মন চায় বামের ভোট বাড়ুক। কিন্তু নরেন্দ্র মোদির ভারতে সম্ভবনার শিল্পে কি সে লেভেল প্লেয়িং গ্রাউন্ড আছে যেখানে বামেরা খেলতে পারে ?
ইলেক্ট্রোরাল বন্ড
কর্পোরেট হাউস থেকে টাকা নেওয়ার কিস্সাটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বৈধ কিন্তু সেখানে বাইপোলারিটিতে হাত পড়লে লোকে রে রে করে উঠবে। ওখানে ব্যবস্থাটা আইনি যুক্তিতে অনেক শক্তপোক্ত যদিও কর্পোরেটের কোলে ঝোল টানার, নানা সুবিধে পাইয়ে দিয়ে টাকা নেবার কেলেঙ্কারি সেখানেও আছে। পোষা ময়না মিডিয়ার প্রবল প্রতাপ সেখানেও একই বুলি শুনিয়ে কান ঝালাপালা করে আর তার সোচ্চার প্রতিবাদও হয়। পুরোটাই বাইপোলারিটির আধারে বৈচিত্র্যকে ধরে রাখার গণতান্ত্রিক কৌশল। আমেরিকান মডেলের ল্যাজ ধরে ধরে কর্পোরেট ফান্ডিংকে আইন সম্মত করারে চেষ্টা হল ভারতে। যদিও সে মডেলে বাই পোলারিটিকে অন্তর্ঘাত করার প্রবণতা ছিল আর ছিল রাষ্ট্রের নজরদারিকে জোরদার করার নানা ফিকির। সেটা আইনের চোখে অসাংবিধানিক বলে ত্যাজ্য হয়েছে আর কেলেঙ্কারির উৎসমুখ বলে নিন্দিতও । বামেরা ছাড়া রাজ্যস্তরে ক্ষমতায় থাকা বা প্রবল ক্ষমতাশালী সব দলই ইলেক্ট্রোরাল বন্ডের সুযোগ নিয়েছে। সে হিসেবে বামেদের প্রশংসা প্রাপ্য যদিও তাতে কেরালার সরকারের কর্পোরেট যোগ যে একদমই নেই তা প্রমাণ হচ্ছে না। তবু নিছক ইলেক্ট্রোরাল বন্ড নেওয়া না নেওয়ার প্রশ্নে শিবির বিভাজন হলে একদিকে বামেরা থাকে অন্য দিকে বাকি সব দল ।
সমস্যা বাইপোলারিটির
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাইপোলারিটি স্বতঃসিদ্ধ। ওটার আধারে সে দেশের বহু বৈচিত্র্য রক্ষা হয় কিনা প্রশ্ন কিন্তু কেউ বাইপোলারিটি উঠিয়ে দেবার উপক্রম করে বেগড়বাঁই করলে, সে রাজনৈতিক দলের কপালে দুঃখ আছে এটা ট্রাম্পের পরাজয়ে প্রমাণিত। মোদির ভারতের সাধারণ নির্বাচন ২০২৪ তে বাইপোলারিটি উঠিয়ে দেবার উপক্রম হয়েছে এটাই সারা বিশ্বে চর্চিত বিষয়। মোদি বলছেন: আমার ব্যর্থতা হল শক্তিশালী বিরোধী না থাকা। অর্থাৎ তিনি বাইপোলারিটির অভাব সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক আশংকাকে, একনায়কতন্ত্রের জোরালো অভিযোগকে খণ্ডন করতে পুরো দোষটা আবার বিরোধীদের ঘাড়ে চাপিয়েছেন। অবশ্য ব্যাপারটা এমন নয় যে এর জন্য বিরোধী দলগুলোর দায়িত্ব নেই। প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসের প্রাপ্ত লোকসভা আসন, মোদির দল বিজেপির আসনের ছ ভাগের এক ভাগ। কংগ্রেসের একার পক্ষে কিছুতেই বাইপোলারিটির দাবিদার হওয়ার হক নেই। নিজেদের দুরাবস্থার কথা কংগ্রেসও জানে, অন্য আঞ্চলিক দল মানে আর বামেরাও টের পায় কারণ তাদের অবস্থা আরো কেরোসিন। একনায়কের দাপাদাপিতে ফেডারালিজমের বারোটা বেজে মাল্টি তো দূরের কথা বাইপোলারিটির শিয়রে শমন।
সমাধান ইন্ডিয়া জোট
সমস্যা যেহেতু বাইপোলারিটির, সমস্যা যেহেতু বিরোধীদের সবার আর আক্রমণের উৎস যেহেতু এক ও অভিন্ন মোদির বিজেপি, তাই মোদির ভারতেও গড়ে উঠেছে ইন্ডিয়া জোট। একমাত্র জঙ্গলের ঘেরাটোপে অভ্যস্থ মাওবাদী ছাড়া সব রাজনৈতিক বিচারাধারার দল এতে নানান ভঙ্গিমায় সামিল। এমনকি তামিলনাড়ু , কর্ণাটক , মহারাষ্ট্র , উত্তরপ্রদেশ , বিহার , রাজস্থান, ঝাড়খন্ড, দিল্লী এরকম কিছু রাজ্যে পরিপূর্ণ আঁতাত হলেও সংবিধান বাঁচানোর, দেশের বৈচিত্র্যপূর্ণ ফেডারেল কাঠামো অটুট রাখার তাগিদ থেকেই মোদির বিজেপির বিকল্প ন্যারেটিভ তৈরি হয়েছে ইন্ডিয়া জোটকে ঘিরে। ২০২৪এর সাধারণ নির্বাচনের ছটা দফার পর এটা পরিষ্কার যে বিজেপি বনাম ইন্ডিয়া বাইপোলারিটি হল সাধারণ বাস্তবতা। এই বাইপোলারিটির আধারেই ভারতের বহুধা বিচিত্র সামাজিক -অথনৈতিক -রাজনৈতিক গতিশীলতা আবর্তিত হচ্ছে।
নির্বাচনের আগে কয়েক মাসের মধ্যে একটা অন্য ভারতের ছবি উঠে এসেছে আর সেটা মোদির ভারতের নয় এক বাইপোলার ভারতের। নির্বাচনের ফলাফল দেশকে আবার, দেশ সম্পর্কে ধারণাকে আবার সেই মোদির উগ্র হিন্দু রাষ্ট্রের ধারণায় ফিরিয়ে নিয়ে যাবে কিনা সেটাই প্রশ্ন। যদি মোদির বি জে পি জেতে তবে মোদির ভারত গড়গড়িয়ে হিন্দু রাষ্ট্রের দিকে এগোবে তাতে কোন সন্দেহ থাকার কারণ আছে?
বাইপোলার ভারতে বামেদের ভোট দেওয়ার প্রশ্ন
স্বতন্ত্র শক্তি হিসেবে বামেদের ভূমিকা এমনকি এই বাইপোলার পরিস্থিতিতেও অনস্বীকার্য। তাই তাদের ভোট দেওয়াটাও গুরুত্বপূর্ণ। খেলার ছলে কেই বা নেবে কৃষক আন্দোলনের অন্যতম চালিকা শক্তি বামেদের? মুশকিল হল ২০২৪ য়ের সাধারণ নির্বাচনে বামেদের বড় অংশকে বেশির ভাগ আসনেই ইন্ডিয়া জোটের আঁতাতের বাইরে প্রার্থী দিতে দেখা গেছে। সবচেয়ে বড় বাম দল সি পি আই এম দিয়েছে মোট বাহান্নটা আসনে। তার মধ্যে কেরালার পনেরোটা সিটে আর বাংলার তেইশটা যথাক্রমে কংগ্রেস আর তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে। ইন্ডিয়া জোটের নেতৃত্ব এই শরিকি লড়াইয়ে ভাবিত নয় কারণ এই দু রাজ্যে জোট করতে যাওয়ার বাস্তবতা নেই। উল্টে করতে গেলে বিরোধী স্পেস বিজেপি খেয়ে নিতে পারে। এ কথাটা কেরালা আর পশ্চিম বাংলা এই দু রাজ্যে শুধু নয় পাঞ্জাবের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। সেখানেও রাজ্যে ক্ষমতায় থাকা আপ আর কংগ্রেসের মধ্যে দা কাটারি সম্পর্ক। অর্থাৎ যেখানে নির্বাচনী জোট হয়নি সেখানে নির্বাচন পরবর্তী জোটের কথাই ইন্ডিয়া জোটের নেতৃত্বের মাথায় আছে। সে কথা মাথায় রেখে, পশ্চিম বঙ্গে দুই যুযুধান ইন্ডিয়া শরিক তৃণমূল কংগ্রেস আর বামফ্রন্ট-কংগ্রেস ভোট পরবর্তী অবস্থান নিয়ে এখনই বিতর্কে মেতেছে। উদ্দেশ্য নিজের নিজের ভোট ব্যাংক চাঙ্গা রাখা। এর শুরু করলেন মমতা, তিনি সম্ভাব্য ইন্ডিয়া জোটের সরকারে বাইরে থেকে সমর্থনের কথা বলে তাঁর দলের সিপিআইএম -কংগ্রেস বিরোধিতার মনোভাব জোরদার করলেন আর তার প্রতিক্রিয়ায় অন্য পক্ষ যা যা বলার বলায়, কংগ্রেস হাই কমান্ডকে সামাল দিতে হল।
ভোটের তাৎক্ষণিকতার ছেদবিন্দু
এই সর্বভারতীয় প্রেক্ষিতে সপ্তম দফা নির্বাচনের আগে ভাবছিলাম বামেদের ভোট দেওয়ার বিষয়টা। পশ্চিমবাংলার ভোটে এবারে আংশিক হলেও ত্রিমুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতার কিছু অভ্যাস দেখা যাচ্ছে যদিও ভোটের পর একটা বাইপোলারিটিকে মানার, ইন্ডিয়া জোটেই থাকার বাধ্যতা আছে সেটা সবাই জানে। তবু এখনকার লড়ায়ের সঙ্গে পরের সন্ধির , একটা ছেদ বিন্দু টানা যেতে পারে ভোটের তাৎক্ষণিকতার স্বার্থে। সেক্ষেত্রে বাংলার বিজেপি বিরোধী লোকজন, বিজেপির বিরুদ্ধে সম্ভাব্য বিজয়ীকেই ভোট দেবে বলে মনে হচ্ছে । হয়ত বেশির ভাগ জায়গায় তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষেই ওই ভোট গেলেও , বামফ্রন্টের বা কংগ্রেস প্রার্থীরা জেতার সম্ভবনার নিরিখে ভোট পাবেন। বাইপোলার ভারতকে টিঁকিয়ে রাখতে , এই তাৎক্ষণিকতার ছেদবিন্দুর কথা মাথায় রেখেই , বামেদের প্রতি যাবতীয় দুর্বলতা থাকলেও , কিছু তেতো বড়ি আমাকে গিলতেই হচ্ছে এটা বেশ বুঝতে পারছি।