এখন সমর বাগচি শুয়ে রয়েছেন শ্মশানে। ২০ জুলাই, ২০২৩। তাঁর দেহের পাশে মাটিতে বসা যুবতি তাঁর হাত ছুঁয়ে বলল, দাদু, আমি কিন্তু শেষ পর্যন্ত থাকলাম। এই হল নাতনী। সমরদা বলেছিলেন, কর্পোরেটের চাকরি ওর পোষালো না। সাত-আট বছর চাকরি করার পর ঠিক করল, আমাকে আরেকটা মাস্টার্স করতে হবে। গেল টাটা ইনস্টিটিউট অফ সোশ্যাল সায়েন্সে। এখন পি এইচডি করছে, অন এডুকেশন।
সে বলল, একটা গান করব। সবাই মিলে গান ধরল—এই আকাশে আমার মুক্তি আলোয় আলোয়।
কিছুক্ষণ আগে পারলৌকিক কাজ করতে শ্মশানের পুরোহিত এসেছিল। এক ভদ্রলোক কাজ না করিয়ে হাতে দুশো টাকা দিয়ে তাকে বিদায় দিলেন। তিনিই সমরদার জামাই। সমরদা বলতেন, আই হ্যাভ গট এ ভেরি গুড সান ইন ল। ভেরি ইন্টেলিজেন্ট, ভেরি শার্প, খুব কম লোকের এত ধৈর্য্য থাকে। প্রায় বারোখানা ওয়েবিনার করেছি ওর সাহায্যে। হি টেক সো মাচ অফ কেয়ার, সেইটা আমার বিরাট সৌভাগ্য।
দেহ ছাই হয়ে যাওয়ার পর তাঁর মেয়ে অনেকের সামনে তাঁর কাজের স্পৃহা, মনের জোর সম্বন্ধে কথাচ্ছলে বলছিলেন, কয়েক মাস আগে কলকাতার গরমে সবাই যখন কাবু, মে মাসে তিনি কাজে পুরুলিয়ায় যাবেন। মেয়ে বলেন, এই সময় না গেলেই কি নয়? উত্তরে তিনি বলেন, তুমি কি করে বুঝবে? তোমার মাথায় তো খড়! মেয়ে ধীরে, দুঃখিত ভাবে স্বগতোক্তি করলেন, সত্যিই তো আমি কি করে বুঝব, মাথায় তো খড়!
বিরক্তি থেকে লোকে যেমন বলে এ কিন্তু তেমন কথা নয়। ‘খড়’ কথাটা সমরদার মুখে প্রথম শুনেছিলাম স্মরজিতদার (ড. স্মরজিত জানা) মৃত্যুর পর। তাঁর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা থেকে তিনি বলেছিলেন, এই লেভেলের লোক পাওয়াতো মুশকিল। দেশ এবং পৃথিবী মিলিয়ে একটা ভয়ঙ্কর সময়ের মধ্যে রয়েছি। শেকসপীয়ারের ভাষায়, টাইম ইস আউট অফ জয়েন্ট, হ্যামলেটে আছে, সময়টা হচ্ছে সেইরকম। এইসব মানুষরা চলে যাচ্ছে, আমরা পিগিমিরা সব বসে থাকব। এলিয়ট বলছেন, উই আর হলো মেন, উই আর স্টাফড মেন, আওয়ার হেড ইস স্টাফড উইথ স্ট্র।
৯২ বছরের কর্মময় জীবন শেষ হল। আমাদের মনের মধ্যে হাহাকার নেই, শূন্যতা কিছুটা আছে, এমন মানুষ কোথায় পাব আর? আমাদের কাছে তিনি ছিলেন বিস্ময়। এই বয়সে এত উৎসাহ, অসুস্থ শরীরেও এমন শারীরিক সক্ষমতা থাকে কি করে? শেষ বয়সেও তাঁর তারুণ্যময় জীবনযাত্রা, কাজকর্ম এবং চিন্তাভাবনা দীর্ঘদিন মুগ্ধচিত্তে স্মরণ করব আমরা।
তিন বছর আগেও গর্ব করে সহাস্যে নিজেকে ইয়ংম্যান অফ এইট্টিনাইন বলতেন। শুনে ভাল লাগতো। তার পরেও তিনটি কর্মময় বছর কাটিয়ে গেলেন সমরদা। চাকরি জীবনে ছিলেন বিড়লা ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড টেকনোলজিক্যাল মিউজিয়ামের অতি সফল ডাইরেক্টর। বিরাট প্রাতিষ্ঠানিক অভিজ্ঞতা ছিল, প্রদর্শশালাবিদও ছিলেন। দেশ-বিদেশের নানা মিউজিয়াম থেকে তাঁর ডাক আসতো। আশির দশকের মাঝামাঝি তাঁর পরিকল্পনায়, তিনি এবং পদার্থবিদ পার্থ ঘোষের পরিচালনায় বিআইটিএম-এর সঙ্গে যৌথ ভাবে দূরদর্শনে দুবছর ধরে ‘কোয়েস্ট’ অনুষ্ঠান সারা দেশে সাড়া ফেলেছিল, তিনি বিশিষ্ট বিজ্ঞান শিক্ষক হিসাবে পরিচিত হয়েছিলেন। বলেছিলেন, একবার এইসির (অ্যাটমিক এনার্জি কমিশন) চেয়ারম্যান রাজারামান্নার সঙ্গে দেখা, দেখেই সে বলে আপনাকেতো আমি চিনি, আমি কোয়েস্ট দেখি। তারপরে দীর্ঘদিন ধরে তিনি হয়ে উঠলেন দেশময় হাতেকলমে প্রাণবন্ত বিজ্ঞান শিক্ষার প্রশিক্ষক। সেই কাজে তাঁর স্লোগান ছিল -- I read I forget, I see I remember, I do I understand. তবে অন্তত শেষ দুই দশকে পরিবেশ ও নানা সামাজিক আন্দোলন এবং তা নিয়ে লেখায় বেশি বেশি জড়িয়েছেন। এছাড়াও পুরুলিয়া, মধ্যমগ্রাম এবং কাশীপুরে গরীব মানুষের জন্য তিনটি স্কুল গড়ে তোলা এবং তা চালানোর পিছনে ছিলেন তিনি। তারুণ্যে ভরা মন ও কর্মস্পৃহা ছাড়া তাঁর বিরাট মনটা আমাদের খুব টানতো। আর ছিল ফোনে সহাস্য মধুময় সম্বোধন। যেন বাবা ডাকছেন তাঁর আদরের ছেলেকে। সহাস্য, সদালাপি এই মানুষটি বাস্তবে হয়ে উঠেছিলেন আমাদের আশ্রয়।
চলে গেছেন কিন্তু এখনও তাঁর নানা কথা যেন কানে ভেসে আসে। বলতেন, আমিতো প্রত্যেক দিনই সাড়ে চারটে পাঁচটায় ঘুম ভাঙ্গার পর থেকে কাজ শুরু করি। কন্টিনিউয়াসলি আই অ্যাম ইন দি ওয়ার্ক। চার ঘণ্টা বসার পর যখন কোমর ধরে যায়, একটু ঘুরে আসি।
নানা খোঁজ পাওয়া যেত তাঁর কাছে। একদিন বললেন, চেরনোবিলের ওপর একটা লেখা পেয়েছি, বুঝলেন। বলছে ওখানে যে রিঅ্যাক্টরটা বন্ধ করে দিয়েছে, সেটা ট্রিমেন্ডাস গরম হচ্ছে, হয়তো নিউক্লিয়ার বার্স্ট হবে সেখানে। এটা বেরিয়েছে কাউন্টার পাঞ্চ বলে একটা ওয়েব ম্যাগাজিনে। আজ সকালে সেটা দেখলাম, আপনাকে পাঠিয়ে দেব, দেখবেন। এতদিন পরেও চেরনোবিল সম্বন্ধে খবর বেরচ্ছে, এখন ইট হ্যাস বিকাম এ ডেঞ্জার টু ম্যানকাইন্ড।
বললেন, আপনাকে একটা অন্য কথা বলি। নোয়াম চমস্কি, বার্নি স্যান্ডার্স ‘প্রগেসিভ ইন্টারন্যাশনাল’ বলে একটা অর্গানাইজেশন তৈরি করেছে। তাদের তরফ থেকে নোয়াম চমস্কির একটা আর্টিকেল এসেছে। পুণা থেকে ‘জনতা উইকলি’ নামে যে কাগজটা বেরয় তাতে ওই আর্টিকেলটা দিয়েছে। মার্ভেলাস আন্ডারস্ট্যান্ডিং অব দি হোল ওয়ার্ল্ড সিচুয়েশন। আপনি ওই লেখাটা পড়বেন।
জলবায়ু বদল নিয়ে খুবই চিন্তিত ছিলেন। এ নিয়ে বক্তৃতা দেওয়া ছাড়া লেখালেখিও করেছেন। ২০১৫ সালে প্রকাশিত এ বিষয়ে আমার একটি বইয়ের মুখবন্ধও লিখেছিলেন। সেখানে একটি প্রসঙ্গে তিনি নিজেকে আমার ‘ভক্ত’ বলে উল্লেখ করেছিলেন। স্বাভাবিক ভাবেই তাঁকে না বলেই শব্দটা কেটে ‘অনুরাগী’ করেছিলাম। ২০১৬ সালে একদিন বিকেলে তাঁর বাড়িতে আমি থাকাকালিন কম খরচে বাড়ি তৈরির দক্ষ ব্যাঙ্গালুরুর আর্কিটেক সুভাস এলো। আমাকে দেখেই সে বইটির প্রসঙ্গ তুলল, খোঁজ পেয়েছিল সে বছরই বইটিকে উপলক্ষ করে পুরস্কার পেয়েছিলাম। আমার দিকে তাকিয়ে থতমত মুখে সমরদা বললেন, কই আমিতো জানিনা! আমার অস্বস্তি কাটিয়ে তারপরই তাকে বললেন, মুখবন্ধে আমি লিখেছিলাম ভক্ত, কেটে অনুরাগী করে দিয়েছে। ভাবলাম, কি বিপদ, সেটাও নজরে এসেছে! নিজেকে বড় মনে করার বিষয় নয়, অন্যক্ষেত্রেও দেখেছি, অনুজদের প্রতি খুশি হলে মুক্তকণ্ঠে এতটাই প্রশংসা করতেন। প্রাতিষ্ঠানিকতার বাইরে এমন মানুষও জীবনে কম দেখেছি।
একদিন বললেন, আপনার কাছে দুটো ইনফরমেশন চাই। একটা হল সমুদ্র কত মাত্রায় কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ করে। আমি এক জায়গায় পড়েছি ২৫ পার্সেন্ট, আরেক জায়গায় ৩৪ পার্সেন্ট। ২০১৯ সালে প্রকাশিত ‘অ্যান ইনহ্যাবিটেবল আর্থ’ নামে একটা বই পড়ছি। লিখেছেন ডেভিড ওয়ালেস। এটাকে এখন ইপক মেকিং বই বলছে। দি গার্ডিয়ান বইটার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছে। সেখানে বলেছে ৩৪ শতাংশ। যদি বিজনেস অ্যাজ ইউজুয়াল হয়, আমরা যদি একইভাবে কার্বন-ডাই-অক্সাইড বা গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ করে যাই, তাহলে ২১০০ সালে তাপমাত্রা ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যাবে। আমি ওই ইনফরমেশনটা আমার লেখায় দিয়ে দিতে চাই। আরেকটা কথা, পৃথিবীতে এই যে শক্তির চাহিদা বাড়ছে, আমি লিখেছি টু পার্সেন্ট হারে বাড়ছে। এরকম কিছু কিছু তথ্য আমি আপনাকে দিয়ে কনফার্ম করিয়ে নেব।
বললেন, সিওপি ২৬ (২৬ নম্বর জলবায়ু শীর্ষ সম্মেলন) সম্বন্ধে কি দেখছেন? আমাদের সৌম্য (দত্ত) ওখানে গেছে। শুরুর সময়ের বক্তব্যের একটা ভিডিও পাঠিয়েছে, সেটা দেখলাম। কিন্তু ওকে কিছুতেই ধরতে পারছি না। দেখি, হোয়াটসঅ্যাপে যদি পাই, হোয়াটসঅ্যাপে ফোনও তো করতে পারি, হ্যাঁ, তাইতো। স্কটল্যান্ডে ছ’ঘণ্টার ডিফারেন্স, এখন করা যেতে পারে। দেখি, ওর সাথে কথা বলি একটুখানি।
পরে বলেন, আইপিসিসির যে রিপোর্ট এখন বেড়িয়েছে, তাতে খুব কঠিন কথা বলছে। আগে ওরা যেসব কথা বলত, সে সব কিছুই না। বলছে পার্মাফ্রস্টের নীচে যে কার্বনেট রক আছে সেখান থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড, মিথেন এবং নাইট্রাস অক্সাইড বেরচ্ছে। গ্রিনহাউস গ্যাস হিসাবে নাইট্রাস অক্সাইড কার্বন-ডাই-অক্সাইডের চেয়ে তিনশোগুণ বেশি ক্ষতিকর। সাইবেরিয়াতে মিথেন থেকে বার্স্ট করে একশো ফিট বাই একশো ফিট এবং ডিপ সমস্ত গর্ত হয়ে যাচ্ছে। তাতে ওখানকার বাড়ি ভেঙ্গে পড়ছে, ধ্বংস হচ্ছে। ওখানে যে হাইডেল পাওয়ার এবং নিউক্লিয়ার পাওয়ার স্টেশন রয়েছে দে আর ইন ডেঞ্জার। আগে শুধু মিথেন বেরনোর কথা বলেছে। কার্বনেট রক থেকে ওখানে মিথেনের সঙ্গে নাইট্রাস অক্সাইড, কার্বন-ডাই-অক্সাইডও বেরচ্ছে, এটা নতুন ফাইন্ডিং।
যখন শোনা গেল বীরভূমের দেউচায় কয়লা খনি হবে তার বিরুদ্ধে জনমত গঠনে তিনি তৈরি হলেন। ফোনে বললেন, দেউচার কয়লার ব্যাপারে তো আপনি জানেন। ওখানে যারা ওয়াকিবহাল সেইরকম দু’জন রয়েছে। ওখানকার ট্রাইবালসদের সঙ্গে ওদের ভাল পরিচয় আছে। এটা নিয়ে যারা চিন্তিত এরকম ট্রাইবাল লিডারদের সঙ্গেও ওদের আলাপ আছে। প্রদীপ চ্যাটার্জীর সঙ্গে কথা হল, আমি প্রোপোস করলাম যে এইটা নিয়ে আমাদের একটা কিছু করা প্রয়োজন। কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেছি। আমরা সাত-আটজন বসে ওয়েবিনারে হোয়াট আর দি প্রবলেমস দ্যাট নেচার অ্যন্ড পিপল উইল ফেস, আর হোয়াট শুড বি ডান অ্যান্ড হাউ ইট হ্যাস টু বি ডান নিয়ে আলোচনা করব। এর বিরুদ্ধে মানুষকে কিভাবে জাগ্রত করা যায় দেখতে হবে। ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন পাঠানোর প্রোপোজাল হয়তো আসতে পারে। একটা ফ্যাক্টশিট তৈরি করতে হবে যে, ওখানে যদি ওটা করা হয় তাহলে হোয়াট আর দি এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড লোকাল ইমপ্যাক্ট অন দি পিপল? প্রদীপ একটা ওয়েবিনার অর্গানাইজ করছে। সে তখন বাইরে থাকবে, সেখান থেকেই করবে। আপনার ডায়রিতে এটা নোট করে নিন। যে ফ্যাক্ট শিটটা হবে তাতে আপনার যা মনে হয় সেরকম পাঁচ-ছ’টা পয়েন্ট আপনি দিন। প্রস অ্যান্ড কন্স অফ দি কোল এবং তার কি অবস্থা সাড়া পৃথিবীতে। সেটা ওদেরকে পাঠাব, সো দ্যাট দে কাম উইথ প্রপার নলেজ অ্যান্ড ইট ইস অ্যাভেইলেবেল ফর ডিসকাশন। পরশু সকালের মধ্যে পাঠান, আমি সন্ধ্যের মধ্যে সবাইকে পাঠাব।
এইসব কাজের সঙ্গেই চলেছে তাঁর বিজ্ঞান শিক্ষার পরীক্ষামূলক আয়োজন। পরিবেশ ও সমাজ নিয়ে চিন্তাভাবনায় বেশি জড়ালেও যে বিষয়ে তিনি দেশে বিখ্যাত সেই কাজ বন্ধ হয়ে যায়নি। একদিন বললেন, আমার একটা ওয়েবিনার হবে। দু’দিনের ওয়েবিনার, একটা পাটনায়, আরেকটা দিল্লিতে। একটা বড় পাবলিশার হারপার কলিন্স, এরা বোধহয় ভারতবর্ষে নতুন এল, তারা এটা করবে, এক্সপেরিমেন্ট অ্যাক্টিভিটিজের উপর। এক ঘণ্টার প্রোগ্রাম। লিংকটা আপনাকে পাঠিয়ে দেব, আপনিও দেখতে পাবেন। আমার জামাইয়ের বাড়িতে গিয়ে এটার দুদিনের রিহার্সাল হয়ে গেল। সারা ভারতে ওদের রিপ্রেজেন্টেটিভরা দেখেছে। তারা মুগ্ধ হয়েছে। আমার তো ওই সমস্ত ইকুইপমেন্ট নাই। তাই জামাইয়ের বাড়িতে থেকে তার হেল্প নিয়ে টিচারদের জন্য এক্সপেরিমেন্টগুলো করতে হবে। উদ্দেশ্য হচ্ছে, কিভাবে বিজ্ঞান পড়াতে হয় তা টিচারদেরকে দেখানো। তার কাগজপত্র রেডি করতে শুরু করেছি। সব নোটস বার করে সাজিয়ে সেইটা যখন শেষ করছি আপনার ফোন এল। এটা আগে অক্সফোর্ড করেছে, আরেকটা বড় বিদেশি পাবলিশার আছে কলকাতায়, তারাও করেছে। সেগুলো ওয়েবিনার ছিল না, ওরা অ্যাকচুয়াল টিচারদের ডেকে এনেছিল, সেখানে করেছি। যে মেয়েটি যোগাযোগ করেছে বিভিন্ন জায়গায় চেঞ্জ করার পর এখন হারপার কলিন্সে জয়েন করে আমায় ফোন করেছে। আপনার নামটা লিখে রাখছি, এটা যেদিন হবে তার আগের দিন ওরা লিংকটা পাঠালে আমি আপনাকে ফরোয়ার্ড করে দেব।
আরেকবার বলেন, কালকে আমার ওয়েবিনার। গ্র্যাভিটি আর বারনুলিস প্রিন্সিপ্যালের ওপর, ঘণ্টাখানেক, ঘণ্টা দেড়েকের প্রোগ্রাম। তো সে সব নিয়ে প্রিপারেশন, এক্সপেরিমেন্ট -- এইসব করছি।
একবার বললেন, ওই যে দুদিন একটা লেকচার দিলাম না ‘উন্নয়নের বিকল্প ধারণা রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধী’ নিয়ে, হাওড়ার প্রদীপ দাসরা করেছিল। ওইটা করার পরে ওরা হিস্ট্রি অফ সায়েন্সের ওপর একটা লেকচার করাতে চাইছে। আগে তা নিয়ে এই নিয়ে এশিয়াটিক সোসাইটিতে ছ’টা লেকচার দিয়েছি। এখন সেই নিয়ে পড়াশুনো করছি, আর এই যে মুঠো যন্ত্র ধরে আছি তা থেকে পুরোনো সমস্ত জায়গার, যেসব জায়গার কথা বলি -- মানে নানা এম্পায়ার, নানা লোকের কথা -- যেমন আল বিরুনি কে, কোথাকার লোক ছিল, কি তার কাজ ছিল -- প্রত্যেকটা জিনিস হাতে লিখে নোট করছি, যাতে কনফিডেন্ট থাকতে পারি। এই মুঠো যন্ত্রে যে কি আছে আর নাই, হোল ওয়ার্ল্ড ইস দেয়ার। মানে যা চাই তাই দিয়ে দিচ্ছে গুগুল সার্চে!
বললেন, আলেকজান্দ্রিয়াতে বিরাট লাইব্রেরি আর মিউজিয়াম ছিল। যেখানে গ্রেট গ্রীক সায়েন্টিস্ট টলেমি থার্ড সেঞ্চুরি এডি-তে বিখ্যাত লাইটহাউস তৈরি করেছিলেন। সেইখানে একবার সিরিয়ার পামিরার রাণী জেনোভিয়া অ্যাটাক করেছিলেন। আমি জানতে চাই পামিরাটা কোথায়, তার ম্যাপ জোগাড় করতে হবে। আমার জামাই কি করছে জানেন, পামিরা, বাইজেন্টাইন কোথায়, এইরকম সব নানা জায়গার ম্যাপ জোগাড় করে, তা ফাইল করে দিচ্ছে। আপনি ভাবতে পারবেন না! বাংলায় আমার অনেক চোথা কাগজ ছিল, সে বলে, এগুলো উড়ে যাচ্ছে, আপনি আমার সাথে বসুন, আপনি ডিকটেট করবেন আমি টাইপ করব। সমস্ত জিনিস আমাকে টাইপ করে দিয়েছে। এরপর ওইগুলো দেখে দেখে আমি লেকচার দিতে পারব।
আমি একদম লিস্ট করেছি যে কি কি জিনিস নিয়ে আমাকে খবর নিতে হবে। লেকচারে যে যে অঞ্চল সম্বন্ধে লিখেছি সেইগুলো কোনটা কি, আন্দালুসিয়া বলতে কি বুঝি আমি -- এখন আমি জানি, সাথার্ন স্পেন -- খুঁজে বার করে সেখানকার ম্যাপ জামাই বার করে দিচ্ছে। স্পেনে যখন ইসলাম গেল সেখানে তিনটে বড় বড় ইউনিভার্সিটি তৈরি করল। তখন সবেমাত্র অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি, প্যারিস ইউনিভার্সিটি তৈরি হয়েছে। পণ্ডিতরা সব গিয়ে দেখছে বিরাট কাজ, সব আরবিকে ট্রান্সলেশন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
এই নিয়ে আমার লেখা আগে পাবলিশড হয়েছে, করেছে পুরুলিয়ার একটা পাবলিশার কিন্তু সে মরে গেল, নিরুপমা অধিকারী। এই মেয়েটা মরে যাওয়া মানে বড় স্যাড ব্যাপার। ওর কিন্তু কোভিড হয়নি। ওর সিওপিডি ছিল, আমার মনে হয় নিউমোনিয়া-টিয়া হয়ে মরে গেল। ও কিন্তু দিল্লীর এক গান্ধীয়ানের জলের উপর বই বাংলায় ট্রান্সলেশন করে ছেপেছে। আমার বইটা তারা পাবলিশ করবে, প্রুফ রিডিং হচ্ছে—কিন্তু চারদিন কি পাঁচদিনের মধ্যে মেয়েটা মরে গেল!
একদিন ফোন করে অনেক কথার মাঝে বললেন, মাঝে মাঝে আমার এমন সমস্ত জিনিস মনে পড়ে যে কী সব কাজ করেছি! বনানী কক্করকে চেনেন তো, যে ওই ওয়েটল্যান্ডের ওপরে কেস করে হাইকোর্টে। শি রিকগনাইজড মি ইন এ মিটিং। আমি কিন্তু ভুলে গেছি। চুল পেকে সাদা হয়ে অনেকখানি বুড়ি হয়ে গেছে। বনানীই বোধ হয় আমাকে ফোন করল ওয়েটল্যান্ডসের ব্যাপার নিয়ে। ফোনে বলল, যে এই যে ওয়েটল্যান্ডের মুভমেন্ট, এই যে কোর্টে যাওয়া সেতো আপনার জন্য হয়েছে। আমি বললাম কীরকম? বলে, না আপনি ওই যে মিটিং ডেকেছিলেন বিড়লা মিউজিয়ামে, সেই মিটিং থেকেই তো ওই ৩৬টা অর্গানাইজেশনের জোট তৈরি হল। তারপর থেকে এই কাজগুলো শুরু হল। আমার মনেও ছিল না, ভুলে গেছি। বিড়লা মিউজিয়ামে থাকতে এমন সব কাজ করেছি না, চাকরি চলে যাওয়া উচিত ছিল। সরকারের বিরুদ্ধেও নানারকম কাজ করেছি।
আরও কিছু কথার শেষে বললেন, আপনি যখন ফোন করলেন আমি জামাইয়ের মা’কে জীবনানন্দ পড়ে শোনাচ্ছিলাম। জীবনানন্দের ‘হাওয়ার রাত’ কবিতাটা পড়ছিলাম।
৮৯ বছরের মধ্যে তাঁর দশটা অপারেশন হয়েছে জানতাম। একদিন শরীরের কথা জিজ্ঞেস করলাম। বললেন, আমার যিনি অপারেশন করেছিলেন আজকে সেই নিউরোসার্জেনের কাছে গিয়েছিলাম। পরশু থেকে পায়ের পাতায় ইলেকট্রিক শকের মত স্পার্ক হচ্ছে, সাত-আট বছর ধরে চলছে। প্রথমে একবার হত, তারপর তিন-চার মাস কোনও সাড়া-শব্দ নাই। ধীরে ধীরে এটা রেগুলার হয়ে গেছে। কালকে এমন হল যে আই কুড নট স্লিপ অ্যাট অল। তাঁকে গিয়ে দেখালাম, উনি টিপে টিপে দেখে একটা ওষুধ দিলেন। সেটা এক সপ্তাহ খেতে বলেছেন, যদি না কমে তাহলে একটা ইনজেকশন দিতে হবে, নার্ভের কিছু গোলমাল হয়েছে। আর গায়ের জোরটা কমে গেছে। কোভিডের আগে যেমন হাঁটতে পারতাম, এখন আর পারি না। নভেম্বরের ৩০ তারিখে (৩০/৪/২০২১) করোনায় হসপিটালে ঢুকেছিলাম। তারপর থেকে তিন মাস হয়ে গেল। কাল না পরশু টাকা তুলতে ব্যাঙ্কে গিয়েছিলাম, ভয় হল পড়ে না যাই। স্টেবিলিটিটা কমে গেছে। কোমরে অসম্ভব যন্ত্রণা, কালকে তো সারা রাত হয়েছে। পাঁচ মিনিট হচ্ছে না, আবার শুরু হচ্ছে। ঘণ্টা দুয়েক আগে ওষুধটা খেয়েছি দেখা যাক কি হয়। কিন্তু মাথাটা তো চলছে চারশো কিলোমিটার পার আওয়ার স্পীডে। অনেককে তো বোর করি বাই সেন্ডিং ডিফারেন্ট মেলস। আশিজন একশোজনকে মেল পাঠাই। যা গুরুত্বপূর্ণ মনে করি তাতো পাঠাতেই হবে সবাইকে, হয় পড়বে নয় পড়বে না। শেষে বললেন, এই ভাবে কোনও রকমে বেঁচে আছি, আরতো বেশি দিন নাই। তবে আমি মরতে চাই না—‘মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে, মানবেরই মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই’।
যেসব কথা বললাম, সবই গত কয়েক বছরের মধ্যে হয়েছে। তাঁর অ্যাক্টিভিজম ছাড়াও এতটা বয়সের অশক্ত মানুষ তাঁর চেয়ে কম পক্ষে কুড়ি-পঁচিশ বছরের অনুজদের সঙ্গে অবলীলায় মিলেমিশে আন্দোলনের পরিকল্পনা করছেন, অনুষ্ঠান করছেন, তথ্য ভাগ করে নিচ্ছেন – এই বা ক’জন দেখেছে!
সারা বছর সংসার খরচের পর যা বাঁচত, মোটা টাকা কয়েকটি সংগঠনকে দান করতেন। লকডাউনের সময় দানের পরিমাণ ও সংগঠনের সংখ্যা বেড়ে গিয়েছিল। বলতেন আমি তো পেনশন পাই, বাড়তি টাকা দিয়ে আমি কী করব? সে সময় অসংখ্যবার ফোনে কথা হত। একদিন বললেন, লকডাউনে আমি বসে বসে কী করছি জানেন? নানা জায়গায় যেসব পরিযায়ী শ্রমিক আটকে গেছে সরকারকে ফোন করে তাদের অনেককে আনাবার ব্যবস্থা করেছি, সে এক বিরাট ব্যাপার। তাঁর হাত ছিল লম্বা, যথাযথ প্রয়োজনে তা কাজে লাগাতে কুণ্ঠা ছিল না।
সেইরকম একটি উদাহরণ দিয়েছেন ফিস ওয়ার্কাস ফোরামের প্রদীপ চ্যাটার্জী, ১২ অগস্ট তাঁর স্মরণসভায়। এ রাজ্যের কয়েকশো মৎস্যজীবী রোজগারের আশায় কেরালার কোলামে ট্রলার এবং মেকানাইজড বোটে করে মজুর হিসাবে মাছ ধরতে যাওয়ার পর হঠাৎই লকডাউন ঘোষণা করা হয়। ট্রলার মালিকরা মেসেজ পাঠিয়ে তাদের সমুদ্র থেকে চলে আসতে বলে। ফিরে এলে দু’একটা নৌকোর মধ্যে কয়েকশো মৎস্যজীবীকে থাকতে বাধ্য করে। ডাঙ্গায় মাথায় ছাদওয়ালা শেল্টার থাকলেও কোভিডের ভয়ে সেখানে থাকতে দেয়নি। কাজ বন্ধ বলে মজুরিও দেয়নি। ওদিকে কেরালা থেকে রাজ্যে ফেরার বিশেষ ট্রেন ছাড়লেও তারা ট্রেনে চাপার সুযোগ পায়নি। এই অবস্থায় খাবারের অভাব ও অসুখবিসুখে মৃত্যুও হয়েছে। খবর পেয়ে অসহায় প্রদীপরা সমরদাকে বিষয়টা জানায়। দীর্ঘদিন ধরেই মৎস্যজীবীদের ভালমন্দ নিয়ে প্রদীপের সঙ্গে সমরদা কথা বলতেন, পরামর্শ দিতেন। এই পরিস্থিতিতে তিনি কয়েকদিন ধরে ক্রমাগত কেরালা শাস্ত্র সাহিত্য পরিষদ ও কেরালা প্ল্যানিং কমিশনে তাঁর পূর্বপরিচিত কয়েকজনকে বার বার ফোন করে সাহায্যের জন্য বলেন। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারি মহলেও বিষয়টি জানান। এরই মধ্যে ওই মৎস্যজীবীরা দল বেধে জেলার ডিএমকে তাদের অসহায় অবস্থার জানাতে গেলে মাঝপথে পুলিশ তাদের মারধোর করে, রক্তপাত ঘটে। মৎস্যজীবীদের মোবাইলে তোলা সেই ছবি সমরদা ও প্রদীপের উদ্যোগে নানা মহলে পৌঁছে যায়। এরপরই কয়েকশো মৎস্যজীবীকে কেরল সরকার জল, রাস্তার খাবারসহ জামাই আদর করে ট্রেনে চড়িয়ে রাজ্যে ফেরত পাঠাবার ব্যবস্থা করে।
প্রদীপ পরে বলে, ক্ষুদ্র মৎস্যজীবীদের বিষয়ে আমাদের যে সব পর্যালোচনা বা সুপারিশের মেল তাঁকে পাঠাতাম তা তিনি শুধু পড়তেনই না, মতামতও দিতেন এবং বিষয়টার প্রচার করতেন। বলতেন, আমি এদেরকে মেলটা পাঠিয়েছি, ওদের সাথে কথা বল। যখন মৎস্যজীবীদের দাবিদাওয়া এবং সরকারি মনোভাব নিয়ে কথাবার্তা হত, তিনি বলতেন, গ্রাউন্ড লেভেলে তোমাদের লড়া ছাড়াও উপরের দিকে আবেদন করা উচিৎ। দীর্ঘকাল ধরে এইভাবে তাদের সঙ্গে থাকা ছাড়াও, বিশেষ করে কোলামে তাদের বিপদের সময় সমরদার ভূমিকা প্রদীপসহ মৎস্যজীবীরা আজও কৃতজ্ঞ চিত্তে স্মরণ করে। কৃতজ্ঞতার জন্য তারা মাছ নিয়ে তাঁর বাড়িতেও হাজির হয়েছে।
সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম এবং হরিপুর আন্দোলনের পরিপেক্ষিতে মেধা পাটকর এবং সমরদার সঙ্গে একই সময় প্রদীপদের আলাপ-পরিচয় হয়। তারপর থেকেই তিনি বলতে থাকেন, মৎস্যজীবী আন্দোলনকে এনএপিএম-এর (ন্যাশনাল অ্যালায়েন্স অফ পিপলস মুভমেন্ট) অংশীদার করতে হবে। কারণ সামাজিক আন্দোলনে তাদের বিরাট যোগদান রয়েছে। তাঁর উদ্যোগেই পশ্চিমবাংলার মৎস্যজীবী সংগঠন এনএপিএম-এর সদস্য হয়। প্রদীপের মতে, সমরদার মধ্যে দুটো জিনিস খুবই বড় ছিল। প্রথমটা উনি একজন মার্গদর্শক (ভিশনারি) ছিলেন। তাঁর মধ্যে একটা পিতৃতুল্য ব্যক্তিত্বও ছিল। তিনি শুধু সমর্থন করেই চুপচাপ থাকতেন না, চেষ্টা করতেন যেন আমরা ঠিকপথে থাকি। নানা বিষয়ে তর্ক হত, কিন্তু তারপরে যখন কথা বলতাম, কি স্নেহ! একদিকে স্নেহ, অন্যদিকে তীব্রতা। ছেলেকে বাবা যেমন বলে, না এটা তুমি করবে না।
একদিন ফোন করে বললেন শুনুন, আমি আর অসিতবাবু মিলে একটা প্রচেষ্টা শুরু করেছি। লকডাউনে পরিযায়ী শ্রমিকদের অবস্থা নিয়ে একটা স্টেটমেন্ট তৈরি হয়েছে, তারপরে শঙ্খ ঘোষের কথাটা শুনে পশ্চিমবঙ্গের বিজ্ঞানী, লেখক, কবি, পেইন্টার -- সবার কাছে যাব। বিশ্বভারতীর ভাইস-চ্যান্সেলর ছিলেন ম্যাথমেটিশিয়ান ডি কে সিনহা, তিনি বলেছেন আমি সই দেব। ফোন করলাম রুদ্রপ্রসাদকে। বললাম, আমরা এদের কাছে যাব, যেই বলেছি শঙ্খ ঘোষের কাছে যাব, বলে, উনি যদি সই দেন তাহলে আমরা সবাই দেব। শঙ্খ ঘোষের শরীর খুব খারাপ। শঙ্খবাবুর ছোটো ভাই অভ্র ঘোষকে ফোন করলাম। ওর যে মেল-টেল দেখে, অ্যাসিস্ট্যান্ট, সেও অসুস্থ হয়ে বাড়িতে আছে। অভ্রবাবু বলেছে, সে ফিরে এলে আমাকে জানাবে। তখন আমি ভদ্রলোককে ওই স্টেটমেন্টটা পাঠিয়ে বলব, এইটেতে শঙ্খবাবু সই দিতে রাজি আছেন কিনা বলুন। অর্পিতা ঘোষকে বলেছি তুমি সমস্ত ইম্পর্ট্যান্ট সাহিত্যিকদের নাম, টেলিফোন নাম্বার, ই-মেল আইডি জোগাড় করে দাও। ও বলেছে দেবে। বাংলা অ্যাকাডেমির চেয়ারম্যান হচ্ছে শাঁওলি মিত্র। ও-ও দেবে বলেছে। এই কাজটা যদি করা যায়, আমরা প্রেস কনফারেন্স করে সেটা রিলিজ করব। দেখা যাক কি হয়, করা যায় কিনা। এইটুকু করলেও হয় যে, আমরা প্রতিবাদ করেছি।
বললেন, এখন যদি আমরা মুখ না খুলি ওরা ভারতবর্ষকে একেবারে শেষ করে দেবে। এত বড় একটা বিপদ হল পরিযায়ী শ্রমিকদের, কিন্তু সেইভাবে কোনও বিদ্রোহ হল না। অথচ আমেরিকায় একটা লোককে মেরে দিল, সারা আমেরিকা, কানাডা, ইউরোপ একেবারে উত্তাল হয়ে উঠল। আমাদের এখানে তাঁর কত গুণ বেশি অত্যাচার হল, অথচ কোনও বিদ্রোহ নাই, কিছু নাই। ওদিকে দিল্লিতে যখন রায়ট করছে, কেউ যে ওখানে যাবে, সেটাকে প্রতিহত করার চেষ্টা করবে, নোবডি ট্রায়েড। খুব খারাপ অবস্থা কিন্তু।
লকডাউনের মধ্যে ‘দেশ’-এর জন্য তৈরি একটা লেখার প্রাথমিক খসড়ার কিছুটা সমরদা পড়ে শুনিয়েছিলেন (মতামতের জন্য লেখাটা মেল-এ পাঠিয়েওছিলেন, অবশ্য মতামতের জন্য অপেক্ষা করেননি)। বলেছিলেন, আমি লিখছি, ভলতেয়ার আর রুশো ১৭৭৫ সালে বলছেন -- সামান্য কিছু মানুষ অপর্যাপ্ত জিনিসের ব্যবহার দ্বারা জীবন-যাপন করে, যেখানে বেশিরভাগ ক্ষুধার্ত মানুষের প্রয়োজনীয় জিনিসের অভাব। ওদিকে ১৯২৪ সালে রবীন্দ্রনাথ তাঁর লেখায় বলছেন -- যদি জীবনের শ্রেষ্ঠ জিনিসগুলো মুষ্টিমেয় কয়েকজনেরই শুধু লভ্য হয় তাহলে সভ্যতার পুষ্টি হয় না ... সমস্ত জগৎ যেন দুই প্রতিপক্ষে বিভক্ত হয়ে গেছে -- ধনী ও নির্ধন, সন্তুষ্ট ও অসন্তুষ্ট। যারা পরিশ্রম করে ও যারা বিশ্রামে থাকে। যতদিন এই দুই শ্রেণীতে বিভাগ থাকবে ততদিন শান্তির আশা নাই। ১১ সেপ্টেম্বর রাশিয়ার চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ এক জায়গায় বলছেনঃ চিরকালই মানুষের সভ্যতায় একদল অভুক্ত লোক থাকে, তাদের সংখ্যাই বেশি ... এখানে এসে আমার চোখে যেটা সবচেয়ে ভাল লেগেছে সেটা হচ্ছে ধন মহিমা আর ইতরতার সম্পূর্ণ তিরোভাব।
বললেন, এইসব চলছে লকডাউনের মধ্যে, আর্টিকেলটা প্রায় শেষ করে ফেলেছি। এটার বিষয় হচ্ছে -- প্রিয় ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য -- পৃথিবীর দিকে ফের। প্রকৃতির যা হাল, আমি লেকচারে যা বলি তারই মধ্যে কিছু কিছু নতুন জিনিস অ্যাড করছি। আমার ইচ্ছে আছে এটা 'দেশ'-এ পাঠানোর, যদি ছাপে। ‘দেশ’ ছেপেছিল। জীবনের শেষ বেলায় তিনি উপলব্ধিতে এসেছিলেন ধন বৈষম্যের জন্য ‘শান্তি’ ছাড়াও জলবায়ু বদল রোখা অসম্ভব। তারপরও নিজের মতো করে বলার চেষ্টায় খামতি ছিল না।
একদিন ফোন করেই বলতে শুরু করলেন, গান্ধীজীকে হত্যার চোদ্দ দিন আগে ১৪ জানুয়ারি ১৯৪৮, তিনি একটা স্টেটমেন্ট দিচ্ছেন, সেই স্টেটমেন্টটা যদি আপনি পড়েন, দেখবেন সমাজ কীরকম হবে তা নিয়ে গান্ধীজীর সাথে কার্ল মার্ক্সের চিন্তা একইরকম প্রায়। আপনার একটু সময় আছে? সম্মতি জানালাম। বললেন, সমাজটা কীরকম হবে তা নিয়ে জার্মান আইডিওলজিতে(১৮৪৫) মার্ক্সের স্টেটমেন্ট হচ্ছেঃ হোয়াইল ইন কমিউনিস্ট সোসাইটি ... সোসাইটি রেগুলেটস দি জেনারেল প্রোডাকশন অ্যান্ড দাস মেকস ইট পসিবল ফর মি টু ডু এনিথিং টুডে অ্যান্ড অ্যানাদার টুমরো, টু হান্ট ইন দি মর্নিং, ফিশ ইন দি আফটারনুন, রিয়ার ক্যাটেল ইন দি ইভিনিং, ক্রিটিসাইজ আফটার ডিনার, জাস্ট অ্যাজ আই হ্যাভ এ মাইন্ড, উইদাউট এভার বিকামিং হান্টার, ফিশারম্যান, হার্ডসম্যান অর ক্রিটিক। আর যদি গান্ধীজীকে মারার আগে তাঁর স্টেটমেন্টটা পড়েন, আমি পড়ে শোনাচ্ছিঃ ইন দি ফিউচার সোসাইটি ... এভরিওয়ান উইল বি প্রাউড টু আর্ন হিস লিভিং বাই ফিজিক্যাল লেবার উইথ জয়। দেয়ার উইল বি নো ডিফারেন্স বিটুইন মেন্টাল অ্যান্ড ফিজিক্যাল লেবার। আই ওয়ান্ট টু কন্টিনিউ মাই ফাস্ট টিল ডেথ টু এস্ট্যাবলিশ দ্যাট সোসাইটি। এইসব পড়ছি। একটা আর্টিকেল লিখছি, ‘জনতা উইকলি’র জন্য।
তিনি অনেক লিখেছেন, কিন্তু বলতেন, আমি অত লিখতে পারি না। অত জ্ঞানীগুণী লোকও নই যে সব বিষয়ে লিখতে পারি। কেউ কেউ আছে যারা অনেক বিষয়ে লিখতে পারে, আমার অত জ্ঞান নাই। সেদিন অনেক কথার শেষে বললেন, ‘বৃক্ষমূল’ বলে কবিতাটা কি আপনি আমার কাছ থেকে শুনেছেন? বললাম, না।
সঙ্গে সঙ্গে আবৃত্তি শুরু করলেন--
বৃক্ষমূলে আমার গভীরতম কথা আমি রেখে দিয়েছি
আমার সমস্ত আত্মীয়তা তার সাথে
কেননা আকুল জল সেখানেই ঢালা হয়েছিল
আর শীত-গ্রীষ্মের মার পড়েছিল বুকে আর পীঠে
ফুলফলের সাজ আর আলোছায়ার ঝিলিমিলি বলে কী সুখ কী সুখ
কিন্তু চুরমার পাঁজরে, যেখানে দুঃখ জমে থাকে, তাকে তো আমি দেখেছি
সেই উৎস থেকে সভা ওঠে, তাই আমার প্রেম পেতেছি আমি মাটিতে আর ধুলোয়।
বললেন, এই যে আপনি এত কাজ করে বেড়াচ্ছেন, মাটিতে আর ধুলোয় যদি প্রেম না থাকত তাহলে কি এই কাজ করতে পারতেন? এইটা আমরা যদি মনের মধ্যে জাগিয়ে রাখি তাহলে কোনও হিংসা, মারামারি, ঝগড়া হবে না। ওসব আমার একেবারেই ভাল লাগে না, খুব খারাপ লাগে, কষ্ট হয়।
বললেন, ‘বৃক্ষমূল’ কবিতাটা কে লিখেছে জানেন তো? আমার খুব প্রিয় কবি দুজন, জীবনানন্দ এবং ইনি। এনার নাম অরুণ মিত্র। একদিন বাড়িতে আসবেন, অরুণ মিত্রের কবিতা শোনাব আপনাকে। অরুণ মিত্রে বহু কবিতার আমিই ফার্স্ট লিসনার। আই হ্যাভ টু প্লে দি পার্ট অফ হিস সান অ্যাট ওয়ান টাইম। একটা সময় ওনার জীবনে ক্রাইসিস এসেছিল। ছেলে বিদেশে বহুকাল, খুব ইমপর্টেন্ট ফিজিক্সের লোক ছিল, তারপর আমেরিকায় খুব ঝামেলায় পড়ল। যখন একটু সময় হবে একদিন আসবেন আমার বাড়িতে, লাঞ্চ করা যাবে, এক সঙ্গে বসে অনেকটা সময় কাটাব।
আরেকদিন বললেন, আপনাকে একটা কাজের কথা বলি। গত সাত-আট দিন ধরে কি করছি জানেন? যেদিন মোদি ফার্মস অ্যাক্টটা উইথড্র করল সেদিন সকালে অভিষেক রায় ফোন করে আমাকে সেটা জানাল। পড়ার ঘরে বসে বসে ভাবছি যে সাতশো অন্নদাতা, ফার্মাররা প্রাণ দিল, তাদের সম্মান জানাতে আমাদের পোয়েট, রাইটার, শিল্পীদের কি কোনও রোল আছে? ওই যে ফার্মাররা এক বছর ধরে লড়াই করল তাদের প্রতি কি কোনও দায়িত্ববোধ নাই? ভাবতে ভাবতে মনে হল ইউপি ইলেকশন আসছে। সেখানে যদি সোশালিস্ট পার্টি আর কংগ্রেস ঝগড়া করে তাহলে ওই বদমাইশরা জিতে যেতে পারে। ঠিক করলাম যে একটা অ্যাপিল করা যাক, বাই ইমপর্টেন্ট পার্সোনালিটিস অফ ইন্ডিয়া। যেখানে অন্যান্য পার্টিগুলোকে বলা হবে যে তোমরা ইউনাইটেড হও টু ফাইট এগেন্সট দি ডিমন। এইটা ভেবে আজ থেকে কিছুদিন আগে একটা কাজ শুরু করলাম। প্রায় আশি জনের নাম, ফোন নাম্বার, ই-মেল জোগাড় করে ফোন করতে শুরু করলাম সবাইকে। প্রায় চল্লিশ জনকে ফোন করেছি। ফোন, ইমেল মিলিয়ে পঞ্চাশ-ষাট জনকে যোগাযোগ করেছি। আরও জনা কুড়ি বাকি। যাদের সঙ্গে কথা বলেছি তাঁদের মধ্যে রয়েছে রোমিলা থাপার, সিনিয়র ইরফান হাবিব, হর্ষ মন্দার, প্রফেসর অমিয় দেব এই রকম আরও অনেকে। মল্লিকা সারাভাই, ইলা ভাটকে মেল পাঠিয়েছি। শুভাপ্রসন্নকে ফোন করতেই সে বলল, আজকেই চিদানন্দ দাসগুপ্তের সেন্টেনারি হবে, আপনি চলে আসুন। ওখানে অপর্ণা সেনরা আসবেন, আমি তাঁদের সাথে আপনার পরিচয় করিয়ে দেব। আমি কাঁপতে কাঁপতে লাঠি নিয়ে চলে গেলাম। দেবসায়ম বলে একজনের খবর পেলাম, তাকে ফোন করতে সে বলল, তুমি আমাকে পাঠিয়ে দাও যারা আমাদের এক্স আইএএস, আইপিএস এবং এক্স জাজ তাদের দেড়শো দুশোজনকে তোমার অ্যাপিল পাঠিয়ে দেব। এইরকম করে আমি শাবানা আজমি ও তার হাজবেন্ডকে পাঠানো ছাড়া কবিতা কৃষ্ণান, নন্দিতা দাস, নাসিরুদ্দিন শা—সবাইকে পাঠিয়েছি। আজকে বসে সেই সমস্ত নামগুলো এক জায়গায় লিখছি। এইসব করছি আর কি, খারাপ কাজ করছি কি? দেখি কি হয়, জানাব আপনাকে।
বিআইটিএম-এর ডাইরেক্টর হিসাবে তাঁর কথা আশির দশকের গোড়াতেই শুনেছি। তখন যাদের সঙ্গে আমার ওঠাবসা ‘উৎস মানুষ’-এর প্রয়াত অশোক বন্দ্যোপাধ্যায়, পবন মুখোপাধ্যায় এবং যে ঘরে আমরা বসতাম সেই বাইন্ডার প্রয়াত নিবারণ সাহা, সবাই হয় বিআইটিএম-এ কাজ করছেন, নয়তো করতেন। তাঁদের মুখে বিক্ষিপ্ত ভাবে তাঁর কথা শুনে এটুকু জানতাম তিনি ওই সংস্থায় বেশ জনপ্রিয় ছিলেন।
কিন্তু সমরদার সঙ্গে আমার পরিচয় হয় ১৯৯৯ সালে। গাড়িতে চড়ে জয়নগরের সমাবেশে দুজনে পরমাণু শক্তির বিরুদ্ধে বলতে যাচ্ছি। সঙ্গে ছিল ব্রেকথ্রু সায়েন্স সোসাইটির প্রয়াত শুভাশিস মাইতি। সে-ই পরিচয় করিয়ে দিল, অবশ্য তার প্রয়োজন ছিল না। পরমাণু শক্তি নিয়ে তাঁর মতামত জানতাম না। সাধারণত যারা পক্ষে বা বিপক্ষে বলেন তাঁদের চিনি। বিপক্ষের বক্তা হিসাবে তিনি নতুন।
বারুইপুরে চারটে নাগাদ পৌঁছে আমরা ফলাহার করলাম। বিকেল পাঁচটা নাগাদ মিটিং শুরু হল। দেখলাম তিনি সুবক্তা। তখনকার দিনে এ বিষয়ে বলা সহজ ছিল না। ইন্টারনেট ছিল না বলে তথ্য সহজলভ্য ছিল না। ওদিকে সৌর বা বায়ু শক্তির বিকাশই শুরু হয়নি। এখন যেমন পৃথিবী জুড়ে বায়ু ও সৌরবিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা হয়েছে ১৭.৫৬ লক্ষ মেগাওয়াট (উৎপাদন ১৩০০ টেরাওয়াট আওয়ার), তখন জলবায়ু বদল বা কার্বন নিঃসরণ নিয়ে দেশে বা পৃথিবীতে তেমন কথাই শুরুই হয়নি। পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি না করলে তাপবিদ্যুৎ নির্ভর হয়েই থাকতে হবে, এই ছিল যুক্তি। বিকল্প বলতে সীমিত জলবিদ্যুৎ। পরমাণু শক্তির বিপদ কি কি এবং তা যে খুবই ব্যায়বহুল তা ভাল করে বুঝিয়ে বলতে হত। সেই হিসাবে বলা কঠিন ছিল, তাই এই নতুন বক্তার বক্তব্যে খুশি এবং অবাক হয়েছিলাম।
এরপর নতুন শতকের প্রথম দিকে সমরদা যোধপুর পার্কের এক বাড়ির একতলার ঘরে এ নিয়ে বক্তব্য রাখার আয়োজন করলেন। শ্রোতারা সবাই পক্বকেশ পুরুষ। মনে আছে সেখানেই মেহেরদার (অধ্যাপক মেহের ইঞ্জিয়ার, সমরদা বলতেন ডক্টর ইঞ্জিয়ার) সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। এরপর অনেকদিন যোগাযোগ ছিল না, দেখা হতো এখানে ওখানে। পরের দশকে, চোদ্দ-পনেরো সালেই যোগাযোগ বাড়ল।
তাঁর মুখেই শুনেছি, সারা ভারতে ঘুরে ঘুরে তিনি এবং তাঁরই মত আরেকজন হাতে কলমে বিজ্ঞান শিক্ষার প্রায় সাড়ে ছ’শো অনুষ্ঠান করেছেন। তার আমলেই ছাত্রছাত্রী ও অন্যান্যদের কাছে বিআইটিএম অত্যন্ত আকর্ষণীয় ও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। মিউজিয়ামের প্রেক্ষাগারেও তিনি নানা সভা ও বিতর্কসভার অনুমতি দিয়েছেন। তাঁকে না চিনলেও এইরকম দুটি সভায় আমি উপস্থিত ছিলাম। মনে আছে একটির বিষয় ছিল ‘নারীমুক্তি’—হয়েছিল আশীর দশকের প্রথম দিকে। এখনকার কথা জানি না, তবে ১৯৯১ সালে তিনি মিউজিয়াম থেকে অবসর নেওয়ার পর ১৯৯২ সালেও ত্রৈমাসিক পত্রিকা ‘সেফ এনার্জি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট’-এর পক্ষ থেকে পরমাণু বিদ্যুৎ নিয়ে বিতর্ক সভা হয়েছে, যেখানে পক্ষের বক্তা হিসাবে বিজ্ঞানী বিকাশ সিংহ আর বিপক্ষে অধ্যাপক সুজয় বসু, অধ্যাপক দেবকুমার বসু ছিলেন।
আমার মনে হয় মাসখানেক সময়ে করে ফেলা যে কাজ তাঁর সাংগঠনিক ক্ষমতা বুঝিয়েছিল এবং তাঁকে কিছুটা খুশি করেছিল তা হল ২০১৯ সালের ২৭ সেপ্টেম্বরের ফ্রাইডেস ফর ফিউচার ক্লাইমেট মার্চ। গ্রেটা ঠুনবার্গ পৃথিবীময় ওই মিছিলের ডাক দিয়েছিল। কয়েকজন ছেলেমেয়ে এসে সমরদাকে ধরে বসল। সেই উদ্যোগে আমাকেও তিনি যুক্ত করে ফেললেন। মিছিল করলেই হবে না। বিষয়টা ছেলেমেয়েদের ভাল করে বোঝাতে হবে। নীলমণি মিত্র ষ্ট্রীটে দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটির অফিসের ঢাকা ছাদের উপর কয়েকটি মিটিং-ওয়ার্কশপ হল। মিছিল কি ভাবে হবে তার পরিকল্পনা এবং বিষয়টির প্রচার শুরু হল। সমরদা শতাধিক স্কুলের বাচ্চাদের মিছিলে আনার জন্য চিঠি দিলেন। ২৭ তারিখে নানা স্কুলের অসংখ্য ছেলেমেয়ে শিক্ষকদের নিয়ে বড় এবং রঙ্গিন মিছিল কলেজ স্ট্রীট থেকে সুবোধ মল্লিক স্কোয়ারে পৌঁছয়, শেষে ঘণ্টা খানেকের মিটিং হয়। সমরদার অনুরোধে মেধা পাটকরও দূর থেকে এসে মিছিলে যোগ দিয়েছিলেন।
সেই মিছিলের পর ঠিক হয়েছিল ছাত্রছাত্রী ও অন্যান্যদের বিষয়টা বোঝানোর জন্য আমরা স্লাইড প্রেজেন্টেশন তৈরি করব। বালিগঞ্জ সায়েন্স কলেজের পরিবেশ বিজ্ঞানের পুনর্জিত বসুকে বলা হল। দেখা গেল তাঁর প্রেজেন্টেশন অতি সুন্দর হলেও স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের বোঝার পক্ষে জন্য কঠিন। শেষ পর্যন্ত ঠিক হল গরফা হাইস্কুলে আমার তৈরি প্রেজেন্টেশন দেখানো হবে। তা কেমন হল বোঝার জন্য সমরদা সহ আরও চার গুণীজন ছাত্রদের সঙ্গে বেঞ্চে এসে বসলেন। সমরদার পরামর্শে প্রেজেন্টেশন কিছুটা ছোটো করা হয়েছিল। আমরা তেড়েফুঁড়ে এখানে-ওখানে, তা নিয়ে অনুষ্ঠান স্কুলে স্লাইড প্রেজেন্টেশন, ওয়ার্কশপ ইত্যাদি করেছিলাম। যাদবপুরের কয়েকজন ছাত্র ও গবেষকের এ বিষয়ে খুব উৎসাহ ছিল। লকডাউনের আগে পর্যন্ত এই নিয়ে সচেতনতা ও প্রচার অভিযান চলেছিল।
করোনার প্রথম ঢেউ থামলে, ফের কাজ কিছুটা শুরু হল। ২০২০-র অক্টোবরের শেষের দিকে ফের স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে মিছিলের কথা উঠল। সমরদা বললেন, মিছিল-টিছিল যেটা গতবার করা হয়েছিল সেটা আর সম্ভব না, তাছাড়া অত বাচ্চার দায়িত্ব কে নেবে! বরং স্কুলে স্কুলে এনিয়ে অনুষ্ঠান করা যায়। বললেন, উদ্যোগটা শুরু করছে কিন্তু হাওড়া বিজ্ঞান চেতনার প্রদীপ দাস। প্রায় ছ’সাতশো স্কুলকে জানানো হয়েছে। কালকে জানানো শেষ হয়েছে। এখন ছুটি পড়ে গেল, চার-পাঁচটা স্কুলের সাথে কথা বলেছি, হেডমাস্টার, হেডমিস্ট্রেসদের কাজের অন্ত থাকে না, পুজোটাতো শেষ হয়ে যাবে, তারইমধ্যে মেলটা দেখবে, যদি কিছু করে। দেখলাম এই ভাবে করলে অনেক বেশি লোকের কাছে পৌঁছনো যাবে। আমাদের যে স্কুলগুলো আছে তারা তো সব করবে বলে রেডি। দেখা যাক কি হয়।
কিন্তু করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে উদ্যোগটি কিছুটা চাপা পড়ে গেল। তখন থেকে চলল তাঁর লেখাপড়া এবং অন্যান্য কাজকর্ম। তখন তিনি ইয়ংম্যান অফ নাইনটি। ভোর থেকে সারাদিন ধরে কাজ করেন। একদিন বললেন, আমি এখন মেয়ের বাড়িতে আছি। আজকে এবং গতকাল এখান থেকে সকাল সাড়ে চারটের সময় গাড়ি চালিয়ে বাড়িতে গেছি। সকালবেলা ভিড় কম থাকে, নিজেই গাড়ি চালিয়ে যাই। ডেস্কটপ কম্পিউটারে কাজ করেছি একটা-দেড়টা অব্দি। তারপরে ড্রাইভার ওখান থেকে আমায় নিয়ে এসেছে। জামাই বলল, আপনি ওখান থেকে ওইসব পাঠিয়ে দিন, এখানে ল্যাপটপে বসে সব কিছু করতে পারবেন। ওমা, যেই না করতে গেছি কম্পোজে গিয়ে দেখি টাইপ হচ্ছে না। ঘণ্টা দুয়েক বসে চেষ্টা করেও টাইপ হল না। কেন যে হঠাৎ এইরকম হয়ে গেল, আই ডোন্ট নো। কাল আবার যাচ্ছি, সেসব ঠিক করতে ওখানে একজন খুব ভাল উড়িয়া ছেলে আসবে।
অসুস্থতাকে অগ্রাহ্য করে, মৃত্যুর দু’মাস আগেও, মে মাসের ঠা-ঠা গরমে ট্রেনে চড়ে পুরুলিয়া গেলেন। তাঁর মেধা ও দক্ষতা ছাড়াও এই বয়সে ওইরকম দায়বদ্ধতা এবং উদ্যোগের জন্য তাঁকে সবাই মনে মনে ভালোবাসায় ভরিয়ে ফেলেছিল। মৃত্যুর পর ৬৭টি নানা ধরনের সংগঠনের ডাকা ১২ অগস্টের স্মরণসভা সে কথাই বলছে। এমন মানুষ ক’টা মেলে এক জীবনে? তাই তাঁকে হারানোর আফসোস চিরকাল থেকেই যাবে।