লোকসভা ভোট শেষ দফায়। এবার ভোটে উত্তুঙ্গ কোনো উদ্দীপনা ছিলনা, ছিলনা কোনো হাওয়া, চাপা এক উৎকণ্ঠা নিয়ে ভোট হয়েছে। সেই ধারা শেষ দফায়ও অব্যাহত। রাজনৈতিক পটচিত্রে উত্তেজনার অবশ্য কোনো অভাব হয়নি। অভাব হয়নি নাটকীয়তার। ভোটের ঠিক আগে নির্বাচনী বন্ড সংক্রান্ত রায় এসেছে সুপ্রিম কোর্টের। নির্বাচনের মধ্যেই এসেছে কলকাতা হাইকোর্টের পরপর দুটি রায়। একটিতে বিপুল সংখ্যক রাজ্য সরকারি শিক্ষককে কর্মচ্যুত করা হয়েছে, অন্যটিতে ২০১০ সালের পর পশ্চাদপদ অংশের সংরক্ষণকে একরকম করে বাতিল করা হয়েছে। দুটির চূড়ান্ত রায়ই অবশ্য সুপ্রিম কোর্টে ঝুলে। সন্দেশখালি ভোটের আগে থেকেই শিরোনামে। কিন্তু ভোটের মধ্যে এসেছে নতুন চমক। গঙ্গাধর কয়ালের এবং আরও কয়েকটি ভিডিও ফাঁস হয়ে ভাইরাল। এসেছে স্বয়ং রাজ্যপালের বিরুদ্ধে যৌন হেনস্থার অভিযোগ।
এত চাপান-উতোরের মধ্যে, কলকাতায় ভোটের ঠিক আগে, লাখ টাকার প্রশ্ন একটাই। পশ্চিমবঙ্গে কে জিততে চলেছে। কেন্দ্রে সরকার যেই গড়ুক, পশ্চিমবঙ্গে জুন মাসের চার তারিখে কার গলায় উঠবে বিজয়ীর মালা। বিজেপি দীর্ঘদিন ধরেই দাবী করে আসছে, এবার পশ্চিমবঙ্গ তাদের। ৪২ এর মধ্যে ২০ থেকে ৩০ এইরকম নানাসংখ্যক আসনপ্রাপ্তির দাবী শোনা যাচ্ছে কান পাতলেই। তাদের কর্মসূচি পরিষ্কার। একদিকে ধর্মীয় মেরুকরণ তৈরি, অন্যদিকে শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকারের সামনে তৃণমূল কংগ্রেসকে অসহায় ঠুঁটো জগন্নাথ এবং দুর্নীতিগ্রস্ত, অপদার্থ প্রমাণ করা। এই অ্যাজেন্ডায় সন্দেশখালি নিয়ে মিডিয়াজোড়া হইচই তাদের পালে হাওয়া দিয়েছিল নিঃসন্দেহে। হাইকোর্টের দুখানি রায়ই পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে বেকায়দায় ফেলেছে, এ নিয়েও কোনো সন্দেহ নেই। ২১ সালের মতই, ভোট যখন শুরু হয় তখন তাদেরই হট-ফেভারিট মনে হচ্ছিল। প্রথম দফার ভোটের পরও সেই অবস্থা বদলায়নি। কিন্তু একই সঙ্গে এও ঠিক, দ্বিতীয় দফার ভোটের পর থেকেই সেই হাওয় ফিকে হতে শুরু করে। পরের দফার দিনই আসে হাইকোর্টের রায়। রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে যাওয়া এই রায় সরকারকে বেকায়দায় ফেলেছে ঠিকই, কিন্তু একই সঙ্গে কোর্টের উপর রাজনৈতিক প্রভাবের ন্যারেটিভকেও সামনে এনে দিয়েছে। এক দফায় এতগুলো চাকরি চলে চলে যাওয়াকে বহু মানুষই সহজভাবে নেননি। তার উপর এসেছে একাধিক ভিডিও এবং রাজ্যপালের উপর প্রভাব। এর মধ্যে কোনো একটা, বা সবকটা কারণেই, বিজেপির অগ্রগতি উত্তর থেকে দক্ষিণে, প্রথম থেকে দ্বিতীয়-তৃতীয় দফায় অনেকটাই ফিকে হয়েছে। পর্যবেক্ষকরা জানাচ্ছেন, এমনকি শুভেন্দুর গড়ে নতুন দুখানা আসন পেয়ে গেলেও, আগের বারের আসন সংখ্যা ধরে রাখাই বিজেপির সামনে চ্যালেঞ্জ। সেটাও আদৌ সম্ভব নাও হতে পারে।
উল্টোদিকে তৃণমূলের তরফ থেকেও গোটা তিরিশেক আসনের দাবী শোনা যাচ্ছে। নিঃসন্দেহে নানারকম দুর্নীতির মামলায় এবং সন্দেশখালির তীব্র মিডিয়া ফোকাসে তৃণমূল এবার কিছুটা বিপাকে ছিল। কিন্তু বিজেপির ফিকে হয়ে যাওয়াটা অবশ্যই তৃণমূলের পক্ষে গেছে। শুধু ভাইরাল ভিডিও বা রাজ্যপালের বিরুদ্ধে অভিযোগই না, অভিজিৎ গঙ্গ্যোপাধ্যায়ের বিজেপির প্রার্থী হওয়া থেকে শুরু করে আরেক অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির নিজমুখে আরেসেস যোগের কথা ঘোষণা করা, সবকটাই তৃণমূল-বনাম- বিজেপি বাইনারি তৈরি করতে সহায়তা করেছে এবং ভোট যত এগিয়েছে, সেটা তৃণমূলের পক্ষেই গেছে। লক্ষ্যণীয় এই, যে, ২১ সালে বরং তৃণমূলকে অনেক বেশি নড়বড়ে লাগছিল। দলে দলে নেতা 'দলে থেকে কাজ করতে পারছিলাম না' বলে দল ছাড়ছিলেন, মুখ্যমন্ত্রীকে জয়-শ্রীরাম ধ্বনি দিয়ে উত্যক্ত করা হচ্ছিল। এবার সেসবের চিহ্নমাত্র নেই। তৃণমূলের ভিতরে জেতা নিয়ে কোনো সংশয় থাকলে, ওই স্রোত আবারও দেখা যেত, নিঃসন্দেহে। এবার বরং উল্টো হচ্ছে। দক্ষিণবঙ্গে বিজেপির প্রার্থীরা বুথের ধারেকাছে গেলে গো-ব্যাক স্লোগান উঠছে। উত্যক্ত করা হচ্ছে। ভোট শেষে নিয়ম করে তৃণমূল কর্মীরা পালন করছেন বিজয়োৎসব। ভাইরাল ভিডিও ছাড়া হচ্ছে নিয়ম করে। তৃণমূলের মতো ক্লাবসদৃশ দলের পক্ষে এ একেবারেই অভূতপূর্ব। সব মিলিয়ে প্রথম দফার পর থেকেই তৃণমূল পরিকল্পনামাফিক এগিয়েছে। তাদের হাঁটু ২১ সালের মতো কাঁপছেনা। গতবারের লোকসভার আসন সংখ্যা এবার বাড়া, আশ্চর্য কিছু না।
হিসেব গুলিয়ে দিতে মঞ্চে অবশ্যই আছেন তৃতীয় পক্ষ। বাম-কংগ্রেস জোট। শোনা যাচ্ছে, অন্তত কিছু আসনে তাঁদের ভোট বাড়বে। এবং তত্ত্বগতভাবে হিসেব এখানে খুব সহজ। তাঁদের বাড়া ভোট যদি হারিয়ে যাওয়া ভোটব্যাঙ্ক অর্থাৎ রাম-ভোট থেকে আসে, তো তৃণমূলের বিজয়রথের গতি আরও বাড়বে। উল্টোদিকে, সেই বাড়তি ভোট যদি আসে তিতিবিরক্ত তৃণমূল ভোটারদের কাছ থেকে, তাহলে তৃণমূলের এত পরিকল্পনা সত্ত্বেও চাকা বসতে বাধ্য। অবশ্য, এও হতে পারে, বাম-ভোট আদতে তেমন বাড়লনা। ভোটের আগে তেমন মনে হচ্ছিলনা। কিন্তু ভোট যত গড়াচ্ছে, ততই একদিকে অন্তত কিছু আসনে যেমন দেখা যাচ্ছে লাল-পকাকার ভিড়, তেমনই মিডিয়ায় তৈরি হচ্ছে তীব্র বাইনারি। যেকোনো টিভি খুললেই দেখা যায় রাজনৈতিক আলোচনায় কেবল দুটি পক্ষ, তৃণমূল এবং তৃণমূল- বিরোধী, অর্থাৎ বিজেপি। এই দুটি পক্ষের মধ্যেই চাপান-উতোর, এবং বামরা যে বাইনারির বিরুদ্ধে রাস্তায় বলছেন, সেটা তাঁদেরই আলোচকরা প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করছেন টিভির পর্দায়। এই গুলিয়ে যাওয় নীতি, সেটা ইন্ডিয়া জোট বনাম সেটিং তত্ত্বের মধ্যেও পরিষ্কার। রাস্তার হিসেব, তরুণ প্রার্থীদের পরিশ্রম ধরলে বামদের কিছু ভোট অবশ্যই বাড়া উচিত, কিন্তু গুলিয়ে যাওয়া আর তীব্র মেরুকরণের মধ্যে সেটা কতটা হবে বলা কঠিন।
সব মিলিয়ে, প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবারও তৃণমূল-বিজেপির মধ্যেই। প্রথম স্থান তৃণমুলই পাবে, এখনও মনে হচ্ছে, কিন্তু বিজেপি ভয়াবহ কিছু ইছিয়ে থাকবে এমনটা নাই হতে পারে। বামদের কতটা উত্থান হয় এবং সেটা রাম-ভোট কেটে হয় কিনা, তার উপর ব্যাপারটা অনেকটাই নির্ভর করছে