হিমালয়ে আমাদের গ্রীষ্মকালীন আবাস কালাধুঙ্গি থেকে পূর্ব হয়ে পশ্চিমে ন হাজার ফুট উঁচু খাড়াই উঠে গেছে।
করবেট বলছেন-
— কোন করবেট?
— কেন?
— এমনিই আরকি।
— করবেটও এমনিই, অত্যন্ত স্বাভাবিক হয়ে আছেন করবেট সাব। জিম করবেট সাহিব। ক্যাপ্টেন সাব। নানান নামের- একজনই। কলোনির ঊর্ধ্বে তাঁর মাথা পাহাড় অবধি চলে গেছে। তিনিই তো উঁচু পাহাড় বন জানোয়ার আর সেখানকার মানুষের কথা বলবেন।
— আগে বলবে তো!
— হ্যাঁ। উনিই বলবেন।
তার পুব দিকের ঢালের উঁচুতে বড় বড় ওটের ঘাস জন্মেছে। ওই ঘাসবনের পরেই খাড়া পাহাড় সোজা নেমে গেছে কোশি নদীর পাড় অবধি। একদিন খাড়াই পাহাড়ের উত্তর দিকের গ্রাম থেকে একদল মেয়েবউ ওখানে ঘাস কাটছিল। হঠাৎ এক বাঘ তাদের মধ্যে এসে পড়ে, হুড়োহুড়িতে এক বয়স্কা মহিলা হুমড়ি খেয়ে পড়ে ঢাল বরাবর গড়িয়ে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। বাঘটা যেমন হঠাৎ আসে তেমনই চিৎকার চেঁচামেচিতে রহস্যময় তার পালানো। খানিকটা ভয় কাটলে খোঁজাখুঁজি শুরু করে মেয়েরা আর ঘেসো জমির ঢাল ধরে খানিকটা নেমে এক সরু ধাপিতে ওনাকে আহত অবস্থায় পাওয়া গেল। মহিলা কোঁকাতে কোঁকাতে বলেন তিনি মারাত্মক চোট পেয়েছেন। দেখা গেল একটা ঠ্যাং তো ভেঙেইছে উপরন্তু কয়েকটা পাঁজরও গেছে। কী ভাবে মহিলাকে তুলে নিয়ে যাওয়া যায় সে নিয়ে শলাপরামর্শ শুরু হল। দেখা গেল এ ছেলেদের কম্মো। কেউই ওখানে বেশিক্ষণ থাকতে চাইছিল না তাই মহিলাকে জানানো হল গ্রাম থেকে লোক এসে তাঁকে নিয়ে যাবে। মহিলা তো কিছুতেই একা থাকবেন না, রীতিমতো কাকুতিমিনতি শুরু করায় এক ষোলো বছরের মেয়ে সঙ্গে থাকতে রাজি হয়।
সকলে চলে যাওয়ার পর মেয়েটা ডান দিক ধরে নেমে এলো, চড়াইয়ের একটা খাঁজ থাকায় সে পাটা রাখতে পারে ধাপিটায়। সেই ধাপিটা, চড়াইয়ের উঁচু মাথাটা যেখানে শেষ হয়েছে তার মাঝ দূরত্ব অবধি পাহাড়ের গা বরাবর গেছে আর মহিলা যেখানে শুয়ে তার কয়েক গজ দূরে শেষ হয়েছে। সরু ধাপটা থেকে পিছলে কয়েকশো ফুট তলায় পাথরে থেঁতলে মরার ভয়ে মহিলা বাচ্চা মেয়েটাকে কাছে ডাকেন। মেয়েটা বিপদের ঝুঁকি নিয়ে কী ভাবে যেন নিচের ধাপটায় আসে।,সেখানে একজনেরই জায়গা ছিল, তাই সে কোনোরকমে ভারতীয় মেয়েদের নিজস্ব কায়দায় হাঁটু মুড়ে মহিলার মুখোমুখি বসার জায়গা করে নিল। চার মাইল দূরের গ্রাম পর্যন্ত পৌঁছতে তাদের সাথীদের কতক্ষণ লাগতে পারে,কজন ছেলেকে এই সময় গ্রামে পাওয়া যেতে পারে, তাদের সব বোঝতে কতক্ষণ সময় লাগতে পারে আর শেষমেশ রেসকিউ পার্টি কত ক্ষণে পৌঁছবে সে নিয়ে দুজনে কথা বলে চলেছিল।
ওরা ফিসফিসিয়ে কথা বলছিল পাছে কাছাকাছি ঘাপটি মেরে থাকা বাঘ শুনে ফেলে আর তখন, হঠাৎই,বয়স্কা মহিলার কথা আটকে গেল ভয়ে, দৃষ্টি স্থির। যে দিকে উনি তাকিয়ে সেখানে ঘাড় ঘুরিয়ে মেয়েটা দেখে বাঘ ঢালের খাঁজ থেকে গুঁড়ি মেরে ধাপিতে পা রাখছে।
এরপর করবেট গোটা ছবিটাকে কোন এক দুঃস্বপ্নের মতো করে আঁকেন, তারপর বলেন দুঃস্বপ্নের শেষে যে আনন্দ সেটা মেয়েটা পাবে না, এক আদমখোর সত্যি এগিয়ে এসেছিল ওই খাড়াইয়ের খাঁজে সরু নড়াচড়া করা যাবে না এমন ধাপিটায় যার হাত থেকে পালানোর সব রাস্তা বন্ধ।
— মেয়েটার কী হল?
— করবেট সরাসরি বলেননি।
— আর ওই বয়স্কা গ্রাম্য মহিলার?
— বেঁচে যায় আর একটু ধাতস্থ হয়ে সেই মতি সিংকে সব জানায়।
— মতি সিং?
— করবেটের সেই কুমায়নি বন্ধু।
— যার ছবি করবেটের গ্রীষ্মকালীন আবাস কালাধুঙ্গিতে আছে, যা এখন সরকারি মিউজিয়ম?
— হ্যাঁ।
— লাগোয়া সুভেনির শপটাও মতি সিংয়ের নামে।
— হ্যাঁ।
— সেই বিখ্যাত মতি সিং?
— হ্যাঁ।
আহত বয়স্কা মহিলাকে গ্রামে ফিরিয়ে আনা হয়, একটু ধাতস্থ হয়ে সে ঘটনাটা বলে, শুনে মতি সিং আঠেরো মাইল হেঁটে আমার কাছে এল। তার বয়েস হয়েছে, ষাটের বেশ কিছুটা ওপর কিন্তু বিশ্রাম নেওয়ার কথা বললে উড়িয়ে দেয়, আমরা একসঙ্গে তদন্ত করতে বেরিয়ে পড়লাম। আমার কিছুই করার ছিল না, চব্বিশ ঘণ্টা পার হয়ে গেছে, নিজেই থেকে যেতে রাজি হওয়া সেই সাহসী মেয়েটার কয়েক টুকরো হাড় আর রক্তমাখা ছেঁড়াখোঁড়া পরনের পোশাকের টুকরোই শুধু রেখে গেছে বাঘ।
এই হল সেই বাঘটার প্রথম মানুষ শিকার পরে সরকারি নথিতে যাকে মোহনের মানুষ খেকো বলে উল্লেখ করা হয়।
বাচ্চা মেয়েটাকে মারার পর বাঘটা শীতকাল কোশি নদীর উপত্যকায় নেমে মানুষ মারতে থাকে, তার মধ্যে পি ডাবলু ডির দুজন কর্মী আর আমাদের বিধান পরিষদ সদস্যের পুত্রবধূও ছিল। গরম পড়লে আবার বাঘটাকে প্রথম মানুষ শিকার করার জায়গায় ফিরে আসতে দেখা গেল। পরের কয়েকটা বছর ওকে কোশি উপত্যকার উজান -ভাটায় কাকরিঘাট থেকে গর্জিয়ার মধ্যে চল্লিশ মাইল এলাকায় ঘোরাফেরা করতে দেখা যায়। শেষে ও মোহনের ওপরের পাহাড়ে কার্তকানৌলা গ্রামের আশপাশের জঙ্গলে ঘাঁটি গাড়ে।
এই সময় কিছুদিন আগে পরে এক জেলাস্তরের প্রশাসনিক মিটিং হয়। সেখানে কুমায়ুন ডিভিশনে তিনটে মানুষ খেকো বাঘ মারার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। করবেটকে দায়িত্ব দেওয়া হল। ভয়ঙ্করতার দিক থেকে প্রথম ছিল ছিল নৈনিতাল জেলার চৌগড়ের মানুষ খেকো।
— আর মোহনের মানুষ খেকো?
— সে আলমোড়া জেলায়।
— ভয়ঙ্করতার দিক থেকে?
— দু'নম্বরে।
— আর তিন?
— গাড়োয়ালের কানডার মানুষ খেকো। কিন্তু করবেট এমন ভাবে লেখেন যে বাঘ আর ভয়ঙ্কর থাকে না।
— তবে?
— সরকারি পরিসংখ্যান থেকে বাঘ হয়ে যাচ্ছে জঙ্গলের এক প্রাণ।
— কী ভাবে?
— উনি বাঘের চলাফেরার ম্যাপ দিচ্ছেন, যেটা আসলে জঙ্গলেরই ম্যাপ তার মধ্যে করবেট কোথায় তার আভাস।
— করবেট কোথায়?
চৌগড়ের বাঘটা হয়ে যাবার পর (করবেট লেখেন – accounted for- . মারার কথা বলেন না। তিনি যেন ঠেকায় পড়ে কলোনির কর্তাদের কামে!) আলমোড়ার ডেপুটি কমিশনার বাইনস মনে করিয়ে দেন কনফারেন্সে দেওয়া প্রতিশ্রুতির আংশিক পূরণ হল, এর পরের লক্ষ্য মোহনের বাঘ।
— করবেট মানুষ খেকো কথাটা বলছেন না?
— দেখছি তো তাই!
— বলছেন সরকারি নথিতে লেখা মোহনের মানুষ খেকোর কথা কিংবা আতঙ্কিত লোকের মুখে ফেরা মানুষ খেকোর নানান গল্পের কথা?
— আর তাঁর নিজস্ব নথিতে?
— কচিৎ কখনো।
বাইনস বলেন বাঘটা দিনদিন বেপরোয়া হয়ে উঠছে শেষ কয়েক হপ্তায় তিনজন মানুষ মেরেছে, সবাই কার্তকানৌলা গ্রামের লোক। উনি বললেন ওই গ্রামেই আমার যাওয়া উচিত।
মে মাসের চাঁদিফাটা রোদের এক দিনে, আমার দুই চাকর আর নৈনিতাল থেকে আনা ছয় গাড়োয়ালিকে নিয়ে আমি রামনগরে ট্রেন থেকে নেমে চব্বিশ মাইল দূরে কার্তকানৌলা গ্রামের দিকে হাঁটা দিলাম।
প্রথম পর্যায়ে সাত মাইল হেঁটে করবেট পৌঁছচ্ছেন গর্জিয়ায়, যেতে সন্ধে হয়। বাইনসের চিঠি পেয়েই তড়িঘড়ি বেরিয়ে পড়াতে সেখানকার এফ আর এইচ বুক করা হয়নি তাই খোলা মাঠেই তাঁবু পড়ল। রাতে করবেট ওপরের খাড়াই থেকে পাথর পড়ার মতো শব্দ শোনাতে দেখতে বেরলেন। শব্দ করছিল রাস্তার পাশেই জলাভূমির ব্যাঙের দল। পরের দিন ভোরবেলা বেরিয়ে সূর্য মাথার ওপর ওঠার আগেই, বারো মাইল হেঁটে ওনারা পৌঁছচ্ছেন মোহনের বাজারের কাছাকাছি বাংলোতে। সেখানে স্থানীয় লোকেরা শোনাচ্ছে মোহনের মানুষখেকোর আতংকের গল্প।
মধ্যদিনে আমরা যাত্রা শুরু করার জন্য তৈরি হয়ে গেলাম আর আশপাশের জমা হওয়া ছোটোখাটো ভিড়ের লোকেদের মুখে, সামনের ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে যাবার সময় মানুষখেকোর দিকে কড়া নজর রাখার সাবধান বাণী শুনতে শুনতে চার হাজার ফুট চড়াই কার্তকানৌলা গ্রামের দিকে রওনা দিলাম। আমরা খুবই আস্তে আস্তে এগোচ্ছিলাম, লোকরা মালের ভারে নুয়ে ছিল,রাস্তা ছিল অতিরিক্ত খাড়াই আর গরমও তেমনি। ওপরের দিকের গ্রামগুলোতে দিনকয়েক আগে এক ঝামেলার জন্য নৈনিতাল থেকে ছোট একদল পুলিশ পাঠাতে হয় আর আমাকে বলে দেওয়া হয়েছিল যা লাগবে সঙ্গে নিয়ে যেতে, ঝামেলার জন্য ওখানে কিছু নাও মিলতে পারে। ওই জন্যই আমার লোকেদের, আনা বেশি মালের ভার বইতে হচ্ছিল।
আমরা চাষ জমির একদম শেষ সীমানায় পৌঁছলাম আর কোন ঝামেলায় আমার লোকেদের ফেলতে পারবে না মানুষ খেকো তাই ওদের ছেড়ে একাই বন বাংলোর দিকে চললাম। মোহন থেকে ওটা দেখা যায় আর ফরেস্ট গার্ডরা বলেছিল ওটাই নাকি কার্তকানৌলায় থাকার সবচেয়ে ভালো জায়গা।
যাওয়ার পথে গ্রামের এক মহিলার সঙ্গে দেখা হচ্ছে করবেটের যে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে একাই জল তুলতে এসেছে, বাড়ির মরদ গেছে ক্ষেতে কাজ করতে।প্রথমে করবেট মহিলাকে তারপর মহিলা প্রাথমিক জড়তা কাটিয়ে সাহেবকে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করছে।
— কী প্রশ্ন?
— কিছু প্রশ্ন সাহেবের আইডেন্টিটি নিয়ে, কিছু আসার উদ্দেশ্য নিয়ে।
— করবেট উত্তর দিচ্ছেন?
— শুধু উত্তর দিচ্ছেন নয়, সে সব তিনি লিখে রেখেছেন। মহিলার সঙ্গে সাহেবের আন্তঃক্রিয়া প্রশ্নোত্তরে।
মহিলা আড়ষ্টতা আর লজ্জা কাটিয়ে উঠছে আর এবার আমার জবাবদিহির পালা। আমি কি পুলিশের লোক? না। আমি কি ফরেস্ট অফিসার? না। তাহলে আমি কে? একজন সাধারণ লোক। আমি এসেছি কেন? কার্তকানৌলার লোকদের সাহায্য করতে চেষ্টা করতে। কী ভাবে? আদম খোরকে মেরে। আদম খোরের কথা আমি কী ভাবে জানলাম? আমি একা এলাম কেন? আমার লোকেরা কোথায়? কতজন আছে? আমি কতদিন থাকব? এইসব।
— মোহনের মানুষ খেকো মারার কাহিনীতে কেন এই সব কথা বিস্তারে লিখছেন করবেট?
— কারণ তিনি কলোনির নন - তিনি করবেট।
— করবেট?
ওই মহিলাই গ্রামের অন্যদের সঙ্গে করবেট ও তাঁর শিকার বাহিনীর যোগসূত্র হয়ে ওঠে। তারাই করবেটকে কনডেন্সড মিল্ক না ব্যবহার করতে জোর করে, খাঁটি দেশি গরুর দুধের যোগান দেয়। মানুষখেকোর যাতায়াতের পথে,বাইরে তাঁবুতে না শুয়ে,খানিকটা ব্যবহার অযোগ্য স্যাঁতস্যাঁতে বন বাংলোতেই রাত কাটাতে বলে। কলোনির প্রশাসনের সঙ্গে সংঘাতের গুমোট কেটে গিয়ে করবেট আর তার লোকজনকে স্বাগত জানাচ্ছে গ্রাম।`কাজের কথা অর্থাৎ আদম খোরের প্রসঙ্গটা আলোচনায় আসে। যে পথের ধারে গাছের তলায় কখন, কী পরিস্থিতিতে আদম খোর তার শেষ শিকার করেছে এক মহিলাকে তাও বলা হয় করবেটকে। করবেটের বিখ্যাত শিকারি মাথা কাজ করতে শুরু করে দিল। তাঁর চোখ শুরু করল গ্রাম আর লাগোয়া জঙ্গলের তীক্ষ্ণ ম্যাপিং। লিখে রাখছেন সেই নিখুঁত, বিস্তারিত বর্ণনা যা তাঁকে শেষ পর্যন্ত পৌঁছে দেবে উদ্দিষ্ট শিকারের কাছে। বাঘ কোনো কারণে মানুষখেকো-আদমখোর হয়ে যাচ্ছে আর করবেটকে সেই বাঘকেই শিকার করতে হবে ধরে নিয়ে এগোতে হয়েছে।
জানলাম যে রাস্তাটা ধরে প্রতি রাতে বাঘ আসে তা পুব দিকে বৈতলঘাটের দিকে গেছে, তারই একটা শাখা গেছে মোহনের দিকে আর পশ্চিমে উৎরাই ধরে রামগঙ্গা নদীর ধারে চাকনাকলে। রাস্তার পশ্চিমমুখো অংশটা চাষের জমি হয়ে আধ মাইল গ্রামের চড়াইয়ের দিকে গিয়ে দক্ষিণে বাঁক নিয়ে পাহাড়ের দিক বরাবর বন বাংলোর চড়াইটা আবার ছুঁয়ে চাকনাকলে নেমেছে। রাস্তার কার্তকানৌলা আর চাকনাকলের মধ্যেকার ছ'মাইলের মতো অংশ খুবই বিপজ্জনক আর মানুষ খেকোর আবির্ভাবের পর থেকে কেউ ব্যবহার করে না। আমি ঘুরে দেখলাম চাষের জমি পার হয়ে রাস্তাটা ঘন গাছপালা আর ঝোপঝাড়ের জঙ্গলের ভেতর দিয়ে নদীতে নেমেছে।
কার্তকানৌলার মূল চাষের জমিগুলো আছে উত্তর দিকে পাহাড়ের মুখোমুখি আর চাষের জমিগুলো ছাড়িয়ে কতগুলো ছোট ছোট চড়াই আর তাদের ফাঁকে ফাঁকে গভীর ঝর্ণা। বন বাংলোর হাতা থেকে একশো গজের মধ্যে সবচেয়ে কাছের চড়াইয়ের কাছে একটা বিশাল পাইন গাছ।
ওই গাছটার কাছে দিন দশেক আগে, বাঘ এক মহিলাকে মেরে, অর্ধেক খেয়ে রেখে যায় আর তিনজন শিকারি যারা বন বাংলোটা থেকে চার মাইল দূরের এক বাংলোয় ছিল তারা কেউই পাইন গাছে বসতে না পারায় একশো থেকে দেড়শো গজ দূরের তিনটে গাছে তিনটে মাচান বাঁধে গ্রামবাসীরা যেগুলোতে ওরা চাকরবাকর নিয়ে সূর্য ডোবার আগে চড়ে বসল। তখন পূর্ণিমা, থালার মতো চাঁদ উঠল,গ্রামবাসীরা বেশ কয়েকটা গুলির আওয়াজ শোনে, পরদিন ওরা চাকরদের থেকে জানে আনতাবড়ি কিছু গুলি ছোঁড়া হয়, তারা নিজেরা কিছুই দেখেনি। এইসব অতি উৎসাহী বেকার মানুষ খেকো শিকারের ঝোঁকে বাঘেরা আরো ভয়ার্ত সতর্কতা অবলম্বন করতে শুরু করে আর বরাবরের জন্য তাদের গুলি মারা কঠিন হয়ে যায়।
গ্রামবাসীরা বাঘের ব্যাপারে একটা দারুণ খবর দিল। তারা বলে বাঘ যখনি গ্রামে আসে তার করা একটা চাপা আর্তনাদের আওয়াজে ওরা ঠিক বুঝতে পেরে যায়। খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করে জানতে পারি কখনো ঘরগুলোর মধ্যে দিয়ে যাবার সময় আওয়াজটা একটানা হয়,অন্য সময় কিছুক্ষণের জন্য আর কখনোবা অনেকক্ষণ সে আওয়াজ বন্ধ থাকে। ওই খবরটা থেকে আমি সিদ্ধান্ত করি (`ক) একটা ঘা বাঘটাকে ভোগাচ্ছে, (`খ) ঘাটা এমনই যার ব্যথা শুধু হাঁটলেই টের পাওয়া যায়, (`গ) ক্ষতটা বাঘের কোন এক ঠ্যাঙে। আমাকে নিশ্চিতভাবে বলা হয়েছিল কোন স্থানীয় শিকারি ওকে ঘায়েল করেনি, করেনি রানিখেত থেকে আসা শিকারিরাও যারা মাচান বেঁধে বসেছিল; এসব অবশ্য বড় কথা নয়, বাঘটা বেশ কবছরই মানুষখেকো, আর যে ক্ষতটার যন্ত্রণার কথা আমি ভাবছিলাম মনে হয় সেটাই ওর মানুষখেকো হবার কারণ। এটা একটা আগ্রহের ব্যাপার বটে যা বাঘটাকে মারার পরই পরীক্ষা করে নিশ্চিত হওয়া যাবে।
— করবেটের সময় ঘুমপাড়ানি বন্দুকের চল হয়নি?
— কলোনির প্রশাসন গুলির আদেশ দিয়েছে এটাই যথেষ্ট ছিল।
— তাই?
— জান না, জানতে না?
— জানতাম?
— খুঁজে বের করে মারো এই ছিল প্রশাসনের নীতি তা মানুষ বা বাঘ যে কোন প্রাণঘাতী বিপদের ক্ষেত্রেই সত্যি।
— এখনকার উন্নয়নের প্রশাসন কি বাঘের ক্ষেত্রে আলাদা কিছু করে বা চিতাবাঘের ক্ষেত্রে?
— করে আবার করেও না।
— কী রকম?
— যদি সে ধরা না পড়ে তবে মরবে- এ নীতিতে গুলি করে মারাই হয় সোজা আর তার দাবিতে আওয়াজ উঠবেই।
— এমনই?
— এমনই অনিবার্যতা।
লোকজন জানতে চাইছিল বাঘের ব্যথার আওয়াজে আমার কী, আর যখন বলি ওটা থেকে বোঝা যাচ্ছে বাঘের কোন এক ঠ্যাঙে চোট আছে আর তা হয়েছে গুলি, বা শজারুর কাঁটা থেকে, তারা তক্কো জোড়ে যে অনেকবার বাঘটাকে দেখেছে বেশ হাট্টাকাট্টা অবস্থাতেই, আর তাছাড়া যে অনায়াস বিক্রমে সে শিকার করে বয়ে নিয়ে যায় তার থেকে পরিষ্কার যে সে কোনোভাবেই চোট খাওয়া ল্যাংড়া নয়। যাই হোক, আমার কথা ওরা মনে রেখেছিল আর পরে আমার নামডাক হয় দিব্য দৃষ্টির অধিকারী বলে।
(জিম করবেটের ' মোহনের মানুষখেকো কাহিনীর অংশ ব্যবহৃত হয়েছে, অনুবাদ লেখকের)