বার করে দিয়েছি। বেঁটে ছোট পাহাড়ি কুকুর একটু চেটে চেটে দেখছে কেমন লাগছে চিজ। একটু খেল কি ? খেতেও পারে চিজের টুকরো। বাংলোতে ঢুকেই সামনের দিকটা অনেকটা সদরের মতো। সেখানে অনেক চেয়ার পাতা আছে। বাইরে ছোট ছোট কাচ দেওয়া জানলা সেখান দিয়ে শত বছরের পুরনো পাইন গাছের গুঁড়ি দেখা যাচ্ছে। কুকুরটা তার অনেক সঙ্গীসাথী নিয়ে ওইসব বড় বড় পাইন গাছের তলায় ঘর সংসার করে। আর থাকে বাংলোর পেছন দিকে কোয়ার্টারে সেখানে তার জন্য বিছানা পাতা আছে, খাবার আছে, অনেক জায়গা রাখা আছে। মাঝেমাঝে দলের মধ্যে এক মাত্র ওই বাংলোয় ঢুকে পড়ে, বাকি কুকুররা তাকিয়ে দেখে ও ঢুকছে। তারপর ও এসেছে দুই ঘরের মাঝখানে। দুই ঘরের দুই নামের মধ্যিখানে যখন দাঁড়ায় সেই জায়গাটা তার হয়ে যায়। তখন তার গন্ধ সব জায়গায় পাওয়া যায়, আওয়াজও। আমি কৌচে বসে থাকতে থাকতে কুকুরটা আমায় ছেড়ে চলে যাচ্ছে, ডাকলেও আসছে না। ও কি দরজার বাইরে চলে গেল, বাংলোর বাইরে ? অথচ বাইরে যাবার আওয়াজ শুনতেই পাচ্ছি না। ক্যাঁচ করে দরজাটা খুলে যাবার আওয়াজ শুনলাম। নব ঢুকে এল। তার হাতে এক পাহাড়ি ফুলের গাছ টবের মধ্যে বসানো। ফুল ফুটে রয়েছে। যার গন্ধ পাচ্ছি না। নবকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তবে কি কুকুরটা আসেনি?
    -কোন কুকুর?
    -ছোট্ট মতো যে কুকুরটা কাল ঢুকে পড়েছিল?
    -ও কাল।
    -আজও এসেছিল।
    -তাতে কী ?
    -ঢুকল কী করে আর বেরলেই বা কখন ?
    -তুই দেখিস নি।
    -আমি তো গাছটা আনতে পেছনের স্টাফ কোয়ার্টাসে গিয়েছিলাম।
    -কিন্তু আমি এতক্ষণ আদর করছিলাম যে।
    -কাকে ?
    -ছোট্ট মতো দেখতে কুকুরটাকে যাকে কাল রাতে আমাদের খাবার পর উচ্ছিষ্ট দেওয়া হয়েছিল।
    -ও রকম হয়।
    -মানে?
    -বোঝা যায় না। কখন আসবে, যাবে।
    -রান্না ঘর দিয়ে চলে যায়নি তো ?
    -সে তো তুই বলতে পারবি ?
    -ব্রেকফাস্ট তৈরি হল ?
    -দেখছি। বিজয়দা ফিরেছে ?
    -কে জানে ? দেখতে পাচ্ছি না তো।
    -কোথায় পড়ে আছে ?
    -নিচের ঢালু রাস্তায়। বড় পাইন গাছের গোড়ায়।
    -বাবাই গেছে ডাকতে, টুবাইও গেছে বোধহয়। তোর ওই ফুলটায় গন্ধ নেই ?
    -এটায় গন্ধ প্রায় নেই বলা যায়।
    -আমি তো গন্ধই পেলাম না।
    -কিন্তু খিদে পেয়েছে বড্ড।
    -বিজয়দা আসুক।
    -এমনিই চলে আসবে ?
    -কেমন করে বলব ?
    -পড়ে থাকতে দেখলি ?
    -বেশ কিছুক্ষণ আগে দেখেছিলাম।
    -আবার দেখি চল।
    -চল।

    আমি আর নব হাঁটা শুরু করলাম। প্রথমে একটা পাইন গাছ আমাদের আড় চোখে দেখছিল এটা বুঝতে পেরেছি। সে বিরাট শরীর নিয়ে তাকিয়েছিল। আমি ভাবছিলাম এর চোখটা কোথায় লুকিয়ে রেখেছে। লুকিয়ে না রাখলে তো চোখাচোখি হতই। তবে চোখাচোখি হতই এ কথা নিশ্চিত বলা যায় কি ? মানুষের সঙ্গে প্রায়ই চোখাচোখি হত এখন সেসব অতীত হয়ে গেছে আজ কাউকে দেখতেই পারছি না। তবে নবকে দেখতে পারছিলাম। দেখলাম গাছটা দেখছে আর তার চোখ আছে সর্বত্র। নবকে জিজ্ঞেস করছি, ‘নব'।
    -কী ?
    -দেখছিস ?
    -কাকে ?
    -গাছ।
    -হ্যাঁ।
    -দেখছে।
    -কাকে ?
    -তাকিয়ে আছে।
    -কোথায় ?
    -সব জায়গায়।
    -কোথায় ?
    -এই দেখা যাচ্ছে।
    -কী করে ?
    -দেখছি।
    -কী করে ?
    -দেখছি।
    -দেখছিস ?
    -হ্যাঁ।
    -কী ?
    -গাছ।
    -কী ?
    -দেখছে।
    -কাকে ?
    -দেখছে।
    -কাকে ?
    -সব জায়গায়, সবাইকে, দেখছে, সব দিক দিয়ে দেখছে।
    -কেন এরকম করছে ?
    -গাছ কেন এরকম করে ?

    এইসব বলছি আর যাচ্ছি কোথায় যেন ? এই ভেবে নবকে জিজ্ঞেস করতে যাব এমন সময় হাওয়া দিল আর মেঘ সরে সরে গিয়ে পরিষ্কার দেখা গেল ঢালু পথ বেয়ে ওরা তিনজন উঠে আসছে। বিজয়দা, বাবাই আর টুবাই। তাদের সামনে দিয়ে সেই ছোট্ট পাড়াড়ি কুকুরগুলোও আসছিল। বাবাই আমাদের দেখতে পেয়ে অন্য দিকে তাকাল। সে সেইদিকে তাকাচ্ছে যে দিকে সিংকোনা প্ল্যান্টেশন হয়েছে কিনা বুঝতে পারছিলাম না। বিজয়দা হাসি হাসি মুখ করে বাবাইয়ের সঙ্গে কথা বলাবলি করছে এটা মেঘ সরে যেতে হাল্কা হাওয়ার মতো ঘুরে আমাদের কাছে চলে আসাতে নবকে বলেছি, ‘দেখলি তো ?’
    -আমি আগেই জানতাম।
    -জানতিস ?
    -হ্যাঁ।
    -ঐ রকম আগেও করেছে।
    -দেখে মনে হচ্ছিল বোধহয়...
    -মরেই গেছে।
    -ঠিক তাই।
    -আগেও করতে দেখেছি
    -কাকে ?
    -বিজয়দাকে।
    -তাই ?
    -এরকমই করে।
    -ড্রামা করে ?
    -তা জানি না।

    আমি বিজয়দাকে জিজ্ঞেস করেছি ‘কী করে পড়ে গেলে ওরকম করে ? পা-টা একদম ছেতরে। মাথার টুপিটা এক হাত দিয়ে কোন রকমে আটকে, শেকড়গুলোর মধ্যে এঁকে বেঁকে শুয়ে রইলে ঘন্টার পর ঘন্টা।’
    বিজয়দা বলল, ‘তোর বলা শেষ হয়েছে।’
    আমি বললাম, ‘তুমি কী করেছ জান ?’
    -কী করেছি ?
    -সবাই ভাবছিল একটা কিছু ঘটিয়ে বসে আছ।
    -কে ভাবছিল ?
    -আবার চালাকি কর না।
    -চালাকি ?
    -চালাকি নয়। সবাই ভাবছিল একটা কিছু ঘটিয়ে বসেছ। তার ওপর ভালো করে দেখাও যাচ্ছে না ভোরের কুয়াশায়।
    -সব দেখা যাচ্ছিল।
    -কিচ্ছু দেখা যাচ্ছিল না। কিস্যু না।
    -দেখার চোখ থাকলে সব দেখা যায়।
    -আবার বড় বড় কথা। লজ্জাও হয়না।
    -লজ্জা হওয়ারই কথা--- মানে তোদের।

    এই বলে বিজয়দা ছোট পাহাড়ি কুকুরটাকে আদর করতে লাগল। সেই কুকুরটা যাকে লেডজেরিএনা আর সুমিরুব্রায় মধ্যিখানে বসার জায়গাটায় আমি আদর করছিলাম, তারপর খুঁজে পাইনি আর নবকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, সেও দেখতে পায়নি, কোথায় চলে গিয়েছিল কুকুরটা ? সে কী এখানে আসবে বলে চলে গিয়েছিল ? এই ঢালু পথে মধ্যিখানে আমরা কথাবার্তা বলছিলাম তারপর দেখলাম বাংলোর ভেতরে চলে এসেছি। একশো বছরের পুরনো বাংলো। কয়েক শো বছরের পুরনো পাইন গাছ দিয়ে ঘেরা। পাইনের শেকড়গুলো মাটির ওপরে উঠে উঠে রয়েছে। সে রকমই একটা শেকড়ের অদ্ভুত জালের মধ্যিখানে বিজয়দা পড়েছিল ও তার টুপি অবছা দেখা যাচ্ছিল। এখন দেখা যাচ্ছে তার টুপি তার চোয়ালের হাড় আর খোঁচা খোঁচা দাড়ি সে কুকুর আদর করছিল। আমার আবার চিজ খেতে ইচ্ছে করছে। শেষ চিজটা খেয়ে ফেললাম। ওটা একটু একটু করে মুখের ভেতর গলছে আর অনেক কিছু ঘটবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েও কিছুই ঘটছে না। বাবাই লেডজেরিএনায় ভেতর ঢুকে গেল। বিজয়দাকে ডাকতে গিয়ে দেখি ওরা কী কী কথাবার্তা বলেছে। বিজয়দাও ঢুকে পড়ছে লেডজারিএনায়। বাবাই আমার মুখের দিকেও তাকাচ্ছে না। টুবাই কি কিছু জানে, সেও তো গিয়েছিল বিজয়দাকে ডাকতে। ওকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোরা কোথায় বিজয়দাকে দেখতে পেলি।’
    -ওই তো ঢালু পথটায় বড় পাইন গাছটার তলায়।
    -শেকড়ের জালের মধ্যিখানে ?
    -শেকড়ের জালের ?
    -হ্যাঁ যে সব শেকড় মাটির ওপর দিয়ে ওঠে মাটির ওপরই একটা জালের মতো তৈরি করেছে।
    -তাই।
    -হ্যাঁ, খেয়াল করিস নি ?
    -না তো।
    -বিজয়দা কি পড়ে গিয়েছিল ?
    -না তো।
    -তবে ?
    -ও তো বলল শুয়েছিল। প্রাণায়াম করছিল।
    -প্রাণায়াম ?
    -ওটা নাকি একটা বিশেষ ধরণের প্রাণায়াম যাতে মাটির সঙ্গে সরাসরিা যোগাযোগ হয় আর গাছেদের কথা শুনতে পারে।
    -গাছেদের কথা ?
    -যে সব সিগন্যাল উদ্ভিদ পাঠাচ্ছে। সব বড় বড় পাইন গাছ, সিংকোনার রোগা রোগা গাছের, সবার সিগন্যাল ও বুঝতে পারছিল তখন শুয়ে শুয়ে।
    -শুয়ে শুয়েই বোঝা যায় ?
    -ও তো বলল।
    নব বলেছে, ‘ও সব কথায় একদম গুরুত্ব দিবি না। আসলে বিজয়দার আর ভালো লাগছে না।
    -ভালো লাগছে না ?
    -না।
    -কেন ?
    -জানি না। হয়ত অনেকদিন হয়ে গেছে।
    টুবাই বলল, ‘ঠিকই বলেছ। বিজয়দা বাড়িতে ফোন করেছিল। আর পাচ্ছিল না কাউকে।’
    -কাকে ?
    -বাড়ির কাউকে না পেয়ে ওর ভালো লাগছিল না - এ কথা বলেছিল।
    এই সময় বাবাইয়ের চিৎকার শোনা গেল আর লেডজেরিএনা থেকে ছোট কুকুরটাকে বেরিয়ে আসতে দেখা গেল। সে সুসিরুব্রায় ঢুকে পড়ল। আমি বললাম, ‘এটা কী হল?
    নব বলল,‘ কী?’
    -কুকুরটা আমাদের ঘরে ঢুকে পড়ল যে।
    -ঢুকুক না।
    -সেকি।
    -হবে আরকি।
    -সে হয় নাকি, ঘরের ভেতর ঢুকে পড়বে যখন তখন।
    বাবাই বলছে, ‘সেটা তো আমিই বলছিলাম। কী বল বিজয়দা ?’

    বিজয়দা টেবিলে এসেছিল সে বলল, ‘ব্রেকফাস্ট দিতে আমাদের এতো দেরি করছে কেন ?’ আমি বললাম, ‘দেখছি।’ এই বলে আমি ঘরের ভেতর কুকুরটাকে তাড়াতে চললাম। কিন্তু কুকুরটা কোথায়? হাওয়া দিচ্ছিল আর সেই হাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাইন গাছেদের কথাবার্তা আসছিল। তারা জানলাদের সঙ্গে কথা বলছে, পর্দারাও উড়ছিল। জানলার ফাঁক দিয়ে কী কুকুরটা চলে যাচ্ছে? এরকম কোন কিছু দেখতে সারা ঘর খুঁজলাম। সুসিরুব্রার খাট আর বিছানাগুলো আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। ওরা আমাকে দেখতে পারছে কি? কাল রাতে কে শুয়েছিল আমার পাশে? আমি সবাইকে জিজ্ঞেস করছি, ‘কুকুরটা কোথায় গেল বল তো?’ কিন্তু কেউ কোন উত্তর দিতে পারছে না। গোটা সুসিরুব্রায় ফিসফাস আওয়াজ হচ্ছিল। বেরিয়ে আসতে নব বলল, ‘ব্রেকফার্স্ট দিয়ে গেছে। খেয়ে নে তারপর মুরগি আনতে যাব।’আমি বললাম, ‘কোথা থেকে আনবি?’ নব কোন উত্তর না দিয়ে খেতে লাগল। টুবাই ঘরে নেই। বাবাই আর বিজয়দা মাথা নিচু করে খাচ্ছিল। আমি বললাম, ‘কি, মুরগি পাওয়া যাবে ?’ নব বলল, ‘দিশি হলে ভালো হয়।’বলে ও খাওয়া শেষ করে উঠে যাচ্ছে আর বাংলোর দরজা খোলায় হাওয়া এসে ঢুকে পড়ছে দেখে আমিও বেরিয়ে এলাম খাওয়ার প্লেট নিয়ে। নব আস্তে আস্তে পাহাড়ের চাতাল দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে হাতে ক্যামেরা। আমি খেতে খেতে, দেখতে দেখতে ওর সঙ্গে চলে গেলাম। বাইরে গিয়ে বাবাইকে সিগারেট খেতে দেখেছি। ওকে বললাম, ‘একটা সিগারেট দিস।' ও বলল, ‘আগে খেয়ে নাও।' আমি খেয়ে ফেললাম। টুবাই আমাকে একটা সিগারেট দিয়েছে। আজকাল সিগারেট খেতে তেমন ভালো লাগে না। বেশি সিগারেট খেতেও পারি না। ব্যাপারটা শুরু হয়েছিল সারান্ডায় বেড়াতে গিয়ে। সেখানে রাস্তাগুলো পাহাড়ি হয়েছে অতিরিক্ত গাড়ি চলাচল করে। একটা গাড়ি চলে যায় তারপর তাকে দেখা যায় না। সে ঢালু পথে অদৃশ্য হয়ে নিচে নেমে যাচ্ছে তখন আর তাকে দেখা যাচ্ছে না। পরে আরো খানিকটা এগিয়ে দেখা যাবে আগের গাড়িটা আর তখন আমাদের গাড়িটাও একটা গাড্ডা মতো কোন কিছুতে গড়াতে শুরু করে আবার নেমে একটু পরে আগের গাড়িটার কাছে পৌঁছব পৌঁছব করছে ঠিক তখন আগের গাড়িটা আর একটা ঢাল বেয়ে নেমে আবার অদৃশ্য হচ্ছিল। এমনই উঁচু নিচু এবড়োখেবড়ো পথ আর ধুলো ভরা। সেই ধুলোতে কালচে খনিজ গুঁড়ো মিশে গিয়ে গিয়ে ফুসফুসের ভেতরটাও অনবরত কালো করে, আমার শ্বাসকষ্ট হয়। সেই শ্বাসকষ্টের কথা ভাবছিলাম। সারাণ্ডার ধ্বস্ত জঙ্গলের কথা ভাবিনি আর সিগারেট খেতে গিয়ে দেখলাম অনেকটা দম পাচ্ছি আর কয়েকটা সিগারেট খাব কি ? নব ক্যামেরায় চোখ লাগিয়ে অনেক নিচের একটা তিস্তা নদী দেখছে আর বলছে, ‘খাবি না।’
    -কী ?
    -সিগারেট।
    -একটা খেলাম।
    -আরো কয়েকটা খাবার কথা ভাবছিলি তো?
    -হ্যাঁ।
    -খাবি না।
    -তুই কী করে বুঝলি ?
    -নিচের নদীটা দেখা যাচ্ছে।
    -দেখছি।
    -দেখছিস না।
    -তবে।
    -সিগারেট খাবার , টানার কথা ভাবছিস।
    -আরো অনেক কিছু ভাবছি।
    -ব্রেকফার্স্টের কথা ভাবছিস।
    -ব্রেকফার্স্ট খেয়ে নিয়েছি।
    -লাঞ্চের কথা ভাবছিস।
    -না।
    -ওই নদীটা তিস্তা। অনেক নিচুতে।

    বলে নব ক্যামেরা জুম করে নদীটা তুলছে। কেন নদীর ছবিটা ও পাবে ? কেন ক্যামেরা ওটা তুলবে ? সেটার কারণ আর কিছুই নয় এই পাহাড়ের চাতাল যেখানে বাংলোটা আছে। বাংলোটা আছে কারণ সিংকোনার প্ল্যান্টেশন আছে। নানা রকমের সিংকোনা হয় সারা পৃথিবীতে চব্বিশ রকম, পঁচিশ রকম। এখানে হয় দু রকমের। সুসিরুব্রা আর লেডজেরিএনা। এই নামের ঘর আছে। আলাদা আলাদা ধরণের ঘর সেখানে আলাদা আলাদা ধরণের লোকেরা থাকছে। তাদের মধ্যে কোন মিল নেই ? থাকতেও পারে। তবে দুটো ঘর আছে বলে বাংলোটাও আছে। বাংলোটা, চাতালটা, সিংকোনাটা আছে বলে নদীটাও ওপর থেকে দেখা যায়। ক্যামেরা দেখে। আমি ভাবছিলাম নদী ও ক্যামেরার সম্পর্কের কথা। নব ও ক্যামেরার সম্পর্কের কথা। ক্যামেরা ও তার কায়দা কানুনের সম্পর্কের কথা। ছবি পাওয়ার কথা ছিল না অথচ পেল, এই পাহাড়ে উঠল বলে পেল – সে কথা। নব আমাকে তিস্তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল। অনেক ওপর থেকে কুয়াশার পাতলা চাদর দিয়ে নদী দেখছিলাম আর দেখছি নদী পড়ে আছে একটা সুতোর মতো। খুব ভালো করে দেখলে দেখা যাবে তার পাড়ে পাড়ে ততোধিক সুতোর মতো কোন গাছ বসে আছে আর সেই গাছের শেকড়েররা খুব শক্ত। পাহাড়ি পাইন গাছেদের মতোই তাদের জীবন ক্রমশ ভিতরের দিক থেকে বাইরের দিকে আর বাইরে থেকে ভেতরে যাতায়াত করছে তো করছেই। আমি বোঝার চেষ্টা করছিলাম নদীর স্রোতের সঙ্গে ভেসে যাওয়া খড়কুটো, হাঁড়ি, পাতিল, মরা মাছ, জ্যান্ত মাছ, মৃত খরগোস আর নানা প্রাণীর শবদের কথা। যাদের নদীর স্রোতের সঙ্গে চলে যেতে দেখা যাচ্ছে অথচ আমি দেখতেই পাচ্ছি না তাদের। এতো ওপর থেকে তাই সুতোর মতো চলমান হয়েছে এমন নদীর স্রোতটাই কেবল দেখতে পাচ্ছি। তাও আবছা আবছা অথচ চলমান যেন দূরের তারা। প্রচুর গল্প আর তার সম্ভাবনা নিয়ে অন্ধকার রাতে মিটমিট জ্বলতে দেখা যায় অথচ সেখানে মাছ আছে কিনা, জল ও অন্যান্য প্রাণ সকল আছে কিনা বুঝতে দেয় না। স্রেফ দূরত্বের জন্যই নদী আর তার স্রোতও এরকম করে তারাদের মতো হয়ে থাকে। সেই আতান্তরে পড়ে এই একশো দেড়শো বছরের পুরনো বাংলো আর অত বড় বড় চাতাল কি বলছে ? সেও কি পাহাড়ের কোল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বা বসে নদী অবলোকন করছে ? এসব ভাবতে ভাবতে সত্যি সত্যিই নদী এসে যায়, দেখা যায় তার জল চলাচল করছে আর সেই আওয়াজ শোনা যাচ্ছে বাংলোর ভেতরে সুসিরুব্রা আর লেডজারিএনা ঘর দুটো থেকে সমান ভাবে। আমি দেখলাম ওই দু ঘরের মধ্যিখানে যে স্থল আছে যেখানে বসে আমরা নানান বিনিময় নিয়ে হিসাব কিতাব করতে থাকি আর কখনই হিসেব না মেলায়, প্রত্যেকে প্রত্যেকের মতো করে না হওয়ার হাহাকার প্রায়ই ঝগড়ার মতো শোনাতে থাকে। তখন চোখে চোখে রাখতে গিয়ে চোখ অন্য দিকে সরিয়ে ফেলতে হয়। প্রত্যেকে আলাদা আলাদা দিকে তাকাতে থাকে আর দেখা গেল তিস্তা চলাচল করছে ওই কেতাদুরস্ত বসার জায়গায়। সরু মতো, সুতোর মতো দেখতে তিস্তা যার জল সুসিরুব্রা আর লেডজারিএনায় মধ্যে দিয়ে বয়েই চলেছে। তার এক পাড়ে নব আর আমি আর অন্যপাড়ে বাবাই আর বিজয়দা বসেছিল। আমরা কেউ কারু দিকে চোখেচোখে তাকাতে না পেরে সব সময় আগের কথা ভাবছিলাম। আগে আমরা কী রকম করে কথা বললাম সে কথা ভাবছিলাম। সেখানে টুবাইকে কোথাও না পেয়ে নবকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘টুবাই কোথায়', নব আর আমি টুবাইকে খুঁজতে বেরিয়েছি। বাংলোর আওতায় থাকা প্রশস্ত চাতাল জুড়ে অনেক গাছ ও ছায়া ও আলোরা বসে আছে, দাঁড়িয়ে আছে তার মধ্যেখানে এক বিশাল পাইন গাছ শেকড় মাটির ওপর বার করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ক্যামেরা দেখাচ্ছে টুবাই বাংলো থেকে বেরিয়ে এসেছে। একটা সিগারেট ধরিয়ে হাঁটছে। সে এক চক্রাকারে ঘুরছে বাংলোর চাতাল দিয়ে দিয়ে। সে একটা সোয়েটার পরে আছে। তার দাড়ি নিখুঁত কামানো। সে কি সেন্ট মেখেছে? সে কি নদীকে সুতোর মতো দেখতে চাতালের এক কোণে যে বসার চেয়ার পাতা আছে তাতে গিয়ে বসছে? যার এক ধারে নব বসে আছে, আমি দাঁড়িয়ে আছি? ক্যামেরা এ সব দেখাচ্ছে আর তখনই দেখা গেল পাইন গাছের জেগে ওঠা শেকড়ে হোঁচট খেয়ে টুবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ল। তার সঙ্গে সঙ্গে সেই ছোটখাটো লোমশ পাহাড়ি কুকুরটা আরো কিছু সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে হাঁটছিল - তারা ওখানে গেল। তারপর টুবাই বিশাল পাইন গাছটার গোড়ায় ঝোপের ধারে দাঁড়িয়েছে। সেখানে সে বিজয়দাকে পড়ে থাকতে দেখছে। বিজয়দাকে কুয়াশার মধ্যে পুরো দেখতে না পেয়ে টুবাই এক কোণ দিয়ে বিজয়দার মাথার টুপিটা দেখছে। তারপর কুয়াশা বেড়েছে ক্রমে আরো বেড়ে সব কিছু আবছায়া করে তুলছে তার মধ্যে দিয়ে চাতালের চারপাশে আলাদা আলাদা বসার জায়গাগুলো দেখা যাচ্ছে। সেখানে আমি আর নব, বিজয়দা আর বাবাই আলাদা আলাদা বসে রয়েছি আর ভাবছি একদিন কোন দিন আমরা একসঙ্গে এইখানে বসে থাকব কিনা। টুবাইয়ের সঙ্গে কুকুরটা ঘুরছে। এক নদী চলে এসে আমাদের আলাদা দুই স্থল সুসিরুব্রা আর লেডজারিএনার মধ্যিখান দিয়ে বয়ে চলেছে তার নাম তিস্তা। তার শব্দ আর গন্ধই মনে হয় রাতে আমার সঙ্গে শুয়েছিল একলা বিছানায়, একটু দূরে অন্য একটা খাটে নব শুয়েছিল। টুবাই বলল, ‘বিজয়দাকে দেখলাম। আবার পড়ে আছে।’আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কোথায়?’ টুবাই বলল, ‘পাইন গাছটার জেগে জেগে থাকা শেকড়ের মধ্যিখানে।’নব বলল, ‘আগের মতো, আবার? প্রাণায়াম করছে? মাটির সঙ্গে, গাছের সঙ্গে কথা বলছে?’ টুবাই কোন উত্তর দিল না। আমি দেখছি দুই সিংকোনা নামাঙ্কিত ঘর দুটোর মধ্যিখানে নদী আর তার অবশেষ ছাড়া বিশাল পাইন গাছটাও এসে গেছে। অন্য পাড় থেকে সে গাছের তলায় আমি কুয়াশা দেখছি আর অন্য কিছু দেখছি কিনা বলতে পারব না।

    সুসিরুব্রায় তখন ফিসফাস আওয়াজ হচ্ছিল, লেডজারিএনায় হচ্ছিল কিনা বলতে পারব না অথচ ওরা কিন্তু সিংকোনার অনেক ধরণগুলোর দুটো যেগুলো একে অন্যতে রূপান্তরিত হতে পারে কি ? হলে অবশ্য ঘরদুটোর আলাদা আলাদা নামের কী হবে কে জানে ?


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ইস্পেশাল | ০১ অক্টোবর ২০২৫ | ১৬৫ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Aditi Dasgupta | ০১ অক্টোবর ২০২৫ ১২:৩৯734567
  • গা ছম ছম করে! কথক এর মুখ খুঁজতে  গিয়ে দেখি সে জায়গায় কি অসীম শূন্যতা! অথচ পাহাড় নদী গাছ ----সবাই যেন তাকিয়ে আছে! উফফফফ! 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভ্যাবাচ্যাকা না খেয়ে মতামত দিন