হঠাৎ সকালবেলা ফোনে যদি টুং করে অচেনা নম্বর থেকে মেসেজ ঢোকে 'অমুক পার্টিকে ভোট দিন', কতজন সাধারণ মানুষ আদৌ তাতে প্রভাবিত হবেন? বেশির ভাগই নাক কুঁচকে, ফোনটা আবার উল্টে রেখে দেবেন। কিন্তু যদি স্বল্প পরিচিত কোনো নম্বর থেকে বা বন্ধুদের হোয়াটস্যাপ গ্রুপে মেসেজ ঢোকে 'সুপ্রভাত, সকাল সকাল সূর্য নমস্কার করলে শরীর ভালো থাকে', এই নিরামিষ মেসেজে বেশিরভাগ সাধারণ লোকই উল্টে হাসিমুখে সম্মতি জানাবেন। কিন্তু এই মেসেজ গুলো আসলেই এত নিরামিষ নয়, একটা সুচারু কৌশলের অংশমাত্র। প্রথমে সেই মেসেজে পজিটিভ রেসপন্স এলে আবার পরের সপ্তাহে মেসেজ আসে, 'আয়ুর্বেদ মতে জীবন যাপন করলে শরীরের সব রোগ সেরে যাবে, আয়ুর্বেদ ভারতের গর্ব', ' সিয়াচেনে সেনারা প্রাণ দিচ্ছেন, তাঁদের কথা ভাবুন, নিজের কষ্ট কমে যাবে', ' কেদারনাথজির এই দুষ্প্রাপ্য ছবিটা সবাইকে ছড়িয়ে দিন, সৌভাগ্য আপনার জীবনে আসবেই', আপনি ভাবছেন এগুলোও তো নেহাতই নির্দোষ মেসেজ। এর পর ধীরে ধীর এর সাথে মেশানো হয় 'ইউনেস্কো ভারতের জাতীয় সঙ্গীতকেই মধুরতম জাতীয় সঙ্গীত ঘোষণা করেছে', ' গুজরাটে ভারতের সর্বোচ্চ মূর্তিকে চাঁদ থেকেও দেখা যায়', ' হার্ভার্ড এর গবেষক বলেছেন হিন্দুধর্মই পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত ধর্ম' ধরণের ফেক নিউজ যা শুধুমাত্র তৈরি সাধারণ মানুষ যাতে এই মিথ্যের জালে ফেঁসে গর্ব অনুভব করতে পারেন, সেই কারণেই। যতজন এসব মেসেজ পান খুব কম মানুষই নেটে সার্চ করে এর সত্যতা খুঁজে দেখেন। এইভাবে তাকে ম্যারিনেট করা শুরু হয়। এরপর তাক বুঝে মাঝে মাঝে ছুঁড়ে দেওয়া হয় সিরিয়া বা বাংলাদেশের ভিডিও, উত্তরপ্রদেশ বা পশ্চিমবঙ্গের ভিডিও হিসেবে সাজিয়ে, উদ্দেশ্য একটাই, আপনাকে উত্তেজিত করা। নানান জায়গার মিথ্যে খবর শেয়ার করা হতে থাকে, যার মূল সুর একটাই, কোনো নির্দিষ্ট জাতি বা গোষ্ঠীকে শত্রু প্রতিপন্ন করে সেই কল্পিত শত্রুর বিরুদ্ধে ভোটারদের ঐক্যবদ্ধ করা ও তার প্রতিফলন হিসেবে শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে অমুক পার্টিকে ভোট দেওয়ানো। তাহলে যেটা এক মেসেজেই বলা যাচ্ছিল, সেটা কিন্তু বলা হল এত গুলো ধাপ পেরিয়ে, এবং সরাসরি নয়, আড়ে আড়ে, কিন্তু তার কার্যকারিতা অনেক অনেক বেশি হয়ে দাঁড়াল।
এই পুরো প্রক্রিয়াটা যারা নিয়ন্ত্রণ করছে তারাই হল সেই রাজনৈতিক পার্টির আই টি সেল। এরা প্রোপাগান্ডা ছড়ানোয় অসম্ভব দক্ষ হলেও শুধু প্রোপাগান্ডা ছড়ানোই এদের কাজ নয়। এরা প্রচুর পরিমাণে তথ্য জোগাড় করে ও তা বিশ্লেষণ করে কোন রাজ্যের, কোন জেলায়, কোন গ্রামে, কোন বুথে দলের কি শক্তি ও দুর্বলতা রয়েছে, কার ওখানে প্রভাব রয়েছে, কোন বিষয়টা ভোটের জন্য ভালো ইস্যু হতে পারে সবই দলকে জানায় ও দল সেই বুঝে পরিকল্পনা ঠিক করে। ইলেক্টরাল রোলের প্রত্যেক পাতা একজন করে 'পন্না-প্রমুখ' কে দেওয়া হয়, ভোটের আগে বাড়ি বাড়ি লোক গিয়ে ভোটারদের সাথে কথা বলে ও সেই কথায় কারা কিভাবে প্রতুত্তর দিলো তা নোট করে সেসব বিশ্লেষণ করে তিন ভাগে ভোটারদের ভাগ করা হয় - পক্ষে, নিরপেক্ষ ও বিপক্ষে। পক্ষে ও নিরপেক্ষ যারা আছেন তাদের ইস্যু গুলোকে টার্গেট করা হয় ও বিপক্ষ যারা তাদের ওপর নজর রাখা হয়। অনেকক্ষেত্রে আবার বাড়ি বাড়ি যাওয়া সম্ভব হয়না, তখন ফোনে পলিটিকাল সায়েন্সের ছাত্রদের সমীক্ষার আছিলায় বা কাছাকাছি পদ্ধতিতে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এইভাবে বুথ লেভেল থেকে তথ্য নিয়ে প্রতি জেলার ডেটাবেস বানিয়ে কার্যপদ্ধতি কি হবে স্থির করা হয়।
এই আইটি সেলে আবার প্রত্যেক কর্মীই সমান তা নয়, নানা স্তরবিন্যাসে তারা বিভক্ত। আইটি সেলের প্রধানের অধীনে প্রায় দেড়শো থেকে আড়াইশো জনের এক কোর গ্রুপ কাজ করে, যাদের মূল কাজ কোন বিষয়ে প্রোপাগান্ডা ছড়ানো হবে তা ঠিক করা ওই সেই মতো কন্টেন্ট লিখে রেডি করা। এর পরের স্তরে থাকে বিভিন্ন রাজ্যের ও বিভিন্ন জেলার নানা সূত্রধর যারা সেগুলো নিয়ে কোন মাধ্যমে কি প্রোপাগান্ডা ছড়ানো হবে তা বুঝে যারা সেসব ছড়াবে তাদের কে পৌঁছে দেওয়া।
নিচু স্তরের কর্মীদের নেওয়া হয় অনলাইনে চোখ রেখে, যারা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে দলের পক্ষে বলছে, বিভিন্ন প্রচারে প্রভাবিত হয় বেশি ও নেটে বেশ সক্রিয় এক্ষেত্রে তাদেরই বেছে নিয়ে যোগাযোগ করে আইটি সেলে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়। যোগ দেওয়ার পর এদের মূল কাজ হয়, আইটি সেলের কন্টেন্ট নিমেষে ভাইরাল করা ও দলের বিরুদ্ধে কোনো ফোরামে বা ফেসবুক গ্রুপে বা টুইটারে যখনই কেউ বিরূপ সমালোচনা করছে তার পিছনে লেগে তাকে হ্যারাস করা। যেসব জায়গায় নিয়ন্ত্রণ কিছুটা ঢিলে ঢালা অথচ সাধারণ মানুষের আনাগোনা ভালোই রয়েছে, সেখানে এরা ধীরে ধীরে নিজেদের সংখ্যা বাড়ায় ও যখন কেউ উল্টো কথা বলে, দশ বারোজন মিলে সেই কথার বিরোধিতা করতে থাকে, কমেন্ট অনেকে মিলে রিপোর্টও করে দেয় এবং সাথে সেইসব সাইটে বা গ্রুপে দলের প্রচ্ছন্ন সমর্থন গড়ে তোলার চেষ্টা করে।
কোনো লেখা বা ছবি নিমেষে ভাইরাল করার জন্যও রয়েছে রকমারি ব্যবস্থা। ফেসবুক, টুইটার বা ইন্সটাগ্রামে হ্যাশট্যাগ জিনিসটা খুব কার্যকর। কোনো বিষয় ট্রেন্ড হচ্ছে কিনা বোঝা যায় সেই সাইটে ওই নির্দিষ্ট হ্যাশট্যাগ দিনে কতবার ব্যবহার হচ্ছে তা দেখে। এই কারণে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রেখে আইটি সেলের নিচু তলার কর্মীরা বিভিন্ন সাইটে, গ্রুপে ও ফোরামে উপর মহল থেকে পাঠানো লেখা ও ছবি একইসাথে একই হ্যাশট্যাগ দিয়ে পোস্ট করা শুরু করে। তার ফলে সহজেই তা দ্রুত ট্রেন্ডিং -এ চলে আসে ও বিভিন্ন সাধারণ ইউজারের ফিডে বা মূল পৃষ্ঠায় পৌঁছে যায়, সেসব সাইটের রেকমেন্ডেশন অ্যালগোরিদমের পিঠে চড়ে। এটার একটা প্রকৃষ্ট উদাহরণ এই কিছু বছর আগেই বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙার পর, লাখে লাখে বিদ্যাসাগর কলেজের ছাত্রকে বা শীতলখুচির ঘটনার পর কয়েক হাজার শীতলখুচির প্রিসাইডিং অফিসারকে ফেসবুকে ঘুরে বেরাতে দেখা গিয়েছিল ও আশ্চর্যজনক ভাবে সবার অভিজ্ঞতাই ছিল এক!
বড় বড় মন্ত্রী ও দলের পদাধিকারীরাও এভাবেই দল বেঁধে আইটি সেলের ঠিক করে দেওয়া বয়ানই একই হ্যাশট্যাগ দিয়ে পোস্ট করেন। তাঁদের ডকুমেন্ট ফরম্যাটে ট্রেন্ড অ্যালার্ট নামে একটি ফাইল আইটি সেলের পক্ষ থেকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়, যাতে বলে দেওয়া থাকে কোনো নির্দিষ্ট ইস্যুতে আপনি কোন হ্যাশট্যাগ সহযোগে কি পোস্ট করবেন। তাঁরা বিনাবাক্যব্যয়ে চোখ কান বুঁজে সেই পোস্ট কপি-পেস্ট করেন। তাঁরা যে কতটা চোখ বুঁজে সেগুলো পোস্ট করেন তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ পাওয়া যায় যখন একবার ভুল বশত এক পদাধিকারী পোস্টের সঙ্গে সঙ্গে ভুল করে ট্রেন্ড এলার্ট এর ফাইলটিও পোস্ট করে ফেলেন।
সাধারণত সেই ফাইল ভিউ অনলি করা থাকে, কিন্তু কোনো কারণে একবার সেই ফাইলের এডিটিং এর অপশন খোলা ছিল ও তা নেটে কিছু কিছু মানুষের কাছে ছড়িয়ে পড়ে। অল্ট নিউজের প্রতীক সিনহা কালক্ষেপ না করে তা এডিট করে কিছু কিছু কথা বদলে দেন, যার ফলশ্রুতিতে দেখা যায় একটি রাজনৈতিক দলের কিছু অফিশিয়াল প্রোফাইল থেকে বলা হচ্ছে 'সততা ও স্বচ্ছতার অভাবই এই সরকারের নতুন ভারতের চিহ্ন'।
এবার আইটি সেলগুলো এমন এমন কিছু পোস্টও তৈরি করে যা সাধারণত কোনো দলের পদাধিকারী বা অফিশিয়াল পেজ থেকে পোস্ট করা সম্ভব নয়। তার জন্য তাই তৈরি করা আছে লক্ষ লক্ষ ফেসবুক গ্রুপ যার সাথে খালি চোখে রাজনৈতিক দলের কোনো যোগসূত্র নেই। তাদের নামেই তারা ঠারে ঠারে বুঝিয়ে দেয় কোনদিকে ঝুঁকে আছে। 'নমো আর্মি', 'ভক্ত হ্যায় হাম', 'রামজি কে শরণ মে', 'মোদীজি ফ্যান ক্লাব', 'ভাগোয়া দল', 'আর নয় অন্যায়' এইরকম সব তাদের নাম। তাতে রোজ প্রচুর পোস্ট হয় ও সেসব গ্রুপে মেম্বারও অসংখ্য। নানা মিম, ভিডিও, ফেক নিউজ, জোকস এইসব গ্রুপে পোস্ট করা হয়ে থাকে যার মাধ্যমে সূক্ষ্ম ভাবে মানুষের মনে ছাপ ফেলে নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের কাছে টানা হয় ও বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতা নেত্রীকে হেয় করা হয় ও তাদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ প্রচার করা হয়। যারা এসব গ্রুপ চালায় ও প্রতিনিয়ত পোস্ট করে তাদের প্রোফাইলে ঢুকলে দেখা যাবে বেবাক ফাঁকা, শুধু নাম কে ওয়াস্তে একটা প্রোফাইল পিকচার ছাড়া কিচ্ছুটি নেই, কোনো পোস্ট নেই, টাইমলাইনে কোনো ছবি নেই, কিচ্ছু না! প্রোফাইলে মানুষের ছবি থাকতে পারে, আবার কোনো মহাপুরুষের ছবিও থাকতে পারে, এমনকি চন্দ্র, সূর্য, হনুমান, জাম্বুবান যে কারোর ছবিই থাকতে পারে। কিন্তু এই গ্রুপগুলোর পোস্ট রোজ লক্ষ লক্ষ মানুষের কাছে পৌঁছয় কি করে?
এইসব ফেসবুক গ্রুপ নিয়মিত নিজেদের পোস্ট ফেসবুকে টাকা দিয়ে বুস্ট করায়, যার ফলেই তার এত বেশি রিচ হয় ও এত মানুষের কাছে নিয়মিত পৌঁছয়। হিসেব করে দেখা গেছে এই সমস্ত বড়ো বড়ো গ্রুপ কোটি কোটি টাকা পোস্ট বুস্টিং এর পিছনে ব্যয় করে, যা ভোটের মুখে আরো বেড়ে যায়। পিছনে যদি কোনো রাজনৈতিক দলের হাত না থাকে, তাহলে কি সাধারণ ভক্ত বা ফ্যানরা নিজের পকেটের টাকা দিয়ে এইসব পোস্ট জনস্বার্থে বুস্ট করেন? উত্তর খোঁজার দায়িত্ব পাঠকের।
এরকম বহু ফেসবুক গ্রুপ আছে আবার ইন্ডিয়ান আর্মির নাম দিয়ে। শক্তিগড়ে যেমন ল্যাংচা মহল, ল্যাংচা প্যালেস, ল্যাংচা মিউজিয়াম এরকম নানা নামে পরপর ল্যাংচার দোকান, তেমনই ফেসবুকে রিয়েল ইন্ডিয়ান আর্মি, ইন্ডিয়ান আর্মড ফোর্স, ইন্ডিয়ান আর্মি ফ্যান, আর্মি ফ্যান ক্লাব, দা ইন্ডিয়ান ফোর্স বলে অসংখ্য ফেক পেজ খুলে রাখা আছে যাতে নানান কট্টর প্রোপাগান্ডা নিয়মিত পোস্ট করা হয়। মজার কথা এইসব পেজগুলোর অনেকেরই ভিউ বা রিচ ইন্ডিয়ান আর্মির অফিশিয়াল পেজের থেকেও অনেক বেশি।
ভোটের মুখে এটা মানুষের কাছে স্পষ্ট, একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দল, দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘু মানুষদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়িয়ে মেরুকরণের চেষ্টা করে। কিন্তু শুনলে অবাক হবেন আইটি সেল মুসলিম জনগণকে টার্গেট করেও প্রচুর পেজ বানায়। এতে নিয়মিত কোরআনের আয়াত, মক্কার ছবি, ভিডিও পোস্ট করে তাঁদের আকৃষ্ট করা হয়। তারপর বেশ ভিড় জমলে সরকারের প্রচার, গুণগান শুরু হয় অল্প অল্প করে। এমন এমন জিনিস প্রচার করা হয় যেখানে মনে হয় সত্যিই সরকার সংখ্যালঘু উন্নয়নে কোনো চেষ্টার খামতি রাখেনি।
সব গ্রুপে একই জিনিস পোস্ট করা হয়না, প্রত্যেক গ্রুপের নির্দিষ্ট টার্গেট অডিয়েন্স রয়েছে। শহুরে গ্রুপে বিষয় দাঁড়ায়- ঝাঁ চকচকে উন্নয়ন এই সরকার ছাড়া কেউ দিতে পারবে না, শেয়ার বাজার তরতরিয়ে উঠবে, একমাত্র এরা থাকলেই শিল্প-ব্যবসা-বাণিজ্য শ্রীবৃদ্ধি হবে। বয়স্কদের গ্রুপে বিষয় বদলে দাঁড়ায় ধর্মীয় মেরুকরণ, অন্যদের থেকে ভয় দেখানো, কট্টর হিন্দুত্ব প্রচার ইত্যাদি। তরুণদের গ্রুপে ঠাট্টা ইয়ার্কির মধ্যে দিয়ে বুঝিয়ে দেওয়া হয় একমাত্র এই সরকার থাকলে তবেই ভারতের নাম ভবিষ্যতে উজ্জ্বল হবে, শক্তিশালী রাষ্ট্র তৈরি হবে। আবার গ্রাম-দেহাতের দিকে সেখানকার কিছু ইস্যুর ওপর নজর দেওয়া হয়, দারিদ্র দূর, বিদ্যুৎ, জাতপাত, বেরদরি, আবেগ প্রোপাগান্ডার বিষয় হতে থাকে।
এইসব গ্রুপে মানুষ যতদিন থাকে, তত কাছাকাছি বিষয়ের আরো খবর ফেসবুক তাদেরকে পাঠায়, আরো এই ধরণের গ্রুপে জয়েন হতে সাজেশন দেয়। ততই এই মানুষরা এক ইকো চেম্বারের অংশ হয়ে যান, একই কথা তাঁদের মাথায় গজাল দিয়ে ঢোকানো চলতে থাকে, সমভাবাপন্ন মানুষদের সাথেই তারা শুধু কথা বলতে অভ্যস্ত হয়ে যান, বিরোধিতা বা ভিন্ন মত শোনার আর ধৈর্য থাকে না। তাঁরা যেটা বিশ্বাস করেন, তার বাইরে দুনিয়ায় যে অন্য কিছুও চলতে পারে এইটা আর তাঁরা মানতে চান না।
ছোটো ছোটো ফেক নিউজগুলো তবুও সহজে ইন্টারনেট ঘেঁটেই মিথ্যে প্রমাণ করা সম্ভব, কিন্তু প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে নিজের মর্জিমতো এমন সব প্রোপাগান্ডা বানানো যাচ্ছে যা মিথ্যে প্রমাণ করা দুরূহ। ক্যামেরায় তোলা ছবির ক্ষেত্রে নানা ফরেনসিক সফটওয়্যার আছে যাতে সহজেই প্রমাণ করা যায় যে ছবিটি এডিটেড, রিভার্স ইমেজ সার্চ করেও ছবির আসল উৎস বের করা যায়। কিন্তু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই দিয়ে তৈরি ছবি নকল কিনা বোঝাও কিছুটা মুশকিল আর কেন নকল তা সাধারণ মানুষকে বোঝানোটাও মুশকিল। সাধারণ মানুষ বিশ্বাসই করতে চান না, যে একটা ছবি যা চোখের সামনে দেখা যাচ্ছে জলজ্যান্ত তার বাস্তব কোনো অস্তিত্বই নেই। গত বছরই আইটি সেল একটি ছবি বাজারে ছড়িয়ে দিয়েছিল, বক্সার ভিনেশ ফোগত ও সঙ্গীতা ফোগত গ্রেপ্তার হওয়ার পর হাসিমুখে পুলিশের বাসে বসে রয়েছেন। সেই ছবি দিয়ে তাঁদের বিরুদ্ধে যখন তীব্র জনমত গড়ে তোলা হচ্ছিল, তখন শুভবুদ্ধিসম্পন্ন কিছু মানুষ আসল ছবিটা খুঁজে প্রমাণ করে দেখিয়ে দিলেন যে বাস্তবে ওনারা ম্লান মুখে মনমরা হয়ে বসেছিলেন পুলিশের বাসে, ওনাদের মুখের হাসিটি ছিল এ আই/মেশিন লার্নিং সফটওয়্যার দিয়ে তৈরি।
এআই/মেশিন লার্নিং দিয়ে তৈরি ছবি যদিও বা ভুল প্রমাণ করা গেল, আরেক বিপদ ধেয়ে আসে মেশিন লার্নিং অ্যালগোরিদম দিয়ে তৈরি নকল কণ্ঠস্বরে। যেহেতু নেতানেত্রীদের সবার গলারই নমুনা নেটে-মিডিয়ায় সর্বত্রই প্রচুর পরিমাণে উপলদ্ধ রয়েছে তাই সহজেই তাঁদের গলার নমুনা সফটওয়্যারে ফেলে সেখান থেকে তাঁকে দিয়ে ইচ্ছেমতো কথা বলিয়ে দেওয়া যায়। তার ফলেই ভোটের মুখে আইটি সেল এরকম নানা অবাস্তব ফোন কল, অবাস্তব ভিডিও ভাইরাল করে বিরোধী দলের নেতা নেত্রীকে বিপদে ফেলার চেষ্টা করে। এগুলো সহজে মিথ্যা বলে প্রমাণ করা ভীষণ জটিল ব্যাপার, কারণ সাধারণ মানুষ কন্ঠস্বর শুনেই নেতানেত্রীদের গলার সাথে মিল পেয়ে তা বিশ্বাস করে বসেন। কোনো মিডিয়া হাউসও যখন সেই বানানো কথোপকথন বা বক্তৃতার ক্লিপ বারংবার দর্শকদের দেখিয়ে টি আর পি বাড়ান, তা সত্য কিনা বিচারের চেষ্টার বদলে, 'আমরা এর সত্যতা যাচাই করিনি' বলে বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ ঝুলিয়ে দেন। তা দর্শকদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রভাবিত যে করেই, তা নিশ্চিত ভাবে বলা চলে, অর্থাৎ আইটি সেল ঠিকই নিজের কাজ সফল ভাবে করে বেরিয়ে গেল।
ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউব এসবের থেকেও আইটি সেলের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হোয়াটস্যাপ। একেক জন সূত্রধর প্রায় ২০০০ এর কাছাকাছি হোয়্যাটস্যাপ গ্রুপ পরিচালনা করেন। প্রত্যেক গ্রুপে প্রায় ২০০-৩০০ জন সদস্য। এই গ্রুপগুলোতে যে শুধুমাত্র রাজনৈতিক আলোচনা হয় তা কিন্তু নয়, বরং চেষ্টা করা হয় প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক আলোচনা যথাসম্ভব কম করতে। গ্রুপগুলোতে বেড়ানো, খাওয়া দাওয়া, জোকস, গুড মর্নিং, গুড নাইট জাতীয় মেসেজই বেশি আদান-প্রদান হয়। মুখ্য উদ্দেশ্য একটা বড় নেটওয়ার্ক বজায় রাখা ও নিয়মিত জনসংযোগ বাড়িয়ে চলা। এই সুবিশাল নেটওয়ার্ক বজায় রাখার কারণ হল কোনো মেসেজ প্রয়োজন অনুসারে যাতে বিদ্যুৎগতিতে ভাইরাল করে দেওয়া যায় ও একটা বড়ো জনসংখ্যাকে যাতে নিয়মিত ফেক নিউজের আওতায় রাখা যায়। আগে একটা সুবিধা ছিল, হোয়াটস্যাপে যত সংখ্যক ইচ্ছা গ্রুপ তৈরি করা যেত ও যতজনকে খুশি যুক্ত করা যেত। পরে হোয়াটস্যাপ কর্তৃপক্ষ এর ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করে যাতে একই নম্বর থেকে একটি নির্দিষ্ট সংখ্যার বেশি গ্রুপ বানালে নম্বরটিকে আটকে দেওয়া হয়। মেসেজ ফরোয়ার্ড ও নতুন সদস্যদের যুক্ত করার ব্যাপারেও কড়াকড়ি করা হয়। তাতে আইটি সেল এমনভাবে গ্রুপের লিংক শেয়ার করা শুরু করে, যাতে ক্লিক করে নতুন সদস্য নিজেই যুক্ত হয়ে যেতে পারে।
এই তথাকথিত 'হোয়্যাটস্যাপ ইউনিভার্সিটিতে' সাধারণ বিষয় ও ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক ফেক নিউজের বাইরে আরেকটা যে জিনিস গুরুত্ব দিয়ে বোঝানো হয় তা হল শত্রুকে চিহ্নিতকরণ। প্রত্যেক গোষ্ঠীকে তাই তার মনের ভাব বুঝে একটা করে কাল্পনিক শত্রুর বিরুদ্ধে লড়িয়ে দেওয়া হয়, সেখান থেকেই উঠে আসে 'টুকরে টুকরে গ্যাং', 'ঘুসপেটিয়া', 'আন্দোলনজীবী', 'আরবান নক্সাল' -এর মতো শব্দবন্ধ। যারা দেশের প্রতি আবেগপ্রবণ তাদের বোঝানো হয়, 'টুকরে টুকরে গ্যাং' ভারতের অখণ্ডতাকে ধ্বংস করতে চায়, যারা ক্যাপিটালিস্ট মনোভাবাপন্ন তাদের বোঝানো হয়, ওই মানবাধিকার, প্রকৃতির অধিকার এসব নিয়ে যারা আন্দোলন করছে, তারাই শিল্প গড়তে দিচ্ছে না, আবার বেকার যুবকদের চাকরি না পাওয়ার দায় ফেলা হয় গিয়ে 'ঘুসপেটিয়া' বা 'অনুপ্রবেশকারী' -দের কাঁধে।
তবে শুধু অচেনা মুখ দিয়ে মানুষকে কাছে টানা যায়না। তাই বেশি মানুষকে কাছে টানতে আইটি সেল সবচেয়ে ভরসা রাখে এলাকার কোনো চেনা পরিচিত মানুষের ওপর। তিনি শিক্ষক, উকিল, চিকিৎসক, প্রযুক্তিবিদ যাই হোন না কেন আইটি সেল যদি দেখে তাঁর ভালো ফলোয়ার আছে বা তাঁর কথা কিছু লোক গুরুত্ব দিয়ে শোনে ও তিনি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের প্রতি কিঞ্চিৎ সহানুভূতি সম্পন্ন, তাঁকে কাছে টেনে তাঁর মাধ্যমেই পরোক্ষভাবে আইটি সেলের প্রোপাগান্ডা প্রচার করা হয়। সরাসরি রাজনৈতিক বক্তব্য যথাসম্ভব কম রেখে জল মাপা হয়। মাঝে মাঝে অন্য ধরণের কিছু মেসেজ দিয়ে কি প্রতিক্রিয়া হচ্ছে দেখা হয়, যদি প্রতিক্রিয়া আশানুরূপ না হয়, তবে বক্তব্যে বদল আনা হয়, আর প্রতিক্রিয়া ভালো পেলে সেই দিকেই আরো এগোনো হয়। এভাবে সাধারণ সদস্যদের উৎসাহ পরখ করে আরো গভীরতায় নিয়ে গিয়ে ধীরে ধীরে খুব উৎসাহীদের বেছে নিয়ে রাজনৈতিক কর্মসূচির অংশ করে নেওয়া হয় বা তাকেও আইটি সেলের ভলান্টিয়ার বানিয়ে ফেলা হয়। তখন সে নিজে থেকেই আইটি সেলের মেসেজ শেয়ার, ফরোয়ার্ড ইত্যাদি করতে থাকে, কখনও সখনও মিটিং মিছিলেও যায়।
আবার আইটি সেল প্রসঙ্গে আসার আগে যে একটা জিনিসের কথা না বললেই নয় তা হলো h-pop। এতে কট্টর হিন্দুত্বের কিছু দিক তুলে এনে গৌরব ও শৌর্যের মোড়কে সুরে বেঁধে তা প্রচার করা হয়। সরাসরি আইটি সেলের ভিতরে না থেকেও প্রোপাগান্ডা প্রচারের এক বড় অস্ত্র হলো বিভিন্ন ইনফ্লুয়েন্সার ও তাদের গাওয়া গান। দিনকে দিন এদের শ্রোতার সংখ্যা বিপদজনক ভাবে বেড়ে চলেছে ও সেইসব গানে রাখঢাক না রেখেই বেশ কিছু সমস্যাজনক বার্তা এভাবে রাখা হচ্ছে যা সমাজের শান্তি বিঘ্নিত করার জন্য যথেষ্ট।
আজকের যুগে দাঁড়িয়ে যেখানে তরুণ থেকে বয়স্ক সবাই নিয়মিত ইন্টারনেটে আনাগোনায় স্বচ্ছন্দ সেখানে নিজেদের সম্ভাব্য ভোটারকে টার্গেট করতে সমস্ত রাজনৈতিক দলই নিজেদের আইটি সেল তৈরি করে ফেলেছে। কারও আইটি সেল বেশি সক্রিয়, কারও কম, তবে প্রত্যেকেই অঞ্চল বুঝে, অডিয়েন্স বুঝে, কোন মাধ্যমে বলা হচ্ছে তার ওপর ভিত্তি করে ভিন্ন ভিন্ন ধরণের প্রচার কৌশল নিয়ে থাকে। কিন্তু কোনো কোনো রাজনৈতিক দলের আইটি সেল অনেক আগেই তাদের কার্যকলাপ শুরু করায় সেই পরিমাণ সাফল্য পেতে বা ততটা নেটওয়ার্ক তৈরি করতে বাকিদের আরোও বেশি কাঠখড় পোড়াতে হবে। তবে আইটি সেলের সাফল্য অনেকটাই নির্ভর করে তাদের কর্মী ও ভলান্টিয়ারদের উৎসাহের ওপর। মাঝে মাঝে এও দেখা যাচ্ছে তাদের দল বা সরকারের কাজে অসন্তুষ্ট হয়ে অনেকেই আবার আইটি সেল ছেড়ে বেরিয়ে আসছেন ও লজ্জিত হচ্ছেন এক সময়ে এর অংশ ছিলেন বলে।
যদিও দিনকে দিন মানুষকে ভুল বোঝানোর ও মিথ্যা ছড়ানোর প্রযুক্তি উন্নত হয়ে চলেছে ও সাথে আইটি সেলগুলিও মানুষের মন বিশ্লেষণ করে প্রোপাগান্ডা ছড়ানোর নিত্যনতুন পদ্ধতি নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছে, তবু এই বিষয়ে সব সময়েই শেষ কথা বলবেন সাধারণ মানুষ। আইটি সেলের কার্যকলাপ নিয়ে সামাজিক পরিসরে যত বেশি আলোচনা হবে, আশা করা যায় ধীরে ধীরে সাধারণ মানুষও তত এদের পাতা ফাঁদগুলো চিনতে শিখবেন ও এড়িয়ে চলতে পারবেন।