এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা

  • জালালউদ্দিন আকবর আর ঔরঙ্গজেব আলমগীর

    উপল মুখোপাধ্যায়
    আলোচনা | ২৮ মার্চ ২০২৫ | ১৪৭৫ বার পঠিত | রেটিং ৪ (১ জন)
  • জালালউদ্দিন আকবর আর ঔরঙ্গজেব আলমগীর 


    প্রাক কথা 


    হিন্দুস্থানে বাবর মোঘল সালতানাতের প্রতিষ্ঠা করলেন ঠিকই কিন্তু তাকে এক স্থায়ী অনন্য , বিশিষ্ট রাজনৈতিক প্রকল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠা দিচ্ছেন আকবর । সমসময়ে কি ছিল তাঁর মুল্যায়ন ? নিজের সম্প্রসারণের  প্রকল্পকে হিন্দুস্থানের বাস্তবতার সঙ্গে  খাপ খাইয়ে নিচ্ছেন তিনি কেমন করে ? সালতানাতের আরেক বিশিষ্ট সম্প্রসারণকারী ঔরঙ্গজেব আলমগীরের সঙ্গে তাঁর তফাৎ কিসে ? 


    ক) সমসময়ে আকবরকে দেখার  দুটো দৃষ্টিভঙ্গী  আছে


     বাদায়ুনির মত 


    মহাভারতের অনুবাদক বিখ্যাত মোঘল মুন্সি –সচিব বাদায়ুনি মন্তখাব উত তেহরিক বইতে  আকবরকে বেয়াড়া পথের পথিক ধর্মাচারী বলেছেন , একই অভিযোগ কিন্তু দারার বিরুদ্ধেও উঠেছিল । ইবাদত খানায় বিভিন্ন ধর্মের প্রতিনিধিদের সঙ্গে তাঁর আলাপ-আলোচনার বিষয়টা উনি ভালো চোখে দেখতেন না।ইন্ডিক নানা অভ্যাস যেমন নিরামিষ খাওয়ায় আকবরের আগ্রহ তাঁর দু চক্ষের বিষ ছিল।বাদায়ুনি   গোপনে বইটা লিখেছিলেন আর সে বই প্রকাশিত হয় আকবরের মৃত্যুর পর জাহাঙ্গীরের আমলে,  তবুও দেখা যাচ্ছে তিনি সে সময় আকবরের চরম বিরোধীদের ব্যাপারে নিশ্চুপ , পক্ষ নিচ্ছেন না তাদের ।  ঘটনা হয়েছিল এই  যে,  আকবরের নিজের নিযুক্ত  বাংলার প্রধান কাজি – কাজি  অল কুজাত, যিনি ছিলেন একজন সুন্নি আর জৌনপুরের এক শিয়া কাজি  দুজনেই সমস্বরে আকবরকে বেয়াড়া   ধর্মাচারী বলে ফতোয়া দিয়েছিলেন । ফলে দরবার -উলেমা-সুফি সামাজিক ভারসাম্য বিঘ্নিত হয়। জালালুদ্দিন আকবরের ল্যাজে পা দেওয়ায় ফল ভুগতে হচ্ছে দুজনকেই। তাঁদের  মণ্ডু দুটো কাটা পড়ে। কিন্তু এইসব ফতোয়ার উস্কানিতেই আর  নক্শবন্দী সিলসিলার মদতে আকবরের ভাই শাহজাদা মির্জা হাকিম আর তাঁর দলবল আকবরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন যথারীতি  মির্জা হাকিমের বিদ্রোহী ফৌজেরও লেজে গোবরে অবস্থা হয় । 


    কান্দাহারীর মত 


    এইসব কাজিদের আর বাদায়ুনির আকবরের ইবাদতখানা বিরোধীতার সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থান নিচ্ছেন মোহাম্মদ আরিফ  কান্দাহারী। যিনি ছিলেন আকবরের শিক্ষক বৈরাম খান আর পরে উজিরে আজম মুজাফফর খানের এক মাঝারি আমলা । কান্দাহারী তাঁর তারিখ ই আকবরী বইতে আকবরকে একজন আদর্শ ইসলামী শাসক হিসেবে দেখিয়েছেন । অবশ্য ওনার বই শেষ হয় পনেরশো আশিতে তারপর দুই কাজি আকবরের  বিরুদ্ধ ফতোয়া দিয়ে মারা পড়বেন । বাদায়ুনির মতোই কান্দাহারীকেও কোনভাবেই আল আরাবীর অনুগামী  এক দিব্যোন্মাদ সুফি ঘরানার বান্দা (ইতিহাসকার এম আর পীরভাই বলছেন  Intoxicated Path , ওনার মত  আকবর আর দারা এই ঘরানার )  বলা যায় না ।  তিনিও  বাদায়ুনির মতোই ছিলেন শিরহিন্দির অনুগামী  উলেমা -দরবারের উপস্থিতিতে সামাজিক বাস্তবতা বুঝেসুঝে চলা সুফি (পীর ভাই বলছেন Sober Path , ওনার মত ঔরঙ্গজেব এই ঘরানার )  । দুজনেই মোঘল নোকর শাহীর লোক।

    আল আরাবী  (দিব্যোন্মাদ পথ -Intoxicated Path) শিরহিন্দি (বুঝেসুঝে চলা পথ -Sober Path) 

     

    পীরভাই যাকে   দিব্যোন্মাদ পথ বলেছেন সেই 

    সুফি ঘরানার মূল তাত্ত্বিক হলেন দ্বাদশ শতকের স্পেনীয় দার্শনিক  ইবন আল আরাবী । 

    কার্ল মার্কস যেরকম হেগেলের দর্শনকে 


    উল্টো করে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন ,সেরকম 


     শিরহিন্দি আরাবীর দর্শনকে সম্পূর্ণ উল্টে দিলেন।নক্শবন্দী সিলসিলার সুফি , ষোড়শ শতকের হিন্দুস্থানি দার্শনিক আহমাদ শিরহিন্দি।  তাঁর যুক্তি -ছায়া(আল্লাহের  সৃষ্টি) কখনো কায়ার (আল্লাহের  )সমতূল্য হতে পারে না। 

    যিনি বললেন,  সকলি তিনি ( আল্লাহ) -হামা  উসত । তিনি বললেন,  সকলি তাঁর( আল্লাহ) থেকে - হামা আস উসত । 

    এ রাস্তার সুফি পথিকরা      হলেন উজুদিরা  -ওয়াহাদ আল –উজুদ  । 

    এ পথের পথিক দের পীরভাই 


    বলছেন বুঝেসুঝে চলার পথের পথিক শুহুদিরা  - ওয়াহাদ আল –শুহুদ । 

    মোঘল যুগের সুফি সিলসিলাগুলোর মতপার্থক্য এই দু ধারায় বিভক্ত ছিল ।আগেই জানা গেছে সামাজিক বাধ্যবাধকাতার চাপে সুফি সিলসিলার মতের গোঁড়ামি টিঁকত না মোটেই , এ ওর মতো আর ও তার মতো হয়ে যেত প্রায়শই।

    ইবাদতখানায় জেসুই ট পাদ্রি সহ অন্য ধর্ম গুরুদের সঙ্গে আলোচনায় আকবর , ষোল শো দুই , শিল্পী নর সিংহ , সূত্র উইকি মিডিয়া কমন্স 


    খ ) আকবর তাঁর রাষ্ট্রে কী  ভাবে নিজের ভূমিকা প্রতিষ্ঠা করলেন


    এই ভাবে সুফি সিলসিলার বিচারে  আকবরের খুব কাছের না হওয়ার কথা যাঁদের সেই বুঝসমঝদার  দুই আমলা দুটো মত রেখেছেন আকবরের ইসলামী শাসক  সত্তা বিষয়ে । তাঁর পছন্দের  সুফি ঘরানা সবাই জানে কিন্তু  আকবর নিজে কি ইসলামী শাসক হিসেবে নিজেকে তুলে ধরেছিলেন? এর উত্তর হ্যাঁ । শরিয়ত বিনে আকবর অসম্পূর্ণ  । কিন্তু কী  ভাবে ? কী ছিল তাঁর রাস্তা ? পথ ? উজুদি পথের পথিক আকবর ……।


    ------ দাঁড়াও , দাঁড়াও।


    ------ এত থামাও ।


    ------ থামাব । 


    ------- কেন ? 


    ------- বাদশাহ কোন সিলসিলার হতে পারে  ?


    ------- তা বটে । বাদশাহ রাষ্ট্রের দাস , রাষ্ট্র ক্ষমতার । আকবরও তাই মোঘল সালতানাতের বাদশাহ । 


    ------- কেমন বাদশাহ । 


    ------- সেটাই হক কথা ।


    ------- মোদ্দা কথায় এসো । 


    ------- হানাফি  বিচার বিধি ছিল  মোঘল দের  রাষ্ট্রীয় বিচার বিধি যা অমুসলিমদের ধিম্মি মনে করে।


    ------ আকবর তাই করতেন ? 


    ------ হ্যাঁ । আকবর উলামাদের আইনি আর রাজনৈতিক মতে প্রভাবিত হয়ে অমুসলিমদের ধিম্মি মনে করতেন  মানে যাদের সুরক্ষা বাদশাহের দায়িত্ব ।


    ------ তবে তো ঔরঙ্গজেব ও তাই মনে করার কথা ।


    ------ ঔরঙ্গজেবও তাই মনে করতেন । অমুসলিম হিন্দু -‌ জৈন –বৌদ্ধদের ধিম্মি মনে করতেন  মানে যাদের সুরক্ষা বাদশাহের দায়িত্ব , তাই কুড়ি বছর আকবরের মতোই চলে তারপর ওই সুরক্ষা বাবদ জিজিয়া নিতেন ষোলোশো উনআশি থেকে , পরে যা আবার তুলে নিচ্ছেন জহান্দার শাহ। সে অন্য প্রসঙ্গ । 


    ------- আকবর কাকে কাফের মনে করতেন , করতেন কি ? 


    ------- করতেন না আবার ।


    ------- কাদের ? আকবর কাদের কাফের মনে করছেন ?


    -------- যাদের বিরুদ্ধে ধর্মযুদ্ধ জেহাদ করা একান্তই জরুরী তাদের ।


    ------ তারা কারা ? 


    ------ তাঁর  দরবারের ক্ষমতাকে  চ্যালেঞ্জ জানাবে  যারা সেই রনথম্বোর আর  চিতোরের  রাজপুত রাজারা ছিলেন  আকবরের চোখে কাফের  তাই  তাঁদের  বিরুদ্ধে  কাতিল এ আম - গণ হত্যার ফরমান জারি হল ? 


    --------- অনেকটা তাই ।


    -------- অনেকটা ? পুরোটা নয় ? 


    -------  হ্যাঁ কারণ সন্ধির পর আর সেই কাফেররা  কাফের থাকেনা ।


    ------- তবে তারা কি হয় ? 


    --------- তবে তারা ধিম্মি হয় ।


    ------- একবার কাফের আর পর ক্ষণেই ধিম্মি । ঔরঙ্গজেবও তাই করতেন ? 


    ------- ঔরঙ্গজেবও তাই করতেন । তাঁর ক্ষমতা , সালতানাতের ক্ষমতাকে কোন রাজা বা সুলতান চ্যালেঞ্জ জানালে ধর্মযুদ্ধ- জেহাদ করতেন  তারপর সন্ধি ।একবার কাফের আর পর ক্ষণেই ধিম্মি হত অমুসলিমরা । অবশ্য যদি তাঁরা না হারে , যদি মাথা ধড়ে থাকে  । একবার মুণ্ডু গেলে আর খাওয়ার কথা ওঠে কি ? 


    ------- মুণ্ডু গেলে খাওয়ার –সন্ধির প্রশ্ন আসে কি ? 


    ------- ধিম্মিদের প্রশাসনের সর্বোচ্চ স্তরে বসানোর  সায় থাকে হানাফি  বিচার বিধিতে ? 


    ------- সর্বোচ্চ স্তরে নীতিনির্ধারণে নয় নীতি রূপায়নের সর্বোচ্চ স্তরে - ওয়াজির আল   তানফিধ নিয়োগ করা যেত । আকবরের দরবারে হিন্দুদের উপস্থিতিকে এভাবে বোঝা যেতে পারে ।পরবর্তী কালেও সে ধারা চলেছে মোঘল দরবারে ।


    ------ ঔরঙ্গজেবের দরবারে ?


    ------- তাঁর দরবারে শাজাহানের  মুন্সি চন্দ্রভান ব্রাহ্মণের কথা আগেই জানা গেছে রঘুনাথ রায় কায়স্থর  কথাও । যেটা বলার তা হল ফৌজি দক্ষতাতেও দড় রঘুনাথকে   রাজা উপাধি দিচ্ছেন আলমগীর আর করছেন দিওয়ান –ই কুল - রাজস্ব ও নির্বাহ বিষয়ক স্বাধীন দায়িত্ব প্রাপ্ত আধিকারিক ।পরে ঔরঙ্গজেব এক চিঠিতে রাজা রঘুনাথকে আদর্শ আধিকারিক মেনে সম্মান জানাচ্ছেন এতে শুধু নীতি রূপায়নে নয়  নীতি নির্ধারণেও  হিন্দুদের ভূমিকা কি স্পষ্ট নয় ?   


    ------ আর হিন্দু রাজপুত রাজাদের সঙ্গে আকবরের বা  অন্য মোঘলদের বৈবাহিক সম্পর্ক , তাও কি হানাফি  বিচার বিধি অনুমোদন করেছিল ? 


    ------- তা তো বটেই ।


    ------- সেকি ! 


    ------- এতে আশ্চর্য হওয়ার  কী আছে ? 


    ------- কিরকম ? 


    ------- কোন মহিলাকে রাজনৈতিক আঁতাতের স্বার্থে যদি বিয়ে করা হয় তাতে তাঁর অমুসলিম ধর্ম কোন বাধা নয় । এমনটাই ছিল উলেমাদের বিধান । তবে……। 


    ------- কী তবে ? 


    ------- সেই মহিলাকে হতে হবে  এমন ধর্মের  যার পবিত্র লিপি উদ্ভাসিত । আকবরের আগে থেকেই,  হিন্দু ধর্মের পবিত্র বইপত্র স্বর্গীয় উদ্ভাসে উদ্ভাসিত ধরে নিয়ে , হিন্দু রাজকুমারীদের বিয়ে করে এসেছেন সুলতানরা । 


    ------- তাহলে বিয়ের জন্য ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হওয়া আবশ্যক নয় ।


    ------- যে ধর্মের পবিত্র লিপি উদ্ভাসিত সে ধর্মের মেয়ে নিজের ধর্ম রেখেই বিয়ে করতে পারত, সে আধিকার তাদের ছিল হানাফি মতে । আকবর সেটাই করেন , পরে অন্যরাও ।


    ------- আর ঔরঙ্গজেব ?


    ------- ঔরঙ্গজেব নিজে না করলেও ছেলেদের বিয়ে দিয়েছেন হিন্দু রাজাদের সঙ্গে আঁতাত করতে । আঁতাতই সব , রাজনৈতিক আঁতাতের সুবিধার স্বার্থে গাদা গুচ্ছের বিয়ে যেমন আকবরেরও। 


    -------শরিয়ত ব্যতিরেকে  অনেক কিছু রাষ্ট্রের  নিজস্ব আইন – দাওয়াবিত অনুযায়ী চালাতেন আকবর । 


    ------- শরিয়ত ছাড়াই ?


    ------- শরিয়ত ছাড়াই বাদশাহের ক্ষমতা প্রয়োগের পরিসর ছিল আকবরের আমলে ।


    ------- যেমন ?


    ------- যেমন হিন্দু রাজাদের অনুকরণ ঝরোখা  দর্শন দেওয়া বা নিজের ছেলেমেয়ে , নাতিনাতনিদের ওজন করে,  তাদের দেহের সমান ওজনের  সোনা দানা টাকাপয়সা ঢোল শহরৎ  করে গরিবদের মধ্যে বিলনো । এসব ঔরঙ্গজেব  বন্ধ করেও আবার চালু করলেন।


    ------- ঔরঙ্গজেবের আমলেও ছিল ?


    ------- শরিয়তের বিধান ব্যতিরেকে  বাদশাহের ক্ষমতা প্রয়োগ করেছিলেন ঔরঙ্গজেব  , পরে করা বন্ধ  করেও  দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে ছেলেমেয়েদের রোগ  আরোগ্যের দুর্বল মুহূর্তে নিজেকে ধরে রাখতে পারছেন না ।দেখা গেল আবার দেহের সমান ওজনের  সোনা দানা টাকাপয়সা  গরিবদের মধ্যে বিলনোর ব্যবস্থা  করছেন তিনি। তাতে তাঁর মেজাজ ভালো  হয়। 


    ------- মেজাজ ?


    ------- হ্যাঁ , বাদশাহের মেজাজ , বাদশাহের ক্ষমতা , বাদশাহের- রাষ্ট্রের  নিজস্ব আইন –দাওয়াবিত । 


    ------- শরিয়ত বনাম দাওয়াবিত ?


    ------- বাইনারি বানাচ্ছ  , যেমন আকবর বনাম ঔরঙ্গজেব।  কিন্তু এসব আধুনিক প্যাঁচাল যা  ওই যুগে কেউ পেড়েছিল কি ? 


     আকবরের বিশিষ্টতা বুঝতে হানাফি বিধি আর উলেমাদের ওপর তাঁর নির্ভরতা বুঝলে হয় না , গৎবাঁধা বিচারবিধি থেকে তাঁর বিছিন্নতাও বুঝতে লাগে । একটা ঘটনা এই বিচ্ছিন্নতা বাড়ায় । 


    গ) মথুরার ঘটনা আর আকবরের ঘোষণাপত্র 


     ষোলশো সাতাত্তরের কোন একদিনে মথুরার কাজিসাহেবকে হন্তদন্ত হয়ে সদর আল সুদুর – বিচারক প্রধান শেখ আব্দাল নবীর কাছে আসতে দেখা যাচ্ছে। ধরে নেওয়া যাক সেটা শীতের অপরাহ্ন কারণ গরমে কাজিসাহেবের কষ্ট হবে আর বর্ষায় ছাতা ব্যবহার বাহুল্যমাত্র, ছাতা যখন তখন হারাবে, তাই বর্ষার কথা ভাবাই যাচ্ছে না। কাজিসাহেবের অভিযোগ শুনে নবী সাহেবের রাতের ঘুম চলে যায়। এক রইস ব্রাহ্মণ মসজিদ বানানোর জন্য আনা জিনিষপত্র তুলে নিয়ে গেছে। শুধু তাই নয় সেসব ব্যবহার হয়েছে মন্দির বানানোর কাজে। এতেই শেষ নয় উপযুক্ত সাক্ষ্য প্রমাণ আছে যে ব্রাহ্মণ হজরত মুহম্মদ সম্পর্কে অবজ্ঞা সূচক মন্তব্য় করেছে। শরিয়তে দু রকমের হকের কথা বলা আছে হক আল–আদমিয়া–দেওয়ানি বিষয়ক আধিকার আর হক আল্লাহ – ঐশ্বরিক প্রভাব বিষয়ক অধিকার। দ্বিতীয়টায় বিচারকের থেকে সুলতানের আধিকার বেশি কারণ তিনিই জেহানে আল্লাহর হয়ে ন্যায়বিধান করবেন। এই কেসটা দ্বিতীয়টায় পড়ে, তাই শেখ আব্দাল নবী আকবরের কোর্টে বল ঠেলে দিলেন শাস্তির রায় দিতে। আর যায় কোথায় আকবরের হিন্দু বউ আর শলাহকাররা তদবিরের পর তদবির করতে থাকে ব্রাহ্মণকে লঘু সাজা দিতে। অন্য দিকে উলেমাদের চাপ, একেবারে ধর্ম বিরোধিতা – ব্লাসফেমির অভিযোগ উঠে গেছে। তেনামেনা করে আকবর পুরোটাই সদর আল সুদুরের বিচার বিভাগীয় প্রাজ্ঞতার ওপর ছেড়ে দিলেন। এতে জুডিশিয়াল বায়াস তৈরি হয়েছিল হয়ত তাই মামলাটা আর আকবরের কোর্টে, লেজিসলেটিভ জুরিসডিকশনে আসেনি, ব্রাহ্মণের শর কালাম –মাথা কাটা হলো  তাঁকে না জানিয়েই ! এই ঘটনা বিবরণ লিখতে গিয়ে বাদায়ুনি তাঁর বই মন্তেখাব উত তেহরিখে কোন সিদ্ধান্ত করছেন না শুধু বললেন এই ঘটনায় আকবর অসন্তুষ্ট হচ্ছেন যখন জানতে পারছেন যে চরম শাস্তিদান সর্বসম্মত ছিল না। এখন কী ছিল বিপরীত মত? এটা জানা জরুরী এ কারণে যে তাহলে আকবরের পরবর্তী পদক্ষেপ বোঝা যাবে। বিপরীত মতটা ছিল এরকমঃ

    হাদিশ উদ্ধৃত করে বাদায়ুনি লিখেছেন হানাফি মতাবলম্বী উলেমারাদের একাংশ বলেছিলেন যে কোন অবিশ্বাসী যে ইসলামী শাসন মেনে নিয়েছে সে হজরত মুহম্মদ সম্পর্কে বিরূপ কথা বললেও মুসলিম পক্ষ চুক্তি ভঙ্গ করতে পারে না, অবিশ্বাসীকে সুরক্ষার দায় বর্তায় মুসলমানের।

    “ …….the cursing of the Prophet by unbelievers who have submitted to the rule of Islam gives no ground for any breach of agreement by Muslims, and in no way absolves Muslims from their obligation to safeguard infidel subjects .” ( Reconsidering Islam in south Asian context, MR Pirbhai, page 75)

    সদর আল সুদুরের কপালে দুঃখ ছিল। তাঁকে পদ থেকে সারিয়ে একরকম বাধ্য করা হল একদল হজ যাত্রীর মুরুব্বি হিসেবে হজে যেতে, ফিরে এসে তিনি মারা যান। আকবর এতেই ক্ষান্ত দিচ্ছেন না তিনি একটা ডিক্রি জারি করে রাজপুত সহ অমুসলিমদের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতির স্বার্থে বিচার বিভাগের ওপর আরো কর্তৃত্ব আরোপ করলেন। উলামারা, কাজিরা বসে তাঁর মনোমত এক ঘোষণাপত্র বানিয়ে ফেলল ষোলোশো উনআশিতেঃ

    এই ঘোষণাপত্রে আকবর হলেন রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন প্রণয়নকারী – মুজতাহিদ যা একমাত্র খালিফারাই হয়েছিলেন ইতিহাসে। এর পরে প্রায়ই আকবরকে খালিফা বলে সম্বোধন করতে দেখা যাচ্ছে আইন ই আকবরি সহ বিভিন্ন লেখায়  ।অবশ্য এটা কতটা আব্বাসিদ /উম্মায়েদ ধাঁচের সার্বজনীন খালিফা  আর কতটা স্থানীয় স্তরে একজন সুলতানের খালিফাত্ব অর্জন সে নিয়ে ইতিহাসকাররা  এখনো তর্কে লিপ্ত ।  শুধু তাই নয় শরিয়ত ব্যতিরেকে রাষ্ট্রীয় আইন - দাওয়াবিত প্রণয়নের একছত্র আধিকার পেলেন তিনি।
    ঘোষণাপত্রের – ডিক্রির এক অংশঃ

    “Abu al-Fath Jalal al-Din Muhammad Akbar, Badshah Ghazi (whose kingdom may God perpetuate), is a most just, most wise, and a most God-fearing king. Should, therefore, in future, a religious question come up, regarding which the opinions of the mujtahids are at variance, and his majesty, in his penetrating understanding and clear wisdom, be inclined to adopt, for the benefit of the community and as a political expedient, any of the conflicting opinions which exist on that point, and issue a decree to that effect, we do hereby agree that such a decree shall be binding on us and on the whole community. Further, we declare that, should his majesty think it fit to issue a new order, we and the community shall likewise be bound by it, provided always that such order be not only in accordance with some verse of the Qur’an, but also of real benefit to the community; and further, that any opposition on the part of his subjects to such an order passed by his majesty, shall involve damnation in the world to come, and loss of property and religious privileges in this. ” ( Reconsidering Islam in south Asian context, MR Pirbhai, page 76-77)


    বাদায়ুনিও আকবরের খালিফা হওয়া উল্লেখ করছেন । এটা তাঁর ও  কাজি লবির চোখে বিচারবিভাগীয় কাজে হস্তক্ষেপ মনে হলেও , এ সিদ্ধান্ত  যেহেতু বিচারবিধির কূট তর্কের ফসল তাই  বিরুদ্ধে  বলা যাচ্ছে না । তাঁদের বিরোধিতা শুরু হল পনেরোশো  বিরাশিতে আকবর রাষ্ট্রীয় আইন প্রয়োগ করে জিজিয়া তুলে দিতে আর হজের জন্য টাকাপয়সা দেওয়া বন্ধ করতে । এরপর পনেরোশো চুরাশিতে আকবর তাঁর মহান যুগের সূচনা করছেন তারিখ ই ইলাহি চালু করে আর তাতে তাঁদের রাগের আগুনে ঘি পড়ে কিন্তু তবু কাজি – উলেমাদের চুপ থাকতে হয় কারণ সব সিদ্ধান্তই হচ্ছিল  বিচারবিধির চুলচেরা বিশ্লেষণের নিরিখে । 


    ঘ) আলমগীরের আলাদা পথ আর হিন্দুস্থানের বাস্তবতা


    প্রাক কথা


    কিসে আলাদা ছিল আলমগীরে পথ ? সে কি ধর্মান্ধতায় আকীর্ণ এক কানা গলি ? তিনিই কি বারোটা বাজিয়ে ছাড়েন মোঘল সালতানাতের ? এই সব প্রশ্নে গবেষণা অনেক দূর এগিয়েছে অথচ বাস্তবে ঔরঙ্গজেব আলমগীরকে কাঠ গড়ায় তুলে,  কলোনির ইতিহাসকারদের আলোচনাই এখনো জনমান্যতা পায় ।এর বাইরে ভাবার এক প্রস্তাবনা ।


    তখতে বসার পর আলমগীরের বাধ্যবাধকতা ছিল দারা শুকোহর রাজনৈতিক বিরোধিতা করার জন্য কিছু পদক্ষেপ নেওয়া যার মধ্যে পড়ে দরবারে সংস্কৃত চর্চায় উৎসাহ দেওয়া বন্ধ করা। আগেই জানা গেছে দারা ঘনিষ্ঠ সংস্কৃতজ্ঞ কোবিন্দাচার্য স্বরস্বতীর ভাতা বন্ধ করেছিলেন তিনি। পণ্ডিত প্রবর কোবিন্দাচার্য মোঘল অভিজাত দানিশমন্দ খানের দরবারে পুনর্বাসন পান। তবে ব্যক্তিনিরপেক্ষ শরিয়তি বিধানে ঔরঙ্গজেব আলমগীরের আস্থা গুজরাটে সুবেদারি করার সময় থেকেই দেখা গেছে। গুজরাটের কাজি আব্দ আল-ওয়াহাব যিনি পরে হলেন কাজি আল-কুজাত - প্রধান কাজি, দাক্ষিণাত্যে সুবেদারির সময় থেকেই তাঁর আইনি উপদেষ্টা বা মুফতি হিসেবে কাজ করতেন। গুজরাটি সুন্নি উলেমারা আলমগীরের সময়কালের উনপঞ্চাশ বছরই বিচারবিভাগের বড় বড় পদে ছিলেন। দিব্যোন্মাদ সুফি পথের পথিক আকবরের রাস্তা আর বুঝেসুঝে চলা সুফি পথের ঘেঁষা আলমগীরের রাস্তা আলাদা হতে শুরু করে। রক্তাক্ত পথে ক্ষমতায় আসার পর ঔরঙ্গজেবের কাজ হয়ে দাঁড়াল শাহাজাহানাবাদ আর আগ্রার বা লাহোরের নাগরিক সমাজের কাছে দারা শুকোহর থেকে সম্পূর্ণ আলাদা এক ইমেজ খাড়া করা। সফল রক্তাক্ত যুদ্ধজয়ী এক বাদশাহের ভীতিপ্রদ ইমেজ থেকে নজর আড়াল করতে, তিনি ইলতুমিশ বা মুহম্মদ বিন তুঘলকের মতোই এক শুদ্ধ ইসলামী আর উপকারী সুলতানের ভেখ ধরেন। তাঁর আমলে মুদ্রায় পবিত্র খুতবা লেখা বন্ধ হয় পাছে তা মুছে গিয়ে ইসলামের অবমাননা করে। বন্ধ হয় পারসিক নববর্ষ নওরোজ উদযাপন আর পর ঝরোখা দর্শন, হিন্দু রাজাদের কপালে টীকা পরানোর মতো, ইসলামী নয় এমন সব শাহী প্রথা। অবশ্য তিনি সোনা বা টাকা দিয়ে নিজের বা ছেলেমেয়েকে ওজন করিয়ে গরীবদের দান করার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারী করেও পেছিয়ে এলেন ছেলেমেয়ের দুরারোগ্য রোগ আরোগ্যের উদযাপনের সময়, আবেগগত কারণে।

    ঝরোখা দর্শনে ঔরঙ্গজেব আলমগীর,  সূত্র - উইকিমিডিয়া কমন্স



    একই ভাবে বৃদ্ধ আলমগীরকে এক ছবিতে দেখা যাচ্ছে প্রজাদের ঝরোখা দর্শনে। ছবি কথা বলে উঠেছে। শ্বেতশুভ্র পোশাকে ঝরোখায় আলমগীর , তলায় বাঁ পাশে মোটা গোঁফওলা হিন্দু, সম্ভবত রাজপুত রাজাই হবে, হাতিয়ারবন্দ  হয়ে দাঁড়িয়ে আর ডানপাশে পরিষ্কার গোঁফ কামানো একটু লম্বা এক মুসলমান আভিজাতই হবে। হিন্দুস্থানের বাদশাহের এই উপস্থপনা, সাতের শো দশ সালের এই ছবি ছবিটার, শিল্পী অজানা। এটা সংরক্ষিত আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সান দিয়াগো মিউজিয়াম অফ আর্টে। । 


    এছাড়া লেনদেন শরিয়ত মোতাবেক হচ্ছে কিনা দেখার জন্য মুহতাসিব নিয়োগ হয়। এই অবধি ঠিক ছিল কিন্তু এমন কিছু নীতি প্রণয়ন করা হয় যাতে মুসলিম ব্যবসায়ীরা শুল্কে ছাড় পায় অথচ তা হিন্দুদের জন্য বলবত থাকে।এটা নিয়ে প্রভাবশালী স্থানীয় ক্ষমতা গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে আ লমগীরের প্রশাসন খামোখা লড়তে গেলে তাদের নাক কাটা যায়। রাজত্বের প্রথম দশকে কৃষিসংকটের সময় পণ্যের প্রবেশ কর তুলে দেওয়ার শাহী ফরমান অবজ্ঞা করে বেমালুম কর আদায় করেছিল স্থানীয়রা আর উলেমাদের কথায় এই ধর্মীয় বৈষম্যমূলক কর আদায় করতে গিয়ে আলমগীরের ল্যাজেগোবরে অবস্থার কথা জানাচ্ছেন ইতিহাসকার ফারহাত হাসান।

    জাকাত ছিল ব্যবসায়ীদের আভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের ওপর কর রপ্তানি শুল্কের সম হারে আদায় হতো। ষোল শো পঁয়ষট্টি পর্যন্ত সব ব্যবসায়ীদের জন্য এর হার ছিল আড়াই শতাংশ। কিন্তু সে বছর থেকে উলেমাদের খুশি করতে ঔরঙ্গজেব হিন্দুদের থেকে পাঁচ শতাংশ, মানে দ্বিগুণ হারে কর সংগ্রহের ফরমান দিলেন। ষোলোশো সাতষট্টিতে ধর্মীয় বৈষম্য আরো বাড়িয়ে মুসলিমদের জাকাত কর পুরো মকুব করা হয়। এর ফলে বেশি উলেমা প্রীতির বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরোয় পরিণত হল আর স্থানীয় ক্ষমতাবান ব্যবসায়ীরা বুঝিয়ে দিল তাদের স্বার্থের বিরুদ্ধে গেলে কেমন করে শাহী ফরমানকে বুড়ো আঙ্গুল দেখাতে হয়। সেসময় রাষ্ট্রীয় আদেশ ততক্ষণই মর্যাদা পেত যতক্ষণ তা স্থানীয় সমাজ জীবনে গ্রাহ্য হতো। মোঘল রাষ্ট্র কাজ করত স্থানীয় ক্ষমতার সঙ্গে তালমিল করে। এক্ষেত্রে তা হয় না, ফলে সরকারের সঙ্গে ব্যবসায়ীদের আঁতাত ধুলোয় লুটিয়ে পড়ে। সামান্য অর্থের বিনিময়ে সব লেনদেন নিজের বলে চালিয়ে প্রভাবশালী গুজরাটি মুসলমান ব্যবসায়ীরা কর দেওয়া থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছিল হিন্দু ব্যবসায়ীদের। শাহী ফরমানের বেলুন চুপসে গিয়ে এমনই হাল হয় যে ওই বৈষম্যমূলক করের ফরমান ষোল শো একাশিতে প্রত্যাহার করতে হয়েছিল আলমগীরকে।

    ফারহাত জানালেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা এই ভাবে প্রায়ই শাহী ফরমান মানত না বা তাকে সুবিধেমত বদলে দিত। মাথা নিচু করে ফরমান না মেনে তারা কিছু গঠনমূলক পরিবর্তন করে তাদের আর্থিক আর প্রথাগত স্বার্থ বজায় রাখত। ষোল শো উননব্বইয়ের আর একটা ফরমানের ব্যাপারেও বলছেন ফারহাত। যখন বেশি জাকাত আদায়ের জন্য আলম গীর ফরমান জারী করলেন যে বিক্রয়মূল্যের ওপর কর দিতে হবে, গুজরাটের ব্যবসায়ীরা মানল না। তারা ক্রয়মূল্যের ওপর কর নেওয়ার আগেকার প্রথা চালু রাখার দাবিতে বাজারের বাইরে গিয়ে, মুহতাসিবের নজর এড়িয়ে কেনাবেচা করতে শুরু করে। ফলে জাকাত বেশি আদায় দূরের কথা আদায় বন্ধ হবার উপক্রম হতে ফরমান প্রত্যাহার করতে হল আলমগীরকে।

    ফারহাত আরও জানালেন মোঘল রাষ্ট্রে সব কর আলমগীরের শাহী ফরমানে ঠিক হবে এমনটা নয়। তথাকথিত আইনি কর আদায়ের সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় ক্ষমতা গোষ্ঠীর স্থির করা তথাকথিত বেআইনি কর আদায় সমান তালে চলত। অবশ্য এই ‘বেআইনি কর’ আদায় শাহী নীতি বিরুদ্ধ হয়ে অলামগীর বা কোন মোঘল বাদশাহকে চ্যালেঞ্জ করত না, মিলেমিশে থাকত সরকারি ব্যবস্থার সঙ্গে। সবচেয়ে উৎপীড়ক স্থানীয় কর ছিল টোল ট্যাক্স বা রাহাদারি যা দিতে দিতে বণিকরা অতিষ্ঠ হয়ে যেত। নথি থেকে জানা যাচ্ছে, স্থানীয় কর আদায় নিয়ে ইংরেজরা মোঘল দরবারে অনেকবার আপত্তি জানিয়েছে। তারা মনে করত এইভাবে আতিরিক্ত কর আদায় ডাকাতি।এদের খুশ করতে মোঘল দরবার শাজাহানের আমলে ষোল শো সাঁইতিরিশ, আট তিরিশ, চল্লিশ আর পঞ্চাশে ফরমান দিয়েছে কিন্তু কে শোনে কার কথা। শকট পিছু দু টাকা কর দিতে হচ্ছিল সাহেবদের। আরেক ‘বেআইনি কর’ ছিল কেনা–বেচার ওপর এক শতাংশ কর। এইসব স্থানীয় কর সামগ্রিক কর ব্যবস্থার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী ছিল। কর ব্যবস্থার এইসব অনুসন্ধান করে ফারহাতের সিদ্ধান্ত হল আলমগীর বা অন্য গ্রেট মোঘলদের আমলের সার্বভৌমত্বের ধারণা হল স্থানীয় ক্ষমতা গোষ্ঠীর সঙ্গে ভাগাভাগি করে রাজপাট চালানোর এক ধারণা (shared basis of imperial sovereignty)।
    ( State & Locality in Mughal India, Power relations in Western India 1572-1730. Farhat Hasan page 117-118)
     
    শিবাজির মারাঠা রাষ্ট্রের উত্থান আর বিজাপুর–গোলকোন্ডার সঙ্গে তাদের মোঘল বিরোধী আঁতাতের প্রেক্ষিতে ঔরঙ্গজেবের  দাক্ষিণাত্য নীতির ব্যর্থতার পথ ধরে , গুজরাটি উলেমাদের কথাতেই   ষোল শো উনআশিতে নতুন করে এলো জিজিয়া।কিন্তু এর পরেও উলেমারা সমস্বরে বিজাপুর –গোলকোন্ডা দখলে সায় দিলো না ।উলটে জিজিয়া  চাপানো হলে তার বিরুদ্ধে খোদ শাহজাহানাবাদে - মোঘল ক্ষমতা কেন্দ্রের   নাগরিক  সমাজকে ক্ষোভ দেখাতে দেখা যাচ্ছে । আলমগীর না তুললেও তাঁর মৃত্যুর বছর ছয়েকের মধ্যে এই ধর্মীয় বৈষম্য মূলক কর তুলে নেওয়া হয় কারণ তা হিন্দুস্থানের বাস্তবতার খেলাপ ছিল।


    মোটের ওপর ঔরঙ্গজেব আলমগীরের পথ যতই শরিয়ত ঘেঁষা হোক না কেন, সে পথও ক্ষমতার রাশ হাতে রাখতে এক বুঝে সুঝে চলা সুফি পথই  বটে, যা ক্ষমতায়  অমুসলিমদেরও সঙ্গী করে চলে, দূরে ঠেলা দুরস্থান।


    শেষমেশ পাতি রাজতন্ত্র  জিন্দাবাদ 


    মোঘলরা পারস্যের নীতিশাস্ত্র প্রণেতা, এরিস্টটলের নেখমেকিয়ান এথিক্স  অনুসারী নাসিরুদ্দিন তুসির আখলাক এ নাসিরিকে অনুসরণ করতেন যার মূলে আছে স্বর্গীয়  আশীর্বাদ পুষ্ট ন্যায় বিধানকারী রাজতন্ত্রের ধারণা । ঔরঙ্গজেবকেও তাই করতে দেখা গেছে যদিও এই ন্যায় বিধানে তাঁর আস্থা ছিল শরিয়তি আইনের শাসনে । তিনি নির্মাণ করতে গেলেন ব্যাক্তি নিরপেক্ষ এক আইন ভিত্তিক রাষ্ট্র ( judicial state ) যার অধীনে বাদশাহও থাকবেন ।   এই করতে গিয়ে বহু ক্ষেত্রে  উলেমাদের দ্বারা চালিত হতে হয় তাঁকে। জিজিয়ার মতো ধর্মীয় কর আবার চালু করে বদনামের ভাগী হলেন তিনি । আকবর আবার শরিয়তের অধীনে থেকেও ন্যায় বিধানে  নিজের একছত্র ক্ষমতায় বিশ্বাসী ছিলেন । স্বর্গীয়  আশীর্বাদ পুষ্ট ন্যায় বিধানকারী রাজতন্ত্রের ধারণা থেকে  নিজেকে খালিফা ঘোষণা করে উলেমাদের ওপর গেলেন তিনি । তাঁর পদ্ধতি ছিল প্রধান মুজতাহিদ – সর্বোচ্চ আইন প্রণয়নকারী ( Chief legislator)  হিসেবে হিন্দুস্থানের বাস্তবতার নিরিখে  শরিয়ত বহির্ভূত আইন প্রণয়ন ও  প্রয়োগ । দুজনের কেউই স্থায়ী প্রভাব ফেলতে সফল হন না । তাঁদের মৃত্যুর পর দেখা গেল যেকে সেই । মূলগত ভাবে নাসিরুদ্দিন তুসির রাজতন্ত্রের সাধারণ ধারণাই সব গ্রেট বা তারপরের  মোঘলদের সাধারণ  নীতি শাস্ত্র হয়ে রয়ে যায়। এই দুজনের মতো কেউই আর আলাদা কিছু করেন না । 

     


    সূত্র: 


     Reconsidering Islam in south Asian context, MR Pirbhai, Brill 


    State & Locality in Mughal India, Power relations in Western India 1572-1730. Farhat Hasan, Cambridge University Press 


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • আলোচনা | ২৮ মার্চ ২০২৫ | ১৪৭৫ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • MP | 103.238.***.*** | ২৮ মার্চ ২০২৫ ১৫:৩৮541959
  •  @উপলবাবু , নাসিরুদ্দিন তুসি কি সেই পারসিক রাষ্ট্রনায়ক যিনি মঙ্গোল শাসক হুলাগু খানের বাগদাদ আক্রমণের সময়ে তার পরামর্শদাতা হিসাবে বাগদাদ ধ্বংসে কোলাবোরেট করেছিলেন ? পরে মোঙ্গলদের মুসলমান হবার পিছনে কি এর শিক্ষাই কাজ করেছিলো ? সেই জন্যই কি মোঙ্গল ও তুর্কি বংশোদ্ভূত মোগলদের উপরে তার লেখা শাস্ত্রের এতো বেশি প্রভাব ? 
  • upal mukhopadhyay | ২৮ মার্চ ২০২৫ ১৮:২৭541961
  • হ্যাঁ , তর্কাতীত না হলেও তাই ।হুলেগু খান নাকি ওঁর গুণগ্রাহী ছিলেন ।
  • MP | 2409:4060:2e12:881b:696:204c:6ef2:***:*** | ২৮ মার্চ ২০২৫ ২২:২৬541964
  • @উপলবাবু , এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে গেলো আমার যে সম্প্রতি ঐতিহাসিক রুচিকা শর্মা দাবী করেছেন যে মুঘলরা নিজেদের মুঘল না বলে তৈমুরী বা গুরকানী বলে পরিচয় দিতেন l মুঘল নামটা নামকরণ ব্রিটিশ আমলে হয়েছিলো l এই বিষয়ে বিস্তারিত জানানো যেতে পারে কি ? 
  • Upalm61@gmail.com | 150.107.***.*** | ২৮ মার্চ ২০২৫ ২২:৪১541965
  • @MP ব্রিটিশরাও হাউস অফ টিমুর বলত প্রায়ই। মোঘল বলার ক্রনোলজিটা বুঝতে হবে। জেমস মিল থেকে শুরু কি ? রুচিকার লিংক টা দিন না। 
  • MP | 2409:4060:2e12:881b:696:204c:6ef2:***:*** | ২৮ মার্চ ২০২৫ ২৩:২২541970
  • বিশ্বেন্দু | 103.5.***.*** | ৩০ মার্চ ২০২৫ ২২:৫১542008
  • প্রথমত ধন্যবাদ। আমার মনে হয়েছে আওরঙ্গজেবের সিংহাসন দখলে দাদা-দিদি-বাবার অক্ষ-বিরুদ্ধে লড়াই আদতে আওরঙ্গজেবের সিংহাসন পরবর্তী সময়ের রাজনীতি বুঝতে সহায়ক হয়। 
    বাবর থেকে শেষ সম্রাট পর্যন্ত নিজেদের গর্বিত গুরখানি, খুব বেশি হল তৈমুরিয়া বলত। গুরখানি কারন তাদের পূর্বজ ছিলেন চেঙ্গিজ খানের জামাই। সে আমলে মুঘল বা মোঙ্গল শব্দ অবশ্যই ছিল ব্লাসফেমি। এটা উপনিবেশের তৈরি নোমেনক্লেচার যার কোনও মানে নেই - কিন্তু আমরা ব্যবহার করছি। 
     
  • upal mukhopadhyay | ৩০ মার্চ ২০২৫ ২৩:২৬542009
  • @বিশ্বেন্দু ধন্যবাদ ।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। বুদ্ধি করে প্রতিক্রিয়া দিন