টাটার ন্যানো কারখানা
২০০৮ সালের ৭ অক্টোবর ন্যানো মোটরগাড়ি তৈরির কারখানা গুজরাটের সানন্দে সরিয়ে আনার খবর বিপুল প্রচার পেয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গে জমির ক্ষতিপূরণ নিয়ে দু’বছর ধরে বিক্ষোভের পর ওই বছর ৩ অক্টোবর রতন টাটা ঘোষণা করেন যে, ন্যানো তৈরির কারখানা তিনি পশ্চিমবঙ্গের সিঙ্গুর থেকে সরিয়ে নিচ্ছেন। ন্যানো প্রকল্প যখন গুজরাটে এলো, উগ্র হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিবিদ থেকে মোদী নিজেকে নতুন ব্যবসায়ী বন্ধু এবং উন্নয়নকামী নেতা হিসাবে তুলে ধরলেন। ভাষণ দিতে গিয়ে পরে মোদী বারবার বলেন, পশ্চিমবঙ্গে ন্যানো কারখানা বন্ধ করার সিদ্ধান্তের কথা জেনেই “আমি টাটাকে একটা এসএমএস পাঠালাম, ওয়েলকাম টু গুজরাট, ব্যাপারটা এমনই সোজা”।
বাস্তবে ব্যাপারটা তেমন সোজা ছিল না। টাটা মোটরস যখন পশ্চিমবঙ্গের সিঙ্গুর থেকে ন্যানো প্রকল্প প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়েছিল, মোদী একটি নিখুঁত পাবলিক রিলেশনস অপারেশন করেন। টাটাদের অভূতপূর্ব নানা ছাড়ের প্রস্তাবের মাধ্যমে এটা সম্ভব হয়েছিল। তা এমন চুক্তি ছিল যে একাধিক আরটিআই আবেদন সত্ত্বেও গুজরাট সরকার প্রকাশ করতে চায়নি। সরকার বলেছিল যে সে তথ্য প্রকাশযোগ্য নয়, কারণ তাতে টাটা মোটরসের বাণিজ্যিক গোপনীয়তা রয়েছে। পরে সেই তথ্য ফাঁস হয়।
পশ্চিমবঙ্গে বন্ধ হলে চারটি রাজ্য ন্যানো কারখানা করার জন্য টাটার সঙ্গে দরবার করেছিল। কিন্তু মোদী সবচেয়ে সুবিধাজনক শর্তে দ্রুত ব্যবস্থা নেন। টাটা তাই গুজরাটেই মনস্থির করেন। দশদিনের মধ্যে চুক্তিপত্র স্বাক্ষরিত হয়। অন্যান্য রাজ্যের ইচ্ছে থাকলেও টাটা মোটর্সকে জমি দেওয়ার আগে তাদের অনেক কিছু নির্ধারণ করা বাকি ছিল। মোদীর প্রস্তাব ছিল খুবই উদার। চুক্তি অনুযায়ী প্রথম ২০ বছরের বকেয়া রাজস্ব টাটা মোটর্স কোম্পানিকে ধার দেওয়া হয়েছে বলে ধরা হবে।v ২০ বছর পর ০.১ শতাংশ সুদ সহ তারা ওই ধার মেটাতে শুরু করবে। ধার মেটানো শুরু হবে ২০২৮ সাল থেকে। আটটি সমান বার্ষিক কিস্তিতে জমির মূল্য পরিশোধ করবে। এছাড়া বিদ্যুতের শুল্ক হ্রাস, ভর্তুকিতে বিক্রি হওয়া ১,১০০ একর জমির রেজিস্ট্রেশনের জন্য স্ট্যাম্প শুল্ক ছাড় ছাড়াও গুজরাট সরকার ন্যানো প্ল্যান্টকে পশ্চিমবঙ্গ থেকে গুজরাটে স্থানান্তরের খরচ বহন করতে সম্মত হয়েছিল। এইসব সুবিধা বাদে সরকার বলেছিল, তাদের চার লেনের সড়ক সংযোগ দেবে, একটি বর্জ্য নিষ্পত্তি কেন্দ্রও স্থাপন করবে, পাইপলাইনের মাধ্যমে প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহ করবে এবং টাটার টাউনশিপের জন্য আহমেদাবাদের কাছে ১০০ একর জমি দেবে ।vi
বিজেপির প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী সুরেশ মেহতা ২০১৭ সালে ‘দ্য ওয়্যার’-কে বলেছেন, গুজরাট কীভাবে পুঁজিপতিদের পক্ষ নিয়েছে তার উদাহরণ হলো টাটার ন্যানো প্রকল্প। রতন টাটা শর্ত দিয়েছিলেন যে, রাজ্য সরকার ঋণ দিলে তবেই তারা প্রকল্পটি রাজ্যে নিয়ে আসবে। সরকার ন্যানো প্রকল্পকে প্রচুর কর ছাড়, সস্তায় জমি এবং বিদ্যুতে ভর্তুকি দিয়েছে। টাটারা ৩৩,০০০ কোটি টাকা ঋণ হিসাবে চেয়েছিল। সরকার সুদহীন ১১,০০০ কোটি টাকা মঞ্জুর করেvii এই টাকা তারা ২০ বছর পর থেকে বেশ কিছু সমান কিস্তিতে শোধ করবে। টাটাদের রাজ্যের কর্মসংস্থান নীতি না মানার অনুমতিও দেওয়া হয়েছিল। অথচ রাজ্যের কর্মসংস্থান নীতি অনুযায়ী যেখানে কারখানা স্থাপন করা হবে সেই অঞ্চল থেকেই ৮৫ শতাংশ কর্মশক্তি তৈরি করে নেওয়ার কথা ছিল।
টাটার দাবি ছিল, কারখানার ঠিক পাশেই হাইওয়ে থাকতে হবে। অথচ প্রস্তাবিত কারখানা হাইওয়ের মাঝে অনেকটা কৃষি জমি পড়ে ছিল। সেখানে কংগ্রেসের স্থানীয় নেতা রাভুবা বাঘেলার জমি ছিল সবচেয়ে বেশি। তিনি অন্য কৃষকদের হয়েও কথাবার্তা চালাচ্ছিলেন। মোদী এবং টাটা যৌথভাবে কারখানা স্থাপনের কথা ঘোষণা করার আগের দিন জিআইডিসির (গুজরাত ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন) সেক্রেটারির সঙ্গে আলোচনায় জমির দাম নিয়ে অচলাবস্থা দেখা দেয়। সময় গড়িয়ে চললেও রাভুবা কম দামে জমি দিতে রাজী ছিলেন না। জিআইডিসি তখনও বলেনি যে তারা টাটার জন্য জমি কিনছে। রাত দশটা নাগাদ আলোচনা ভেস্তে যেতে বসলে, জিআইডিসির সেক্রেটারি বললেন, ন্যানো কারখানার জন্য জমি নেওয়া হচ্ছে, কাল আমেদাবাদে রতন টাটা আসছেন, তাদের যেন সমস্যায় না ফেলা হয়। ওই কথা শুনে রাভুবা বাঘেলা সহ বাকি কৃষকদের মন আনন্দে নেচে ওঠে। এক ঘণ্টার মধ্যে জমির আশাতীত মূল্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
পরে রাবুভা সাংবাদিক বিনোদ জোসকে বলেন, গুজরাটিদের জমির সঙ্গে খুব বেশি আবেগ জড়িয়ে নেই, এখানেই গুজরাটিদের সঙ্গে অন্যদের তফাৎ। তারা হিসাব করে দেখে তাদের জমি বিক্রি পাশের জমির জন্য কতটা লাভজনক হবে। রাবুভা টাটা মোটর্সের জমির কাছে ৩০ একর জমি বেচার পরই, মোদীর অফিস থেকে ডাক পেলেন। তাঁদের সাক্ষাৎ পরেরদিন টাইমস অফ ইন্ডিয়ায় খবরের হেডলাইন হলো-- ওয়েলদিয়েস্ট ম্যান ইন সানন্দ জাস্ট গট রিচার।
সানন্দে ন্যানো ফ্যাক্টরির জন্য যে চুক্তি হয়েছিল তা পৃথিবীর নজর কেড়েছিল। ২০১০ সালের জুন মাসে কারখানা উদ্বোধনের কয়েক সপ্তাহের মধ্যে ফোর্ড ও পাশোট (peugeot) গুজরাটে কারখানা করবে বলে জমি চায়। জিআইডিসি তাদের প্রয়োজন মত মোট ২২০০ একর জমি জোগাড় করে দেয়। সঙ্গে টাটাকে যেমন আর্থিক সুবিধা দেওয়া হয়েছিল সেইরকম যথেচ্ছ সুবিধা। সেখানেও জমির মালিক বাজার মূল্যের দশগুণ অর্থ পেয়েছে। টাটা গুজরাটে আসার আগে এক একর জমির দাম ছিল ৩ লক্ষ টাকা, জিআইডিসি কৃষকদের দিয়েছে একর প্রতি ৩০ লক্ষ টাকা। জমি বিক্রেতারা সাতদিনের মধ্যে চেক পেয়েছে। মোদী এই অঞ্চলটিকে অটো হাবে পরিণত করতে চেয়েছিলেন। গাড়ি নির্মাতা মারুতি সুজুকও মেহসানা জেলার বেচারাজিতে কারখানা স্থাপন করেছে।
বিপুল সরকারি ভর্তুকির বিনিময়ে হলেও সানন্দায় মোদীর সফলতার গল্প উন্নয়নের গুরু হিসাবে তাঁর সুনাম বাড়াল। তারপর থেকে সুযোগ পেলেই ভোটার বা ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের কাছে তিনি ওই উন্নয়নের কথা বলতেন। তবে গুজরাট সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় তৈরি হলেও সব কলকারখানা কিন্তু মসৃণভাবে চলেনি।
ন্যানো প্রকল্পটি যেখানে ছিল সেই সানন্দের নির্বাচকমণ্ডলী ২০১২ সালের বিধানসভা ভোটে কংগ্রেসের বিধায়ক নির্বাচিত করে ন্যানো প্রকল্পের বিরুদ্ধে মত দিয়েছিল।
ভাইব্রেন্ট গুজরাট
তবে মনে রাখতে হবে, ২০০১ সালের ৭ অক্টোবর নরেন্দ্র মোদী যখন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হলেন তিনি উত্তরাধিকার সূত্রেই ভাইব্রেন্ট বা স্পন্দনশীল গুজরাট পেয়েছিলেন। ১৯৬০ সালে গুজরাট ১মে গুজরাট তৈরি হওয়ার পর থেকে দুই দশক (১৯৬০-১৯৮০) রাজ্যের গ্রস ডোমেস্টিক প্রোডাক্ট (জিডিপি) বৃদ্ধির হার ছিল ৪.৪ শতাংশ, যেখানে দেশের ছিল ৩.৩ শতাংশ। পরের দুই দশকে গুজরাটের অর্থনীতি বেড়েছিল ১৪.৫ শতাংশ হারে, যেখানে দেশের বৃদ্ধি ছিল ৫.৫ শতাংশ। গুজরাট তৈরি হওয়ার পর থেকে চার দশক ধরে রাজ্যটি দেশের বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ছিল চালিকা শক্তি। এরপর ২০০২ সাল থেকে ২০১৪ পর্যন্ত জিডিপির বৃদ্ধি ছিল ৯.৫ শতাংশ এবং ২০১৪ থেকে ২০১৮ ছিল ৮.৬ শতাংশ। ওই দুই সময়কালে দেশের বৃদ্ধি ছিল যথাক্রমে ৭.৫ ও ৬.৮ শতাংশ।
মোদীর রাজ্যপাটের প্রায় পুরো সময় গুজরাটের জিডিপি বৃদ্ধি দেশের বৃদ্ধির চেয়ে বেশি ছিল। বিশেষজ্ঞদের মতে তা কিছুটা স্বাভাবিক, কারণ বহুকাল ধরেই গুজরাট শিল্পোন্নত রাজ্য। তবে মোদীর আমলে বৃদ্ধির হার আগের দুই দশকের চেয়ে মোটেই তেমন বেশি ছিল না। অথচ এমন ভাবে বিষয়টি উপস্থাপন করা হয় যেন ফরেন ডায়রেক্ট ইনভেস্টমেন্ট (এফডিআই) আনার ক্ষেত্রে গুজরাটই দেশকে নেতৃত্ব দেয়। এফডিআই-এর মাপকাঠিতে ২০০০ থেকে ২০০৯ সালে গুজরাট দেশের মধ্যে ছিল চতুর্থ, ২০১১ সালে ষষ্ঠ। ২০১১-তে মহারাষ্ট্রের এফডিআই ছিল গুজরাটের ন’গুণ বেশি।
২০০৩ সাল থেকে মোদী প্রতি দু’বছর অন্তর ভাইব্রেন্ট গুজরাট গ্লোবাল সামিট চালু করেন। ভাইব্রেন্ট গুজরাট প্রকল্প বিনিয়োগ আকর্ষণ করার জন্য তৈরি করা হয়। নবরাত্রির সময় সেপ্টেম্বর মাসে সরকার সংগঠিত বিনিয়োগকারীদের প্রথম শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। অসংখ্য দেশী-বিদেশী বাণিজ্য প্রতিনিধি সেখানে যোগ দিয়েছেন। সবাই জানত, ওই সম্মেলন ছিল গুজরাট দাঙ্গায় অভিযুক্ত মোদীর নতুন ইমেজ তৈরি করার করার উপায়, -- মোদীকে বিকাশ পুরুষ বা উন্নয়নের জন্য মাস্টার হিসাবে প্রমাণ করা। তিনি দাঙ্গার প্রধান পৃষ্ঠপোষকের ইমেজ মুছে ফেলার জন্য অক্লান্তভাবে চেষ্টা করেছেন। ওই সম্মেলন বিনিয়োগ টানার উদাহরণ হিসাবে পরিচিত হয়। ১২ বছর মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন মোদী নিজেকে শিল্প-বাণিজ্যের সবচেয়ে বড় বন্ধু হিসাবে তুলে ধরেন। গুজরাটিদের উদ্যোগী প্রকৃতির স্বীকৃতি হিসাবে ‘ভাইব্রেন্ট গুজরাট’ কথাটা ব্যবহার করেছেন। প্রতিটি বিনিয়োগ শীর্ষ সম্মেলনের সাথে প্রতিশ্রুতিগুলি আরও বড় হয়েছে। এই ধরনের অসামান্য সভা আয়োজন করার জন্য রাজকোষের খরচ বছরের পর বছর ধরে বেড়েছে।viii
ধীরে ধীরে মোদী শিল্পপতিদের প্রিয় হয়ে ওঠেন। গুজরাটে বেশ কিছু বিনিয়োগের প্রস্তাব আসার সাথে সাথে, ২০০৯ থেকে শিল্পপতিদের একাংশ মোদীকে ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী হিসাবে স্বাগত জানাতে শুরু করে। ওদিকে ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত শীর্ষ সম্মেলনের পর সরকার জানিয়েছিল যে, ১২ লক্ষ কোটি টাকা বিনিয়োগের জন্য ৩,৯৪৭টি সমঝোতা পত্র (এমওইউ) স্বাক্ষরিত হয়েছে ।ix
২০১১ সাল থেকে মোদী সক্রিয় ভাবে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার চেষ্টা শুরু করলে ভাইব্রেন্ট গুজরাট আরও বড় ঘটনা হয়ে ওঠে। শীর্ষ সম্মেলনের জন্য গান্ধীনগরে ‘মহাত্মা মন্দির’ নামে ১৩৫ কোটি টাকা ব্যয়ে পনেরো হাজার মানুষ উপস্থিত থাকার ক্ষমতাসম্পন্ন কনভেনশন সেন্টার স্থাপন করা হয়। মোদী, তিনবার গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে, ভারতীয় জনতা পার্টিকে তাঁর উন্নয়নের ট্র্যাক রেকর্ড এবং বিপুল প্রচারিত ‘গুজরাট মডেল’x -এর ভিত্তিতে লোকসভায় নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেন।xi
২০১১ সালের জানুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে একশোটি দেশের দশ হাজার ব্যবসায়ী-শিল্পপতি পঞ্চম দ্বিবার্ষিক শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন। সেখানে ৮,৩৮০টি সমঝোতা পত্র স্বাক্ষরিত হয়, ২০ লক্ষ কোটি টাকা বিনিয়োগের দাবি করা হয়। বলা হয় যে ওই বিনিয়োগ ৫২ লক্ষ কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে। কিন্তু সিএমআইআই-র (সেন্টার ফর মিডিয়া অ্যান্ড ইন্সট্রাকশনাল ইনোভেশন, ইয়েল) গবেষণায় ওইসব সমঝোতা পত্র এবং প্রকল্পের বিবরণ পাওয়া যায়নি। তারা জানায়, প্রাথমিক তথ্যের অভাবে আগের শীর্ষ সম্মেলনের মতো এক্ষেত্রেও প্রকল্পগুলি পৃথক করে শনাক্ত করার জন্য কোম্পানির নাম, অবস্থান, পণ্য ইত্যাদির বিশদ বিবরণ স্পষ্টভাবে পাওয়া যায়নি।
২০০৩ থেকে ২০১১ পর্যন্ত যে পাঁচটি সম্মেলন হয়েছে তাতে ৪০ লক্ষ কোটি টাকার মৌ (মেমোর্যান্ডাম অফ আন্ডারস্ট্যান্ডিং) স্বাক্ষরিত হয়েছে বলে প্রচার করা হয়েছিল, তবে বাস্তবে বিনিয়োগ হয়েছে তার শতকরা ২৫ ভাগের কম। ২০০৩ সালে যতগুলো মৌ স্বাক্ষরিত হয়েছে তার ৭৩ শতাংশ প্রকল্প রূপায়িত হয়েছে বা রূপায়নের কাজ চলছিল। ২০১১ সালে সেই ভাগ ছিল ১৩ শতাংশ। দশের দশকের শেষ ভাগ থেকে গুজরাটে বিনিয়োগ এবং উৎপাদন বৃদ্ধি দুইই কমেছে। কারণ বিনিয়োগের পর কতটা লাভ হতে পারে তা নিয়ে বিনিয়োগকারীরা সন্দিহান ছিলেন।
গুজরাট সরকারের ডায়রেক্টরেট অফ ইকোনমিক্স অ্যান্ড স্ট্যাটিসটিক্স প্রকাশিত গুজরাটের আর্থ-সামাজিক রিপোর্ট (২০১৭-২০১৮) অনুসারে, ভাইব্রেন্ট গুজরাট গ্লোবাল ইনভেস্টরস সামিট থেকে উদ্ভূত প্রতি এক কোটি টাকার বিনিয়োগে চারজনের জন্য চাকরি হয়েছে। ২০০৩ সালে থেকে ২০১৭ পর্যন্ত, ৭৬,৫১২টি প্রকল্পের জন্য মৌ স্বাক্ষর করা হয়েছিল। ২০১৭ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত গৃহীত প্রকল্পগুলি থেকে মোট প্রায় ১৭ লাখ কর্মসংস্থান হয়েছে। ২০১৭ সালের ৩১ জুলাই পর্যন্ত মোট ৬,২৫১টি প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছিল, যেখানে বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ২,৭৫,৮৮০ কোটি টাকা। ৪,২৮০টি প্রকল্পের কাজ তখনও চলছিল, যা শেষ হলে মোট বিনিয়োগের পরিমাণ হবে ৯,৯৬,৪৫৮ কোটি টাকা।xii
আমেদাবাদ থেকে ১০০ কিলোমিটার দূরে ধোলেরাতে শিল্প শহর গঠনের কথা আগেই বলা হয়েছিল। গুজরাট স্পেশাল ইনভেস্টমেন্ট রিজিয়ন অ্যাক্ট ২০০৯, কার্যকর হওয়ার পর ধোলেরা স্পেশাল ইনভেস্টমেন্ট রিজিয়ন (এসআইআর) প্রকল্পের জন্য ২০০৯ সালের ভাইব্রেন্ট গুজরাট সামিটে মৌ স্বাক্ষরিত হয়েছিল। দশ বছর পরে, ২০১৯ সালের সম্মেলনে যখন গুজরাট সরকার ধোলেরা এসআইআর-কে বিনিয়োগের কেন্দ্র হিসাবে দেখায়, বাস্তবে ২০০৯ সালে স্বাক্ষরিত বেশিরভাগ প্রকল্পই তখনও চালু হয়নি। ধোলেরা এসআইআর-এর জন্য ঘোষিত প্রকল্পগুলির মধ্যে ছিল একটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, আমেদাবাদ শহরের সাথে ধোলেরা সংযোগকারী এক্সপ্রেসওয়ে এবং একটি ৫০০০-মেগাওয়াট সোলার পার্ক৷
এছাড়া ২০১১ ভাইব্রেন্ট গুজরাট সামিটে স্বাক্ষরিত অনাবাসী ভারতীয় ব্যবসায়ী প্রসূন মুখার্জির ইউনিভার্সাল সাকসেস এন্টারপ্রাইজের টাউনশিপ, একটি ১০,০০০ মেগাওয়াটের তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র, একটি বন্দর। ধোলেরার কাছে ওয়াটার সিটির জন্য হিন্দুস্তান কনস্ট্রাকশন কোম্পানির ৪০,০০০ কোটি টাকার সমঝোতার কাজ কিছুই এগোয়নি। ১১,০০০ কোটি টাকার জিন্দাল পাওয়ার প্ল্যান্ট, প্রায় ১১,৫০০ টাকার গুজরাট ভিট্টাল ইনোভেশন সিটির কাজ শুরুই হয়নি। এসআইআর প্রকল্পগুলির জন্য ৮০,০০০ কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ প্রস্তাব ২০১৯ সালেও অচল অবস্থায় ছিল।
সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকোনমির (সিএমআইই) তথ্য দেখায় যে, ২০০৩ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত, গুজরাটে এই ধরনের বিনিয়োগকারী সম্মেলনগুলিতে দেওয়া প্রতিশ্রুতির মাত্র ২৫ শতাংশ দিনের আলো দেখেছিল৷ অনেক বিজেপি শাসিত রাজ্য একে মডেল হিসাবে গ্রহণ করেছে। যেমন -- হ্যাপেনিং হরিয়ানা, মোমেন্টাম ঝাড়খণ্ড, রিসার্জেন্ট রাজস্থান ইত্যাদি। উত্তরপ্রদেশ (ইউপি ইনভেস্টর সামিট), পশ্চিমবঙ্গ (বেঙ্গল গ্লোবাল সামিট), ঝাড়খন্ড এবং ওড়িশাও বিনিয়োগের উপযুক্ত গন্তব্য হিসাবে নিজেকে তুলে ধরার জন্য ভাইব্রেন্ট গুজরাট সামিটের অনুরূপ সংস্করণ আয়োজন করেছে। কিন্তু সব জায়গাতেই একই কান্ড– বড় বড় ঘোষণার কিছুকাল পর দেখানোর মতো কিছু নেই। ইভেন্টের সময় যে মৌ (এমওইউ) স্বাক্ষরিত হয়, খুব কমই প্রকৃত বিনিয়োগ হয়, কারণ মৌগুলির কোনও আইনি বাধ্যবাধকতা নেই। এই জাতীয় শোগুলির পর বলার মতো কর্মসংস্থান যে হয় এমন কোনও বিশ্বাসযোগ্য তথ্যও নেই।
অনেক বিশেষজ্ঞই বলেন, মোদীর শাসনে গুজরাটে উন্নয়নের ধারণা ভুল। ২০১২ সালে ইকোনমিক টাইমসের বিনয় প্রভাকর ও মিতুল ঠক্করকে আহমেদাবাদের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ম্যানেজমেন্টের (আইআইএমএ) অর্থনৈতিক ইতিহাসবিদ অধ্যাপক দ্বিজেন্দ্র ত্রিপাঠী বলেছিলেনঃ ঐতিহাসিকভাবে গুজরাট তার ১,৬০০ কিলোমিটার উপকূলরেখার জন্য সুবিধা ভোগ করেছে, গুজরাটের মাটিও অর্থকরী ফসলের জন্য ভাল। সুরাত ছিল ভারতের প্রথম বড় বন্দরগুলির অন্যতম। ওদিকে প্রাক-স্বাধীন যুগে মুম্বাইয়ের পরে আহমেদাবাদেই একটি টেক্সটাইল মিল চালু হয়েছিল। প্রতিটি গুজরাটির রক্তে উদ্যোক্তা এবং ব্যবসা রয়েছে। কিন্তু আজকাল গুজরাটের কথা বলার সময় এই দিকটি বাদ দেওয়া হয়। অতীতেও রাজ্যটি দেশের অন্যান্য অংশের তুলনায় উচ্চতর বৃদ্ধি পেয়েছে, বিশেষত উত্পাদনে। গুজরাটের বৃদ্ধি নিঃসন্দেহে বেশ ভালো, কিন্তু অলৌকিক নয়। অন্যান্য রাজ্য গুজরাটকে কিছু ক্ষেত্রে ছাড়িয়েও যেতে পারে। যেমন, বিহার, দিল্লি এবং পুদুচেরি হল দেশের সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল রাজ্য এবং গুজরাট পরপর দ্বিতীয় বছরের জন্য শীর্ষ পাঁচে স্থান পায়নি।
অনেক সমালোচক মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে গুজরাটের উন্নয়নকে অতিরঞ্জিত করার জন্য অভিযুক্ত করে বলেন যে, বাস্তবে গুজরাটের বৃদ্ধির হার অর্থনৈতিকভাবে উন্নত মহারাষ্ট্রের মতো। তাঁরা আরও বলেন যে, গুজরাট ঐতিহাসিক সুবিধাগুলি থেকে উপকৃত হয়েছে -- একটি উদ্যোক্তা শ্রেণী, অপেক্ষাকৃত ভাল পরিকাঠামো এবং একটি বিস্তৃত উপকূলরেখা। মোদীর নেতৃত্বে থাকুক বা না থাকুক তা বেড়ে উঠত। দক্ষ প্রচারের সাহায্যে মোদী নিজেকে প্রাণবন্ত গুজরাটের মুখ হিসাবে প্রতিষ্ঠা করেছেন। শক্তিশালী মিডিয়া এবং বিজ্ঞাপন জগতের মহাশক্তিশালী ‘অ্যাপকো ওয়ার্ল্ডওয়াইড’ মোদী ও তাঁর সাফল্যের কথা পৃথিবীময় প্রচার করেছে (কয়েকটি দেশের ডিক্টেটর-সহ বিশ্বের বড় বড় বিনিয়োগকারী কোম্পানি যাদের ক্লায়েন্ট)।
আদিত্য নিগম এবং বিনয় প্রভাকর তাদের প্রবন্ধে জানিয়েছেন, যে কর্তৃত্ববাদী আচরণে ‘গুজরাটের উন্নয়ন’ সম্ভব হয়েছে তা ধর্মীয় সংখ্যালঘু, তফসিলি জাতি, উপজাতি এবং নিচু জাতির বিরুদ্ধে আজ দেশব্যাপী যে ফ্যাসিবাদী হিংসা স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে তা থেকে আলাদা নয়। নরেন্দ্র মোদীর শাসনকালে যে কর্পোরেটমুখী, বিনিয়োগ-বন্ধু শাসন শুরু হয়েছিল তা কর্তৃত্ববাদী রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে দৃঢ় করেছে এবং অসাম্য মেনে নেওয়ার বাতাবরণ তৈরি করেছে।
কাফিলায় শিপ্রা নিগমের প্রবন্ধ এবং অতুল সুদ সম্পাদিত গবেষণা পত্রের সংকলন (পভার্টি অ্যামিডস্ট প্রস্পারিটিঃ এসেস অন দ্য ট্রাজেক্টরি অফ ডেভেলপমেন্ট ইন গুজরাট) থেকে জানা যায়, গুজরাটের ২০০৯ সালের শিল্পনীতি অনুযায়ী কেন্দ্রের দিল্লী-মুম্বাই ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল করিডোর (ডিএমআইসি) তৈরি করতে উপকূলের কাছাকাছি অঞ্চল ও ভৌগলিক অবস্থানকে কাজে লাগানো হয়। ডিএমআইসি পরিকল্পনায় ধার, পুনে, অলওয়ার, সুরাট, রেওয়ারি, মুজফফরনগরের গ্রিনফিল্ড অঞ্চলে শিল্প ও পরিকাঠামো গড়ে তোলার কথা বলা হয়েছিল। যেখানে প্রয়োজন সেই গ্রিনফিল্ড অঞ্চলের পরিকাঠামো মজবুত না করে অন্যত্র উন্নয়নের এনক্লেভ তৈরি করা হয়েছে। জনবসতিকে অবজ্ঞা করার জন্য মানুষ ও পরিবেশের উপর তার ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে। যেমন, ভূগর্ভস্থ জল নিয়ে ডিএমআইসি পরিকল্পনা থেকে বোঝা যায় রাজ্যে কৃষি ও গৃহস্থালির কাজে জলের ব্যবহার কমিয়ে শিল্পের কাজে দেওয়া হবে। পরিকল্পনায় কোথাও বলা হয়নি যে কিভাবে জল বণ্টন করা হবে, শহরে জলের বিপুল চাহিদা কিভাবে মিটবে, কে তার মূল্য দেবে।
অর্থনীতির গবেষক ইন্দিরা হিরোয়ে জানিয়েছেন, গুজরাট মডেলে পরিকাঠামোগত উন্নয়ন-- রাস্তা, বিমানবন্দর, এবং ২৪ ঘণ্টা বিদ্যুৎ সরবরাহের উপর জোর দেওয়া হয়েছিল। এছাড়া সরকার বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে কর্পোরেট সেক্টরের বিনিয়োগে ইনসেন্টিভ এবং ভর্তুকি অভূতপূর্ব ভাবে বাড়িয়েছিল। সেই কারণে সাধারণ মানুষের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবেশ এবং কর্মসংস্থানের বাজেট সীমিত হয়ে গিয়েছিল। কর্পোরেট বিনিয়োগের ইনসেন্টিভের মধ্যে প্রধানত ২০০৬-০৭ পর্যন্ত ছিল বিক্রয় কর ভর্তুকি (কেন্দ্র তা নিষিদ্ধ না করা পর্যন্ত)। বিক্রয় কর থেকে রাজস্বের (যা রাজ্য সরকারে আয়ের প্রধান উত্স) চল্লিশ শতাংশ বাদ দেওয়া হয়েছিল। এরপর, সরকার মূলধন, সুদ, পরিকাঠামোতে ভর্তুকি দেওয়ার পাশাপাশি জমি, জল সরবরাহ এবং প্রাকৃতিক সম্পদের উপরও অনেক ভর্তুকি চালু করে (যেমন, টাটা-ন্যানো মোট প্রায় ৩০,০০০ কোটি টাকা ভর্তুকি পেয়েছে)। সরকার গোচারণ ভূমি, ডিনোটিফাইড সংরক্ষিত এলাকা, জাতীয় উদ্যান এবং সেচযুক্ত উর্বর জমিও অধিগ্রহণ করেছিল। শিল্পপতিদের একর প্রতি ১ টাকা মূল্যেও জমি দেওয়া হয়েছিল (আদানির ক্ষেত্রে জমি ইজারা দেওয়া হয়েছে হেক্টর প্রতি ওই মূল্যে)। গুজরাট মডেলের শেষ বছরগুলিতে জমির দাম বেশি নেওয়া হলেও বাজার মূল্যের চেয়ে কম ছিল।
২০১২ সালের ২ অক্টোবর গুজরাট বিধানসভায় পেশ করা কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেলের (সিএজি) রিপোর্ট থেকে জানা যায়, আইন ভেঙ্গে কর্পোরেট কোম্পানিকে অনুচিত সুবিধা দেওয়ার জন্য রাজকোষের ৫৮০ কোটি টাকা ক্ষতিতে মোদী সরকার এবং রাজ্যের পাবলিক সেক্টর উদ্যোগ দায়ী। সিএজি জানিয়েছে, যারা সেই সুবিধা পেয়েছে সেই রকম বড় কোম্পানি হল—রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিস লিমিটেড (আরআইএল), এসার স্টিল ক্যারিবিয়ান লিমিটেড (ইএসসিএল) এবং আদানি পাওয়ার লিমিটেড (এপিএল)। আইনকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে সরকার গাড়ি প্রস্তুতকারক ফোর্ড ইন্ডিয়া এবং লার্সেন অ্যান্ড টুব্রোকে জমি দিয়েও রাজস্বের ক্ষতি করেছে।
অভিযোগ ওঠে, মোদী সরকারের সঙ্গে কর্পোরেট হাউসের অশুভ আঁতাত আছে বলেই কর্পোরেটরা অনুচিত সুবিধার বিনিময়ে মোদী সরকারের প্রশংসা করে। গুজরাটে বিনিয়োগকারীরা শুধু সম্পদই জোগায়নি, উন্নয়নে কোন বিষয় জোড় পাবে তাও ঠিক করেছে। উন্নয়নের জন্য কোন কাজ গুরুত্ব পাওয়া দরকার তা সরকার বা অর্থনীতিবিদদের কোনও পরিকল্পনাকারী কমিটি ঠিক করেনি। ঠিক করেছে বিনিয়োগকারী, আর্থিক সংস্থা এবং কর্পোরেট ফার্ম। এক কথায় গুজরাটের অর্থনীতি কর্পোরেটদের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তারা বিনিয়োগ করে, তারাই ওই উন্নয়ন মডেলের প্রশংসা করে। এই কারণেই তা কতটা টেকসই এবং আদৌ ঠিক কি না তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। সব ক্ষেত্রেই বেসরকারি শিল্পপতিদের আকর্ষণ করার জন্য তাঁদের বিপুল ছাড়, ভর্তুকি, এমনকি সরাসরি আয় এবং রাজস্ব নিয়ন্ত্রণের সুযোগ দেওয়া হয়েছে।
বেসরকারি ক্ষেত্রকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের মূল্য ও শুল্ক নির্ধারণ করার মতো আইন পরিবর্তন করে নানা সুবিধা দেওয়ার জন্য বিদ্যুৎক্ষেত্রে বিপুল বিনিয়োগ এসেছে। তবে ২০১১ সাল পর্যন্ত যে বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি হয়েছে তার বেশিটাই এসেছে বেসরকারি শিল্পে ক্যাপ্টিভ পাওয়ার প্ল্যান্টের দৌলতে। বিদ্যুতের ট্যারিফ কাঠামো কৃষি ক্ষেত্রের চেয়ে বাণিজ্য ও শিল্পে সুবিধা দেয় বেশি (জাতীয় গড়ের তুলনায়)।
আগে যে সমস্ত মূল সেক্টরগুলো সরকারের হাতে থাকতো— বন্দর, রাস্তা, রেল, বিদ্যুৎ-- সবই কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। ওইসব প্রকল্পে যাবতীয় সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা ও আর্থিক নিয়ন্ত্রণ সরকার ছেড়ে দিয়েছে। আর কোনও রাজ্যের অর্থনীতি এইভাবে পুরোপুরি কর্পোরেট ও বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়নি। বেসরকারি বিনিয়োগকারীর জন্য জমি জোগাড় করে দিয়ে মুনাফার জন্য দু-তিন দশক ধরে সব কিছুতে ছাড় দেওয়া হয়েছে। যেমন, বন্দর উন্নয়নের বুট নীতি (বিল্ড ওন অপারেট অ্যান্ড ট্রান্সফার) অনুযায়ী ডেভেলপারকে রয়্যালটি দিতেই হবে না। তারাই নানান চার্জ এবং টোল ঠিক করবে। সরকার বিনিয়োগকারীদের কর প্রক্রিয়া ও শুল্কে অনেক ছাড় দিয়েছে। সরকারের ভূমিকা খর্ব করে ন্যূনতম করা হয়েছে। এই কারণেই বন্দর উন্নয়নে গুজরাটে যে বিনিয়োগ এসেছে তা দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি।
একই ভাবে রাস্তা ও রেল তৈরির ক্ষেত্রে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপে (পিপিপি) কাজ হয়েছে। যোগাযোগ বাড়ানোর জন্য রাজ্যের সিংহভাগ বিনিয়োগই হয়েছে নতুন বন্দর, স্পেশাল ইকনোমিক জোন (এসইজেড), স্পেশাল ইনভেস্টমেন্ট রিজিওনের (এসআইআর) সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে। পরিকাঠামোয় বেসরকারি বিনিয়োগ যেন কেবলমাত্র ইন্ডাস্ট্রিয়াল করিডোরের যোগাযোগ বৃদ্ধির জন্য। রাস্তা ও রেল যোগাযোগ বৃদ্ধির উদ্দেশ্যও এসইজেড এবং বন্দরের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানো। স্থানীয় মানুষের তাতে কতটা সুবিধা হবে বলা মুশকিল। একইভাবে ৬৩০ কিলোমিটার রেল ন্যারো গেজ থেকে ব্রড গেজ করতে যে খরচ হয়েছে তার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল বন্দরের যোগাযোগ উন্নত করা, বসতি বা লোকালয়ের নয়। মানুষের বসতি অঞ্চলের যোগাযোগ বাড়ানোর কাজ যেটুকু হয়েছে, সে টাকা এসেছে কেন্দ্রের কাছ থেকে (পিএমজিএসওয়াই)।
২০১১ সালের ইকনোমিক সার্ভেতে শ্রমিক অসন্তোষের বিচারে গুজরাটের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ ছিল। অথচ একই সময় বাকি দেশে তা কমেছে। স্ট্রাইক, লকআউট ও অন্যান্য নানা ধরণের অসন্তোষ সবচেয়ে বেশি ছিল বলে মারুতি কি টাটা-- বিনিয়োগকারী ও শিল্পপতিরা তাদের উৎপাদন কেন্দ্র ও কাজকর্ম গুজরাটের অন্যত্র সরিয়ে নিতে যেন প্রতিযোগিতায় নেমেছিল। সেই অবস্থায় শ্রমিক অসন্তোষ নিয়ন্ত্রণে, মোদী সরকারের আইনের রাজত্ব স্থাপনের উপর শিল্পের ক্রমবর্ধমান আস্থা মোদী শাসনব্যবস্থার সর্বগ্রাসী চেহারার কথা বলে।
জনসংযোগের সুপরিকল্পিত প্রচারে মোদীকে অর্থনীতির অলৌকিক অগ্রগতির নায়ক হিসাবে তুলে ধরা হয়েছে। মিথ্যা ইমেজ তৈরি করা হয়েছে। গুজরাট সরকার স্পেশাল ইকনোমিক জোন, স্পেশাল ইনভেস্টমেন্ট রিজিয়ন ও প্রাইভেট ইন্ডাস্ট্রি স্থাপনের জন্য জমি নেওয়ার বিরুদ্ধে কৃষকদের বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ পুলিশ দিয়ে দমন করেছে, মিথ্যা ফৌজদারি মামলা করেছে। পুলিশ, বনদপ্তর ও রাজস্ব বিভাগকে কাজে লাগিয়ে জোর করে গুজরাটের বিরোধী দল, সমাজকর্মী, ট্রেড ইউনিয়ন লিডার, শিক্ষাবিদ, সংখ্যালঘু, দলিত ও আদিবাসীদের কণ্ঠরোধ করেছে।
নির্বাচিত প্রতিনিধিদের যে গণতান্ত্রিক সুযোগ আছে বিধানসভার সেশনের সময় কমিয়ে দিয়ে সরকারি দল তাও সঙ্কুচিত করেছিল। এছাড়া বিরোধী বিধায়কদের সামান্য ছুতোয় সাসপেন্ড করে, বিধানসভায় শেষ মুহূর্তে কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেলের (সিএজি) রিপোর্ট পেশ করে তা নিয়ে আলোচনার সুযোগ না দিয়ে গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধ করেছিল।
আজ দেশের উন্নতি নিয়ে যে ঢাক পেটানো হচ্ছে, সাম্প্রতিক অতীতে ‘গুজরাট মডেল’ নিয়ে একই ভাবে বুক বাজানো হয়েছে। শুধু দেশেই নয়, অনেক অর্থের বিনিময়ে মার্কিন লবিং কোম্পানি বিশ্ব জুড়ে সেই প্রচার করেছে। শেষে অর্থনীতির বহু গবেষক ও সাংবাদিক মোদীর রাজত্বে গুজরাটের অগ্রগতি নিয়ে মাথা ঘামিয়ে অজস্র লেখা ও গবেষণাপত্রে আসল চিত্র প্রকাশ করার পর গুজরাট মডেলের নিয়ে কথা বন্ধ হয়েছে, বোঝা গেছে তা কোনও অনুকরণযোগ্য মডেলই নয়।
প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী সুরেশ মেহতার বক্তব্য
গুজরাতের পাঁচ বারের বিধায়ক ও প্রাক্তন বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী (২১ অক্টোবর ১৯৯৫ থেকে ১৯ সেপ্টেম্বর ১৯৯৬) সুরেশ মেহতার রাজনৈতিক কর্মজীবন ২০০২ সালে শেষ হয়েছিল। মুখ্যমন্ত্রী ছাড়াও তিনি রাজ্যের অর্থ ও শিল্পমন্ত্রী হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০০৭ সালে নরেন্দ্র মোদীর বিরোধিতা করে তিনি বিজেপি দল ছেড়ে দেন। ২০০১৭ সালের অক্টোবর মাসে দ্য ওয়্যারের অজয় আশীর্বাদ মহাপ্রশস্তকে দেওয়া এক সাক্ষাত্কারে তিনি সরকারি তথ্যের ভিত্তিতে এক দশক ধরে গুজরাট সরকারের ব্যর্থতার কথা বলেছেন। গুজরাট মডেল নিয়ে প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন যে, তা শুধু ধনীদের সেবায় কাজে লাগে। গুজরাট মডেল কথার ফাঁকি ছাড়া আর কিছুই নয়, গুজরাটের কঠিন বাস্তব অন্য কথা বলে। সরকার রাজ্যটিকে ক্রমাগত ঋণের ফাঁদের দিকে ঠেলে দিয়েছে৷
তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০০৪ সালে সিএজি (কম্পট্রোলার ও অডিটর জেনারেল) গুজরাটের আর্থিক সংস্থান পরীক্ষা করে। সেই সময়ে, রাজ্যের ঋণ ছিল ৪,০০০ থেকে ৬,০০০ কোটি টাকার মধ্যে। তাই গুজরাটকে স্থায়ীভাবে ঋণের ফাঁদে আটকে পড়া রাজ্যে পরিণত হওয়া থেকে রক্ষা করার জন্য সিএজি কিছু আর্থিক শৃঙ্খলা মানার জন্য সতর্ক করেছিল। সরকার সিএজির পর্যবেক্ষণ উপেক্ষা করে।xiii
সিএজি বলে, সরকারের ঘোষণা অনুসারে, ৩১ মার্চ, ২০১৬ পর্যন্ত ২৫,৮৬৬.৭৮ কোটি টাকার কর (ট্যাক্স রেভিনিউ) উত্থাপিত হলেও আদায় হয়নি। তার আগের বছরে এই অংক ছিল প্রায় ১৮,০০০ কোটি টাকা। প্রতি বছর, এই অংক প্রায় ৭-৮ হাজার কোটি বৃদ্ধি পায়। তাই রাজ্য সরকারের সদিচ্ছা নিয়ে সংশয় রয়েছে। বকেয়া কর সংগ্রহ করতে বাধা কোথায়? এটি সরকারের দুর্নীতির ইঙ্গিতও হতে পারে।
সুরেশ মেহতা বলেন, গুজরাট সরকারের অগ্রাধিকার কোথায় রয়েছে খতিয়ে দেখলে বোঝা যায়। ২০০৭-০৮ সাল থেকে কৃষি ভর্তুকি (যা থেকে কৃষকরা উপকৃত হন) ধারাবাহিকভাবে হ্রাস পেয়েছে। সেই বছর যা ছিল ৪০৮ কোটি, ২০১৬-১৭ সালে তা কমে হয় ৮০ কোটি টাকা। তিনি বলেন, আদানি ও আম্বানি পরিচালিত শক্তি এবং পেট্রোকেমিক্যাল সেক্টরে দেওয়া ভর্তুকির সাথে এর তুলনা করলে অবাক লাগবে। ২০০৬-০৭ সালে এই ভর্তুকি ছিল ১,৮৭৩ কোটি টাকা, ২০১৬-১৭ সালে তা বেড়ে ৪,৪৭১ কোটি টাকা। অথচ দরিদ্র মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য ও নাগরিক সরবরাহের ব্যয় একই সময়কালে ১৩০ কোটি টাকা থেকে কমে হয়েছে ৫২ কোটি টাকা।
তিনি জানান, গুজরাটের নির্বাচনের বছরে, ২০০৭ সালে, মোদী মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে আদিবাসীদের জীবনযাত্রার উন্নতির ঘোষিত উদ্দেশ্য নিয়ে অনেক ধুমধাম করে বনবন্ধু কল্যাণ যোজনা চালু করেছিলেন। তিনি এই স্কিমের জন্য ১৫,০০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছিলেন, যা 'হর এক কো ঘর, হর এক কো স্বাস্থ্য' (সবার জন্য ঘর, সবার জন্য স্বাস্থ্য) দিয়ে শুরু হয়েছিল। পাশাপাশি, তিনি আদিবাসীদের জন্য পাঁচ লক্ষ দক্ষ কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকায় পাকা রাস্তা নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। সরকারের নিজস্ব তথ্য অনুযায়ী, তার ৫ শতাংশও অর্জিত হয়নি।
একইভাবে, ২০০৭ সালের ৬ জুলাই, মোদি উপকূলীয় অঞ্চলের উন্নয়নের জন্য ‘সাগর খেদু সর্বাঙ্গী বিকাশ যোজনা’ নামে আরেকটি প্রকল্প চালু করেছিলেন। রাজ্যের উপকূলীয় বেল্টের ১,৬০০ কিলোমিটারের মধ্যে ৩০০টি গ্রাম এবং ৩৮টি তালুকে বাস করা ৬০ লক্ষ লোকের জন্য ১১,০০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছিল। মোদি বলেছিলেন যে, উপকূলীয় অঞ্চলের শিশুরা খুবই প্রতিভাবান, তাই তাদের প্রশিক্ষণের জন্য তিনি একটি কলেজ খুলবেন, যেন তাদের ভারতীয় নৌবাহিনীতে নিয়োগ করা যায়। ২০১২ সালের ২১ মার্চ সরকার পক্ষ বিধানসভায় এক প্রশ্নের উত্তর জানায় যে, উপকূলীয় অঞ্চল থেকে একটি শিশুকেও প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং নৌবাহিনীতে নিয়োগ করা হয়নি। মোদি বলেছিলেন যে উপকূলের ৩০০টি গ্রামের প্রতিটিতে নোনা জলের সমস্যা মোকাবিলা করতে একটি করে আরও প্ল্যান্ট বসানো হবে। কিন্তু একটি গ্রামেও সেই প্ল্যান্ট বসেনি। তাঁর প্রশ্ন, কিন্তু ওই প্রকল্পের অত টাকা গেল কোথায়?
মোদি ঘোষণা করেছিলেন যে, স্ট্যাচু অফ ইউনিটি (সর্দার সরোবর বাঁধে সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের মূর্তি) বিশ্বের বৃহত্তম মূর্তি হবে। এও বলেছিলেন যে, এর জন্য সরকারি কোষাগারের বোঝা বাড়বে না। তিনি বলেছিলেন, তিনি জনগণের কাছ থেকে তহবিল তুলবেন। কিছুটা টাকা ওঠার পর ওই তহবিল বন্ধ হয়ে যায়। পরে গুজরাটের অর্থমন্ত্রী বিধানসভায় বলেন যে, ওই মূর্তি তৈরি করতে তিন বছরে নর্মদা প্রকল্পের তহবিল থেকে ৩,০০০ কোটি টাকা নেওয়া হয়েছে। তাঁর প্রশ্ন, সরকার কীভাবে সেচ ও কৃষকদের খাতের টাকা মূর্ত্তি তৈরির জন্য বরাদ্দ করে?
গুজরাটে যক্ষার প্রকোপ
অর্থনীতিবিদ মৈত্রীশ ঘটক লিখেছেন, গুজরাট হল কর্পোরেট নেতৃত্বাধীন উন্নয়ন মডেলের এক চিরায়ত উদাহরণ যেখানে ধনীদের সমৃদ্ধি বাড়ে কিন্তু ব্যাপক জনসাধারণের খুব একটা উন্নতি হয় না। জঁ দ্রেজা বলেছিলেন, গুজরাটের চারপাশে ঘুরে বেরালে ভাল রাস্তা, অসংখ্য কলকারখানা এবং নিয়মিত বিদ্যুৎ সরবরাহ যে কারো চোখে পড়তে বাধ্য। কিন্তু সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার হাল কী?
কিরণ কুম্ভর ২০১৭ সালে দ্য ওয়্যার-এ লিখেছেন, ভারত সরকারের টিবি (যক্ষ্মা) পরিসংখ্যান দেখায় যে, সাধারণ গুজরাটিদের জীবনযাত্রার হাল সবসময়ই ‘মডেল’ থেকে দূরে ছিল, গত দশকে তা আরও খারাপ হয়েছে। অনেকের মনে হতে পারে জীবনযাত্রার মান বোঝার জন্য টিবি কেন এত গুরুত্বপূর্ণ? আসলে এই রোগটি সামাজিক এবং রাজনৈতিক কারণগুলির সাথে এতটাই জড়িত যে টিবির সফল নিয়ন্ত্রণকে একটি অঞ্চলের সামগ্রিক অগ্রগতির পরিমাপ হিসাবে ধরে নেওয়া যায়। নানা রোগের মধ্যে, টিবি রোগটিই সম্ভবত একটি অঞ্চলের সামগ্রিক আর্থ-সামাজিক অগ্রগতির সবচেয়ে সঠিক প্রতিনিধিত্বকারী সূচক বা পরোক্ষ সূচক (প্রক্সি সূচক), যেখানে জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা এবং রাজনৈতিকব্যবস্থা দুইই প্রতিফলিত হয়। টিবির হার যেখানে বেশি তা দুর্বল জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা এবং অবহেলিত শাসনের প্রমাণ। কোনও জাতি বা রাজ্য কতটা উন্নত এবং স্থিতিশীল বুঝতে হলে তাদের টিবি সংখ্যার দিকে তাকালেই চলে।
তিনি জানান, ২০১৭ সালে ভারতের উপ-রাষ্ট্রপতি ভেঙ্কাইয়া নাইডু ‘ইন্ডিয়া স্টেট-লেভেল ডিজিস বারডেন’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিলেন। ওই বিস্তৃত প্রতিবেদনটি ভারতের মিনিস্ট্রি অফ হেলথ অ্যান্ড ফ্যামিলি ওয়েলফেয়ারের সহযোগিতায় ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিকেল রিসার্চ (আইসিএমআর), পাবলিক হেলথ ফাউন্ডেশন অফ ইন্ডিয়া (পিএইচএফআই) এবং ইউএস-ভিত্তিক ইনস্টিটিউট ফর হেলথ মেট্রিক্স অ্যান্ড ইভ্যালুয়েশন (আইএইচএমই)-এর যৌথ উদ্যোগে তৈরি করা হয়েছে। পরিসংখ্যানগুলি গত পচিশ বছরে ভারতের সমস্ত শনাক্তযোগ্য মহামারী সংক্রান্ত তথ্যের বিশ্লেষণের ভিত্তিতে পাওয়া।
ওই রিপোর্ট গুজরাটের অনুন্নয়ন এবং খারাপ জনস্বাস্থ্যের অস্বস্তিকর ছবি এঁকেছে। ভারতে প্রতি বছর যক্ষ্মায় আক্রান্ত মানুষের পরিপ্রেক্ষিতে গুজরাট রয়েছে এক নম্বরে। ১০১৬ সালে প্রতি এক লক্ষ গুজরাটির মধ্যে টিবি হয়েছে ৩৫৬ জনের। শুধুমাত্র ওই রাজ্যেই প্রায় ২,৪০,০০ মানুষের যক্ষ্মা ধরা পড়েছে৷ অর্থাৎ, প্রতি ঘন্টায় ২৫ জন গুজরাটি টিবি রোগে আক্রান্ত হয়। কেরালা এবং পশ্চিমবঙ্গের সাথে তুলনা করলে (বিজেপি যে দুটি রাজ্যকে আইনহীন এবং অনুন্নত বলে) দেখা যায়, ওই বছর পশ্চিমবঙ্গে যক্ষ্মা হয়েছিল ১৩৯ জনের এবং কেরালায় ৫৯ জনের। টিবি নিয়ন্ত্রণে গুজরাট এতটাই ব্যর্থ যে উত্তরপ্রদেশ ছাড়া একমাত্র ওই রাজ্যেই এক দশকে টিবির প্রকোপ প্রবল বেড়েছে। প্রতি এক লাখ মানুষের যক্ষ্মায় মৃত্যুর অনুপাতে গুজরাট আসামের সাথে রয়েছে ৩ নম্বরে। ২০১৬ সালে প্রতি এক লাখ গুজরাটির মধ্যে ৪২ জন টিবিতে মারা গেলেও, পশ্চিমবঙ্গ এবং কেরালার ক্ষেত্রে ওই সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ১৯ এবং ৮।
এক দশক আগেও গুজরাট এবং মহারাষ্ট্র এবং তামিলনাড়ুর মতো বড় রাজ্যগুলির মধ্যে পার্থক্য তেমন বেশি ছিল না। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৯০ সালে প্রতি এক লাখ মানুষের মধ্যে টিবিতে মৃত্যুর সংখ্যা ওই তিনটি রাজ্যে ছিল ৮০ থেকে ৯০-এর মধ্যে। মোদি মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার এক বছর পর, ২০০২ সালে গুজরাটে ওই সংখ্যা ছিল ৬২, মহারাষ্ট্র ও তামিলনাড়ুতে যথাক্রমে ৫১ এবং ৪৩। সম্প্রতি তামিলনাড়ু এবং মহারাষ্ট্র দুই রাজ্যেই যক্ষ্মাজনিত মৃত্যু প্রায় ৫০ শতাংশ কমেছে, মোদীর গুজরাট মডেলে কমেছে মাত্র ৩২ শতাংশ (তিনটি রাজ্যের পরিসংখ্যান যথাক্রমে ২৪, ২৪ এবং ৪২)। গত এক দশক ধরে উত্তরপ্রদেশ ছাড়া গুজরাটেই টিবি-র প্রকোপ বেশি।
গুজরাটের বাস্তব
মোদীর শাসন সম্পর্কে ২০১৩ সালের জুলাই মাসে অমর্ত্য সেনও ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে গুজরাত উন্নয়নের মডেল সম্পর্কে বলেছিলেন, সামাজিক দিকে ওই মডেলের দুর্বলতা রয়েছে, তাই তাকে সফল বলা যায় না। অথচ বছরের পর বছর ধরে আমরা শুনে আসছি, গুজরাট মডেল হল অর্থনৈতিক উন্নয়নের অতুলনীয় উদাহরণ।
নানা গবেষণায় দেখা গেছে যে, অর্থনৈতিক বৃদ্ধি এবং মাথাপিছু আয়ে গুজরাট দেশের মধ্যে উঁচুতে থাকলেও সামাজিক সূচকে নীচুতে ছিল। তাই গুজরাত মডেল ব্যাপক মানুষের জন্য মঙ্গল বয়ে আনেনি। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে মোদী আর্থিক উন্নয়নে গুজরাট মডেলের ঢাক পিটিয়েছেন, দ্বিতীয়বার ২০১৯ সালে কিন্তু তা করেননি। কারণ, ততদিনে ভাইব্রেন্ট গুজরাট যে আসলে জুমলা তা নিয়ে অর্থনীতির গবেষক ও সাংবাদিকদের অনেক আলোচনা প্রকাশ্যে এসেছে। কেউ কেউ বলেছেন, গুজরাট শুধু স্থবিরই নয়, সে রাজ্যের পশ্চাদ্গতি শুরু হয়েছে। ২০০৬-০৭ থেকে ২০১০-১১-র মধ্যে, এমনকি উড়িষ্যা, বিহার, মহারাষ্ট্র, হরিয়ানা এবং ছত্তিশগড়ের মতো রাজ্যগুলির বৃদ্ধির হারও উঁচু ছিল। তাই গুজরাটের ৯.৩ শতাংশ বৃদ্ধি উঁচু হলেও চোখ ধাঁধানো ছিল না।
সমৃদ্ধির আখ্যানের আড়ালে জানা গেছে যে, অনেক সামাজিক সূচকেই গুজরাটের অবস্থান খারাপ। পাঁচ বছরের কম বয়সী প্রায় ৪ শতাংশ শিশু অপুষ্টিতে ভুগছে এবং ৭০ শতাংশ ভুগছে রক্তাল্পতায়। পরিকল্পনা কমিশন (কেন্দ্রে মোদী সরকার আসার পর লুপ্ত) প্রকাশিত ২০১১ সালের ইন্ডিয়া হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট রিপোর্ট অনুসারে, মানব উন্নয়ন সূচকে গুজরাট দেশের মধ্যে ১১তম স্থানে রয়েছে। ওই সূচকে ১৯৯৬ সালে ছিল পঞ্চম স্থানে। ২০০৬ সালে ছিল নবম স্থানে, ২০১৭ সালে ফের ১১তম। গুজরাটে পাঁচ বছরের নীচে ৪৭ শতাংশ শিশু, ২৮ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ, ৬৩ শতাংশ মহিলা অপুষ্টিতে ভোগে, যা উত্তরপ্রদেশের অবস্থার চেয়েও খারাপ। প্রসবের সময় মাতৃমৃত্যুর হার বেড়েছে। ২০১৪ সালে প্ল্যানিং কমিশনের (ভেঙ্গে দেওয়ার আগে) তথ্য অনুযায়ী, অর্থনৈতিক বৃদ্ধি স্বত্বেও দারিদ্র মোচনে গুজরাট ছিল বিহার, উত্তরপ্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গ এবং অন্ধ্রপ্রদেশের পিছনে। ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের রিপোর্ট অনুসারে, গুজরাট ক্ষুধার সূচকে সবচেয়ে পিছিয়ে রয়েছে। রাজ্যের মাত্র ৪৩ শতাংশ শিশুর ওজন স্বাভাবিক।
কর্পোরেটদের বিপুল পরিমান প্রণোদনা (ইনসেন্টিভ) দেওয়ার পরে, সাধারণ মানুষের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবেশ এবং কর্মসংস্থানের জন্য গুজরাট সরকারের তহবিল সীমিত হয়ে যায়। গুজরাট তার আয়ের ২ শতাংশের কম শিক্ষায় ব্যয় করে (আদর্শ ৫-৬ শতাংশ)। এর ফলে রাজ্যে শিক্ষার মান খারাপ। রাজ্যের ৪৫ শতাংশ কর্মী নিরক্ষর বা পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পড়েছে। উচ্চশিক্ষার মানও খারাপ বলে বেকার ইঞ্জিনীয়ার এবং বিজ্ঞান স্নাতকের সংখ্যা বেড়েছে। স্বাস্থ্য খাতে সরকারি ব্যয় রাজ্যের আয়ের ০.৮ শতাংশ (আদর্শ ৪-৬ শতাংশ)। প্রায় সমস্ত স্বাস্থ্য সূচকে গুজরাট দ্রুত নেমেছে।
আজ কারো কারো পছন্দের মেডিক্যাল টুরিজিম-এর গন্তব্য গুজরাট। ২০১৩ সাল থেকে ২০১৮-র মধ্যে আমেদাবাদে ২০০টি প্রাইভেট হাসপাতাল গড়ে উঠেছে। তবে ওই সময়কালে সরকারি হাসপাতালের বেড বেড়েছে মাত্র ২০০টি, চিকিৎসা সহায়কের অভাবের কথা বাদ দিলেও সরকারি ডাক্তারের ঘাটতিই হল ১২ হাজার। শিক্ষা ব্যবস্থার হালও একই রকম। প্রতি ১০০ জন প্রথম শ্রেনীর পড়ুয়ার মধ্যে কলেজ পর্যন্ত যায় ২০ জন।
মোদীর বহু প্রচারিত উজ্জ্বলা যোজনা অনুযায়ী দাবি করা হয়, মাটির ঘরে জ্বালানি হিসাবে কাঠের ব্যবহার বন্ধ করে মানুষ গ্যাস ব্যবহার করছে। অসরকারি সংগঠন ‘দিশা’ উত্তর ও পূর্ব গুজরাটের আদিবাসী অধ্যুষিত জেলায় ১০৮০টি ঘরে সমীক্ষা করে দেখেছে ৯৫৩টি ঘরই দ্বিতীয় গ্যাস সিলিন্ডার না কিনে জ্বালানি হিসাবে কাঠের ব্যবহারে ফিরে গেছে। বিপদ হল গ্যাস ব্যবহারকারী হিসাবে নাম ওঠায় তারা রেশন দোকান থেকে কম দামে কেরোসিন তেল পায় না।
অতুল সুদ সম্পাদিত ‘পভার্টি অ্যামিডস্ট প্রস্পারিটিঃ এসেস অন দ্য ট্রাজেক্টরি অফ ডেভেলপমেন্ট ইন গুজরাট’ বইটিতে রুচিকা রাণী এবং কালাইয়ারাসান তাদের গবেষণাপত্রে দেখিয়েছেন ২০০৭ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে গুজরাটে উল্লেখযোগ্য উৎপাদন বৃদ্ধি হলেও উৎপাদন ও পরিষেবায় কর্মসংস্থান বৃদ্ধি ছিল ঋনাত্বক। ওদিকে ২০০৩ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে যেটুকু কর্মসংস্থান বেড়েছে বেশিটাই ঠিকা শ্রমিক এবং স্বনিযুক্তিতে। উৎপাদন ও পরিষেবা ক্ষেত্রে উঁচু জাতের হিন্দু এবং কম অনুপাতে তফশীলি জাতির (এসসি) নিয়মিত কর্মসংস্থানে হয়েছে। তফশীলি জাতির কর্মসংস্থান বেড়েছে ঠিকা কর্মী হিসাবে। ওবিসি, মুসলমান ও অন্য সংখ্যালঘুরা পরম্পরাগত কৃষিক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের ফাঁক ভরিয়েছে। অর্থাৎ গুজরাটে বৃদ্ধি হচ্ছে শিল্প ক্ষেত্রে, কর্মসংস্থান বাড়ছে কৃষিক্ষেত্রে। বলা যায়, কৃষিক্ষেত্রে দুর্দশার অভিবাসন হচ্ছে। অর্থাৎ যে কাজে দুজন লোকই যথেষ্ট সেই কাজ তিনজনে করছে। এই অবস্থা কর্মসংস্থানে স্থবিরতার কথা বলে। বলবার মত উৎপাদন বৃদ্ধির পরও আয়, দারিদ্র ও অসাম্যের পরিমাপে গুজরাট গড়পড়তা জাতীয় গড়ের মধ্যেই ছিল, এবং নানা মাপকাঠিতে তামিলনাড়ু, মহারাষ্ট্র, হরিয়ানার চেয়েও পিছিয়ে।
আরেক গবেষক নিধি মিত্তাল জানিয়েছেন, কর্মসংস্থানের মাপকাঠিতে ১৯৯৩ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত গুজরাটের মানুষ যেমন ছিল, ২০০৫ থেকে ২০১০ সালে ছিল তার চেয়ে খারাপ। অথচ এই সময়েই গুজরাটে উৎপাদন বৃদ্ধি ও ‘উন্নয়ন’ জোর কদমে হয়েছে। শহরাঞ্চলে বৃদ্ধির হার এবং মাথাপিছু ব্যায় বাড়লেও অসাম্য অনেক বেড়েছে। ওদিকে ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ২০০৮ গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্সে গুজঅদিকেছিল ৬৯তম স্থানে, ছিল খাদ্য দাঙ্গার জন্য কুখ্যাত দেশ হাইতির সাথে 'আশঙ্কাজনক' বিভাগে।
নরেন্দ্র মোদীর আমলে (তারপরও বিজেপীর আমলে) গুজরাটের শাসন বেসরকারি উদ্যোগের উপর নির্ভরশীল ছিল। সরকারি নীতিতে বেসরকারি বিনিয়োগকারীর প্রয়োজন ও লাভের দিক খেয়াল রাখা হতো। উন্নয়নের মডেলের মানে দাঁড়িয়েছিল নির্বাচিত পুঁজি-নিবিড় উৎপাদন শিল্পের উন্নতি এবং চাকরিহীন উন্নয়ন, মোট আয়-এ মজুরির ভাগ কমা, কৃষিকে কর্পোরেটের অধীনে আনা, জমি ব্যবহারে আইনী পরিবর্তন করে জমিতে ফাটকা চালু করা, জনকল্যান ব্যায়ে অবহেলা করা, সামাজিক পরিকাঠামোর অপ্রতুলতা কাটাতেও বেসরকারি উদ্যোগে নির্ভর করা।
এছাড়া পরিকল্পিত ভাবে পুঁজিপতির মঙ্গল করা এবং সাধারণ মানুষের জীবনের প্রতি চরম অবহেলা করার জন্য সামাজিক ও অর্থনৈতিক কুফল দেখা দিয়েছে। আঞ্চলিক বৈষম্য বেড়েছে, পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। গ্রামজীবনের প্রতি করুণ অবহেলা করা হয়েছে, অন্যদিকে শ্রমিক, মহিলা, তফশীলিজাতি, মুসলমান ও অন্য সংখ্যালঘুদের বেশি বেশি প্রান্তিকীকরণ হয়েছে। গুজরাতের উৎপাদন ক্ষেত্রে ঠিকাকর্মীর সংখ্যাই বেশি এবং তা বেড়েই চলেছে। রাজ্যে মজুরির হার ভারতের প্রধান রাজ্যগুলির তুলনায় বেশ কম, ২০০৭ সাল থেকেই কমেছে। অত্যাধুনিক প্রযুক্তি প্রয়োগের জন্য বৃদ্ধিও পুঁজি নিবিড় হয়েছে।
২০০৬ সাল থেকে গুজরাটের কৃষিতে বছরে ৯ শতাংশের বেশি বৃদ্ধি হয়েছে, যা ভারতে সর্বোচ্চ। ২০১২ সালে সাংবাদিক বিনয় প্রভাকর ও মিতুল ঠক্করকে আহমেদাবাদের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ম্যানেজমেন্টের (আইআইএমএ) সেবাস্টিয়ান মরিস বলেছিলেন, কৃষি পুনরুজ্জীবনের প্রধান কারণ হল গুজরাট গত ১০ বছরে বৃষ্টিপাতের বড় পরিবর্তন থেকে উপকৃত হয়েছে। তিনি বলেন, নর্মদা জুড়ে সর্দার সরোবর বাঁধ প্রকল্প রাজ্যের কৃষকদের সাহায্য করেছে। তাই মোদী যে বছর মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন (২০০১) সেই বছরই সর্দার সরোবর বাঁধ চালু হওয়ার জন্য তা কৃষি বৃদ্ধিকে কতটা সাহায্য করেছে এবং কতটা তাঁর প্রশাসনিক দক্ষতার জন্য তা মাপা কঠিন।
২০১৩ সালের শেষ থেকে ২০১৪ সালের শুরুতে ইকোনমিক অ্যান্ড পলিটিকাল উইকলি পত্রিকায় উন্নয়নের গুজরাট মডেল নিয়ে বেশ কয়েকটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছিল। কয়েকজন গবেষক দেখিয়েছিলেন যে, মোদী শাসনের আগে ও পরে দেশের তুলনায় গুজরাটের বৃদ্ধির প্রবনতায় সামগ্রিকভাবে কোনও পার্থক্য নেই। তবে মোদির শাসনকালে গুজরাটে কৃষি বৃদ্ধির হার মোদী-পূর্ব যুগে ভারতের তুলনায় বেশি হয়েছিল।
সর্দার সরোবর বাঁধ ছাড়াও ক্রমাগত ভাল বৃষ্টিপাত এবং উন্নত বীজ নিয়ে সরকারের নীতি, আধুনিক কৃষি পদ্ধতির জন্য এই সময়কালে গুজরাটের কৃষিতে উচ্চ বৃদ্ধি হলেও কম ন্যূনতম সমর্থন মূল্য (চাষের খরচ অনেক বেশি), দুর্বল শস্য বীমা (এমনকি ভাল এলাকায় কভারেজ ১০-১২%) এবং বিনিয়োগ কমার জন্য কৃষি উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাছাড়া ওই বৃদ্ধি টেকসই নয়। কারণ সেচের প্রধান উৎস ভূগর্ভস্থ জল রিচার্জের পর্যাপ্ত উদ্যোগ নেই বলে জলতল দ্রুত কমছে। কৃষি শ্রমিকের ক্রমবর্ধমান সংখ্যার জন্য গুজরাটে কৃষি মজুরি সবচেয়ে কম।
গুজরাটের সামাজিক সূচকে নব্বইয়ের দশকের পর খুব একটা উন্নতি হয়নি৷ তার কারণ অন্য রাজ্যের তুলনায় খুব কম কর্মসংস্থান সৃষ্টি, সামাজিক ব্যয় হ্রাস এবং শিল্পে বিনিয়োগ মূলধন-নিবিড় হওয়ার সাথে সম্পর্কিত। রাজ্যের ৪০-৪৫ শতাংশ পরিবার তাদের জীবিকা নির্বাহের জন্য প্রাকৃতিক সম্পদের উপর নির্ভর করে (চাষ, পশুপালন, দুধ, বনজসম্পদ, মাছ ধরা ইত্যাদি)। সম্পদের ক্ষয় ও অবনমন এবং প্রবল দূষণের সাথে উত্পাদনশীলতা এবং আয় কমেছে। গুজরাটের উন্নয়নে আদিবাসী জনগোষ্ঠী সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে৷ হাজার হাজার মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়ে শহরের রাস্তায় বা গ্রামীণ এলাকায় কোনওরকমে তৈরি কুঁড়েঘরে বাস করতে বাধ্য হয়েছে। গুজরাট হাইকোর্ট তাই রাজ্য সরকারকে বার বার বলেছে, ভুলে যাবেন না যে তারাও রাজ্যের জনসংখ্যার একটি অংশ। উন্নয়ন যজ্ঞের নেট ফলাফল হল, জনসংখ্যার ৪০ শতাংশ দারিদ্র্যসীমার নীচে বেঁচে থাকা। কেন্দ্র এবং রাজ্যের অনেকগুলো গরিব-সমর্থক কর্মসূচি থাকলেও তার বাস্তবায়ন তেমন হয় না।
২০১৪ সালে লোকসভা নির্বাচনের আগে, গুজরাট মডেল নিয়ে খুব হই হই করা হয়েছিল। সংবাদমাধ্যম গুজরাটকে বিনিয়োগের চুম্বকে পরিণত করার জন্য, বরাবর নরেন্দ্র মোদির প্রশংসা করেছে। ২০১২ সালের জানুয়ারি মাসের ‘ইন্ডিয়া টুডে’র সমীক্ষায় উত্তরদাতাদের ২৪ শতাংশ পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসাবে মোদীকেই চান বলে জানিয়েছিলেন। মোদীই ছিলেন এক নম্বরে। ছ’মাস আগের সমীক্ষার তুলনায় তা ছিল দ্বিগুণ। গুজরাট দাঙ্গার দশ বছর পূর্তির সেই বছর, ডিসেম্বর মাসে গুজরাটে তাঁর তৃতীয়বারের বিধানসভা নির্বাচন ছিল। ঘরের রাজ্যে হারার সম্ভাবনা ছিল ক্ষীণ। গুজরাট বিধানসভায় ভোটে ফের জিতলে ইমেজ আরও বাড়বে, হয়েছিলও তাই। সবাই জানতো পরের লোকসভা নির্বাচনে (২০১৪) মোদী প্রধানমন্ত্রীর দাবিদার হতে হতে চান।
আমরা দেখলাম নরেন্দ্র মোদী দশ বছর কেন্দ্রে ক্ষমতায় থাকার পর দেশের যেমন উন্নতি হয়েছে গুজরাটে বারো বছর ক্ষমতায় থাকার পর একইরকম উন্নতি হয়েছিল। পুঁজিপতিদের পুঁজি এবং গরিব মানুষের হাহাকার বেড়েছে। এখন বলে বেড়াচ্ছেন যে তিনি ভগবান প্রেরিত জীব। মা যতদিন বেঁচেছিলেন, তিনি নিজেকে মায়ের সন্তান বলে মনে করতেন। তারপর মনে হল তা নয়, ঈশ্বর তাঁকে ইহলোকে পাঠিয়েছেন নির্দিষ্ট কাজ সম্পন্ন করতে। ঈশ্বর নির্দিষ্ট কাজ শেষ হবে ২০৪৭ সালে। কাজেই আমাদের তাঁকে সেই সময় দিতে হবে! এমন মানুষকে কি সাইকোপ্যাথ বলবেন না? আমেরিকার ট্রাম্পের সঙ্গে তাঁর অনেকটাই মিল আছে। ক্ষমতায় থেকে এতটা বাড়াবাড়ি ট্রাম্পও করেননি।