মানসের জঙ্গলের মতো গন্ধ পেতে পেতে আমরা হাঁটছিলাম। কিছুটা আগেই মোহনের ফরেস্ট চৌকিটা দেখতে পেলাম। জঙ্গলের অনেক বিটের মধ্যে একটা বিট অফিস। অফিসের আগে একটা লোহার পোল উপরে তুলে রাখা আছে। পোলটায় মোটা দড়ি বাঁধা যাতে টেনে যখন তখন পোলটা নামিয়ে নাকাবন্দী করা চলে। আমাদের এগোতে দেখে আড়চোখে একজন ফরেস্ট গার্ড তাকাল, তাকে অবশ্য গন্ধের কথা জিজ্ঞেস করিনি। চৌকির লাগোয়া বাজার চত্বরে সব পেয়ে গেলাম। বেছেবুছে একটা বড় দোকান থেকে মালপত্র নিতে গেলাম আর দোকানদার বলল, 'জলদি কিজিয়ে'।
— কিঁউ?
— এক আদমখোর।
— আদমখোর?
— জি হা । এক আদমখোরনে হামলা কিয়া।
— কব?
— করিব দশ রোজ আগে।
বলে সে জিনিসপত্র তাড়াতাড়ি দিতে থাকে আর অন্য দোকানগুলোও দেখি বন্ধ হতে আরম্ভ করেছে। আলো থাকতে থাকতে কেটে পড়ছে সবাই। তাদের আর হামলার ব্যপারে জিজ্ঞেস করার সুযোগই দিল না কেউ। বেশ বড় সড় ঘন বসতি এলাকা তৈরি হয়ে গেছে আরো বাড়ছে বসতি। রাস্তা তো ঝাঁ চকচকে, অভ্যস্ত চোখেও জঙ্গলকে আশপাশে দেখা যায় না। বাইক বা গাড়িতে দ্রুত গেলে তো নয়ই। শুধু একটা ঝাপ্টা মারতে থাকে হাওয়ার। সে যে জঙ্গলেরই হাওয়া কে বুঝবে। হয়ত এক নতুন জঙ্গলের আবির্ভাব হয়েছে যেখানে ঘন জঙ্গলের আভাস ছাড়াই বসতির ভেতরই রাস্তার ওপরই আদমখোর বাঘেরা হামলা করবে বলে কোন এক ঝোপের আড়ালে শরীরগুলো মাটিতে লুকিয়ে, মাটির সঙ্গে ক্রমশ মিশে গিয়ে বিশেষ সতর্কতায় গুঁড়ি মেরে মেরে এগিয়ে আসছে। এসব ভাবলে অজান্তেই গায়ে কাঁটা দেওয়ার কথা। কিন্তু আমাদের গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল কি?
আমি জিজ্ঞেস করলাম, 'আপ আদমখোর কো দেখা ক্যায়া?' সে কোনো উত্তর দিল না। রাজু আমার দিকে তাকাল বুঝলাম অবান্তর কথা বলে ফেলেছি। হয়ত ভয় কাটানোর জন্য এই সব কথা বলতে হয়। আর আমাদের অন্য বন্ধু বাঘা আর পার্থ কখন যেন চলে গিয়েছিল মদের দোকানে। সেখান থেকে থেকে মদ কিনে এনে সবে ফিরল হাঁপাতে হাঁপাতে আর বাঘা বলে, 'সব কী প্যানিক খেয়ে আছে মাইরি। তাড়াতাড়ি দোকান বন্ধ করে পালাচ্ছে।'
— পালাচ্ছে?
— বাড়ি চলে যাচ্ছে আরকি!
— তবে পালাচ্ছে বললি কেন?
— ভ্যান্তারা না মেরে তাড়াতাড়ি কর।
— বাবাঃ, ভয় পেয়েছে।
— ভয় নারে! এই মোহনের চৌকির থেকে দু কিলোমিটার আগে একটা ছেলেকে তুলে নিয়ে গেছে বাঘ ।
— তাই?
— হ্যাঁরে সে রকমই বলল।
— হেঁটে যাচ্ছিল?
— হেঁটে যাবে কেন?
— তবে?
— ঘটনাটা ঘটেছে রাতে।
— কখন?
— সাড়ে সাতটা আটটা নাগাদ , বাইক থেকে পিলিয়নে বসা ছেলেটাকে তুলে নিয়েছে।
— কোথায় বসা?
— পেছনে বসা।
— তাই বল।
— হ্যাঁ।
— ছেলেটা?
— খেয়েছে প্রায় পুরোটাই ।
— তাই !
— সেই নিয়ে হেভি প্যানিক। বাঘটা এখনো ঘুরে বেড়াচ্ছে।
— ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট?
— ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টই বলেছে তাড়াতাড়ি দোকান বন্ধ করতে। মাইকিং করছে। পোস্টার মেরেছে। সাবধানে থাকতে বলছে।
আমি দোকানদারকে জিজ্ঞেস করলাম, ''ক্যা সচ হ্যায়? '' দোকানদার কোন উত্তর দিল না। আমাদের মালপত্র গুছিয়ে দিয়ে একটা প্লাস্টিকের কাগজের ব্যাগে ভরল। তারপর টাকার হিসেব করছিল। লোকটা মাঝবয়সী আর মাঝবয়সীদের প্রত্যয় ওর ছিল আরো নানা কিছু ছিল যা দোকানটার আনাচে কানাচে ভরা তাকে মালপত্রের মধ্যে ছড়ানো ছেটানো। তার গন্ধ কি সারা দোকানটায় ছড়িয়ে রয়েছে? সেই গন্ধ আশপাশের জঙ্গলের দিকে রওনা দেওয়ার আগেই আমাদের লেনদেন শেষ হয়ে গেছে। বাঘ আসল না নকল বাঘ, আদমখোরের গল্পটা লোকমুখে ছড়িয়ে থাকা গল্প না আসল কথা, সে সব দোকানদাররের কাছ থেকে যাচিয়ে নেবার কোন অবকাশ না পেয়ে আমরা আবার মালপত্র নিয়ে রিসর্টের দিকে রওনা দিলাম। ঠিক যে ভাবে এসেছিলাম সেভাবে রাস্তা দিয়ে ফেরার সময় আবার রাজ বাতাস শুখতে থাকে। বারবার শোখে । আমি জিজ্ঞেস করি, বাঘা জিজ্ঞেস করে, 'কিছু পেলি?' রাজু কোন উত্তর দেয় না। তারপর ওরা দুজনে দাঁড়িয়ে পড়ে একটা কালভার্টের ওপর জলেদের যাতায়াত দেখে।। একটু পেছনে থাকি আমি আর পার্থ।
করবেট জাতীয় উদ্যানের আকাশের আলোটা হঠাৎ কমে কমে আর এক জঙ্গল মানসের নদীর ধারে সেই বিটটায় – জঙ্গলের বিশেষ অঞ্চলটায় চলে যায়। যেখানে আমরা একটা বোটকা গন্ধ পাই আর চারপাশে ঝোপঝাড়ের আড়ালে সূর্য দেখা যায়, ঝোপের মধ্যে থেকে। অন্ধকার থেকে কিছু বেরিয়ে আসব আসব করেও আসে না। একটা প্রকট গন্ধ যা শোখার জন্য বাতাসের দ্বারস্থ হতে হয়নি, এমনিই গন্ধ চলে এসেছিল।
সে সময় উঁচু নিচু রাস্তার ধারে এক টুকরো চরার জমিতে একটা মা সম্বর দেখলাম সঙ্গে বাচ্চা আর লাগোয়া ঘন জঙ্গলের ভেতর দিয়ে একটা পুরুষ সম্বরের সিং দেখা যাচ্ছিল। তিন ফুটের বেশি লম্বা হওয়ায় সেটা সে লুকিয়ে রাখতে পারেনি । কিম্বা তার অস্ত্রটা উঁচিয়ে আমাদের সতর্ক করছে এমনটাও ভাবা যেতে পারত।একমনে ঘাস খেতে খেতে মা সম্বরটা হঠাৎ মুখ তুলে আমাদের জিপসির দিকে তাকালে, তার বাচ্চাটার ভ্রূক্ষেপ ছিল না। তখন সবাই দেখলাম তার গলায় একটা লাল দাগ। বেশ দগদগে লাল। আমি রাজুকে জিজ্ঞেস করলাম, 'বাঘে কামড়েছিল?' রাজু উত্তর দেয়নি। আর তখন লক্ষ্য করলাম বোটকা গন্ধটা আর পাচ্ছি না। বাঘাকে জিজ্ঞেস করাতে সে বলল, 'আমিও পাচ্ছি না।'
— কি?
— গন্ধ। বোটকা গন্ধ।
বোটকা গন্ধটা চলে যাওয়ায় আমরা সম্বরদের ছবি তুলে রাখি। পরে জানলাম ও রকম দগদগে লাল দাগ নিয়ে পুরুষ আর সদ্য মা হওয়া অথবা গর্ভবতী মেয়ে সম্বররা ঘোরে। দেখে মনে হয় রক্তের চিহ্ন।
আকাশের রঙটা কমে এসে দগদগে লাল হয়ে যাবার কিছু পরে আমরা ঢুকলাম রিসর্টে। বাইরের নালাটায় তখন খানিকটা জল বেড়ে আওয়াজ একটু কম মনে হচ্ছে । তখন রিসর্টের মালিক আমাদের বলল, 'রাত মে রুম সে বাহার মৎ যানা স্যার।' দেখলাম রিসর্ট চত্বরে দুটো রটওয়েলার কুকুর গাছের সঙ্গে বাঁধা রয়েছে। আমাদের দেখে নির্লিপ্তভাবে তাকিয়ে রইল। আর এক বন্ধু পার্থ সিঁটিয়ে বাঘার গায়ে গা লাগিয়ে হাঁটতে শুরু করল। বাঘা তাকে বলে, 'নাও, কুকুর দেখে বিচি সর্ট হয়ে গেছে।'
— কার
— কার আবার?
পার্থ বলল, 'রটওয়েলারদের চোখের রঙগুলো কেমন যেন হয়।' বাঘা বলে, 'কুকুরের সঙ্গে চোখাচোখি করতে কে বলেছে তোকে।' রাজু বলল, 'ফেরা সময়ে কিন্তু আর গন্ধটা পেলাম না।'
— কিসের?
— অথচ যাওয়ার সময় রাস্তায় পেয়েছিলাম দোকান অবধি ছিল।
— কিসের?
— চারিদিকে রিসর্ট। জঙ্গল দেখা যায় না।
— কেন?
— ঘন রিসর্ট আর পাতলা হয়ে এসেছে।
— কী?
— জঙ্গল। পাতলা হয়ে আসা আসল জঙ্গল, রিসর্ট, রাস্তা, দোকানঘর, ফরেস্ট গার্ডের চৌকি নাকা বন্দীর গেট। বাঘ হাটবে কোথা দিয়ে?
— কোথা দিয়ে?
— রাস্তা দিয়ে বাঘ হাঁটছে।
— কখন?
— একটু রাত হলে। কখনও দিনের বেলা। রাস্তায় বসে থাকছে।
— তুই কিসের গন্ধ পেয়েছিলি? বাঘের?
— জানি না।
কুমু অনেকক্ষণ একা ছিল। বারান্দায় বসে বই পড়ছিল সে। আস্তে আস্তে আলো পড়ে আসছে আর ও চলে যাচ্ছে মালানি এফ আর এইচয়ের এরকমই এক সন্ধেয়।কুমু আস্তে আস্তে চা খাচ্ছিল আর গন্ধ পাচ্ছিল লেবুর। এখানে ওরা রেশন নিয়ে এসেছে। তার মধ্যে লেবু ছিল না। ভিকি রান্না করে দিচ্ছে। সে এই লেবু দিচ্ছে যাতে গন্ধ আছে আর তা জঙ্গলের মধ্যিখানে, এই বনবাংলোর হাতার মধ্যিখানে, স্টাফ কোয়ার্টারের আসপাশে বসানো কোন গাছের থেকে সদ্য তোলা। তার বইটা উপুড় হয়ে পড়ে আছে। সেখানে সে মহামারীর ইতিহাস পড়ে দেখেছে যত লোক পৃথিবীতে মারা গেছে তার অধিকাংশই এ দেশের। এখানে প্রদেশ ভাগ নেই। আছে একটা সংখ্যা, সেটা কিছু ধারণার যোগফল যার মানে হল এই সংখ্যক লোক মারা যাবে এমনটাই মনে করা হচ্ছে। কারা মনে করছে? কারা মনে করেছে? কারা মনে করছে না? একশো বছর, দুশো বছর গোটাটাই আসলে মহামারীর ইতিহাস এসব এই সন্ধের আলোয় পড়ছিল কুমু। বাকি তিনজন বারান্দা থেকে বেরিয়ে এসে মালানির বাংলোর চাতালে বসে চা নাস্তা করছিল। সেই সব চায়ের কাপ পড়ে রয়েছে। নাস্তা শেষ হয়ে গেছে। ভিকি আর একবার চা আনতে গেছে। আর দুবেলা জঙ্গল সাফারির ধকল সেরে কুমু পড়ছে মহামারীর ইতিহাস। এটা সে অনেকদিন ধরেই পড়ছে। মহামারী হলেও পড়ছে না হলেও পড়ছে আর পড়ছে করবেট। এই করবেটের জঙ্গলে এসে সে আবারও করবেট পড়বে যেন ঠিক করা ছিল। বাঘেদের এরকম মহামারী হয়েই চলবে এটা বুঝে করবেট ক্যামেরা নিয়ে বাঘ পেতে চাইত। আর করবেট ক্যামেরা নিয়ে বাঘ পেয়েই যেত। সে ওষুধ বিলি করত গ্রামের লোকেদের। বনবাংলোর মধ্যে গ্রামের লোকেদের চাইলেও পাওয়া যাবে না। এখন সন্ধে সাতটা, তার মধ্যেও যে আলো আসছে তাতে সবার ছবি তোলা যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে সবাই গেঞ্জি পরে ছড়িয়েছিটিয়ে বসে আছে। চারপাশ থেকে ভেসে আসছে নানান ডাক — জীবজন্তর সব ‘কল’। এখন কি মালানি বাংলোর তলায় সোঁতার মধ্যে দিয়ে বাঘ তার সঙ্গিনীকে নিয়ে আস্তে আস্তে হাঁটছে। মহামারীতে কিন্তু চিতাবাঘের সংখ্যা বেড়েই চলেছে এমনটা বলেছি করবেট। আধপোড়া, না পোড়া মানুষের মাংসের প্রচুর ভোজ পেয়ে যায় তারা কুমায়ুন গাড়োয়ালের পাহাড়ের আনাচে কানাচে। এখনও কি পাচ্ছে? এবারও?
অন্ধাকার বনবাংলোর চারপাশ থেকে চিতার ডাক শোনা যাচ্ছে। ঘর ঘর ঘর ঘর ঘর ঘক্ ঘক্ ঘক্ ঘক্। তার সামনে কি একটা আয়না রাখা আছে? সেই আয়নায় চিতাবাঘ নিজেকে দেখছে তো দেখছেই আর সেকি নিজেকে ভালোবাসছে? আয়নায় নিজেকে আদর করে পিচ্ছিল স্বচ্ছ কাচের মধ্যে দিয়ে হড়কে হড়কে নিজেকে দেখতে দেখতে কুমু যেভাবে সম্পর্কের লোককে নিজের শরীরে আস্তে আস্তে ঘুরতে ঘুরতে বিছানায়, নরম বিছানায় পাক খেতে খেতে ঢুকতে দেয় — সেরকম ঢুকতে দিচ্ছে? চিতাবাঘ কি মেয়ে? ভাবছিল কুমু আর আলমকে জিজ্ঞেস করাতে সে তাকে শম্বর , চিতল , চিতাবাঘ আর নানা পাখির রাতের ডাক চেনাতে ও শোনাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। অন্ধকার ঘনিয়ে এলে জঙ্গলে তাপমাত্রাও আবার কমে এল। সবাই বাংলোর বারান্দায় ঢুকে পড়ল খোলা চাতাল ছেড়ে।
আমরা যখন ঘরে এলাম দেখি কুমু সব ব্যবস্থা সেরে রেখেছে। ও বলল , '' আজ কিন্তু তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়তে হবে। বসে পড়। ''
— পড়তে?
— দিদিমনি।
— তাও বসতে পার।
— তাই?
— তবে আজ আমরা মাল খেতে বসব।
— দারুণ অভিজ্ঞতা হল রে , তুই মিস করলি।
— কিসের?
রাজুকে বললাম , ''মালটা সারাক্ষণ পড়ে পড়ে ঘুমলো রিসর্টে আর ফোকটে সব জেনে যাবে?'' রাজু বলল,''জেনে তো যাবেই। বলেই দে।''
কুমু বলল , ''বল না, প্লিজ।'' আমি বলেছি ,''আদমখোর।''
— বাঘ !
— ঘুরে বেড়াচ্ছে।
— কোথায়?
— এই মোহনের আশপাশের এলাকাতেই। রাতে ঘর থেকে বেরতে বারুণ করেছে।
— তা হলে তো বেরোতেই হচ্ছে। কটা নাগাদ বেরুবে মানুষখেকো।
— মোহনের মানুষখেকো।
— আবার?
— আবার মোহনের মানুষখেকো।
— এরা আদমখোর বলছিল। ''
— বলুকগে যাক।
— তাই সই।